আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ পর্ব-১১+১২

0
259

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(১১)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(২২)
মেহরিনের ডাকাডাকি চিৎকারে বাড়ির বাকি সদস্যরা ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হয়। রাহেলা আর রুমিও এসেছে আবারও। রুমির চেহারায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। রুমি বিরবিরিয়ে বললো….

—“মায়ের হাতে থা*প্প*ড় খেয়েছে না, এখন অতিরিক্ত যত্ন পাওয়ার জন্য অজ্ঞান হওয়ার নাটক করছে। তোমাকে আমি চিনি না মনে করেছো মেজো ভাবী! ভুলেও আমি এখন তোমার ধারের কাছে ঘেঁষতে যাবো না।”

মেহরিন শেফালির দিকে তাকিয়ে বললো….
—“বড় ভাবী..মেজো ভাবী জ্ঞান ফেরানোটা জরুরী। মেঝের উপর এভাবে রাখা ঠিক হবে না। তাকে ধরো। রুমে নিয়ে যেতে হবে।”

মেহরিনের কথানুযায়ী শেফালি ঊর্মিলার শরীরের উপরিভাগ ধরে আর মেহরিন নিচেরভাগ ধরে উঠিয়ে রুমের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। অজ্ঞান হওয়ার পর সর্বশরীরের ভার ঊর্মিলা ছেড়ে দিয়েছে। স্বাভাবিক এর তুলনায় ওজন যেনো বেড়ে গিয়েছে। মেহরিন আর শেফালির দু’জনের ঊর্মিলাকে নিয়ে যেতে ভিষণ বেগ পেতে হচ্ছে। রাহেলা ওদের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে দাঁড়িয়ে আছে কেবল। রুমি একবার ভেং*চি কেটে শেফালি, ঊর্মিলা আর মেহরিনের পাশ কাটিয়ে আগে আগে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হয়। শেফালি রুমির এরূপ কাজে যথেষ্ট অবাক হয়। আজ ঊর্মিলার দূ*র্সময়ে রুমি বা রাহেলা কেউই ওর পাশে দাঁড়ালো না কাল যদি শেফালির নিজের কোনো বি*প*দ হয় তখনও যে তারা এভাবেই মুখ ফিরিয়ে নিবে না তারও তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। শেফালি একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাত্র। কিয়ৎক্ষণ পর শেফালি আর মেহরিন ঊর্মিলাকে তার নিজরুমে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়। মেহরিন দ্রুততার স্বরে বললো….

—“বড় ভাবী তুমি মেজো ভাবীর কাছেই বসে থাকো আমি এক গ্লাস পানি আর একটা চামচ নিয়ে এক্ষুণি আসছি।”

এই বলে মেহরিন ঊর্মিলার রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। শেফালি মেহরিনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বললো…

—“জীবনে দূ*র্সময় না আসলে কে আপন কে পর তা বুঝতে পারার যায় না। ছোট…যেই মেহরিনের সাথে আমি আর তুমি সবসময় যাচ্ছে নয় তাই ব্যবহার করেছিলাম, ছোট-বড় কতো অপমান মূলক কথা শুনিয়েছিলাম সেই মেহরিন-ই তোমার বি*প*দের সময়ে পাশে এসে দাঁড়ালো।”

শেফালির কথা শেষ হতে না হতেই মেহরিন গ্লাসে করে পানি আর চামচ নিয়ে আবারও ঊর্মিলার রুমে প্রবেশ করে ওর মাথার অন্যপার্শে বসে ওর চোখ-মুখে পানির ছিটা দিতে শুরু করে। মেহরিন পানির গ্লাসটা শেফালির হাতে দিয়ে ঊর্মিলার মুখ খুলতেই দেখে দাঁতের সাথে দাঁত ভিষণ শক্ত ভাবে বসে আছে। মেহরিন বললো….

—“বড় ভাবী, আমি এই চামচের সাহায্যে মেজো ভাবীর বসে যাওয়া দাঁত খোলার চেষ্টা করছি। তুমি একটু পর পর মেজো ভাবীর চোখে-মুখে পানির ছিটে দিতে থেকো।”

অতঃপর মেহরিন ওর কাজ শুরু করে, শেফালিও মেহরিনের কথানুযায়ী কাজ করে। বেশকিছু সময় ধরে চেষ্টা করার পর অবশেষে ঊর্মিলার সেন্স ফিরে। সেন্স ফেরা মাত্র সে কাশতে শুরু করে। মেহরিন দু’হাতে ঊর্মিলাকে ধরে উঠে বসতে সাহায্য করে। মিনিট দু’য়েক পর ঊর্মিলা তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিক হয়ে যায়। নিজের পাশে শেফালি আর মেহরিনকে দেখে ঊর্মিলা অনুশোচনা বোধের কারণে নিজের মাথা নুইয়ে ফেলে। মেহরিন আবারও বললো….

—“মেজো ভাবী…তুমি বিশ্রাম করো। আমি তোমার জন্য কিছু খাবার বানিয়ে আনছি। বড় ভাবী আছে তোমার পাশেই।”

এই বলে মেহরিন বিছানা থেকে নেমে ঊর্মিলার রুম থেকে বেড়িয়ে রান্নাঘরে চলে আসে। ঊর্মিলা শেফালির দিকে তাকিয়ে বললো….

—“বড় ভাবী…আমাকে ক্ষমা করে দিও তুমি। সকালে আমি তোমার সাথে অকারণেই ঝ*গ*ড়া করেছিলাম। আম্মার কাছে বানিয়ে, বাড়িয়ে মি*থ্যে বলেছিলাম। আমি আমার আচারণ ও কাজের জন্য ভিষণ ভাবে লজ্জিত। সবকিছু ভুলে তুমি আর মেহরিন আমার এই দূ*র্সময়ে যে এভাবে পাশে এসে দাঁড়াবে আমি ভাবতেও পারি নি।”

ঊর্মিলাকে এই প্রথম এতো নম্রস্বরে কথা বলতে দেখে শেফালির বুকের ভিতরে এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতে শুরু করে। কিয়ৎক্ষণ নিরব থাকার পর শেফালি বললো….

—“সেসব কথা ছাড়ো, আগে বলো হুট করেই এভাবে অজ্ঞান হয়ে গেলে কি করে তুমি! আম্মা বা রুমির সাথে কি কোনো ঝামেলা হয়েছে তোমার ছোট?”

ঊর্মিলা একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুরো ঘটনা খোলাশা করে তুলে ধরলো শেফালির সামনে। অতঃপর বললো….

—“আমার কথাগুলো বিশ্বাস করা হয়তো তোমার জন্য ক*ষ্ট*কর হবে। এবারও মি*থ্যা, বানোয়াট কথা বলছি এমন মনে হবে। কিন্তু আমি এখন একটা শব্দ ও মি*থ্যা বলি নি মেজো ভাবী।”

ঊর্মিলার মুখে সম্পূর্ণ কথাগুলো শুনে শেফালি যেনো কয়েক সেকেন্ডের জন্য বাক*রুদ্ধ হয়ে যায়। ঊর্মিলা আর শেফালির মাঝের নিরবতার দেওয়াল ভেঙে শেহতাজ আর ঊষা রুমে প্রবেশ করে বিছানায় উঠে বসে। ঊষা ওর মায়ের একেবারে সংস্পর্শে এসে নিজের ছোট্ট হাতজোড়া দিয়ে তার হাত ধরে বললো….

—“আম্মু তোমার কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলো আমায়। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করে দিবো। দেখবে তোমার সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে।”

ঊষার মুখে এরূপ কথা শুনে ঊর্মিলার দু’চোখ ছলছল করে উঠে। ঊর্মিলা বললো…

—“এখন আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না মামনি। আল্লাহর কাছে দোয়া করলে তিনি অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে দেয় এইটা তোমাকে কে শিখিয়েছে মা!”

ঊষা হাসিমুখে বললো…
—“ছোট্ট চাচী শিখেয়েছে। ছোট্ট চাচী তো আমাকে আর ভাইয়াকে অনেক কিছু শিখান প্রতিদিন।”

ঊর্মিলা শেফালির দিকে একপলক দেখে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাত্র। কিয়ৎক্ষণ পর মেহরিন একটা ট্রে হাতে নিয়ে ঊর্মিলার রুমে প্রবেশ করে। মেহরিনকে আসতে দেখে শেফালি ঊর্মিলার পাশ থেকে উঠে অন্যপাশে গিয়ে বসে। মেহরিন শেফালির পূর্বের স্থানে বসে বললো….

—“মেজো ভাবী, আপাতত তোমার জন্য কয়েক প্রকার সবজি দিয়ে এই পাতলা ঝোল বানিয়ে এনেছি। এটুকু খেতে পারলে তোমার শারীরিক দূর্বলতা অনেকটা কেটে যাবে।”

ঊর্মিলা নিঃশব্দে মেহরিনের কথা মেনে নিয়ে খেতে শুরু করে। ঊষা, শেহতাজ এমনকি শেফালিও গভীর দৃষ্টি নিয়ে ঊর্মিলাকে খেতে দেখছে। মেহরিন বিষয়টা লক্ষ্য করে বললো…

—“তোমাদের কি ক্ষুধা পেয়েছে!”

শেফালি নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিরব রয়। ঊষা শেহতাজের দিকে একপলক দেখে উপরনিচ মাথা নাড়ায়। মেহরিন শেহতাজের দিকে তাকালে শেহতাজ মাথা নুইয়ে ফেলে। ভালো-মন্দ বোঝার সামান্যতম বুদ্ধি ওর হয়েছে। মেহরিন ওদের নিরবতার ভাষা বুঝতে পেরে বললো….

—“তোমরা কিছুসময় অপেক্ষা করো আমি তোমাদের জন্য চটজলদি কিছু বানিয়ে আনা চেষ্টা করছি।”

এই বলে মেহরিন আবারও রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। অতিরিক্ত ক্ষুধার কারণে ঊর্মিলার এতোসময় ধরে যেনো এসবের প্রতি কোনো খেয়াল ই ছিলো না। সে দ্রুত পারছে নিজের হাতে থাকা বাটিতে রাখা খাবার গুলো শেষ করছে। শেফালি এখনও নিরব হয়েই বসে রয়।

(১২)
রাতের বেলা….
নিজরুমে আয়নার সামনে বসে শেফালি নিজের চুল চিরুনি করছে। সেইসময় রাজিবুল ক্লান্ত মুখশ্রী নিয়ে রুমে প্রবেশ করে আলনার কর্ণারে কাঁধের ব্যগটা রেখে বিছানায় এসে বসে পরণের শার্ট খুলতে শুরু করে। শেফালি বললো….

—“আমরা মানুষ চিনতে বড্ড ভুল করেছি জানো!”

শেফালির মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে রাজিবুল বেশ অবাক হয়ে যায়। রাজিবুল শেফালির দিকে তাকিয়ে অবাক স্বরে বললো…

—“রাতে-বিরাতে উল্টো-পাল্টা কিছু খেয়েছো নাকি তুমি শেফালি!”

—“আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আর স্বাভাবিক আছি। আজ আসলে কে আমাদের আপন আর কে আমাদের পর তা একটু হলেও বুঝতে পেরেছি আমি।”

—“এতো হেয়ালি না করে কি হয়েছে সেটা খোলাসা করে বলো তো।”

অতঃপর শেফালি দুপুরের পর ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা রাজিবুলকে খোলাসা করে বলে। সম্পূর্ণ ঘটনা শোনার পর রাজিবুল কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে হুট করেই শব্দ করে হাসতে শুরু করে। রাজিবুলের হাসির শব্দ শুনতে পেয়ে শেফালি ওর দিকে ঘুরে বসে বললো…

—“হাসছো কেনো এভাবে?”

রাজিবুল হাসি থামিয়ে বললো…
—“এ আমি কোন শেফালিকে দেখছি! আজ সকালেই যেই শেফালিকে রেখে আমি অফিসে গেলাম তুমি আদেও সে! মাত্র কয়েক ঘন্টার ভিতরে একটা মানুষের ভিতর এতোটা পরিবর্তন হতে পারে কি করে?”

—“আমি শুধু স্বার্থ বুঝে পাশে থাকা মানুষ আর নিঃস্বার্থ ভাবে পাশে থাকা মানুষের মাঝে পার্থক্যটা দেখাতে চাইছি তোমায় রাজিব।”

—“তোমার চোখে ইতিমধ্যেই একটা পর্দা পড়তে শুরু করেছে বুঝলে! তুমি নিজের চিন্তা-বুদ্ধি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছো।”

—“তেমন কিছুই না।”

—“মেহরিন আর ওর স্বামীই আসল মুখোশধারী এটা বুঝতে শিখো।”

—“এভাবে বলো না। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা উচিত আমাদের।”

—“ভুলে যেও না শেফালি, রিজওয়ান আমার শরীরে হাত উঠানোর ও আমাকে অপমানমূলক কথা শোনানোর সাহস করেছিলো। আমি বা আমার ভাই যে এ বাড়ির বংশধর নই এমনটাও বলেছিলো সে। হুট করেই আমাদের সাথে দুর্বব্যহার করে আবার হুট করেই আমাদের প্রতি সহানুভূতি আচারণের শেষ থাকে না ওদের। এরা মুখোশধারী নয়তো কারা মুখোশধারী হবে শুনি! আমাদের দল ভাড়ি আর ওরা মাত্র দু’জন তাই আমাদের সাথে ভালোমানুষি আচারণ দেখিয়ে আমাদের মনে দূর্বলতার জায়গা করে নিতে চাইছে ওরা। এরপর সুযোগ বুঝে আমাদের পিঠে ছু*ড়ি ঢুকিয়ে প্র*তা*রণা করতেও দু’বার ভাববে না বুঝলে! আর তুমি ঊর্মিলার বলা কথাগুলোই বা বিশ্বাস করে নিলে কি করে? ও তো একটা নাটক*বা*জ স্বভাবের মেয়ে। হয় যদি ১ শতাংশ তা নিজের মতো করে বাড়িয়ে আরো ৯৯ শতাংশ করে তুলে ধরবে। যেনো সে ধোঁয়া তুলসি পাতার মতো স্বচ্ছ আর বাকিরা ওর খুব খারাপ। আম্মা আর রুমির প্রতি আমার শতভাগ বিশ্বাস আছে। আম্মা তোমার বা ঊর্মিলার সাথে অকারণে কোনোরূপ খারাপ আচারণ করবেন না আমি জানি। তাই কে আসলে আমাদের আপন আর কে আমাদের পর তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে যেও না। আম্মা, রুমি আর রফিকুল ই আমাদের আসল আপন মানুষ ছিলো, আছে ওরাই সারাজীবন থাকবে।”

এই বলে রাজিবুল ওয়াশরুমে চলে যায়। শেফালি নিরব হয়ে রাজিবুলের বলে যাওয়া কথাগুলো ভাবে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ…….

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(১২)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(২৪)
রাতের বেলা…..
আঙিনায় এপাশ থেকে ওপাশ তো ওপাশ থেকে এপাশ পায়চারি করতে করতে বারবার মূল দরজার দিকে নিজের অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে মেহরিন। কিয়ৎক্ষণ পর ডায়নিং টেবিলের সম্মুখে থাকা দেওয়ালের উপর রাখা ঘড়ির দিকে দৃষ্টি যায় মেহরিনের। ঘড়িতে তখন ৯ টা বেজে ৩০ মিনিট। রিজওয়ানের অফিসে আজই প্রথম দিন ছিলো। আজই এতো দেড়ি হচ্ছে কেনো ওর বাড়ি ফিরতে সে বিষয়ে চিন্তা করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না মেহরিন। মেহরিনের চিন্তার ঘোর কাটে মূল দরজা থেকে ভেসে আসা রিজওয়ানের ডাকে। মেহরিন দ্রুততার সাথে রিজওয়ানের দিকে তাকিয়ে ওকে সুস্থ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছোট্ট করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে। অতঃপর রিজওয়ানের কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধে থাকা ব্যগটা নিজ হাতে নিয়ে বললো….

—“প্রথম দিন-ই এতো দেড়ি হলো যে! কাজের কি খুব চাপ পড়েছে তোমার উপর?”

রিজওয়ান মেহরিনের দিকে একপলক তাকিয়ে স্বচ্ছ হাসি দিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হতে বললো….

—“কাজ তো আজ থেকে শুরু হলো মাত্র। রোজই এমন দেড়ি হবে বাড়ি ফিরতে। আমজাদ চাচা বলেছেন কাজের প্রতি আমি যতো বেশি গুরুত্ব দিবো, যতোবেশি দক্ষতা অর্জন করবো আর আমার কাজ দ্বারা কোম্পানির যতো বেশি লাভ হবে আমার পদ ততোই দ্রুত উপরের দিকে যাবে।”

মেহরিন রিজওয়ানের সাথে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে কৌতুহলের স্বরে প্রশ্ন করলো….
—“কি কাজ করতে হয় সেখানে তোমায়?”

—“অফিসে আমার মতো আরো ৩শ কর্মচারী আছে জানো। তাদের সবাইকে মোট ২০টা গ্রুপে ভাগ করে কাজ বুঝিয়ে দিয়েছেন স্যার। আমার কাজ এতোটা কঠিন না কিন্তু এই ২০টা গ্রুপের তৈরিকৃত ৪০টা হাতে কলমে লেখা ইংরেজি শব্দের চিঠি আমাকে একস্থানে বসে কম্পিউটারে টাইপ করে বিভিন্ন জায়গায় মেইল করে দিতে হয়। আমি যাওয়ার পর আমজাদ চাচা আমার সব সার্টিফিকেট গুলো চেক করে আমাকে একজন দক্ষ কর্মচারীর আন্ডারে দিয়ে কিভাবে কম্পিউটারে টাইপ করতে হয় আর কিভাবে মেইল করতে হয় সেইসব শিখিয়ে দিয়েছেন। আজ নতুন তো তাই সব কাজ শিখে উঠতে উঠতে লম্বা সময় লেগে গিয়েছিলো আমার। তবে কাজ করতে আমার ভিষণ ভালো লাগছিলো জানো! নিজেকে কেমন স্বাধীন লাগছিলো।”

মেহরিন মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে রিজওয়ানের দিকে তাকিয়ে এতোসময় ধরে বলা ওর সব কথা শুনলো। কথা বলতে বলতেই রিজওয়ান মেহরিনকে নিয়ে নিজরুমে চলে এসেছে। রিজওয়ান মেহরিনের দিকে তাকিয়ে বললো…

—“বউ আমার না ভিষণ ক্ষুধা লেগেছে। খেতে দিবে একটু!”

রিজওয়ানের মুখে এরূপ কথা শুনে মেহরিনের হুস ফিরে। কথার তালে সে খেয়াল হারা হয়ে গিয়েছিলো যে রিজওয়ানকে খেতে দিতে হবে। মেহরিন বললো…

—“তুমি হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় পরিবর্তন করে নাও আমি এক্ষুণি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।”

এই বলে মেহরিন দ্রুত কদমে রুম থেকে বেড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করে। মেহরিন রান্নাঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখলো রুমি একটা টিফিন বাটিতে খাবার উঠাচ্ছে। এতো রাতে রুমিকে এমন কাজ করতে দেখে মেহরিন কিছুটা অবাক হয়। পরক্ষণেই মেহরিন কোনো সাড়াশব্দ না করে আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে পরে রুমি কি করে তা দেখার উদ্দেশ্যে। কিয়ৎক্ষণ পর রুমি টিফিন বাটিটা হাতে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে চারপাশ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে ধীর কদমে মূল দরজার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। মেহরিন আড়াল থেকে বেড়িয়ে নিজমনে বললো…

—“এতোরাতে রুমি বাটিতে খাবার উঠিয়ে নিয়ে বাহিরে যাচ্ছে কার জন্য? দেখতে হচ্ছে তো বিষয়টা।”

এই বলে মেহরিন রুমির থেকে যথাযথ দুরত্ব বজায় রেখে ওকে অনুসরণ করে সামনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। মূল দরজা পেরিয়ে বাহিরে এসে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পরে মেহরিন। আড়াল থেকে সামনের দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করে রুমির সম্মুখপানে একজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আবছা আলোয় ছেলেটার চেহারা মেহরিন স্পষ্ট ভাবে দেখতে পারছে না। ওদের থেকে মেহরিনের দূরত্ব ততোটা বেশি না হওয়ায় ওদের দু’জনের কথপোকথন মেহরিনের কান এড়াতে পারে না। রুমি ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বললো…

—“আমার হাতে রান্না করা মাছের ভুনো খাওয়ার জন্য তো ভিষণ জেদ নিয়ে বসেছিলে তুমি। আর তোমার জেদ পূরণ করতে আজ আমায় রান্না করতে হয়েছে। খেয়ে জানিও কেমন হয়েছে।”

—“ঠিক আছে।”

—“এভাবে আর জেদ করবে না আমার হাতের রান্না করা খাবার খাওয়ার জন্য। বাড়ির সবার আড়ালে বাটি ভরে তোমার জন্য খাবার নিয়ে বাহিরে আসাটা আমার জন্য কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় তা এবার থেকে বুঝতে শিখো।”

—“সবসময় তো বলি না, মাসে একদিন বলি তাতেও তোমার এতো বাহানা দেখাতে হয় রুমি!”

—“আমার যে সমস্যা তা বুঝতে চাও না কেনো তুমি জিহাদ!”

জিহাদ নামটা শোনামাত্রই মেহরিনের হাত অটোমেটিক মুখের উপর চলে আসে। জিহাদ যে তাদের গ্রামের চেয়ারম্যান এর ছেলে। চেয়ারম্যান লোকটা ভিষণ ই ব*র্বর স্বভাবের। নিজের সামান্য ক্ষমতা আর আয় এর জন্য অহং*কারে মাটিতে যেনো তার পা পড়ে না। গ্রামের কৃষকদের উপর ও অ*ত্যা*চার করে। চড়া সু*দে গরীব চাষিদের টাকা ধার দেয়। পরবর্তী সেই টাকা শোধ করতে না পারলে সেসব চাষীদের সকল সয়-সম্পত্তি নিজের নামে করে নিয়ে তাদের সর্বস্ব হারা করে দেয়। তারই ছেলের সাথে রুমি গোপনে সম্পর্কে জড়িয়েছে বুঝতে পেরে মেহরিনের মুখশ্রী জুড়ে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়। পরক্ষণেই জিহাদের কথা কানে পড়তেই মেহরিন আবারও ওদের দিকে লক্ষ্য করে…..

—“আমার বাড়িতে প্রতিবেলায় ভালো ভালো খাবারের অভাব হয় না। যখন যেটা খাওয়ার জন্য ইচ্ছে পোষণ করি তখন সেটাই পাই আমি। কিন্তু আমার কাছে তোমার হাতের রান্না করা খাবারের মূল্য অনেক বেশি। এই খাবার খেয়ে আমি যতোটা তৃপ্তি পাই তা ওসব খেয়ে পাই না বুঝলে! তাই আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না। প্রতিমাসে এই একদিন করে তুমি আমাকে তোমার নিজ হাতের রান্না করা খাবার দিবে যেভাবে পারো।”

জিহাদের জেদের সামনে হার মানতে হয় রুমিকে। রুমি একবার শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো….

—“ঠিক আছে আমি চেষ্টা করবো। কিন্তু এভাবে আর বেশিদিন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। তুমি আমার কথা তোমার বাড়িতে কবে বলবে জিহাদ!”

—“কয়েকদিন পর আমি শহরে যাবো। বাবা তার পরিচিত একজন লোকের সাথে কথা বলে আমার জন্য উচ্চপদে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সেখানে জয়েন হওয়ার জন্য চূড়ান্ত চিঠি এসেছে আমার কাছে। চাকরিতে জয়েন হই। এরপর নিজের কাজটা ভালো ভাবে বুঝে নেয়া হয়ে গেলেই তোমার কথা আমার বাড়িতে জানিয়ে দিবো আমি।”

—“ঠিক আছে, এখন বাড়িতে যাও। আমাকেও যেতে হবে। এতোরাতেও সদরদরজা খোলা রয়েছে কেও দেখে দরজা আটকে দিলে সারারাত আমাকে বাড়ির বাহিরেই কাটিয়ে দিতে হবে।”

ওদের কথপোকথন ফুরিয়ে এসেছে বুঝে মেহরিন আড়াল থেকে বেড়িয়ে বাড়ির ভিতরে আগে চলে আসে। কিয়ৎক্ষণ পর রুমি ও বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে মূল দরজা ভিতর থেকে আটকে দিয়ে বললো…

—“যাক বাবা, এই সময়ে কেও আর এদিকে আসে নি বেঁচে গেলাম।”

এই বলে রুমি যেই না সামনের দিকে ঘুরে তক্ষুনি মেহরিনকে রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বেশ ঘা*ব*ড়ে যায়। রুমি শুকনো ঢোক গিলে কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে নিজরুমের দিকে হাঁটতে শুরু করে। মেহরিন নিরব রয়। এটা সঠিক সময় নয় রুমির সাথে এসব বিষয়ে কথা বলার। অতঃপর মেহরিন নিজ চেহারায় স্বাভাবিক ভাব স্পষ্ট রেখে রান্নাঘরের ভিতরে প্রবেশ করে রিজওয়ানের জন্য প্লেটে খাবার সাজিয়ে নিয়ে নিজরুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ……….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে