আমি যারে চেয়েছিলাম পর্ব-০২

0
1842

#আমি_যারে_চেয়েছিলাম
#পর্বঃ০২
#Arshi_Ayat

সেহরীশ একটু চুপ করে থেকে আবার বলল,’ভাইয়া আপনি কোন ইয়ারের?’

রুদ্ধ চোয়াল শক্ত করে বলল,’এই মেয়ে তুমি কি ভাইয়া বলা ছাড়া কথা বলতে পারো না?’

সেহরীশ ভীরু কন্ঠে বলল,’আপনি তো সিনিয়র।তাই ভাইয়া’ই তো বলবো।’

রুদ্ধ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’না খুকুমণি আমাকে ভাইয়া বলবে না।তুমি আমার নাম ধরে ডাকবে।’

‘কিন্তু….’

‘কোনো কিন্তু নেই।আমার নাম ‘বাবু’।তুমি আমাকে বাবু বলে ডাকবে।’

‘বাবু ছাড়া কি আপনার আর কোনো নাম নেই?’

‘কেনো?বাবু নাম কি পছন্দ না?’

‘না মানে…সবার সামনে বাবু বলে ডাকলে মানুষ কি বলবে?তার চেয়ে বাবু ভাইয়া বলে ডাকি?’

রুদ্ধ সেহরীশের দিকে অগ্নী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’নো ভাইয়া।অনলি বাবু।ওকে?’

সেহরীশ মুখ কালো করে ক্ষীণ কন্ঠে বলল,’ওকে।’

রুদ্ধ মনে মনে হাসলো।ভাবলো একে আর র‍্যাগিং দেওয়া লাগবে না।তারচেয়ে ভালো ওর সাথে দু’একটা মিষ্টি কথা বলে ওকে ফার্স্ট ইয়ারের রুম দেখিয়ে দেই।

ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসের সামনে এসে রুদ্ধ বলল,’সেহরীশ এই হলো তোমার ক্লাসরুম।কোনো প্রয়োজন হলে বলো।আমি তোমার সিনিয়র হলেও আমরাতো ফ্রেন্ড হতে পারি তাই না?’

সেহরীশের সাদা মনে কোনো কাঁদা নেই।সে মিষ্টি করে হেসে বলল,’অবশ্যই পারি।’

‘তো ঠিকাছে আজকে থেকে আমরা ফ্রেন্ড।’

‘আচ্ছা।’

‘আচ্ছা।তাহলে ক্লাসে যাও।’

সেহরীশ নিজের ক্লাসে এসে প্রথম সারিতে বসে পড়লো।ও বসতেই তিন চারটা মেয়ে এসে বসল ওর পাশে।তন্মধ্যে একজন বলল,’আচ্ছা।ওই ভাইয়াটা তোমার সাথে আসলো কেনো?উনি কি তোমার কেউ হয়?’

সেহরীশ বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল,’না, না।আমি ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস খুঁজে পাচ্ছিলাম না তো!ওনাকে বলতেই উনি দেখিয়ে দিলেন।’

‘ও,কিন্তু আমরা শুনেছি রুদ্ধ নামের কেউ একজন নতুন স্টুডেন্টদের র‍্যাগিং দেয়।’

সেহরীশ বলল,’না ওনার নাম তো বাবু।ওনার নাম রুদ্ধ না।ওনার ব্যবহার অনেক ভালো।’

‘ও।আমরা আমাদের সিনিয়র আপুর থেকে শুনেছি কিন্তু তাকে কখনো দেখি নি।’

‘আচ্ছা বাদ দাও আমরা তো ক্লাসেই এখন কেউই কিছু করতে পারবে না।চলো আমরা পরিচিত হই।’সেহরীশ প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল।কারণ কোন রুদ্ধ না যুদ্ধ কে জানে তার ভয়ে কি এখন ইঁদুরের গর্তে লুকোনো লাগবে নাকি!আসুক র‍্যাগিং দিতে মজা আমিও বুঝাবো।

আপাতত সেহরীশ তিনজন ক্লাসফ্রেন্ড পেয়ে গেলো।আজকে স্যার’রা তেমন পড়াবে না।তাই সেহরীশ তাই নতুন পাতানো বান্ধবীদের সাথে আলাপে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

র‍্যাগিং দেওয়া শেষ এখন আর ভার্সিটি তে থেকে লাভ নেই।তাই রুদ্ধ,তাসিন,অনিমেষসহ বাকিরাও বেরিয়ে পড়লো।ওদের পড়াশেষ।শুধু মাস্টার্স এর রেজাল্ট বাকি আছে।তাও ওরা ভার্সিটিতে আসে।নতুন ছেলেপেলেদের জ্বালানোর জন্য।

ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে তাসিন ওর অফিসে চলে গেলো।ও পার্টটাইম একটা জব করে আর রাতে টিউশনি করায়।অনিমেষেও একই অবস্থা আর রুদ্ধ শুধু পাঁচটা টিউশনি করায় দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত।ও পার্টটাইম চাকরী করবে না।ওর ফুলটাইম চাকরী আর স্যালারি ভালো হতে হবে এমন চাকরী লাগবে।কিন্তু এমন চাকরী মিলছে না।অনেক জায়গায় ইন্টারভিউ দেওয়া স্বত্বেও এখনো কোনো চাকরী হয় নি।চাকরী যেনো সোনার হরিণ!

এখন ঘড়িতে ১০.০৫ বাজে।এখন থেকে দুপুর ৩.০০ টা পর্যন্ত রুদ্ধ একদম ফ্রী।এই সময়টা সে তার গার্লফ্রেন্ডদের পিছনে ব্যায় করে।তবে প্রতিদিন না।সপ্তাহে দুইদিন প্রেমিকাদের সাথে দেখা হয় আর পাঁচদিন বাসায় ঘুমায় নয়তো ছাদে ঘুড়ি ওড়ায় পাড়ার ছেলেদের সাথে ক্যারাম খেলে।আজকে সে ক্যারাম খেলবে।
—————-
আজ সূর্যদেব ওঠেনি।কাঠ-কয়লার মতো মেঘ আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সকাল থেকে কিন্তু এখনো বৃষ্টি নামে নি।সেহরীশ তৈরি হয়ে ভার্সিটির জন্য বেরিয়ে পড়লো।কাছাকাছি হওয়ায় হেটেই যাওয়া যায়।হেটে আসতে সাত/আট মিনিটের মতো লাগে।সেহেরীশ ভার্সিটিতে পৌঁছে নিজের ক্লাসে গিয়ে বসলো।এখনো তেমনভাবে কেউ আসে নি।আজ ও সময়ের অনেক আগেই এসেছে।কারণ কাল পুরো ভার্সিটিটা ঘুরে দেখা হয় নি তাই আজ তাড়াতাড়ি এসেছে।ব্যাগ থেকে ফোনটা নিয়ে ক্যাম্পাসে চলে এলো।শুনেছে মূল ভবনের পিছনে বটতলা আছে।ভবনের পেছনে দিকে যেতে লাগলো।এই সাইড’টা অনেক বেশি সুন্দর।সেহরীশ হাঁটতে হাঁটতে বটতলার কাছাকাছিই চলে এসেছে।সামনে কতোগুলো ছেলে মেয়ে মিলে গান গাইছে।সেহরীশ আরেকটু কাছে গিয়ে দেখলো এখানে বাউলা গানের আসর চলছে।কেউ গিটার বাজাচ্ছে তো কেউ বাশি,একতারা এগুলো বাজাচ্ছে।আর সমস্বরে গাইছে।সেহরীশ একপাশে দাঁড়িয়ে ওদের গান শুনছে।

‘দিলোনা দিলোনা, নিলো মন দিলোনা।
এতো যে নিঠুর বন্ধু জানা ছিলো না গো।
এতো যে নিঠুর বন্ধু জানা ছিলো না।
আমি যারে বাসি ভালো, কাজলের চেয়েও কালো ।(২)
হয় না যে তার তুলনা ।
এতো যে নিঠুর বন্ধু জানা ছিলো না গো।
এতো যে নিঠুর বন্ধু জানা ছিলো না।
দিলোনা দিলোনা, নিলো মন দিলোনা।
এতো যে নিঠুর বন্ধু জানা ছিলো না গো।
এতো যে নিঠুর বন্ধু জানা ছিলো না।

চুল কালো আঁখি কালো…কাজল কালো আরো…
কাজলের চেয়ে কালো কি বলতে কি কেউ পারো।
আমি যারে বাসি ভালো, কাজলের চেয়েও কালো।(২)
হয়না যে তার তুলনা।
এতো যে নিঠুর বন্ধু জানা ছিলো না গো।
এতো যে নিঠুর বন্ধু জানা ছিলো না।’

গান শুনতে শুনতে একপর্যায়ে সেহরীশ খেয়াল করলো কালকে বাবু নামের ছেলেটাও গাইছে।ও সবার মাঝে বসে আছে।গান শেষ হতেই সবাই হাততালি দিলো।সবার হাততালি থামার পর সেহরীশ সবার সামনেই রুদ্ধ’র সামনে এসে বলল,’বাহ!বাবু কন্ঠ’টা কিন্তু সুন্দর।’

সেহরীশের কথা শুনে উপস্থিত সকলে একবার সেহরীশের দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে হেসে দিলো শুধু রুদ্ধ হাসে নি।সবার হাসি দেখে সেহরীশ বেকুব বনে গেলো।সবাই হাসছে কেনো?সেহরীশ ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলো,’তোমরা হাসছো কেনো?আমি কি ভুল বলেছি?’

রুদ্ধ সেহরীশের অগোচরে সবাইকে ইশারায় চুপ থাকতে বলল।সবাই ওর কথামতো চুপ থাকলো।কারো কাছে জবাব না পেয়ে বেচারি অসহায় মুখে রুদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল,’আচ্ছা ওরা সবাই হাসলো কেনো?’

‘আরে ওরা পাবনা থেকে পালিয়ে আসা পাগল।কালকে রাতেই পালিয়ে এসেছিলো।তুমি কিছু মনে করো না।কি যেনো বলছিলে?’

‘বললাম আপনার কন্ঠ অনেক সুন্দর।’

‘ধন্যবাদ সেহরীশ।’

সেহরীশ ঘড়িতে একবার তাকিয়ে বলল,’আচ্ছা বাবু আমি আসি।’

সেহরীশের কথায় এবারও সবাই হাসলো।কেউ মুখ টিপে তো কেউ জোরে।সেহরীশ ভ্রু কুঁচকে সবার দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেলো।সেহরীশ যাওয়ার পর।তাসিন বলল,’দোস্ত কাহিনি কি রে?আবার আরেকটারে পটায় ফেললি।’

রুদ্ধ হাসতে হাসতে কালকের কাহিনি বলল ওদের সবশুনে ওরা হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরেছে।

আর এদিকে সেহরীশ নিজের ক্লাসের সামনে আসতেই একজন সিনিয়র আপু ডাক দিলো ওকে।সেহরীশ গেলো।মেয়েটা সেহরীশকে বলল,’তুমি নতুন না?’

‘হ্যাঁ আপু।’

‘আচ্ছা তুমি বটতলায় রুদ্ধ ভাইয়াকে বাবু ডাকছিলে কেনো?’

সেহরীশ বুঝতে না পেরে বলল,’কোন রুদ্ধ ভাইয়া?ওনার নাম তো বাবু।উনিই আমাকে বলেছেন।’

‘আরে না।ওনার নাম রুদ্ধ শেখ।’

‘না আপু আপনার ভুল হচ্ছে।ওই ভাইয়াটার নাম বাবু।’

মেয়েটা নিজের ফোন বের করে রুদ্ধ’র আইডি বের করে সেহরীশকে দেখিয়ে বলল,’দেখো প্রোফাইল পিক’টা।নামটাও পড়ো।’

সেহরীশ দেখলো আসলেই প্রোফাইলে ওই ছেলেটার ফর্মাল ড্রেস’আপের একটা ছবি।আর বাংলার নাম লেখা ‘রুদ্ধ শেখ।’

সেহরীশের চোখে পানি ছলছল করছে।এভাবে কেউ ওকে বোকা বানালো।একটু আগে সবাই কি না কি ভেবেছে।
মেয়েটা নিজের ফোন ব্যাগে রেখে বলল,’এবার বিশ্বাস হলো?ওনার নাম রুদ্ধ।উনিসহ ওনার সব বন্ধুরা ভার্সিটির সবচেয়ে সিনিয়র।ওনাদের মাস্টার্স শেষ।তবুও ভার্সিটিতে আছে জুনিয়রদের র্যাগ দিতে।তুমি একটু সাবধানে চলবে।আর রুদ্ধ ছেলেটা ভালো না।প্লে বয়।’

এগুলো বলেই মেয়েটা চলো গেলো।আর সেহরীশের মন চাচ্ছে হাত পা ছেড়ে চৌরাস্তার মোড়ে কাঁদতে।এভাবে বলদ না বলদি হয়ে যাবে সেটা ভাবতেই পারে নি।দুঃখী মন নিয়ে সেহরীশ ক্লাসে চলে গেলো।ক্লাস শেষে বাসার উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করলো।মাঝরাস্তায় আসতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়া শুরু করলো।সেহরীশ রাস্তার পাশের দোকানটায় যেতে যেতে অনেকটাই ভিজে গেলো।ওই দোকানের ছাউনিতে অনেক মানুষই দাড়িয়ে আছে।হঠাৎ আশেপাশে খেয়াল করতেই দেখলে দুইটা ছেলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ঠিক ওর দিকে নয় ওর শরীরের দিকে।তাকানোটা অস্বস্তিকর লাগছে।বৃষ্টির পানিতে জামা ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে।আবার এখন বেরও হওয়া যাবে না প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে।হঠাৎ কেউ একজন পাশ থেকে কিছু একটা বাড়িয়ে দিলো।সেহরীশ তাকাতেই দেখলো রুদ্ধ ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর ও ই ওর গায়ের শার্ট’টা সেহরীশের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।সেহরীশ শার্ট’টা নিতে চেয়েও পারলো না আজকে সকালে ওই সিনিয়র আপুর কথা মনে পড়ে যাওয়ায়।

রুদ্ধ দেখলো সেহরীশ শার্ট’টা নিচ্ছে না।তাই নিজেই শার্ট’টা ওর গায়ে জড়িয়ে দিলো।সেহরীশ কিছু বলতে নিলেই বলল,’শার্ট’টা ফেরত দিলে তোমারই ক্ষতি।ওরা তোমাকে চোখ দিয়ে গিলে খাবে তাতে আমার কি!আমি তো একটু উপকার করতে চাইলাম।’

সেহরীশ রুদ্ধের কথা শুনে একবার ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে আর ফেরত দেওয়ার কথা ভাবলো না।বৃষ্টি থেমেছে।তবে এখনো গুড়িগুড়ি পড়ছে।সেহরীশ রুদ্ধের শার্ট’টা দিতে চাইলে রুদ্ধ বলল,’তোমার বাড়ি কোথায়?’

‘সামনেই।একটু হাটলেই।’

‘আচ্ছা চলো আমিও তোমার সাথে যাবো?’

সেহরীশ ভ্রু কুঁচকে বলল,’কেনো?’

‘আমার শার্ট’টা নিতে।কারণ তুমি এই অবস্থায় বাসায় যেতে পারবে না।পুরো ভিজে গেছো তুমি।আর আমার এখনো টিউশনি করাতে যেতে হবে।শার্ট ছাড়া গেলে মান ইজ্জত শেষ।সেইজন্য তোমাকে বাসায় দিয়ে আমি আমার শার্ট’টা নিয়ে যাবো।এবার বুঝলে?’

‘হ্যাঁ বুঝলাম।চলুন।’সেহরীশ আগে আগে হাঁটছে আর রুদ্ধ পিছনে।একটু পরপরই সেহরীশ পিছনের দিকে তাকাচ্ছে আর রুদ্ধের চোখে চোখ পড়ছে।চোখ পড়তেই সরিয়ে নিচ্ছে।আগে পিছে হাটার ব্যাপারটা ভাল্লাগে না সেহরীশের।হাঁটতে হলে পাশাপাশি হাটুক।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে