#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(১৫)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)
(৩১)
নিজরুমে বিছানায় পাশাপাশি বসে আছে ঊর্মিলা আর রফিকুল। ঊর্মিলা বললো…..
—“বড় ভাইয়ের মতো চালাক-চতুর কবে হবে তুমি শুনি?”
আকস্মিক ঊর্মিলার এমন প্রশ্নে রফিকুল ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললো….
—“কেনো বড় ভাই আবার কি এমন চালাকির কাজ করলো?”
—“চোখ থাকতেও অন্ধের মতো চলাফেরা করো তো তুমি, তোমার থেকে এমন প্রশ্নই আশা করা যায়।”
—“আরে হয়েছে টা কি সরাসরি বলো তো। আজাইরা কথা বলে কানের মাথা খেও না।”
—“হ্যা, এখন আমার কথা তো আজাইরাই মনে হবে। ঘরের বউ পুরাতন হয়ে গেছে না! একটা বাচ্চা হলে কি আর সেই বউয়ের প্রতি কোনো টান কাজ করে? তখন তো মন আরো ফুরফুরে হয়ে যায়। হাঁটুর বয়সী মেয়েদের দেখলে ছলাৎ ছলাৎ করে।”
—“কথার কি ধরণ, ছিহ্।”
ঊর্মিলা একবার মুখ বাঁকিয়ে বললো…….
—“তোমার বড় ভাই নিজেদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করার জন্য উপযুক্ত রাস্তা দেখে নিয়েছে তা কি দেখছো না! বাহিরের সম্পত্তিও পাবে ১৬ আনা আবার তোমার এই বোকা বোকা চাল-চলনের জন্য একদিন ঘরের সব সম্পত্তিও নিজের নামে লিখে নিবে। তখন রিজওয়ান বা ওর বউও কিছু করে উঠতে পারবে না। আমাদের সবাইকে এ বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে নিজের বউ-বাচ্চাকে নিয়ে রাজত্ব করবে।”
—“তোমার মাথায় এমন উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা গুলো আসে কি করে আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে ঊর্মি!”
—“আমি কোনো উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা করি নি। সকালে খেতে বসে তোমার ভাই যে তোমাদের একমাত্র বোনের জন্য এমন একটা সম্বন্ধ আনার কথা বললো সে বিষয়ে কি একটা বার ও ভেবে দেখেছিলে! এমন সম্বন্ধ আনার পিছনে তার কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে! তখন তো তোমার মুখশ্রী জুড়ে খুশির শেষ ছিলো না বোনের বিয়ে হবে ভেবে।”
—“উদ্দেশ্য! এখানে আবার উদ্দেশ্য কি থাকতে পারে?”
ঊর্মিলা ওর কপালে একবার চাপর দিয়ে আফসোসের স্বরে বললো….
—“ইয়া আল্লাহ, এ আমি কোন গ*র্ধ*ভকে ভালোবেসে বিয়ে করতে গেলাম!”
—“আমাকে অসম্মান না করে কখনও একটা বিষয় নিয়ে কথা পরিষ্কার ভাবে শেষ করতে পারো না তুমি তাই না!”
ঊর্মিলা শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বললো….
—“ঊর্মি-ঊর্মি-ঊর্মি…ঠান্ডা হ। এখন নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিবাদ করার সময় না।”
অতঃপর ঊর্মিলা আবার বললো….
—“তোমার ভাই আর তোমার আয়ের অবস্থা প্রায় একই। যদি শ্বশুড়মশাই খরচ না দিতেন তাহলে সত্যিই যে আমাদের জীবন এতোটা স্বচ্ছল ভাবে কাটতো না এ কথা আমি কখনও অস্বীকার করবো না। শ্বশুড় মশাই তো আমৃত্যু পর্যন্ত কষ্ট করে টাকা রোজগার করবেন না। আর এই বংশের আসল উত্তরাধিকার যে রিজওয়ান এ কথাও অস্বীকার করার জোঁ আমাদের নেই। সেই হিসাবে রিজওয়ান তোমার আর বড় ভাইয়ের থেকে কয়েকগুন বেশি সম্পত্তির ভাগ পাবে। সবদিক চিন্তা করেই তোমার বড় ভাই নিজের লাভের জন্য রুমির জন্য এমন একটা বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছেন। রুমির জন্য আনা সম্বন্ধে ঐ লোকের বয়স রুমির বয়সের দ্বিগুণের থেকেও বেশি। আবার তার দু’জন সন্তানও আছে। সয়-সম্পত্তির নাকি অভাব নেই। আবার বড় ভাইয়ের অফিসের ম্যনেজার ও উনি। রুমি বিয়ে সত্যিই ওখানে হলে অফিসের দিক থেকেও বড় ভাই লাভবান হবেন আবার ওনার যে বুদ্ধি! তা খাঁটিয়ে রুমির শ্বশুর বাড়ির সব সম্পত্তি নিজের নামে কিভাবে লিখে নিবেন কেউ বুঝতেও পারবে না। উনি সবদিক থেকে লাভবান হয়ে যাবেন। আর আমরা বসে বসে বুড়ো আঙুল চুষে খাবো।”
ঊর্মিলার মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে রফিকুলের কপালে চিন্তার কয়েকটা ভাঁজ স্পষ্ট হয়। কিয়ৎক্ষণ পর ঊর্মিলা আবারও বললো….
—“বাহির দিক থেকে লাভবান হতে পারো কিন্তু ভিতর দিক থেকে হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। একেবারে তো হাল ছেড়ে বসে থাকা যাবে না।”
রফিকুল ঊর্মিলার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি স্থির করলে ঊর্মিলা বললো…..
—“শ্বশুড় মশাই একেবারের জন্য দেশে ফিরে আসলে খুব বেশি দেড়ি করবেন না নিজের অর্জিত অর্থ ও সয়-সম্পত্তি সবার মাঝে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিতে। তার এই কাজ করার পূর্বেই তোমাকে এমন কোনো পরিকল্পনা সাজাতে হবে যেনো সব সম্পত্তি তুমি কেবল নিজের নামে লিখে নিতে পারো। বাকিরা শত চেষ্টা করেও যেনো এই সম্পত্তিতে ভাগ বসাতে না পারে।”
—“হুম তুমি ঠিক বলেছো। আমি ভাবছি এই বিষয়ে। তুমি কোনো চিন্তা করো না।”
রফিকুলের মুখে এরূপ কথা শুনে উর্মিলা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে।
(৩২)
পরেরদিন সকালে….
রুমির রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই শেফালি দেখলো রুমি কোথাও যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। শেফালি শান্ত স্বরে বললো….
—“কোথায় যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছো রুমি?”
শেফালির কন্ঠে এমন প্রশ্ন রুমির কর্ণপাত হতেই ওর মুখশ্রী জুড়ে একরাশ বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হয়। রুমি বিরক্তির স্বরে বললো….
—“ক’টা বাজে এখন? এই সময় আমি কোথায় যেতে পারি জানো না তুমি? আমার কি রসের শত শত বন্ধু-বান্ধব আছে যে তাদের বাড়িতে ঘুরতে যেতে পারবো!”
রুমির মুখে এমন ত্যড়া প্রতিত্তুর শুনেও তা শেফালি হজম করে নেয় অনায়াসেই। কেনো জানি না এখন আর আগের মতো কথায় কথায় মুখ লাগিয়ে কারোর সাথে ঝগড়া করতে ইচ্ছে হয় না ওর। অল্পতেই সমাধান হয়ে যাক এমনটা ভাবে সে। শেফালি ছোট্ট করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে বললো…..
—“তোমার ভাইয়ের আনা তোমার জন্য গতকালের সেই সম্বন্ধের জন্য ওর পাশাপাশি আমার উপরেও রেগে আছো তুমি তাই না রুমি!”
রুমি শেষ বারের মতো নিজেকে আয়নায় আরেকবার দেখে নিয়ে শেফালির দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো….
—“সকাল সকাল এই আজাইরা বিষয়ে কথা বলার কোনো ইচ্ছে আমার নেই বড় ভাবী। আজ আমার মনটা গতকালের তুলনায় অনেকটা ভালো আছে তাই কলেজের যাওয়ার কথা চিন্তা করেছি, এই শেষ মূহূর্তে এসে আমি চাই না এই বিষয়ে কথা বলে তুমি আমার যাওয়ার সম্পূর্ণ ইচ্ছে মাটি করে দাও।”
এই বলে রুমি শেফালিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বিছানা থেকে নিজের হাত ব্যগটা নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। শেফালি দরজার একপার্শে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে রুমির যাওয়ার পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়।
(৩৩)
নিজরুমে দরজা ভিতর থেকে আটকে দিয়ে বিছানার পাশে থাকা টেবিলের ড্রয়ার খুলে নিজের ফোনটা বের করে তা নিয়ে বিছানায় এসে বসেন রাহেলা বেগম। তার দৃষ্টি এখন বিছানার উপর রাখার তারই মোবাইলের উপর স্থির। পরক্ষণেই রুমের ভিতরে দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটার দিকে তাকাতেই দেখলেন ঘড়িতে তখন ১১টা বেজে ৫মিনিট। কিয়ৎক্ষণ যেতে না যেতেই রাহেলার ফোন বেজে উঠে। রাহেলার স্বামী শরীফ সাহেব ফোন করেছেন। রাহেলা বেগমের ঠোঁটে বাঁকা হাসির রেখা ফুটে উঠে। পরক্ষণেই হাসি থামিয়ে টেবিলের উপর থাকা পানির বাটি থেকে স্বল্প পরিমাণ পানি নিয়ে নিজের চোখ ভিজান তিনি। যেনো তাঁকে দেখে মনে হয় তিনি এতোসময় ধরে কান্না করছিলেন। মুখশ্রীর ভাব ও তেমন করলেন তিনি। অতঃপর শরীফ সাহেবের কল রিসিভ করেই তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি ন্য*কা কান্নার নাটক করতে করতে বললেন……
—“ওগো…আমার সব শেষ হয়ে গেলো গো। আমি এবার কি নিয়ে বাঁচবো। এমন দিন দেখার আগে আমার মরণ কেনো হলো না!”
রাহেলার মুখে আকস্মিক এমন কথা শুনে শরীফ সাহেব ভরকে যান। দ্রুততার স্বরে তিনি বললেন….
—“রাহেলা..কি হয়েছে তোমার? এভাবে কান্না করছো কেনো? আমার ছেলে-মেয়েরা সবাই সুস্থ আছে তো? বউমারা-বাচ্চারা ওদের কিছু হয় নি তো?”
—“সবাই সুস্থ আছে। কিন্তু আজ আমাকে আমারই এক ছেলের মুখে শুনতে হলো এতো বছরের চেষ্টায় সাজানো এই সংসার নাকি আমার না। আমি, আমার দুই – ছেলে – বউমারা আমরা সবাই নাকি এই সংসারের আগাছা। খুব তাড়াতাড়ি আমাদের সবাইকে এ বাড়ি থেকে চিরতরের জন্য বের করে দেওয়া হবে।”
শরীফ সাহেব অত্যন্ত অবাক স্বরে বললেন….
—“কি বলছো কি তুমি এসব রাহেলা! রিজওয়ান তোমাদের এমন কথা বলেছে?”
—“শুধু এতোটুকুই না। আরো অনেক কথা বলেছে সে আমাদের। আর এটা নতুন কিছু না। তোমার অবর্তমানে আমরা সবাই এখানে কিভাবে দিন পার করছি আমরা জানি। সবসময় রাজিবুল আর রফিকুলকে এটা বলে খোঁটা দেয় সে যে, ওদের দুজনের জন্মদাতা পিতা তুমি নও। তাই এই বাড়ির সব সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকার সে নিজে। আর রইলো রুমির কথা। খুব তাড়াতাড়ি ওকে দায়সারা ভাবে বিয়ে দিয়ে এ বাড়ি ছাড়া করার ব্যবস্থা করবে রিজওয়ান। তারপর আমাদেরও এ বাড়ি থেকে বের করে দিবে সে। এতোদিন সংসারে অশান্তি হবে ভেবে আমরা সবাই সব অন্যায়-অবিচার মুখ বুঝে সহ্য করে গিয়েছিলাম। তোমার কাছে কখনও এসব নিয়ে কোনো অভিযোগ করি নি কেউ। কিন্তু এবার সব সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে গিয়েছে। তাই সম্পূর্ণ সত্য সম্পর্কে তোমাকে অবগত না করে পারলাম না। আমার মন আর আমার সৃষ্টিকর্তা খুব ভালোভাবেই জানে আমি বা আমার ছেলে-মেয়েরা আসলে কেমন। আমরা সবাই সেই শুরু থেকে রিজওয়ানকে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করে এসেছি। কিন্তু রিজওয়ান না কখনও আমাকে তার মায়ের স্থানে বসিয়ে সম্মান দিয়েছে আর না আমার ছেলে-মেয়েদের নিজের ভাই-বোন মনে করে শ্রদ্ধা-স্নেহ করেছে। সবকিছু হাতের বাহিরে চলে যাওয়ার আগে তুমি দেশে চলে এসো। আমাদের সাথে হওয়া এই অন্যায়ের সুবিচার পাওয়ার আশায় মুখর হয়ে বসে আছি আমরা।”
রাহেলার বলা সম্পূর্ণ কথা গুলো শুনে শরীফ সাহেবের মুখশ্রী জুড়ে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়। তিনি যেনো কিছুতেই নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তার ও তার প্রথম স্ত্রীর ভালোবাসার চিহ্ন রিজওয়ান এতোটা নিম্ন মানসিকতার হতে পারে তা তিনি ভাবতেও পারছেন না। শরীফ সাহেব কিছু না বলে কল কেটে দিলেন। কল কেটে গিয়েছে বুঝে রাহেলা শাড়ির আঁচল টেনে নিজের চোখে-মুখে লেগে থাকা পানি গুলো মুছতে মুছতে বললেন…..
—“সঠিক সময় সঠিক স্থানে বিষমন্ত্র উগলে দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করে দিলাম। এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত লাগছে।”
এই বলে রাহেলা নিঃশব্দে হাসতে থাকেন।
#চলবে ইনশাআল্লাহ………..
#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(১৬)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)
(৩৪)
বিকেলবেলা…..
আমজাদ চৌধুরী নিজরুমে হেলানো চেয়ারে শরীর এলিয়ে বসে আছেন আর বই পড়ছেন। সেইসময় আরফা ওর বুকের সাথে একহাত দিয়ে ছোট্ট একটা টেডি জড়িয়ে নিয়ে আমজাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো….
—“দাদু..দাদু..শুনো একটু আমার কথা।”
আরফার কন্ঠ কর্ণপাত হতেই আমজাদ সোজা হয়ে বসে হাত থাকা বইটা বন্ধ করে পাশের ছোট্ট টেবিলের উপর রাখতে রাখতে আদুরে স্বরে বললেন….
—“আরে আমার দিদিভাই এসেছে যে, কি বলতে চাও তুমি আমায় দিদিভাই?”
আরফা বললো….
—“দাদু তুমি আমাকে নামাজ কিভাবে পড়তে হয় তা শিখিয়ে দিবে! আমি নামাজ পড়তে চাই।”
ছোট্ট আরফার মুখে এরূপ কথা শুনে আমজাদ কিছুটা অবাক হলেন। মাত্র ৫ বছর বয়সের বাচ্চা নামাজি শিক্ষা নিতে চাচ্ছে এতো আগ্রহের সাথে! আমজাদ হাসিমুখে বললেন….
—“এ তো অনেক ভালো কথা দিদিভাই। আমি অবশ্যই তোমাকে শিখাবো কিভাবে নামাজ আদায় করতে হয়। আর নামাজে থাকাকালীন কোন কোন সূরা গুলো পড়া তোমার জন্য সুবিধাজনক হবে সেগুলোও মুখস্থ করতে সহোযোগিতা করবো। একটু পর আছরের আজান দিবে। তখন তোমাকে শিখিয়ে দিবো কেমন!”
—“ঠিক আছে দাদু।”
এই বলে আরফা গুটি গুটি পায়ে আমজাদের রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। আমজাদ নিরব হয়ে আরফার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রন।
(৩৫)
অফিসে নিজ টেবিলে বসে আছে রিজওয়ান। এখন ১৫মিনিটের ব্রেক টাইম পেয়েছে সে। চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে মনে মনে চিন্তা করছে সে তার ‘বাবাকে সম্পূর্ণ সত্য সম্পর্কে কিভাবে অবগত করা উচিত হবে’। কিয়ৎক্ষণ পর রিজওয়ানকে হাতের বাম পার্শে ওদের অফিসের অনেক পুরোনো মধ্যবয়সের একজন পুরুষ পিওন এসে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললেন….
—“ছোট স্যার আপনাকে তার কেবিনে ডেকে পাঠিয়েছেন এক্ষুণি।”
রিজওয়ান সোজা হয়ে বসে বললো…
—“আচ্ছা আমি যাচ্ছি।”
পিওন স্থান ত্যগ করা মাত্র রিজওয়ান ও আরহাম চৌধুরীর কেবিনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে। কিয়ৎক্ষণ পর আরহামের কেবিনের দরজার সামনে এসে দাড়িয়ে নক করে ভিতরে যাওয়ার অনুমতি চাইলে আরহামের অনুমতি পেয়ে রিজওয়ান তার কেবিনে প্রবেশ করে শান্ত স্বরে বললো….
—“স্যার..আপনি আমাকে ডেকেছিলেন?”
আরহাম শান্ত স্বরে বললো….
—“জ্বি, বসুন এখানে।”
রিজওয়ান বিনাবাক্যে আরহামের সম্মুখপানে রাখা চেয়ারটি টেনে সেখানে বসে। পরক্ষনেই আরহাম বললো…
—“অফিসে জয়েন হয়েছেন পর আমার নানান ব্যস্ততার কারণে আপনার সাথে পারসোনালি কথা বলা হয় নি এখনও। বাবার থেকে শুনেছিলাম অনেক আগেই। আপনার জন্য আমার বাবার প্রাণ রক্ষা হয়েছিলো। আপনার কাছে সেই সূত্রে আমি ঋণী হয়ে আছি। আমার জীবনে আমার বাবার মূল্য অনেক বেশি। তাঁকে আমি অনেক ভালোবাসি। তিনি ছাড়া আমার আপন বলতে এ পৃথিবীতে ২য় কেউ নেই।”
আরহামের মুখে এরূপ কথা শুনে রিজওয়ানের মনে পরে প্রথম পরিচয়ের দিন আমজাদের বলা কথাগুলো। আমজাদের সাথে থাকা সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটি আরফাকে আরহাম আজও নিজের মেয়ে বলে মেনে নেন নি তা আজ আরো পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারলো রিজওয়ান। নিজের ভিতরে দলা পেকে আসা কিছু প্রশ্নগুলোকে আর বের হতে দিলো না সে। শব্দ করে কেবল একবার নিঃশ্বাস ফেললো রিজওয়ান। কিয়ৎক্ষণ পর আরহাম আবারও বললো….
—“বাবা খুশি হয়ে আপনাকে আমাদের কোম্পানিতে চাকরি দিয়েছেন। এই কাজের পাশাপাশি তিনি আমাকে কড়া শব্দে বলে দিয়েছেন আমি যেনো আপনাকে কোম্পানি থেকে সবরকম সুযোগ সুবিধা দেই।”
এই বলে আরহাম ওর হাতের ডান পার্শে থাকা টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা সপিং ব্যগ বের করে রিজওয়ানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো….
—“এই ব্যগটিতে আপনার জন্য একটি এনড্রয়েড ফোন আর ২ মাসের বেতন রাখা আছে।”
আরহামের এরূপ কথা শুনে রিজওয়ান কিছুটা অবাক হয়। রিজওয়ান শান্ত স্বরে বললো….
—“স্যার আপনারা আমায় এতো বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছেন। সেদিন বড় স্যারের প্রাণ আল্লাহ তায়ালার রহমতে বেঁচে গিয়েছে। আমি তো উছিলা ছিলাম মাত্র। তাই মানবিকতার খাতিরে যতোটুকু করা যায় করেছিলাম।”
—“আপনার করা উপকারের ফলসরূপ এই সুযোগ-সুবিধা গুলো পাচ্ছেন আপনি। যদি এগুলো গ্রহন না করেন তাহলে বাবার কড়া জবাবের সম্মুখীন হতে হবে আমায়। যা আমি চাই না। তাই না করবেন না।”
অতঃপর রিজওয়ান বাধ্য হয়ে আরহামের দেওয়া উপহার সামগ্রীগুলো গ্রহন করে। আরহাম আবারও বললো….
—“সামনের শুক্রবারে আপনার স্ত্রীকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসবেন। দুপুরের খাবার একসাথে খাবো৷ এই দাওয়াত আমার তরফ থেকে। আর এ বিষয়ে আমি কোনো নারাজ বাক্য শুনতে রাজি নই। নিঃশব্দে মেনে নিন। মন থেকে খুশি হবো।”
রিজওয়ান হাসিমুখে বললো….
—“ঠিক আছে স্যার।”
অতঃপর রিজওয়ান বসা অবস্থা থেকে উঠে আরহামের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে।
(৩৬)
রাতের বেলা,
রাজিবুল বিছানায় শুয়ে আছে আর শেফালি রাজিবুলের মাথার পাশে বসে ওর মাথায় তেল মালিশ করে দিচ্ছে। রাজিবুল বললো…
—“রুমির সাথে আমার আনা সম্বন্ধের বিষয়ে কথা বলেছিলে?”
শেফালি শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে বললো…
—“সকালে গিয়েছিলাম রুমির সাথে কথা বলতে। কিন্তু সে আমার সাথে খামোখাই উগ্র আচারণ করলো। আর বললো আমি যেনো এই সম্বন্ধ নিয়ে ওর সাথে কথা বলে ওর মুড নষ্ট করে না দেই।”
শেফালির মুখে এরূপ কথা শুনে রাজিবুলের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে চট করে শোয়া থেকে উঠে বসে রাগী স্বরে বললো….
—“তোমাকে সামান্য একটা কাজ দিয়েছিলাম আর তুমি সেটা করতে পারলে না! কোথায় আগে তো কখনও রুমি তোমার সাথে উগ্র আচারণ করার সাহস পেতো না! যদিও উঁচু গলায় একটা কথা বলতে আসতো তখন তুমি ওর মুখ বন্ধ করে দেওয়ার মতো কথা ওকে শুনিয়ে দিতে। আমি তোমার ভিতর আমার পুরোনো শেফালিকে খুঁজে পাই না এখন। সেদিনের পর থেকে কেনো নিজেকে এতোটা পরিবর্তন করে ফেললে তুমি? যদি সময় থাকতে নিজেকে পূর্বের ন্যয় করতে না পারো তাহলে সম্পর্কের ১০ বছরের মাথায় এসে এই সম্পর্ক নিয়ে আমার ২য় বার ভাবতে হবে।”
এই বলে রাজিবুল বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। শেফালি নিরব হয়ে রাজিবুলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়। নিজ রুম থেকে বেড়িয়ে রাজিবুল সোজা ওর মা রাহেলা বেগম এর রুমে আসে। রাহেলা বিছানায় আয়েশী ভঙ্গীতে বসে পান চিবুচ্ছিলেন। সেইসময় রাজিবুলকে গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে নিজ রুমে প্রবেশ করতে দেখে রাহেলা বললেন….
—“আরে আমার বড় বা’জানের মুখটা এমন গম্ভীর হয়ে আছে কেনো? কি হয়েছে বা’জান! আমার পাশে এসে বোস বাবা।”
রাজিবুল ওর মায়ের পাশে এসে বসে বললো….
—“মা তুমি আমাকে ভালোবাসো তো?”
রাহেলা অবাক স্বরে বললেন….
—“হঠাৎ এমন প্রশ্ন করছিস কেনো বাবা?”
—“উল্টো প্রশ্ন না করে যা জিজ্ঞাসা করলাম তার উত্তর দাও।”
—“এটা আবার জিজ্ঞাসা করতে হয় রে! তুই, রফিকুল আর রুমি তোরা তিনজন-ই তো আমার কলিজার টুকরো। তোদের তিনজনকে ঘিরেই তো আমার সকল ভালোবাসা।”
—“আমার কারণে তুমি প্রথম ‘মা’ ডাক শুনতে পেরেছিলে সেই সূত্রে তোমার নিকট আমার হক রফিকুল আর রুমির থেকে বেশি হওয়া উচিত নয় কি!”
—“কি হইছে তোর বা’জান? এমন এমন কথা বলছিস কেনো তুই?”
—“যদি তুমি তোমার বড় সন্তানকে হারাতে না চাও আর তার ভালো হোক এমনটা চাও তাহলে রুমির জন্য
আমার আনা সম্বন্ধে ওকে সম্মতি জানাতে বাধ্য করিও।”
—“রাজিবুল! কি বলছিস তুই এসব? রুমি তোদের একমাত্র ছোট বোন। নিজের ভালোর জন্য তুই বোনকে কু*র*বানি দিতে চাচ্ছিস কি করে?”
রাজিবুল তেজী স্বরে বললো….
—“ভুলে যেও না মা রুমির শরীরে আমার বাবার রক্ত বইছে না। তুমি কেবল ওকে পেটেই ধরেছিলে। আমাদের নাড়ির টান একই হতে পারে কিন্তু আমাদের পৈতৃক সূত্র আলাদা। তাই নিজের ভালোর জন্য রুমিকে কু*র*বানি দিতে চাওয়া অ*ন্যায় কিছু নয়।”
—“রাজিবুল বাপ আমার! মাথা ঠান্ডা কর। এসব চিন্তা-ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল তুই। আমার কাছে তুই, রফিকুল এর থেকে রুমির গুরুত্ব কোনো অংশে কম না। আমি চাই তোরা তিন জন-ই ভালো থাক, সুখে-শান্তিতে থাক। এক সন্তানের সুখের জন্য আমি মা হয়ে আরেক সন্তানকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ের জন্য জো*র-জ*ব*রদ*স্তি করতে পারবো না।”
রাজিবুল বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রাগে হিসহিসিয়ে বললো….
—“যদি তুমি আমার কথা না শুনো তাহলে তোমার বৃদ্ধ বয়সে তুমি তোমার পাশে আমাকে পাবে না। তোমার মৃত্যুর সময় তোমার মুখে পানি দেওয়ার জন্য তোমার ছোট ছেলে, মেয়ে কেউ থাকবে না। এই কথাটা মনে রেখো।”
এই বলে রাজিবুল রাহেলাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহনিয়ে তার রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। এতোসময় ধরে রাহেলার রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে রুমি ওদের দু’জনের সম্পূর্ণ কথপোকথন শুনেছে। রাজিবুল বেড়োনোর পূর্বেই সে সাবধানে স্থান ত্যগ করেছিলো। রুমির দু’চোখ বেয়ে কেবল অঝোর ধারায় অশ্রু গড়ে পড়ছে। ভাগ্য তাকে এ কোন মোড়ে এনে দাঁড় করালো। বাবা সমতুল্য বড় ভাই কিনা নিজের সুখের কথা চিন্তা করে তার সুখকে কু*র*বা*নি দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করেছে! রুমির কানে কেবল সেই সময়ের কথা গুলো বাজছে।
#চলবে ইনশাআল্লাহ………..