আমি পদ্মজা পর্ব-৬২+৬৩

0
1992

আমি পদ্মজা – ৬২
__________
চন্দ্র তারকাহীন ম্লান আকাশের কারণে চারপাশ অদ্ভুত ভয়ংকর হয়ে আছে। পদ্মজার মুখ ঘেঁষে একটা পাতা মাটিতে পড়লো। সাথে সাথে সে ভয় পেয়ে দুই পা পিছিয়ে যায়। যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারলো, নিজের ভয় পাওয়া দেখে নিজের উপর খুব বিরক্ত হয়। দুই পা এগিয়ে এসে অন্দরমহলের পিছনে তাকায়। আধো অন্ধকারে আবিষ্কার করলো, মৃদুল এবং আগন্তুক নেই! চোখের পলকে যেন মুহূর্তেই ভোঁজবাজির মতো নাই হয়ে গেল! পদ্মজার মস্তিষ্ক সাবধান হয়ে উঠলো। মৃদুলের মধ্যে ঘাপলা আছে ভাবতেই ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সে সবকিছু ভাবতে পারে। সবকিছু! পদ্মজা তার পরিকল্পিত পথ ধরে হাঁটা শুরু করলো। মনে মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, মৃদুল জঙ্গলের ভেতরে ঢুকেনি তো? আর দীর্ঘদেহী, ঝাঁকড়া চুলের আগন্তুকও কি সাথে রয়েছে? পদ্মজা এক হাতে ছুরি নিল, অন্য হাতে রাম দা। তার চোখের দৃষ্টি প্রখর। চারপাশে চোখ বুলিয়ে সাবধানে এক পা,এক পা করে এগোচ্ছে। নিঃশ্বাস যেন আটকে আছে। এই বুঝি কেউ আক্রমণ করে বসল! সেদিন যতটুকু এসেছিল সে,ঠাওর করে করে নিরাপদভাবে ঠিক ততটুকুই চলে আসে পদ্মজা। সামনে বড় বড় গাছপালা ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। ভূতুড়ে পরিবেশ। পদ্মজা কেন জানি নিশ্চিত,আজও কেউ থাকবে এখানে, অজানা রহস্যজাল পাহারা দেয়ার জন্য। আর আশেপাশেই আছে সেই গুপ্ত রহস্যজাল। পদ্মজার শিরায়,শিরায় প্রবল উত্তেজনা বয়ে যায়। কয়েকটা গাছ পেরিয়ে সে থমকে দাঁড়াল। একটা শব্দ ভেসে আসছে কানে। পদ্মজা দুরু দুরু বুকে শব্দ্যোৎস লক্ষ করে তাকাল। কিছুটা দূরে একজন লোক উবু হয়ে বসে আছে। সম্ভবত প্রস্রাব করছে। পদ্মজা প্রস্তুত হয় লোকটিকে পেছন থেকে আক্রমণ করার জন্য। কিন্তু অগত্যা কারণে তার হাত কেঁপে উঠলো। সে কাউকে প্রাণে মারতে পারবে না। সেই সাহস হচ্ছে না। একটা খুন করেছে ভাবলেই তার গাঁ কেঁপে উঠে। সেদিনের খুনটা তার নিজের অজান্তেই হয়ে গিয়েছে। সে যেন ছিল অন্য এক পদ্মজা। সেই পদ্মজাকে সে নিজেও চিনতো না।
পদ্মজা অস্থির হয়ে কিছু একটা খোঁজে। লোকটা উঠে দাঁড়ায়। পদ্মজা দ্রুত একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে লোকটির দিকে। লোকটির মুখ অস্পষ্ট। অবয়ব শুধু স্পষ্ট। দুলকি চালে এদিকেই এগিয়ে আসছে। পরনে লুঙ্গি ও সোয়েটার পরা। মাথায় টুপিও রয়েছে। লোকটার হাঁটা দেখে মনে হচ্ছে না, সে টের পেয়েছে অন্য কারো উপস্থিতি। তবুও পদ্মজার নিঃশ্বাস আটকে যায়। সে রাম দা শক্ত করে ধরলো। লোকটি তার কাছে আসতেই সে শরীরের সবটুকু জোর দিয়ে মাথায় আঘাত করে। লোহার রাম দার এক পাশের আঘাতে লোকটি লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। গোঙানির শব্দ করে, হাত পা ধাপড়াতে থাকলো। সেকেন্ড কয়েক পরই দেহ নিস্তেজ হয়ে যায়। পদ্মজার বুক ফুঁড়ে নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। তবে লোকটাকে কাঁচা খেলোয়ার মনে হলো! এক আঘাতেই কুপোকাত! পদ্মজা একবার ভাবল,টর্চের আলোয় লোকটার মুখ দেখবে। তারপর মাথায় এলো,টর্চের আলো দেখে যদি ওত পাতা বিপদ তার উপস্থিতি টের পেয়ে এগিয়ে আসে! তাই আর টর্চ জ্বালাল না। সে নিথর দেহটিকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেল। বাতাসের সাঁ,সাঁ শব্দ,ঝিঁঝিঁপোকার ডাক,আর অশরীরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালা, আর রাতের অন্ধকার বার বার পদ্মজার গা হিম করে দিচ্ছে। পদ্মজা প্রমোদ গুণে নিজের মধ্যে সাহস জোগানোর চেষ্টা করছে। বড় বড় গাছপালা ফেলে সে খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল। সামনে কোনো বড় গাছ নেই। জঙ্গলের মাঝে এরকম খোলা জায়গা কেন? এতে কি কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে! একদমই খোলা তাও নয়। জংলি লতাপাতা রয়েছে। তবে একটু অন্যরকম। লতাপাতার মাঝে জোঁক বা কোনো বিষাক্ত জীব থাকতে পারে। বিপদের কথা ভেবেও পদ্মজা ঝুঁকি নিলো। সে পা বাড়াল সামনে। কয়েক কদম এগোতেই জুতা ভেদ করে কাঁটা ফুঁটে পায়ে! আঘাতে আবার আঘাত লেগেছে। ব্যথায় পদ্মজার কলিজা যেন ছিঁড়ে যায়। সে কাঁটা বের করার চেষ্টা করে। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল বেরোয়। রক্তজবা ঠোঁট দুটি জলে ভিজে যায়।

মৃদুল এদিকওদিক দেখে বলল,’লিখন ভাই, চলো চইলা যাই।’
অসহনীয় যন্ত্রনায় লিখনের কপালে বিন্দু,বিন্দু ঘাম জমেছে। সেসবকে তোয়াক্কা করে সে বলল,’পদ্মজার খোঁজ নিতে হবে আগে।’

মৃদুল বুঝতে পারছে না কি করবে সে! লিখনের হাত থেকে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। দুপুরে সে পূর্ণার সাথে দেখা করতে মোড়ল বাড়িতে গিয়েছিল। পূর্ণা চোখমুখ ফুলে যা তা অবস্থা। অনেক কান্নাকাটি করে পদ্মজার জন্য। পূর্ণা আশঙ্কা করছে,তার বোন ভালো নেই। মৃদুলেরও তাই মনে হয়। সে যেতেই পূর্ণা ঝরঝর করে কাঁদতে থাকল। তখন লিখন শাহ আসে। তার শুটিং শেষের দিকে। সপ্তাহখানেক পর ঢাকা ফিরবে। তাই পূর্ণাদের সাথে দেখা করতে এসেছিল। পূর্ণাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে লিখন বিচলিত হয়ে পড়ে। তারপর প্রশ্ন করে বিস্তারিত জানতে পারে। লিখন,হাওলাদার বাড়িতে আসতে চাইলে,মৃদুল না করলো। সে বললো,ঢুকতে দিবে না। লিখন মৃদুলের কথা শুনে না। চলে আসে হাওলাদার বাড়িতে। পিছু পিছু আসে মৃদুল। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত দারোয়ান গেইটের ভেতরেই ঢুকতে দিল না লিখনকে। তখন মৃদুল, লিখনের সাথে পরিকল্পনা করলো, তারা বাড়ির পিছনের ভাঙা প্রাচীর পেরিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকবে। লিখন প্রথম রাজি না হলেও,পরে রাজি হলো। সে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। পদ্মজার খোঁজ নেই কথাটা সে ভাবতেই পারছে না! এতো বয়সে এসেও সে একটা মেয়ের জন্য এতো ব্যকুল হয়ে পড়ছে! তাও বিবাহিত মেয়ে! এমন মেয়েকে ভালোবেসে ব্যকুল হওয়া তো সমাজের চোখে খারাপ। এই সমাজের জন্যই সে পদ্মজার থেকে নিজের এতো দূরত্ব রাখে। যাতে কোনো খারাপ কথা,কোনো দূর্নাম পদ্মজাকে ছুঁতে না পারে। পদ্মজা যেন অসুখী না হয়। সেই পদ্মজার নাকি চারদিন ধরে খোঁজ নেই! মৃদুল দেখা করতে চাইলে,তাও করতে দেয়া হচ্ছে না! লিখনের মাথার রগরগ দপদপ করতে থাকে। আঁধার নামতেই দুজনে হাওলাদার বাড়ির পিছনের ভাঙা প্রাচীর দিয়ে বাড়ির সীমানায় ঢুকে পড়ে। বাড়ির পিছনে যে জঙ্গল,সেই জঙ্গলসহ পুরো বাড়ির সীমানা মিলিয়ে চারিদিকে গোল করে প্রাচীর দেয়া। তাই পিছনের প্রাচীর দিয়ে তারা আগে পশ্চিম দিকের জঙ্গলে পা রাখে। মৃদুল একবার মদনের সাথে পশ্চিম দিকে এসেছিল। একটা ঔষধি পাতা নিতে। তাই সে জানতো,এদিকে বড় বড় কাঁটা আছে। যা পথ রোধ করে। এজন্য সে রামদা নিয়ে এসেছে। যা লিখনের হাতে ছিল। লিখন অসাবধানবশত কাঁটার লতাপাতা কাটতে গিয়ে নিজের হাতে আঘাত করে বসে। ফলে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে। গলগল করে বেরিয়ে আসে রক্ত। রক্তাক্ত হাত নিয়ে বেরিয়ে আসে জঙ্গল থেকে। মৃদুল চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,’ভাই, রক্ত তো বন্ধই হইতাছে না।’
‘কী করা যায় বলোতো?’
‘আসো চইলা যাই। বাজারে যাইবা। নয়তো ডাক্তারের বাড়িতে নিয়া যাব।’
‘ব্যস্ত হয়ো না মৃদুল।’
লিখন এক জায়গায় বসল। তারা অন্দরমহলের বাম দিকে আছে। মৃদুলের হাত থেকে টর্চ নিয়ে লিখন চারিদিকে কিছু দেখল। তারপর বলল,’ওইযে দেখা যাচ্ছে,ওই পাতাটা নিয়ে আসো।’
‘আচ্ছা,ভাই। ‘
মৃদুল লিখনের দেখানো কয়েকটা পাতা নিয়ে আসে। তারপর কচলে নরম করে লিখনের ক্ষতস্থানে লাগায়। লিখন বলল,’হয়েছে এবার। রক্তপড়া বন্ধ হয়ে যাবে।’
‘আমরা চইলা যাইলেই পারতাম।’
‘পদ্মজার খোঁজ না নিয়ে কীভাবে যাই?’
‘পদ্মজা ভাবিরে এতো ভালোবাসো ভাই,অবাক করে আমারে।’
লিখন মুচকি হেসে বলল,’এসব বলো না মৃদুল। এসব বলতে নেই।’
‘সত্যি কথা কইতে ডর কীসের?’
লিখন ঠোঁটে হাসি রেখেই উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে হাঁটতে বলল,’বিবাহিত নারী নিয়ে এসব বলতে নেই। সমাজ ভালো চোখে দেখে না।’
‘সমাজরে আমি জুতা মারি।’
‘তোমার বয়স বেড়েছে ঠিকই,জ্ঞান হয়নি।’ বলতে বলতে লিখন অন্দরমহলের পিছনে এসে দাঁড়াল। গা হিম করা ঠান্ডা বইছে। তার পরনে শীতবস্ত্র নেই। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে সে। মৃদুল বলল,’এই কথা আমার আম্মাও বলে।’
‘এসব কথা বাদ দাও এখন। শুনো,আমরা বাড়ির সামনে যাব নাকি পিছন থেকেই কিছু করব?’
লিখনের ভাবগতি বোঝা যাচ্ছে না। মৃদুল লিখনের দৃষ্টি অনুকরণ করে অন্দরমহলের দুই তলায় তাকাল। পদ্মজার ঘরের জানালার দিকে। প্রশ্ন করলো,’পিছনে কী করার আছে?’
‘পদ্মজার ঘরের জানালার পাশে রেইনট্রি গাছটা দেখেছো? গাছে উঠে উঁকি দিলেই পদ্মজাকে দেখা যাবে। কথা বলাও যাবে।’
‘উঠতে পারো গাছে?’
‘আরে পুরুষ মানুষ হয়েছি কীজন্যে?’
‘তাইলে গাছে উঠমু আমরা?’
‘একবার সামনে দিয়ে চেষ্টা করা উচিত। তুমি যাও,গিয়ে দেখো ঢুকতে দেয় নাকি।’
মৃদুল মুখ কালো করে বললো,’দিবে না। আবার অপমান হতে ইচ্ছা করতাছে না।’
‘তাহলে চলো গাছে উঠি।’
মৃদুল চুল ঠিক করতে করতে গুরুতর ভঙ্গিতে বলল,’তুমি যহন কইছো, আমি যাবো।’

লিখন হাসলো। পূর্ণার মতোই মৃদুলের স্বভাব। পূর্ণাকে যে কারণে ভালো লাগে,ঠিক একই কারণে মৃদুলকেও ভালো লাগে। মৃদুল চলে যায়। লিখনের মাথাটা ব্যথা করছে। সে দু হাতে কপালের দু পাশ চেপে ধরে পদ্মজার ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে ভাবে, একজন জনপ্রিয় অভিনেতা হয়ে এভাবে প্রাচীর ডিঙিয়ে,লুকিয়ে এক পাক্ষিক ভালোবাসার মানুষের খোঁজ নিতে আসাটাকে হয়তো কারো চোখে পাগলামি মনে হবে। কিন্তু তার চোখে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব! নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্ব! পদ্মজা ভালো আছে ভেবেই সে মানসিকভাবে ভালো থাকে। এ কথা ঠিক, পদ্মজার সাথে আমিরের এতো সুখ দেখে তার বুকে চিনচিন ব্যথা হয়। তবে এটাও ঠিক পদ্মজার সুখ দেখে সে শান্তিও পায়! বেঁচে থাকার মানসিক মনোবল পায়। আশা থাকে মনে, আছে! বেঁচে আছে পদ্মফুল! চাইলেই দূর থেকে দেখা যাবে। চাইলে কথা বলাও যাবে। কিন্তু যদি নাই বা থাকে? তবে-

মৃদুল এসে জানালো,’শালার ব্যাঠা দুলাভাই নাই। কেউই নাই দরজার সামনে।’
লিখন বলল,’তাহলে চলো। সামনে দিয়েই যাই। আমারও কেমন লাগছিল,এভাবে লুকিয়ে বাড়ির পিছন দিয়ে… ” লিখন হাসলো। ম্লান হাসি। সে এগিয়ে গেল। সাথে মৃদুল। দুজন অন্দরমহলে প্রবেশ করলো নির্বিঘ্নে। কোনো বাধা আসেনি। আমিনা সদর ঘরে বসে ছিলেন। তিনি লিখনকে দেখে বললেন,’তুমি এইহানে কেরে আইছো?’
মৃদুল ঘরে ঢুকে বলল,’ফুফুআম্মা,পদ্মজা ভাবি কই?’
আমিনা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। মৃদুলের কাছে এসে আদুরে গলায় বললেন,’কই আছিলি বাপ? তোর ফুপায় বকছে বইলা চইলা যাবি কেন? আমি তোর ফুফুআম্মা আছি না? তুই এইহানেই থাকবি। যতদিন ইচ্ছা থাকবি।’
মৃদুল কপালে ভাঁজ সৃষ্টি করে বলল,’ধুর! বাদ দেও এসব কথা। তোমার জামাই একটা ইবলিশ। ইবলিশের ধারেকাছে মানুষদের থাকতে নাই।’
আমিনা মৃদুলের মুখ ছুঁয়ে বললেন,’এমন কয় না বাপ।’
‘আদর পরে কইরো। এখন কও তো পদ্মজা ভাবি কই?’
‘ঘরেই আছে।’
‘ভাবির কি শরীর ভালা আছে?’
আমিনা ক্ষণমুহূর্ত সময় নিয়ে লিখনকে দেখলেন। তারপর বললেন,’হ ভালা।’
‘আচ্ছা,ফুফুআম্মা আমরা উপরে যাইতাছি।’
আমিনা লিখনের দিকে আঙ্গুল তাক করে তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,’এই ছেড়াও যাইবো?’
লিখন চোখের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। পরপুরুষ হয়ে পদ্মজার মতো মেয়েকে দেখতে যাওয়া ঠিক হবে না বোধহয়। মৃদুল তো এই বাড়ির আত্মীয়। সে গেলে সমস্যা নেই। মৃদুল কিছু বলার পূর্বে লিখন বলল,’আমি এখানে বসি। তুমি যাও।’
‘না ভাই,তুমি আইয়ো।’
‘আরেএ,মৃদুল যাও তো।’

মৃদুল সিঁড়িতে পা রাখলো। আমিনা ভাবছেন,পদ্মজা তো ঘরেই আছে। বাড়িতে কোনো পুরুষ নেই। এরকম সময়ে যদি পদ্মজার নিচে নেমে আসে? লিখনের সাথে কথা বলে! আর এ খবর কোনোভাবে খলিল হাওলাদারের কানে যায়। তবে তার রক্ষে নেই। তিনি উঁচুকণ্ঠে ডাকলেন,’ মৃদুলরে?’
মৃদুল তাকালো। আমিনা জানেন না,পদ্মজা সত্যি যে ঘরে নেই। তিনি মিথ্যে ভেবে বললেন,’পদ্মজায় তো ঘরে নাই।’
লিখন উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলো,’কেন? কোথায় গিয়েছে?’
আমিনা নির্বিকার কণ্ঠে বললেন,’আমি কিতা কইতাম? গেছে কোনো কামে।’
মৃদুল সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসলো,’ভাবি একলা গেছে?’
আমিনা আরেকটা মিথ্যা বললেন,’না,একলা যায় নাই। আমিরের লগে গেছে?’
মৃদুল উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো,’আমির ভাই বাড়িত আছিলো? আমি যে দেহি নাই। ভাবছি,জরুরি কোনো কামে ঢাকাত গেছে।আচ্ছা,ফুফুআম্মা অন্দরমহল নজরবন্দিতে আছিলো কেন? আমারে ঢুকতে দিতো না।’
আমিনা তৃতীয়বারের মতো মিথ্যে বললেন,’আমির তো ঢাকাতই গেছিলো। কাইল রাইতে আইছে। আমির নাই এজন্যে পদ্মজার-‘
লিখন কথা কেড়ে নিয়ে বলল,’বুঝতে পেরেছি। সিকিউরিটি মানে নিরাপত্তা দিয়ে গিয়েছিল। আমি আছিতো গ্রামে! আমির হাওলাদার খুব ভালোবাসেন পদ্মজাকে!’ শেষ শব্দ তিনটি লিখন জোরপূর্বক হেসে বলল। তার চোখের মণি চিকচিক করছে। মৃদুল আফসোস করে বললো,’ধুর,দেখা হইলো না।’
‘আসি চাচি।’ বললো লিখন।

মৃদুল,লিখন বেরিয়ে আসে। মৃদুল বললো,’পদ্মজা ভাবির চিঠি দেখে তো মনে হয় নাই এতো সহজ ব্যপার।’
‘হু। পদ্মজা একটা রহস্যময়ী,মায়াময়ী। তাই বোধহয় রহস্য রেখে চিঠি লিখেছে। আর,মিস্টার আমির যেহেতু এখন সাথে আছে নিশ্চয় পদ্মজা ভালো আছে।’
মৃদুল গভীর মগ্ন হয়ে কিছু ভাবছে। সে লিখনের কথার জবাবে বললো,’ উমম।’
‘তবুও, আগামীকাল পদ্মজা পূর্ণার সাথে যোগাযোগ না করলে আমরা আবার আসব না হয়।’
মৃদুল লাফিয়ে উঠে বলল,’এটাই ভাবছিলাম।’

লিখনের হাতের রক্তপড়া বন্ধ হলেও খুব ব্যথা হচ্ছে। তা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মৃদুল বললো,’ভাই,সাইকেল নিয়া আসি। এ অবস্থায় হেঁটে যাওয়া ঠিক হইব না।’

লিখনও সায় দিল। মৃদুল আলগ ঘর থেকে সাইকেল নিয়ে আসে। মৃদুল সামনে, লিখন পিছনে বসলো। তাদেরকে দারোয়ান দেখে অবাক হয়। তবে বেশিকিছু বলতে পারেনি,মৃদুল হুমকি-ধামকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাতের স্নিগ্ধ বাতাসে লিখন অনুভব করলো,তার বুকের সূক্ষ্ম ব্যথাটা সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে। সে একবার ঘুরে তাকাল হাওলাদার বাড়ির গেইটের দিকে! খ্যাতিমান, সুদর্শন, ধনী লিখন শাহ, যে সবসময় ঠোঁটে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে রাখে তাকে দেখে সবার কত সুখী মনে হয়! কত যুবক স্বপ্ন দেখে লিখন শাহর অবস্থানে আসার! কিন্তু তারা কী কখনো জানবে, লিখন শাহ সর্বক্ষণ বুকের ভেতর বিষাক্ত সূচ নিয়ে হাসে। যে সূচের তীব্রতা তাকে এক মুহূর্তও শান্তি দেয় না।

পদ্মজা চারিদিকে হাঁটছে। কিন্তু চোখে পড়ার মতো কিছু পাচ্ছে না। কী এমন আছে এখানে? যা পাহারা দেয়ার জন্য কেউ না কেউ থাকে। কিছুই তো নজরে আসছে না। পদ্মজা জংলি লতাপাতার উপর হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে আসে। শিশিরের জলে পায়ের তালু থেকে হাঁটু অবধি ভিজে গিয়েছে। পা জোড়া ঠান্ডায় জমে যাওয়ার উপক্রম। থেকে থেকে কাছে কোথাও শেয়াল ডাকছে। পদ্মজার বুক ধুকপুক,ধুকপুক করছে।
মনে হচ্ছে,কয়েক জোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণ করে বসবে। ছিঁড়ে খাবে দেহ! ভাবতেই,পদ্মজার গা শিউরে উঠলো। সে ঢোক গিলল। তারপর আয়তুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দিল। আয়তুল কুরসি যতবার সে পড়ে,ততবার নিজের মধ্যে একটা শক্তি অনুভব করে। ভরসা পায়। এই মুহূর্তেও তার ব্যক্তিক্রম হয়নি। সে সামনে এগোতে এগোতে একসময় আবিষ্কার করলো,তার পায়ের নিচে মাটির বদলে অন্যকিছু আছে! চকিতে পদ্মজার মস্তিষ্ক চারগুণ গতিতে সচল হয়ে উঠলো। সে পায়ের নিচের লতাপাতা সরাতে গিয়ে দেখল, এই লতাপাতাগুলোর শেকড় নেই! পদ্মজা দ্রুতগতিতে সব লতাপাতা সরালো। তখনই আবছা আলোয় চোখে ভেসে উঠলো,লোহার মেঝে! পদ্মজার মুখে একটি গাঢ় বিস্ময়ের ছাপ প্রতীয়মান হয়ে উঠলো। তার উত্তেজনা বেড়ে যায়। শীতল শরীর উত্তেজনায় ঘামতে শুরু করলো। লোহার মেঝেটা খুব একটা বড় নয়। পদ্মজা টর্চ জ্বালায়। খুঁটিয়ে, খুঁটিয়ে দেখে। এক পাশে ছিদ্র রয়েছে। মনে হচ্ছে,এখানে চাবি ব্যবহৃত হয়! চকিতে পদ্মজার মাথায় এলো,আলমগীরের দেয়া চাবিটার কথা। সে দ্রুত পেটিকোটের দুই ভাঁজ থেকে চাবিটি বের করলো। প্রবল উত্তেজনায় তার হাত মৃদু কাঁপছে। বিসমিল্লাহ বলে,চাবি ছিদ্রে প্রবেশ করালো। এবং কাজও করে! পদ্মজা বিস্ময়ে বাকহারা হয়ে পড়ে! কী হতে চলেছে? সে লোহার এই অংশটি দুই হাতে তোলার চেষ্টা করলো। যতটা ভারী ভেবেছিল,ততটা নয়! পদ্মজা লোহার ভাবলেও,এটা বোধহয় লোহার নয়। ধীরে ধীরে পদ্মজা আবিষ্কার করলো,এটি একটা দরজা,গুপ্ত কোনো ঘরের দরজা। সে আতঙ্কে হিম হয়ে যায়। নিচের দিকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে। পদ্মজা তার কাঁপতে থাকা পা এগিয়ে দেয় ভেতরে। সে ভয় পাচ্ছে না তা নয়! খুব ভয় হচ্ছে। এমন আচানক ঘটনার সম্মূখীন তো আগে হয়নি। সিঁড়ি ভেঙ্গে সে অনেক দূর অবধি নেমে আসে। ভীষণ ঠান্ডা এদিকে। মনে হচ্ছে সব স্বপ্ন! কোনো রূপকথার গল্পের রাক্ষসপুরীতে চলে এসেছে! চোখের সামনে ভেসে উঠে আরেকটি দরজা। এই দরজাটি অদ্ভুত ধরণের। তাদের ঢাকার বাড়িতে হুবুহু একইরকম দরজা আছে! এই দরজার আড়ালে যাই হয়ে যাক বাইরে শব্দ আসে না! পদ্মজা অস্পষ্ট একটা সন্দেহে বিভোর হয়ে উঠে। এই দরজাটি খুলতে আলমগীরের দেয়া চাবিটাই কাজ করে! পদ্মজা চাবিতে চুমু খায়। এতো গুরুত্বপূর্ণ চাবি আলমগীর তাকে দিল কেন? এসব ভাবার সময় এখন নয়। বাকিটুকু তাকে দেখতে হবে। দরজা খুলে অন্য একটি অংশে প্রবেশ করতেই মুখে তীব্র আলো ধাক্কা খেল। পদ্মজা কপাল কুঁচকে দুই হাত সামনে বাড়িয়ে আলোর গতিবেগ রোধ করে মুখে অস্ফুট বিরক্তিসূচক শব্দ করলো। তারপর ধীরে ধীরে পিটপিট করে তাকালো। চারিদিকে রঙ-বেরঙের বাতি জ্বলছে। এই বাতিগুলোও তার চেনা। তাদের বাড়িতে আছে। যখন বিদ্যুত থাকে না,ব্যাটারিচালিত এই বাতিগুলো পুরো বাড়ি আলোয় আলোয় ভরিয়ে তুলে! দুইদিকে আরো দুটো দরজা। প্রথম দরজাটিতে লেখা ‘স্বাগতম’। দ্বিতীয়টিতে লেখা ‘ধ-রক্ত।’ রুম্পা তো এমন কিছুই বলেছিল! পদ্মজা আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। দ্বিতীয় দরজাটির দিকে হেঁটে আসে। এটার কোনো তালা নেই। তাহলে খুলবে কী করে? পদ্মজা ধাক্কা দিল। সাথে সাথে খুলেও গেল। পদ্মজার মুখ হা হয়ে যায়। তার ঠোঁট বার বার শুকিয়ে যাচ্ছে। এ কোথায় এসেছে সে! আর কি ফিরতে পারবে নিজের ঘরে? আচমকা পদ্মজার কানে ভেসে আসে মেয়েদের কান্নার চিৎকার! পদ্মজার রক্ত হিম হয়ে যায়। এরকম একটা জায়গায় এতোগুলো মেয়ে কেন কাঁদছে? কত কষ্ট,যন্ত্রণা সেই কান্নায়! কান্নার বেগ বাড়ছে। যেন কেউ বিরতিহীনভাবে আঘাত করছে। পদ্মজা দুই হাতে ছুরি ও রাম দা শক্ত করে ধরলো। তারপর সেই কান্না অনুসরণ করে এগিয়ে গেলো সামনে। যত এগুচ্ছে কান্নাগুলো তীব্র ধাক্কা দিচ্ছে বুকে। পদ্মজার নিঃশ্বাস আটকে আছে। সে চলে এসেছে খুব কাছে। চোখের সামনে আরেকটা ঘরের দরজা। দরজাটি একটু খোলা। সে সাবধানে দরজা ঠেলে ঘরের ভেতর তাকালো। আর ঠিক তখনই তার পায়ের পাতা থেকে মাথার তালু অবধি শিরশির করে উঠলো। চোখের সামনে দেখা দৃশ্যটা দুঃস্বপ্ন বলে মনে হতে লাগলো। মনে হচ্ছে জায়গায় জমে গেছে সে। বিবস্ত্র অবস্থায় পাঁচ-ছয়টি মেয়ে হাতজোড় করে কাঁপছে,কাঁদছে। তাদের শরীর রক্তাক্ত। আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা লম্বা শ্যামবর্ণের দেহ। গায়ে শার্ট নেই। প্যান্ট নেমে এসেছে নাভির অনেক নিচ অবধি। তার হাতে বেল্ট! সম্ভবত বেল্ট দিয়েই,মেয়েগুলোকে আঘাত করছিল! প্রশস্ত ও তুষ্টপুষ্ট শরীরের গড়নের মানুষটিকে চিনতে পেরে পদ্মজার বুকের পাঁজর টনটন করে উঠল। তার হাত থেকে পড়ে যায় ছুরি ও রাম দা। বিকট শব্দ হয়। সেই শব্দ অনুসরণ করে উপস্থিতি মানুষগুলোর চোখ পড়ে দরজার দিকে। পদ্মজা ধপ করে বসে পড়ে মাটিতে। শরীরের সবটুকু শক্তি নিমিষেই কে যেন চুষে নিয়েছে! পদ্মজাকে দেখে মানুষটির চোখ হিংস্র জন্তুর মতো জ্বলজ্বল করে উঠে। কপালের শিরা ভেসে উঠে,হিংস্র চাহনি আরো ভয়ঙ্কর হয়ে যায়। সে ভাবতেই পারছে না, পদ্মজা এত দূর চলে এসেছে! পদ্মজা বিস্ময়ভরা ছলছল চোখ দুটি সেই মানুষটার দিকে তাক করে অস্পষ্ট স্বরে বলল,’ ছিঃ!’

চলবে…
®ইলমা বেহরোজ

আমি পদ্মজা – ৬৩
_________
বিছানার উপর কাঁথা মোড়ানো ফরিনার দূর্বল দেহটা শুয়ে আছে। বিদ্যুত নেই। ঘরের এক কোণে লণ্ঠন জ্বলছে। ফরিনার চোখ বোজা। লতিফা পায়ে পায়ে হেঁটে এসে নিঃশব্দে ফরিনার শিয়রে দাঁড়াল। ক্ষীণস্বরে ডাকলো,’খালাম্মা ঘুমাইছেন?’

ফরিনা ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। চোখের দৃষ্টি ঘোলা। কিছু মুহূর্তের ব্যবধানে বয়সের তুলনায় একটু বেশিই যেন বয়স্ক দেখাচ্ছে। ফরিনা কিছু একটা বললেন। লতিফা বুঝলো না। সে নত হয়ে ফরিনার মুখের কাছে নিজের মুখ এনে বললো,’কী কইছেন খালাম্মা?’
ফরিনা দূর্বল গলায় নিম্নস্বরে বললেন,’পদ্মজা কই?’
‘আপনের ঘরে না আইলো দেখলাম।’
‘ঘুম থাইকা উইঠা তো দেহি নাই।’ ফরিনা থামলেন। তারপর বললেন,’এহন কই?’
‘ মনে কয় ঘরে আছে। ডাইকা দিমু?’
‘না, থাকুক।’
‘খাইবেন কিছু?’
‘না। আরেকটা কেঁথা দে।’

লতিফা আলমারি থেকে লেপ বের করলো। তারপর ফরিনার গায়ের উপর দিল। আর বললো,’অনেক ঠান্ডা পড়ছে খালাম্মা। কাঁথা দিয়া হইবো না।’
ফরিনা লতিফার সাথে আর কথা বাড়ালেন না। তিনি জানালার বাইরে চোখ রাখেন। রাতের আকাশ দেখা যাচ্ছে। আর শীতল হাওয়া সাঁ,সাঁ করে ঘরের ভেতর ঢুকছে। তিনি আকাশের গায়ে বাবুর ছোটবেলার মুখটা দেখতে পেলেন। যখন বাবুর জন্ম হলো, আমিনা কপাল কুঁচকে বলেছিলেন,’তোমার ছেড়ায় তো সত্যি কালা হইছে। আমি ঠিকই কইছিলাম।’
আমিনার কথা শুনে ফরিনার বিন্দুমাত্র রাগ হয়নি। বাবুর নিষ্পাপ মুখটা দেখে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েন। সারা মুখে গুচ্ছ গুচ্ছ মায়া। এই মায়াময় শ্যামবর্ণের মুখ দেখে তিনি যেন পিছনের সব কষ্ট ধামাচাপা দিয়ে দিতে পেরেছিলেন। আদর করে কোলে নিয়ে ডেকেছিলেন,’আমার বাবু।’
মায়াময় এক রত্তি বাবুর নামকরণ হয় আমির হাওলাদার। ধীরে ধীরে বড় হয় আমির। মায়ের চুলের বেণি করে দেয়া ছিল তার নিত্যদিনের অভ্যাস। মায়ের হাতে তিন বেলা না খেলে পেটই ভরতো না। কতশত আবদার ছিল তার! আম্মা,আম্মা করে বাড়ি মাথায় তুলে রাখতো। যতবার আম্মা ডাকতো ততবার বোধহয় নিঃশ্বাসও নিতো না। ছোট থেকেই আমির স্বাস্থ্যবান,তেজি। বাবা-মায়ের আদরের একমাত্র ছেলে ছিল। যখন আমিরের বয়স চৌদ্ধ,তখন সে ফরিনাকে কোলে নিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরেছে! ফরিনা সেদিন আবেগে আপ্লুত হয়ে ছেলেকে বকেছেন,উচ্চস্বরে হেসেছেন। জীবনে স্বর্গীয় সুখ নিয়ে এসেছিল আমির। পিছনের কথা ভেবে, ফরিনার ঠোঁট দুটি থরথর করে কেঁপে উঠলো। চোখ দুটি ভিজে উঠে জলে। এই বয়সে এসে স্মৃতির নরকীয় যন্ত্রণা হজম করা খুব কষ্টের। কম তো বয়স হলো না। পঞ্চাশের ঘরে পড়েছেন। ফরিনার চোখের দেয়াল টপকে উপচে পড়ছে নোনা জল। সেই জল দেখে লতিফা বিচলিত হয়ে উঠলো,’খালাম্মা,ও খালাম্মা। কান্দেন কেন?’
ফরিনা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালেন। ভেজা কণ্ঠে বললেন,’তুই যা লুতু।’
লতিফা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ পর বললো,’পদ্মরে কিছু কইয়েন না খালাম্মা। কষ্টে মইরা যাইব। ছেড়িডা ভালা আছে। ভালাই থাহক। মা-বাপ নাই।’
ফরিনা লতিফার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,’তুই সব জানতি লুতু?’
লতিফা মাথা নত করে বলল,’হ।’
ফরিনা হিংস্র সিংহীর মতো গর্জে উঠে বললেন,’আমারে আগে কইলি না কেন তুই? আমার বাবু কেমনে আমার হাত থাইকা ছুইটা গেলো? বাপের রক্ত কেমনে পাইলো?’
ফরিনা কাশতে থাকলেন। উত্তেজিত হওয়াতে শরীরের হাড়ে,হাড়ে তীব্র ব্যথা অনুভব হচ্ছে। কেউ যেন কাঁটাচামচ দিয়ে একটার পর একটা ঘা দিচ্ছে। লতিফা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ফরিনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,’খালাম্মা,আপনি চিল্লাইয়েন না। আপনের ক্ষতি হইবো।’
ফরিনা শ্বাসকষ্ট রোগীর মতো ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে বললেন,’আমার ক্ষতি হওনের আর কী আছেরে লুতু!’

লতিফা ভয় পেয়ে যায়। ফরিনা বিরতিহীন ভাবে কাশছেন। যেন শ্বাস নিতে পারছেন না। সে দৌড়ে দুই তলায় ছুটে যায় পদ্মজাকে আনতে। ফরিনা ছাদের দিকে চোখ নিবদ্ধ করে হা করে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিলেন। মনে হচ্ছে দম গলায় এসে আটকে গেছে। তিনি শূন্য! একেবারে ফাঁকা কোল! মজিদ হাওলাদার নামক নরপিশাচ তার নিষ্পাপ বাবুকে খুন করে,নিষ্পাপ বাবুর মনকে খুন করে বাঁচিয়ে রেখেছে হিংস্র আমিরকে! হাওলাদার বাড়ির রক্ত থেকে তিনি তার বাবুকে পরিষ্কার রাখতে পারেননি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম চলে আসা পাপের পাহাড় আমির যেন কয়েক বছরে কয়েকগুণ বড় করে তুলেছে! একজন দুঃখী মায়ের শেষ সম্বল হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে ভালোবাসারা,চলছে শুধু অভিনয়! যার কাছেই সেই অভিনয় ধরা পড়বে,তার জায়গা বন্দি ঘরে নয়তো কবরে।

বাতাসটাতে বোধহয় প্রকৃতি বিষ মিশিয়ে দিয়েছে। পদ্মজার বুক জ্বলছে। বুকের ভেতরটা তীব্র দহনে পুড়ে যাচ্ছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি তারই ভালোবাসার স্বামী! আমির হাওলাদার! আমিরের হিংস্র চোখ দুটি শিথিল হয়ে ভয়ে, আতঙ্কে জমে যায়। মস্তিষ্ক মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে যায়। হুট করে পদ্মজাকে দেখে তার চোখ দুটি স্বভাবসুলভ কারণে জ্বলজ্বল করে উঠে। যা হিংস্র দেখায়। কিন্তু এই মুহূর্তে তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে! হাত থেকে বেল্ট পড়ে যায়। আড়চোখে বিবস্ত্র মেয়েগুলোকে একবার দেখে,তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। এ কোন সময়ে পদ্মজার উপস্থিতি! পদ্মজার গাল বেয়ে জল মেঝেতে পড়ে। আমির দ্রুত পায়ে পদ্মজার কাছে আসে। পদ্মজাকে ছুঁতেই পদ্মজা ছ্যাঁত করে উঠল। ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকায় আমিরের দিকে। আমির জোর করে পদ্মজাকে তুললো। পদ্মজা জোরে জোরে কাঁদতে থাকলো। সে দুই হাতে ধাক্কা দেয় আমিরকে। কিন্তু এক চুলও দূরে সরাতে পারেনি। আমির পদ্মজা দুই হাত পিঠের দিকে নিয়ে নিজের এক হাতে চেপে ধরে। অন্য হাতে পদ্মজার মাথা বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,’কিছু দেখোনি তুমি।’
তারপর উচ্চস্বরে কাউকে ডাকলো, ‘আরভিদ,আরভিদ! দ্রুত মেয়েগুলোকে ঢেকে দাও।’
আমিরের ডাক শুনে সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে একজন দৌড়ে আসে। দেখতে শ্বেতাঙ্গদের মতো। লাল চুল। তার হাতে কাপড়। সে দরজা পেরিয়ে মেয়েগুলোকে ঢেকে দিতে যায়। পদ্মজা কপাল দিয়ে আমিরের বুকে আঘাত করে আর্তনাদ করে বললো,’ছাড়ুন আমাকে। আমার ঘেন্না হচ্ছে আপনাকে। কত নিকৃষ্ট আপনি!’
আমির বুঝতে পারছে না তার কী করা উচিত। আচমকা ঘটনায় সে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে। পদ্মজা ধ্বস্তাধস্তি শুরু করে। তার সারা শরীরে যেন পোকারা কিলবিল করছে। মেয়েগুলোর মধ্য থেকে একজন মেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললো,’আপা আমরারে বাঁচান। এই লোকটা আমারারে মাইরা ফেলব।’
আরভিদ নামের শ্বেতাঙ্গ লোকটি চোখের পলকে মেয়েটির গালে থাপ্পড় বসালো। মেয়েটি আম্মা বলে কেঁদে উঠে। পদ্মজার বুকের হাড়ে,হাড়ে কাঁপন ধরে। এসব কী হচ্ছে! কেন হচ্ছে! সব দুঃস্বপ্ন হয়ে যাক! হয়ে যাক! পদ্মজা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো,’ছাড়ুন আমাকে।’
আরভিদের থেকে পাওয়া কাপড়ের একটু অংশ বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে, একটা মেয়ে পদ্মজাকে দেখছে। পদ্মজাকে দেখে মেয়েটার মনে হচ্ছে এই মানুষটা ভালো। এখানের সবার মতো খারাপ না। তাই সে অনুরোধ করে বললো,’আমাদের বাঁচান আপা। আমাদের অনেক মারে ওরা।’

আমির কিছুতেই পদ্মজাকে হটাতে পারছে না। যেন জায়গায় জমে আছে। মেয়েটির কথা শুনে আমিরের মাথার রক্ত টগবগ করে উঠে। সে তার রক্তচক্ষু দিয়ে ভয় দেখালো। আরভিদ মেয়েটির পেট বরাবর লাথি মারে। মেয়েটি কুঁকিয়ে উঠে কাপড়ের অংশ থেকে দূরে সরে গিয়ে দেয়ালের সাথে গিয়ে ধাক্কা খেলো। নগ্ন দেহটি দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়েই মেঝেতে পড়ে গুটিয়ে যায়। সেই গুটিয়ে যাওয়া দেহটির উপরই আরভিদ আরেকটা লাথি বসায়। মেয়েটা চিৎকার অবধি করতে পারলো না! নির্মম,পাশবিক অত্যাচার পদ্মজাকে হিংস্র করে তুললো। সে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে আমিরকে দূরে সরিয়ে দিল। আমিরের খেয়াল ছিল মেয়েগুলোর দিকে, তাই সহজেই ছিটকে যায়। পদ্মজা মেঝে থেকে তুলে নিলো ছুরি। আরভিদ কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই পদ্মজা তেড়ে এসে মুখ দিয়ে অদ্ভুত উচ্চারণ করে আরভিদকে আঘাত করলো। আরভিদের পরনে ঘন জ্যাকেট ছিল। তাই তার বেশি আঘাত লাগেনি।তবে সে আকস্মিক আক্রমণে ঘাবড়ে যায়। পদ্মজাকে আঘাত করতে চায়,আমির চেঁচিয়ে উঠলো,’আরভিদ, থামো।’
আরভিদ থামলেও পদ্মজা থামলো না। সে আবার আঘাত করতে উদ্যত হয়, ধরে ফেললো আমির। পদ্মজা হিংস্র বাঘিনীর মতো ফোঁস,ফোঁস করতে থাকে। তার শরীর কাঁপছে ক্রোধে। পদ্মজার রাগ দেখে আমির প্রচণ্ড অবাক হয়। পদ্মজার রাগ সে কোনোদিন দেখেনি! ফ্রান্স থেকে তারা অনেক যন্ত্রপাতি আনে। তার মধ্যে একটি পদ্মজার হাতের ছুরি। যে ছুরির ধার বিষের চেয়েও ধারালো। সে ছুরি পদ্মজার হাতে! আমির জোরদবস্তি করে পদ্মজার হাত থেকে ছুরি ফেলে দিলো। মেয়েগুলো ভয়ে কাঁপছে। তারা এখন পদ্মজাকেও ভয় পাচ্ছে। এতো সুন্দর মেয়ের তেজি রূপ দেখে মনে হচ্ছে, হাজার বছর ধরে যুবতিদের রক্ত দিয়ে গোসল করে সৌন্দর্য রক্ষা করা এক ভয়ংকর সুন্দরী ডাইনি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমির পদ্মজাকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে ঘরের বাইরে নিয়ে আসে। পদ্মজা হাত পা ছুটাছুটি করছে। চিৎকার করছে। দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল আরেকজন লোক। তার চুলগুলো মেয়েদের মতোন অনেক লম্বা,তবে ফর্সা। এতো চেঁচামিচি শুনেও ভেতরে যায়নি। কারণ, আমির না বললে তারা এক পাও নড়ে না। আমির পদ্মজার সাথে ধ্বস্তাধস্তি করতে করতে বললো,’মেয়েগুলোকে সামলাও,দ্রুত যাও। আরভিদকে সাহায্য করো।’

লোকটি আমিরের আদেশমতো চলে গেলো। পদ্মজা নিজের কান দুটি বিশ্বাস করতে পারে না। তার স্বামীর কণ্ঠে এ কি শুনছে সে! বুকের জ্বালাপোড়া বেড়ে চলেছে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার! আমির পদ্মজাকে একটা ঘরে নিয়ে আসে। পদ্মজা নিজের মধ্যে নেই। সে কিড়মিড় করছে,কাঁদছে। আমির পদ্মজাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দ্রুত চেয়ারের সাথে বেঁধে ফেললো। তখন পদ্মজার সুযোগ ছিলো আমিরকে ধাক্কা মেরে পালানোর চেষ্টা করার। কিন্তু সে পারেনি! সে কার থেকে পালাবে? নিজের স্বামীর থেকে? যাকে সে ভালোবাসে। যে মানুষটা তাকে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়ায়। খাইয়ে দেয়। শতশত আবদার পূরণ করে! পদ্মজা ডুকরে কেঁদে উঠলো। এক হাতের উপর কপাল ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,’আমি মেনে নিতে পারছি না।’

আমির পদ্মজার চেয়ে কিছুটা দূরে চেয়ার নিয়ে বসলো। তার চোখেমুখে আতঙ্ক! সে চেয়ে রইলো পদ্মজার দিকে। পদ্মজা চোখ তুলে তাকায়। আমিরের চোখে চোখ পড়ে। সে ঠোঁট দুটি ভেঙে কেঁদে বললো,’আপনি আমাকে বাঁধতে পারলেন?’
আমির কিছু বললো না। পদ্মজা বললো,’আপনি ওভাবে মেয়েগুলোকে মারতেও পারলেন?’
আমির আগের অবস্থানেই রইলো। পদ্মজা নাক টেনে বললো,’এতো খারাপ আপনি? এতো বেশি! মেয়েগুলোকে কেন মারছিলেন?’
আমির শুধু চেয়েই আছে। পদ্মজা বললো,’এতো নিষ্ঠুর আপনি? সব দুঃস্বপ্ন হতে পারে না?’
আমির পদ্মজার প্রশ্ন উপেক্ষা করে বললো,’রিদওয়ান কোথায়?’
পদ্মজা কান্না থামিয়ে হাসলো। ধারালো সেই হাসি। ঠোঁটে হাসি রেখেই বললো,’আমাকে পাহারা দিতে রেখেছিলেন? মারতেও কি বলেছিলেন?’
‘যা বলছি উত্তর দাও।’
পদ্মজা সেকেন্ড কয়েক আমিরের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর বললো,’মেরে দিয়েছি।’
আমির চমকে উঠলো,’কি!’
‘মরেনি। হাসপাতাল আছে।’

আবারও পিনপতন নীরবতা। পদ্মজা আমিরকে দেখছে। যে মুখে মায়া ছাড়া কিছু দেখতো না সে,আজ সে মুখটাই চিনছে না। বুকের ভেতরটা কেমন করছে! আল্লাহ যেন বুকের ভেতর জাহান্নামের আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। পদ্মজার মস্তিষ্কের সব প্রশ্ন উধাও হয়ে গিয়েছে। শুধু দেখছে আমিরকে, ভাবছে আমিরকে নিয়ে। পদ্মজা ম্লান হেসে জানতে চাইলো,’এখন কী করবেন আমাকে নিয়ে? বুকে ছুরি চালাবেন? নাকি রাম দা? মারার জন্য আর কিছু কি আছে?’
আমির নিশ্চুপ। সে নিজেও জানে না সে কী করবে! পদ্মজা বললো,’ পশুরা কাউকে ভালোবাসে?’
আমির মুখ খুললো,’বাসে বোধহয়।’
পদ্মজা হাসলো। হাসতে হাসতে চেয়ারে হেলান দিল। তারপর আবার সোজা হয়ে বসলো। গুরুতর ভঙ্গিতে বললো,’মেয়েগুলোকে ছেড়ে দিন।’
‘অসম্ভব।’
‘আমি ঠিক ছাড়িয়ে নেব।’
‘আর কিছু করো না।’
‘কী করবেন? খুনই তো।’
‘একটু ভয়ডর ঢুকাও মনে।’
‘বিশ্বাস করুন,আপনার বুকে ছুরি চালাতে আমার খুব কষ্ট হবে।’

আমির চকিতে তাকালো। পদ্মজা কথাটা বলে কাঁপতে থাকলো। নিয়তি তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! কী বলাচ্ছে! এই কথাটা সে মন থেকে বলেনি। সে কিছুতেই এমন কথা বলেনি! আমির নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,’ভালোই তো ছিলাম আমরা!’
‘মুখোশধারীর সাথে আবার ভালো থাকা!’
‘একদম মায়ের মতো হয়েছো।’
‘নিঁখুত অভিনেতা!’
‘বাধ্য হয়ে।’
‘কে করেছে বাধ্য আপনাকে?’
‘তোমার আদর্শ। তোমার পবিত্রতা।’
‘আপনি কলুষিত করেছেন।’
‘বিয়ে করেছি।’
‘কেন করেছেন? ভোগ করে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিতেন। তাহলে ভালোবেসে আজকের নরকীয় যন্ত্রণাটা সহ্য করতে হতো না।’
‘সব ভুলে যাও। রানির হালে থাকবে।’ আমিরের কণ্ঠে জোর নেই। সে পদ্মজাকে চিনে। পদ্মজাকে সে এতদিন অন্ধকারে রাখলেও,পদ্মজা তাকে আলোতে রেখেছিল। সেই আলো দিয়ে আমির চিনতে পেরেছে পদ্মজাকে। পদ্মজা অন্যায় মেনে নেয়ার মেয়ে নয়। কিন্তু চেষ্টা তো করতে হবে। আজও পদ্মজা জানতে পারতো না কিছু,যদি সে ঝড়ের কবলে না পড়তো! গুটি ওলটপালট হয়ে গেছে! এরেই বোধহয় বলে চোরের দশদিন,গৃহস্থের একদিন।

পদ্মজা ছলছল চোখে আমিরকে দেখে। সে চোখের সামনে সবকিছু দেখেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। সর্বাঙ্গে যে কষ্টটা হচ্ছে,শরীর থেকে রুহ বের হয়ে যাওয়ার সময়ও বোধহয় তেমন কষ্ট হয় না। পদ্মজা ঝরঝর করে কেঁদে দিল। এ কেমন নিয়তি তার! যতক্ষণ সে সামনে থাকে ততক্ষণ প্রেমের কথা বলা মানুষটা তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে ঠান্ডা মাথায় ভাবছে,তাকে নিয়ে এখন কী করা যায়! পদ্মজা তার হাতের চুড়িগুলো দিকে তাকালো। চুড়ি দুটো তার মায়ের। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে! এই পৃথিবীতে তার একমাত্র ছায়া,একমাত্র ভরসার স্থান ছিল তার মা! মা মারা গেল। তারপর সেই স্থানটা পরিবর্তন হলো আমিরের নামে। সেই মানুষটার রূপ এভাবে গিরগিটির মতো পাল্টে গেল! না,পাল্টে যায়নি। এমনই ছিল। শুধু মুখোশ পরে ছিল। ছদ্মবেশী!

মেয়েগুলোর চিৎকার ভেসে আসে। তাদের অত্যাচার করা হচ্ছে খুব। কিছু একটা দিয়ে পিটাচ্ছে,ফ্যাচফ্যাচ শব্দ হচ্ছে। কোন বাবা-মায়ের চোখের মণিদের এভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে! পদ্মজা চিৎকারগুলোকে ইঙ্গিত করে বললো,’আপনার কষ্ট হয় না? একটুও হয় না?

আমিরের ভাবান্তর হলো না। সে চিন্তায় মগ্ন। তার ছক উল্টে গেছে। এমন এক জায়গা এসে ছক উল্টেছে যে আর ঠিক করার উপায় নেই। নতুন করে সাজালে সেখান থেকে হয় পদ্মজা নয় এতো বছরের পাপের সাম্রাজ্য ত্যাগ করতে হবে! তুখোড় আমির মনে মনে পরিকল্পনা করলো, আপাতত,যে কাজের জন্য তার ছুটে আসতে হয়েছে অলন্দপুরে সে কাজটা সম্পন্ন করতে হবে। এই চাপটা মাথার উপর থেকে গেলে তারপর অন্যকিছু। কয়টা দিন পদ্মজাকে নজরে রাখতে হবে। কিন্তু যদি,সেই কাজ করার পথেই পদ্মজা দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়!

পদ্মজা চেয়ার থেকে ছুটতে চাইছে। ছটফট করছে। সে আমিরকে অনুরোধ করলো,’শুনছেন আপনি, ওদের মারতে নিষেধ করুন। আপনার বুক কাঁপছে না? ওদের কান্না অনুভব করুন। ওদের কষ্ট হচ্ছে অনেক। পুরো…পুরো শরীরে রক্ত ছিল। তার উপর আবার মারছে। আমি সহ্য করতে পারছি না।’

আমির চুপ করে তাকিয়ে আছে পদ্মজার দিকে। তার চোখের পলক পড়ছে না। চাইলেও আর অজুহাত দেয়া সম্ভব নয়। অজুহাত দেয়ার মতো কিছু নেই। এবার যা হবে সরাসরি হবে। পদ্মজার কান্না বেড়ে যায়। পদ্মজা কি মেয়েগুলোর জন্য কাঁদছে নাকি নিজের স্বামীর সমর্থনে মেয়েগুলো অত্যাচারিত হচ্ছে বলে কাঁদছে? কে জানে।

চলবে…
®ইলমা বেহরোজ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে