আমি যারে চেয়েছিলাম পর্ব-০১

0
3005

#আমি_যারে_চেয়েছিলাম
#পর্বঃ০১
#Arshi_Ayat

রুদ্ধ শক্ত করে মিথির পা চেপে ধরে রেখেছে।আর কাঁদছে।এদিকে মিথি চলে যাওয়ার জন্য পা ছাড়াতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না।মিথি কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলল,’এইজন্যই আমি আসতে চাই নি।ছাড়ো রুদ্ধ।একটু পর আমার বিয়ে।তোমার কথায় আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।এমন ভাবে কান্নাকাটি করছিলে যেনো আমি মরে যাচ্ছি।আরে বাবা,কে না নিজের সুখ চায়।আমি আমার সুখের জন্যই যাচ্ছি।তাই ছাড়ো আমার পা।আর এখান থেকে চলে যাও।প্লিজ!’

রুদ্ধ কান্না করুণ কন্ঠে বলল,’মিথি এটা কিন্তু কথা ছিলো না।তুমি বলেছিলে আমার সাথেই থাকবে তুমি।’

‘তুমি বলদই রয়ে গেলে।আরে রিলেশনশিপে থাকলে ওরকম দু’চারটা ইমোশনাল মিথ্যা বলতেই হয়।’

‘মিথি আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।চলো না পালিয়ে যাই।আমার পরিবারের সবাই তোমাকে মেনে নিবে।’

‘তোমার পরিবার দিয়ে আমি কি করবো?আমার পরিবার খুশী থাকাই আমার সব।আমার বর জানো কি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কাজ করে।সে বি সি এস ক্যাডার।তোমার তো বি সি এস দেওয়ার যোগ্যতাও নাই।ছাড়ো এবার পা তা নাহলে এখন বাবাকে ডেকে জুতাপেটা খাওয়াবো।তখন আমার নাম নিতেও ভুলে যাবে।’

রুদ্ধ কাঁদতে কাঁদতে পা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাড়ায়।ও বুঝে গেছে কোনো কাজ হবে না।পাষাণীর মন গলবে না।বাম হাতের পিঠে চোখ মুছে বলল,’যাও,চলে যাও।আটকাবো না আর তবে শুনে রাখো আমাকে কাঁদিয়ে কখনো তোমার সুখ মিলবে না।আমি যতটুকু কেঁদেছি তারচেয়ে বেশী তুমি কাঁদবে।এখন যতোটা আমার তোমাকে মন পড়তে একটা সময় তারচেয়েও বেশি তোমার আমাকে মন পড়বে।মিলিয়ে নিও।’

মিথি খিলিখিলিয়ে হাসলো।যেতে যেতে বলল,’ব্রেকাপের সময় সব এক্সরাই এগুলো বলে।সমস্যা নাই।অভিশাপ দিতে থাকো।’

এটা বলে হাসতে হাসতেই মিথি ছাঁদ থেকে নিচে নেমে গেলো।আর রুদ্ধ ধপ করে ছাদের মেঝেতে বসে পড়লো।এইভাবে হেরে যাবে ভাবতেও পারে নি রুদ্ধ।ওদের সম্পর্কটা ছিলো তিনবছরের।রুদ্ধ ভার্সিটির সিনিয়র ছিলো আর মিথি জুনিয়র।অন্যান্য সিনিয়র ভাইদের মতো রুদ্ধ র‍্যাগিং দিতো না কাউকে।ও খুব শান্তশিষ্ট।তখন রুদ্ধ ৩য় বর্ষের ছাত্র ছিলো।আর মিথি প্রথম বর্ষ।প্রথম তিনমাস কারো সাথেই কারো দেখা হয় নি।তিনমাস পর নবীন বরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো।সেই অনুষ্ঠানে যারা অংশগ্রহণ করবে তাদের প্রাকটিস হচ্ছিলো হলরুমে।সেখানে মিথিও নাচের প্রাকটিস করছিলো।মিথি ভালো নাচতে পারে।ওইদিন আবার রুদ্ধ ক্লাস শেষ ওর বন্ধু অনিমেষের সাথে হলরুমে এসেছিলো।উদ্দেশ্য হলো অনিমেষ ওর প্রেমিকার সাথে দেখা করবে আর রুদ্ধ এমনিতেই যাবে।হলরুমের শেষ মাথায় অনিমেষ ওর প্রেমিকার সাথে কথা বলছিলো আর রুদ্ধ সবার প্র্যাকটিস দেখছিলো।হঠাৎ নৃত্যরত একটা মেয়েকে দেখে রুদ্ধের চোখ আটকে গেলো।কি সুন্দর গানের তালে তালে সে নাচছে।মুগ্ধ হয়ে রুদ্ধ তাই দেখছিলো।হঠাৎ অনিমেষ ওর পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,’চল হয়ে গেছে।’

রুদ্ধ মেয়েটাকে দেখতে দেখতে অজান্তেই বলল,’আমার হয় নি।’

‘মানে?রুদ্ধ,এই রুদ্ধ।’অনিমেষ ওকে মৃদু ঝাঁকুনি দিতেই ও সম্বিত ফিরে পেলো।তারপর বলল,’আচ্ছা তুই যা আমি একটু পর আসছি।’

‘কেনো?’অনিমেষের চোখে সন্দেহ।

‘এমনিতেই।ওদের প্র্যাকটিসগুলো একটু দেখে যাই।’

‘প্রতিদিন তো তোকে শত চেষ্টা করেও আনতে পারি না আজ হঠাৎ কি হলো?’অনিমেষ এক ভ্রু নাচিয়ে বলল।

‘কিছু হয় নি তুই যা।’

‘আচ্ছা যাচ্ছি।আমি একটু লাইব্রেরিতে যাবো।তুই তাড়াতাড়ি আসিস।’

‘আচ্ছা যা।’

অনিমেষ যাওয়ার সময় রুদ্ধের কানে কানে ফিসফিস করে বলল,’মেয়েটা কিন্তু সুন্দর।দেখতে থাকো তোমরও হয়ে যাবে।’

এটা বলেই ছুটে বেরিয়ে গেলো।রুদ্ধ কিছু বলতে পারলো না।আরো কিছুক্ষণ মেয়েটার প্র্যাকটিস দেখে তারপর চলে গেলো রুদ্ধ।এভাবে প্রতিদিন ক্লাস শেষে রুদ্ধ হলরুমে আসতে লাগলো।একসপ্তাহ পর অনুষ্ঠান।এই একসপ্তাহ ধরে রুদ্ধ প্রতিদিন হলরুমে গিয়েছে।প্র্যাকটিসের শেষের দিন রুদ্ধ মুগ্ধ নয়নে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছিলো।হঠাৎ মেয়েটা নাচ থামিয়ে রুদ্ধ’র সামনে এসে দাড়ালো।রুদ্ধ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।মেয়েটা রুদ্ধকে আগাগোড়া একবার দেখে বলল,’আপনি কি প্রতিদিন আমাকে দেখতেই আসেন।’

এমনিতে তো অস্বস্তি কম ছিলো না তার ওপর এই প্রশ্নটা!রুদ্ধ ঢোক গিলে বলল,’ক কই না তো!আ আমি তো এমনিই আসছি।’

‘আপনি কি তোতলা?’

হঠাৎ হঠাৎ এসব আচমকা আক্রমণে রুদ্ধের হৃৎপিণ্ড বের হওয়ার জোগাড়!ও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো।তারপর বলল,’না তো।’

‘আচ্ছা।আমার নাচ দেখছেন এটা বলতেই পারতেন।আমি আপনাকে খেয়ে ফেলবো না।বাই দ্য ওয়ে আপনি কোন ইয়ার?’

‘থার্ড ইয়ার।’

‘ওহ!আচ্ছা।’
এটা বলেই মিথি আবার নিজের জায়গায় চলে গেলো।এভাবেই আস্তে আস্তে যেকোনো ছুতোয় রুদ্ধ মিথিকে দেখতো।মিথিও বুঝতো।একপর্যায়ে দুজনের সম্মতিতে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লো ওরা।কিন্তু রিলেশনে যাবার পর থেকেই মিথির আচার আচরণ রুদ্ধ’র ভালো লাগতো না।ও রাত বিরেতে কারো সাথে কথা বলতো।এদিকে রুদ্ধ ফোন দিলে ওর ঘুম পায়।আবার বন্ধুদের সাথে ট্যুরে চলে যায় ওকে না জানিয়েই এ নিয়ে কিছু বললেই ‘ব্রেকাপ’।প্রথম থেকেই রুদ্ধ সিরিয়াস ছিলো সম্পর্কে।তাই ব্রেকাপ শব্দটা নিতে পারতো না।তবুও নিজের মতো করে মিথিকে বোঝাতে কিন্তু মিথি বুঝতে চাইতো না।ওকে সময়ও দিতো না।রুদ্ধ’র বন্ধুরা বলেছিলো এই টক্সিক রিলেশন থেকে বেরিয়ে আসতে কিন্তু রুদ্ধ তবুও থেকেছে।তিলে তিলে কষ্ট পেয়েছে।তবুও ছাড়তে চায় নি।কিন্তু হঠাৎ একসপ্তাহ আগে মিথি রুদ্ধকে ব্লক করে দিয়েছে সব জায়গা থেকে।রুদ্ধ চেয়েও একটাবারের জন্যও যোগাযোগ করতে পারে নি।এই একসপ্তাহে প্রতিদিন ওর বাসার সামনে এসে দাড়িয়েছে কিন্তু মিথি ওর সাথে দেখা করে নি।ওর বান্ধবীর থেকে জানতে পারে মিথির বিয়ে ঠিক হয়েছে।আর ও এই বিয়েতে রাজি।রুদ্ধ কি করবে বুঝতে পারছিলো না।তারপর ওর এক বান্ধবীর মাধ্যমে অনেক কান্নাকাটি করে আজ ওর সাথে ওর বাসার ছাদে এসে দেখা করেছে।কিন্তু অনেক কাকুতি মিনতি করেও ভালোবাসা ভিক্ষা দিলো না।

রুদ্ধ মেঝে থেকে উঠে দাড়ালো।তারপর নিচে চলে গেলো।বাড়িতে অনেক মেহমান।বিয়ে বলে কথা!সবার অগোচরে রুদ্ধ বেরিয়ে পড়লো।অনিমেষ,তাসিন ওরা দুইজন বাইরেই দাড়িয়ে ছিলো।রুদ্ধকে চোখ মুছতে মুছতে আসতে দেখে ওরা সব বুঝে নিলো অবশ্য এটাই হওয়ার ছিলো।রুদ্ধ না মানলেও ওরা অনেক আগেই জানতো।রুদ্ধকে বলার পরও ও বুঝতে চাইতো না।

ওরা রুদ্ধকে বাসায় পৌঁছে দিলো।আজকে ওরাও ওর সাথে থাকবে।বন্ধুর বিপদের দিনে পাশা থাকাই বন্ধুত্ব।একবছর আগে যখন অনিমেষের প্রেমিকা একটা দুর্ঘটনায় মারা যায় তখন অনিমেষ একবারেই ভেঙে পড়েছিলো।ওই সময়টায় রুদ্ধ,তাসিন ওরা ভাইয়ের মতো সামলেছে ওকে।তখনও যেমন বন্ধুর প্রয়োজন ছিলো এখনো তেমন বন্ধুর প্রয়োজন আছে।

১বছর পরের কথা…..
বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে রুদ্ধ।ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে বারবার।রুদ্ধ’র খবর নেই।হয়তো আফরা,রিধি আর নাহলে মিম।এরা তিনজনই রুদ্ধের প্রেমিকা।চার নম্বর প্রেমিকার সাথে দু’দিন আগেই ব্রেকাপ হয়েছে।রুদ্ধ’র কাছে প্রেম এখন খেলনা।ভালোবাসা না।ভালোবাসা তো কবেই হারিয়ে গেছে।মিথি ধোঁকা দেওয়ার পর রুদ্ধ ভেঙে পড়েছিলো খুব কিন্তু বন্ধুদের সহোযোগিতায় খুব তাড়াতাড়ি মুভ অন করতে পেরেছে।এখনকার রুদ্ধ’র পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো।সে এখন র্যাগ দেয় জুনিয়র দেয়।জুনিয়ররা তাকে জমের মতো ভয় পায়।প্রেম চার/পাঁচটা।আগে ছিলো লাভারবয় আর এখন প্লে বয় রুদ্ধ শেখ!

রুদ্ধ আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠে বসলো।ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো।তাসিন আর অনিমেষের কল আর মেসেজ।একটা মেসেজ ওপেন করতেই দেখলো লেখা আছে,’রুদ্ধ কই তুই।তাড়াতাড়ি আজকে ফার্স্ট ইয়ার’রা আসবে।যার্গ দিবি না?’

মেসেজটা পড়ে রুদ্ধ মৃদু কন্ঠে বলল,’ওহ!শীট!’তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে।হালকা নাস্তা করেই বেরিয়ে পড়লো।দ্রুত ভার্সিটিতে এসে বন্ধুদের আড্ডায় চলে গেলো।সেখানে আলোচনা হচ্ছে নতুন কি কি রাইপের র্যাগ দেওয়া যায় সেটা নিয়ে।রুদ্ধ আসতেই ওকে মাঝখানে জায়গা দেওয়া হলো বসার ও নিজের সীট গ্রহণ করলো।তারপর আবারও আড্ডা জমে উঠলো।

রুদ্ধ বসে বসে চুইংগাম চাবাচ্ছে আর চারদিক দেখছে।ওর সৈন্যবাহিনী মানে বন্ধুরা যে যার মতো ফার্স্ট ইয়ার দের যার্গ দিচ্ছে।কিন্তু ও মনের মতো একজনকেও পাচ্ছে না।হঠাৎ দেখলো একটা মেয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে।মেয়েটা ওর সামনে এসে বলল,’ভাইয়া ফার্স্ট ইয়ারদের রুম কোন দিকে?

রুদ্ধ ‘ভাইয়া’ শব্দটা শুনে বিরক্তিতে ভ্রু কুচকালো।এসব ন্যাকা মেয়েরা ভাইয়া ভাইয়া করে মেজাজের খিল্লি করে দেয়।কিন্তু মেয়েটাকে দেখে মনে হলো এরসাথে কিছুক্ষণ মজা নেওয়া যেতে পারে।তাই মুখভঙ্গি ঠিক করে রুদ্ধ বলল,’আচ্ছা আসো খুকুমণি তোমাকে নিয়ে যাই।’

মেয়েটা রুদ্ধ’র পিছনে যেতে যেতে বলল,’আমার নাম খুকুমণি না ভাইয়া আমার নাম সেহরীশ।’

রুদ্ধ একবার সেহরীশের দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে চাইলো।তারপর মনে মনে বলল,’আজকে এমন শিক্ষা দেবো ভাইয়া ডাকা বন্ধ হয়ে যাবে।’

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে