আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ পর্ব-১৭+১৮+১৯

0
212

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(১৭)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(৩৭)
রাতেরবেলা…..
রুমি নিজরুমে এসে বিছানায় স্থির হয়ে বসে নিরবে নিজের দু’চোখ দিয়ে নোনাজল বিসর্জন দিচ্ছে। কিয়ৎক্ষণ পর রুমি দু’হাতে নিজের দু’চোখের পানি মুছে বললো….

—“যে পরিবার আমার সুখকে কু*র*বা*নি দিয়ে নিজেদের সুখের পরিমাণ বাড়াতে চায় সেই পরিবারের সাথে থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না। সেই পরিবারের সম্মানের কথা চিন্তা করে নিজের জীবনের মূল্যবান সময় গুলোও নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। আমি কালই জিহাদের সাথে দেখা করবো। আর আমাদের সম্পর্ক নিয়ে হয়তো ভালো নয়তো খারাপ যেকোনো একটা সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবো।”

(৩৮)
মেহরিনের বিছানা ঠিক করা শেষ হয়েছে দেখে রিজওয়ান বেডসাইড টেবিলের উপর থেকে ওর বস আরহাম চৌধুরীর দেওয়া গিফট এর ব্যগটা হাতে নিয়ে মেহরিনের কাছে এসে ওর মুখোমুখি বসে দুপুরের পর অফিসে হওয়া সম্পূর্ণ ঘটনার কথা খুলে বললো। অতঃপর গিফট প্যকেটটি খুলতেই ভিতর থেকে হাজার টাকার দু’টো বান্ডিল আর একটা এন্ড্রয়েড ফোনের বক্স বের করে। মেহরিন স্মিত হাসি দিয়ে বললো….

—“তোমার এমন একটা ফোন কেনার অনেক শখ ছিলো বাবা তোমাকে দিতে চাইলেও সেই সময়ের পরিস্থিতি এমনই ছিলো যে তুমি চেয়েও নিজের শখ পূরণ করতে পারো নি। অথচ এখন দেখো, তুমি সব ভুলে নতুন করে নিজের জীবন শুরু করেছিলে আর একটু একটু করে তোমার অপূর্ণ থাকা শখগুলো পূরণ হতে শুরু করেছে। এতে কি বুঝা যায় জানো! আল্লাহ আমাদের সবাইকে ঠিকই কঠিন ও খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন করান কিন্তু কখনও এতোটা হতাশ করেন না যে আমরা তাঁকে ভুলে যাই বা তাঁর ইবাদত পালন করতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়ি। আমাদের ইমান পরীক্ষা করেন তিনি কঠিন ও খারাপ পরিস্থিতিতে ফেলে। আর আমাদের সহ্য ক্ষমতা ল*ঙ্ঘ*ন হওয়ার পূর্বেই তিনি সব সমস্যা দূর করে ভালো সময় এনে দেন। তাই আমাদের উচিত জীবনের প্রতিটি ক্ষণে তার উপর অগাধ ভরসা রাখা।”

রিজওয়ান হাসিমুখে বললো….
—“হুম ঠিক বলেছো বউ। এতোদিন একটা ফোনের অভাবে বাবাকে সব সত্য সম্পর্কে অবগত করতে পারি নি। ভেবে রেখেছিলাম ১ম মাসের বেতনটা হাতে পেলে সর্বপ্রথম একটা ফোন কিনবো। কিন্তু আল্লাহ আমাকে ততোদিন অপেক্ষা করালেন না।”

মেহরিন শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে বললো….
—“বাবা কি তোমার কথা বিশ্বাস করবেন? আমরা মাত্র দু’জন আর ওরা ৬জন। ওদের দল যে ভিষণ ভাড়ি। এমন না হয় যেনো মিথ্যার জোরে সত্য মাটির নিচে চাপা পরে যায়।”

রিজওয়ান মেহরিনের দু’গালের উপর নিজের দু’হাত আলতো ভাবে রেখে বললো….
—“মি*থ্যা*র দল যতোই ভাড়ি হোক না কেনো তা কখনও সত্যকে মাটির নিচে চাপা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না বউ। সত্য একাই একশত জনের শক্তির সমতুল্য। আমি আগামীকালই বাবাকে সম্পূর্ণ সত্য সম্পর্কে অবগত করবো। এরপর তার নিটক যেটা ঠিক মনে হবে সেটাই হবে। বাবা যদি একটু গভীর ভাবে চিন্তা করেন ও যাচাই করেন তাহলে কারা সত্য বলছে আর কারা মিথ্যা তা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারবেন।”

—“হুম দেখা যাক কি হয়। সম্পূর্ণ ভরসা এখন আল্লাহর উপর। তিনি যা লিখে রেখেছেন তাই হবে ইনশাআল্লাহ।”

—“ওহ হ্যা, বউ তোমাকে তো আরো একটা কথা বলার ছিলো আমার এসব কথার তালে স্মরণ হারা হয়ে গিয়েছিলো।”

—“কি কথা?”

—“আরহাম স্যার শুক্রবার দুপুরবেলা তোমাকে নিয়ে আমায় তার বাসায় যেতে বলেছেন৷ তিনি নিজ থেকে আমাদের দুপুরের খাবার একসাথে খাওয়ার জন্য দাওয়াত করেছেন৷ আমি তার এমন ভাবে বলা কথায় না করতে পারি নি।”

মেহরিন হাসিমুখে বললো….
—“ঠিক আছে আমরা যাবো।”

(৩৯)
পরেরদিন সকালবেলা……
অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আরহাম ড্রয়িংরুমে আসতেই ওর সম্মুখে এসে দাঁড়ায় আরফা। আরহাম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরে এমন ভাবে আরফার উপস্থিতিতে। আরহাম আরফার উপর শান্ত দৃষ্টি স্থির করতেই আরফা বললো….

—“জানেন আমি দাদুর কাছে নামাজ পড়া শিখে নিয়েছি। নামাজ শেষে আমি আল্লাহর কাছে একটা সিক্রেট দোয়া করেছিলাম। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছে কি না সেটাই দেখতে আজ আপনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি আমি। এখন আমি চোখ বন্ধ করছি কেমন!”

এই বলে আরফা চোখ বন্ধ করে ফেলে। ছোট্ট আরফার মুখে এরূপ কথা শুনে আর এমন কাজে আরহাম অত্যন্ত অবাক হয় ঠিকই। কিন্তু পরমুহূর্তেই আরহাম আরফার প্রতি ভালো কোনো রিয়াকশন প্রকাশ করার পূর্বেই ওর চোখের সামনে সানজিদ এর মুখশ্রী ভেসে উঠে। যার ফলে আরহাম বরাবরের মতোই আরফার পাশ কাটিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। কিয়ৎক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকার পরেও কোনো রকম রিয়াকশন বুঝতে না পেরে অস্থির হয়ে আরফা চোখ মেলে সামনে তাকায়। আরহাম নেই। আরফা একনজরে নিজের চারপাশ দেখে নেয় নাহ্ আরহাম নেই। সেইসময় বাহির থেকে গাড়ির হর্ণ বাজার শব্দ আরফার কর্ণপাত হতেই আরফার সম্পূর্ণ মুখশ্রী একরাশ কালো মেঘে ঢেকে যায়। আরফা বুঝতে পারে বরাবরের মতোই ওর বাবাই ওকে এড়িয়ে চলে গিয়েছে। আরফা আর সেখানে না দাঁড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে সিঁড়ি বেয়ে সোজা ছাদে চলে আসে। ছাদের এক কোনে হাঁটু ভাজ করে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে অভিমানী স্বরে বললো….

—“দাদু তো বলেছিলো আল্লাহ সব বেবিসদের প্রার্থনা খুব তাড়াতাড়ি কবুল করে নেন। আমি তো আল্লাহর কাছে খুব করে চেয়েছিলাম বাবাই যেনো আমাকে একটু আদর করেন। একটু সময়ের জন্য কোলে নেন। তবে কি বাকি বাকি বেবিসদের মতো আমি ভালো না! বাবাই যেমন আমাকে পঁচা মনে করেন আল্লাহও তেমন-ই আমাকে পঁচা মনে করেন। তাই তিনি আমার দোয়া কবুল করেন নি! মাম্মাম এখন দিন হয়ে গিয়েছে তাই আমি তোমাকে দেখতে পারছি না। কিন্তু আমাকে তো তুমি সবসময় দেখতে পাও। আমার কথাও তুমি সবসময় শুনতে পাও। মাম্মাম তুমি বাবাইকে বলে দিও আমি তোমাকে আর বাবাইকে দু’জনকেই অনেক ভালোবাসি। কিন্তু জানো মাম্মাম বাবাই শুধু তোমাকে ভালোবাসে। আমাকে একটুও নয়। আমি এখন থেকে আল্লাহর কাছে এই দোয়া করবো যেনো আল্লাহ আমাকে খুব তাড়াতাড়ি স্টার বানিয়ে দেন আর তোমাকে আবারও বাবাইয়ের কাছে ফিরিয়ে দেন। আমিও তখন আকাশে বসে তোমাদের একসাথে হাসি-খুশি থাকতে দেখবো।”

কথাগুলো বলতে বলতেই ছোট্ট আরফার দু’চোখ নোনা জল দ্বারা ভিজে গিয়েছে। আরফা আকাশ থেকে নিজের দৃষ্টি নামিয়ে দু’হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে ওভাবেই বসে রয়।

(৪০)
কলেজের যাওয়ার জন্য নিজ রুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছে রুমি। সেইসময় রুমির মা রাহেলা ওর রুমে প্রবেশ করে। আয়নায় নিজের মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখে রুমির বুঝতে বাকি রয় না তার মা এখন তাঁকে কি বলার জন্য এখানে এসেছেন। সবকিছু জেনেও নিরব আর স্বাভাবিক রয় রুমি। রাহেলা নিজের মুখে হাসি বজায় রেখে বিছানায় বসতে বসতে বললেন…..

—“রুমি মা..আমার পাশে এসে বোস তো। তোর সাথে আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলার আছে।”

রুমি কোনোরূপ প্রশ্ন না করে নিরব হয়ে ওর মায়ের সম্মুখপানে এসে বসে। রুমির মুখে লেগে আছে স্মিত হাসির রেখা। রাহেলা আবারও বললেন….

—“শোন মা..সব মেয়েদেরই একদিন না একদিন বাবার বাড়ির মায়া ত্যগ করে নিজের আসল বাড়ি অর্থাৎ শ্বশুড় বাড়িতে চলে যেতে হয়। আর আমৃত্যু পর্যন্ত সেখানে থাকতে হয়। আমাদের সময় মেয়েদের বয়স ১০ পেরোলেই পাড়া-পড়শী ও বাড়ির সকল গুরুজনদের নজরে সে বিয়ের জন্য যোগ্য হয়ে যেতো। আর তোর বয়স ১৭ তে পরেছে আরো বেশ কয়েকমাস আগেই। তাই আমার নজরেও বিয়ের উপযুক্ত বয়স তোর হয়ে গিয়েছে। অনেকদিন থেকেই বিভিন্ন আত্মীয়, পাড়া-পড়শীর থেকে অনেক ছেলের সম্বন্ধই আমার কান পর্যন্ত পৌঁছে ছিলো। কিন্তু কখনও কোনো সম্বন্ধ নিয়ে এতো গভীর ভাবে ভেবে দেখি নি। এবার তোর বড় ভাই যে সম্বন্ধটা নিয়ে এসেছে তা নিয়ে আমি না ভেবে পারলাম না। এতো ভালো ছেলে সহজে কি পাওয়া যায় বল! টাকা-পয়সা, বাড়ি, সয়-সম্পত্তি, সম্মান কোনো কিছুর অভাব নেই তার। হ্যা হতে পারে ছেলেটার একটু বয়স বেশি। চেহেরার উজ্জ্বলতা কিছুটা ঢাকা পড়ে গিয়েছে। স্ত্রী মা*রা গিয়েছে আর সে পক্ষের দুই সন্তান ও আছে। কিন্তু এসব কিছুই ঢাকা পরে যাচ্ছে তার অর্থের সামনে। একটা কথা কি জানিস মা! স্বামী হিসেবে পুরুষ মানুষদের একটু বেশি বয়স হওয়া ভালো। কারণ তারা তাদের স্ত্রীকে অনেক বেশি ভালোবাসেন আর তাদের চাওয়া-পাওয়া গুলোর গুরুত্ব বেশি দেন। আর রাজিবুল তো বলেছিলোই যে বাচ্চাদের নিয়ে তোর সমস্যা হলে বিয়ের পর কৌশলে নিজের সংসার থেকে ওদের সরিয়ে ফেলতে পারবি তুই। রাণীর মতো সেই সংসারে রাজত্ব করতে পারবি। সবকিছু চিন্তা করার পর এই সম্বন্ধে আমার মন খুব ভালো ভাবেই বসে গিয়েছে রে মা। তুই ও আর দ্বিমত করিস না। আমি বা তোর ভাইয়েরা কেউই তোর খারাপ চাই না। তুই সুখে থাকবি এটাই সর্বপ্রথম চিন্তা করি।”

রাহেলার বলা প্রতিটি শব্দ এই মুহূর্তে রুমির নিকট বি*ষে*র থেকে বি*ষা*ক্ত মনে হচ্ছিলো। যা ওর বুকের ভিতরটা খুব যত্ন নিয়ে ক্ষ*ত-বি*ক্ষ*ত করে দিতে সক্ষম হলো। রুমি মনে মনে কেবল একটি বাক্য আওরালো…..

—“মা! মা জাতি তো এমন হওয়ার কথা না!”

চলবে ইনশাআল্লাহ…………

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(১৮)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(৪১)
কলেজের কথা বলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে রুমি জিহাদের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে পার্কে এসেছে। পার্কের ভিতর একটা বেন্ঞ্চে বসে জিহাদের আসার অপেক্ষা করছে রুমি। কিয়ৎক্ষণ পর জিহাদকে পার্কের মূল দরজা পেরিয়ে নিজের দিকে অগ্রসর হতে দেখে রুমি। জিহাদ রুমির পাশে এসে বসে বললো…..

—“হঠাৎ কি হলো তোমার রুমি! দেখা করার জন্য এতো জরুরী তলব কেনো?”

রুমি শান্ত স্বরে বললো….
—“বড় ভাইয়া আমার জন্য একটা বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে জিহাদ।”

জিহাদ ভাবলেশহীন কন্ঠে বললো….
—“তো এর জন্য এমন উদাস হওয়ার কি আছে!”

রুমি শব্দ করে একবার নিশ্চিত ফেলে বললো….
—“আমার জন্য আনা সেই সম্বন্ধে লোকটির বয়স আমার বয়সের দ্বীগুণেরও বেশি। আর লোকটির আগের একবার বিয়ে হয়েছিলো। প্রথম স্ত্রী মারা গিয়েছেন। প্রথম পক্ষের একজন ছেলে সন্তান ও একজন মেয়ে সন্তান আছে। ছেলে সন্তানের বয়স ১২ বছর আর মেয়েটার বয়স খেয়াল নেই।”

রুমির মুখে সম্বন্ধের বর্ণনা শুনে জিহাদ শব্দ করে হেসে উঠে বললো….
—“শেষ পর্যন্ত তোমার ভাই কি না তোমার জন্য বাচ্চাসমেত বুড়ো পুরুষ খুঁজে আনলেন! তো তুমি কি বললে? না করে দিয়েছো নিশ্চয়ই!”

—“হুম প্রথমদিন-ই শোনামাত্র না করে দিয়েছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতি আমাকে আমার প্রিয়জনদের আসল রূপ দেখিয়ে দিয়েছে।”

—“মানে!”

—“আমার জন্য আনা সম্বন্ধের পুরুষ লোকটি বড় ভাইয়ার অফিসের ম্যনেজার হন। তাঁর আর্থিক অবস্থা নাকি অনেক ভালো। সয়-সম্পত্তির কোনো অভাব নেই। বড় ভাইয়া অফিসে নিজের জায়গা আরো মজবুত করার জন্য আমাকে তার আনা সম্বন্ধে রাজি করাতে উঠে পরে লেগেছেন। আজ সকালে আম্মাও আমাকে অনেক বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। যেনো আমি রাজি হয়ে যাই। তাদের এই রূপ আমার ভিতরটা জ্বা*লি*য়ে পু*ড়ি*য়ে শেষ করে দিচ্ছে জিহাদ। এভাবে চলতে থাকলে আমি নিশ্চিত কোনো অ*ঘটন ঘটিয়ে ফেলবো।”

রুমির মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে জিহাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট হয়। কিয়ৎক্ষণ যাবৎ পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে পুরো পরিবেশ জুড়ে। কিয়ৎক্ষণ পর জিহাদ বললো….

—“কিন্তু আমার অবস্থাও তো এখন এমন নয় যে আমি তোমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে পারবো। সবে পড়াশোনার গন্ডি পেরিয়ে জীবনে কিছু করার চিন্তা ভাবনা করছিলাম। ব্যবসা কিংবা চাকরি যেকোনো একটাতেও যদি ফোকাস করি তা দ্বারা নিজের জীবনকে গুছিয়ে নিতেও আমার যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন।”

রুমি মলিন স্বরে বললো….
—“নিজের মা-ভাই যেখানে আমার সুখের কথা চিন্তা করছে না সেখানে আমি তাদের সাথে ল*ড়া*ই করে কতোদিন আর টিকতে পারবো জিহাদ! যদি সবকিছু হাতের বাহিরে চলে যায় আর তুমি সময়ের ভিতর কিছু করতে না পারো তাহলে আমার আ*ত্ম*হ*ত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। আমি ম*রে যাবো কিন্তু তুমি ব্যতিত ২য় কোনো পুরুষের হতে পারবো না।”

রুমির এরূপ কথায় জিহাদের বুকের ভিতরটা যেনো মো*চ*র দিয়ে উঠে। ভাগ্য তাদের এতো তাড়াতাড়ি এমন কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন করতে পারে তা ভাবতেও পারে নি জিহাদ।

(৪২)
রাতেরবেলা…..
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে আঙিনার মাঝ বরাবর গোল হয়ে চেয়ারে বসে আছে রাহেলা, রাজিবুল, শেফালি, রফিকুল, ঊর্মিলা। রাহেলা পাশেই মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুমি। সেইসময় রাজিবুল বললো…..

—“আম্মা…তোমার মেয়ে কি আমার আনা সম্বন্ধে সম্মতি জানিয়েছে! ম্যনেজার সাহেবকে আমি বলে দিয়েছিলাম তার জন্য যোগ্য মেয়ের সন্ধান আমি করে ফেলেছি। মেয়েটি কে তা জানার জন্য তিনি ভিষণ তাড়া দিচ্ছেন।”

রাহেলা রুমির দিকে একপলক তাকিয়ে পরপরই দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বললেন….
—“রুমি এখনও আমাকে এ বিষয়ে কোনো মতামত জানায় নি রে বা’জান।”

রাহেলার এমন উত্তরে রাজিবুলের চেহারায় অসন্তুষ্ট ভাব স্পষ্ট হয়। রাজিবুল রুমির দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো….

—“রুমি..কি সমস্যা তোর হ্যা! সম্মতি জানাতে অহেতুক এতো সময় কেনো নিচ্ছিস তুই?”

রুমি আর চুপ না থেকে জোর গলায় বললো….
—“আমি তো প্রথম দিনই বলে দিয়েছি তোমাদের সবাইকে বড় ভাইয়া যে আমি ঐ লোককে বিয়ে করতে একদম-ই ইচ্ছুক নই। আর আমি এখন নিজের বিয়ে নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনাই করছি না। আমার সময়ের প্রয়োজন। আমি অনেক দূর পর্যন্ত পড়াশোনা করতে চাই। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।”

রাজিবুল ধমকের স্বরে বললো….
—“আরে রাখ তোর পড়াশোনা। তুই মেয়ে মানুষ। পরের বাড়ির সম্পত্তি। আমাদের ভাগের টাকা খরচ করে তোকে এতো পড়াশোনা করিয়ে বড় জায়গায় চাকরি নিয়ে দিতে যাবো কেন আমরা! বিয়ের পর তো সেই চাকরি থেকে পাওয়া টাকা তুই আমাদের হাতে তুলে দিবি না।”

রাজিবুলের তালে তাল মিলিয়ে রফিকুল বললো….
—“বড় ভাইয়া একদম ঠিক বলেছে। তোকে পড়াশোনা করাতে গিয়ে এ যাবতে যে অর্থ গুলো ব্যয় হয়েছে সেই ক্ষতিই তো আমাদের কখনও পূরণ হবে না। আর তুই কি না অনেক দূর পর্যন্ত পড়াশোনা করার কথা বলছিস!”

রুমি নিজের দুই ভাইয়ের এমন তি*ক্ত কথা হজম করতে না পেরে তেজী স্বরে বললো…..

—“তোমরা হয়তো ভুলে যাচ্ছো আমি তোমাদের টাকা দিয়ে পড়াশোনা করি না। আমি জনাব. শরীফ সাহেবের একমাত্র মেয়ে। জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত আমার পিছনে হওয়া যাবতীয় খরচ তিনি একা হাতেই সামলে এসেছেন। রিজওয়ান ভাই সেদিন কি বলেছিলো ভুলে গিয়েছো নাকি তোমরা! আমি সেদিন এখানে উপস্থিত না থাকলেও আম্মার থেকে সম্পূর্ণ ঘটনাই শুনেছিলাম। এই বংশের উত্তরাধিকার সূত্রে কেবল আমি আর রিজওয়ান ভাই-ই যাবতীয় সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার অধিকার রাখি। তোমরা দু’জন এই বংশের উত্তরাধিকার নও। তাই আমার পড়াশোনা বন্ধ করতে চাওয়ার কথা বলারও কোনো অধিকার তোমাদের নেই বুঝলে!”

রুমির মুখে এরূপ কথা শুনে রফিকুল আর রাজিবুলের সর্বশরীরের র*ক্ত যেনো টগবগ করে ফু*ট*তে শুরু করেছে। রফিকুল নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলেও রাজিবুল পারে না। সে বসা থেকে উঠে অত্যন্ত রাগ নিয়ে রুমির দিকে তে*ড়ে এসে সকলের সামনেই ভিষণ শক্ত ভাবে ওর গলাটা একহাত দিয়ে চে*পে ধরে গোল বৈঠকখানার মাঝবরাবর টেনে আনে। উপস্থিত বাকিদের চোখে-মুখে ভ*য় ও হ*ত*ভ*ম্ব*তার ছাপ স্পষ্ট হয়। সকলেই যেনো মুখ দিয়ে একটা টু শব্দ করার ভাষা হারিয়ে ফেলে। এদিকে রুমি নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য হাত-পা ছুঁ*ড়*তে শুরু করেছে। রাজিবুল অত্যন্ত রাগী স্বরে বললো…..

—“আমাকে আমার জায়গা চেনাচ্ছিস তুই! হাঁটুর বয়সী মেয়ে হয়ে আমার মুখে মুখে এতো বড় কথা বলার সাহস দেখিয়েছিস। আজ তোকে মে*রে*ই ফেল……!”

রাজিবুল পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই ঝড়ের বেগে একটা লা*থি ওর পেটের বাম পার্শে এসে পড়লে রুমির গলা ছেড়ে গিয়ে সে কয়েকহাত দূরে মেঝেতে ছিঁ*টকে পরে যায়। তাল সামলাতে না পেরে রুমিও মেঝেতে পরে গিয়েছে। রাজিবুল অত্যন্ত ব্যথায় কুঁ*ক*ড়ে যায়। আকস্মিক এমন কিছু হওয়ায় উপস্থিত সকলেই ঘোর থেকে বেড়িয়ে এসে চোখ তুলে তাকাতেই দেখে ওদের সামনে রিজওয়ান রাগে হালকা লাল বর্ণ ধারণ করা মুখশ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিচ থেকে উচ্চশব্দে কথা বলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে এতোক্ষণে মেহরিন ও সেখানে উপস্থিত হয়েছে। মেহরিন পরিস্থিতি হালকা ভাবে আঁচ করতে পারে। রুমিকে মেঝেতে পরে থাকতে দেখে মেহরিন রুমির কাছে এসে ওকে ধরে ডাইনিং রুমে এনে সেখানে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে ওর দিলে এক গ্লাস পানি বাড়িয়ে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে রুমির দু’চোখ ফুলে লাল বর্ণ ধারণ করতে শুরু হয়েছে। রিজওয়ান দ্রুতকদমে রাজিবুলের নিকট এগিয়ে গিয়ে ওকে টেনে দাঁড় করিয়ে ওর নাক বরাবর পর পর কয়েকটা ঘু*ষি প্রয়োগ করে। রাজিবুল নাক ফে*টে র*ক্ত ঝড়তে শুরু হয়েছে। উপস্থিত কেউই রাজিবুলকে রিজওয়ানের হাত থেকে বাঁচাতে এগোনোর সাহস করে উঠতে পারছে না। পরমুহূর্তেই রিজওয়ান ওর দু’হাত দিয়ে শক্ত ভাবে রাজিবুলের শার্টের কলার্ট চেপে ধরে বললো…..

—“তোর সাহস কি করে হলো আমার বোনের গলা চে*পে ধরার! মাতৃসূত্রে তুই ওর বড় ভাই হতে পারিস কিন্তু পিতৃসূত্রে আমিও তোর বড় ভাই হই। রুমি হাজার অন্যায় করলেও এমন ভাবে ওর গায়ে হাত দেওয়ার অধিকার তোর নেই। আমার বোনকে মে*রে ফেলতে চাস তুই! এতো বড় সাহস তোর! আমি চাইলে এক্ষুণি তোকে মে*রে এই আঙিনার ২০ ফুট নিচে দা*ফ*ন করিয়ে দিতে পারবো। শুধুমাত্র বাবার সামনে তোদের আসল রূপটা দেখানোর জন্য আমি এমন কিছু করি নি এখনও। আজ যা করেছিস পরবর্তীতে ভুলেও এমন কিছু করার চিন্তাও করিস না। তখন আমি কারোর পরোয়া করবো না। সোজা মে*রে মাটির নিচে গে*ড়ে দিবো।”

এই বলে রিজওয়ান স্বজোরে একটা ধাক্কা দেয় রাজিবুলকে। রাজিবুল এবারও কয়েকহাত দূরে মেঝের উপর পরে গিয়ে সেন্স হারিয়ে ফেলে। পরমুহূর্তেই রিজওয়ান রাহেলা আর রফিকুলে সামনে এসে দাঁড়ায়। রফিকুল পরপর কয়েকবার শুকনো ঢো*ক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। রিজওয়ান তেজি স্বরে বললো…..

—“আমার বোনকে বিয়ে দেওয়ার জন্য যে বা যারা জোর জ*ব*র দ*স্তি করার চেষ্টা করবে তাদের পরিণতিও ভিষণ ভ*য়া*বহ হবে মনে রাখবেন সবাই। আপনাদের মতো অ*মানুষদের সুখের ব*লি আমার বোনকে চ*ড়*তে দিবো না আমি।”

এই বলে রিজওয়ান সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিজরুমে চলে যায়। রিজওয়ান চলে যেতেই ওরা সবাই বসা থেকে উঠে ছুটে যায় রাজিবুলের কাছে। দূর থেকে রুমি ওদের দিকে ঘৃ*ণা ভরা দৃষ্টি নি*ক্ষে*প করে মনে মনে বললো……

—“কে আমার আপন আর কে আমার পর আজ তা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে সক্ষম হলাম আমি।”

রুমির পাশেই মেহরিন নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো কেবল।

#চলবে ইনশাআল্লাহ……….

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(১৯)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(৪৩)
রাহেলা, রফিকুল, শেফালি, ঊর্মিলা অচেতন রাজিবুলের চেতনা ফেরানোর কাজে ব্যস্ত আছে। মেহরিন রুমিকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“তুমি তোমার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো রুমি। ওদের বিষয় ওদেরকেই সামলাতে দাও। আর বিয়ের বিষয়ে কোনো চিন্তা করো না। পুরো দুনিয়া তোমার বিরুদ্ধে চলে গেলেও তোমার রিজওয়ান ভাই আর আমাকে সবসময় পাশে পাবে তুমি।”

এই বলে মেহরিন সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিজরুমে চলে যায়। রুমি ছলছল দৃষ্টি নিয়ে মেহরিনের যাওয়ার পানে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর নিজের মা-ভাই-ভাবীদের দিকে দৃষ্টি স্থির করে মনে মনে বললো….

—“অ*ন্যায় কারীর পরিণতি এমন-ই হয়। যা হয়েছে বেশ হয়েছে।”

এই বলে রুমি বসা থেকে উঠে ওদের সবার পাশ কাটিয়ে নিজরুমে চলে যায়। ঊর্মিলা একপলক রুমিকে দেখে আবার বাকিদের উপর দৃষ্টি স্থির করে। শেফালি অস্থির কন্ঠে বললো….

—“আম্মা…ওর নাক থেকে রক্ত পড়া তো বন্ধ হয়ে গিয়েছে কিন্তু ওর চেতনা কেনো ফিরছে না। ওকে কি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে!”

শেফালির মুখে এরূপ কথা শুনে ঊর্মিলা মনে মনে বললো….

—“হুম হুম আমার স্বামীর পকেট থেকে টাকা খ*সানোর জন্যই এখন নিজের স্বামীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা উঠাচ্ছে চতুর মহিলা। ভেবেছি আমি বুঝবো না। তুমি শেফালি যদি চলো ডালে ডালে আমি ঊর্মিলাও চলবো তেমন পাতায় পাতায়।”

এই বলে ঊর্মিলা নিজের ডান হাতের কনুই দিয়ে রফিকুলের পেটের একপার্শে পরপর কয়েকবার গুঁ*তো দেয়। রফিকুল কিন্ঞ্চিত ব্য*থায় চোখ-মুখ হালকা কুঁ*চ*কে নিয়ে ঊর্মিলাকে কিছু বলতে নিয়ে ঊর্মিলা ইশারায় রফিকুলকে নিরব থেকে ওদের থেকে দূরে সরে আসতে বলে। অতঃপর ঊর্মিলা বসা থেকে উঠে ওদের সবার থেকে কয়েকহাত দূরে এসে দাঁড়ায়। রফিকুলও ঊর্মিলার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো….

—“কি হলো..এভাবে ডাকার মানে কি?”

—“শুনলে না তোমার বড় ভাবী কি বললো! তোমার ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা তুলেছে।”

—“হুম, এতে কি হয়েছে।”

—“কি হয়েছে মানে! তোমার মাথায় কি বুদ্ধি বলতে কোনো কিছু আছে আদেও?”

—“আহহ ঊর্মিলা, এতো ভনিতা না করে যা বলার সরাসরি বলো তো৷”

—“বলি আমাদের এলাকায় আশেপাশে কোনো হাসপাতাল আছে কি?”

—“না, নেই তো।”

—“হুম নেই। হাসপাতাল সব শহরে অবস্থিত। আমাদের এখান থেকে শহরে যেতে প্রতিজনের ৫০ টাকা করে ভাড়া লাগে। এখন তোমার ভাইকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য তোমার মা সম্মতি জানালে এতোগুলো মানুষের যাওয়ার ভাড়া থেকে শুরু করে, হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর খরচা ও ঔষধ কেনার খরচা সব তো তোমার পকেট থেকেই দিতে হবে। তোমার ভাবী, মা তো তখন সুযোগ পেয়ে অসহায় হওয়ার নাটক করবে। খামোখা তুমি এতো টাকা ব্যয় করতে যাবে কেনো শুনি?”

ঊর্মিলার বলা কথাগুলো বুঝতে পেরে রফিকুল বললো….
—“হুম এভাবে তো ভেবে দেখি নি বিষয়টা।”

—“তা ভাববে কেনো? ভাবার জন্য তো মাথায় সামান্যতম বুদ্ধি বলতে কিছু থাকতে হবে।”

—“আহহা ঊর্মি, আবার শুরু করো না তো তুমি।”

—“শুনো, তোমার মা আর ভাবীকে যেভাবেই হোক বুঝায় বলো যে বড় ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। র*ক্ত পড়া যেহেতু বন্ধ হয়েছে সেহেতু আর চিন্তার কোনো কারণ নেই। মা*ই*রের ধ*ক*ল*টা একটু পর কে*টে গেলে আপনা-আপনিই ওনার চেতনা ফিরে আসবে। আর যদি ওনারা একান্তই না মানে তাহলে এই আমি বলে দিচ্ছি তুমি ওদের সাথে এক পা ও বাহিরের দিকে বের করবে না। নয়তো তোমার একদিন হবে আর আমার যতোদিন লাগে।”

এই বলে ঊর্মিলা রফিকুলের কাছে থেকে সরে রাহেলা আর শেফালির পাশে এসে বসে। রফিকুলের কপালে কয়েকটা চিন্তার ভাঁজ পড়েছে ইতিমধ্যেই। কিয়ৎক্ষণ নিরব হয়ে ভাবার পর রফিকুল ঊর্মিলার কথানুযায়ী ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো….

—“আম্মা…ভাবী! তোমরা শান্ত হও। এতোটা অস্থির হওয়ার মতো আহামরি বিষয় এখানে হয় নি। বড় ভাই ভাড়ি শরীরের মানুষ। আকস্মিক মা*ই*রের ধ*ক*ল নিতে পারেন নি জন্যই এখনও তার চেতনা ফিরছে না। এতোসময় ধরে এভাবে তাঁকে শুধু মেঝের উপর শুইয়ে রাখাটা ঠিক হচ্ছে না। সবাই আমাকে সাহায্য করো বড় ভাইকে রুমে নিয়ে যেতে।”

বাকিরা আর কথা না বাড়িয়ে রফিকুলকে সাহায্য করে রাজিবুলকে মেঝে থেকে উঠিয়ে রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

(৪৪)
মেহরিন রুমে প্রবেশ করতেই দেখে রিজওয়ান এখন অফিসের পোশাক পরিবর্তন করে নি। বিছানার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে কপালের উপর একহাত ভাঁজ করে দু’চোখ বুঁজে আধশোয়া হয়ে আছে সে। মেহরিন রিজওয়ানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওর কপালের উপর রাখা হাতের উপর নিজের শীতল হাত রাখতেই রিজওয়ান হাত সরিয়ে সোজা হয়ে বসে মেহরিনের উপর নিজের শান্ত দৃষ্টি স্থির করে। মেহরিন কিয়ৎক্ষণ পূর্বে নিচে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে কোনো কথা না উঠিয়ে বললো….

—“কি হয়েছে তোমার! কেমন বিষন্ন লাগছে তোমাকে দেখতে। কোনো বিষয় নিয়ে কি চিন্তিত তুমি?”

রিজওয়ান শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে বললো….

—“অফিসে যাওয়ার পর অনেক খোঁজা-খুঁজি করে বাবার ফোন নাম্বারটা জোগার করেছিলাম আমি। কিন্তু ফোন দেওয়ার পর বারংবার ফোন বন্ধ দেখিয়েছে। ঐ নাম্বার দিয়ে অনলাইন সাইডে বিভিন্ন একাউন্ট ও খোলা আছে তার। কিন্তু সেখান দিয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। ৩দিন আগে সব জায়গা থেকে অনলাইন এ এক্টিভ ছিলেন তিনি। বাবাকে সব সত্য সম্পর্কে অবগত না করা পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাচ্ছি না মেহরিন। বাবার সাথে যোগাযোগ করতে না পারলে কিভাবে এই কাজটা সম্পন্ন করবো আমি! বাবার কোনো সমস্যা হলো কি না এ নিয়েও চিন্তা হচ্ছে আমার।”

রিজওয়ানের এরূপ কথাগুলো শুনে মেহরিনের চেহারা জুড়েও চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়। মেহরিন নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো….

—“এভাবে দু*শ্চিন্তা করো না তুমি। হয়তো বাহ্যিক কাজে বাবা অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যার দরুন ফোন বন্ধ করে রেখেছেন আর নিজের অনলাইন একাউন্ট গুলোতেও এক্টিভ হতে পারছেন না। ব্যস্ততা শেষ হলে নিশ্চয়ই তিনি তোমার সব কল, অনলাইন সাইডে যোগাযোগ করার চেষ্টা গুলোকে দেখবেন। ততোদিন অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর করার কিছু নেই। ধৈর্য রাখো। আল্লাহ আছেন আমাদের পাশে। তিনি যা করবেন নিশ্চয়ই তাতে আমাদের ভালোটাই হবে।”

মেহরিনের কথায় রিজওয়ান পূর্বের থেকে কিছুটা শান্ত হয়। কিয়ৎক্ষণ সম্পূর্ণ পরিবেশ জুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে। কিয়ৎক্ষণ পর রিজওয়ান বললো…

—“রাজিবুলের আনা ওমন সম্বন্ধ মেনে নেওয়া সম্ভব না এটা আমি বুঝতে পারছিই। কিন্তু রুমির বিয়েতে না করার পিছনে আরো অন্য কোনো কারণ আছে বলে মনে হচ্ছে না তোমার মেহরিন!”

রিজওয়ানের কথার ধরণে মেহরিন বুঝতে পারে সে রুমিকে সন্দেহ করছে। মেহরিন এবার মনঃস্থির করে সে রিজওয়ানকে রুমির সব সত্য সম্পর্কে অবগত করবে। নয়তো দিনকে দিন পরিস্থিতি আরো খা*রা*প পর্যায়ে চলে যেতে পারে। পরমুহূর্তেই মেহরিন বললো….

—“রুমি একজন ছেলেকে ভালোবাসে রিজওয়ান।”

মেহরিনের মুখে এরূপ কথা শুনে রিজওয়ান অবাক হয় না। রিজওয়ান স্মিত হাসি দিয়ে বললো….

—“কে সেই ছেলে?”

—“আমাদের এলাকার চেয়ারম্যান সাহেবের একমাত্র ছেলে জিহাদ।”

—“জিহাদ ছেলেটা খারাপ না। যথেষ্ট ভদ্র। এখনও বাহিরে কোথাও দেখা হলে সালাম দিয়ে সম্মানের সহিত কথা বলে। কিন্তু মূল সমস্যা চেয়ারম্যান সাহেবকে নিয়েই। লোকটা মোটেও সুবিধার নয়। অর্থবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের দু’নজরে দেখেন সবসময়। এছাড়াও ওনার অ*ন্যায়, অ*বৈধ কাজের তো হিসাব নেই। আমাদের বাড়ির মেয়ের সাথে উনি ওনার একমাত্র ছেলের বিয়ে দিতে সম্মতি জানাবেন কি না এ নিয়ে চিন্তিত আমি।”

—“এই বিষয়টা আমিও চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু রুমির আচারণ দেখে আমি যা বুঝেছি সে এই সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে আসবে না। তুমি বরং জিহাদের সাথে একাকী এই বিষয়ে কথা বলো একবার। সে কি বলে শুনো। তারপর যা করা দরকার মনে হবে তাই করবো আমরা।”

—“হুম ঠিক বলেছো। আমি আগামীকাল-ই জিহাদের সাথে দেখা করবো।”

(৪৫)
আরফা নিজরুমে বিছানায় বসে নিজের মায়ের ছবিতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো…..

—“মাম্মাম জানো..তোমার ছবিতে হাত বুলিয়ে দি যখন তখন মনে হয় আমি তোমার শরীর স্পর্শ করছি। মনে হয় তুমি আমার কাছেই আছো। মাম্মাম তুমি একদম আফসেট হইও না। খুব তাড়াতাড়ি আমি তোমার জায়গায় স্টার হয়ে গিয়ে তোমাকে বাবাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।”

আরহাম মাত্রই অফিস থেকে বাসায় ফিরেছে। আরফার রুম পেরিয়েই আরহামকে তার নিজের রুমে যেতে হয়। সেইসময় আরফার কন্ঠে এরূপ কথাগুলো শুনে অজান্তেই আরহামের বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। ছোট্ট আরফা যে এটা বুঝে না, কেউ যদি মারা যায় তাঁকে আর কখনও ফিরিয়ে আনা যায় না। একজন জিবীত মানুষের বদলে আরেকজন মৃত্যু মানুষকে ফিরিয়ে আনার মতো অসম্ভব শক্তি আল্লাহ কাওকে দেন নি। আরহাম ওভাবেই স্থির হয়ে আরফার রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়। কিয়ৎক্ষণ পর আরহাম আর না পেরে নিজরুমে চলে যায়। আরফা ওর বাবার উপস্থিতি বুঝতে পারে না।

#চলবে ইনশাআল্লাহ……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে