আমি পদ্মজা – ৫৩
____________
কোনো সাড়া নেই। পদ্মজা পিছনে ফিরে তাকাল। লিখন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে তার দিকে চেয়ে কী দেখছে! পদ্মজা আবার মুখ ঘুরিয়ে নিল। কাটা কাটা গলায় বলল,’কিছু বলার যখন নেই,আসি আমি।’
‘ ভুলে গেছো আমায়? মনে পড়ে না?’ লিখনের কণ্ঠে ব্যাকুলতা।
পদ্মজার তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ,’না ভুলবার মতো কোনো সম্পর্ক কী আমাদের ছিল? ছিল না। আর এভাবে নির্জনে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। আপনি বুঝদার মানুষ,জ্ঞানী মানুষ। এতটুকু নিশ্চয়ই বুঝবেন।’
লিখন ম্লান হেসে বলল,’আচ্ছা,আজ আসো।’
‘একটা অনুরোধ ছিল।’
‘কী?’
পদ্মজা ফের আবার তাকাল। সরাসরি লিখনের চোখের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে লিখনের বুক কেঁপে উঠে। সে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে। পদ্মজা বলল,’নিজেকে এবার গুছিয়ে নিন। মরীচিকার পিছনে অনেক দৌড়েছেন,আর না। এবার নিজের জীবনটা নতুন করে সাজান। আপনার মনের জোর বাড়ান। মানুষ দ্বিতীয় প্রেমেও পড়ে। দ্বিতীয় বার কাউকে ভালোবাসে। মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসে। আপনি চেষ্টা করুন। আপনিও পারবেন। কেউ না কেউ আপনার জন্য অবশ্যই আছে।’
‘পদ্ম ফুল।’
পদ্মজা একটু সময়ের জন্য হলেও থমকায়। লিখন বলল,’এভাবেই ভালো আছি আমি। তুমিও এভাবেই সারাজীবন ভালো থেকো।’
পদ্মজা কী প্রতিক্রিয়া দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। এই লিখন শাহ তো এক ধ্যানেই পড়ে আছে। সে আর কথা বাড়াল না। যে বুঝেও বুঝতে চায় না,তাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। সে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,’শুভ রাত্রি।’
লিখন পদ্মজার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। তার অশ্রুসজল চাহনি। তবে বুকে প্রশান্তি। জীবনের খরতাপ দহনে মায়াময় পদ্মজার কণ্ঠ,একটু দেওয়া সময় তার বুকে প্রশান্তির ঢেউ তুলেছে। এই…এইটুকু সময়ের স্মৃতি নিয়েই কয়েকটা রাত আরামে ঘুমানো যাবে। সে বিড়বিড় করল,’আমি মানতে পারি না তুমি অন্য কারো। আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
শেষের শব্দ তিনটে ঘোর লাগা কণ্ঠে ভেঙে ভেঙে বলল।
পূর্ণাকে ঘরে এনে পদ্মজা ধমকে বলল,’এই ঠান্ডার মধ্যে সোয়েটার না পরে কীভাবে থাকিস? বাইরে বাতাসও হচ্ছে। আমার কোনো কথাবার্তাই কী শুনবি না?’
পূর্ণা অপরাধী স্বরে বলল,’আর হবে না আপা। আগামীকাল সন্ধ্যার আযানের সাথে সাথে ঘরে চলে আসব।’
‘জি, না। বিকেল থেকেই ঘরে থাকবেন। এমনিতেই এই বাড়ির অবস্থা ভালো না। তুই দুই দিন পর বাড়িতে চলে যাবি।’
‘তুমি যাবে না?’
পদ্মজা আনমনে কিছু ভাবল। তারপর বলল,’যাব। কয়দিন পর। আচ্ছা,শোন রাতে টয়লেটে যেতে ভয় পেলে আমাকে ডাকবি। চেপে রাখবি না।’
‘আচ্ছা।’
পূর্ণা খুক খুক করে কাশতে থাকল। পদ্মজা বিচলিত হয়ে বলল,’কাশিও হয়ে গেছে! কত ঠান্ডা বাঁধিয়েছিস। জ্বরও আছে নাকি দেখি।’
পদ্মজা পূর্ণার কপাল ছুঁয়ে তাপমাত্রা অনুমান করে বলল,’আছেই তো। তুই কী নিজের যত্ন নেয়া শিখবি না? সারাদিন নতুন শাড়ি পরে, সাজগোজ করে ঘুরে বেড়ালেই নিজের যত্ন নেয়া হয়ে যায়? স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে তো।’
পূর্ণা বাধ্য মেয়ের মতো বলল,’আচ্ছা,নেব।’
‘তা তো সবসময় বলিস। তুই বস, আমি কুসুম গরম পানি নিয়ে আসছি। গড়গড়া কুলি করে এরপর ঘুমাবি।’
‘আপা-
‘তুই চুপ থাক। চুপচাপ লেপের ভেতর শুয়ে থাক। আমি আসছি।’
পদ্মজা রান্নাঘরে এসে দেখে বালতিতে পানি নেই। বাড়ির সবাই যার যার ঘরে আছে। হয়তো ঘুমিয়েও গেছে। আমির তো সেই কখন ঘুমিয়েছে। পদ্মজা ছোট বালতি হাতে নিয়ে কলপাড়ে আসে। চারিদিক নির্জন,থমথমে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। পদ্মজা আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে নিল। ঝাপসা আলোয় পুরো বাড়িটাকে রহস্যময় মনে হচ্ছে। যদিও এই বাড়িতে সবসময়ই রহস্য বিদ্যমান! পদ্মজা বালতি রেখে,কল চাপতে যাবে তখনই কানে একটা ঝনঝন শব্দ আসে। স্টিলের কিছু কাছে কোথাও পড়েছে। পদ্মজা থমকে দাঁড়াল। কান খাড়া করে বুঝতে পারল শব্দটা রানির ঘর থেকে আসছে। রানি আপার কোনো বিপদ হলো না তো? পদ্মজা ছুটে আসে রানির ঘরের সামনে। কানে ক্রোধ মেশানো চাপা কণ্ঠ ভেসে আসে,’তোমার লগে কয়বার হুতছি বইললা ভাইবো না সবসময় হুইতে দিয়াম। মাডিতে যেভাবে এতদিন ছিলা,আজও থাকবা। বিছানাত উঠার জন্য গাঁইগুঁই করবা না।’
‘মাডিত অনেক ঠান্ডা লাগে। আমারে এক কোণাত জায়গা দেও।’
‘তুমি মাডিত থাকবা মানে মাডিত থাকবা। কামলা হইয়া মালিকের ছেড়ির লগে হুইবার সাহস আর করবা না।’
‘আমি বিছানাত ঘুমাইয়াম। তুমি আমার বউ লাগো।’
‘তুমি মাডিত ঘুমাইবা। আমি তোমারে জামাই মানি না।’
‘দেহো রানি-
এরপরই একটা আর্তচিৎকার ভেসে আসে। রানি-মদন তর্ক করছে। নিশ্চয় রানি মদনকে ধাক্কা দিয়েছে। আর মদন ব্যথা পেয়েছে। পদ্মজা একবার ভাবল,দরজায় কড়া নাড়বে। এরপর ভাবল,স্বামী-স্ত্রীর অনেক কথা সে শুনে ফেলেছে। আর না শোনাই ভালো। যেহেতু তারা কারো সামনে ঝগড়া করে না,রাতে নিজ ঘরে সবার অগোচরে ঝগড়া করে। তাহলে ব্যপারটা ব্যক্তিগত। পদ্মজা সরে আসে। তবে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। এই দাম্পত্য সংসারে কী ভালোবাসা, সুখ আসবে না? মদন তো দেখতে খারাপ না। শুধু এতিম আর এই বাড়ির একজন বাধ্য ভৃত্য। এ ছাড়া তো ভীষণ সহজ-সরল। সবার সাথে হেসেখেলে কথা বলে। ঠোঁটে হাসি সবসময় থাকে।
লিখন, মৃদুল একই ঘরে একই বিছানায় শুয়েছে। লিখনের জন্য আলাদা ঘর ছিল। কিন্তু সে মৃদুলের সাথেই শুয়েছে। ছেলেটাকে খুব ভালো লেগেছে তার। সোজাসুজি কথা বলে। মনে কিছু চেপে রাখতে পারে না। এতক্ষণ বকবক করেছে। সবেমাত্র অন্যপাশে ফিরে চোখ বুজেছে। বোধহয় ঘুম পেয়েছে। লিখনের মনটা আনচান আনচান করছে। ইচ্ছে হচ্ছে,পদ্মজাকে দেখতে। একসাথে বসে গল্প করতে। কিন্তু এ তো সম্ভব নয়। এই বাড়িতে আর আসা যাবে না। পদ্মজার সামনে এলেই মন বেপরোয়া হয়ে যায়। কত-শত ইচ্ছে জেগে উঠে। লিখনের ব্যাক্তিত্ব ভীষণ শক্ত। শুধু এই একটা জায়গাতেই সে দূর্বল। এভাবে চলতে পারে না। নিজের জায়গায় নিজেকে শক্ত থাকতে হবে। লিখন জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ল। মৃদুল ফিরে তাকাল। বলল,’ভাইয়ের ঘুম পাইতাছে না?’
‘হু। তুমি ঘুমাও।’
মৃদুল মেরুদণ্ড সোজা করে শুয়ে বলল,’আপনি –
‘আপনি না তুমি। একটু আগেই না আমাদের কথা হলো। তুমি আমাকে তুমি বলবে।’
মৃদুল হাসল। বলল,’তুমি যে মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করছো,সে মেয়েটা পদ্মজা ভাবি। তাই না?’
লিখন অপ্রস্তুত হয়ে উঠল। পদ্মজা যে বাড়ির বউ সে বাড়ির আত্মীয়র সাথে এসব নিয়ে কথা বলাটা নিশ্চয় অনুচিত! এতে পদ্মজার অসম্মান হবে। সে তো চায় না,পদ্মজা কষ্ট পাক। তাকে নিয়ে কেউ দুই লাইন বেশি ভাবুক। পদ্মজা সবসময় ভালো থাকুক। লিখন জোরপূর্বক হাসল। তারপর বলল,’কী বলছো! তেমন কিছুই না। ঘুমাও এখন। আমারও অনেক ঘুম পাচ্ছে।’
লিখন অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে পড়ে। মৃদুল হতাশ হয়ে চোখ বুজে।
পদ্মজা অন্ধকারে ধীরে ধীরে হাঁটছে। হাতে কাঁচের গ্লাস। তাতে কুসুম গরম পানি। সিঁড়িতে পা রাখতেই কারো পায়ের আওয়াজ কানে আসে। পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে,আলমগীর চোরের মতো চারপাশ দেখে দেখে সদর দরজার দিকে যাচ্ছে। পদ্মজা দ্রুত সিঁড়ি থেকে নেমে চেয়ারের পিছনে লুকিয়ে পড়ে। গ্লাস রেখে দেয় এক পাশে। তার স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। চোখ দুটি তীক্ষ্ণ হয়ে আলমগীরকে পরখ করছে। আলমগীরের পরনে পাঞ্জাবি। বাড়িতে ভদ্রলোকের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। শান্তশিষ্ট,চুপচাপ। মাঝেমধ্যে ঢাকা যায়। দেখা হয়,তবে কথা হয় না। কিছু প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়। নিজ ইচ্ছায় কথা বলে না। আলমগীর সদর দরজা পেরিয়ে যায়। পদ্মজা সাবধানে আলমগীরের পিছু নেয়। পায়ের জুতাগুলো হাঁটার তালে মৃদু শব্দ তুলছে। তাই পদ্মজা জুতাজোড়া খুলে দরজার পাশে রেখে দিল। আলমগীর অন্দরমহলের ডান দিকে এগোচ্ছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক চারিদিকে। দূরে কোথাও শেয়াল ডাকছে। গা ছমছমে পরিবেশ। এদিকওদিক কোনো মৃদু শব্দ হতেই পদ্মজা উৎকর্ণ হয়ে উঠছে। কেমন গা কাটা দিচ্ছে। এতো রাতে দীর্ঘদেহী এই লোক যাচ্ছে কোথায়? হাঁটতে হাঁটতে তারা বাড়ির পিছনে চলে আসে। আলমগীর অন্দরমহলের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। মনে হচ্ছে এটাই তার গন্তব্য। পদ্মজা কলাগাছের পিছনে লুকিয়ে পড়ে। বাতাসে গা কাঁপুনি দিচ্ছে। আলমগীর টর্চ জ্বালিয়ে চারপাশ দেখে নিল। তারপর মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ করল। মনে হচ্ছে,কাউকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। পদ্মজার রগে রগে দামামা শুরু হয়। কী হতে চলেছে? আজ সে কী দেখবে?
পূর্ণা বিরক্ত হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে। এতক্ষণ হয়ে গেল তার আপা আসছে না কেন? সে জুতা পরে বেরিয়ে আসে। নেমে আসে নিচ তলায়। রান্নাঘরে যাওয়ার পথে পায়ে কাঁচের গ্লাস লেগে পড়ে যায়। পূর্ণা ভয় পেয়ে যায়। এখানে গ্লাস কে রাখল! আংশিক পানি তার পায়ে লাগে। মনে হচ্ছে, পানিটা গরম। এই রাতের বেলা গরম পানি এখানে…কীভাবে? পূর্ণা ভাবে, তার আপার পানি গরম করার কথা ছিল। কিন্তু গরম করে এখানে কেন রাখবে? ঘরে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। পূর্ণা রান্নাঘরে এসে দেখে পদ্মজা নেই। সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। দরজার পাশে পদ্মজার জুতা দেখে ভয়টা আরো বেড়ে যায়। সে দৌড়ে আমিরের ঘরে গেল। গিয়ে দেখল,আমির ঘুমাচ্ছে। পদ্মজা নেই। পূর্ণা এবার ঘামতে থাকল। সে শুনেছে,এই বাড়িতে ভূত-জ্বীন আছে। এরা মানুষের ক্ষতি করে। বিশেষ করে সুন্দর মানুষদের। তার মানে তার আপার গুরুতর বিপদ! পূর্ণা এক দৌড়ে রান্নাঘরে আসে। লণ্ঠন জ্বালিয়ে নেয়। অন্যসময় হলে ভয় কাজ করত। আজ করছে না। সে তার আপাকে জান দিয়ে হলেও বাঁচাবে। মনে হয়,কোনো শয়তান জ্বীন তার বোনকে ধরেছে এবং পুকুরপাড়ে নিয়ে গেছে। পূর্ণা ঝটপট বেরিয়ে পড়ে। কাউকে ডাকার বুদ্ধি অবধি মাথায় আসেনি। সে আতঙ্কে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। আয়তুল কুরসি পড়তে পড়তে পুকুরপাড়ের পথ ধরে।
পদ্মজাকে চমকে দিয়ে তৃতীয় তলার একটা জানালা হাট করে খুলে যায়। সেখান থেকে একটা মোটা দড়ি আলমগীরের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। পদ্মজার ওষ্ঠদ্বয় নিজেদের শক্তিতে আলাদা হয়ে যায়। দুই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। আলমগীর সেই দড়ি বেয়ে তৃতীয় তলায় উঠে যায়। দড়ি বেয়ে উপরে উঠার দ্রুততা দেখে মনে হলো,এর আগে বহুবার আলমগীর দড়ি বেয়ে উপরে উঠেছে। পদ্মজার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ে। জানালা দিয়ে আলমগীর কার ঘরে গিয়েছে? তৃতীয় তলায় সে একবার গিয়েছে তাই জানেও না কোন ঘরে কী আছে। পায়ের গোড়ালিতে ঠান্ডা শিরশিরে অনুভব হচ্ছে। পদ্মজা এক হাত দিয়ে ছুঁতেই বুঝতে পারে জোঁকে ধরেছে। জোঁকে তার খুব ভয় আছে। কিন্তু এখন ভয় করছে না। এখন তার স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে আছে অন্যকাজে। সে জোঁক ছাড়িয়ে নিল। অনেকক্ষণ পার হয়ে যায় আলমগীরের দেখা নেই। দড়ি তো ঝুলছে। মানে নামবে আবার। পদ্মজা কোমরে এক হাত রেখে তাকিয়ে রইল। আচমকা মনে পড়ে,তৃতীয় তলায় রুম্পা আছে। ডান দিকের কোনো এক ঘরে। আর আলমগীর ডান দিকের কোনো ঘরের জানালা দিয়েই ঢুকেছে। মানে কী রুম্পার কাছে গিয়েছে? পদ্মজা বারংবার শুধু চমকাচ্ছে। আলমগীর দড়ি বেয়ে নেমে পড়ে। তারপর ইশারায় অন্য কাউকে নামতে বলে। কাঙ্ক্ষিত সেই মুখটি দেখে পদ্মজার পিল চমকে উঠে। রূম্পা! শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে দড়ি বেয়ে নামছে। বার বার দড়ি থেকে হাত ছুটে যাচ্ছে। আলমগীর দুই হাত বাড়িয়ে রেখেছেন যাতে রুম্পা পড়ে গেলে তিনি ধরতে পারেন। পদ্মজার বুক দুরুদুরু করছে,যদি রুম্পা পড়ে যায়! এতো ঝুঁকি কেন নিয়েছে?
রুম্পার পা মাটিতে পড়তেই আলমগীর শক্ত করে রুম্পাকে জড়িয়ে ধরে। রুম্পার কান্নার সুর ভেসে আসে। তাৎক্ষণিক আলমগীর রুম্পার মুখ চেপে ধরে কিছু বলল। তারপর টর্চের আলো দিয়ে চারপাশ দেখে, রুম্পাকে এক হাতে শক্ত করে ধরে হাঁটা শুরু করল। তখন কোথেকে উদয় হয় একজন অদ্ভুত লোকের। লোকটা কালো,মোটা,লম্বা চুল। এক হাতে রাম দা, অন্য হাতে লাঠি। অজানা বিপদের আশঙ্কা পেয়ে পদ্মজার ভয় হলো। পা থেকে কিছুটা দূরে থাকা কয়েকটা পাথরের মধ্যে বড়সড় দেখে একটা পাথর হাতে নিল। যেন বিপদে কাজে লাগানো যায়। আলমগীর আর অজ্ঞাত লোকটির মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়। একসময় তা হাতাহাতিতে চলে যায়। রুম্পা ভয়ে জুবুথুবু হয়ে গেছে। অজ্ঞাত লোকটি রুম্পাকে ধরতে চাইছে। কিন্তু আলমগীর তা হতে দিচ্ছে না। পদ্মজার মনে হচ্ছে,এখন তার সামনে যাওয়া উচিত। আল্লাহর নাম নিয়ে সে কলাগাছের পেছন থেকে বেরিয়ে আসে। আলমগীর অজ্ঞাত লোকটির হাত থেকে রামদা নিয়ে দূরে ফেলে দিল। তখনই সে পদ্মজাকে দেখতে পেল। চেঁচিয়ে উঠে বলল,’বোন,সাহায্য করো।’
অজ্ঞাত লোকটি পদ্মজাকে দেখে আরো বেশি হিংস্র হয়ে উঠল। সে ছুটে এসে ছোঁ মেরে রুম্পাকে ধরতে চাইল। আলমগীর অজ্ঞাত লোকটির ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুই হাতে ঝাপটে ধরে রেখে রুম্পাকে বলে,’তুমি যাও রুম্পা।’
রুম্পা দৌড়ে পদ্মজার কাছে আসে। সে হাঁপড়ের মতো হাঁপাচ্ছে। ভয়ে ঘামছে। আলমগীর অজ্ঞাত লোকটিকে আটকে রাখতে পারছে না। সে অনেক কষ্টে অনুরোধ করে,’আমার রুম্পারে ওরা মেরে ফেলবে। তুমি ওরে খালপাড়ে নিয়ে যাও বোন। আমি আজীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকব।’
পদ্মজা দুই হাতে আঁকড়ে ধরে রুম্পাকে। আলমগীরের হাত থেকে পড়ে যাওয়া টর্চের আলো অজ্ঞাত লোকটির মুখে পড়তেই পদ্মজার খুব চেনা মনে হয়। আবার পারিজার খুনির বর্ণনাও ঠিক এমনই। ভাবতেই, পদ্মজার রক্ত ছলকে উঠে। সেই মুহূর্তে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভাব ঘটে পূর্ণার। সে পুকুরপাড়ে যাচ্ছিল। টর্চের আলো পেয়ে সে এদিকে ছুটে এসেছে। অজ্ঞাত লোকটি রুম্পার উদ্দেশ্যে হাতের লাঠি ছুঁড়ে মারে। পদ্মজা দ্রুত রুম্পাকে নিয়ে সরে যায়। লাঠি গিয়ে সোজা পূর্ণার কাঁধে পড়ে। সে আপা বলে আর্তনাদ করে বসে পড়ে। পদ্মজা দিকদিশা হারিয়ে ফেলে। কী করবে সে? মনে হচ্ছে রুম্পাকে কেউ খুন করতে চাইছে তাই আলমগীর তাকে নিয়ে পালাচ্ছে। আর এই নাম না জানা লোক,রুম্পাকে আঘাত করতে চাইছে। আবার পূর্ণাও আঘাত পেয়েছে। কী করবে পদ্মজা? রুম্পাকে নিয়ে খালের দিকে যাবে? পূর্ণাকে এই ভয়ংকর পরিবেশ থেকে নিরাপদে নিয়ে যাবে? নাকি পারিজার খুনিকে ধরবে?
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ
আমি পদ্মজা – ৫৪
___________
থেকে থেকে দূরে হুতুম প্যাঁচা ডাকছে। যা ভুতুড়ে শোনাচ্ছে। গা কাঁপুনি ঠান্ডা। সময়টা যেন থমকে দাঁড়িয়ে চড়ছে দণ্ড শূলে। পদ্মজা ছুটে আসে পূর্ণার কাছে। পূর্ণা উবু হয়ে শুয়ে পড়েছে। কাঁদছে মা,মা করে। পদ্মজা এক হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে রুম্পাকে। আরেক হাতে পূর্ণার কাঁধে ছুঁয়ে দেখল কোথায় আঘাত পেয়েছে। ঠান্ডায় তার ঠোঁট কাঁপছে। কানে ভেসে আসছে দুজন পুরুষের ধস্তাধস্তির দুপদাপ শব্দ। পদ্মজার ঠান্ডা হাতে পূর্ণার আহত স্থানের রক্ত লাগতেই সে আঁতকে উঠল। রুম্পাকে ছেড়ে পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরল। পাশে তাকিয়ে দেখল,যে লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে সে লাঠির আগায় কাঁচি বাঁধা। পূর্ণার ঘাড়ের চামড়া ছিঁড়ে গেছে। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পূর্ণার পুরো শরীর। আলমগীর অজ্ঞাত লোকটির সাথে আর পারছে না। সে আকুতি, মিনতি করে পদ্মজাকে বলছে,’পদ্মজা,পদ্মজা, বোন সহায় হও।’
টানাপোড়নে পদ্মজার হাত পা কাঁপতে থাকল। সে পূর্ণাকে টেনে তোলার চেষ্টা করল। পূর্ণা কিছুতেই উঠতে পারছে না। যন্ত্রনায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে সে। পূর্ণার কান্না দেখে পদ্মজার বুক ব্যথায় বিষে যাচ্ছে। এই রাত, রাতের আঁধার এতো পাষাণ কেন হলো! আলমগীরের আর্তনাদ ভেসে আসে। পদ্মজা চমকে ফিরে তাকাল। অজ্ঞাত লোকটি আলমগীরের স্পর্শকাতর স্থানে অস্বাভাবিকভাবে আঘাত করেছে। ফলে সে দূর্বল হয়ে আর্তনাদ করে উবু হয়ে ছটফট করছে। অজ্ঞাত লোকটি দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে ছুটে এসে রুম্পাকে ধরতে চাইল। পদ্মজা বাধা হয়ে দাঁড়াল। অজ্ঞাত লোকটি কর্কশ কণ্ঠে পদ্মজাকে হুংকার দিল,’আমার কাম আমারে করতে দে।’
একটা মানুষের কণ্ঠস্বর এতো ভয়ংকর কী করে হয়! এই কণ্ঠস্বর যে কাউকে কাঁপিয়ে তুলবে। পদ্মজা কিঞ্চিৎ চমকালেও থেমে থাকল না। উত্তরে হাওয়ায় তার চুল এলোমেলো হয়ে উড়ছে। সে অজ্ঞাত লোকটির মতোই হুংকার দিয়ে বলল,’নিজের ভালো চান তো আত্মসমর্পণ করুন।।
পদ্মজার কথা শুনে লোকটি ব্যঙ্গ করে হাসল। খুব কাছ থেকে অজ্ঞাত লোকটির মুখ দেখে পদ্মজা কপাল কুঁচকে ফেলল। লোকটির মুখ থেকে বিশ্রি একটা দূর্গন্ধ আসছে। স্বাস্থ্যবান দেহ,গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। সাদা দাঁতকপাটি আর লাল ভয়ংকর চোখ দুটিই আগে নজর কাড়ছে। পদ্মজা কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই অজ্ঞাত লোকটি পদ্মজাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। এরপর লাঠি হাতে তুলে নিল। রুম্পা ছুটে পালাতে চাইল। কিন্তু পারল না। অজ্ঞাত লোকটি তার গলা চেপে ধরল।
পদ্মজা দৌড়ে এসে অজ্ঞাত লোকটির পিঠে কিল ঘুষি দিল। তাও কাজ হলো না। পদ্মজার গায়ের শক্তি লোকটিকে এক চুলও নাড়াতে পারেনি। রুম্পা গোঙাচ্ছে। পূর্ণা যন্ত্রনায় কাঁদছে,ভয়ে জুবুথুবু হয়ে আছে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। নিশাচর পাখিরা আজ যেন অদ্ভুত স্বরে ডাকাডাকি করছে। কেমন গা কাঁপিয়ে তোলা! ঝিঁঝিঁপোকাদের ডাক বেড়েছে,কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে বাতাসের বেগ।
অজ্ঞাত লোকটির হিংস্র থাবা রুম্পাকে গ্রাস করে নিয়েছে। লোকটি পা দিয়ে মাটি থেকে লাঠি তুলল। তারপর লাঠির আগা থেকে কাঁচি হাতে নিল।
আর একটু ক্ষণ তাহলেই সেই ধারালো কাঁচি রুম্পার গলার রগ টেনে নিবে। উড়ে যাবে রুম্পার রুহ। আলমগীর নিজের যন্ত্রণা ভুলে ছুটে আসে তার সহধর্মিণীর প্রাণ বাঁচাতে। তার আগেই ঘটে যায় ভয়ংকর এক দৃশ্য। পদ্মজা অজ্ঞাত লোকটির পড়ে থাকা রামদা তুলে তার পিঠেই কোপ বসিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞাত লোকটি লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। ফলে রাম দা আরো গভীরে প্রবেশ করে। গরু জবাইয়ের পর গরু যেভাবে কাতরায় অজ্ঞাত লোকটি সেভাবে কাতরাতে থাকল। রক্ত ছিটকে পড়ে পদ্মজার শাড়িতে,মুখমণ্ডলে। কাতরাতে থাকা দেহটি ডিঙিয়ে আলমগীর রুম্পার কাছে যায়। তারপর পদ্মজার দিকে তাকাল। পদ্মজার বুক হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে। চোখে যেন ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যায় দেহটি। নিস্তেজ হয়ে পড়ে পদ্মজাও। সে এলোমেলো পায়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। তার শরীর কিঞ্চিৎ কাঁপছে। এটা সে কী করেছে! এ যে অচিন্তনীয় কাজ! সব এলোমেলো লাগছে। মাথা ভনভন করে ঘুরছে। গা গুলিয়ে উঠছে।
পূর্ণা এই দৃশ্য দেখে নিজের রক্তক্ষরণ ভুলে যায়। ভয়ে কাঁপতে থাকে। নাভি উল্টে বমি বেরিয়ে আসে। আলমগীর তাড়াহুড়ো করে পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়াল। পদ্মজার বুকে বইছে অপ্রতিরোধ্য তুফান! সে নিষকম্প চোখে তাকিয়ে আছে নিথর দেহটির দিকে। আলমগীর একটা চাবি পদ্মজার হাতে গুঁজে দিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলল,’ভয় পেয়ো না। এই বাড়িতে দিন দুপুরে খুন হলেও তা বাইরের কেউ জানবে না। সকালে উঠে দেখবে এখানে বাবলুর লাশও নেই রক্তও নেই। কেউ না কেউ সরিয়ে দিবে। সব দুঃস্বপ্ন মনে হবে। দ্রুত ঘরে ফিরে যাও। আমার অনেক কথা বলার আছে। আমি চিঠি লিখব। তোমার বাপের বাড়ির ঠিকানায়। আসছি।’
রুম্পা দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরল। তার বুকটা হাহাকার করছে। পদ্মজার কথা খুব মনে পড়বে। আলমগীর অস্থির হয়ে চারিদিক দেখছে। আতঙ্কে সে কাঁপছে। এই বুঝি কেউ এসে গেলো। আর রুম্পাকে আবার বন্দি করে দিল। এমন অশান্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। আতঙ্কে যেকোনো মুহূর্তে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। রুম্পা পদ্মজাকে কিছু বলতে চেয়েছিল,আলমগীর বলতে দিল না। তার আগেই টেনে নিয়ে দৌড়াতে থাকল। পদ্মজা তাদের যাওয়ার পানে চেয়ে থাকল। ঝিঁঝিঁপোকাদের আলোর ভীড়ে দুজন হারিয়ে যাচ্ছে। তারা বাঁচার আশায় দৌড়াচ্ছে। না হওয়া সংসার পাতার স্বপ পূরণ করতে দৌড়াচ্ছে। দুজন আড়াল হয়ে যেতেই পদ্মজা দুই হাতে নিজের মুখ ছুঁলো। এরপর দুই হাত সামনে এনে দেখল,টকটকে লাল রক্ত। সঙ্গে সঙ্গে সে বমি করতে থাকল। তারপরপরই সম্বিৎ ফিরল। সে পূর্ণাকে খুঁজতে থাকল। একটু দূরে পূর্ণা ঘাসের উপর নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। পদ্মজা দৌড়ে আসে। পূর্ণা পিটপিট করে তাকায়। পূর্ণাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। একুশ বছর বয়সী একটা মেয়ের শরীর তো কম ভারি নয়। পদ্মজার শক্তিতে কুলোচ্ছে না। সে পূর্ণাকে আকুতি করে বলল,’উঠার চেষ্টা কর বোন।’
পূর্ণার শরীরে ভূমিকম্প বয়ে যাচ্ছে। সে পুরো ভর পদ্মজার উপর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। পদ্মজা শরীরের পুরোটা শক্তি দিয়ে পূর্ণাকে আগলে ধরে সামনে হাঁটা শুরু করে। পদ্মজার পা জোড়া ঠকঠক করে কাঁপছে। সে জানে না এটা শীতের কাঁপুনি নাকি ভয়ংকর কোনো কিছুর প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার উত্তেজনা। মনে হচ্ছে যেন ভয়ংকর একটা ঝড় হুট করে শুরু হয়ে হুট করে থেমে গেছে। আর রেখে গেছে নিঃশ্বাস থামিয়ে দেওয়া নিস্তব্ধতা। পদ্মজা ঘামছে, কাঁপছে। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। মনে হচ্ছে,এই বুঝি মৃত বাবলু উঠে দাঁড়াল। অনেক অনেক প্রেতাত্মা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল দুই বোনের উপর!
জঙ্গলের গাছপালা থেকে প্যাঁচাদের দল তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে,সদ্য খুন হওয়া একটা মৃত দেহ পড়ে আছে ঘাসের উপর। আরেকটু দূরে ছিমছাম গঠনের শাড়ি পরা একটা মেয়ে চুল খোলা রেখে এলোমেলো পায়ে আরেকটা দূর্বল দেহকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির ভেতর! দুজনের গায়ে তাজা লাল রক্ত। এই দৃশ্য তো রাতের আঁধারের চেয়েও ভয়ংকর! যার স্বাক্ষী হয়ে রইল রাতের আঁধার আর নিশাচর পাখিরা।
প্রতিদিনের মতোই ভোরের আলো নিকষকালো রাতকে ঠেলে দূরে সরিয়ে পৃথিবীটাকে আলোকিত করে তুলেছে। পাখিরা কিচিরমিচির করে ডাকছে। নতুন করে শুরু হয়েছে আরেকটা দিন। শুধু পদ্মজার সময়টা থমকে গেছে। সে তার গোসলখানায় বসে আছে। কনকনে ঠান্ডায় গোসল করেছে। এরপর থেকেই উদাসীন হয়ে ভেজাকাপড়ে বসে আছে। পূর্ণা অন্য ঘরে ঘুমাচ্ছে। পদ্মজা রাতে ধীরেসুস্থে পূর্ণার ক্ষত সামলেছে। বুঝতে দেয়নি,সে মনে মনে কতোটা ভেঙে পড়েছে। যখন রাতে তারা দুই বোন দুই তলায় উঠছিল,তখন পিছনে কেউ যেন ছিল! এতো চিৎকার, চেঁচামিচি হয়েছে আর কেউ শুনেনি? অন্দরমহলের রিদওয়ান এবং মজিদের ঘরের মানুষদের তো শোনার কথা ছিল। কারণ তাদের ঘর ডান দিকে,আর ডান দিকেই এতো বড় ঘটনাটি ঘটে গিয়েছে। পূর্ণা জোরে জোরে কেঁদেছে,আলমগীর চেঁচিয়েছে। বাবলু নামের সেই লোকটি খুন হওয়ার সময় আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করেছিল। দুপদাপ শব্দ তুলে কাতরেছিল। তবুও কেউ আসেনি! কেন? তার কেন মনে হচ্ছে,সবাই শুনেছে কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। পদ্মজার চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসে। সবকিছু কেমন ওলটপালট লাগছে। কাউকে খুন করার মতো সাহস কী করে হলো? এ কী মা হেমলতার গুণ! পদ্মজা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। চোখ পড়ে আলমগীরের দেয়া চাবিটার দিকে। চাবিটা দেখতে অনেক বড়। সে অপলক চোখে চাবির দিকে তাকিয়ে থাকল।
আমির ঘুম থেকে উঠে পদ্মজাকে দেখতে না পেয়ে গোসলখানায় উঁকি দিয়ে পদ্মজাকে দেখে সে চমকে উঠল। পদ্মজার শাড়ি হাঁটু অবধি তোলা। আঁচল বুকে নেই। চুল এলোমেলো। গায়ের রঙ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। থেমে থেমে কাঁপছে। তাতেও পদ্মজার ভ্রুক্ষেপ নেই। আমির হন্তদন্ত হয়ে গোসলখানায় প্রবেশ করল। পদ্মজার দুই বাহু দুই হাতে চেপে ধরে উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল, ‘পদ্মবতী, কী হয়েছে? এ কী অবস্থা তোমার।’
পদ্মজা কিছু বলল না। সে আমিরের চোখের দিকে নিজের চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখল। আমির দ্বিগুণ বিচলিত হয়ে বলল,’এই পদ্ম, তুমি কাঁপছো তো। কী হয়েছে?’
পদ্মজার ঠোঁট দুটি ভেঙ্গে আসে। আর চোখ ছাপিয়ে জল। আমির অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। পদ্মজা আচমকা আমিরকে জড়িয়ে ধরল। আমিরের পুরো শরীর মুহূর্তে ঠান্ডা বরফ হয়ে যায়। পদ্মজা বাঁধভাঙা নদীর মতো হু হু করে কাঁদতে থাকল। আমির শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,’বলো না কী হয়েছে? আমার চিন্তা হচ্ছে।’
পদ্মজা আরো শক্ত করে আমিরকে জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,’আমি…আমি খ..খুন করেছি।’
‘কী…কী বলছো! এই পদ্মজা।’
পদ্মজা আমিরের পিঠ খামচে ধরে বলল,’আ…আমি..এটা কেমনে করলাম!’
আমির পদ্মজাকে নিজের সামনাসামনি বসিয়ে বলল,’আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। সব বলো না আমাকে! কান্না থামাও।’
পদ্মজা মেঝেতে দৃষ্টি রেখে ফোঁপাতে ফোঁপাতে পুরো ঘটনাটা বলল। সে নিজের কাজে নিজে অবাক। আমির পদ্মজাকে শান্ত করার জন্য বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,’কিছু হয়নি। শান্ত হও। কান্না থামাও।’
পদ্মজার কান্না থামে। সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। তার মাথা কাজ করছে না। মস্তিষ্ক শূন্যের কোঠায়। আমির তা বেশ বুঝতে পেরেছে। আলমারি থেকে শাড়ি,ব্লাউজ নিয়ে আসল। নিজে পদ্মজাকে পরিয়ে দিল। পদ্মজার পুরো শরীর যেন শরীর না, বরফ। এতোই ঠান্ডা! আমির পদ্মজার চুল মুছে দিয়ে বলল,’ঘরে চলো। না, থাক। আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
পদ্মজা তরঙ্গহীন স্বরে বলল,’তোমার ঘাড়ে টান পড়বে। আমি যেতে পারব।’
আমির পদ্মজাকে ধরে ধরে নিয়ে আসে। পদ্মজাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে লেপ জড়িয়ে দিল গায়ে। তারপর বলল,’আমি থাকতে তোমার কিছু হবে না। ডান দিকে তো?’
পদ্মজা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। আমির সোয়েটার পরে বেরিয়ে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে বলল,’কই কোথাও তো কিছু পাইনি।’
পদ্মজা চমকে গেল। দ্রুত উঠে বসল। তারপর চোখ বড়বড় করে জানতে চাইল,’লাশ বা রক্ত কিছুই নেই?’
আমির নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,’না তো। তুমি রাতে স্বপ্ন দেখেছো বোধহয়।’
পদ্মজা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। অস্থির হয়ে পড়ে। এটা কী করে সম্ভব! এই কাকডাকা ভোরে লাশ থাকবে না কেন! আলমগীরের বলা কথাগুলো মনে পড়তেই পদ্মজা সব বুঝতে পারে। ধীরে ধীরে আবার শুয়ে পড়ে। চোখ বুজে। তার ঠোঁট দুটি তিরতির করে কাঁপছে!
চলবে….
®ইলমা বেহরোজ
আমি পদ্মজা – ৫৫
_________________
অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা তার ঝাঁপি থেকে অন্ধকার নিয়ে এসে ঝপ করে রাত নামিয়ে দিল। বিদ্যুৎও চলে গেল। পদ্মজা হারিকেন জ্বালিয়ে প্রেমার ঘরে এলো। প্রেমা পড়ছিল। পূর্ণা শুয়ে আছে। পদ্মজাকে দেখে প্রেমা এগিয়ে এসে হারিকেন নিল। এরপর বলল,’আপা সন্ধ্যার নামায পড়েনি।’
‘তুই পড়। আমি দেখছি।’
পদ্মজা পূর্ণার শিয়রে বসে কাশি দিল,পূর্ণার মনোযোগ পেতে। পূর্ণার সাড়া পাওয়া যায়নি। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সেদিনের ঘটনার ছয় দিন কেটে গেছে। পূর্ণার স্বাভাবিক হতে দুইদিন লেগেছিল। দুইদিন ঘর থেকে বের হয়নি। কিন্তু কাঁধের ক্ষতটা শীতের কারণে পেকেছে। খুব জ্বালাতন করে। আপা,আপা করে কাঁদে। পদ্মজার ভালো লাগে না সেই কান্না শুনতে। কষ্ট হয়। পদ্মজার বুক ভারি হয়ে আসে। পূর্ণার গায়ে লেপ জড়িয়ে দিল। তারপর পূর্ণার মাথায় কিছুক্ষণ বিলি কেটে দিয়ে প্রেমাকে প্রশ্ন করল,’ প্রান্ত কোথায়?’
‘লাহাড়ি ঘরে।’
‘কী করে ওখানে?’
‘কী হিবিজিবি বানায়। বিজ্ঞানী হয়ে যাবে দেখো।’
‘মজা করে বলছিস কেন? হিবিজিবি বানাতে বানাতেই একদিন চমকে দেয়ার মতো কিছু বানিয়ে ফেলবে। বিরক্ত করিস না। ওকে ওর মতো সময় কাটাতে দিস।’
‘কে যায় ওরে বিরক্ত করতে। আমি আমার পড়া নিয়েই আছি।’ কথা শেষ করেই প্রেমা পড়ায় মনোযোগ দিল। পদ্মজা মুচকি হাসল। প্রেমাকে খুব ভালো লাগে তার। মেয়েটা লাজুক না শুধু,ভীষণ বুদ্ধিমতীও বটে। চাল চলন আকর্ষণ করার মতো।
বাসন্তী এই রাতের বেলা হারিকেন জ্বালিয়ে কাঁথা সেলাই করছেন। পদ্মজা রাগী স্বরে বলার চেষ্টা করল,’রাতের বেলা কী করছেন আপনি? বিশ্রাম নিন এখন।’
বাসন্তী পদ্মজার দিকে চেয়ে হাসলেন। বললেন,’কিছুক্ষণ আগেই তো সন্ধ্যা হলো।’
‘সারাদিন কাজ করেন। এখনও করবেন? বিকেলে এতোসব রান্নাও করলেন। যতদিন গ্রামে আছি আমি এই সেলাই-টেলাই যেন আর না দেখি।’
বাসন্তীকে আর কিছু বলতে না দিয়ে পদ্মজা কাঁথা কেড়ে নিল। বাসন্তীর কোনো কথা শুনেনি। আলমারির ভেতর কাঁথা,সুতা,সুঁই রেখে বলল,’যতদিন আছি আমি এগুলো বের করতে যেন না দেখি। বুঝছেন?’
‘আমার কী আর কিছু বলার আছে?’
পদ্মজা হেসে ফেলল। সাথে বাসন্তীও। আমিরের আগমন ঘটে তখনি। পরনে বেশ দামী জ্যাকেট। পায়ে বুট। সে বাইরে গিয়েছিল,হেমলতার মিলাদের ব্যবস্থা করতে। পদ্মজা এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল,’সব ঠিক হয়েছে? আর একদিন পরেই কিন্তু-
‘কোনো চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে গেছে। পেটে ইদুর দৌড়াচ্ছে। খেতে দাও।’
বাসন্তী বিছানা থেকে দ্রুত নামলেন,’দিতেছি বাবা।’
‘আমি যাচ্ছি তো।’ বলল পদ্মজা।
‘তুমি জামাইকে নিয়ে কলপাড়ে যাও। দেখ, জুতায় কাদা লাগিয়ে আসছে।’
সাথে সাথে পদ্মজা আমিরের পায়ের দিকে তাকাল। আমিরও তাকাল। পদ্মজা আক্ষেপের সুরে বলল,’এতো কাদা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন কেন!’
আমির তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল। অপরাধী স্বরে বলল,’দুঃখিত আমি।’
‘আসুন কলপাড়ে।’
কুয়াশায় চারিদিক ঝাপসা হয়ে আছে। কুয়াশার স্তর এতোই ঘন যে পাঁচ-ছয় ফুট দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। পদ্মজা কল চাপছে, আমির জুতা থেকে কাদা ধুয়ে ফেলছে। কলের পানি কুসুম গরম। শীতের সময় কল থেকে গরম পানি আসার ব্যাপারটা দারুণ। আমির বলল,’পূর্ণা কী ঘুমিয়ে গেছে?’
‘হু।’
‘হু,ঘুমাবেই তো। প্রতিদিন সন্ধ্যার আযান পড়তেই ঘুমিয়ে পড়ে। আর ফজরের আযানের আগ থেকে উঠে পকপক শুরু করে। ঘুমাতে পারি না।’
পদ্মজা শব্দ করে হাসল। বলল,’ঠিকই তো করে। ফজরে কীসের ঘুম?’
‘বোনের পক্ষই তো নিবে।’
ক্ষণকাল পিনপতন নিরবতা। আমিরের জুতা ধোয়া শেষ। পদ্মজা শুকনো কণ্ঠে বলল,’ওই বাড়ির মানুষদের আসতে বলেছেন?’
ওই বাড়ির নাম উঠতেই আমির জ্বলে উঠল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,’ওই বাড়ির নাম নিতে নিষেধ করেছি।’
‘তবুও-
‘না বলিনি। আর বলবও না।’
আমির পায়ে গটগট শব্দ তুলে চলে যায়। পদ্মজা আমিরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকল। সে রাতের পর ওই বাড়িতে তারা তিন দিন ছিল। তারপরই আমির চাপ দিতে থাকে,ওই বাড়ি ছাড়তে। সে সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকে। এভাবে আতঙ্ক নিয়ে বাঁচা যায় না। আমির রাতে ঘুমায় না, ছটফট করে। এই বুঝি পদ্মজার কিছু হয়ে গেল। পদ্মজা খেয়াল করেছে, আমির রাতে কপালের উপর হাত রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকে। তাছাড়া এইভাবে লাশ অদৃশ্য হয়ে গেল। পর পর তিন দিন কেটে যায় তবুও কেউ কিছু বলেনি। কারো মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। ব্যাপারটা ভয়ংকর। পূর্ণার ওখানে থাকা বিপদজনক। সে বিপদকে ভয় পায় না। কিন্তু পূর্ণার কিছু হলে সে মানতে পারবে না। আবার পূর্ণা একা এই বাড়িতে আসবে না। তাই বাধ্য হয়ে তিনজন একসাথে চলে এসেছে। তবে পদ্মজা আবার যাবে ওই বাড়িতে। যেতে তাকে হবেই। হাওলাদার বাড়ির প্রতিটি কোণার রহস্য সে নিজের নখদর্পণে আনবেই। এটা তার শপথ।
অনেক রাত হয়েছে। রাতের খাবারের সময় পূর্ণাকে ডেকে তোলা হয়। একবার ঘুম ভেঙে গেলে পূর্ণা আর ঘুমাতে পারে না। ঘন্টার পর ঘন্টা পার হয়ে যায়। প্রেমা এখনও পড়ছে। পূর্ণা বিরক্তি নিয়ে প্রেমার দিকে তাকাল। মনে মনে বলে,এই মেয়ে কী বিশ্ব জয় করে ফেলবে পড়ে? এতো তো আপাও পড়েনি।
‘বাত্তিডা নিভিয়ে এসে ঘুমা। অনেক পড়ছস।’ কিড়মিড় করে বলল পূর্ণা।
প্রেমা গুরুজনদের মতো করে বলল,’বাত্তিডা না বাতিটা হবে।’
‘থাপ্পড় দিয়ে দাঁত গাছে তুলে দেব, আমাকে কিছু শেখাতে আসলে।’
প্রেমার মুখে আঁধার নেমে আসে। সে থমথমে মুখ নিয়ে বই বন্ধ করে। ঝিম মেরে বসে থাকে। পূর্ণা সন্তুষ্ট হয়ে বলে,’এবার হারিকেনের আগুন নিভা। এরপর শুয়ে পড়।’
প্রেমা হারিকেনের আগুন নিভাতে প্রস্তুত হতেই,পূর্ণা বলল,’না,থাক নিভাতে হবে না। ভয় করে। তুই শুয়ে পড়।’
প্রেমা বাধ্যের মতো এসে শুয়ে পড়ে। লেপের ভেতর ঢুকে। তার ঠান্ডা পা জোড়া পূর্ণার পায়ে লাগতেই,পূর্ণা হইহই করে উঠে,’ও মাগো কী ঠান্ডা! দূরে যা।’
প্রেমা রাগী চোখে তাকাল। পূর্ণা ধমক দিয়ে বলল,’কি হইছে? এমনে তাকাস কেন? খেয়ে ফেলবি?’
পূর্ণার সাথে কথা বলে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারতে ইচ্ছে হচ্ছে না প্রেমার। পূর্ণার কথাবার্তাকে পাত্তা দিলে প্রেমার ঘুম নষ্ট হবে,সকালে উঠে নামায পড়াও হবে না,বই পড়াও হবে না। এটা ভেবে প্রেমা পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও যায়। পূর্ণা মাথা তুলে দেখে প্রেমা ঘুমালো নাকি। যখন বুঝলো ঘুমিয়ে গেছে,তখন লেপ দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিল প্রেমাকে। এরপর জড়িয়ে ধরল। যেন দ্রুত প্রেমার ঠান্ডা শরীর গরম হয়ে আসে। এই বোনটাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। খুব বেশি। শুধু ভালোবাসাটা প্রকাশ করতে পারে না কেন জানি! প্রেমার ঘুম খুব পাতলা। পূর্ণা তাকে জড়িয়ে ধরতেই তার ঘুম ছুটে যায়। ঠোঁটে ফুটে উঠে মুচকি হাসি। প্রায় এরকম হয়। সে ঘুমালে পূর্ণা তার কপালে চুমু দেয়,চুলে বিলি কেটে দেয়। হাত-পায়ের নখ কেটে দেয়। ভালোবাসার অনেক রূপ হয়! তেমনি এই দুই বোনের ভালোবাসাটা অন্যরকম। লুকিয়ে একজন আরেকজনকে ভালোবাসে। প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। দুজনই টের পায়। কিন্ত প্রকাশ্যে সাপে-নেউলে যুদ্ধ চলে!
পূর্ণার কিছুতেই ঘুম আসছে না। হারিকেনের আলো নিভু,নিভু। পূর্ণা উঠে বসে। আবার শুয়ে পড়ে। নিভু, নিভু আলোর দিকে চেয়ে মৃদুলের কথা ভাবে। মানুষটার কথা ইদানীং উঠতে বসতে মনে পড়ে তার। কাঁধে আঘাত পাওয়ার পর পূর্ণা দুইদিন ঘর থেকে বের হয়নি। তাই মৃদুল বার বার পূর্ণার ঘরে উঁকি দেয়। পদ্মজা সারাক্ষণ থাকতো তাই ঢোকার সাহস পায়নি। দুই দিন পর পূর্ণা ছাদে যায়। পিছু পিছু মৃদুলও আসে। পূর্ণার পিছনে দাঁড়িয়ে কাশে। পূর্ণা ফিরে তাকায়। মৃদুলকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখায়। পূর্ণা প্রশ্ন করল, ‘কিছু বলবেন?’
মৃদুল বলল,’কেমন আছো ? হুনলাম,রাইতে রান্নাঘরে নাকি পইড়া গেছিলা।’
‘হু। ভালো আছি।’
‘তোমার কি ধপাস, ধপাস কইরা পইড়া যাওয়ার ব্যামো আছে?’
পূর্ণা কিছু বলেনি। পদ্মজা নিষেধ করেছে,সেদিনের রাতের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে। মৃদুল দেখল,পূর্ণা কপাল কুঁচকে,কাঁধে হাত বুলাচ্ছে। সে বিচলিত হয়ে জানতে চাইল,’বেদনা করে? দা’য়ের উপর পড়ছো কত্তটা কাটছে কে জানে! তার উপরে শীতের দিন এই ঘা সহজে ভালা হইব না। এইখানে তো বাতাস হইতাছে। ঘরে যাও। ঘা বাড়াইও না।’
‘না। এইখানেই থাকব।’
মৃদুল আর জেদ ধরেনি। পূর্ণা যতক্ষণ ছিল, সেও ছিল। এরপরদিন একটু পর পর পূর্ণার খোঁজ নিয়েছে। পূর্ণা খুব সুন্দর একটা অনুভূতির সাক্ষাৎ পায়। শুরুতে মৃদুলকে দেখে শুধুই ভালো লাগলেও,আস্তে আস্তে মৃদুলের বিচরণ শুরু হয়েছে তার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে। মৃদুলের কথা বলা,দুষ্টুমি,হাসি সব ভালো লাগে। মনের অনুভূতিগুলো হাটি হাটি পা করে গুরুতর সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মৃদুলও যে তার ব্যপারে আগ্রহী পূর্ণা টের পায়। এই বাড়িতে আসার পরদিন মৃদুল আমিরের সাথে দেখা করার অজুহাতে পূর্ণার সাথে দেখা করতে আসে। সবার অগোচরে বলে যায়, তার সাথে পরের দিন দুপুরে উত্তরের ঘাটে দেখা করতে। পূর্ণা বলেছিল যাবে। কিন্তু পূর্ণা দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙে সন্ধ্যায়। তাই আর যাওয়া হয়নি। গতকাল পদ্মজা বের হতেই দিল না। পূর্ণার মন কেমন কেমন করছে। খুব মনে পড়ছে মৃদুলকে। হারিকেনের আলো নিভে যায়,তখনই জানালায় টোকা পড়ে। পূর্ণা ভয় পেয়ে যায়। কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। ভূত এলো নাকি! পূর্ণা ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে নামে। আবারও সেই ডাক ভেসে আসে। কণ্ঠটা পরিচিত। পূর্ণা ভ্রুকুঞ্চন করে টিনের দেয়ালে কান পাতে। আবারও ভেসে আসে চেনা স্বর,’এই পূর্ণা।’
কণ্ঠটা চেনার সাথে সাথে পূর্ণা জানালা খুলল। মৃদুলের মুখটা ভেসে উঠে। পূর্ণার বুক ধক করে উঠল। সর্বাঙ্গে একটা উষ্ণ বাতাস ছুঁয়ে যায়। সে ফিসফিসিয়ে বলল,’পাশের ঘরে আপা,ভাইয়া। আপনি ঘাটে যান। আমি আসছি।’
‘আচ্ছা। ‘
মৃদুল চলে যায়। পূর্ণা তাড়াহুড়ো করে সোয়েটার পরে। শাল দিয়ে মাথা ঢাকল। তারপর হারিকেনে নতুন আগুন জ্বালিয়ে, হারিকেন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ভালোবাসার কথা বলা হয়নি। কোনো সম্পর্ক নেই দুজনের। তবুও পূর্ণা কোনো এক বশীকরণের জাদুতে ছুটে যাচ্ছে মৃদুলের কাছে। কলপাড় অবধি গিয়ে আবার ছুটে আসে ঘরে। আয়না,কাজল বের করে। চোখে কাজল দেয়। তারপর বেরিয়ে যায়। ব্যস্ত পায়ে ঘাটে আসে। চারিদিকে জোনাকিপোকা। জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। একটু দূরেই মৃদুল দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ণার হাঁটার গতি কমে যায়। সে অকারণে লজ্জা পাচ্ছে। মৃদুল এগিয়ে আসে। তার গলায় মাফলার। মাথায় টুপি। পরনে সোয়েটার। শীতল জলোবাতাসে শীত যেন আরো বেশি জেঁকে ধরছে। পূর্ণা মৃদুলের দিকে না তাকিয়ে, বিনিদ্র আরক্ত চোখে হারিকেনের মৃদু আলোয় নদীর অশান্ত জলরাশির দিকে চেয়ে বলল,’কেন ডেকেছেন?’
‘কেমন আছো?’
পুরুষালি ভরাট কণ্ঠটি পূর্ণাকে কাঁপিয়ে তুলে। অন্যবেলা তো এমন হয় না। এখন এরকম হওয়ার কারণ কী, রাতের অন্ধকার এবং নির্জনতা?
পূর্ণা বলল,’ক্ষতস্থান পেকেছে। তাই একটু যন্ত্রণা হয়। আপনি কেমন আছেন?’
‘ভালো নেই।’ মৃদুলের কণ্ঠটি করুণ শোনায়।
পূর্ণা মৃদুলের দিকে চোখ তুলে তাকায়। চোখাচোখি হয়। হারিকেনের আলোয় পূর্ণার কাজল কালো চোখ দুটি তীরের বেগে মৃদুলকে ঘায়েল করে। পূর্ণা সাবধানে প্রশ্ন করল,’কেন?’
‘জানি না।’
‘এতো রাতে আসা ঠিক হয়নি।’
‘এতো রাইতে আমার ডাকে তুমি কেন সাড়া দিলা?’
‘জানি না।’
দুজনের কেউই কথা খোঁজে পাচ্ছে না। দুজনের কেউই জানে না তারা কেন দেখা করেছে। মৃদুল জানে না, সে কেন এতো রাতে,তীব্র শীতে এখানে ছুটে এসেছে। পূর্ণা জানে না,সে কেন পর পুরুষের ডাকে সাড়া দিল। শুধু এইটুকু জানে,তাদের অশান্ত মন শান্ত হয়েছে। খালি খালি জায়গাটা পূর্ণ হয়েছে। তবে, হৃদস্পন্দন ছন্দ তুলে নৃত্য করছে। পূর্ণার কাঁধের ব্যথা বাড়ে। তাই তার ভ্রু দুটি বেঁকে গেল। কাঁধে এক হাত রাখে। মৃদুল ব্যথিত স্বরে জানতে চাইল,’আবার বেদনা করে? দেখি কেমনে কী হইছে।’
মৃদুল দুই পা এগিয়ে আসে। পূর্ণা পিছিয়ে যায়। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,’ অবিবাহিত মেয়ের কাঁধ দেখতে চাওয়া অন্যায়।’
‘সে তো দেখা করাও অন্যায়। সব অন্যায় কী মানা যায়?’
‘অনেকে তো মানে।’
‘আমি পারি না।’
‘আপনি অন্যরকম।’
‘ব্যথা কমেছে?’
‘হু,হুট করে ব্যথা বেড়ে যায়। আবার সঙ্গে সঙ্গে কমেও যায়।”
‘পাকলে এরকম হয়।’
‘হু।’
‘ভয় হচ্ছে না?’
পূর্ণা কেমন করে যেন মৃদুলের দিকে তাকাল। মৃদুল থমকে যায়। পূর্ণা বলল,’কার ভয়? আপনার?’
‘আমার আর সমাজ। দুইটাই।’
‘আপনাকে ভয় পেলে আসতাম না। আর সমাজের ভয় অনেক আগেই কেটে গেছে।’
উত্তরে বলার মতো কিছু পেল না মৃদুল। ঝিঁঝিঁপোকারা ডাকছে। আলো দিচ্ছে। কী সুন্দর দেখাচ্ছে। তার মাঝে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও নারী দাঁড়িয়ে আছে,বুকে ভালোবাসার উথালপাতাল ঢেউ নিয়ে। অনেকক্ষণ পর মৃদুল বলল,’আমি আসতে চাইনি।’
পূর্ণা আবারও সেই মন কেমন করা দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। বলল,’তাহলে কেন এসেছেন?’
‘মনে হইতাছে,কোনো বশীকরণ তাবিজের জোরে এখানে আইসা পড়ছি।’
পূর্ণা হেসে ফেলল। হারিকেনের মায়াবী আলোয় সে হাসি কী যে ভালো দেখাচ্ছিল। তার প্রশংসা করার মতো যোগ্য শব্দ মৃদুলের ভাষার ভান্ডারে মজুদ নেই। সে গাঢ় স্বরে বলল,’পিরিতির মায়া বড় জ্বালা।’
কপাল ইষৎ কুঁচকে পূর্ণা প্রশ্ন করল,’কার পিরিতের দহনে জ্বলছেন?’
‘তোমারে কইতে হবে?’
‘না।’
‘ঘরে যাও।’
পূর্ণা তার মুখের ধারে হারিকেন ধরে মৃদুলের দিকে চেয়ে বলল,’আমি কাজল দিয়েছি।’
পূর্ণা ভেবেছে তার কাজল কালো চোখ মৃদুল দেখেনি। কিন্তু মৃদুল তো শুরুতেই দেখেছে। আর ঘায়েল হয়েছে। সে হেসে পূর্ণার চোখ,মুখ আবার দেখল। হারিকেনের হলদে আলোয় পূর্ণার তেলতেলে ত্বক চিকচিক করছে। মৃদুল বলল,’দেখেছি। ভালো লাগছে।’
মৃদুলের এইটুকু প্রশংসায় পূর্ণার মন নেচে উঠল। সে ঠোঁটে হাসি রেখে বলল,’সাবধানে বাড়ি যাবেন।’
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ