আমি পদ্মজা – ৮৪
_________
হৃদয়ের প্রলয়ঙ্করী ঝড় ক্ষণমুহূর্তের জন্য থামিয়ে আমির বললো,’ ছাড়ো পদ্মজা।’
পদ্মজার কান্না থেমে যায়! হাত দুটি আমিরের পিঠ থেকে সরে যায়। পদ্মজা তার জলভরা নয়ন দুটি মেলে আমিরের দিকে তাকালো। তার রক্ত জবা ঠোঁট দুটি কাঁপছে। হোঁচট খাওয়া গলায় পদ্মজা বললো,’ আমার হৃদয়ের আকুলতা আপনাকে ছুঁতে পারছে না?’
আমির ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে। পদ্মজা দূরে সরে দাঁড়ালো। আমিরের কৃষ্ণ মুখে, বিপর্যস্ত পদ্মজার নিষ্কম্প স্থির চোখের দৃষ্টি থমকে আছে। পদ্মজা থেমে থেমে বললো,’ তাহলে আমি…আমিও বঞ্চিত ভালোবাসা থেকে!’
পদ্মজার দুই চোখ বেয়ে জল পড়ছে। আমির আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। চোখের পলকে প্রস্থান করলো। পদ্মজা ধাতস্থ হয়ে আচমকা ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো চিৎকার করে উঠলো,’ ধিক্কার নিজের উপর! জানোয়ারকে মানুষ হওয়ার সুযোগ দিয়েছি! ধিক্কার নিজের ভালোবাসার উপর! প্রতিটি কাজের জন্য আপনি শাস্তি পাবেন। আমি আপনার আজরাইল হবো।’
পদ্মজার গলার হাড় ভেসে উঠে। তার চিৎকার অন্দরমহলকে কাঁপিয়ে তুলে। কাঁদতে-কাঁদতে সে মেঝেতে বসে পড়লো। আমিরের প্রত্যাখ্যান তার ভালোবাসাকে ক্রোধে পরিণত করছে। পদ্মজা রাগে বিছানার চাদর টেনে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললো। বুকের ভেতরটা পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে! ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ! পানি প্রয়োজন!
ফরিনার কবরের চারপাশে বাঁশের বেড়া দেয়া হয়েছে। আমির ফরিনার কবরের পাশে এসে বসলো। হাতের ব্যাগটা পাশে রেখে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ফরিনার কবরে হাত বুলিয়ে দিল। গাঢ় স্বরে ডাকলো,’আম্মা! আমার আম্মা।’
চারিদিকে নিস্তব্ধতা। অন্দরমহল থেকে কোনো শব্দ আসছে না। নিস্তব্ধতা ভেঙে- ভেঙে মাঝেমধ্যে পাতার ফাঁকেফাঁকে পাখ-পাখালির ডানা নাড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমিরের ঠোঁট দুটো কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। অথবা সে কিছু বলছে কিন্তু শব্দ হচ্ছে না। আড়ষ্টতা ঘিরে রেখেছে তাকে। সে তার মৃত মা’কে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। আমির অনেকক্ষণ নতজানু হয়ে চুপচাপ বসে রইলো। তারপর উঠে দাঁড়ালো। ব্যাগ হাতে নিয়ে পাতালঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে। লতিফা অন্দরমহল থেকে অস্থির হয়ে বের হয়। তার হাঁটায় তাড়াহুড়ো।
আমির ডাকলো,’ লুতু।’
লতিফা দাঁড়াল। আমির বললো,’ পদ্মজার খেয়াল রাখবি। খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক রাখবি। আর, যখন যা বলে করবি।’
লতিফা মাথা নাড়াল। আমির প্রশ্ন করলো,’কোথায় যাচ্ছিস?’
আমিরের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে লতিফা বললো,’ ভাইজান,তোমারে কিছু কইতাম।’
‘বল।’
‘মৃদুল ভাইজানে আর তার আম্মা-আব্বা আইছিলো। মৃদুল ভাইজানের আম্মা মৃদুল ভাইজানরে পূর্ণার লগে বিয়া করাইতে রাজি হয় নাই। ‘
আমির কপাল কুঁচকাল। বললো,’কী সমস্যা? কেন রাজি হয়নি?’
রিদওয়ান অন্দরমহল থেকে বের হয়ে ফোড়ন কাটলো,’আমির,তোর সাথে কথা আছে।’
আমির পিছনে ফিরে তাকালো না। বললো,’পরে শুনব।’
রিদওয়ান বললো,’আমি জানি কেন রাজি হয়নি। আয়,ওদিকে যেতে যেতে বলি।’
লতিফা রিদওয়ানের দিকে তাকায়। রিদওয়ান তার চোখের দৃষ্টি দিয়ে লতিফাকে সতর্ক করে। আমির রিদওয়ানের দিকে ফিরে বিরক্তি নিয়ে বললো,’ আরে ভাই,যা তো। লুতু কী কী হয়েছে বলতো?’
রিদওয়ানের সামনে রিদওয়ান সম্পর্কে কিছু বলার সাহস লতিফার হলো না। সে বললো,’ মৃদুল ভাইজানের আম্মা পূর্ণার গায়ের রঙ পছন্দ করে নাই। কইছে,কালা ছেড়ি ঘরে নিব না।’
আমির রাগ নিয়ে বললো,’ফালতু মহিলা! পূর্ণা জানে? কোথায় পূর্ণা?’
‘হ জানে। এই বাড়িত আছিলো। এহন হেই বাড়িত গেছে।’
‘মৃদুল…মৃদুল কী বললো?’
লতিফা পুরো ঘটনা খুলে বললো। এড়িয়ে গেল পদ্মজার ব্যাপারটা। সে মনে মনে পরিকল্পনা করলো,রাতে যদি রিদওয়ান অন্দরমহলে থাকে সে পাতালঘরে গিয়ে আমিরকে সব বলবে। আমির সব শুনে বললো,’ মৃদুল ছাড়া এই পরিস্থিতি ঠিক হবে না। দেখা যাক,ও কী সিদ্ধান্ত নেয়। আর ওই মুখছুটা মহিলাকে আমি একবার পাই শুধু!’
আমির রাগে গজগজ করতে করতে সামনে এগিয়ে যায়। রিদওয়ান লতিফাকে চাপা স্বরে হুমকি দিল,’ গতকালের ঘটনা যদি আমিরের কানে যায় তোর খবর আছে। ল্যাং* করে গাছে ঝুলিয়ে রাখবো।’
লতিফা চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। বললো,’ বাড়ির বাইরে গেলেই আমির ভাইজানে সব জাইননা যাইব। তহন ?’
লতিফার প্রশ্ন শুনে রিদওয়ান চিন্তায় পড়ে যায়। সে আমিরের পিছনে যেতে যেতে ভাবতে থাকে,এই পরিস্থিতি কী করে সামাল দিবে! আজ না হয় কাল আমির তো সব জানবে! আমির জঙ্গলে প্রবেশ করে রিদওয়ানকে বললো,’ কী কথা না বলবি!’
রিদওয়ান বললো,’ শনিবার রাতে ভোজ আসর হবে। চাচা সিদ্ধান্ত নিল।’
‘আচ্ছা।’
‘ছাগলের মাংস পুড়ানো হবে।’
‘কয়টা?’
‘দুটো।’
‘বিরাট আয়োজন!’
দুজন কথা বলতে বলতে পাতালঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। রিদওয়ান ঘাস সরিয়ে দরজা খুললো। এক পা সিঁড়িতে দিতেই আমির রিদওয়ানের কাঁধ চেপে ধরলো। ফিসফিসিয়ে বললো,’এখানে কেউ আছে!’
আমিরের কথা শুনে রিদওয়ানের বুক ছ্যাঁত করে উঠলো। এমতাবস্থায় কে দেখে ফেললো! রিদওয়ান চারপাশে চোখ বুলায়। কোথাও কেউ নেই! আমিরের প্রখরতা নিয়ে তাদের কোনো সন্দেহ নেই। আমির যেহেতু বলেছে এখানে কেউ আছে। মানে আছে। রিদওয়ান চাপাস্বরে বললো,’এখন কী করব?’
আমির দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যাক্তি। সে চারপাশে আরো একবার চোখ বুলিয়ে বললো,’ কেউ এখানে থাকলে সে ডান দিকে আছে।’
রিদওয়ান ডান দিকে এগিয়ে যায়। তখনই একজন লোক ঝোপঝাড়ের মাঝখান থেকে উঠে দৌড়াতে শুরু করে। রিদওয়ান উল্কার গতিতে তাকে ধরে ফেললো। লোকটার মাথায় চুল নেই। পরনে লুঙ্গি আর ফতুয়া। পাটকাঠির মতো চিকন লোকটা ইয়াকুব আলীর সহকারী পলাশ মিয়া। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি অথবা ত্রিশই। রিদওয়ান পলাশকে ঘাড়ে ধরে আমিরের সামনে নিয়ে আসে। দেখে মনে হচ্ছে,রিদওয়ান জীবিত ইঁদুর ধরেছে। আমির পলাশকে প্রশ্ন করলো,’ নির্বাচনের তো অনেক দেরি আছে। এখনই আমাদের পিছনে পড়ার রহস্যটা বুঝলাম না।’
পলাশ পাতালঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে বললো,’ এইডা কিতা? এইহানে কিতা করেন আপনেরা?’
আমির হাসলো। পলাশের মাথায় টোকা মেরে বললো,’ এই দৃশ্য দেখা তোর একদম ঠিক হয়নি। আয়ুটা কমে গেল।’
আমির পাতালে নেমে গেল। পলাশ ছটফট করতে থাকে। সে কিছুতেই ভেতরে যাবে না। সে ভয় পাচ্ছে। রিদওয়ান পলাশকে টেনে ভেতরে নিয়ে যায়। আমির বিওয়ানের চেয়ারে এসে বসলো। রিদওয়ান পলাশকে বেঁধে মেঝেতে ফেললো। চিৎকার,চেঁচামেচি করার জন্য পলাশ রিদওয়ানের হাতে দুই-তিনটা থাপ্পড় খেল। পলাশ কাঁদো-কাঁদো হয়ে আমিরকে বললো,’ আপনেরা এমন করতাছেন কেন আমার লগে? আমারে ছাইড়া দেন।’
রিদওয়ান আমিরকে বললো,’তুই সামলা। আমি যাই,চাচার সাথে কথা আছে।’
আমির ইশারা করলো, যেতে। রিদওয়ান চলে গেল। পলাশ চারপাশ দেখে ঢোক গিললো। পাতালঘর মৃদু লাল-হলুদ আলোতে ডুবে আছে। কেমন ভূতুড়ে পরিবেশ! তার মনে হচ্ছে,সে কবরে আছে। আর সামনে ঘাড় বাঁকিয়ে বসে আছে স্বয়ং যমদূত! আমির এক পা চেয়ারে তুলে বললো,’ তারপর,পলাশ মিয়ার এখানে কোন দরকারে আসা হয়েছে?’
পলাশ হাতজোড় করে বললো,’আমারে ছাইড়া দেন। আমি এমন কবর আর দেহি নাই। আমার কইলজাডা কাঁপতাছে।’
আমির ধমকে বললো,’এখানে আসছিলি কেন?’
পলাশ দ্রুত বললো,’ ইয়াকুব চাচা পাডাইছে।’
‘কোন দরকারে?’
‘আমারে খালি কইছে,মজিদ মাতব্বরের বাড়িত যা। আমার মনে হইতাছে ওই বাড়িত কিছু একটা গোলমাল আছে। কিছু যদি বাইর করতে পারছ তোরে আরেকটা বিয়া দিয়া দিয়াম।’
আমির চমকাল। বললো,’উনার হুট করে কেন মনে হলো এখানে গোলমাল আছে?’
পলাশ কেঁদে বললো,’আমি এইডা জানি না ভাই। আমারে ছাইড়া দেন।’
আমিরের মাথায় কয়েকটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়ে যায়। কী এমন হলো যে, ইয়াকুব আলী হাওলাদার বাড়ি নিয়ে সন্দেহ করছে! আমির আয়েশি ভঙ্গিতে বসলো। বললো,’ শুনেছি,গত বছর তোর বউকে নাকি হিন্দু এক জমিদারের কিনে নিয়েছে । তারপর তোর বউ আত্মহত্যা করলো! সত্যি?’
পলাশ মেঝেতে কপাল ঠেকিয়ে বললো,’ভাই,আমারে মাফ কইরা দেন। আমি ভুল করছিলাম। আমারে ছাইড়া দেন। আমি কেউরে কিছু কইতাম না।’
আমির বললো,’তুইতো ভাই আমার চাইতেও খারাপ। আচ্ছা,সবসময় তো পাপ কাজ করেছি। আজ একটা ভালো কাজ করার সুযোগ যখন পেয়েছি,করে ফেলি।’
পলাশের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। সে জানে না,এই কবরস্থানের মতো বড় ঘরটায় কী হয়! কিন্তু এখানে যে ভালো কিছু হয় না বুঝা যাচ্ছে। বাঁচতে পারলে পরে এর রহস্য বের করা যাবে। আমির চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পলাশের মুখে জোরে লাথি দিল। পলাশ আর্তনাদ করে শুয়ে পড়ে। আমির চারিদিকে চোখ বুলিয়েও কোনো অস্ত্র পেল না। সে টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা কাঁচি বের করলো। ধারালো কাঁচি। সে কাঁচি দিয়ে পলাশের মুখে আঁচড় কাটে। হাতে-পায়ে,শরীরে আঁচড় কাটে। পলাশের বিদঘুটে চিৎকার পাতালঘরেই চাপা পড়ে যায়। তার চামড়া ছিঁড়ে রক্ত ঝরতে থাকে। আমিরকে আব্বা ডেকে অনুরোধ করে,তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু সে জানে না, আমির কখনো তার শিকারের প্রতি মায়া দেখায় না। আমির পলাশের পাশে বসলো। দুই-তিনবার মাথা ঘুরাল। খুব নিঃস্ব লাগছে নিজেকে,মাথাটা ফাঁকা লাগছে। সে কাঁচি দিয়ে নিজের হাতে হেঁচকা টান মারে। সাথে-সাথে হাত থেকে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসে। পলাশ আমিরের কাণ্ড দেখে চমকে যায়। আমির কাঁচি রেখে মেঝেতে শুয়ে পড়ে। শূন্যে চোখ রেখে হাসে। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি করে দেয়ালের পাশে যায়। ভয়ে পলাশের আত্মা কেঁপে উঠে! আমির দেয়ালের পাশ ঘেঁষে বসে। পলাশের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে উঠে। হঠাৎ করে তার কী হয়ে গেল? আমিরের উন্মাদ আচরণ দেখে পলাশের গায়ের পশম দাঁড়িয়ে পড়ে। আমির চট করেই উঠে দাঁড়াল। পলাশকে টেনে বসালো। তারপর নিজে গিয়ে চেয়ারে বসলো।
ব্যাগ থেকে কাগজে মুড়ানো বস্তুটি বের করলো। কাগজের ভাঁজ খুলতেই একটা লাল বেনারসি বেরিয়ে আসে। আমির লাল বেনারসি গায়ে জড়িয়ে নিয়ে পলাশকে বললো,’আমার আম্মা ছোটবেলা একটা গল্প বলতেন,এক রাজা প্রতি রাতে বিয়ে করে প্রতি রাতেই বউকে খুন করতেন। তারপর শেষদিকে যে রানিকে বিয়ে করেন সেই রানি রাতজেগে রাজাকে গল্প শোনাতেন। গল্প শেষ হতো না বলে রাজাও রানিকে খুন করতে পারতেন না। রানি এভাবে গল্প বলে-বলে অনেকদিন বেঁচে ছিলেন। এখন আমি তোকে একটা গল্প শোনাব। আমাদের নিয়ম হচ্ছে,যতক্ষণ আমার গল্প চলবে ততক্ষণ তুই বেঁচে থাকবি। গল্প শেষ তোর আয়ুও শেষ।’
পলাশ হাতজোড় করে আকুতি-মিনতি করলো,’ ভাই,আমার জীবন ভিক্ষা দেন। আপনেরা তো ভালা মানুষ ভাই। আপনেরার অনেক নাম। আমারে কেন মারতে চাইতাছেন? আমারে ছাইড়া দেন ভাই।’
পলাশের কথায় আমিরের ভাবান্তর হলো না। সে বেনারসি থেকে ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করলো। তারপর শূন্যে চোখ রেখে ঘোর লাগা গলায় বললো,’ এক ছিল দুষ্টু রাজা! নারী আর টাকার প্রতি ছিল তার চরম আসক্তি। যে নারী একবার তার বিছানায় যেত তার পরের দিন সে লাশ হয়ে নদীতে ভেসে যেত। রাজা এক নারীকে দ্বিতীয়বার ছুঁতে পছন্দ করতো না। কিন্তু সমাজে ছিল রাজার বেশ নামডাক! সবার চোখের মণি। খুন করা ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। তার কালো হাতের ছোঁয়ায় বিসর্জন হয়েছে হাজারো নারী। প্রতিটি বিসর্জন রাজার জন্য ছিল তৃপ্তিকর। তাকে শাস্তি দেয়ার মতো কোনো অস্ত্র ছিল না পৃথিবীতে। ভাইয়ের সাথে বাজি ধরে হেরে যায় রাজা। শর্তমতে,ভাইয়ের জন্য এক রাজকন্যাকে অপহরণ করতে যায়। সেদিন ছিল বৃষ্টি। সন্ধ্যার আগ মুহূর্ত। রাজকন্যার প্রাসাদে সেদিন কেউ ছিল না। রাজা এক কামরায় ওৎ পেতে থাকে। রাজকন্যা আসলেই তাকে তার কালো হাতে অপবিত্র করে দিবে। কামড়ায় ছিল ইষৎ আলো। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত আসে। রাজকন্যার পা পড়ে কামড়ায়। রাজকন্যা রাজাকে দেখে চমকে যায়। ভয় পেয়ে যায়। কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করে “‘কে আপনি? খালি বাড়িতে কেন ঢুকেছেন?” সেই কণ্ঠ যেন কোনো কণ্ঠ ছিল না। ধনুকের ছোঁড়া তীর ছিল। রাজার বুক ছিঁড়ে সেই তীর ঢুকে পড়ে। রিনঝিনে গলার রাজকন্যাকে দেখতে রাজা আগুন জ্বালাল। আগুনের হলুদ আলোয় রাজকন্যার অপরূপ মায়াবী সুন্দর মুখশ্রী দেখে রাজা মুগ্ধ হয়ে যায়। তার পা দুটো থমকে যায়। রাজকন্যা যেন এক গোলাপের বাগান। যার সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ে রাজার কালো অন্তরে। রাজা কী আর তখন বুঝেছিল,সৃষ্টিকর্তা তাকে তার পাপের শাস্তি দেয়ার জন্য সেদিন অস্ত্র পাঠিয়েছিল!’
আমির পলাশের দিকে তাকিয়ে হাসলো। কী মায়া সেই হাসিতে! মায়াভরা সেই হাসি প্রমাণ করে দিল,সেদিনটার জন্য সে কতোটা খুশি!
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ
আমি পদ্মজা – ৮৫
________
মঙ্গলবার দুপুর বারোটা। হাওলাদার বাড়িতে কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। আলগ ঘরের বারান্দায় মজিদ বসে আছেন। তার সামনে খলিল এবং রিদওয়ান। রিদওয়ান চারপাশ দেখে মজিদের দিকে ঝুঁকে বললো,’ কাকা,পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে। তার আগে আমাদের কিছু করতে হবে।’
মজিদ পান চিবোতে চিবোতে বললেন,’ কোন পরিস্থিতি?’
‘আমিরের হাব-ভাব ভালো না। ও কখন আমাদের উপর চড়া হয়ে যায় জানি না। আপনি আমি আব্বা সবাই জানি আমির কী কী করতে পারে! আমির আমাকে আর আব্বাকে কখনোই পছন্দ করেনি। আপনাকেও সেদিন মারলো। তাছাড়া আমাদের উপর আমিরের পুরনো একটা ক্ষোভ আছে।’
মজিদ পান চিবানো বন্ধ করে বললেন,’ বাবু আমাদের খুন করবে?’
রিদওয়ান সোজা হয়ে বসলো। লম্বা করে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,’ কাকা, আমির পদ্মজার জন্য পাগল। পদ্মজার জন্য অনেক কিছু করতে পারে। আমাদের খুন করে পদ্মজাকে নিয়ে ভালো থাকতে চাইতেই পারে।’
মজিদ হাসলেন। যেন রিদওয়ান কোনো কৌতুক বলেছে। রিদওয়ান অধৈর্য্য হয়ে পড়ে। বললো,’কাকা,বিশ্বাস করুন আমি আমিরর চোখেমুখে কিছু একটা দেখেছি। ও কিছু একটা করতে যাচ্ছে। আর পদ্মজা তো আছেই। পদ্মজা এতো শান্ত-স্বাভাবিক,মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি। এসব লক্ষণ কিন্তু ভালো না কাকা। আমির যেমন ভয়ংকর পদ্মজাও তেমন ভয়ংকর। যেকোনো মুহূর্তে আমাদের ক্ষতি করতে পারে।’
মজিদ হাওলাদার মেরুদণ্ড সোজা করে বসলেন। গুরুতর ভঙ্গিতে বললেন,’ পদ্মজাকে নিয়ে আমারও চিন্তা আছে। এই মেয়ের চোখের দিকে তাকানো যায় না।”
মজিদ হাওলাদারের কল্পনায় পদ্মজার চোখ দুটি ভেসে উঠে। সবসময় তিনি পদ্মজার চোখের ভেতর আগ্নেয়গিরি দেখতে পান। তিনি দ্রুত মাথা ঝাঁকালেন। বললেন,’খলিল, পদ্মজার কিছু একটা করতে হবে। এই মেয়ে ক্ষতিকর। ধরে-বেঁধে রাখার মেয়ে না। ‘
খলিল বললেন,’এই ছেড়ি এতোকিছু দেইক্ষাও ডরায় নাই। আর কেমনে ডরাইবো?’
মজিদ থুথু ফেলে বললেন,’ পদ্মজাকে রাখাই যাবে না। এই দায়িত্ব রিদুর।’
রিদওয়ানের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে উঠলো। পরপরই সেই আলো নিভে গেল। সে প্রশ্ন করলো,’ আর আমির? আমির পদ্মজার ক্ষতি মানবে না।’
মজিদ চিন্তায় পড়ে যান। কিছু বলতে পারলেন না। রিদওয়ান উত্তেজিত। সে চেয়ার ছেড়ে মজিদের পায়ের কাছে বসলো। বললো,’ কাকা, গত পরশু যা হলো,আমির জানতে পারলে আপনাকে, আমাকে আর আব্বাকে কাউকে ছাড়বে না। আমির গ্রামের সবাইকে ডেকে সবকিছু বলে দিতে পারে।’
মজিদ ধমকে উঠলেন,’ বাবু এটা কখনো করবে না। নিজের ক্ষতি করবে না।’
‘করবে কাকা,করবে। ওর মাথা ঠিক নাই। আমাদের ক্ষতি করতে ওর হাত কাঁপবে না। মাথাও কাজ করবে না। আর নিজের ক্ষতি তো এখনই করতেছে। পরেও করতে পারবে।’
মজিদ হাওলাদারের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ে। রিদওয়ানের কথায় যুক্তি আছে। রিদওয়ান বললো,’ কাকা,আমির এখন আমাদের জন্যও হুমকি।’
মজিদ হাওলাদার রিদওয়ানের দিকে ঝুঁকে বললেন,’আমির ছাড়া আমরা অচল রিদু। এখনের মানুষ সচেতন,বুদ্ধিমান,আইন শক্তিশালী এমন অবস্থায় আমির ছাড়া কী করে চলবে? আমিরের মাথা পরিষ্কার। একবার-দুইবার না বার বার পুলিশ সন্দেহ করেও সন্দেহ ধরে রাখতে পারেনি। আমির সামলিয়েছে।’
রিদওয়ান আশ্বাস দিল,’কাকা,আমরা সাবধান থাকব। আপনাদের পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতা আছে আর আমার বিশ বছরের অভিজ্ঞতা। আমরা চাইলে সামলাতে পারবো।’
মজিদ হাওলাদার রিদওয়ানের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। বললেন,’ বাবুর জায়গা নেয়ার জন্য এসব বলছিস?’
রিদওয়ানের চোখেমুখে হতাশার ছাপ পড়লো। সে চেয়ারে উঠে বসলো। বললো,’ আমার একার কোনো স্বার্থসিদ্ধি নাই কাকা। আব্বা আর আপনাকেও বাঁচাতে চাইছি। আমির আগের আমির নাই। আপনার বড় ভুল পদ্মজার সাথে আমিরের বিয়ে দেয়া।’
মজিদ হাওলাদার উঠে দাঁড়ালেন। গম্ভীর স্বরে বললেন,’ আমার ছেলের সাথে আমি কথা বলবো। তারপর সিদ্ধান্ত নেব।’
মজিদ হাওলাদার চলে যান। তিনি চোখের আড়াল হতেই রিদওয়ান মজিদের চেয়ার লাথি দিয়ে ফেলে দিল। রাগে গজগজ করতে করতে বললো,’ শু*** বাচ্চা।’
খলিল রিদওয়ানের উরুতে এক হাত রেখে বললেন,’ মাথাডা ঠান্ডা করো আব্বা।’
রিদওয়ান চোখ বড়-বড় করে বললো,’ আর কতদিন ওদের বাপ-ব্যাঠার কামলা খাটব? আদেশ মানব? মার খাব? বলতে পারেন? আমার বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে,আপনি অকর্মার ঢেকি আব্বা। কাকা সবকিছু আমিরের নামে করে দিল আপনি টু শব্দও করেননি। ‘
খলিল হাওলাদার দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইলেন। তিনি ছোট থেকেই মনে মনে মজিদের উপর ক্ষিপ্ত। গোপনে অনেক পরিকল্পনাই করেছেন কখনো তা বাস্তবে রূপ নেয়নি!
লতিফা পদ্মজার ঘরে প্রবেশ করে দেখলো,পদ্মজা নেই। সে হাতের বস্তা পালঙ্কের নিচে রাখলো। বস্তার ভেতর পদ্মজার চাওয়া কিছু জিনিসপত্র রয়েছে। লতিফা ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হয়। তখন গোসলখানা থেকে পদ্মজা বের হলো। পদ্মজাকে দেখে লতিফার শরীর কেঁপে উঠে। পদ্মজার পরনে একদম সাদা শাড়ি! ভেজা চুল থেকে টুপটুপ করে জল পড়ছে। এই সন্ধ্যাবেলা সে গোসল করেছে! বাঁকানো কোমর,ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ,ঘন কালো লম্বা চুল,রক্তজবা ঠোঁট,মসৃণ ত্বক থাকা সত্ত্বেও তাকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। পদ্মজা তো বিবাহিত সে কেন সাদা শাড়ি পরলো? লতিফার অনুভব হয়,তার পায়ের তলার মেঝে কেঁপে উঠেছে। পদ্মজা চুল মুছতে মুছতে বললো,’ যা আনতে বলছিলাম এনেছো?’
লতিফা নিরুত্তর। পদ্মজা লতিফার দিকে তাকালো। লতিফা হা করে তাকিয়ে আছে। পদ্মজা ডাকলো,’লুতু বুবু?’
লতিফা এগিয়ে আসে। তার বিস্ময়কর চাহনি। পদ্মজা লতিফার বিস্ময়ের কারণ বুঝতে পেরেছে। লতিফা বললো,’ তুমি সাদা কাপড় পিনছো কেরে?’
পদ্মজা হেসে বললো,’বলা যাবে না।’
লতিফা বলার মতো কথা খুঁজে পেল না। পদ্মজা আলমারি থেকে ছাই রঙা ব্লাউজ বের করলো। বিছানার উপর বসে বললো,’ লুতু বুবু, ব্লাউজের এ পাশটা সেলাই করে দাও। তোমার হাতের সেলাই খুব সুন্দর হয়।’
লতিফার ধীর পায়ে পদ্মজা সামনে এসে দাঁড়ালো। পদ্মজার হাত থেকে ব্লাউজ নিয়ে বিছানায় বসলো। পদ্মজা একটা ছোট বাক্স থেকে সুই-সুতা বের করে লতিফাকে দিল। লতিফা রয়ে সয়ে বললো,’ শাড়িডা কি বুড়ির?’
পদ্মজা ছোট করে জবাব দিল ‘হু।’
লতিফা বললো,’ হ,কাপড়ডা দেইক্ষাই চিনছি।’
পদ্মজা বললো,”দাদুর অবস্থা খুব বাজে। শরীরে মাছি বসে,বাজে গন্ধ বের হয়। যন্ত্রণায় ছটফট করে।’
লতিফা হঠাৎ করেই হইহই করে উঠলো,’ আল্লাহর শাস্তি আল্লাহই দেয় বইন। বুড়ির সাথে উচিত অইতাছে। বুড়ি কানলে আমার যে কি শান্তি লাগে পদ্ম। মরুক বুড়ি,মরুক! ‘
পদ্মজা নরম স্বরে বললো,’ এভাবে বলো না বুবু। এভাবে বলতে নেই।’
লতিফা পদ্মজার চোখের দিকে তাকালো। হাতের ব্লাউজটা বিছানায় রেখে পদ্মজার এক হাত চেপে ধরে বললো,’ তুমি সাদা কাপড় কেরে পিনছো পদ্ম? আমারে কও।’
লতিফার চোখেমুখে জানার প্রবল আগ্রহ। পদ্মজা ধীরেসুস্থে বললো,’ আমি ধরে নিয়েছি আমার স্বামী মৃত।’
‘কিন্তু এইডা তো মিছা।’
পদ্মজা গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে বললো,’এটা সত্য হবে বুবু।’
‘পদ্মজা…’
‘কিছু বলো না বুবু। এই সাদা রঙ আমার আত্মবিশ্বাস আর সাহসকে দ্বিগুণ করে দিয়েছে। সারাজীবন ভয়ে চুপ থেকেছো,অন্যায়কে-পাপকে সমর্থন করেছো। এবার অন্তত থেকো না। মরতে হবে তো তাই না? কবরে কী জবাব দিবে?’
লতিফা মাথা নিচু করলো। ক্ষণমুহূর্ত পর বললো,’ আমিতো কইছি তোমার সব কথা মাইননা চলাম। এখনো কইতাছি,সব মাইননা চলাম।’
‘এবার বলো,যা আনতে বলেছিলাম এনেছো?’
‘হ আনছি। পালঙ্কের নিচে রাখছি।’
পদ্মজা পালঙ্কের নিচে থেকে বস্তা বের করে মেঝেতে বসলো। লতিফা ব্লাউজ সেলাই করা শুরু করে। পদ্মজা বস্তার ভেতর থেকে দুটো রাম দা, একটা চাপাতি বের করলো। লতিফা বললো,’ পদ্ম, আমার অনেক ডর লাগতাছে। ‘
পদ্মজা রাম দায়ের আগা দেখতে দেখতে বললো,’ কী জন্য?’
‘তুমি যদি না পারো তুমারে ওরা মাইরা ফেলব।’ লতিফার কণ্ঠে ভয়।
পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে লতিফার দিকে তাকালো। তার চোখ-মুখের রঙ পাল্টে গেছে। পদ্মজা বললো,’ আজ অনুশীলন করব। দেখা যাক,আমার হাত কতোটা সাহসী।’
কথা শেষ করে পদ্মজা হাসলো। লতিফার অশান্তি হচ্ছে। সামনে কী হবে সে জানে না! কিন্তু যা ই হোক, খুব খারাপ হবে! পদ্মজা চাপাতি হাতে নিয়ে লতিফাকে ডাকলো,’ বুবু?’
‘কও পদ্ম।’
‘জসিম গতকাল থেকে তোমার পিছনে ঘুরঘুর করছে দেখলাম।’
লতিফার মনোযোগ সেলাইয়ে। সে সেলাই করতে করতে বললো,’জসিম আমারে খারাপ প্রস্তাব দিছে। ডর দেহাইছে,রাজি না হইলে জোর কইরা নাকি খারাপ কাম করব।’
‘ধর্ষণের হুমকি দিল?’
‘হ।’
‘জসিম,হাবু কতদিন ধরে কাজ করে এখানে?’
‘অনেক বছর। দশ-বারো বছর তো হইবই।’
পদ্মজা চাপাতি দিয়ে রামদায় মৃদু আঘাত করে বললো,’হাবু তো এখন নাই। তাহলে শুরুটা জসিমকে দিয়েই হউক!’
লতিফা চুপ রইলো। তার কাছে খুন স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেক খুন সে নিজের চোখে দেখেছে। তাই খুনখারাপিতে তার ভয় নেই। কিন্তু এইবার ভয় হচ্ছে। খুব ভয় হচ্ছে। পদ্মজা সরাসরি কিছু বলেনি। তবে বুঝা যাচ্ছে সে কী করতে চলেছে। যদি পদ্মজা ধরা পড়ে যায়? তখন কী হবে! লতিফা ঢোক গিলল। সেলাইয়ে মন দেয়ার চেষ্টা করলো। পদ্মজা প্রশ্ন করলো,’মগা কি এসবের সাথে জড়িত?’
‘মগা অনেক ভালা পদ্ম। বাড়ির টুকটাক কাম করে। বেক্কলের মতো। আর খালি ঘুমায়। ওর ভিতরে প্যাচঁগোচ নাই।’
‘বাড়ির ভেতর কখনো মেয়ে নিয়ে আসা হয়নি?’
‘বাঁইচা আছে এমন আনে নাই। মরা আনছে।’
পদ্মজা চমকে তাকাল। প্রশ্ন করলো,’মৃত মেয়ে দিয়ে কী করে?’
লতিফা দরজার দিকে তাকালো। পদ্মজা দ্রুত উঠে যায় দরজা বন্ধ করতে। তারপর লতিফার সামনে এসে বসলো। লতিফা বললো,’ যে ছেড়ি বেশি সুন্দর থাকে, জানে মারার পরেও রিদওয়ান ভাইজানে তারে ছাড়ে না। মরা মানুষের শরীরের উপর টান খলিল কাকার আছিলো। রিদওয়ান ভাইজানেও এই স্বভাব পাইছে।’
পদ্মজার গা গুলিয়ে উঠে। বমি গলায় চলে আসে। সে এক হাতে মুখ চেপে ধরলো। ঘৃণায় তার চোখে জলে ছলছল করে উঠে। লতিফা বললো,’রিদু ভাইজানে কয়দিন আগেও বস্তাত ভইরা এক ছেড়িরে বাড়ির ছাদে আনছিলো। তিন তলা ঘরের দরজায় তালা আছিলো। তাই ছাদে গেছিল। পরে আমি চাবি লইয়া গেছি। বস্তা থাইকা রক্ত পড়ছিল। শীতের মাঝে কাঁইপা-কাঁইপা আমি রক্ত ধুইছি।’
পদ্মজা কোনোমতে বললো,’ তখন আমি এখানে ছিলাম?’
‘হ। পূর্ণা আর মৃদুল ভাইজানেও আছিলো।’
পদ্মজা এক হাত কপালে ঠেকিয়ে বললো,’আল্লাহ! তাও আমার চোখে পড়েনি!’
পদ্মজা সেকেন্ড দুয়েকের জন্য থামলো তারপর বললো,’ এমনকি আমি তিন তলার এক ঘর থেকে বোটকা গন্ধ পেয়েছিলাম তবুও ভাবিনি এই বাড়িতে এতো ভয়ংকর ঘটনা ঘটে!’
লতিফার সেলাই শেষ। সে ব্লাউজটি পদ্মজার উরুর উপর রেখে বললো,’ লও তোমার বেলাউজ(ব্লাউজ)।’
পদ্মজা রাগে কিড়মিড় করে লতিফাকে বললো,’দেখো,রিদওয়ানের শরীর টুকরো,টুকরো করে কুকুরের সামনে ছুঁড়ে দেব আমি।’
লতিফা এতক্ষণে হাসলো। বললো,’ আল্লাহ তোমারে শক্তি দেউক।’
পদ্মজার ডান হাত কাঁপছে। সে তার ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারছে না। এই মুহূর্তে সে যা শুনেছে, তারপর শান্ত থাকা সম্ভব নয়। লতিফা পদ্মজার মস্তিষ্ক অন্য প্রসঙ্গে নেয়ার জন্য বললো,’ পারিজারে কেলা মারছে জানো পদ্ম?’
পদ্মজা লতিফার দিকে তাকালো। পারিজার কথা মনে পড়লেই তার বুকের ব্যথা বেড়ে যায়। সে ম্লান হেসে বললো,’ না। কিন্তু আন্দাজ করতে পেরেছি।’
‘আমির ভাইজানে জানে।’
‘সেটাও এখন বুঝতে পারছি। শুনেছি,তার আড়ালে একটা পাখিও উড়ে যেতে পারে না। সেখানে আমার মেয়ের খুনিকে সে চিনবে না? অবশ্যই চিনবে। কিন্তু কিছু করেনি কারণ এতে তার লোক কমে যাবে। ব্যবসার ক্ষতি হবে।’
‘কিছু যে করে নাই এইডাও ঠিক না। এক মাস পরে আমির ভাইজানে জানছে,রিদু ভাইজানে হাবলু মিয়ারে দিয়া পারিজারে খুন করাইছে। সব জাইননা হাবলু মিয়ারে আমির ভাইজানে কুড়াল দিয়া কুপাইছে। রিদু ভাইজানরে আমির ভাইজানে খুন করতে চাইছিলো কিন্তু বড় কাকার লাইগগা পারে নাই। তয় মাসখানেক হাসপাতালে আছিলো। বছরখানেক রিদু ভাইজানে আমির ভাইজানের সামনে যায় নাই।’
পদ্মজা দুই হাতে চাদর খামচে ধরলো। তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। সে কান্নামাখা স্বরে বললো,’ কী নিষ্ঠুর ওরা! আমার ছোট বাচ্চা!’
লতিফার পদ্মজার জন্য খুব মায়া হয়। মেয়েটা বড় বড় আঘাত সহ্য করেছে,করে যাচ্ছে! পদ্মজা বললো,’ আমির হাওলাদার তার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিত বলে সে আমার মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে তাই না?’
লতিফা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। পদ্মজা কাঁদো-কাঁদো স্বরে বললো,’প্রতিশোধ নিয়েছে সে! আমিও নেব। করুণ মৃত্যু হবে তার। এতো বড় সাহস কী করে পেলো সে? আমির হাওলাদারের মেয়েকে খুন করার সাহস রিদওয়ানের থাকার কথা না। তার পিছনে মজিদ হাওলাদার আর তার ভাই ছিল। তাদের সমর্থন ছিল। সে জানতো,তাকে বাঁচানোর জন্য ঢাল হবে তারা।’
লতিফা বিচলিত হয়ে বললো,’ কাইন্দো না পদ্ম। আর কাইন্দো না।’
পদ্মজা দুই হাতে চোখের জল মুছে বললো,’ কাঁদব না আমি। আমার ছোট মেয়ে জান্নাতে তার নানুর সাথে আছে। সে সুখে আছে। এই জগতে তার না থাকাটাই ভালো হয়েছে বুবু।’
পদ্মজাকে যত দেখে তত অবাক হয় লতিফা। এই নারী কীসের তৈরি? এতো যন্ত্রণা, এতো দুঃখ নিয়েও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামবাসীর ছিঃ চিৎকার তাকে দূর্বল করতে পারেনি। যতবার ভেঙে যায় ততবার চোখের জল মুছে নতুন উদ্যমে বেঁচে উঠে। লতিফা দ্বিধাভরা কণ্ঠে বললো,’আমি তোমারে একবার জড়ায়া ধরি পদ্ম?’
লতিফা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। এশার নামায আদায় করে
পদ্মজা ঘর থেকে বের হলো। দরজার পাশে জসিম নেই। একটু আগেই সে জসিমের কাশি শুনেছে। কোথায় গেল? অন্দরমহল অন্ধকারে ছেয়ে আছে। সন্ধ্যার পরপর বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার ব্যাপারটা বিরক্তিকর। বাড়িতে সাড়াশব্দও নেই। কখনোই থাকে না। সন্ধ্যা হলেই আলো ঘুমিয়ে পড়ে। রিনু তার ঘরে শুয়ে থাকে। লতিফা রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করে,সবার আদেশ শুনে। আর এখন সবার খেয়েদেয়ে নিজের ঘরে যাওয়ার সময়। আর এই মুহূর্তেই জসিম উধাও! পদ্মজার স্নায়ু সাবধান হয়ে উঠলো।
লতিফা রান্নাঘরে থালাবাসন ধুচ্ছে। থালাবাসন ধোয়া শেষে পানি গরম করার জন্য চুলায় আগুন ধরালো। রান্নাঘরে আর আলো নেই। জসিম লতিফার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। লতিফা জসিমের উপস্থিতি টের পেয়ে কপাল কুঞ্চিত করলো। পিছনে ফিরে বললো,’ আপনে আমার পিছনে ঘুরতাছেন কেরে?’
‘তোরে আমার পছন্দ অইছে। আমার লগে আয়।’
‘আমি যাইতাম না।’
‘আরে আয়,আয়।’
জসিম হাসলো। তার বিদঘুটে হাসি। সে অনেক চিকন হলেও তালগাছের মতো লম্বা। লতিফার মাথা উঁচু করে তাকাতে হয়। লতিফা জসিমের আক্রমণের জন্য মনে মনে প্রস্তুত ছিল। সে সজোরে প্রবল কণ্ঠে বললো,’ এন থাইকা বাইর হইয়া যা কুত্তার বাচ্চা! নাইলে তোরে আমি দা দিয়া কুপাইয়াম।’
জসিম লতিফার ব্লাউজ টেনে ধরে। লতিফা চিৎকার করে দা হাতে নিতে নেয় জসিম লাথি দিয়ে দা সরিয়ে দেয়। লতিফা জসিমকে তার কাছ থেকে সরানোর চেষ্টা করে। দুজনের মাঝে ধ্বস্তাধস্তি শুরু হয়। জসিম গায়ের জোরে লতিফার স্পর্শকাতর স্থানে ছুঁতেই লতিফা চিৎকার করে মজিদ আর আমিনাকে ডাকলো। জসিম টেনেহিঁচড়ে লতিফার শাড়ি খুলে ফেললো। লতিফার গায়ে হাত দেয়ার অনুমতি সে খলিলের কাছে পেয়েছে। যদিও খলিল বলেছিল,বাড়িতে কিছু না করতে। কিন্তু জসিম সে কথা শুনেনি। ফলে,তার পরিণতি ভয়ংকর হয়। সাদা শাড়ির আবরণে আচ্ছাদিত পদ্মজা রান্নাঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার হাতে রাম দা। লতিফা পদ্মজাকে দেখে জসিমকে দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। পদ্মজা শক্ত করে রাম দা ধরলো। তারপর ‘জারজের বাচ্চা, মর’ বলে পিছন থেকে জসিমের গলায় কোপ বসাল। জসিমের গলা অর্ধেক কেটে যায়। রক্ত ছিটকে পড়ে পদ্মজার গায়ে। লতিফার নাকমুখ রক্তে ভেসে যায়। কিছু রক্ত ছিটকে আগুনে পড়ে। রক্তে রান্নাঘরের থালাবাসন,পাতিল রাঙা হয়ে উঠে। দেহটি সজোরে শব্দ তুলে মেঝেতে পড়ে গেল। লতিফার মুখ দিয়ে রক্ত প্রবেশ করায় সে বমি করতে থাকে। পদ্মজার বুক হাঁপড়ের মতো উঠানামা করছে। সে চোখ বুজে লম্বা করে নিঃশ্বাস নিয়ে স্থির হলো। তারপর লতিফার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,’ এটা কিন্তু আমার দ্বিতীয় শিকার ছিল।’
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ
আমি পদ্মজা – ৮৬
__________
পদ্মজা রাম দা হাতে নিয়ে অন্দরমহল থেকে বের হলো। রাম দা থেকে চুইয়ে-চুইয়ে রক্ত পড়ছে। তার গায়ের সাদা শাড়িতে ছোপ-ছোপ রক্তের দাগ। লতিফা আড়চোখে পদ্মজাকে দেখছে। পদ্মজার শান্ত থাকা দেখে লতিফা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! পদ্মজার হাঁটা দেখে মনে হচ্ছে মানুষ খুন করাটাই তার কাজ! লতিফা নিজের কপালের ঘাম মুছে মিনমিনিয়ে বললো,’ জসিমের লাশটা কিতা করাম?’
পদ্মজা কলপাড়ে পা রেখে শান্ত স্বরে বললো,’ এতো বড় দেহ দুজন মিলে কিছুই করতে পারবো না। রিদওয়ান কুকুরটা ঘরে আছে না?’
লতিফার খুব ঘাম হচ্ছে। সে বিড়বিড় করে বললো,’ তোমারে দেইখা আমার ডর লাগতাছে পদ্ম।’
লতিফার কথা পদ্মজার কানে আসতেই পদ্মজা হাসলো। বললো,’ তুমি কখনো খুন করোনি?’
পদ্মজা শীতল চোখে তাকায়। লতিফা মাথা নাড়িয়ে বললো,’না,করি নাই।’
‘শুধু দেখেছো?’
‘হ।’
‘রিদওয়ানকে গিয়ে বলো,পদ্মজা জসিমরে খুন করছে।’
কলপাড়ের এক পাশে সাদা রঙের বালতি ভর্তি পানি রয়েছে। পদ্মজা বালতির পাশে বসলো। পদ্মজার কথা শুনে লতিফার বুক ছ্যাঁত করে উঠে। সে দুই কদম এগিয়ে এসে চাপাস্বরে বললো,’ এইতা কিতা কও পদ্ম! রিদু ভাইজানে জানলে…’
লতিফাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে পদ্মজা বললো,’কিছুই হবে না। বরং লাশটা সরিয়ে ফেলতে সাহায্য করবে।’
পদ্মজা রাম দা বালতির ভেতর রাখলো। সঙ্গে-সঙ্গে সাদা পানি লাল হয়ে উঠে। লতিফা কথা বলছে না,চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সে দ্বিধাগ্রস্ত। পদ্মজা লতিফার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,’ যা বলেছি করো বুবু।’
লতিফা জবাবে কিছু বললো না। সে উল্টোদিকে ঘুরে অন্দরমহলে চলে গেল। চারিদিকে অন্ধকার। তবে আকাশে চাঁদ আছে। জোনাকি পোকারা অনর্থক গল্প করে যাচ্ছে। তাদেরও কী পদ্মজার মতো শীত অনুভব হয় না? শিশির পড়ছে। মৃদু বাতাসও রয়েছে। তীব্র ঠান্ডায় মাটিও যেন কাঁপছে। শুধু কাঁপছে না পদ্মজা। শীতের দানব তার শরীর ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে পারছে না। পদ্মজার বুকের ভেতর একটা উষ্ণ অনুভূতি ছুটে বেড়াচ্ছে। সেই উষ্ণ অনুভূতি শীতের দানবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।
রাম দা-এ লেগে থাকা জানোয়ারের রক্ত ধুয়ে পরিষ্কার করে দেয় পদ্মজা। তারপর অন্দরমহলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। অন্দরমহলের সদর দরজার দিকে ফিরে তাকাতেই রিদওয়ানের দেখা মিলল। রিদওয়ান তার দিকে ছুটে আসছে। চোখেমুখে ক্রোধ স্পষ্ট।
পদ্মজা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ালো। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে রিদওয়ানকে স্বাগত জানালো। রিদওয়ান নিঃশ্বাসের গতিতে এক হাতে পদ্মজার গলা চেপে ধরে বললো,’বেশ্যা মা* মরার ইচ্ছে জাগছে তোর?’
পদ্মজা রিদওয়ানকে বাঁধা দিল না। সে ঠোঁটে হাসি ধরে রাখলো। রিদওয়ান পদ্মজার হাসি দেখে ভড়কে যায়। পরক্ষণেই রেগে গিয়ে আরো জোরে চেপে ধরে পদ্মজার গলা। কিড়মিড় করে বললো,’ জন্মের মতো হাসি বন্ধ করে দেব!’
পদ্মজার চোখ উল্টে আসতেই রিদওয়ান পদ্মজার গলা ছেড়ে দিল। পদ্মজা দুই-তিনবার কাশলো। তারপর রিদওয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ শব্দ করে হেসে দিল! রিদওয়ানের শরীর রাগে কাঁপছে। সে পদ্মজার ব্যবহারে হতভম্ব! পদ্মজার চোখেমুখে ভয়ের বিন্দুমাত্র ছাপ নেই! রিদওয়ান দ্রুতগতিতে অন্দরমহলে ভেতর চলে গেল। লতিফা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। রিদওয়ান চলে যেতেই লতিফা দৌড়ে আসে পদ্মজার কাছে। লতিফাকে দেখে পদ্মজা কোনো কারণ ছাড়াই বললো,’ শিকার তাকে বলে যাকে আমরা হত্যা করার উদ্দেশ্যে আঘাত করি।’
লতিফা শুধু ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো।
খলিল টয়লেটে যাচ্ছিলেন,রিদওয়ানকে অস্থির হয়ে মজিদ হাওলাদারের ঘরের দিকে যেতে দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। রিদওয়ান মজিদের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজায় জোরে শব্দ করলো।
সে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। অস্থির হয়ে আছে। মজিদ হাওলাদার সবেমাত্র শুয়েছেন। দরজায় এতো জোরে শব্দ হওয়াতে খুব বিরক্ত হলেন। তিনি চোখে চশমা পরে দরজা খুললেন। ততক্ষনে খলিল হাওলাদারও সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি রিদওয়ানকে ডাকলেন,’ রিদু আব্বা?’
রিদওয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে খলিলকে একবার দেখলো। দরজা খোলার শব্দ হতেই সে সামনে তাকায়। মজিদ কিছু বলার পূর্বে রিদওয়ান দুই হাত ঝাঁকিয়ে মজিদকে বললো,’আমার কথা তো কোনোদিন শুনেন না।পদ্মজা কী করছে খবর রাখছেন?’
খলিল দুই তলায় উঠার সিঁড়িতে তাকিয়ে বললেন,’ এই ছেড়ি আবার কোন কাম করলো?’
মজিদ উৎসুক হয়ে রিদওয়ানের দিকে তাকালেন। রিদওয়ান এক হাত দিয়ে অন্যে হাতের তালুতে থাপ্পড় দিয়ে বললো,’ খুন করছে…খুন। জসিমের গলা কেটে রান্নাঘরে ফেলে রাখছে।’
মজিদ ও খলিল চমকালেন! রিদওয়ান গলায় জোর বাড়িয়ে বললো,’ খুন করেও একদম স্বাভাবিক আছে। মনে ভয়ডর নাই। রাম দা হাতে নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কতোটা ভয়ংকর হয়ে গেছে বুঝতে পারছেন কাকা? আপনার অনুমতি নাই বলে ওই মা** আমার সহ্য করতে হলো। নয়তো ওরে আমি কলপাড়েই গেঁথে আসতাম।’
মজিদ হাওলাদার কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। আচমকা এমন একটা খবর পেয়ে তিনি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন। রিদওয়ান গলার জোর আরো বাড়ালো,’পদ্মজার হাতে অস্ত্র উঠে গেছে কাকা! অস্ত্র! ওদিকে আমিরের খবর নাই। পাতালঘরের দরজায় নতুন তালা দিয়ে চাবি নিয়ে ভেতরে বসে আছে। খাবারও কেউ নিয়ে যায় না,নিতেও আসে না। ভেতরে ও কী করতেছে তাও জানি না। ও নিজে মরবে আমাদেরও মারবে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমির-পদ্মজা দুজনই আমাদের জন্য হুমকি কাকা। বুঝতেছেন না কেন? আজকের ঘটনার পরও কি বুঝবেন না? সময় থাকতে আপনি দুজনের কবর খোঁড়ার অনুমতি দেন।’
বৃহস্পতিবার, দুপুর ১:৪০ মিনিট। পূর্ণা দুপুরের নামায আদায় করে লাহাড়ি ঘরের চেয়ে কিছুটা দূরে অবস্থিত গোলাপ গাছটির পাশে বসে রয়েছে। গোলাপ গাছটি তার ভীষণ প্রিয়। এই গাছটি তার মন খারাপের সঙ্গী,একাকীত্বের সঙ্গী! প্রেমা পূর্ণার পিছনে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু পূর্ণা টের পেল না। সে অন্যমনস্ক। তার ঠোঁটে লেগে আছে মিষ্টি হাসি। প্রেমা পূর্ণার কাঁধে হাত রাখে। পূর্ণা চমকে উঠে। প্রেমাকে দেখে বুকে তিনবার থুথু দিল। তারপর বললো,’ ভয় দেখালি কেন?’
‘কখন ভয় দেখালাম?’
‘কখন ভয় দেখালাম হা?’
প্রেমা ভ্রুকুঞ্চন করলো। পূর্ণা বললো,’ কী দরকার বল?’
পূর্ণার ব্যবহার দেখে বিরক্তি ধরে গেছে প্রেমার। সে তীব্র বিরক্তি নিয়ে বললো,’বড় আম্মা খেতে ডাকছে।’
‘যা,আমি আসছি।’
‘আমার সাথে আসো।’
পূর্ণা রাগ নিয়ে বললো,’যেতে বলছি,যা তো।’
‘তুমি কী ভাবছিলে? মুচকি-মুচকি হাসছিলে কেন?’
‘তোকে বলতে হবে?’
প্রেমা দৃঢ়কণ্ঠে বললো,’হ্যাঁ,বলতে হবে।’
পূর্ণা মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বললো,’তর্ক করবি না। থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব।’
‘সবসময় ঝগড়া করো কেন?’
‘আমি করি? নাকি তুই বেয়াদবি করে আমাকে রাগাস!’
প্রেমা গাল ফুলিয়ে চলে যেতে নিল,তখনই পূর্ণা চট করে প্রেমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। প্রেমা পূর্ণাকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করে বললো,’ছাড়ো। লাগবে না আমার আদর।’
পূর্ণা প্রেমাকে শক্ত করে ধরে রাখে। প্রেমার কাঁধে থুতুনি রেখে আহ্লাদী স্বরে বললো,’ কালতো সারাজীবনের জন্য চলেই যাব। রাগ করে না লক্ষী বোন।’
পূর্ণার কথা শুনে প্রেমা চুপ হয়ে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে পূর্ণার দিকে তাকালো। অবাক হয়ে প্রশ্ন বললো,’কোথায় যাবা?’
পূর্ণা ঠোঁট কামড়ে হাসলো। প্রেমা জোর করে পূর্ণার থেকে ছুটে যায়। একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়াল। পূর্ণা সারাজীবনের জন্য চলে যাবে শুনে প্রেমা বিচলিত হয়ে পড়েছে। সে প্রশ্ন করলো,’বলো, কোথায় যাবা?’
পূর্ণা হাত দিয়ে ঢেউয়ের মতো করে বললো,’অনেক দূরে!’
‘জায়গার নাম নেই?’
পূর্ণা হাসলো। তার চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। প্রেমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙার পথে! পূর্ণা বললো,’বিকেলে জানতে পারবি।’
‘এখন বললে কী সমস্যা? ‘
পূর্ণা হঠাৎ চোখমুখ কঠিন করে বললো,’বেশি কথা বলিস! আম্মা ডাকতেছে না খেতে? চল।’
‘কিন্তু…’
পূর্ণা প্রেমাকে ধাক্কা দিয়ে তাড়া দিল,’চল,চল।’
বারান্দায় পা রাখার পূর্বে পূর্ণা ঘাড় ঘুরিয়ে গেইটের দিকে তাকালো। তার ভেতরে-বাহিরে বসন্তের কোকিল কুহু কুহু করে ডাকছে। মনের বাগানে ফুটেছে শত রঙের ফুল। সেই ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণে তলিয়ে যাচ্ছে সে। হারিয়ে যাচ্ছে বারংবার ফেলে আসা অনাকাঙ্ক্ষিত মধুর ক্ষণে। সেদিন পূর্ণা হাওলাদার বাড়ি থেকে ফিরেই মোড়ল বাড়ির উঠানে বসে পড়ে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাটিয়ে দেয় মুহূর্তের পর মুহূর্ত! বাসন্তী অনেক বুঝিয়েছেন, যেন পূর্ণা ঘরে যায়। চারিদিক ছিল কুয়াশায় ঢাকা। কুয়াশার জন্য কয়েক হাত দূরের বস্তুও চোখে পড়ছিল না। এমতাবস্থায় পূর্ণা উঠানে, শিশিরভেজা মাটিতে বসেছিল। প্রেমা-প্রান্ত কেউ বুঝাতে পারেনি। বাসন্তী কেঁদে বলেছেন,’ আমি তোর আপন মা না এজন্যে আমার কথা শুনস না?’
তাতেও পূর্ণার ভাবান্তর হলো না। সে যে বসে আছে তো আছেই। পাথর হয়ে গেছে। না শীত,না বাসন্তীর কান্না কিছুই ছুঁতে পারেনি। বিচ্ছেদের যন্ত্রণা তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। মা সমতূল্য বড় বোনের সাথে মনমালিন্য, ভালোবাসার পুরুষের সাথে বিচ্ছেদ কী করে সহ্য করবে? কী করে?…বুকের ভেতরটায় আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। সে কী করে তা বাসন্তীকে দেখাবে? সন্ধ্যার আযান পড়ার পরও যখন পূর্ণা ঘরে গেল না তখন বাসন্তী ও প্রেমা উঠানে পাটি এনে বিছালো। তারপর পূর্ণাকে প্রেমা বললো,’মাটিতে বসে থেকো না। পাটিতে বসো। কেন এমন করছো? বড় আপার সাথে কত খারাপ হলো! তার উপর তুমি এমন করছো!’
পূর্ণা আগের অবস্থানেই রইলো। “বড় আপার সাথে কত খারাপ হলো” কথাটি শুনে তার দুই গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। বাসন্তী এবং প্রান্ত পূর্ণাকে টেনে পাটিতে নিতে চাইলে পূর্ণা চিৎকার করে কেঁদে বললো,’কী সমস্যা তোমাদের? আল্লাহর দোহাই লাগে,একটু শান্তিতে থাকতে দাও। নয়তো আমি কিছু একটা করে ফেলবো। আমি আত্মহত্যা করবো। আমার আর সহ্য হচ্ছে না!’
পূর্ণার রুদ্রমূর্তির সামনে বেশিক্ষণ টিকে থাকার সাহস কারো হলো না। পূর্ণা যে ধাঁচের মেয়ে সে নিজের ক্ষতি করতে দুইবার ভাববে না। বাসন্তী ঘরে এসে চাপাস্বরে কাঁদতে থাকলেন। তিনি আত্মগ্লানিতে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছেন। না পেরেছেন পদ্মজাকে অপবাদ থেকে বাঁচাতে,আর না পারছেন পূর্ণার কষ্ট কমাতে! সব ঘটনার জন্য তিনি নিজেকে দোষারোপ করছেন। বার বার মনে হচ্ছে, হেমলতা থাকলে এসব কিছুই হতো না। বাসন্তী মা হিসেবে নিজেকে ব্যর্থ মনে করছেন! প্রেমা বাসন্তীকে কাঁদতে দেখেও দূরে দাঁড়িয়ে রইলো। তার নিজেরও বুক ভারী হয়ে আছে। গ্রামবাসী ছিঃ চিৎকার করছে। বাড়ি বয়ে এসে যা তা বলে যাচ্ছে। বড় বোন পদ্মজার সাথে মৃত মা হেমলতাকেও তারা ছাড়ছে না। সাথে মৃদুল-পূর্ণার নাম তো আছেই। কিশোরী এই ছোট মনে আর কতক্ষণ সহ্য ক্ষমতা ধরে রাখা যায়! প্রেমার চোখ দুটি ছলছল করে উঠে। চোখের জল গড়িয়ে পড়ার আগে দ্রুত মুছে ফেললো সে।
চারপাশ গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেছে। পূর্ণা উঠান ছেড়ে তার প্রিয় গোলাপ গাছটির পাশে এসে বসলো। গাছের পাতা আলতো করে ছুঁয়ে দিতেই দুই ফোঁটা শিশির ঝরে পড়ে মাটিতে। প্রেমা পূর্ণার জন্য অপেক্ষা করতে করতে বারান্দার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাসন্তী বারান্দার মুখে মোড়া নিয়ে বসে আছেন। পূর্ণাকে বাইরে রেখে তিনি ঘরে থাকতে পারবেন না! নিজের অজান্তে একসময় চোখ লেগে যায়। প্রান্ত টয়লেটে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিল। লাহাড়ি ঘরের চারপাশ অন্ধকারে তলিয়ে আছে দেখে সে এগিয়ে আসে। অন্ধকারের জন্য পূর্ণাকে তার চোখেই পড়ছে না। তাই সে রান্নাঘর গিয়ে একটা হারিকেন জ্বালিয়ে নিয়ে আসে। তারপর পূর্ণার পাশে এসে বললো,’ আপা, ঘরে চলো।’
পূর্ণা রুক্ষ চোখে তাকায়। কাঠ-কাঠ কণ্ঠে বললো,’,যা এখান থেকে।’
তাও প্রান্ত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর পূর্ণার চেয়ে কিছুটা দূরে থাকা মুরগির খুপির উপর হারিকেন রেখে সে চলে যায়।
রাত গভীর থেকে গভীরত হয়। পূর্ণা গোলাপ গাছটি ছেড়ে লাহাড়ি ঘরের বারান্দায় যায়। সেখান থেকে আবার গোলাপ গাছের সামনে আসে। রাত বাড়ার সাথে কষ্টগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আক্ষেপের ভারে শরীর ভার হয়ে আসছে! লাল বেনারসি পরার স্বপ্ন কী স্বপ্নই রয়ে যাবে? পায়ে আলতা দেয়া হবে না? হবে না একটা সংসার? যে সংসারে মৃদুল হবে কর্তা সে হবে কর্তী! মৃদুল কেন তাকে বুঝলো না? মৃদুল কি তাকে ভালোবাসেনি? কখনো মুখফুটে কেন বলেনি ভালোবাসার কথা? অসহ্য যন্ত্রণায় তার ইচ্ছে হচ্ছে নিজের চুল ছিঁড়ে ফেলতে!
গা ছমছমে পরিবেশ। নিস্তব্ধতায় ঘিরে আছে চারপাশ। বৃষ্টির ফোঁটার মতো শিশির পড়ছে। লাহাড়ি ঘরের টিনের ছাদে টুপটুপ শব্দ হচ্ছে! পূর্ণার শরীর মৃত মানুষের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। মৃদু কাঁপছেও। তবুও তার ইচ্ছে হচ্ছে না,ঘরে যেতে। হঠাৎ এক জোড়া পায়ের শব্দ কানে এসে ধাক্কা দেয়। পূর্ণা থমকে যায়। সে টের পায় কেউ একজন তার চেয়ে কয়েক হাত দূরে এসে দাঁড়িয়েছে। পূর্ণা চট করে উঠে দাঁড়ালো। ঘাড় ঘুরিয়ে আগন্তুককে দেখে তার চোখেমুখে কোনো পরিবর্তন ঘটলো না। সে অন্যদিকে ফিরে তাকালো। তারপর আবার আগন্তুকের দিকে তাকালো। না সে সত্যি দেখছে! মৃদুল এসেছে! এই কুয়াশাজড়ানো রাত, টুপটুপ শিশির আর হারিকেনের হলুদ আলো স্বাক্ষী বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত মৃদুল ঘায়েল করা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে ছিল পূর্ণার দিকে! সেই চাহনির তীরবিদ্ধে পূর্ণার বুকের স্পন্দন থেমে গিয়েছিল। থেমে গিয়েছিল শ্বাস-প্রশ্বাস! চোখের পলক পড়েনি দীর্ঘক্ষণ!
মৃদুল যখন অস্পষ্ট স্বরে ডাকলো,’পূর্ণা।’
তখন পূর্ণার সম্বিৎ ফিরলো। সে আবিষ্কার করলো, মৃদুলের উপস্থিতি, মৃদুলের চাহনি তার মনের রাগ-ক্ষোভ পানি করে দিয়েছে! এ কেমন শক্তি! তবে মৃদুলের কণ্ঠ শুনে অভিমানের পাহাড়টা যেন মজবুত হয়ে দাঁড়িয়েছে! অভিমানের ভারে পূর্ণা বাজখাঁই কণ্ঠে বললো,’ কী চাই?’
মৃদুল মাথা নত করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সে কোনো জবাব দিতে পারলো না। পূর্ণা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও যখন উত্তর পেল না। তখন মৃদুলের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চায়,মৃদুল পথ আটকে দাঁড়ায়। তার মাথা নত।
পূর্ণা বললো,’ কী চান আপনি? এতো রাতে আমার বাড়িতে এসেছেন কেন? আপনার তো এতক্ষণে নিজের বাড়িতে থাকার কথা ছিল!’
মৃদুল কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না, গলা আটকে আসছে। সে পূর্ণার চোখের দিকে তাকালো। তার চোখেমুখে অসহায়ত্ব স্পষ্ট! পূর্ণার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। ফর্সা মানুষের এই এক সমস্যা, তারা কাঁদলে চোখমুখ লাল হয়ে যায়। তখন দেখে খুব মায়া হয়। পূর্ণা গলার স্বর নরম হয়,’ কী বলবেন বলুন। বলে বিদায় হোন।’
কত নির্দয়ভাবে পূর্ণা বিদায় হতে বললো! মৃদুলের মনে হলো,এমন নিষ্ঠুর কথা সে আগে কখনো শুনেনি! সঙ্গে -সঙ্গে মৃদুলের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। সে তার ভুলের ক্ষমা কী করে চাইবে বুঝতে পারছে না। সারাদিন সে অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যে কাটিয়েছে! হারে হারে টের পেয়েছে পূর্ণাকে শুধু মন নয়,তার সুখের চাবিও দিয়ে বসে আছে! কখন, কী করে তার এতোবড় ক্ষতি হয়ে গেল সে বুঝতেও পারেনি! ভেবেছিল,পূর্ণাকে এই মুখ আর দেখাবে না। কিন্তু রাতের আঁধার পাহাড়সম যন্ত্রণার সূচ নিয়ে যখন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে আর স্থির থাকতে পারলো না। উল্কার গতিতে হাওলাদার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। সেখানে গিয়ে দারোয়ানের কাছে জানতে পারলো, পূর্ণা নিজের বাড়ি চলে গিয়েছে। মৃদুল আর দেরি করেনি। কুয়াশার স্তর ভেদ করে ছুটে আসে প্রিয়তমার বাড়ি! কিন্তু এই মুহূর্তে মনের মণিকোঠায় জড়িয়ে রাখা প্রিয়তমাকে দেখে তার কথা হারিয়ে গেছে,হারিয়ে গেছে সত্ত্বা। নিজ সত্ত্বা হারিয়ে কাউকে ভালোবাসতে নেই! এ ক্ষতি কখনো পূরণ হয় না। কিন্তু প্রেমিক মন কি আর এতকিছু বুঝে! মৃদুলের চোখে পানি দেখে পূর্ণার গলা জড়িয়ে আসে। সে গোপনে ঢোক গিললো। মৃদুল তার কান্না আটকিয়ে বললো,’ আমি তোমারে ছাড়া থাকতে পারবো না পূর্ণা।’
পূর্ণা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে। তখন মৃদুল তাকে অবজ্ঞা করে চলে গিয়েছিল,এখন সেও এর প্রতিশোধ নিবে! পূর্ণা বললো,’ কিন্তু আমি আপনাকে চাই না। আমার সাথে যাকে মানায় না আমি তার ধারেকাছেও থাকতে চাই না।’
পূর্ণার উচ্চারিত একেকটা শব্দ মৃদুলের বুক ছিঁড়ে ফুটো করে দেয়। সে পূর্ণার দিকে এক পা বাড়িয়ে বললো,’আমি তহন বুঝি নাই। আমি…আমি আমার রাগ সামলাইতে পারি নাই।’
মৃদুলের কথার ধরণ এলোমেলো! সে ভীষণ অস্থির। সে যেন নিজের মধ্যে নেই! পূর্ণা এত সহজে নরম হওয়ার পাত্রী নয়। সে তার তেজ উর্ধ্বে রেখে বললো,’কৈফিয়ত দেয়ার জন্য কষ্ট করে কালো মেয়ের কাছে আসতে গেলেন কেন? রাতের কালো আঁধারে কালো মেয়েটাকে কি দেখা যাচ্ছে?’
মৃদুল কী বলবে,কী করবে বুঝতে পারছে না। আচমকা সে পূর্ণার কোমর জড়িয়ে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। হঠাৎ যেন পাহাড়ের শক্ত মাটির দেয়াল ভেঙে ঝর্ণধারার বাঁধ ভেঙে গেল। পূর্ণার পায়ের তলার মাটি শিরশির করে উঠে। মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। সর্বাঙ্গে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। যেন মাথার উপর বরফের পাহাড় ধ্বসে পড়েছে। মৃদুল কান্নামাখা স্বরে বললো,’ আমি কখন এমন হইয়া গেলাম পূর্ণা! তুমি আমারে কোন নদীতে নিয়া ঝাঁপ দিলা। নদীর একূলও পাই না,ওকূলও পাই না। তুমি হাত ছাইড়া দিলেই মরণ! ধইরা রাখো আমারে!’
মৃদুলের আকুল আবেদন শুনে পূর্ণার বুকের পাঁজর ব্যথায় টনটন করে উঠে। তার অভিমানের পাহাড় মুহূর্তে ধ্বসে যায়। মৃদুল কখন তাকে এতো ভালোবেসে ফেললো? এই জাদু কখন হলো! এভাবে কোনো প্রেমিক কাঁদতে পারে! পূর্ণা মৃদুলের সামনে বসলো। তার চোখ দুটি আবারও জলে পূর্ণ হয়ে উঠে। সে মৃদুলের এক হাতে শক্ত করে ধরে। মৃদুল বললো,,’পূর্ণা আমি আর কুনুদিন এমন করতাম না। কুনুদিন না! এইবারের মতো মাফ কইরা দেও। যদি আর এমন করি তুমি আমারে আমার লুঙ্গি দিয়া শ্বাস আটকায়া খুন কইরো!’
মৃদুলের কথা শুনে পূর্ণার মনের আকাশের মেঘ কেটে যায়। সে মৃদুলের হাতের উপর কপাল ঠেকিয়ে হাসতে হাসতে কান্না করে দিল। বিচ্ছেদের পরের পূর্ণমিলন এতো মধুর হয় কেন? পূর্ণার ইচ্ছে হচ্ছে,মৃদুলকে নিয়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে!
শেষরাতের বাতাস সাঁ সাঁ করে উড়ছে। লাহাড়ি ঘরের বারান্দার চৌকিতে বসে আছে মৃদুল-পূর্ণা। দুজনের মাঝে এক হাত দূরত্ব। হাড় কাঁপানো শীত! পূর্ণা ঠকঠক করে কাঁপছে। মৃদুল মৃদু ধমকের স্বরে বললো,’কখন থাইকা কইতাছি,ঘরে যাও।’
পূর্ণা কাঁপছে ঠিকই তবে তার মুখে হাসি। সে ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে বললো,’ কাঁপতে ভালো লাগে আমার!’
‘অসুস্থ হইয়া যাইবা তো। শরীর মরা মানুষের মতো ঠান্ডা হইয়া গেছে।’
‘কিছু হবে না।’
মৃদুল পূর্ণাকে দেখে অবাক হচ্ছে। একটা মানুষ এমন তীব্র ঠান্ডা কী করে সহ্য করতে পারে! ফজরের আযান পড়ার খুব বেশি সময় নেই। ফজরের আযানের পূর্বে মৃদুলকে তার আত্মীয়র বাড়িতে পৌঁছাতে হবে। ফজরের নামাযের পরই ট্রেন আসবে। মৃদল চৌকি থেকে নেমে বললো,’ আমি যাই এহন?’
মৃদুলের কণ্ঠে জড়তা। সে যেতে চাইছে না। পূর্ণা চৌকি থেকে নেমে মৃদুলের পাশে এসে দাঁড়ালো। মৃদুলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,’ আসবেন তো?’
মৃদুল পূর্ণার খুব কাছে এসে দাঁড়ালো। পূর্ণার দুই গালে হাত রেখে বিভ্রম নিয়ে বললো,’ বৃহস্পতিবার বিকালের মধ্যেই আইসসা পড়ুম। আর শুক্রবার আমার এই রানির সাথে আমার নিকাহ হইবো।’
মৃদুল নিকাহ শব্দটা খুশিতে বাকবাকম হয়ে উচ্চারণ করে। পূর্ণা বললো,’আপনার আম্মা রাজি না হলে?’
‘পুরা দুইন্নারে এক পাশে রাইখা শুক্রবার আমি তোমারে বিয়া করাম। বিয়ার শাড়ি,গয়না সব নিয়া আসুম। তুমি খালি প্রহর গুণতে থাহো।’
পূর্ণার খুশিতে কান্না পাচ্ছে। তিনদিন পর সেও বউ সাজবে! মৃদুলের বউ হবে! সুদর্শন, বাউন্ডুলে,রাগী ছেলেটার বউ! ভাবতেই বুকের ভেতর শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। মৃদুল আমুদে গলায় বললো,’ এহন যাও, লেপের তলে ঢুইকা ঘুম দেও। তোমারে ধরছি না সাপরে ধরছি বুঝা যাইতাছে না। এত্ত ঠান্ডা! যাও ঘরে যাও।’
‘টর্চ নিয়ে আসেননি? অন্ধকারে যাবেন কী করে?’
মৃদুল চুল ঝাঁকি দিয়ে ভাব নিয়ে বললো,’ আমি মিয়া বংশের ছেড়া! দুইন্নাত এমন কিছু নাই যে আমার পথ আটকাইবো! যেমনে আইছি ওমনেই যামু।’
পূর্ণা ফিক করে হেসে দিল।
গেইটের কাছাকাছি এসে পূর্ণা বললো,’ তাড়াতাড়ি আসবেন কিন্তু! আমি অপেক্ষা করব।’
মৃদুল হেসে মাথা নাড়াল। ইশারায় আশ্বস্ত করলো, সে তাড়াতাড়ি আসবে! গেইটের কাছে গিয়ে ফিরে তাকালো মৃদুল। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে! মনে হচ্ছে কিছু একটা বলা হয়নি। সে কথাটি না বললে,বড় ভুল হয়ে যবে। মৃদুল পূর্ণার সামনে এসে দাঁড়ালো। খুব কাছাকাছি! পূর্ণাও উৎসুক হয়ে আছে। সেও কি যেন শুনতে চাইছে! মৃদুল তার শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভেজাল। তারপর ডাকলো,’পূর্ণা?’
মৃদুলের কথার সাথে মুখ থেকে ধোঁয়া বের হয়। পূর্ণা স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে। মৃদুল পূর্ণাকে একবার দেখলো তারপর লাহাড়ি ঘরের দিকে তাকালো। তারপর আবার পূর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো,’তুমি ছাড়া এই পৃথিবীর সুখ আমার জন্যে হারাম হইয়া যাক পূর্ণা!’
মৃদুলের প্রতিটা কথা এতো মধুর কেন মনে হচ্ছে পূর্ণার! তারা যেন নতুন কোনো জগতে চলে এসেছে। যেখানে শুধু সে,মৃদুল, প্রেম,প্রেম আর প্রেম! পরক্ষণেই মৃদুল বললো,’ভালোবাসি না কইলে হয় না? কইতেই হয়?’
পূর্ণা চোখে জল নিয়ে হেসে উঠে। তার রেশমি কালো চুল মৃদু বাতাসে উড়ছে। কুয়াশার আবছা আলোয় শ্যামবর্ণের পূর্ণাকে আবেদনময়ী মনে হচ্ছে৷ রাতের অন্ধকারের নিজস্ব ক্ষমতা আছে। রাত মানুষের মনের অনুভূতিকে সযত্নে জাগ্রত করে তুলে। মৃদলের উপর রাত তার নিজস্ব ক্ষমতা ফলায়! ফলস্বরূপ, মৃদুলের মনের জানালায় উঁকি দেয় নিষিদ্ধ সব আবদার! যখন মৃদুলের নিজের মনের চাওয়া বুঝতে পারলো সে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে হঠাৎ বলে উঠলো,’শয়তান,শয়তান!’
পূর্ণা হতভম্ব হয়ে যায়। সে চোখমুখ বিকৃত করে বললো,’শয়তান কে? আমি?’
মৃদুল অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে বললো,’ না,না! তুমি হইবা কেন?’
মৃদুল চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে আবার বললো,’দেখো,আমার চারপাশে শয়তান ঘুরতাছে।
পূর্ণা মৃদুলের চারপাশ দেখে বললো,’কোথায়? কীভাবে দেখলেন?’
মৃদুল অসহায় চোখে তাকায়। অনেকক্ষণ তাকিয়েই থাকে। তারপর বললো,’আমার তোমারে চুমু খাইতে ইচ্ছা করতাছে। এইটা তো শয়তানের কাম!’
মৃদলের সহজ/সরল স্বীকারোক্তি। পূর্ণার কান গরম হয়ে যায়। লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে। মৃদুল অস্থির হয়ে বললো,’আমি যাইতাছি।’
কথা শেষ করেই মৃদুল ঘুরে দাঁড়ায়। গেইটের বাইরে যেতে যেতে দুইগালে থাপ্পড় দিয়ে কয়েকবার উচ্চারণ করলো,’ আসতাগফিরুল্লাহ,আসতাগফিরুল্লাহ!’
মৃদুল চোখের আড়াল হতেই পূর্ণা একা একা হেসে কুটি-কুটি হয়ে যায়।
পূর্ণা পায়ে আলতা দিয়ে প্রেমাকে বললো,’ভালো দেখাচ্ছে না?’
প্রেমা পূর্ণার উপর ভীষণ রেগে আছে। সে তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে বললো,’ কথা বলব না তোমার সাথে।’
‘ওমা! আমি আবার কী করলাম?’
‘আম্মা এতো রান্নাবান্না করছে। আর তুমি পুরো বাড়ি নতুন করে গুছালে এখন আবার সাজতে বসেছো। কেন এসব হচ্ছে সেটা বলছো না! কেন?’
পূর্ণা ঠোঁট টিপে হাসলো। দুই ডজন লাল কাচের চুড়ি দুই হাতে পরে বললো,’আমি কি আর কখনো সাজিনি?’
‘এবার আলাদা মনে হচ্ছে।’
‘সেটা তোর দোষ।’
‘আপা,বলো না।’
‘বিরক্ত করবি না তো।’
প্রেমা রাগে পায়ে গটগট শব্দ তুলে সোজা রান্নাঘরে চলে গেল। এখন সে বাসন্তীকে চাপ দিয়ে সব জেনে নিবে! প্রেমাকে রাগাতে পূর্ণার বেশ লাগে। সে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। মৃদুল পূর্ণার আলতা দেয়া পা খুব পছন্দ করে! যতবার পূর্ণা আলতা দিয়েছে মৃদুল ততবার প্রশংসা করেছে। পূর্ণার নিজেকে প্রজাপতি মনে হচ্ছে। মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াতে ইচ্ছে করছে যত্রতত্র। চোখ বুঁজলেই সেদিনের রাতটা ধরা দেয় ছবির মতন! মৃদুল চলে যাওয়ার পরদিন সকালে উঠেই পূর্ণা পদ্মজার কাছে গিয়েছিল। দুই বোনের মন-মালিন্য শেষ হয়েছে। পূর্ণার মুখে সব শুনে পদ্মজা ভীষণ খুশি হয়েছে। মাঝে একদিনের বেশি সময় চলে গেল,পদ্মজার সাথে পূর্ণার দেখা হয়নি। তাই পূর্ণা সিদ্ধান্ত নেয় সে এখন হাওলাদার বাড়িতে যাবে। মৃদুলের জন্য অপেক্ষা করা সময়টা খুব বেশি দীর্ঘ মনে হচ্ছে। ওই বাড়িতে গেলে সময়টা কেটে যাবে, আর ফিরেই দেখবে মৃদুল চলে এসেছে! তাছাড়া আমিরের সাথে পূর্ণা সাক্ষাৎ করতে চায়। পদ্মজার অনিশ্চিত জীবনটা গুছিয়ে দেয়ার কোনো পথ আছে নাকি খুঁজতে হবে! পূর্ণা মাথায় ঘোমটা টেনে নিল। তারপর চিৎকার করে বাসন্তীকে বললো,’বড় আম্মা,আপার কাছে যাচ্ছি।’
রান্নাঘর থেকে বাসন্তীর জবাব আসে,’যাস না এখন।’
কিন্তু চঞ্চল পূর্ণা কী কারো কথা শুনার মেয়ে! সে দৌড়ে পালাতে চায়। গেইটের কাছে এসেই হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। বড়ই কাঁটা পড়ে ছিল,সেই কাঁটা তেড়চাভাবে পূর্ণার হাতে প্রবেশ করে। কিঞ্চিৎ রক্ত বেরিয়ে আসে। তাতেও দমবার পাত্রী নয় সে। কাঁটা বের করে দ্রুত মোড়ল বাড়ি ছাড়লো! বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর পূর্ণার মনটা হঠাৎ করেই বিতৃষ্ণায় ভরে উঠে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে মোড়ল বাড়ির দিকে তাকালো। গাছগাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে তাদের ঘরের ছাদ দেখা যাচ্ছে!
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ