(সতর্কতা – নিজ দায়িত্বে পর্বটি পড়বেন। এই পর্বে নৃশংস খুনের বর্ণনা রয়েছে।)
আমি পদ্মজা – ৯০
_________
চাঁদটা ঠিক মাথার উপরে। চারিদিকে ভয়াবহ নিস্তব্ধতা। জোনাকি পোকা ও রাতের প্যাঁচা কারোর মুখে রা নেই। এমনকি বাতাসের নিজস্ব শব্দও থমকে গিয়েছে। শুধু শোনা যাচ্ছে তাণ্ডবলীলার আহবান। গাছের ডালপালার আড়াল থেকে নিশাচর পাখিরা চেয়ে আছে। তারা তেজস্বী পদ্মজার আগমন দেখছে। পদ্মজার একেকটা কদম নিশাচর পাখিদের মনে বজ্রপাতের মতো আঘাত হানছে। তার সাদা শাড়ি থেকে বিচ্ছুরিত সাদা রঙ নিশাচরদের চোখ ঝলসে দিচ্ছে। পদ্মজার এক হাতে রাম দা অন্যহাতে দঁড়ি। দঁড়ি দিয়ে বাঁধা তিনটে নেড়ি কুকুর! আচমকা কুকুরগুলো চিৎকার করে উঠলো। নিশাচর পাখিরা ভয় পেয়ে এক গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে গেল। গাছের ডালপালা নড়ে উঠাতে পদ্মজাসহ তিনটে কুকুর আড়চোখে উপরে তাকালো। চার জোড়া হিংস্র চোখ
জ্বলজ্বল করছে! কুকুরগুলোর চোখের চেয়ে মানবসন্তান পদ্মজার চোখের দৃষ্টি ভয়ংকর! যেন চোখ নয় আগ্নেয়গিরি! এক্ষুনি আগুন ছড়িয়ে দিয়ে চারপাশ ভস্ম করে দিবে! পদ্মজা পায়ে হেঁটে ঘাস পেরিয়ে একটা পুকুরের সামনে এসে দাঁড়ালো। পুকুরের জল কুচকুচে কালো। পুকুরের চেয়ে কিছুটা দূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় রেইনট্রি গাছ । গাছগুলোর শত বছর বয়স। রেইনট্রি গাছের সাথে বাঁধা অবস্থায় ঘুমাচ্ছে মজিদ,খলিল,আমির,রিদওয়ান ও আসমানি।
পদ্মজা পাশ থেকে ছোট চৌকিখাট টেনে নিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় বসলো। তার শরীরের রক্ত বুদবুদ করে ফুটছে! ঘুমন্ত অমানুষগুলোকে দেখে তার ঠোঁটে তিরস্কারের মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। যখন চোখ খুলে আমির ও তার দলবল আবিষ্কার করবে, তারা বন্দী! আর সামনে তিনটে কুকুরের সাথে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মজা! তখন তাদের কেমন অনুভূতি হবে?
__________
সাত ঘন্টা পূর্বে, তখন শেষপ্রহরের বিকেল। পদ্মজা লতিফাকে পানি আনতে পাঠিয়েছে। সে রান্নাঘরে রান্না করছে। লতিফা কলপাড়ে এসে আমিরকে দেখতে পেল। আমির আলগ ঘরে প্রবেশ করেছে মাত্র। লতিফা কলসি রেখে আমিরের কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কিন্তু দুই কদম হেঁটে এসে সে থমকে দাঁড়ায়। দ্রুত উল্টো ঘুরে কলপাড়ে চলে আসে। কলপাড়ে খালি কলসিটা স্থির হয়ে আছে। লতিফা কলসির উপর চোখ নিবদ্ধ রেখে কপাল কুঁচকায়। নূরজাহানের ঘর থেকে তিনদিন আগেই ঘুমের ঔষধ সংগ্রহ করে রেখেছিল পদ্মজা। আজ রাতের খাবার পরিবেশন করার পূর্বে খাবারের সাথে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দেয়া হবে। যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়বে তখন পদ্মজা আক্রমণ করবে! এই পরিকল্পনাই লতিফাকে জানানো হয়েছে। লতিফা কলপাড়ে এসে আমিরকে দেখে দূর্বল হয়ে পড়ে। তার বলে দিতে ইচ্ছে হয়,আমির যেন রাতের খাবার না খায়! কিন্তু যখন মনুষ্যত্ব জেগে উঠলো সে থেমে গেল।
আজ লতিফার একখানা বড় কাজ আছে। রিনুকে নিয়ে তার পালাতে হবে! এই বাড়িতে কিশোরী রিনু এসেছে গতবছর। তার আগেও অন্দরমহলে রিনু নামে একজন কাজের মহিলা ছিল। তিনি ডায়রিয়ায় গত হয়েছেন দুই বছর আগে। এতিম লতিফা প্রথম যখন এই বাড়িতে এসেছিল,মজিদ ও খলিলের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিল। তারপর লতিফা ফরিনাকে সব জানায়। ফরিনা প্রতিবাদ করায় আমির সব শুনলো। আমির তার বাপ-চাচাকে নিষেধ করে লতিফাকে নির্যাতন করতে। সে চায়,তার মায়ের সেবা করা মানুষগুলো নিরাপদ থাকুক।
এরপর প্রায় দুই-তিনবছর নিরাপদে কেটে গেলেও পনেরো বছর বয়সে রিদওয়ানের মাধ্যমে লতিফা ধর্ষিতা হয়। ধর্ষণের পর লতিফা পালানোর জন্য ছটফট করেছে। দরজা বন্ধ করে দিনের পর দিন লুকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদেছে। তারপর বেশ কয়েকবার মজিদ ও খলিলের থাবার শিকার হতে হয়েছে। দিনগুলো বিষাক্ত ছিল। পালানোর মতো জায়গা ছিল না। তাই একসময় লতিফা ভাগ্যকে মেনে নিল। সহ্য করে নিল সবকিছু। অন্দরমহলের পাশাপাশি পাতালঘরের বিশ্বস্ত সহযোগী হয়ে উঠলো। তবে গত চার বছর ধরে সে মজিদ,খলিল আর রিদওয়ানের থাবা থেকে মুক্ত। এর পিছনেও কাহিনি রয়েছে। ফরিনার প্রতি লতিফার ভালোবাসা এবং সম্মান দেখে আমির লতিফার ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। তার হুমকিতে থেমে যায় লতিফার কালরাত্রিগুলো। লতিফা বিশ্বস্ততার সাথে আমিরের গোপন আদেশ-নিষেধগুলো মেনে চলে। পদ্মজা, রূম্পা ও হেমলতাকে চোখে চোখে রাখা ছিল লতিফার দায়িত্ব। গত বছর কিশোরী রিনু নতুন এসেছে অন্দরমহলে। সে এ বাড়ি সম্পর্কে কিছুই জানে না। মজিদ হাওলাদার উদারতা দেখিয়ে এতিম রিনুকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। যেহেতু রিনুকে উদারতার জন্য আনা তাই রিনুকে দেখেশুনে রাখা হয়। বিয়ের জন্য পাত্রও খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু লতিফা দেখেছে,রিদওয়ানের কু-দৃষ্টি রিনুর উপরে আছে। রিনুর সাথে একই বিছানায় থাকতে থাকতে লতিফা রিনুকে আপন ছোট বোন ভাবা শুরু করেছে। সে রিনুকে ছোট বোনের মতো ভালোবাসে। রিনুকে অভিশপ্ত নিখুঁত যন্ত্রণাময় কালরাত্রিগুলো থেকে বাঁচাতে লতিফা দ্রুত পালাতে চায়। তাই আমিরের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থাকা সত্ত্বেও গোপন পরিকল্পনার কথা বলতে পারলো না। দমে গেল! সে কলসি রেখে দ্রুতপায়ে অন্দরমহলে চলে যায়।
রান্নাঘরে পা রাখতেই পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। সে পাথরের মতো স্থির! লতিফার হাত খালি দেখে যান্ত্রিক স্বরে বললো,’ পানি কোথায়?’
লতিফা নিজের হাতে নিজের কপাল চাপড়ালো। সে কলসি রেখে চলে এসেছে। লতিফা টান টান করে হেসে বললো,’ এহনি আনতাছি। খাড়াও। ‘
লতিফা কলসি আনতে চলে গেল। পদ্মজা এক এক করে পাতিলে মশলা ঢাললো। মুরগি কষানো হবে। পুলিশ ভোরে পূর্ণার লাশ ফেরত দিয়েছে। বাসন্তী নাকি রাতে স্বপ্ন দেখেছেন,পূর্ণা লাহাড়ি ঘরের পাশে কবর খুঁড়ছে। তাই তিনি সবাইকে অনুরোধ করেছেন,পূর্ণার কবর যেন লাহাড়ি ঘরের পাশে গোলাপ গাছটির নিচে হয়। বাসন্তীর কথা রাখা হয়৷ পূর্ণা তার প্রিয় গোলাপ গাছটির নিচে পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। পদ্মজা আজও কাঁদলো না। সে চুপচাপ কোরান শরীফ পড়েছে। তারপর পূর্ণাকে কবর দেয়া হলে অন্দরমহলে ফিরে এসেছে। এ নিয়ে সমাজে নানান কথা হচ্ছে৷ পদ্মজার ব্যবহারে অবাক হয়েছে প্রেমা,বাসন্তী ও প্রান্ত। মৃদুলের অবস্থা নাজেহাল। তাকে হাজার টেনেও পূর্ণার কবর থেকে সরানো যাচ্ছে না। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। মৃদুলের মা জুলেখা বানু ছেলের পাগলামি দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মোড়ল বাড়ির অবস্থা করুণ! পদ্মজা ভাবনা ছেড়ে কাজে মন দিল। লতিফা কলসি নিয়ে দৌড়ে আসে। তারপর মেঝেতে কলসি রেখে বললো,’ লও পানি।’
পদ্মজা পূর্বের স্বরেই বললো,’ যা যা আনতে বলেছিলাম,আনা হয়েছে?’
‘হ,আনছি।’
‘রিনু ব্যাগ গুছিয়েছে?’
‘হ,গুছাইছে।’
‘রিনুকে ডাকো।’
লতিফা রান্নাঘর থেকে গলা উঁচু করে ডাকলো,’ রিনুরে…ওই রিনু।’
রিনু আশেপাশেই ছিল। লতিফার ডাক শুনে দ্রুত হেঁটে আসে। সে গতকাল থেকে আতঙ্কে আছে। ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারেনি। রিনুর সামনের দাঁতগুলো উঁচু। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। কিন্তু মনটা সাদা। সরল-সহজ একটা মেয়ে। রিনু এসে বললো,’ হ, আপা?’
পদ্মজা বললো,’ রাতে বের হয়ে যাবি লুতু বুবুর সাথে। পথে একদম ভয় পাবি না। আমি লুতু বুবুকে কিছু টাকা দিয়েছি আর একটা ঠিকানা দিয়েছি। আল্লাহ সহায় আছেন। বিসমিল্লাহ বলে বের হবি। পথে আল্লাহকে স্মরণ করবি বেশি বেশি। ইনশাআল্লাহ কোনো ক্ষতি হবে না।’
রিনু বাধ্যের মতো মাথা নাড়াল। লতিফা পদ্মজাকে বললো,’ তোমারে ওরা কিচ্ছু যদি করে?’
পদ্মজা উত্তর দিল না। লতিফা উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো। অনেকক্ষণ পর পদ্মজা বললো,’ আমার ঘর থেকে কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে পুকুরপাড়ের আশেপাশে কোথাও রেখে আসো। এখন আরেকটু পেঁয়াজ, রসুন বাটো।’
‘রাইখা আইছি। সব কাম শেষ। গোয়ালঘরের পিছনে তিনডা কুত্তা বান্ধা আছে। চিল্লাইছে অনেকক্ষণ, খাওন দিছি এরপরে থামছে। আর ওইযে আলমারিডার পিছনে একটা বৈয়াম আছে। ওইডার ভিতরে রিনু বিষ পিঁপড়া ভরছে। এইডাও একটু পরে রাইখা আমুনে।’
‘মরে যাবে না?’
‘না। বৈয়ামের মুখ কাপড় দিয়া বাইন্ধা রাখছি। ভিত্রে(ভিতরে)মাডিও আছে।’ বললো রিনু।
পদ্মজা,লতিফা ও রিনু তিনজনে মিলে রান্নাবান্না শেষ করলো। আমিনা সদর ঘরে আলোকে নিয়ে খেলছেন। তার জীবন আলোতে সীমাবদ্ধ। আর কিছুতে পরোয়া করেন না। আগে ঘরের ব্যাপারে হলেও কথা বলতেন। এখন তাও করেন না। সারাদিন আলোর সাথে কথা বলেন। মনের ব্যথা আলোকে শোনান। আলো কিছু বুঝে না। শুধু হাসে। আলোর হাসিটাই আমিনার সঙ্গী। রিনু রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। মিনিট দুয়েকের মাঝে দৌড়ে ফিরে আসে। পদ্মজাকে জানায়,’ রিদওয়ান ভাইজানে আইতাছে। লগে একটা ছেড়ি।’
পদ্মজার হাত থেমে যায়! তাহলে সেই নারী? যে পূর্ণাকে হত্যা করতে সাহায্য করেছে! রিনু এক হাত দিয়ে অন্য হাত চুলকাতে থাকলো। সে রিদওয়ানকে আগে ভয় পেত,এখন নাম শুনলেই কাঁপে। লতিফা রিনুর অস্বস্তি,ভয় খেয়াল করে বললো,’ রিনু ঘরে যা। দরজাডা লাগায়া দিবি।’
লতিফার বলতে দেরি হয়,রিনুর ঘরে চলে যেতে দেরি হয় না।
রিদওয়ান সদর ঘরে প্রবেশ করে আসমানিকে বললো,’ আমার লগে থাকবা না অন্য ঘর লইবা?’
রিদওয়ানকে দেখেই আমিনা আলোকে নিয়ে ঘরে চলে যান। আসমানি নিকাব তুলে চোখ বড় বড় করে বললো,’ বাড়ির ভিত্রে(ভিতরে) তোমার লগে থাকুম? আইছি যে এইডাই বেশি। এমনিতে ডর লাগতাছে আমার।’
‘তখন রানি,কাকি এরা ছিল। এখন তো নাই। যারা আছে এরা থাকা আর না থাকা সমান।’
আসমানি চারপাশ দেখে বললো,’ পদ্মজা কই?’
আসমানির চোখমুখ দেখে দাত কেলিয়ে হাসলো রিদওয়ান। বললো,’ বাবুর বউ পাগল হইছে। মাথা ঠিক নাই। ভয় পেও না।’
আসমানি চারপাশ দেখতে দেখতে বললো,’ মাথা ঠিক নাই দেইখাই তো ডর বেশি।’
রিদওয়ান আসমানির সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো। বললো,’ আজিদ ফিরবে কোনদিন?’
‘মা রে লইয়া শহরে গেছে। আইতে চাইর-পাঁচদিন তো লাগবই।’
‘তাহলে কয়দিন আমার সাথে থাকো।’
আসমানি রিদওয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো। রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। আসমানি বললো,’পদ্মজা যদি জিগায়,আমি কার কী লাগি?’
‘তোমাকে চিনে না? বাড়ির কাছে থাকো,আজিদের বউ হিসেবে দেখেনি কখনো?’
‘না।’
‘তাইলে কিছু বলার দরকার নাই। প্রশ্ন করলে উত্তর দিও না।’
‘সন্দেহ করলে?’
‘সন্দেহ করলেই কী? না করলেই কী? পদ্মজার দাম আছে আর?’
‘আইচ্ছা ছাড়ো,আমি পদ্মজারে দেইখা আইতাছি।’
আসমানি রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়। সে চোখ বুলিয়ে চারপাশ দেখছে। এই বাড়িতে আসার অনেক ইচ্ছে ছিল তার। কখনো আসতে পারেনি। এই প্রথম আসতে পেরেছে। অন্যবার সোজা পাতালঘরে যেত। লুকোচুরি লুকোচুরি খেলাটা কমেছে বলে ভালো লাগছে। এখন হয়তো প্রতিনিয়ত অন্দরমহলে আসা হবে! লুকিয়ে ভাঙা ফটক দিয়ে পাতালঘরে যেতে হবে না।
আমির ধানের বস্তায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। ঘরের অর্ধেক অংশ জুড়ে ধানের বস্তা রাখা হয়েছে। বস্তাগুলো বাঁশের মাচার উপর। মাটি স্যাঁতসেঁতে। এই ঘরটায় খুব দরকার ছাড়া কেউ আসে না। আবছা অন্ধকারে আমিরের মুখটা অস্পষ্ট। তার হাতে পদ্মজার বেনারসি। বুকটা ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। আর মাত্র কয়টা ঘণ্টা! ইশ,যদি থেকে যাওয়া যেত! আফসোসে বুকের ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো পথ নেই। সব পথ বন্ধ। হয় আগুনে ঝলসে যেতে থাকো নয় মৃত্যু গ্রহণ করো। কী নিষ্ঠুর শর্ত! আমির পদ্মজার বেনারসির দিকে তাকালো। ধূলোর আস্তরণে বন্দী হয়ে গেছে সব স্বপ্ন-আশা! চোখে ছবির মতোন দৃশ্যমান হয়,পদ্মজার লাজুক মুখখানা। তার দুধে আলতা ছিমছিমে গড়নে খয়েরী রঙটা কী ভীষণ মানাতো! বর্ষাকালের শুক্রবার মানেই ছিল, বৃষ্টিতে ভেজা। আমির ঘন্টার পর ঘন্টা পদ্মজাকে একধ্যানে দেখেছে। মুখস্থ করে নিয়েছে তার প্রতিটি পশমের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ। আমির কল্পনা থেকে বেরিয়ে বেনারসিতে চুমু দিল। সীমাহীন যন্ত্রণা থেকে বললো,’যখন তোমার কথা ভাবি, তখন আমার শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরা বাজতে থাকে। আমাদের পথটা কি আরেকটু দীর্ঘ হতে পারতো না?’
আমির উত্তরের আশায় বেনারসির দিকে তাকিয়ে রইলো। তার ঠোঁট দুটো বাচ্চাদের মতো ভেঙে আসে। একটু কথা বলুক না…বেনারসিটি একটু কথা বলুক! আমির ভেজা গলায় আবার বললো,’তোমার জন্য বুকটা পুড়ে যাচ্ছে। তোমায় ছোঁয়ার সাধ্যি,দেখার সাধ্যি কেন নেই আমার?’
বেনারসি নিশ্চুপ! সে বোবা,প্রাণহীন। আমির চোখ বুজে বস্তায় হেলান দিল। গত কয়দিনে পদ্মজার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ কানে বাজছে। যখন পদ্মজার বলা, ‘ একবার…একবার নিজের মা-বোনকে মেয়েগুলোর জায়গায় দাঁড় করিয়ে ভাবুন। একবার আমাকে মেয়েগুলোর জায়গায় ভেবে দেখুন।’ কথাগুলো কানে বাজলো তখন চোখের পর্দায় ভেসে উঠে পদ্মজার নগ্ন শরীর। তার সারা শরীরে ছোপ ছোপ দাগ। একটা ছায়া পদ্মজার শরীরে চাবুক মারছে। পদ্মজা আর্তনাদ করার শক্তিটুকু পাচ্ছে না। শুধু গলা কাটা গরুর মতো কাতরাচ্ছে।
আমির ছায়াটির গলা চেপে ধরার জন্য হাত বাড়ায়৷ কিন্তু একি! ছায়াটিকে ছোঁয়া যাচ্ছে না! আমির দ্রুত চোখ খুলে ফেললো। তার মুখ থেকে অস্পষ্ট উচ্চারণ হয়,পদ্মজা! আমির চট করে উঠে দাঁড়ায়। বুকের ভেতর আগুন লেগে গেছে৷ ভেতরটা ভস্ম হয়ে যাচ্ছে। শরীর দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে। সে শার্ট খুলে ছুঁড়ে ফেলে দূরে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। শরীরের শিরা-উপশিরায় তাণ্ডব শুরু হয়ে গিয়েছে। এই যন্ত্রণা আমির নিতে পারে না। সেই দুই হাতে নিজের চুল টেনে ধরলো। বিগত দিনগুলো তাকে নরকীয় শাস্তি দিয়েই চলেছে। চোখগুলো আজেবাজে দেখছে৷ মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন আজেবাজে ভাবছে। পদ্মজা,পদ্মজা,পদ্মজা…এই পদ্মজাতে কী শক্তি লুকিয়ে আছে? এই একটিমাত্র নাম তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। বিষাক্ত করে তুলেছে প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস। আমির টিনের দেয়ালে এক হাত রেখে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে।
মজিদ ক্লান্ত হয়ে আলগ ঘরে বসলেন। এখানে প্রচুর আলো-বাতাস আসে। লতিফা মজিদকে আসতে দেখে,দ্রুত শরবত আর পান-সুপারি নিয়ে আসে। মজিদের সামনে এসে বসে রিদওয়ান ও খলিল। মজিদ শরবত পান করে লতিফাকে প্রশ্ন করলেন,’পদ্মজা কথাবার্তা বলছে?’
লতিফা নতজানু অবস্থায় উত্তর দিল,’হ,কইছে।’
রিদওয়ান লতিফাকে বললো,’যে মেয়েটা আসছে দেখে রাখবি। যত্ন নিবি।’
লতিফা বাধ্যের মতো বললো,’আইচ্ছা,ভাইজান।’
খলিল বললেন,’ আসিদপুর থাইকা যে বড় পাটিডা আনছিলাম, পুশকুনিপাড়ে ওইডা বিছাবি।’
‘বিছাইছি খালু। এশারের আযানডার পরে সব খাওনদাওন দিয়া আমু।’
‘ভালা করছস।’ খলিল পান মুখ পুরে বললেন।
লতিফা শরবতের খালি গ্লাস নিয়ে চলে গেল। মজিদ আরো দুই গ্লাস পানি পান করলেন। তিনি ভীষণ ক্লান্ত। সারাদিন দৌড়ের উপর ছিলেন। রিদওয়ানের ভুল আপাতত মগার উপর ঘুরে গিয়েছে। মগা গতকাল থেকে বাড়িতে নেই। আবার শেষবার মগার সাথে পূর্ণা ছিল। সবার জবানবন্দির ভিত্তিতে আপাতদৃষ্টিতে মগা খুনি! পুলিশ হাওলাদার বাড়ির দারোয়ানকে খুঁজেছে। মোড়ল বাড়িতে পুলিশ এসেছে শুনেই রিদওয়ান দারোয়ান মুত্তালিবকে হত্যা করেছিল। তাই পুলিশ মুত্তালিবকে পেল না। মজিদ হাওলাদার পুলিশকে বলেছেন,তিনি ধারণা করছেন দারোয়ান ও মগা পরিকল্পনা করে পূর্ণালে ধর্ষণ করার পর হত্যা করেছে। পুলিশ এখন দারোয়ান মুত্তালিব ও মগাকে খুঁজছে।
রিদওয়ান নিরাপদে আছে। খলিল মজিদকে বললেন,’ ভাইজান, কিছু ভাবছেন?’
‘কী নিয়ে?’ মজিদের নির্বিকার স্বর।
রিদওয়ানের ভ্রুকুটি হয়ে গেল। সে চারপাশ দেখে বললো,’ আপনি এতো নির্বিকার কেন চাচা? আজ আমিরকে খুন করার কথা ছিল।’
মজিদ এক হাত তুলে রিদওয়ানকে চুপ করতে ইশারা করলেন। তারপর বললেন,’বাবু যদি আমাদের কথা না শুনে তখন ব্যবস্থা নেব। তার আগে না।’
রিদওয়ানের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে নাছোড়বান্দা স্বরে বললো,’ আমির কখনোই পদ্মজাকে খুন করবে না,শেকল বন্দীও করবে না!’
মজিদ গম্ভীর স্বরে বললেন,’দেখা যাবে।’
রিদওয়ান খলিলের দিকে তাকালো। তারপর অধৈর্য্য হয়ে মজিদকে বললো,’ আমিরের জন্য আমাদের ক্ষতি না হয়ে যায়!’
মজিদ খলিলকে বললেন,’ দেখ তো আশেপাশে কেউ আছে নাকি। ঘরগুলোও দেখবি।’
আমির মাত্র বের হতে যাচ্ছিল। মজিদের শেষ কথাটা কানে আসতেই সে দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। খলিল আলগ ঘরের প্রথম দুটো ঘর দেখে এসে বললেন,’কেউ নাই।’
তারপর চেয়ারে বসলেন। রিদওয়ান খলিলের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে মজিদকে বুঝাতে। খলিল মজিদের আরেকটু কাছে এসে বসলেন। তারপর বললেন,’রিদু কিন্তু হাচা কইতাছে ভাইজান। বাবুরে দিয়া আর ভরসা নাই।’
মজিদ রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন,’তুই কী বোঝাতে চাচ্ছিস? বাবু আমাদের খুন করে পদ্মজাকে নিয়ে সংসার করতে চাইবে?’
রিদওয়ান তড়িৎ গতিতে বললো,’এটা কি সম্ভব না কাকা? আলমগীর ভাই কী করলো?’
মজিদ নির্লিপ্ত কণ্ঠে খলিলকে বললেন,’ খলিল,তোর ছেলের বুদ্ধি এখনো হাঁটুতে আছে।’
রিদওয়ান উঠে দাঁড়ায়। তার মাথা চড়ে যাচ্ছে। মজিদ বললেন,’তুই আমার পাশে বস। তোর মাথায় কিছু কথা ঢোকাতে হবে।’
রিদওয়ান মনের বিরুদ্ধে আবার বসলো। মজিদ বললেন,’চুপ করে আমার কথা শোন। আলমগীর আর বাবুর মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। পাতালঘরের রীতি পূর্বপুরুষ থেকে পেলেও, নারীপাচার চক্রটার সৃষ্টি বাবুর। এই চক্রে আলমগীর, তুই, আমি আর খলিল বাবুর দলের একটা অংশমাত্র। আমরা সরে গেলে আমাদের উপর রাগ একমাত্র বাবুই ঝাড়তে পারবে। কিন্তু এই চক্রের শুরুটা যে করেছে সে হচ্ছে নেতা। গত সপ্তাহে বাবু ঢাকা থেকে একটা খাম নিয়ে আসছে। খামের চিঠিতে স্পষ্ট লেখা আছে,ছয় মাস পর বাবু নিজ দায়িত্বে ষোলটা মেয়ে সিঙ্গাপুরে পাঠাবে। সার্নার জনের সাথে তিন মাস আগে থেকে চুক্তিবদ্ধ বাবু। বাবুর সাক্ষর আছে চিঠিতে। বাবু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
রিদওয়ান বললো,’পড়ছি আমি। কিন্তু টাকা কী করছে? আমাদের তো দেয়নি।’
মজিদ বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালেন। তিনি কথার মাঝে কথা বলা একদম পছন্দ করেন না। বললেন ‘হয়তো কাজশেষে দিত। আমার পুরো কথা শোন। কথার মাঝে কথা বলবি না।’
রিদওয়ান মাথা নাড়াল। মজিদ বললেন,’এখন বাবু যদি প্রতিজ্ঞা রক্ষা না করে এর পরিণতি কেমন হবে ধারণা আছে? বিদেশের কত মানুষের সাথে ও কাজ করছে হিসাব আছে? সবার বিরুদ্ধে ছোটখাটো প্রমাণ হলেও বাবুর কাছে আছে। আর এই দেশে কি একমাত্র বাবু মেয়ে পাচার করে? আরো আছে। কম হলেও আট-নয় জন দলনেতার সাথে বাবুর ভালো পরিচয় আছে। যেখানে এই দেশ পরিচালনা করা একজন নেতা এই চক্রের সাথে জড়িত আর বাবুর তার সাথে যোগসূত্র আছে, সেখানে বাবু পালিয়েছে যদি জানতে পারেন তিনি বাবুকে ছেড়ে দিবেন না। সব রকম ব্যবস্থা নিবেন। সম্মানহানির ভয় পাবেন,সব প্রকাশ হওয়ার ভয় পাবেন। বাবুর সাথে পদ্মজার ক্ষতি করবেন। পদ্মজা সুন্দর। বাবুর সামনে পদ্মজার বেইজ্জতি হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ আছে। আরো কত ক্ষমতাশীল লোক বাবুর সাথে এই কাজে জড়িত আছে। যতদিন বাবু এই কাজে নিজেকে রাখবে ততদিন ভালো থাকবে। ছাড়তে চাইলেই সর্বনাশ। বাবুর বুদ্ধি তোর মতো না রিদু। ও আর যাই করুক পালিয়ে যাওয়ার মতো বোকামি করবে না। এতোটা বোকা বাবু না। যদি সত্যি বাবু পদ্মজাকে ভালোবেসে থাকে ও ভুলেও পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিবে না। এই চক্রের সাথে জড়িত সবাই একজোট! বাবু পালানোর চেষ্টা করলে ও একা হয়ে যাবে। সবাই ঠিক ধরে ফেলবে বাবুকে। আর বাবু ধরা পড়লে পদ্মজাও ধরা পড়বে। পদ্মজা একবার ধরা পড়লে চোখের পলকে ভোগের বস্তু হয়ে যাবে।’
‘পালিয়ে কোথাও না গিয়ে পুলিশকে সব খুলে বললেই তো ও নিরাপত্তা পেয়ে যাবে! আর ফেঁসে যাবো আমরা আর অন্যরা!’
মজিদ বোকা রিদওয়ানের পিঠ চাপড়ে বললেন,’ পুলিশ কয়জনকে ধরবে? আমির নিজেও পুলিশের হাতে ধরা পড়বে। ফাঁসিও হবে। নিজের মৃত্যু নিজে টেনে আনবে। তো কী হলো? কিছু কিছু কাজ আছে,যেগুলোতে একবার প্রবেশ করে ঘাঁটি সৃষ্টি করে ফেললে আর সেখান থেকে বের হওয়া যায় না। বাবু তেমনই চিপায় আছে। যদি পালাতে চায় নিজের সাথে পদ্মজার ইজ্জত আর জীবন হারাবে। এই ঝুঁকি নেয়ার সাহস বাবুর হবে না। আমি নিজের চোখে ঢাকায় দেখেছি, পদ্মজা অসুস্থ হয়ে ঘরে ঘুমাচ্ছে আর আমির বাড়ির সব কাজ করছে। পদ্মজার জন্য হলেও বাবু পাতালঘর আর আমাদের আঁকড়ে ধরে রাখবে ।’
‘দেশে কি জায়গার অভাব আছে? কোথাও না কোথাও ঠিক লুকিয়ে থাকতে পারবে।’
‘ওর কাজ করতে হবে না? ঘরে বসে খাবে? তুই নিজ চোখে দেখেছিস, আমির কীভাবে মাত্র দশ দিনে আলীকে রাজশাহী থেকে ধরেছে। আলীর পালিয়ে যাওয়া আমিরের জন্য হুমকি ছিল। তাই চিরুনি অভিযান চালিয়ে ঠিক খুঁজে বের করছে। আমিরের অভিজ্ঞতা আছে। আমির পদ্মজাকে নিয়ে এতো বড় ঝুঁকি নিবে না। আমির চিনে তার পেশার রক্ত কেমন! এতদিন অন্য মেয়েদের পিটিয়েছে। তখন নিজের বউকে পিটাতে দেখবে।’
মজিদ থামলেন,দাঁত বের করে হাসলেন। এতো কথাতেও রিদওয়ানের মনে শান্তি এলো না। সে দুইহাত তুলে বললো,’ আচ্ছা ধরলাম,আমির পালাবে না। কিন্তু পদ্মজাকে বেইজ্জতি করার জন্য আমাদের খুন করবে না তার নিশ্চয়তা আছে?’
মজিদ হাওলাদার এবার রেগে গেলেন। বললেন,’বাবুর যখন এই কাজের সাথে থাকতেই হবে তখন আমাদের খুন করে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবে না। খলিল তোর ছেলেরে নিয়ে যা। তারপর গোয়ালঘর থেকে কতোটা গোবর খাইয়ে দে।’
অপমানে রিদওয়ানের মুখটা থমথমে হয়ে যায়। সে ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে থাকলো। আমিরের জায়গাটা সে কিছুতেই দখল করতে পারছে না!ব্যর্থ হচ্ছে বার বার। রিদওয়ান চেয়ারে লাথি দিয়ে, চলে গেল। খলিল বললেন,’ ভাইজান,আসমানিরে আনা কি ঠিক কাম হইলো?’
‘একদম না। রিদওয়ান আবার আরেকটা ভুল করলো। বাড়িতে কেউ নাই বলে,ঝুঁকি নিয়ে যা ইচ্ছে করছে। আবার বিপদে পড়লে আমার পা যেন না চাটে বলে দিস।’
খলিল মুখ থেকে পানের পিচকিরি ফেলে বাইরে চোখ নিবদ্ধ করলেন।
ক্রোধে-আক্রোশে আমিরের কপালের রগ ভেসে উঠে। চোখ দুটি রক্তবর্ণ ধারণ করে। সে রাগে এক হাতে দরজা চেপে ধরলো। তার দূর্বলতা ধরতে পেরে মজিদের আনন্দ হচ্ছে! মজিদের হাসি দেখে আমিরের গা জ্বলে যাচ্ছে। সে একবার ভাবলো এক্ষুনি গিয়ে মজিদের গলা চেপে ধরবে। কিন্তু পরক্ষণে কী ভেবে থেমে গেল। চলে এলো ধান রাখার ঘরে। ধানের মাচার ভেতর উঁকি দিয়ে দেখলো,চাপাতি আর রাম দা ঠিকঠাক আছে নাকি। হ্যাঁ,ঠিকঠাক আছে! আমির স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। জানালা খুলে বাইরে তাকাতেই বিকেলের রঙহীন ধূসর কুয়াশা চোখে পড়ে।
পদ্মজা পালঙ্কের উপর গাঁট হয়ে বসে আছে। এশারের নামায আদায় করে মাত্রই উঠেছে। তার পরনে সাদা শাড়ি৷ লতিফা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে পদ্মজাকে জানালো,সে পুকুরপাড়ে খাবার রেখে এসেছে। বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে চারপাশ। মজিদ,খলিল,আমির,রিদওয়ান ও আসমানি এখুনি যাবে৷ পদ্মজা নিস্তেজ গলায় বললো,’ওরা ঘুমিয়ে পড়লে আমাকে ডেকো।’
তার শান্ত স্বর ! কথা শুনে মনে হচ্ছে,পদ্মজা লতিফাকে ঘর ঝাড়ুর জন্য অথবা রান্না করার জন্য ডাকতে বলেছে! লতিফা দৌড়ে বেরিয়ে গেল। তার বুকের ভেতর দামামা বাজছে। মনে হচ্ছে, যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে। এ তো সত্যিই যুদ্ধ! লতিফার ঘাম হচ্ছে।চাপা একটা আনন্দও কাজ করছে! কী অদ্ভুত!
রান্নাঘরে আসমানি গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু পদ্মজাকে কথা বলাতে পারেনি৷ পদ্মজা একটাও জবাব দেয়নি। সে আসমানিকে পুরোদমে এড়িয়ে গিয়েছে। আসমানি নিরাশ হয়ে বেরিয়ে যায়৷ তারপর আর তাদের দেখা হয়নি। পদ্মজা বিছানা থেকে নেমে শক্ত করে হাত খোঁপা করলো। জানালা গলে চাঁদের আলো পদ্মজার পায়ের উপর পড়ে। নিখুঁত কালো রাতকে চাঁদ তার নরম আলোয় আচ্ছন্ন করে রেখেছে। পদ্মজা চাঁদের আলোকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে। ছোঁয়া গেল ঠিকই অনুভব করা গেল না। পদ্মজার কানের পাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে বাতাস উড়ে যায়। সে বাতাসের শীতলতাকে আগুনের আঁচের মতো অনুভব করছে!
তারা পাঁচ জন গোল হয়ে বসেছে। খাবারের সুন্দর ঘ্রাণে চারপাশ মৌ মৌ করছে। রান্নার ঘ্রাণ শুনেই আমির বুঝে গেল,সব পদ্মজা রান্না করেছে! সে নিজেকে সামলাতে পারলো না। সবার আগে খাওয়া শুরু করলো। আগে তাদের হালকা-পাতলা আলোচনা করার কথা ছিল। তারপর খাওয়া দাওয়া করে ভবিষ্যত পরিকল্পনা করবে। কিন্তু আমির নিয়ম ভঙ্গ করে শুরুতেই খাওয়া শুরু করে। অগত্যা বাকিরাও খাওয়া শুরু করলো। তাদের চেয়ে কয়েক হাত দূরে টলটলে জলের বিশাল পুকুর। জলের রঙ কালো। আশেপাশে কোনো ফুলের গাছ আছে। একটা মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছে৷ কালো জলের পুকুরটির পঁচিশটি সিঁড়ি। এই পুকুর নিয়ে অনেক গুজব রয়েছে। যদিও সব মিথ্যে৷ বাড়ির মেয়েরা এদিকটায় কখনো আসেনি। মজিদ হাওলাদারের ভীষণ প্রিয় এই জায়গাটা। তার দাদা এই জায়গাটাতে সবসময় ভোজ আসর করতেন। মজিদের ইচ্ছে ছিল চাঁদের রাতে পুকুরের পাশে বসে ভোজ আসর উপভোগ করার। কিন্তু সম্ভব হয়নি! মজিদ হাওলাদারের দাদা নিজের বউকে ভূতে ধরা পাগল প্রমাণ করার জন্য গুজব রটিয়ে দেন। সেই গুজব ধরে রাখতে মজিদ হাওলাদারও এদিকটায় আসেননি কখনো। আজ বাড়ি খালি হওয়াতে সেই সুযোগ মিলেছে৷ তিনি গতকালই দুজন লোক দিয়ে জায়গাটা সুন্দর করে পরিষ্কার করেছেন। চোখ জুড়িয়ে দেয়ার মতো দৃশ্য হয়েছে!
একটু দূরেই ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি পোকা উড়ছে৷ মাথার উপর চাঁদের আলো। চারপাশে চারটি হারিকেন। চমৎকার পরিবেশ। খলিল মুরগির রানে কামড় দিয়ে বললেন,’ বাবু,সারাদিন কই থাহছ?’
আমির ছোট করে উত্তর দিল,’এখানেই।’
মজিদ আমিরকে আগাগোড়া পরখ করে নিয়ে বললেন,’কোনো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছিস?’
‘না,আব্বা।’ বললো আমির।
রিদওয়ান কিছু বলতে আগ্রহী নয়। সে চুপচাপ খাচ্ছে। তার চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। আসমানি আমিরের পাশ ঘেঁষে বসলো। বললো,’ পরের কামে কয়দিনের সময় দিছে?’
‘অনেকদিন।’
‘এইবার ভৈরবে নিশানা রাইখো। ওইহানে সুযোগ সুবিধা আছে অনেক।’
মজিদ আসমানির সাথে তাল মেলালেন,’আমিও ভৈরবের কথা বলতাম।’
আমির রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,’এই কাজ রিদওয়ান নিক। আজিদ আর হাবুরে নিয়ে কয়দিনের জন্য ট্রলার নিয়ে ভৈরবে চলে যাবে।’
রিদওয়ান না চাইতেও সম্মতি জানালো। আমির আড়চোখে পিছনে তাকালো। তার চেয়ে পাঁচ হাত দূরে একটা রেইনট্রি গাছ। গাছটির পিছনে সে চাপাতি আর রাম দা রেখেছে। আরেকটু রাত বাড়লে যখন সবাই ক্লান্ত হয়ে যাবে,নেশা করবে তখন সে আক্রমণ করবে। দুই হাতে দুই অস্ত্র নিয়ে রিদওয়ান ও মজিদকে আঘাত করা তার লক্ষ্য। তারপর খলিল ও আসমানি বাঁ হাতের খেল! আমির চুপচাপ প্রহর গুণতে থাকে।
খাওয়া শেষে প্লেটগুলো দূরে রাখা হয়। প্লেটগুলো সরানোর জন্য মজিদ চারপাশে চোখ বুলিয়ে লতিফাকে খুঁজলেন। লতিফা আশেপাশে নেই।
অন্যবার তো থাকে। আজ কোথায়? মজিদ বিরক্ত হলেন। তিনি মনে মনে লতিফাকে একটা নোংরা গালি দিলেন। তারপর পরবর্তী ডিল নিয়ে কথাবার্তা শুরু করলেন। কীভাবে এগোতে হবে কোন এলাকায় যেতে হবে,বর্তমান পরিস্থিতি কীভাবে স্বাভাবিক করা যায়। এসব নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। রিদওয়ান চোখমুখ কুঁচকে বসে আছে। মজিদ হাওলাদার আমিরকে কী প্রশ্ন করবেন বলেছিলেন। তাও করছে না। এই বুড়ো আবার গুটি পাল্টে দিয়েছে। আমির কথা কম বলছে। সে মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায়! কিন্তু তার সুযোগ আসার পূর্বেই সে এবং বাকিরা ঘুমের কাছে হেরে যায়। এতোই ঘুম পেয়েছিল যে,তাদের শরীর অন্দরমহলে যাওয়া অবধি ইচ্ছেশক্তি পায়নি।
লতিফা কিছুটা দূরে অন্ধকারে লেবু গাছের আড়ালে বসে ছিল। মশা কামড়ে তার হাত-পা বিষিয়ে দিয়েছে। যখনই দেখলো ভোজ আসরের পাঁচজনই ঘুমিয়ে পড়েছে,তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। সে ছুটে যায় অন্দরমহলে। পদ্মজা সদর ঘরে শান্ত হয়ে বসেছিল। লতিফা হাঁপাতে হাঁপাতে সব জানালো। তারপর তারা লুকিয়ে রাখা দঁড়ি আর ওড়না নিয়ে চলে আসে পুকুরপাড়ে। পদ্মজা, লতিফা ও রিনু মিলে ঠান্ডা মাথায় মজিদ,খলিল,আমির,রিদওয়ান এবং আসমানির হাত-পা ও মুখ বেঁধে ফেললো। তারপর এক এক করে টেনে নিয়ে গেল রেইনট্রি গাছের সামনে। পাঁচজনকে পাঁচটি গাছের সাথে বেঁধে তারা স্থির হয়ে দাঁড়ালো।
লতিফা,রিনু ঘেমে একাকার। রিনু তো ভয়ে তরতর করে কাঁপছে। এমন একটি দুঃসাহসিক কাজে অংশগ্রহণ করে সে হতভম্ব! পদ্মজা বললো,’ এবার তোমরা বেরিয়ে যাও।’
লতফা ও রিনু দুজনের গায়েই বোরকা ছিল। তারা ব্যাগ নেয়ার জন্য অন্দরমহলে দৌড়ে যায়। পদ্মজা বিদায় জানাতে অন্দরমহলে আসে। বের হওয়ার পূর্বে রিনু ও লতিফা পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। লতিফা বিষণ্ণ গলায় বললো,’ আবার দেখা হইবো তো পদ্ম?’
‘আল্লাহ চাইলে,আবার আমাদের দেখা হবে বুবু।’
‘সামলাইতে পারবা সব?’
‘পারবো। তুমি বেরিয়ে যাও। আর দেরি করো না।’
লতিফা এক হাতে ব্যাগ নিয়ে অন্য হাতে রিনুর হাত ধরলো। তারপর ছলছল চোখে পদ্মজাকে একবার দেখে বেরিয়ে পড়লো অচেনা গন্তব্যে। আমিনা সদর ঘর থেকে সবকিছু দেখেছেন। এতদিনের পুরনো কাজের মেয়ে চলে যাচ্ছে কেন? তিনি প্রবল আগ্রহ থেকে পদ্মজাকে প্রশ্ন করলেন,’ লুতু কই যাইতাছে?’
পদ্মজা শান্ত স্বরে বললো,’ শহরে যাচ্ছে।’
‘ওমা! কার কাছে?’
‘আপনি ঘরে যান। সকাল হওয়া অবধি বের হবেন না।’
আমিনা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,’কেরে?’
পদ্মজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো,বললো,’ এতদিন যেরকম নির্জীব ছিলেন আজও থাকুন।’
পদ্মজা রান্নাঘর থেকে হাতে রাম দা তুলে নিল। তারপর আমিনাকে জোর করে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। দরজা বন্ধ করার আগে আমিনার উদ্দেশ্যে বললো,’যদি কোনো শব্দ করেন আপনার মাথা শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাবে।’
তারপর পদ্মজা রাম দা নিয়ে গোয়ালঘরে গেল। সেখান থেকে তিনটে নেড়ি কুকুর নিয়ে পুকুরপাড়ের পথ ধরলো।
__________
নিশীথে পাঁচজন মানুষ বাঁধা অবস্থায় মাথা ঝুঁকে ঘুমাচ্ছে। আর সামনে রাম দা নিয়ে এক রূপসী বসে আছে। পাশে তিনটে কুকুর দাঁড়িয়ে আছে। দৃশ্যটি ভয়ংকর। সুনসান নীরবতায় কেটে যায় ক্ষণ মুহূর্ত। আর সময় নষ্ট করা যাবে না। তারা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মৃত্যু উপভোগ না করে অমানুষগুলো মরে যাক পদ্মজা চায় না। সে দুই জগ পানি পাঁচ জনের মাথার উপর ঢেলে দিল। তাতেও তাদের ঘুম ভাঙলো না। পদ্মজা রাম দার শেষ প্রান্ত দিয়ে পর পর পাঁচজনের পায়ের তালুতে আঘাত করলো। এতে কাজ হয়। তারা সক্রিয় হয়। পাঁচ জনই আধবোজা চোখে তাকায়। তাদের ঘুমের ঘোর এখনো কাটেনি। মাথা ভারী হয়ে আছে। ভনভন করছে। পদ্মজা চৌকিখাটের উপর গিয়ে বসলো। রিদওয়ান পদ্মজাকে ঝাপসা ঝাপসা দেখছে। সে চোখ বুজে আবার তাকালো। পদ্মজার হাসি হাসি মুখটা ভেসে উঠে। তার হাতে রাম দা। জ্বলজ্বল করছে পদ্মজার পাশের তিনটে কুকুরের চোখ! রিদওয়ান চমকে গেল। মজিদ,খলিল এবং আসমানি যখন পরিস্থিতি বুঝতে পারলো তারাও চমকে যায়। তারা কথা বলতে গেলে ‘উউউ’ আওয়াজ বের হয়। উঠতে গেলে টের পায় তাদের হাত-পা বাঁধা। ঘুম উবে যায়। মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠে। রিদওয়ান অবাক চোখে মজিদের দিকে তাকায়। মজিদও তাকালেন। তারা ছোটার জন্য ছটফট করলো। কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু কোনো চেষ্টাই সফল হচ্ছে না। আমির পদ্মজার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটি বার বার বুজে যাচ্ছে। তবে পরিস্থিতি ধরতে পেরেছে। সে সবসময় বলে,পদ্মজার নাকি নিজস্ব আলো আছে! এইযে এখন তার মনে হচ্ছে,অন্ধকারাচ্ছন্ন অতলে যখন সে তলিয়ে যাচ্ছিল তখন পদ্মজা এসে আলোর মিছিলে ভরিয়ে দিয়েছে তার মনের উঠান!
পদ্মজা পাঁচজনকে পরখ করে নিল। তাদের ছটফটানি আর ভয়ার্ত চোখ পদ্মজার দেখা সবচেয়ে সুন্দর ও তৃপ্তিকর দৃশ্য। আমিরের উপর চোখ পড়তেই আগে চোখে ভাসে আমিরের অযত্নে বেড়ে উঠা মাথার চুল। যা আমিরের কপাল ও চোখ ঢেকে রেখেছে৷ পদ্মজা উঠে দাঁড়ালো। রিদওয়ান ও মজিদের পাশে গিয়ে বসলো। দূরে সন্তানহারা পেঁচা ডাকছে চাপাস্বরে। আশেপাশে নাড়াচাড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। পদ্মজা তাদের উপর ঝুঁকলো। তারপর মৃদু হেসে চাপাস্বরে বললো,’ তবে হউক উৎসব। ‘
পদ্মজার কন্ঠ ও হাসি তাদের হৃৎপিণ্ডে জোরেশোরে আঘাত হানে। আসমানি ‘উউ’ শব্দ করই চলেছে। সে ভীতগ্রস্ত। ভয়ে তার শরীরে ঘাম হচ্ছে। ভয় পাচ্ছে উপস্থিত চারজনই। পদ্মজা আনাড়ি নয়৷ সে এর আগে তিনটে খুন করেছে। শেষ খুনটা নিখুঁত ছিল! পদ্মজাকে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। রিদওয়ান শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। পদ্মজা হিজল গাছটির দিকে এগিয়ে যায়। লতিফা হিজল গাছের পিছনে কাপড়ের ব্যাগটি রেখেছে। পদ্মজা কাপড়ের ব্যাগখানা নিয়ে আসে। ব্যাগ উল্টো করতেই বেরিয়ে আসে তিনটে বৈয়াম, চাপাতি,ছুরি,রাম দা ও তলোয়ার। অস্ত্রগুলো দেখেই বন্দীদের আত্মা কেঁপে উঠে। খলিল হাওলাদার ভয়ে পা দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে গোঙানো শুরু করলেন। পদ্মজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। ছুরি নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে আসে। পদ্মজার হাতে ছুরি দেখে কুকুরগুলো পালাতে উদ্যত হয়। কিন্তু তারা সুপারি গাছের সাথে বাঁধা! তাই পালাতে পারলো না। ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করে উঠলো।
পদ্মজা খলিলের উপর ঝুঁকে তার মাথার চুল শক্ত করে ধরে কিড়মিড় করে বললো,’ যে হাত দিয়ে এতদিন হত্যা করে আসা হয়েছে আমি আজ সেই হাত কেটে ফেলবো।’
খলিল চোখ দুটি মারবেলের মতো বড় বড় হয়ে যায়। পদ্মজার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ে পূর্ণার মৃত দেহের সোঁদা গন্ধ৷ ভেসে উঠে আঁচড় কাটা মায়াবী মুখটা। সে মনের ক্রোধ প্রকাশ করতে,খলিলের চুলে ধরে রেইনট্রি গাছের সাথে বার কয়েক আঘাত করলো। খলিলের মাথা ফুলে টিলার মতো উঁচু হয়ে যায়। যে চোখে এতদিন হিংস্রতা ছিল সেই চোখে ভয়ের ছাপ।
পদ্মজা ছুরি দিয়ে খলিলের হাত-পায়ের চামড়া ছিঁড়ে দিল। তারপর বৈয়াম থেকে মরিচ নিয়ে সেখানে আহত স্থানে মাখিয়ে দিল। খলিলের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। তিনি কেঁদে কিছু বলছেন,কিন্তু ‘উউ’ ছাড়া কিছু শোনা যাচ্ছে না। যন্ত্রণায় তার কলিজা ফেটে যাচ্ছে। জ্বলে যাচ্ছে হাত-পা।
খলিলকে ছেড়ে পদ্মজা সরু চোখে রিদওয়ানের দিকে তাকালো। কাছে কোথাও থেকে থেকে পেঁচা ডাকছে। জোনাকি পোকাদের দেখা যাচ্ছে না। কুকুর তিনটে পদ্মজার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
খলিলকে আঘাত করার সময় পদ্মজার চোখেমুখে যে হিংস্রতা ফুটে উঠেছিল, সেই দৃশ্য দেখে তারা অবাক হয়েছে৷ পদ্মজাকে তাকাতে দেখে রিদওয়ান চট করে চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নিল। খলিলের অবস্থা দেখার পর থেকে সে পদ্মজাকে ভয় পাচ্ছে। শরীরের সব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে ছোটার। রিদওয়ানের চোরা চাহনি দেখে পদ্মজা হয়তো হাসলো। মধ্যরাতের বাতাস ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। পদ্মজা দ্বিতীয় বৈয়ামটি নিয়ে রিদওয়ানের দিকে এগিয়ে আসে। পদ্মজার একেকটা কদম রিদওয়ানের আত্মাকে কাঁপিয়ে তুলছে। পদ্মজা রিদওয়ানের পাশে বসলো। রিদওয়ান আড়চোখে পদ্মজার দিকে তাকায়। পদ্মজা রিদওয়ানের মুখের সামনে মুখ নিয়ে দাঁত বের করে হাসলো। বললো,’ রাখে আল্লাহ মারে কে হা?’
রিদওয়ান একটু নড়াচড়া করে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। পদ্মজা এক থাবায় রিদওয়ানের মুখ থেকে ওড়নার বাঁধন খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে রিদওয়ান মজিদের উদ্দেশ্যে বললো,’ আমি আগেই বলছিলাম এই মেয়ে আমাদের বিপদের কারণ হবে। শুনেননি।’
পদ্মজা খপ করে রিদওয়ানের তালুর চুল টেনে ধরলো। রিদওয়ান পদ্মজার মুখে থুথু ছুঁড়ে মারে। পদ্মজা তার মুখ দ্রুত সরিয়ে নেয়। রিদওয়ানের থুথু রিদওয়ানের মুখের উপরই পড়লো। রিদওয়ান কটমট করে তাকালো। বললো,’ বে** মা* তোরে প্রথম দিনই মেরে ফেলা উচিত ছিল।’
পদ্মজা উঠে দাঁড়ায়। জোরে লাথি মারে রিদওয়ানের মুখে। লাথি খেয়ে রেইনট্রি গাছের সাথে আঘাত পায় রিদওয়ান। তার মাথা ভনভন করে উঠে। রিদওয়ান কিছু বুঝে উঠার আগে পদ্মজা তার প্যান্টের ভেতর বৈয়াম থেকে কিছু ঢেলে দিল। সেকেন্ড কয়েক পার হতেই বিশেষস্থানে জ্বালাপোড়া অনুভুব করে। একসাথে অনেকগুলো জীবের কামড়ে তার মুখ নীল হয়ে যায়। সে চমকে তাকায় পদ্মজার দিকে। প্রশ্ন করে,’কী দিছস? খান** ঝি প্যান্টের ভেতর কী দিছস তুই?’
পদ্মজা উত্তর দিল না। রিদওয়ান চিৎকার করতে থাকে। পদ্মজা রয়ে সয়ে রিদওয়ানের চিৎকার করার দৃশ্য দেখতে দেখতে কুকুরগুলোকে মুক্ত করে দেয়। কুকুর তিনটে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করে পিছিয়ে যায়। পদ্মজা তৃতীয় বৈয়াম নিয়ে মজিদের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। বৈয়াম থেকে দুই টুকরো কাঁচা মাংস বের করলো। ছাগল জবাই করেছিল আজ। সে দেখেশুনে হাড্ডিসহ কয়েক টুকরো মাংস রেখে দিয়েছিল। মাংস দেখে কুকুরগুলোর চোখ চকচক করে উঠলো। পদ্মজা এক টুকরো মাংস নিয়ে মজিদের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর মজিদের মুখের উপর মাংসের টুকরোটি ধরলো। তিনটে কুকুর ঘেউ ঘেউ করে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে মজিদের উপর। কুকুরগুলো লাফ দিতেই পদ্মজা মাংসের টুকরোটা মজিদের উরুর উপর ছেড়ে দেয়।
কুকুরগুলোকে নিজের দিকে তেড়ে আসতে দেখে মজিদ নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যান। চোখের পলকে মজিদের হাত-পা ও মুখের চামড়া ছিঁড়ে যায়। বেরিয়ে আসে রক্ত। এক টুকরো মাংস নিয়ে তিন কুকুরের মধ্যে কাড়াকাড়ি শুরু হয়। তাদের বিষদাঁতের কামড় পড়ে মজিদের গোপনাঙ্গে!
তিনি গোঙাতে গোঙাতে চোখের ইশারায় পদ্মজাকে আকুতি করেন এসব যেন থামানো হয়। অন্যদিকে রিদওয়ান ছোটার জন্য ছটফট করছে। পদ্মজাকে বিশ্রী গালিগালাজ করে হুমকিও দিয়েছে। যখন পিপড়ার কামড়ে সর্বাঙ্গ বিষিয়ে উঠে তখন সে পদ্মজাকে অনুরোধ করে তাকে বাঁচাতে। কখনো পদ্মজাকে দেবী বলে আবার কখনো মা বলে ডাকলো। ওয়াদা করলো,সে আর কখনো অন্যায় করবে না। পদ্মজা উত্তরে কিছুই বলেনি। সে নির্বিকার। রিদওয়ান ও কুকুরের চিৎকার শুনে মাথার উপর এক ঝাঁক পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল। আবার ডানা ঝাপটিয়ে ফিরে এলো। পাখিদের মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। তাদের অস্থিরতায় দানবের মতো দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর কচি ডালপালা ও পাতা বার বার নড়েচড়ে উঠছে। পদ্মজা এবার বৈয়াম নিয়ে খলিলের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। পূর্বের মাংসটি নিয়ে একটি কুকুর দৌড়ে দূরে চলে যায়। তার পিছনে পিছনে বাকি দুটি কুকুরও গেল।
পদ্মজা আরেক টুকরো মাংস খলিলের মুখের উপর ধরলো। তারপর কুকুর তিনটের আকর্ষণ পেতে মুখ দিয়ে শব্দ করলো,’হুশশ!’
খলিল হাওলাদার কুকুরগুলোর দিকে তাকিয়ে ভয়ে প্রস্রাব করে দিলেন। পদ্মজার ডাকে তিনটে নেড়ি কুকুর সাড়া দিল। তারা ঘেউ ঘেউ করে দৌড়ে আসে। খলিলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পদ্মজা আগের মতোই হাতের মাংস খলিলের উরুর উপর ছেড়ে দিল।
তারপর আরেক টুকরো মাংস নিয়ে আসমানির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বৈয়াম রাখলো মাটিতে। একটা কুকুর পদ্মজার পিছনে এসে দাঁড়ায়। ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করে,তাকে মাংস দিতে। পদ্মজার এক হাতে ছুঁরি বলে ভয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মাংস কেড়ে নেয়ার সাহস পাচ্ছে না। আসমানি পদ্মজাকে তার সামনে দাঁড়াতে দেখে গোপনে ঢোক গিলল। তার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। সে কিছু একটা বলতে চাইছে। চোখের জলে যেন এক্ষুনি বন্যা বয়ে যাবে! মেয়েরা ভালো হউক,খারাপ হউক, বুড়ো হউক আর যুবতী হউক তারা ভীষণ কাঁদতে পারে! পদ্মজা আসমানির মুখ মুক্ত করে দিল। আসমানি কাঁদো কাঁদো স্বরে অনুরোধ করলো,’ আল্লাহর দোহাই লাগে ভাবি,আমারে ছাইড়া দেন। আমি আপনার গোলামি করাম সারাজীবন।’
পদ্মজা আসমানির সামনে বসলো। আসমানির উপর ঝুঁকে তার গাল আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে আদুরে স্বরে বললো,’ তুমি ভীষণ সুন্দর।’
পদ্মজার ঠান্ডা স্পর্শ আসমানির যকৃত ছুঁয়ে ফেললো। সে কেঁপে উঠে। চোখেমুখে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে পদ্মজার চোখের দিকে তাকায়। পদ্মজা হাসলো। আসমানির চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে বললো,’ আমি পুরুষ না যে আমাকে আকৃষ্ট করবে। আমার বোনের মৃত্যুকষ্ট তোমাকেও অনুভব করতে হবে।’
পদ্মজা হাতের মাংসের টুকরোটি মজিদের উপর ছুঁড়ে মারলো। তাৎক্ষণিক কুকুর তিনটে মজিদের উপর আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে।
পদ্মজা আসমানির পায়ের দঁড়ি খুলে সেই দঁড়ি দিয়ে আসমানির গলা পেঁচিয়ে ধরে৷ আসমানির চোখ উল্টে যায়। পদ্মজার চোখেমুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে শান্ত,স্বাভাবিক। যখন আসমানি নিস্তেজ হওয়ার পথে পদ্মজা দঁড়ি ছেড়ে দিল৷ আসমানি কাশতে কাশতে নতজানু হয়। পদ্মজা আবার পেঁচিয়ে ধরলো। আসমানি দুই পা দাপিয়ে দম নেয়ার চেষ্টা করে। তার শাড়ি হাঁটু অবধি চলে এসেছে। যতক্ষণ না আসমানির নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হয় পদ্মজা শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে টেনে ধরে রাখে দঁড়ি। ক্ষণমুহূর্ত যুদ্ধে আসমানি নিস্তেজ হয়ে যায়। পদ্মজা দঁড়ি ছেড়ে দিল। আসমানির জিহবা মুখের ভেতর নেই। বাইরে বেরিয়ে এসেছে। চোখ দুটি উল্টে রয়েছে। সারামুখ কালচে ভাব। পদ্মজা তার দুই হাত ঝেড়ে আসমানির মৃত লাশ থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়।
পিঁপড়ার কামড়ে রিদওয়ানের কোমর থেকে পায়ের তালু অবধি অবশ হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ! শরীর ব্যথায় টনটন করছে। তার স্পর্শকাতর স্থান গুরুতর আহত। পদ্মজা ছুরি নিয়ে রিদওয়ানের সামনে এসে দাঁড়ায়। রিদওয়ানের উরুতে ছুরি প্রবেশ করে আবার বের করে আনে। রিদওয়ান চিৎকার করে উঠলো। অনেক কষ্টে উচ্চারণ করলো,’ আর না। আর না…’
পদ্মজা শূন্যে ছুরি ছুঁড়ে মেরে কৌশল করে ধরলো। তারপর ছুরি দিয়ে
রিদওয়ানের শরীরে অগণিত আঘাত করতে থাকে। তারপর এক চোখ তুলে নিল। রিদওয়ান জোরে আর্তনাদ করে উঠে। আকুতি করে তাকে মৃত্যু দিতে নয়তো বাঁচতে দিতে। পদ্মজা দাঁতে দাঁত চেপে রিদওয়ানের দুই গাল চিপা দিয়ে ধরলো। ফিসফিস আওয়াজের মতো করে বললো,’ এই…এই চোখগুলো আর কোনোদিন কোনো মেয়েকে দেখবে না।কোনোদিন না।’
রিদওয়ানের এক চোখ থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে৷ কুকুরগুলো আরো মাংসের জন্য বিরতিহীনভাবে চিৎকার করে যাচ্ছে৷ পদ্মজা তার কথা শেষ করে রিদওয়ানের আরেকটা চোখে ছুরি ঢুকিয়ে দিল। তারপরই মুখের উপর ছুরি দিয়ে তেরছাভাবে টান মারলো। রিদওয়ানের নাক ছিঁড়ে উপরের ঠোঁট দুই ভাগ হয়ে যায়। চিৎকার করার শক্তিটুকুও আর সে পেল না। তার পূর্বেই বেহুশ হয়ে যায়। পদ্মজা ক্রোধে মৃদু কাঁপছে। তার সাদা শাড়ি ইতিমধ্যে রাঙা হয়ে গেছে। সে রাম দা নিয়ে নিঃশ্বাসের গতিতে যেভাবে পারে রিদওয়ানকে কোপাতে থাকলো। তার মুখ দিয়ে ক্রোধ স্বর বের হচ্ছে। রিদওয়ান শরীরের মাংস ছিটকে পড়ে এদিকসেদিক। লুকিয়ে দেখা নিশাচরেরা একস্বরে ডেকে উঠে। তারা পদ্মজাকে তার কাজে সাহস যোগাতে কিছু বলছে? নাকি ভয় পেয়ে ডাকছে? কে জানে!
প্রায় মিনিট দশেক পর পদ্মজা স্থির হয়ে দাঁড়ালো৷ তার মুখ রক্তে অস্পষ্ট। চোখ দুটি ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। শাড়ি তাজা রক্তে জবজবে! সামনের চুলগুলো রক্তে আঠালো হয়ে গেছে। তার বুক হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে। নিঃশ্বাস নিচ্ছে ঘন ঘন। বাতাস পদ্মজার সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে আলিঙ্গন করার জন্য ধেয়ে আসে। পদ্মজা রাম দা থেকে রক্ত পড়ছে চুইয়ে চুইয়ে। সে রাম দা রেখে সদ্য কেনা চাপাতি তুলে নেয় হাতে। ঘুরে এসে মজিদের সামনে দাঁড়ায়। কুকুরের আঁচড় আর কামড়ে মজিদের প্রাণ নেতিয়ে পড়েছে! পদ্মজা মজিদের মুখের বাঁধন খুলে দেয় মজিদের শেষ আর্তনাদ শোনার জন্য। মজিদ অস্পষ্ট স্বরে বললো,’ মা,মা…আমায়…’
মজিদ কথা শেষ করতে পারলেন না। পদ্মজা চিৎকার করে হাত ঘুরিয়ে এক আঘাতে মজিদের মাথা দ্বিখণ্ডিত করে ফেললো। রক্ত ফিনকি দিয়ে ছিটকে পড়ে। বুরবুর শব্দ তুলে পেটের নাড়িভুড়ি ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। পদ্মজা এক মুহূর্তও থামলো না। হিংস্র তাণ্ডব চালিয়ে গেল। তার রক্তের তৃষ্ণা মিটেনি! সে খলিলের মুখের বাঁধন খুলে দিল। পদ্মজাকে রক্তমানবী মনে হচ্ছে। তার শরীরে প্রতিটি লোমকূপ রক্তে স্নান করেছে। খলিল হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো,’ও মা, ও মা আমারে ছাইড়া দেও। আমি তোমার বাপের মতো। ও মা আমারে ছাইড়া দেও….’
পদ্মজা দাঁত বের করে হাসলো। তার দাঁতেও রক্ত লেগে আছে! ভয়ানক দেখাচ্ছে! কোথায় গেল তার ভুবনমোহিনী রূপ? রক্তের সাগরে ডুব দিয়েছে সে। পদ্মজা চাপাতি দুই হাতে ধরে হাত ঘুরিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো খলিলকে আঘাত করতে থাকে। এক আঘাতেই খলিলের আত্মা দেহ ছেড়ে দেয়। কিন্তু পদ্মজা থামলো না। সে ক্রোধ স্বর মুখে রেখে খলিলকে ইচ্ছেমতো কোপাতে থাকলো। ক্যাচক্যাচ শব্দে চারপাশ কেঁপে কেঁপে উঠে। আঘাতে আঘাতে খলিলের এহ হাত,কান, নাক শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায়। পদ্মজা ক্লান্ত হয়ে চাপাতি খলিলের মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। বাম হাতে কোমর থেকে আরেকটা ছুরি নিয়ে খলিলের পেটে ঢুকিয়ে দিল। রিদওয়ান, মজিদ আর খলিলের রক্ত মাটি বেয়ে পুকুরের কালো জলের দিকে যাচ্ছে। পদ্মজা মাটিতে বসে পড়ে। নেড়ি কুকুরগুলো ভয় পেয়ে দূরে চলে গিয়েছে। দূর থেকে তারা পদ্মজাকে দেখছে।
হিংস্র ঝড়ের তান্ডব থামতেই চারিদিকে নিস্তব্ধতা ভর করে। পদ্মজা ভীষণ ক্লান্ত। সে দুই চোখ বুজে লম্বা করে নিঃশ্বাস নিল। তারপর মাথা তুলে আমিরের দিকে তাকালো। আমির এতক্ষণ পদ্মজার দিকে তাকিয়ে ছিল। পদ্মজাকে তার দিকে তাকাতে দেখে সে চোখ সরিয়ে নিল। আমিরের চোখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। সে শান্ত হয়ে বসে আছে। কোনো ছটফটানি নেই,অস্থিরতা নেই,ভয় নেই। সে নির্লিপ্ত। পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে ডান পাশে তাকালো। আমিরের দেয়া নতুন তলোয়ারটি ঘাসের উপর পড়ে আছে। পদ্মজা মাটিতে হাতের ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তিন কদম এগিয়ে তলোয়ারটি হাতে তুলে নিল। তারপর ফিরে তাকালো আমিরের দিকে। সেদিনের কথা,যেদিন আমির নিজে এই তলোয়ার পদ্মজার হাতে তুলে দিয়েছিল,জীবন নেয়ার অনুমতি দিয়েছিল! এ কথা শুনে পদ্মজার সেকি কান্না! কিন্তু আজ পদ্মজা শুধুই পদ্মজা,প্রিয় স্বামীর পদ্মবতী নয়! পদ্মজা শক্ত করে তলোয়ার ধরে সামনে এগিয়ে যায়। সে যত এগুচ্ছে অনুভব করছে বুকের ভেতরের শক্ত আবরণটা সরে যাচ্ছে। একটা নরম কোমল অনুভূতি জেঁকে বসছে!
পদ্মজা আমিরের সামনে এসে দাঁড়াতেই আমির চোখ তুলে তাকালো। এইযে রাতের বাতাসে পদ্মজার এক দুটো চুল উড়ছে। তাতেও ভালো লাগছে। রক্তের মাখামাখিও পদ্মজার রূপের বাহার নষ্ট করতে পারেনি। অন্তত আমিরের কাছে!
নির্জন,নিরিবিলি পরিবেশে আমিরকে এমন অবস্থায় এতো কাছে দেখে পদ্মজার চোখগুলো শীতল হয়ে উঠে। তার মনে হচ্ছে, আমিরের চোখ,পা,হাত,বুক,বাহু সব কথা বলছে! সেদিনই তো তাদের বিয়ে হলো। আমির তার শক্তপোক্ত দুটি হাত দিয়ে পদ্মজাকে কোলে নিয়ে ঘরে তুলে। উপহার দেয় নতুন সংসার,নতুন পৃথিবী! সে আমিরের সংস্পর্শে এসে আবিষ্কার করে নতুন এক সত্ত্বা। পুরনো কথা ভেবে পদ্মজার কণ্ঠনালিতে একটা যন্ত্রণা ঠেকছে। তার কণ্ঠনালী ব্যথা করছে! সে মাটিতে তলোয়ার রেখে রেইনট্রি গাছের দঁড়ি থেকে আমিরকে মুক্ত করে দেয়। এখন শুধু আমিরের হাত-পা আর মুখ বাঁধা। পদ্মজা আমিরের সামনে বসলো। আমিরের নতজানু মুখটা নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করলো । তারপর আমিরের বুকে সাবধানে এক হাত রাখলো। পদ্মজার একটুখানি ছোঁয়া আমিরের সত্ত্বাকে কাঁপিয়ে তুলে। যেন সমুদ্রের ঢেউ গর্জে উঠে। আকাশ ভেঙে বজ্রপাত পড়ে!
কুকুরগুলো ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। পদ্মজার ছলছল চোখ দুটি স্পষ্ট! আমিরের মনে হচ্ছে, আকাশের চাঁদটা ঠিক পদ্মজার মাথার উপরেই। সে সকল অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু পদ্মজাকে কোমল চোখে তাকাতে দেখে তার বুকটা হুহু করে কেঁদে উঠলো। চোখের চাহনীতে মনের সবটুকু ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছে পদ্মজা। বুঝা যাচ্ছে সে আমিরের প্রেমে কতোটা মাতোয়ারা! আমির আশা করেনি,এই মুহূর্তে এতোকিছুর পর পদ্মজার চোখে পুরনো প্রেম দেখতে পাবে! বুকটা আর কত পুড়বে? যখন একসাথে থাকা সম্ভবই নয়।
আমিরের চুপ থাকা,আমিরের নির্লিপ্ততা বলে দিচ্ছে সে পদ্মজার কোনো আঘাতকেই পরোয়া করে না। আমিরের মায়া মায়া চোখ দুটি গ্রাস করে ফেলে পদ্মজাকে। কেনো জানি তার খুব কান্না পাচ্ছে! বুকের ভিতরে কোথায় যেনো লুকানো জায়গা থেকে একদল অভিমান প্রচণ্ড কান্না হয়ে দু’চোখ ফেটে বেরুতে চাইছে। পদ্মজা ধীর কণ্ঠে বললো,’কেন আমায় ভালোবাসলেন না?’
তার কণ্ঠে কান্না! আমিরের এক চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে। সে কোন শাব্দিক উচ্চারণে বোঝাবে,পদ্মজাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসে? কী করে বলবে? সে পদ্মজার জন্য বিষের দাঁনা!
ভালোবাসা এক ভয়ংকর মহামারির নাম। যে মহামারির একমাত্র পথ,বিপরীত মানুষটিকে ছাড়া নিঃস্ব হয়ে যাওয়া। এই মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে কত মানুষ বৈরাগী হয়েছে! আর আমির বেছে নিয়েছে মৃত্যু! পদ্মজা হুট করে আমিরের কপালে চুমু খেল। আমিরের হৃৎপিণ্ড জ্বলে উঠে! তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। পদ্মজার দুই চোখের জল আটকাতে পারলো না। সে বললো,’ আপনার দুটি সত্ত্বার একটি আমার স্বামী। আমি তাকে সম্মান করি। কিন্তু অন্য সত্ত্বার জন্য আপনাকে মরতে হবে।’
পদ্মজা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকাচ্ছে। আমির নিজেকে সামলে চোখের দৃষ্টি নত করলো। পদ্মজা নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে,বুকটা জ্বলে যাচ্ছে কেন? একটু আগের তেজটা কেন নেই বুকের ভেতর? আমিরের ভালোবাসার অভাব তাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। ছয়টা বছর মানুষটা এতো কেন ভালোবাসলো? এত নিখুঁত ভালোবাসার অভিনয় হতে পারে? কাঙাল সে,তার স্বামীর ভালোবাসার কাঙাল। কিন্তু সেই ভালোবাসাই প্রতারণা করলো। এই ভালোবাসা ভাগ হয়েছে আরো আগে। কষ্টগুলো বাতাসে উড়ে যায় না কেন?
পদ্মজা খাপ থেকে তলোয়ার বের করলো। তলোয়ারখানা দেখে পদ্মজার বুকের ভেতরে দ্রিমদ্রিম করে কিছু বাজতে থাকে। কেঁপে উঠে তার হাত। পদ্মজা ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করলো। তারপর কাঁপা হাতে আমিরের মুখ থেকে ওড়নার বাঁধন খুলে দিল। আমিরের আর্তনাদ শোনার জন্য নয়! সে চায়,আমির তাকে কিছু বলুক। কিন্তু কী শুনতে চায় সে জানে না। আমিরের বেলা সে কঠোর হওয়া তো দূরে থাক,তলোয়ার চালানোর সাহস পাচ্ছে না। আমির মাথা নত করে অপেক্ষা করছে মৃত্যুর জন্য। মৃত্যু তার জন্য উপহার! পদ্মজা আঘাত করতে সময় নিচ্ছে। আমিরের নিশ্চুপতা তার মনের ব্যথা বাড়িয়ে দিচ্ছে। সে বেহায়া হয়ে কাঠ কাঠ কন্ঠে বললো,’কিছু বলার আছে?’
আমির তাকালো। এইতো…এই দৃষ্টি পদ্মজাকে খুন করে ফেলে! তীরের বেগে বুকের ভেতর ছিদ্র করে ফেলে! এই পৃথিবীতে নাকি শ্যামবর্ণ অবহেলিত! অথচ ভুবনমোহিনী রূপসী পদ্মজা শ্যামবর্ণ এক পুরুষকে ভালোবেসে থমকে গিয়েছে! আমির বললো,’ গত চারদিনের যন্ত্রণার একাংশ যদি তুমি অনুভব করতে আমাকে খুন না করে বাঁচিয়ে রাখতে। আমার শাস্তি হতো আমার বেঁচে থাকা!’
আমির কথা শেষ করে চোখের পলক ফেলার পূর্বে পদ্মজা তার বুকের মধ্যিখানে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিল। তলোয়ার বুক ভেদ করে পিঠে গিয়ে ঠেকে!
আচমকা আক্রমণ করায় আমির অবাক হলো। তার মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। বুকের যন্ত্রণারা শেষবারের মতো দুই চোখ ছাপিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আমিরের মুখ থেকে এতো রক্ত বের হতে দেখে পদ্মজার পায়ের তলা কেঁপে উঠে। সে সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ার টেনে বের করলো। আমিরের দেহটা দপ করে শব্দ তুলে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। পদ্মজা বুক ছ্যাঁৎ করে উঠে। বুকের ভেতর পাহাড় ধ্বসে পড়ে। সে দ্রুত আমিরের দুই হাতের বাঁধন খুলে দেয়। বুকের ভেতর থেকে শব্দ তুলে কান্নারা বেরিয়ে আসে। সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,’ যাবেন না…যাবেন না।’
আমিরের শরীর দুই-তিনটে ঝাঁকি দিয়ে নিথর হয়ে যায়। পদ্মজা মাথায় এক হাত দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো এদিকসেদিক তাকায়। তার শরীরটা কেমন যেন করছে। চোখের সামনে তিলে তিলে গড়ে তোলা প্রেমের রাজপ্রাসাদ ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে! সে শব্দ শুনতে পাচ্ছে। শব্দের আঘাতে তার মগজ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। পদ্মজা আর্তনাদ করে উঠে। দুই হাতে মাটি চাপড়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো,’আল্লাহ…আল্লাহ।’
তার চিৎকার শুনে সন্তানহারা পেঁচাটির কান্না থেমে যায়। ‘আল্লাহ’ উচ্চারণটি প্রতিধ্বনিত হতে থাকে যেন বার বার৷ এই একটি ডাকে পদ্মজার সর্বহারার বেদনা ফুটে উঠে। সে আপন মানুষদের মৃত্যু দেখতে দেখতে ক্লান্ত। তার যন্ত্রণার পাহাড় ভেঙে গেছে। পদ্মজা বাচ্চাদের মতো হাঁটুতে ভর দিয়ে একবার ডানে যায় আরেকবার বামে যায়। তারপর আমিরের মাথার কাছে এসে বসে। আমিরের চোখ দুটো খোলা। পদ্মজার দিকে তাকিয়ে আছে! চোখ জোড়ার কি পদ্মজাকে দেখার তৃষ্ণা মেটেনি?
“তোমাকে দেখার তৃষ্ণা আমার কখনোই মিটবে না,পদ্মবতী।” পদ্মজা চমকে পিছনে তাকায়। কেউ নেই। ডান পাশ থেকে আবার শুনতে পায় একই কথা। পদ্মজা ডান পাশে তাকায়। তারপর শুনতে পায় বাম পাশ থেকে। পদ্মজা চরকির মতো ঘুরতে থাকে। সে বাস্তব দুনিয়া থেকে বেরিয়ে এসেছে অনেক আগে। আমিরের বলা পুরনো কথাগুলো সে শুনছে। প্রতিটি কথা তাকে সূচের মতো খোঁচাচ্ছে। পদ্মজা এতো ব্যথা সহ্য করতে না পেরে দুই হাতে খামচে ঘাস টেনে তুললো। তারপর এক হাত দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে করতে চিৎকার করে কাঁদলো।
কাঁদতে কাঁদতে তার গলার স্বর স্তব্ধ হয়ে যায়। সে শরীরের ভার ছেড়ে দেয়। সেজদার মতো উঁবু হয়। তারপর মাথা তুলে এক হাতে আমিরের চোখ দুটি বন্ধ করে দিল। চোখের জল মুছে চারপাশে চোখ বুলাল। তার চোখের দৃষ্টি অস্থির৷ নিঃশ্বাস এলোমেলো। এই বিশাল পৃথিবীতে এখন সে একা!
আচমকা সে উঠে দাঁড়ায়। যেখানে ভোজ আসর হয়েছিল সেখানে ছুটে যায়। আমিরের প্লেট আলাদা। তার প্লেটে দুটো পদ্মফুল আঁকানো। পদ্মজা খুঁজে খুঁজে আমিরের প্লেটটা বের করলো। সেখানে কিছু খাবার অবশিষ্ট ছিল। পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার আমিরের মৃত দেহ দেখলো। তারপর দ্রুত অবশিষ্ট খাবারটুকু খেল। খাবার শেষ হতেই পানি না খেয়েই দৌড়ে আমিরের কাছে আসে। একটা তীক্ষ্ণ ঠান্ডা স্রোত বুকের এদিক থেকে ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। চাঁদটা অর্ধেক ডুবে গিয়েছে। তবে তার আলো এখনো রয়ে গেছে৷ পদ্মজা আমিরকে টেনে সোজা করলো৷
আমিরের শার্টের বুক পকেট থেকে একটি বিষের শিশি বেরিয়ে আসে। পদ্মজা শিশিখানা হাতে নিয়ে অবাক চোখে আমিরের ফ্যাকাসে মুখটা দেখে। সে কিছু একটা বলে কিন্তু কথাটি ফুটল না। তার কথা হারিয়ে গেছে! তারপর ভাবলো, বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবে৷ কিন্তু পরক্ষণে মনে পড়লো, আত্মহত্যা মহাপাপ! পদ্মজা বিষের শিশি ছুঁড়ে ফেলে পুকুরে।
আমিরের মাথাটা কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ গুনগুন করে কাঁদলো পদ্মজা। বাতাসের বেগ বেড়েছে। রক্ত শুকোনোর পথে। ঠান্ডা কাঁটার মতো বিঁধছে শরীরে। পদ্মজার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। সে রক্তাক্ত আমিরকে টেনে মাঝে নিয়ে এসে সুন্দর করে শুইয়ে দিল। তারপর আমিরের নিথর দেহটিকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে তার বুকের উপর শুয়ে পড়লো। মিনিট দুয়েক পর ঘুম ঘুম চোখে মাথা উঁচু করে আমিরের দুই গালে সময় নিয়ে দুটো চুমু দিল পদ্মজা। একটা কুকুর পদ্মজাকে ঘিরে হাঁটছে। আর বাকি দুটো কুকুর মজিদ,খলিল,রিদওয়ান ও আসমানির লাশ শুঁকছে। ক্লান্ত পদ্মজা আমিরের বুকে শুয়ে শান্ত হলো। চোখ বুজলো। যে পৃথিবীর লীলাখেলায় সে বাধ্য হয়েছে স্বামীর বুকে অস্ত্র চালাতে সেই পৃথিবীর উদেশ্যে মনের খাতায় চিঠি লিখলো-
“ক্ষমা করো পৃথিবী। তাকে আমি ঘৃণা করতে পারিনি। তাকে আমি নিষ্ঠুর মৃত্যু দিতে পারিনি। যার হাতের পাঁচটি আঙুল আমার নির্ভরতা,যার বুকের পাঁজরে লেগে থাকা ঘামের গন্ধ আমার সবচেয়ে প্রিয়,যার উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া আমার প্রতিদিনের অভ্যাস, যার এলোমেলো চুলে আমি হারিয়ে যাই বারংবার, যার ভালোবাসার আহবানে সবকিছু তুচ্ছ করে ছুটে যাই,যার মিষ্টি সোহাগে অন্য জগতে হারিয়ে যাই, তার কষ্ট আমি কী করে সহ্য করি? লোকে বলে, স্বামীর বাঁ পাঁজরের হাড়ে স্ত্রী তৈরি। তাহলে যার পাঁজরে আমার সৃষ্টি তার আর্তনাদ কী করে শুনি? এই কঠিন কাজ আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ও পৃথিবী সবাইকে বলে দিও,আমার কবরটা যেন আমার স্বামীর কবরের ঠিক বাঁ পাশেই হয়! আমি তাকে ভালোবাসি। যেমন সত্য চন্দ্র-সূর্য তেমন সত্য আমি তাকে ভালোবাসি!
শেষ রাত্রি। চারিদিকে ছড়িয়ে আছে রক্ত,একটি জিহবা বের করা নারী দেহ,তিনটি ক্ষত-বিক্ষত পুরুষ দেহ ও একটা মাথা। মাঝখানে শুয়ে আছে আমির হাওলাদার। তার বুকের উপর শুয়ে আছে তারই অর্ধাঙ্গিনী তারই খুনি উম্মে পদ্মজা! খাবারে ঘুমের ঔষধ ছিল বলে, পদ্মজা ঘুমিয়ে পড়েছে। তিনটে নেড়ি কুকুর এলোমেলো হয়ে এদিক সেদিক হাঁটছে। সাঁইসাঁই করে বাতাস বইছে। অনেকগুলো তারার মাঝে একটা চাঁদ। স্বচ্ছ আকাশ। চাঁদটা তার নরম আলো নিয়ে ঠিক আমির-পদ্মজার উপর স্থির হয়ে আছে।
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ