আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ পর্ব-০৩

0
68

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(৩)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(৪)
মেহরিনের হাত ধরে রিজওয়ান ওকে সোজা নিজেদের রুমে নিয়ে এসে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ওর পায়ের কাছে দু’হাটু ভাঁজ করে বসে। রিজওয়ানের এমন কাজে মেহরিন কিছু বলতে নিলে রিজওয়ান মেহরিনের ঠোঁটের উপর নিজের ডান হাতের তর্জনী আঙুল ঠেকিয়ে শান্ত স্বরে বললো….

—“চুপ করে বসো ওখানেই। নড়বে না, আর মুখ দিয়ে কোনো শব্দ তো একদম-ই উচ্চারণ করবে না।”

মেহরিন নিরব হয়ে যায়। রিজওয়ান মেহরিনের ঠোঁটের উপর থেকে নিজের আঙুল সরিয়ে ওর দৃষ্টির উপর নিজের দৃষ্টি স্থির করে আবারও বললো….

—“আমাকে ক্ষমা করে দাও বউ।”

মেহরিন দ্রুততার স্বরে বললো…
—“এভাবে ক্ষমাই চাইছো কেনো তুমি? তুমি তো কোনো অ*ন্যায় করো নি।”

—“সবথেকে বড় অ*ন্যায় আমিই করেছি বউ। আর সেটা আমি খুব ভালো ভাবেই আজ উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমার বাবা স্বয়ং তোমাকে আমার জন্য পছন্দ করেছিলেন। তোমার মা-বাবা সমতুল্য মামা-মামী আমার উপর ভরসা করে তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আল্লাহ ও দশজন মানুষকে সাক্ষী রেখে আমরা বৈবাহিক বন্ধনে আবব্ধ হয়েছিলাম। আর একজন স্বামী হিসেবে আমার প্রধান দায়িত্বগুলো হলো তোমার খেয়াল রাখা, আল্লাহর উছিলা হিসেবে তোমাকে সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করা, তোমাকে সম্মান করা ও বাহিরের সকলের সামনে তোমার সম্মান অটুঁট রাখা। তোমার ভরণপোষণের দায়ভার বহন করা, তোমার ইচ্ছেগুলো পূরণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করা। আর এই শতভাগ দায়িত্ব গুলোর ভিতর আমি ৯৫% দায়িত্ব পালনেই ব্য*র্থ হয়েছি। আমি তো তোমার যোগ্য স্বামী হয়ে উঠতে পারি নি বউ। এ নিয়ে তোমার ভিতর নিশ্চয়ই অনেক খারাপ লাগা, অভিমান জমে আছে বলো!”

মেহরিন ওর ঠোঁটে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললো….
—“শুধু ঐসব করলেই যে যোগ্য স্বামী হওয়া যায় তোমার এই ধারণা যে ভুল মহাশয়।”

রিজওয়ান কিছুটা অবাক স্বরে বললো…
—“মানে!”

—“এই যে তুমি বিয়ের পর থেকে এখন প্রায় ৪ মাস হতে চললো এই পুরো সময়টা ধরে আমাকে নিজের সবটা উজার করে ভালোবাসা দিয়ে এসেছো! প্রতিরাতে তোমার উন্মুক্ত লোমশ বুকে আমায় মাথা রেখে নিজের বাহুডোরে আগলে নিয়ে পরম শান্তিতে ঘুমাতে দিয়েছো! আমাকে না খাইয়ে কোনো এক বেলাও নিজে আগে খাও নি! সারাদিন কাজ করার পর ক্লান্তিতে যখন আমার মাথা ধরে যায় তখন আমি পুরোপুরি ভাবে ঘুমিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমার মাথা টিপে দিয়েছো! ঘোর জ্বরে যখন আমি আবোল-তাবোল ব*ক*তাম তখন খুব মনোযোগ সহকারে আমার বলা প্রতিটি কথা তুমি শুনেছো! আমার সর্ব শরীর যখন শীতে থ*র-থ*র করে কাঁপতো তখন তোমার শরীরের উষ্ণতা বিলিয়ে দিয়ে আমার শরীর উষ্ণ করেছো! আমার শরীরের কোনো অংশের ব্য*থা*য় যখন আমি নিরব হয়ে শুয়ে থাকতাম তখন তুমি তা আপনা-আপনিই বুঝে নিয়ে মাসাজ করে দিয়েছো! এতোকিছু করার পরেও কি করে তুমি নিজেকে অ*যোগ্য স্বামী বলে মনে করো শুনি? ক’জন নারী পায় তোমার মতো একজন ভালোবাসাময় যত্নশীল স্বামী? অনেক তো শোনা যায়…! ঘরে লক্ষ-কোটি টাকা আছে, চাওয়া মাত্র যেকোনো জিনিস নিজের সামনে হাজির করা সম্ভব এমনও কিছু দম্পতিদের বি*চ্ছে*দ হয়ে যাচ্ছে! এই বি*চ্ছে*দ গুলোর পিছনে আসল কারণ কি বলো তো? টাকা দিয়ে কখনও প্রকৃত সুখ কেনা যায় না। যদি দু’জন নারী-পুরুষের মাঝে প্রকৃত ভালোবাসা থাকে তাহলে তারা দিন এনে দিন খেয়ে কুঁড়েঘরে থাকলেও সুখে-শান্তিতে দিন পার করতে পারবে। আমার চাহিদা, ইচ্ছেগুলো ভিষণই সামান্য জানো! ছোটবেলায় সবেমাত্র বুঝতে শিখেছি তখন একসাথে একটা দূ*র্ঘট*নায় নিজের বাবা-মা’কে চিরতরের জন্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। তখন আমার কাছে পুরো দুনিয়া বি*ষা*ক্ত হয়ে যেতো যদি না আমার দিকে আমার মামা-মামী ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিতেন। আমার মামার তো ছোট্ট একটা চা-পানের দোকান ছিলো। তিনি দৈনিক স্বল্প অর্থ আয় করতেন। তবুও জানো আমাদের তিন সদস্যের সেই ছোট্ট পরিবারে কোনো অভাব কিংবা ক*ষ্ট ছিলো না। বয়স ১০ পেরোনোর পূর্ব পর্যন্ত মামা আমাকে নিজের বুকে আগলে নিয়ে ঘুম পাড়াতেন প্রতিরাতে। আর ১০ পেরোনোর পর থেকে সেই দায়িত্ব মামী সাদরে গ্রহন করেছিলেন। ঐ দু’টো মানুষের মুখশ্রী পানে তাকালে আমি আমার মরহুম মা-বাবার মুখশ্রী ভাসমান অবস্থায় দেখতে পারতাম। কি যে শান্তি কাজ করতো সবসময় হৃদয়জুরে তা ভাষায় বলে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তোমার পরিবারের মানুষগুলোর ভিতর বাবা আর দাদীমা ব্যতিত কেওই আমার এ বাড়ির বউ হওয়া নিয়ে যে খুশি নন তা বুঝতে আমার খুব সময় লাগে নি। গি*র*গি*টি*র মতো তাঁদেরকে নিজের চরিত্রের রং পরিবর্তন করতে দেখে ও প্রতিমূহূর্তে ক*টা*ক্ষ করে কথা শুনাতে দেখে প্রথমে হৃদয় চেঁ*রা য*ন্ত্র*ণা হতো এই কথা আমি অ*স্বীকার করবো না আজ। তবে এসবের সাথে ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করেছিলাম বটে। কিন্তু মাঝেমধ্যে নিজের এই চেষ্টা আর সহ্য করার মতো শক্তি যুগিয়ে উঠতে পারে না। অবাধ্য চোখজোড়া তাঁদের বাঁধ ভে*ঙে নোনাজলের বৃষ্টি ঝরিয়েই কেবল দম নেয়।”

এই বলে মেহরিন শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে। রিজওয়ান মুগ্ধ দৃষ্টিতে মেহরিনের দিকে তাকিয়ে ওরা বলা সম্পূর্ণ কথাগুলো শুনলো। মেহরিনের বলা শেষ কথাগুলো রিজওয়ানের বুকে গিয়ে আ*ঘা*ত করে বসে। রিজওয়ান মেহরিনের দু’হাত নিজের দু’হাতের বাঁধনে আ*বদ্ধ করে বললো……

—“আমাকে ঘিরে তোমার মনের মাঝে অন্তত একটা বিষয় নিয়ে খারাপ লাগা আর অভিমান জমাট বেঁধে আছে অবশ্যই।”

মেহরিন রিজওয়ানের উপর নিজের শান্ত দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে। রিজওয়ান মেহরিনের হাতের উপরিভাগে নিজের কপাল ঠেকিয়ে ওর কোলের ভিতর নিজের মুখশ্রী আলতো ভাবে গুঁজে দিয়ে আবারও বললো…..

—“২মাস আগে যখন তোমার মামা-মামী তাদের সাধ্যানুযায়ী জামা-কাপড় ও খাবার নিয়ে এখানে এসেছিলেন তখন পরিবারের সবাই মিলে তাঁদের যাচ্ছে তাই বলে অ*প*মান করেছিলো। সেদিন তুমি ছলছল দৃষ্টি নিয়ে কেবল আমারই দিকে চেয়ে ছিলে। আশা নিয়ে ছিলে হয়তো আমি তাদের ক*ষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব করতে অন্তত দু’টো প্র*তি*বাদ মূলক কথা বলে ওদের সবার মুখ বন্ধ করে দিবো। কিন্তু তোমার আশা সেদিন অপূর্ণ রয়ে গিয়েছে। আমার নিরবতা আর পরমুহূর্তে নিরবে স্থান ত্যগ করা তোমার মনের ভিতর যে কড়া ভাবে দা*গ কেটেছিলো তা আমি বুঝতে পেরেছি খুব ভালো ভাবেই। এই য*ন্ত্র*ণা যে আমাকে প্রতিমূহূর্তে দ*গ্ধ করে দিয়ে যাচ্ছে বউ। এ থেকে আমি এবার মুক্তি পেতে চাই। আমাকে সুরুপুষ হতে সাহায্য করবে তো তুমি বলো! আমি তোমাকে আর তোমার মামা-মামীকে আর কখনও অ*সম্মানিত হতে দিবো না। নিজেকে পুরোপুরি ভাবে সবদিক দিয়ে তোমার যোগ্য করে তুলে দেখাবো। তোমার সকল ভরণপোষণের দায়ভার বহন করবো। কেবল ভালোবাসার দিক থেকে নয় আর্থিক স্বচ্ছলতার দিক থেকেও তোমাকে সুখের মুখ দেখাবো। সকল অ*ন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উচিত জবাব দিয়ে অ*হং*কারীদের মুখ বন্ধ করে দিবো। থাকবে তো বউ তুমি আমার পাশে!”

মেহরিন এর চোখ খুশির নোনাজলে টইটম্বুর হয়ে এসেছে ইতিমধ্যেই। মেহরিন নিজের দু’হাত রিজওয়ানের দু’গালে রেখে ওর মাথা নিজের কোলের উপর থেকে তুলে ধরে। রিজওয়ানের দু’চোখ জুরে নিষ্পাপ ও অনুতপ্ততার ছাপ ফুটে আছে। মেহরিন তা দেখতে পারছে। মেহরিন কিছুটা নিচু হয়ে রিজওয়ানের কপালে একবার ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে বললো….

—“শেষ নিঃশ্বাস না পড়া পর্যন্ত আমি তোমার পাশে তোমার ছায়াসঙ্গিনী ও জীবনসঙ্গিনী হয়ে থাকবো ইনশাআল্লাহ।”

রিজওয়ান মেহরিনের হাতের তালুতে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে বললো….
—“আজ থেকে মা-রুমি কিংবা ভাবীদের ভিতর কেও যদি তোমাকে ক*টা*ক্ষ করে একটা কথাও শোনায় তাহলে কোনোরূপ ভ*য় বা চিন্তা না করে নিজের মতো করে প্রতি*বাদ করবা তুমি। মনে রেখো এই বাড়িতে ওদের সবার যেমন অধিকার আছে সমান অধিকার তোমারও আছে। কেও যদি তোমার অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করে তবে তাদের হাত ভে*ঙে গুঁ*ড়ি*য়ে দিতে দু’বার ভাববে না তুমি। আজ এই মূহূর্ত থেকে না তুমি কারোর অ*ন্যায় সহ্য করবা আর না আমি সহ্য করবো। আল্লাহর রহমত হলে খুব শীঘ্রই আমার কোথাও না কোথাও একটা স্বল্প আয়ের হলেও চাকরি হয়েই যাবে দেখো। তখন আমরা পুরোপুরি ভাবে স্বাধীন হয়ে যাবো। আমাদের উপর তখন ভুলেও কেও নিজেদের ক্ষ*মতা খাঁ*টা*নোর চেষ্টাও করতে আসবে না৷”

মেহরিন ওর দু’চোখ দিয়ে খুশির নোনাজল ফেলতে ফেলতে হাসিমুখে বললো…..

—“ইনশাআল্লাহ।”

রিজওয়ান বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মেহরিনকে দু’হাতে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে।

(৫)
নিজ রুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধছে শেফালির স্বামী রাজিবুল। সেইসময় শেফালি রাগে গ*জ-গ*জ করতে করতে রুমে প্রবেশ করে ধ*প করে বিছানায় বসে কিছুটা উচ্চস্বরে বললো….

—“সারাদিন শুধু অফিস আর কাজ নিয়েই পড়ে থাকো। বাড়িতে কি কি হচ্ছে না হচ্ছে সে খেয়াল তো রাখার সময় তোমার হাতে নেই।”

রাজিবুল নিজের কাজ করতে করতেই বললো….
—“সকাল সকাল আবার কি হলো!”

—“তোমার সৎ ছোট ভাই আজ তোমাকে আর রফিকুল ভাইকে খোঁ*টা দিয়ে যতোগুলো কথা শুনালো বাপরে বাপ।”

—“আরে হয়েছে টা কি সেটা তো বলবে নাকি!”

—“তোমার ছেলের তো রোজ সকালে দুধ দিয়ে হরলিক্স বানিয়ে খাওয়ার অভ্যাস। মেহরিন-ই প্রতিদিন সেই দায়িত্ব পালন করে। আজ বেশ বেলা হয়ে যাওয়ায় আমি মেহরিনকে ভালো ভাবেই বললাম সে যেনো হরলিক্স বানিয়ে শেহতাজকে নিয়ে আসে। ওমা সেইসময় কোথা থেকে রিজওয়ান এসে হাজির হয়। আর বলে ‘আমার স্ত্রী তো তোমাদের দাসী-বা*ন্দি নয় যে তোমাদের ফাই-ফরমাস খাঁটবে। নিজের ছেলের যখন হরলিক্স খাওয়ার অভ্যাস তখন নিজেই বানিয়ে খাওয়াও। যদি নিজে বানাতে না পারো তাহলে একজন কাজের লোক রাখো। তোমাদের স্বামীরা তো করে স্বল্প আয়ের চাকরি। বাবা আয় না করলে তোমরা নিজেদের তিনবেলার খাবারটুকুও সেই আয় দিয়ে সামলাতে পারতে না, সংসারের বাকি খরচ সামলানোর হিসাব তো দূরের বিষয়।’ এমন আরো অনেক তু*চ্ছ-তা*চ্ছি*ল্য করে কথা শুনালো গো তোমাদের দু’জনকে। আমার তো রাগে শরীর জ্ব*ল*ছিলো ওর বলা কথা গুলো শুনে। এগুলো কি মানা যায় নাকি! তুমি কি এর কোনো বিহীত করবে না রাজিব?”

রাজিবুল ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে নিজের মানিব্যাগ আর ঘড়িটা নিয়ে বললো…..

—“এখন অফিসের জন্য লেইট হয়ে যাচ্ছে। খেতে দাও। রাতে বাসায় ফিরে এর একটা উপযুক্ত বিহীত অবশ্যই করবো।”

এই বলে রাজিবুল চেয়ারের উপর থেকে নিজের ব্যগটা কাঁধে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। শেফালি বসা অবস্থা থেকে উঠে বাঁকা হেসে বললো….

—“রাতে একটা বড়-সড় জমজমাট নাটক হবে তাহলে।”

এই বলে শেফালিও রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।

#চলবে ইনশাআল্লাহ………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে