#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(৪)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)
(৬)
সকালের খাবার খাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে বাড়ির বাকি সদস্যরা ডাইনিং রুমে আসতেই রিজওয়ান আর মেহরিনকে সেখানে বসে থাকতে দেখে অনেক অবাক হয়ে যায়। রাহেলা বেগম একপলক নিজের দুই ছেলে ও বউমাদের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই দৃষ্টি সরিয়ে হ*ন*হ*নি*য়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে অগ্রসর হয়। টেবিলের অন্যপাশে রিজওয়ান আর মেহরিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাহেলা রাগী স্বরে বললো…
—“এই ছোট*লোকের ঘরের ছোট*লোক মেয়ে-ছেলে! তোমাকে না সকালেই বলে দিলাম আজ সকালে তোমার আর তোমার সোহাগের স্বামীর খাবার খাওয়া বন্ধ! তারপরেও কোন সাহসে নিজের স্বামীকে নিয়ে আমার ডাইনিং টেবিলে এসে জায়গা দ*খ*ল করেছো হ্যা? সামান্যতম লজ্জাবোধ নেই নাকি তোমাদের মাঝে?”
মেহরিন ঘাড় বাঁকিয়ে রিজওয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। রিজওয়ান মেহরিনের ডান হাতের উপর নিজের বাম হাত রেখে আপন-মনে খাবার খেয়ে যাচ্ছে। রাহেলা যে কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই এতোগুলো কথা তাদের উদ্দেশ্য করে বললো তার কোনো প্রভাবই যেনো ওর উপর পরে নি। মুখশ্রীর ধরণ এমন করে রেখেছে যেনো এখানেই কিছুই হয় নি। সবকিছু স্বাভাবিক-ই আছে। রিজওয়ানের এমন আচারণে রাহেলার রাগের মাত্রা এবার যেনো আকাশ ছুঁই হয়ে দাঁড়ায়। পরক্ষণেই রাহেলা ওপাশ থেকে সরে রিজওয়ানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওর সামনে থেকে খাবারের প্লেটটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালে রিজওয়ান নিজের হাত আলগা করে দেয় মেহরিনের হাতের উপর থেকে। মেহরিন তৎক্ষণাৎ বসা অবস্থাতেই রাহেলার হাত ধরে তার কাজে বাঁধা প্রদান করে শ্বাশুড়ির মুখশ্রী পানে নিজের শান্ত দৃষ্টি স্থির করে। রাহেলা ক*ট-ম*ট করা চাহুনি নিয়ে তাকায় মেহরিনের দিকে। বউ-শ্বাশুড়ির মাঝে বসে রিজওয়ান তার প্লেটে অবশিষ্ট খাবার টুকু খেয়ে আঙুলে লেগে থাকা তরকারীর ঝোল গুলো চেটে-পুটে খেয়ে চেয়ারের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে আস্তে করে ঢেঁ*কুর তুলে বললো…..
—“একটু আগে কি যেনো বলছিলেন! এই ডাইনিং টেবিল আপনার? কিন্তু আমি যতোদূর জানি এই ডাইনিং টেবিল বানানো হয়েছে আমার দাদা মশাইয়ের আমলে। দাদা মশাই নিজ অর্থ ব্যয় করে এই টেবিল ও চেয়ারগুলো বানিয়ে নিয়েছিলেন কোনো এক সূক্ষ্ম কারিগরের থেকে। আপনি এ বাড়ির বউ সেই সূত্রে এই বাড়ির প্রতিটি জিনিসের উপর আপনার অধিকার অবশ্যই আছে। কিন্তু আমি তো এ বাড়ির বংশধরদের মাঝে একজন। তাই আপনার থেকেও আমার অধিকারের জায়গা এই বাড়িতে আরো বেশি মজবুত। কি তাই নয় কি? আর রইলো আমার স্ত্রীর এখানে বসে আমাকে খাবার পরিবেশন করার বিষয় ও আপনার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার মতো সাহস দেখানোর বিষয়! সেগুলোর ও যথাযথ উত্তর আমার কাছে আছে। আমি এ বাড়ির বংশধর হওয়ার সুবাদে আমার স্ত্রীর ও এ বাড়িতে সব রকম বিষয়ে সাহস দেখানোর অধিকার আছে। আপনার স্বামী আমার জন্মদানকারী পিতা হন। তিনি এখনও প্রবাসে থেকে নিজের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা রোজগার করছেন। আর তার রোজগারের টাকা তিনি দেশে পাঠালে তা দিয়েই পুরো সংসারের যাবতীয় খরচ সামলে যায়। এই যে টেবিল ভর্তি বাহারি রকমের সবজি, ডাল, ভাজি, মাছের তরকারী রান্না করা আছে। এগুলো সব আমার বাবার অর্থ ব্যয় করেই আনা হয়েছে। এখানে থাকা সব খাবারের উপর আমার ও আমার স্ত্রীর যথাযথ অধিকার আছে। সেখানে আপনি নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কে শুনি? কেনো শুনবো আমরা আপনার কথা? আমাদের ভরপোষণ যদি আপনি বা আপনার ছেলেরা সামলাতো তখন এই জোর খাটানো হয়তো আপনার শোভা পেতো। কিন্তু এমন তো নয়! তাহলে কোন সাহস আর কোন লজ্জায় আপনি আমাদের উপর জোর খাটানোর চেষ্টা করেন শুনি? এখন তো দেখছি আপনার নিজের মধ্যেই সামান্যতম লজ্জাবোধ নেই।”
রিজওয়ানের মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে মেহরিন ব্যতিত উপস্থিত সবার মুখই অবাকের পাশাপাশি পানসেটে বর্ণ ধারণ করেছে। মেহরিন অনেক পূর্বেই রাহেলার হাত ছেড়ে দিয়ে আবারও নিজের স্বামীর পাশে থাকা চেয়ারে বসে পড়েছে। রাজিবুল আর রফিকুল ও কোনো কথা বলার মতো শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না। রাহেলা এই প্রথম পরিবারের ছোট-বড় সকলের সামনে লজ্জায়, অ*প*মানে জর্জরিত হয়ে গিয়েছেন এমন অনুভব করছেন। শেফালির একমাত্র ছেলে ৯ বছর বয়সী শেহতাজ নিজের ছোট্ট হাতটি দিয়ে আলতো ভাবে মুখ চেপে ধরে হাসি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। ছোট হলেও শেহতাজ ভালো ও খারাপ ব্যবহারের মাঝে পার্থক্য বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে শিখে গিয়েছে। নিজের ছোট চাচ্চু আর চাচী মাকে সবসময় নিজের মা-চাচী-দাদীর কাছে অ*প*মান মূলক কথা শুনতে দেখতে শেহতাজের কখনই ভালো লাগতো না। সবার সামনে বাবা-মায়ের শা*স*ণের ভ*য়ে কিছুই বলতে বা করতে পারতো না সে। তবে সবার আড়ালে নিজের চাচীমার কাছে গিয়ে ঠিকই তার অশ্রুসিক্ত নয়ন থেকে অশ্রু মুছে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করতো। আজ প্রথম নিজের ছোট চাচ্চুকে তার দাদীর ও বাড়ির বাকি সদস্যদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার মতো কথা বলতে দেখে ভিষণ আনন্দ অনুভব হচ্ছে শেহতাজের। শেহতাজের পাশেই ঊর্মিলার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে ঊষা নিজের বড় আকৃতির চোখ জোড়া নিয়ে ওদের সবার দিকে তাকিয়ে আছে। এতো জটিল ও কঠিন কথার বেশির ভাগই যে তার কাছে বোধগম্য হয় নি তা তার মায়াবী ছোট্ট মুখশ্রী দেখলেই বোঝা সম্ভব।
কিছুসময় ধরে পুরো বাড়ি জুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে। নীরবতার সেই দেওয়াল ভেঙে যায় রাহেলার কান্নার শব্দে। সবার দৃষ্টি স্থির হয় তার উপর। রাহেলা ধ*প করে মেঝের উপর বসে একহাতে কপাল চা*প*ড়া*তে চা*প*ড়া*তে ন্য*কা কান্না করতে করতে বললেন…..
—“হায় হায় রে এ আমার কি হলো! আমার কপালে এমনও দিন দেখা লেখা ছিলো ভাবতেই আমার কলিজা পু*ড়ে যাচ্ছে! হায় হায় রে! আমার দু-দু’টো সামর্থ্যবান যোগ্য ছেলে সামনে থাকতেও সতীনের ছেলের মুখে এতো এতো ক*টু কথা শুনতে হলো আমায়! তোদের আমি কখনও পেটে ধরেছিলাম বলে তো আমার মনে হয় না। যদি তাই হতো তাহলে নাড়ির টানে হলেও এতোসময় ধরে চুপচাপ থেকে নিজেদের জন্মদাত্রী মাকে অ*প*মা*নি*ত হতে দেখতে পারতি না। কা*পুরুষ জন্ম দিয়েছি আমি। সন্তান নামে ক*ল*ঙ্ক তোরা।”
নিজের মায়ের মুখে এমন কথা শুনে রাজিবুল আর রফিকুল এর শরীরের ভিতরে শীতল র*ক্ত কণা যেনো রাগে, ক্ষো*ভে টগ-বগ করে ফুঁ*ট*তে শুরু করে। রাজিবুল রাগ নিয়ে রিজওয়ানের হাতের ডানপার্শে এসে দাঁড়িয়ে একহাতে ওর গেন্ঞ্জির কলার্ট চে*পে ধরে টেনে বসা অবস্থা থেকে দাঁড় করিয়ে ডাইনিং এর জায়গা থেকে কিছুটা দূরে এনে দাঁড় করিয়ে মুখের উপর একবার স্ব*জোড়ে ঘুঁ*ষি প্রয়োগ করে। রাজিবুলের প্রয়োগ করা ঘুঁ*ষি*র আ*ঘা*তে রিজওয়ান এর ঠোঁটের একপাশ থেকে র*ক্ত ঝড়তে শুরু করে। শেহতাজ আর ঊষা এতে কিছুটা ভ*য় পেয়ে যায়। শেফালি, ঊর্মিলা আর রফিকুল ওদের মুখ দিয়ে ‘বেশ হয়েছে’ শব্দ উচ্চারণ করে ঠোঁটে পৈ*শা*চি*ক হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে। রাহেলা দুই হাতে নিজের দু’চোখের কর্ণিশে কেবল জমে আসা অশ্রু টুকু মুছে নিয়ে বাঁ*কা হাসি দেয়। মেহরিন দ্রুততার সাথে চেয়ার ছেড়ে উঠে রাজিবুল আর রিজওয়ানের কাছে এসে দাঁড়িয়ে কিছুটা জোড়ের সাথে বললো….
—“ছাড়ুন আমার স্বামীকে। আমার স্বামীর শরীরে আঘাত করতেই আপনি সুপুরুষে পরিণত হবেন না মি.রাজিবুল।”
মেহরিনের এরূপ কথা শুনে রাজিবুল সহ সবাই আবারও অবাক ও রাগের পাশাপাশি কিছুটা বি*র*ক্ত ও হয়। রাজিবুল রিজওয়ানের কলার্ট ছেড়ে দিয়ে অত্যন্ত রাগ নিয়ে মেহরিনকে থা*প্প*ড় দেওয়ার জন্য উদ্দ্যত হলে সঙ্গে সঙ্গে রিজওয়ান রাজিবুলের হাত ধরে মো*চ*ড় দিয়ে ঘুরিয়ে ওর পিঠের সাথে শক্ত ভাবে চেপে ধরে কঠিন স্বরে বললো…
—“আমাকে মে*রে র*ক্তা*ক্ত করে দিয়েছিস কিছু বলি নি। কিন্তু আমার স্ত্রীর শরীরে আ*ঘা*ত করার জন্য উদ্দ্যত হওয়ার সাহস দেখালি কি করে! এতো যাবৎ ধরে চুপ থেকে তোদের সবার সব অ*ন্যা*য় সহ্য করে গিয়েছি জন্য একেবারে মাথায় চড়ে বসেছিস তোরা তাই না!”
মো*চ*ড়ে*র ব্য*থা*য় রাজিবুল মুখ দিয়ে আর্ত*নাদ বের করতে শুরু করলো। রাহেলা চিল্লিয়ে বললেন…..
—“রফিক বাপ আমার তোর ভাইরে বাঁচা এই জা*লি*মে*র হাত থেকে। আমার সোনার টুকরো ছেলের হাতটা ভে*ঙে ফেললো রে।”
মায়ের কথা শুনে রফিকুল রাগ নিয়ে রিজওয়ান আর রাজিবুলের দিকে অগ্রসর হতে নিলে রিজওয়ান আরো শক্ত করে রাজিবুলের হাত চেপে ধরে বললো….
—“আর এক পা ও যদি সামনের দিকে বাড়িয়েছিস তুই তাহলে সত্যি সত্যিই তোর ভাইয়ের হাত তার শরীর থেকে একেবারের জন্য আলাদা করার ব্যবস্থা করবো আমি।”
রিজওয়ানের এমন হু*ম*কি*তে থেমে যায় রফিকুল। শেফালি আর ঊর্মিলার মাঝে ভ*য়ে*য় সৃষ্টি হয়েছে কিছুটা। এই প্রথম রিজওয়ানের মতো শান্ত ছেলেকে এতোটা ভ*য়ং*কর রূপে দেখার বিষয়টা হজম করে নেওয়া ভিষণ বে*গ দায়ক হয়ে যাচ্ছে।
#চলবে ইনশাআল্লাহ………