#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(২০)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)
(৪৬)
নিজরুমে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে নিজের নাকের সাথে বরফের থলি চেপে ধরে আছে রাজিবুল। মুখশ্রী জুড়ে রাগের ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। তার চারপাশে বসে আছে রফিকুল, ঊর্মিলা, শেফালি ও রাহেলা বেগম। রাজিবুল রাগী স্বরে বললো….
—“তোমরা এতোজন মানুষ থাকতেও রিজওয়ান আমাকে পর পর ২দিন আ*ঘা*ত করতে পারলো। তোমাদের যদি আমি আমার বিপদের সময়েই পাশে না পাই তাহলে তোমাদের মতো প্রিয়জন আমার কাছে থাকা না থাকা তো সমান। আ*ঘা*ত পাওয়ার পর সেই আ*ঘা*তে*র জ্বা*লা বাড়াতেই যে তোমরা আমার কাছে থাকো সেটাও বুঝতে আমার বাকি নেই।”
রফিকুল বললো….
—“দেখ ভাই, তুই আমাদের ভুল বুঝছিস।”
—“আমি ভুল কিছুই বুঝছি না। আজ এই মুহূর্ত থেকে তোর আর আম্মার রাস্তা আলাদা আর আমার রাস্তা আলাদা। আমার কোনো পরিকল্পনায় আমি তোদের সঙ্গ পেতে চাই না। এক্ষুণি আমার রুম থেকে বেড়িয়ে যাবি তোরা সবাই। আম্মা আপনিও যান।”
রাহেলা বেগম কোনো প্রতিত্তুর না করে নিরবে রাজিবুলের কথা মেনে নিয়ে স্থান ত্যগ করলেন। রাজিবুলের এমন আচারণ ঊর্মিলার মোটেও পছন্দ হয় নি। তাই সে রফিকুলকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওর হাত ধরে টানতে টানতে বাহিরে চলে যায়। শেফালি শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে বললো….
—“রাগের মাথায় অতিরিক্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে বলে মনে হচ্ছে না তোমার!”
রাজিবুল শেফালির দিকে ক্ষি*প্ত নজরে তাকিয়ে বললো…
—“এই সিদ্ধান্ত আমার আরো আগেই নেওয়া উচিত ছিলো। এখন ওদের কাউকে নিয়ে আমার কাছে সাফাই গাইতে আসবে না তুমি। তাহলে কিন্তু ফল মোটেও ভালো হবে না বলে দিলাম।”
শেফালি আর কিছু না বলে বসা থেকে উঠে রুমের বাহিরে চলে যায়। রাজিবুল নিজমনে বিরবিরিয়ে বললো…
—“খুব শীঘ্রই তোর নাম ও নিশান এই পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরের জন্য মুছে ফেলার ব্যবস্থা করবো আমি রিজওয়ান। এই রাজিবুলের শরীরে আ*ঘা*ত করার ফল কতোটা ভ*য়া*ব*হ হতে পারে তা সময় তোকে বুঝিয়ে দিবে।”
(৪৭)
আজ শুক্রবার…..
আরহামের বাসায় দুপুরবেলার দাওয়াত উপলক্ষে রিজওয়ান আর মেহরিন তৈরি হয়ে নিচে আসতেই রুমির সাথে দেখা হয়ে যায় ওদের। আঙিনায় তখন ৪র্থ কোনো ব্যক্তি উপস্থিত ছিলো না। মেহরিন রুমির সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললো….
—“কি ব্যপার রুমি, তুমি এই সময়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছো যে!”
—“ভাবী তোমরা দু’জনেই বাহিরে যাচ্ছো মনে হচ্ছে!”
—“হ্যা, তোমার ভাইয়ার বস তার বাসায় দাওয়াত দিয়েছেন আজ আমাদের। সেখানেই যাচ্ছি।”
—“ভাবী বাড়িতে আজ ওরা সবাই আছে। তোমাদের অবর্তমানে আমার সাথে ওরা যদি কোনো খারাপ আচারণ করে বা বড় ভাইয়া রিজওয়ান ভাইয়ের মা*ই*রের ব*দ*লা নিতে আমাকে আঘাত করে তখন কি হবে! আমার যে ভিষণ ভ*য় করছে।”
রুমির মুখে এরূপ কথা শুনে রিজওয়ান ওর দিকে শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বললো…
—“আমরা না আসা পর্যন্ত পুরো সময়টা তুই আমাদের রুমে থাকতে পারিস। আর হ্যা রুমের দরজা ভিতর থেকে আটকে দিস। ওরা কেউ আমাদের রুমে যাবে না। তোকে খুজতে তোর রুমে গিয়েও তোকে না পেলে বুঝবে তুই বাড়িতে নেই। তুই কোনো অ*ন্যা*য় করিস নি। তাই তোর ওদের ভ*য় পাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসছে না।”
রিজওয়ানের কথায় রুমি কিছুটা সন্তুষ্ট বোধ করে। অতঃপর সে নিরবে সিঁড়ি বেয়ে উপরে রিজওয়ানদের রুমের ভিতরে প্রবেশ করে দরজা ভিতর থেকে আটকে দেয়। রিজওয়ান আর মেহরিন পুরো দৃশ্যটা দেখে বাসা থেকে বের হয়।
বাসার সামনেই ওদের নিয়ে যাওয়ার জন্য পূর্ব থেকেই গাড়ি দাঁড় করানো ছিলো। রিজওয়ান ও মেহরিন গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি তার আপন গতিতে চলতে শুরু করে। প্রায় ৪৫ মিনিট পর গাড়িটি চৌধুরী মেনশনের মূল গেইট পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। মেহরিনের সিটের পাশের জানালা খোলা থাকায় সে বাহিরের দিকে দৃষ্টি স্থির করে। গাড়িটি চলছে যেই রাস্তা দিয়ে তার দু’পাশে রং-বেরঙের ফুলের গাছ লাগানো রয়েছে। ফুলগুলো নিজ নিজ রূপে সজ্জিত হয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে মনখুলে হাসছে যেনো। কিয়ৎক্ষণ পর গাড়ি থেমে গেলে মেহরিন আর রিজওয়ান গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। এই অল্প সময়েই বাহ্যিক পরিবেশটা মেহরিনকে মুগ্ধ করে দিয়েছে। রিজওয়ান আর মেহরিনের আসার খবর পেয়ে আরহাম ও আমজাদ নিজরুম থেকে বেড়িয়ে মূল দরজার সামনে এসে দাঁড়ান। আরহাম হাসিমুখে বললো…
—“রিজওয়ান সাহেব, আপনি আমার দাওয়াত কবুল করেছেন দেখে ভিষণ ভালো লাগলো। ভিতরে আসুন আপনারা।”
আমজাদ হাসিমুখে বললেন…
—“তোমাদের দু’জনের সাথে পুনরায় সাক্ষাৎ করার ভিষণ ইচ্ছে ছিলো আমার। কিন্তু ব্যস্ততার জন্য সময় করে উঠতে পারি নি। তোমাদের এখানে আসার বিষয়ে আরহাম আমাকে পূর্ব থেকে অবগতও করে নি। ওর তরফ থেকে পাওয়া এই সারপ্রাইজটি আমার কাছে বিশেষ হয়ে থাকবে সবসময়।”
মেহরিন আর রিজওয়ান হাসিমুখে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। অতঃপর ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে পরে ওরা সবাই। মেহরিন বললো……
—“চাচা, আরফাকে দেখছি না যে! ও কোথায়? ওকেও ডাকুন। মেয়েটা ভাড়ি মিষ্টি। ১ম দিন ওর সাথে ঠিকভাবে কথাও বলা হয় নি আমাদের।”
আমজাদ কিছু বলার পূর্বেই আরহাম বললো…..
—“আরফা ওর রুমে আছে। আর ওকে এখানে না আনাই ভালো।”
মেহরিনের হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রীতে মলিনতার ছাপ স্পষ্ট হয়। প্রথম দিন আমজাদ তাদের আরফার সাথে আরহামের করে যাওয়া আচারণ সম্পর্কে অবগত করেছিলো। সেই কারণেই যে তিনি এখন এখানে আরফাকে উপস্থিত করতে চাচ্ছেন না তা মেহরিনের বুঝতে বাকি রয় না।
(৪৮)
নিজরুমে বিছানায় বসে আছে আরফা। আজও তার হাতে তার মা সানজিদের ছবি রাখা। আরফার দৃষ্টি তার মায়ের ছবির উপরেই স্থির। আরফা ওর মায়ের ছবিতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো….
—“আর কিছুসময়ের-ই অপেক্ষা মাম্মাম। তারপর তোমাকে বাবাইয়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে তোমার জায়গায় আমি স্টার হয়ে যাবো। মাম্মাম তুমি বাবাইকে পেয়ে আমাকে ভুলে যেও না যেনো। বাবাইকে বলিও আমি তোমাকে আর বাবাই অনেক ভালোবাসি। আমি যখন স্টার হয়ে যাবো প্রতিরাতে আমাকে দেখার জন্য তোমরা ছাদে এসো কিন্তু। তোমাদের একসাথে খুশি খুশি সময় কাটাতে দেখে তখন আমার কি যে আনন্দ হবে।”
আরফা হাসতে হাসতে কথাগুলো বলছিলো তবুও ওর দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় নোনাজল গড়িয়ে পড়ছিলো।
(৪৯)
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে বাগানের মাঝ বরাবর থাকা বসার স্থানে বসে আছে রিজওয়ান, মেহরিন, আরহাম ও আমজাদ। গল্পের মাঝে থাকা অবস্থাতেও মেহরিনের মন আজ আরফার জন্য অজানা কারণে টানছে ভিষণ ভাবে। আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত একপলকের জন্যও সে আরফাকে দেখতে পায় নি। বেশ কিছুটা সময় এভাবেই পেরিয়ে যায়। হঠাৎ আরফার ‘বাবাই’ বলে ডাকার আওয়াজ ভেসে আসলে ওদের সকলের দৃষ্টি যায় তিন তলার বেলকনির কার্ণিশে দাঁড়িয়ে থাকা আরফার দিকে। এই প্রথম আরফার কন্ঠে আরহাম ‘বাবাই’ ডাক শুনতে পেলো। সকলে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে বেলকনির নিচে এসে দাঁড়ায়। আমজাদ বললেন…..
—“দিদিভাই, ওখান থেকে সরে দাঁড়াও তুমি। ঐ জায়গাটা ভিষণ পিচ্ছিল। একটু এদিক-সেদিক হলে পরে যাবে। পিছিয়ে যাও দিদিভাই।”
আমজাদের কথা আরফার কান পর্যন্ত পৌঁছালেও ওর উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না তা। আরফা হাসিমুখে বললো…..
—“বাবাই, তুমি মাম্মামকে অনেক ভালোবাসো আমি জানি। কিন্তু মাম্মামের স্টার হয়ে যাওয়ার জন্য তুমি আমাকে দায়ী করো এ কারণে আমার ভিষণ কষ্ট হয় জানো!”
মেহরিন বললো….
—“আরফা, সোনা মামনি তুমি পিছিয়ে যাও। তোমার বাবাই জানে তুমি দায়ী নও তোমার মাম্মামের স্টার হয়ে যাওয়ার জন্য। তুমি পরে যাবে মা, পিছিয়ে যাও।”
মেহরিনের কথাও আরফার উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। আরফা বললো….
—“স্কুলে যাওয়ার পর আমার ফ্রেন্ডসের বাবাই ও মাম্মাদের দেখি তারা ওদের কোলে নিয়ে অনেক আদর করে। কিন্তু আমি তো কখনও আমার মাম্মামের আদর পাই নি। আর না কখনও তোমার আদর পেয়েছি বাবাই। জানো বাবাই আমি আল্লাহর কাছেও প্রার্থনা করেছিলাম যেনো তিনি আমার জন্য তোমার মনে একটু হলেও ভালোবাসার সৃষ্টি করেন। কিন্তু তুমি যেমন আমাকে পঁচা বেবি মনে করো তেমনি আল্লাহও আমাকে পঁচা বেবি মনে করেন। তাই তো তিনি আমার প্রার্থনা কবুল করেন নি।”
মেহরিন রিজওয়ানকে উদ্দেশ্য করে বললো…
—“তুমি উপরে যাও। আরফাকে ওখান থেকে সরিয়ে নাও। ও ছোট মানুষ। ওর মনে বাজে ভাবে ইফেক্ট করেছে ওর বাবাইয়ের এই দূরত্ব ও খারাপ আচারণ। ও খারাপ কিছু করে ফেলতে পারে। যাও গিয়ে আটকাও ওকে।”
—“হ্যা, হ্যা আমি যাচ্ছি।”
এই বলে রিজওয়ান আরফার কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ির ভিতরে যেতে দৌড় দেয়। মেহরিন আরফাকে বললো….
—“আরফা, মামনি পিছিয়ে যাও। এমন ভাবে কর্নিশে এসে দাঁড়াতে হয় না। আমরা তোমার বাবাইকে খুব করে বকা দিবো। দেখবে এখন থেকে তোমার বাবাই তোমাকে অনেক আদর করবে।”
আরহাম শক্ত পাথরের ন্যয় দাঁড়িয়ে আছে। বোধশক্তি যেনো হারিয়ে ফেলেছে সে। তার ৫ বছর বয়সে মেয়ের মুখে এতো কঠিন কঠিন কথা শুনে সে কি রিয়েক্ট করবে বুঝে উঠতে পারছে না যেনো। আরফা আবারও বললো…
—“না, না তোমরা কেউ বাবাইকে বকা দিও না। দাদু বাবাইকে অনেক বার বকা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাবাই তার কথা শুনেন নি কখনও। আমি জানি বাবাই মাম্মামকে আবারও নিজের কাছে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত খুশি হবেন না। জানো বাবাই, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তাই মাম্মামকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিবো আজ। মাম্মাম এর জায়গায় আমি স্টার হয়ে গেলে তো আল্লাহ মাম্মামকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিবেন। তখন মাম্মামের সাথে তুমি অনেক খুশি থাকতে পারবে। আর কখনও মাম্মামকে বাবু নিতে দিও না। তাহলে সেই বাবুকে আনতে গিয়ে মাম্মাম আবারও স্টার হয়ে গেলে তাকেও তুমি আমার মতো দায়ী করবে। সব বাবু তো আমার মতো তোমার খুশির কথা ভেবে স্টার হয়ে মাম্মামকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিবে না।”
ছোট্ট আরফার মুখে এরূপ কথা শুনে মেহরিনের দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। কাঁদছেন আমজাদ চৌধুরী নিজেও। আরফা আবারও বললো…
—“মিষ্টি আন্টি, মিষ্টি আঙ্কেল দরজার ধাক্কাচ্ছেন। আজ দরজা ধাক্কিয়ে তো কোনো লাভ হবে না।”
পরক্ষণেই আরফা আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো….
—“মাম্মাম…বাবাইয়ের কাছে আসার জন্য তুমি তৈরি তো! আমি কিন্তু তোমার জায়গায় স্টার হওয়ার জন্য তৈরি।”
এই বলে আরফা খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করে। মেহরিন ও আমজাদ কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই আরফা ওদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিন তলা থেকে লাফ দেয়। চোখের পলকে আরফার ছোট্ট দেহটা ওদের পায়ের কাছে এসে মুখ থু*ব*রে পরে। মেহরিন ‘আরফা’ বলে ও আমজাদ ‘দিদিভাই’ বলে চিৎকার করে উঠে। ওদের পিছনেই আরহাম দু’হাটু ভাঁজ করে মাটির উপর ধপ করে বসে পরে। ইতিমধ্যে দরজা ভেঙে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায় রিজওয়ান। নিচের দিকে তাকাতেই আরফার নিথর দেহটা সে দেখতে পায়। বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে ওর।
#চলবে ইনশাআল্লাহ…..
#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(২১)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)
(৫০)
হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে থাকা বসার স্থানে চিন্তিও ও ভ*য়া*র্ত মুখশ্রী নিয়ে বসে আছে আমজাদ, মেহরিন ও রিজওয়ান। তাদের থেকে কয়েকহাত দূরে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরহাম। আরহামের পরণে থাকা সাদা শার্টটা র*ক্তে রঙিন হয়ে আছে। আরহামের ফর্সা হাত জোড়াও র*ক্তে মেখে আছে। জায়গায় জায়গায় লেগে থাকা র*ক্তগুলো সব শুকিয়ে গিয়ে হালকা কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। অধিক উঁচু থেকে লাফ দেওয়ায় ছোট্ট আরফার মুখের একপাশ প্রায় থে*ত*লে গিয়েছিলো। মাথা ফেঁ*টে অত্যাধিক ব্লেডিং ও হয়েছিলো। হাসপাতালে আনার পথে অনেক চেষ্টা করেও ব্লেডিং বন্ধ করতে পারে নি কেউ।
প্রায় চার ঘন্টা পর অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে দরজার উপর জ্বলতে থাকা বাতিটা নিভে যায় ও ভিতর থেকে একজন পুরুষ ডাক্তার গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে বেড়িয়ে আসেন। আমজাদ, মেহরিন ও রিজওয়ান বসা থেকে উঠে ডাক্তারের সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। আমজাদ বললেন….
—“আমার ছোট্ট দিদিভাই এখন কেমন আছে ডাক্তার সাহেব!”
উপস্থিত সবাই আমজাদের করা প্রশ্নের উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। ডাক্তার সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন….
—“বাচ্চার অবস্থা ভালো না। মুখের যে পাশ থে*ত*লে গিয়েছে সে পাশ আবারও আগের মতো ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা ৫% ও নেই। শরীরের বিভিন্ন জায়গার হাড়ের জোড়া আলাদা হয়ে গিয়েছে। মেরুদন্ডের হাড় ও ভেঙে গিয়েছে কয়েকটা। মাথার অনেকটা জায়গা ফেঁ*টে যাওয়ায় ১৫টা সেলাই দেওয়া হয়েছে সেখানে। বাচ্চাটি যে কোমায় চলে গিয়েছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই আমার। আমরা আমাদের তরফ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। এবার ওর সুস্থতা নির্ভর করতেছে আল্লাহ তায়ালার উপর। এতো মেজর আ*ঘা*ত পেয়েও বেঁচে যাওয়ার ক্ষমতা খুব কম মানুষেরই থাকে। এতো ছোট বাচ্চার ক্ষেত্রে বিষয়টা মিরাক্কেল ই বলা যায়।তাই আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন, দোয়া করুন ওর জন্য।”
আমজাদ বললেন….
—“ডাক্তার সাহেব আমরা কি দিদিভাইকে দেখতে পারি!”
—“একটু পর ওকে কেবিনে সিফট করা হবে। যেহেতু ওর অবস্থা এখনও চিন্তার বাহিরে নয় তাই আগামী ৪৮ ঘন্টা আপনাদের ওর থেকে দূরে থাকতে হবে। তারপর আমরা ওর অবস্থা দেখে আপনাদের দেখা করার পারমিশন দিতে পারবো।”
এই বলে ডাক্তার স্থান ত্যগ করলেন। আমজাদ তার দু’চোখ দিয়ে নোনাজল ফেলতে ফেলতে বললেন…
—“আমার ছোট্ট ফুলটা এতো য*ন্ত্র*ণা কিভাবে সহ্য করছে! আল্লাহ আপনি আমার দিদিভাইকে সুস্থ করে দিন। ওর য*ন্ত্র*ণা গুলো নির্মূল করে দিন।”
আগের স্থানেই দাঁড়িয়ে ওদের সম্পূর্ণ কথপোকথন নিরবে শুনলো আরহাম। পরক্ষণেই সে সেই স্থান থেকে সামনের দিকে কিছুটা অগ্রসর হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে। উঠতে উঠতে সোজা হাসপাতালের ছাদে এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থির করে আরহাম৷ সারাদিন ধরে মাথা চাড়া দিয়ে থাকা সূর্য অনেক আগেই পশ্চিমাকাশে ডুবে গিয়ে রাতের জানান দিয়েছে। তার বিপরীত পার্শে থালার মতো বিশালাকার চাঁদ যেনো খিলখিলিয়ে হাসছে। হালকা কালচে বর্ণ ধারণ করা সম্পূর্ণ আকাশজুড়ে আজ তারারা মেলা বসায় নি। দূর দূরান্তে কেবল হাতে গোণা ২-৪ টা তারার দেখা মিলছে। আরহাম চাঁদের প্রায় সংস্পর্শে থাকা সবথেকে উজ্জ্বল ও বড় তারাটির দিকে তাকিয়ে বললো….
—“আরফা তোমাকেই ওর মা মনে করে এসেছে সবসময়। আমিও তোমাকে আজ আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর স্থানে বসাচ্ছি। তুমি তো জানতে সানজিদ আমি তোমাকে কতো বেশি ভালোবাসতাম এখনও কতো বেশি ভালোবাসি। প্রথম বার যখন প্রেগন্যান্সির ৬মাস চলাকালীন আমাদের বাচ্চাটা মা*রা গেলো তখন অত্যাধিক ব্লে*ডিং হওয়ায় ডাক্তার তোমাকে ২য় বার প্রেগন্যন্সির রি*স্ক নিতে নিষেধ করেছিলেন। কারণ প্রথমবার তোমাকে অনেক চেষ্টার পর আল্লাহর রহমতে তারা বাঁচাতে পেরেছিলেন। ২য় বার আর তিনি সহায়ক নাও হতে পারেন। আকস্মিক বাচ্চা ন*ষ্ট হওয়ায় তোমার শারিরীক অবস্থা যেমন খারাপ ছিলো তেমনি তুমি মানসিক ভাবেও ভে*ঙে পড়েছিলে। অনেক বার অনেক ভাবে তোমাকে সুস্থ, স্বাভাবিক করার চেষ্টা আমি করেছিলাম কিন্তু কখনও আমার চেষ্টা গুলো তোমার ভিতর ভালো পরিবর্তন আনতে পারে নি। এরপর তুমি আমাকে না জানিয়েই ২য় বার প্রেগন্যান্ট হওয়ার চিন্তাধারা স্থির করেছিলে। সেদিন রাতে তোমার ধারনা সম্পর্কে আমি কল্পনাও করতে পারি নি। তোমার স্বাভাবিক রূপ আমাকে তোমার প্রতি এতোটাই আকৃষ্ট করে ফেলেছিলো যে সমস্ত বাঁধ-দ*ন্দ পেরিয়ে তোমাতে মিলিত হয়েছিলাম আমি। কয়েকমাস পর তোমার শারিরীক পরিবর্তন আমার মনে সন্দেহের সৃষ্টি করলে তোমাকে জোরপূর্বক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই আর জানতে পারি তোমার গর্ভে আমাদের সন্তানের বয়স তখন ৪মাস হয়ে গিয়েছে। ডাক্তার আমার সাথে ভিষন রাগারাগি করলেন। কারণ কয়েকমাস আগেই তোমার উপর দিয়ে এতো বড় একটা ঝ*ড় গিয়েছে। যার প্রভাব এখনও তোমার শরীর কাটিয়ে উঠতে পারে নি। এর ভিতরেই তুমি ২য় বার প্রেগন্যান্ট হয়েছো। এখন এই বাচ্চাকে বহন করতে গিয়ে তোমার শারিরীক অবস্থার যে আরো অব*নতি ঘটবে সে বিষয়েও ডাক্তার আমাকে অবগত করেছিলেন। আর শেষ মূহূর্তে গিয়ে ডেলিভারির সময়ে বাচ্চা ও মা দু’জনকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। যদি বাচ্চাকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয় তবে মা মা*রা যাবে। আর যদি মা’কে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয় তাহলে বাচ্চা তো মারা যাবেই পাশাপাশি তুমি আজীবনের জন্য মা হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলবে। ঐ মুহূর্তটা যে আমার জন্য কতোটা য*ন্ত্র*ণা দায়ক ছিলো তা আমি কখনও কাউকে ভাষায় বলে প্রকাশ করতে পারি নি। টানাপোড়া মুহূর্ত নিয়ে আরো ৬মাস কাটিয়ে উঠলে তুমি। তোমার চেহারার সমস্ত উজ্জ্বলতা কোথায় যেনো ঢাকা পরে গিয়েছিলো। অতিরিক্ত ব*মির কারণে ও না খেয়ে বেশিরভাগ সময় পার করার জন্য তোমার ওজন ৫৫ থেকে ৪০ এ নেমেছিলো। তোমাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানোর পূর্বে ডাক্তার যখন আমাকে বলেছিলো বাচ্চা নয়তো মা যেকোনো একজনকে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিতে তখন নিজের বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে আমি তোমাকে বাঁচাতে বলেছিলাম। কিন্তু তুমি আমার সাথে বি*শ্বা*স*ঘা*ত*কতা করেছিলে সেদিন। আমার কথা না ভেবে বাচ্চার কথা ভেবেছিলে। তাই তো ডাক্তারকে আমার জানানো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছিলে। ঘন্টাখানেক পর অপারেশন থিয়েটারের ভিতর থেকে যখন বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে এসেছিলো তখন পুরো দুনিয়া যেনো আমার কাছে থ*ম*কে গিয়েছিলো। আমার আর বুঝতে বাকি ছিলো না এ পৃথিবী থেকে তুমি স্বা*র্থ*পরের মতো চিরতরের জন্য বিদায় নিয়েছো। সেদিন বাচ্চাকে গ্রহন করার মতো মানসিকতা আমার ছিলো না। আমি হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম। পরেরদিন তোমার দা*ফ*ন কার্য সম্পন্ন করার পর বাবা যখন আমার দিকে আমাদের ছোট্ট মেয়েটাকে তুলে দিতে ধরেছিলো তখন তোমার মুখশ্রী আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিলো। এই বাচ্চার জন্যই তো তুমি আমাকে ছাড়তেও দু’বার ভাবো নি। তোমার মৃ*ত্যু*র জন্য আমার ওকেই দায়ী মনে হয়েছিলো। এরপর থেকে কখনও আমি আরফার দিকে পিতৃনজরে তাকাই নি, ওকে পিতৃস্নেহ থেকে বন্ঞ্চিত করেছিলাম। ওকে কখনও আর পাঁচ বাচ্চার বাবার মতো কোলে নিয়ে বাবার আদর দেই নি। আমার এই অবহেলা, অ*যত্ন যে আমাদের মাত্র ৫ বছর বয়সী মেয়েটার উপর এতো বড় প্রভাব ফেলতে পারবে কখনও ভাবি নি। কখনও এমন ভাবে চিন্তাও করি নি ঐ নিষ্পাপ বাচ্চাটির আসলেই কি কোনো দো*ষ আছে বা ছিলো! ওকে তো আমরাই পৃথিবীতে এনেছি। তাহলে আমাদের বি*চ্ছে*দ এর জন্য ঐ নিষ্পাপ প্রাণটাকে কেনো আমি দায়ী করে আসছি সবসময়! ও তো নিজ থেকে বলে নি তোমরা আমাকে পৃথিবীতে আনো। ৫ বছরের একজন বাচ্চার মনে আমার আচারণ ঠিক কতোটা বা*জে ভাবে প্রভাব ফেললে সে আমার কাছে তোমাকে ফিরিয়ে দিতে নিজে তোমার স্থান নিতে চায়! আজ আমাদের মেয়ের এই করুণ পরিণতির জন্য যে আমিই দায়ী সে কথা অস্বীকার করার মতো নয়। তুমি তো আমার উপরে ভরসা করেই ওকে পৃথিবীতে রেখে নিজে চলে গিয়েছিলে। আমি তোমার সেই ভরসা রাখতে পারি নি। আমার আজ নিজেকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতেও ঘৃ*ণা হচ্ছে। ভিষণ ঘৃ*ণা হচ্ছে নিজের প্রতি।”
এই বলে আরহাম হাঁটু ভে*ঙে ছাদের উপর বসে পড়ে। আজ আরহামের দু’চোখ আর বাঁধ মানছে না। অঝোর ধারায় দু’চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। আকাশে থাকা চাঁদটা কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা পরে গিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যেই মুশল ধারায় বৃষ্টি পড়তে শুরু হয়। আজ আরহামের কান্নার সাথে পাল্লা দিয়ে যেনো আকাশ ও কাঁদছে।
#চলবে ইনশাআল্লাহ……….
#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(২২)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)
(৫১)
২দিন পর……
আজ ৪৮ ঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে। ডাক্তার আরফার সাথে সাক্ষাৎ এর পারমিশন দিয়েছেন আমজাদ ও আরহাম। তবে এ’ও বলে সতর্ক করেছেন তারা যেনো আরফার পাশে বসে উচ্চস্বরে কথা না বলে৷ আরফা কোমায় চলে যাওয়ায় ওর সর্বশরীর পাথর মূর্তির ন্যয় স্থির হয়ে রইলেও ওর ব্রেইন স্বাভাবিক সময়ের মতোই কাজ করছে। তাই এমন কোনো বিষয় নিয়েও ওর পাশে বসে কথা যেনো না বলে তারা যার প্রভাব ওর ব্রেইনে পৌঁছে বা*জে অবস্থা হয়। আরফার কেবিনের বাহিরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরহাম। কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই আমজাদ ভিতরে গিয়েছেন তার ছোট্ট ফুলকে একপলক দেখার জন্য গত দু’দিন ভিষণ ছটফট করেছেন তিনি। কেটে যায় আরো কিছু সময়। আমজাদ চোখ মুছতে মুছতে কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে বললেন…..
—“দিদিভাইয়ের এই অবস্থা আমি সহ্য করতে পারছি না রে বাবা, আমার দিদিভাইকে তুই আগের মতো সুস্থ করে তুলে আমার কাছে ফিরিয়ে দে।”
আরহাম আমজাদের দিকে অনুশোচনার চাহুনি স্থির করে রেখেছে। ওর দু’চোখ গত দু’দিন এক সেকেন্ড এর জন্যও বুঁজে নি। হালকা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে কালচে মনির চারপাশে। আমজাদ আরহামের কাঁধে হাত রেখে বললেন….
—“ভিতরে যা।”
অতঃপর আমজাদ সেখানে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আরহাম নিঃশব্দে কেবিনের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে। কেবিনের মাঝ বরাবর একটা মাঝারি সাইজের বেডের উপর শরীরে যান্ত্রিক লাইনের ছড়াছড়ি রেখে দু’চোখ বুঁজে স্থির হয়ে শুয়ে আছে ছোট্ট আরফা। আরহাম ধীরপায়ে একটু একটু করে ওর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মেয়ের যতো কাছে এগিয়ে যাচ্ছে সে ততোই মেয়ের ক*রু*ণ অবস্থা স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছে আরহাম। ওর বুকের ভিতরটা যেনো অনুশোচনার আ*গু*নে জ্ব*লে-পু*ড়ে দ*গ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আরহাম আরফার হাতের ডান পার্শে রাখা চেয়ারটি টেনে সেখানে বসে৷ ওর ডান পার্শের মুখশ্রী সম্পূর্ণ ঠিক আছে। বাম পাশ টা ব্য*ন্ডে*জ দিয়ে মোড়ানো। আরহাম ওর কাপান্বিত হাত দ্বারা আরফার ছোট্ট হাতটা স্পর্শ করলো। আরফার জন্মের পর এই প্রথম আরহাম স্বইচ্ছায় আরফাকে স্পর্শ করলো। আরহামের দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। আরহাম বললো…..
—“বাবাইয়ের প্রতি তোমার অনেক রাগ, অভিমান জমে আছে তাই না মা! বাবাই তোমাকে কখনও একটুও আদর করে নি, একটুও ভালোবাসে নি। শুধু সীমাহীন অবহেলা আর কষ্টই দিয়ে গিয়েছে। তোমার কোনো দো*ষ না থাকা সত্বেও তোমাকে তোমার মাম্মামের মৃ*ত্যু*র জন্য দায়ী করেছে সবসময়। তোমার এই পুতুলের মতো মুখটা ন*ষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য তো বাবাই-ই দায়ী। তোমার বাবাই ভিষণ পঁ*চা, অ*মানুষ একটা। তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠে তোমার বাবাইকে অনেক বকা দিও তো। কিন্তু এভাবে নিরব হয়ে বিছানায় পরে থেকে বাবাইয়ের বুকের ভিতরটা য*ন্ত্র*ণা*য় ক্ষ*ত-বি*ক্ষ*ত করে দিও না। তোমার বাবাই বুঝে গিয়েছে সে কতো বড় অন্যায় করেছে তোমার সাথে। তাকে ক্ষমা করে দাও তুমি মা।”
আরহাম কথাগুলো বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েছে। আরফা সুস্থ, স্বাভাবিক থাকলে হয়তো এতোক্ষণে নিজের ছোট্ট দুটো হাত দিয়ে খুব যত্ন নিয়ে নিজের বাবাইয়ের দু’চোখের পানিগুলো মুছে দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে বসে থাকতো।
(৫২)
দুপুরবেলা……..
ডান হাতে ব্যন্ডেজ করা অবস্থায় বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে ঊর্মিলা উচ্চস্বরে নিজের শ্বাশুড়ি মা’কে ডাকতে শুরু করে। কিয়ৎক্ষণ পর রাহেলা, শেফালি ও রুমি নিজরুম থেকে বেড়িয়ে আঙিনায় এসে দাঁড়ায়। রাহেলা বললেন….
—“কি হয়েছে বউমা! এই ভর দুপুরবেলা এতো চিৎকার চেচামেচি করছো কেনো?”
শেফালির দৃষ্টি ঊর্মিলার হাতের উপর পড়তেই সে ঊর্মিলার কাছে গিয়ে চিন্তিত স্বরে বললো…..
—“এ’কি মেজো! তোর হাতে কি হয়েছে? ব্যন্ডেজ করা কেনো? আর তুই তো ঊষাকে স্কুল থেকে আনার জন্য গিয়েছিলি। ঊষা কোথায়? ওকে দেখছি না তো তোর সাথে।”
ঊর্মিলার এতোসময় ধরে আটকে রাখা কান্নাগুলো এবার বাঁধ অতিক্রম করে ফেলে। ঊর্মিলা কান্না করতে করতে বললো….
—“ভাবী…অনেক বড় বি*প*দ হয়ে গিয়েছে।”
ঊর্মিলার মুখে বিপদ শব্দটা শোনামাত্র ভরকে যান রাহেলা। তিনিও ঊর্মিলার কাছে এগিয়ে এসে বললেন….
—“বি*প*দ! কি বি*প*দ হয়েছে? আমার ঊষা দিদিভাইয়ের কিছু হয় নি তো?”
—“মা আজ হয়তো আপনি আর আপনার নাতনীকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পারতেন না।”
—“কি সব যা তা বলছো তুমি মেজো বউ মা? মুখে কি একেবারেই লাগামহীন হয়ে গিয়েছে নাকি!”
—“আমি সত্যি বলছি মা। আজ ঊষাকে স্কুল থেকে আনার সময় আমার ফোনে একটা কল এসেছিলো। কথা বলার ব্যস্ততায় কখন থেকে আমার হাত থেকে ঊষার হাত ছুটে গিয়েছিলো বুঝতে পারি নি। কিয়ৎক্ষণ পরই কোথায় থেকে যেনো আল্লাহর পাঠানো উছিলার মতো রিজওয়ান আর মেহরিন এসে ঊষাকে গাড়ির নিচে পড়া থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছে। ঊষাকে বাঁচাতে গিয়ে মেহরিন ওর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বা*জে ভাবে আ*ঘা*ত পেয়েছে। মূহূর্তের মধ্যেই সেখানে লোকজনে ভরপুর হয়ে যায়। ভিড় ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতে গিয়ে ধা*ক্কা লেগে রাস্তায় পরে গিয়ে আমার হাতের চামড়া উঠে গিয়েছে। পরে আমরা সবাই মেহরিনকে নিয়ে হাসপাতালে যাই। আমার ক্ষ*ত স্থানে ব্য*ন্ডে*জ করে দেওয়া মাত্র আমি বাড়িতে চলে আসি আপনাদের খবর দেওয়ার জন্য। মেহরিন হাসপাতালে ভর্তি আছে। ওর কাছে রিজওয়ান আর ঊষাও আছে।”
মেহরিন আ*ঘা*ত পেয়েছে শুনে রাহেলার মুখে কিন্ঞ্চিত পরিমাণও খারাপ লাগার ছাপ ফুটে উঠে না। সে স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো….
—“ঐ দুই আ*প*দ ম*রে যাক কিংবা জা*হা*ন্না*মে যাক তাতে আমার কি হ্যা! এমন ভাবে কান্নাকাটি করে পুরো ঘটনা বললে যেনো কি না কি হয়ে গিয়েছে। দুপুরবেলা খাওয়া শেষ করে মাত্রই বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়েছিলাম। চোখ লাগতে না লাগতেই চেচামেচি করে পুরো বাড়ি একেবারে মাথায় তুলে ফেলেছো তুমি। শুনো বউমারা, ওদের দু’জনকে নিয়ে এতো আ*দি*খ্যে*তা করো না তোমরা। মেজো বউমা তোমার কি কখনই আক্কেল জ্ঞান হবে না! শ*ত্রু*দের কাছে যে নিজের একমাত্র মেয়েকে রেখে এসেছো ওরা যদি আমার দিদিভাইয়ের কোনো ক্ষ*তি করে তাহলে কিন্তু তোমাকেও আমি ছেড়ে কথা বলবো না বলে দিলাম।”
এই বলে রাহেলা নিজরুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন। উপস্থিত ওরা তিনজন রাহেলার যাওয়ার পানে তাকিয়ে হয়তো এটাই চিন্তা করে যে, যাদের জন্য আজ এ বাড়ির সবথেকে ছোট সদস্যটির প্রাণ বাঁচলো তারাই কি ওদের আড়ালে ওর ক্ষ*তি করবে। শেফালি একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো…..
—“মেজো! আমাদের এক্ষুণি হাসপাতালে যাওয়া উচিত। মেহরিন এর সাথে আমরা কম রেষারেষি করি নি। তবুও আজ ও তোর মেয়ের প্রাণ বাঁচাতে নিজের প্রাণকে ঝুঁ*কি*র সম্মুখীন করতে দু’বার ভাবে নি। ও চাইলেই পারতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোর মেয়েকে গাড়ির নিচে পি*ষে যেতে দেখে মজা নিতে। কিন্তু ও তা করে নি। এবার আমাদেরও এই খা*রা*প মানুষের খো*ল*স ত্যগ করে ভালো হওয়ার চেষ্টা করা উচিত।”
ঊর্মিলা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। রুমি ওদের দু’জনের চিন্তাধারা পরিবর্তন হতে দেখে মনে মনে খুশি হয়। অতঃপর ওরা তিনজন একসাথে মেহরিনকে দেখতে হাসপাতালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে।
(৫৩)
পরেরদিন সকালবেলা……
শেফালি, ঊর্মিলা, রুমি, রিজওয়ান ও ঊষা মেহরিনকে নিয়ে একসাথে বাড়িতে ফিরে। গতকাল দুপুর বেলা মেহরিনকে দেখার জন্য ওরা তিনজন হাসপাতালে যাওয়ার পর আর বাড়িতে ফেরে নি। আঙিনায় দাঁড়িয়ে রাগী মুখশ্রী নিয়ে পায়চারি করছে রাজিবুল। সেইসময় ওদের সবাইকে বাসায় ফিরতে দেখে রাগে গজগজ করতে করতে শেফালির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো…..
—“তোমার এতো সাহস হলো কি করে আমার পারমিশন না নিয়ে আমারই শত্রুদের কাছে গিয়ে তাদের সমবেদনা জানানোর ও সেখানেই রাত কাটানোর! অনেকদিন ধরেই তোমার অত্যাধিক বার সহ্য করে যাচ্ছিলাম আমি। কিন্তু আজ তুমি তোমার সব বাঁধা অতিক্রম করে ফেলেছো। আজ তোমাকে তোমার এই কাজের জন্য শা*স্তি পেতেই হবে।”
এই বলে যেই না রাজিবুল শেফালিকে মা*রা*র জন্য উদ্যত হয়েছে ওমনি সময় রিজওয়ান রাজিবুলের হাত ধরে তা ওর পিঠের পিছনে নিয়ে গিয়ে অনেকটা মু*চ*ড়ে ফেলার মতো করে। রিজওয়ান এবারেরও আকস্মিক আ*ক্র*ম*ণ রাজিবুলকে ঘা*য়ে*ল করে ফেলে। সে ব্য*থা*য় ছুটার চেষ্টা করে। রিজওয়ান রাগী স্বরে বললো…..
—“ঘরের মেয়ে ও বউয়ের গায়ে হাত তোলার মতো কাপুরুষত্বতা করা ছাড়া তো তোর দ্বারা কখনও কোনো প্রশংসার যোগ্য কাজ করা সম্ভব হতে দেখলাম। আগের মা*ই*র গুলোর কথা ভুলে গিয়েছিস নাকি! নাকের ব্য*ন্ডে*জ টা তো এখনও খুলিস নি দেখছি। ক্ষ*ত শুখায় নি নিশ্চয়ই এখনও! হাত-পা খুঁ*ই*য়ে ল্যং*ড়া হয়ে আজীবন বিছানায় পরে থাকার শখ না থাকলে আমার ভাবীর শরীরে ভুলেও একটা ফুলের টোকা দেওয়ার চেষ্টা করিস না।”
এই বলে রিজওয়ান রাজিবুলের হাত ছেড়ে দিয়ে স্বজোরে একটা ধা*ক্কা দেয় ওকে। ধা*ক্কার বেগ সামলাতে গিয়ে রাজিবুল আঙিনার মেঝের উপর পড়তে গিয়েও পড়ে না। অন্যহাত দিয়ে নিজের ডানহাত বুলাতে বুলাতে স্থান ত্যগ করে সে। শেফালি আর ঊর্মিলা রিজওয়ানের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। আজ রাজিবুলকে এমন ভাবে শা*য়ে*স্তা করায় শেফালির মাঝে একটুও খারাপ লাগা কাজ করছে না।
#চলবে ইনশাআল্লাহ………..