Monday, October 6, 2025







আমি পদ্মজা পর্ব-৪৬+৪৭

আমি পদ্মজা – ৪৬
__________________
১৯৯৬ সাল। ঘনকুয়াশার ধবল চাদর সরিয়ে প্রকৃতির ওপর সূর্যের নির্মল আলো ছড়িয়ে পড়েছে। কাঁচের জানালার পর্দা সরাতেই এক টুকরো মিষ্টি পেলব রোদ্দুর পদ্মজার সুন্দর মুখশ্রীতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। নীচ তলা থেকে মনার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘আপামনি।’

মিষ্টি রোদের কোমল ছোঁয়া ত্যাগ করে ঘুরে দাঁড়াল পদ্মজা। আমির আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে লেপের ওম ছেড়ে উঠে বসল। দরজার বাইরে চোখ পড়তেই দেখতে পেল পদ্মজাকে। ধনুকের মতো বাঁকা শরীরে সবুজ সুতি শাড়ি। মাথায় লম্বা বেনুনি, চওড়া পিঠের ওপরে সাপের মতন দুলছে। পাতলা কোমর উন্মুক্ত। আমির চমৎকার করে হেসে ডাকল,’পদ্মবতী।’
পদ্মজা ফিরে না তাকিয়েই জবাব দিল,’অপেক্ষা করুন,আসছি।’
আমির মুখ গুমট করে বলল,’ইদানীং আমাকে একদমই পাত্তা দিচ্ছো না তুমি। বুড়ো হয়ে গেছি তো।’

ওপাশ থেকে আর সাড়া আসল না। আমির অলস শরীর টেনে নিয়ে বারান্দায় গেল। পদ্মজা বৈঠকখানায় এসে দেখে,মনা সোফায় পানের কৌটা নিয়ে বসে আছে। তাকে দেখেই দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। নয় বছরের মনা এখন চৌদ্ধ বছরের ছটফটে কিশোরী। পদ্মজা গম্ভীর স্বরে বলল,’ পান খাওয়ার অনুমতির জন্য ডেকেছিস?’
মনা নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে মাথা নত অবস্থায় রেখেই চোখ উল্টিয়ে তাকিয়ে পদ্মজাকে দেখল একবার। এরপর আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল,’অনেকদিন খাই না। আপামনি একটা খেতে দাও না?’

মনা চাইলে লুকিয়ে খেতে পারতো। কিন্তু সে পদ্মজাকে ডেকে অনুমতি চাইছে। পদ্মজা মনে মনে সন্তুষ্ট হলো। সোফায় বসে প্রশ্ন করল,’পান কে দিয়েছে? আবার সাথে পানের কৌটাও!’
‘আব্বা আসছিল।’ ভীতু কণ্ঠে বলল মনা।
‘কখন?’
‘ভোরবেলা।’
‘বাসায় আসেনি কেন?’
‘কাজে যাচ্ছে তাই।’
‘উনি এমনি এমনি কেন আনবেন পানের কৌটা? তুই স্কুল থেকে ফেরার পথে বস্তিতে গিয়েছিলি, তাই না?’

মনা জবাব দিল না। তার চুপ থাকা প্রমাণ করছে,পদ্মজার ধারণা সত্য। পদ্মজা আর কথা বাড়াল না। বলল,’একটা পান খাবি। কৌটাসহ বাকি পান,সুপারি রহমত চাচাকে দিয়ে তোদের বস্তিতে পাঠিয়ে দেব।’
পদ্মজা চলে যেতে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করল,’তুই নাকি গণিতে ফেইল করেছিস?’
পদ্মজার প্রশ্নে মনা চোরের মতো এদিকওদিক চোখের দৃষ্টি দৌড়াতে থাকল। পদ্মজা ধমকে উঠল,’বলছিস না কেন? আমি প্রতিদিন রাতে সময় নিয়ে তোকে গণিত বুঝিয়েছি। তবুও ফেইল করলি কী করে?’
মনা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,’পরীক্ষার আগের দিন পড়িনি। পরীক্ষায় গিয়ে সব ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ছিল।’
‘কেন পড়িসনি? সেদিন আমি অসুস্থ ছিলাম না? তাই আমি দুই তলায় ছিলাম নিচে একবারও আসতে পারিনি। এই সুযোগে পড়া রেখে টিভি দেখেছিলি তাই তো?’
মনা বাধ্যের মতো মাথা নাড়াল। পদ্মজা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। বেহায়ার মতো আবার স্বীকারও করছে,পড়া রেখে টিভি দেখেছে! ঢাকা আসার পরের বছরই মনাকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল সে। এখন মনা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। মাথায় বুদ্ধি বলতে নেই। সারাক্ষণ টিভি, টিভি আর টিভি! এতো পড়ানোর পরও কিছু মাথায় রাখতে পারে না। পদ্মজা বিরক্তি নিয়ে জায়গা ছাড়ল। শোবার ঘরে ঢুকতেই আমির আক্রমণ করে বসল। পদ্মজার কোমরের উন্মুক্ত অংশে হাত রাখতেই পদ্মজা ‘উফ! ঠান্ডা।’ বলে ছিটকে সরে গেল। আমির হতভম্ব হয়ে গেল। দুই পা এগোতেই প্রাপ্তবয়স্ক নারীর রিনরিনে কণ্ঠে ধমক বেরিয়ে আসল,’একদম এগোবেন না। এই শীতের মধ্যে ভেজা হাতে ছুঁলেন কীভাবে? আচ্ছা,আপনি আমার কালো সোয়েটারটা দেখেছেন? পাচ্ছি না। শীতে জমে যাচ্ছি একদম।’
আমির কিছু বলল না। সে পদ্মজার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে। পদ্মজা এদিকওদিক তার কালো সোয়েটারটা খুঁজল। এরপর আমিরের দিকে তাকিয়ে হেসে দিল। বলল,’এভাবে সঙের মতো খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’
আমির কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখনই টেলিফোন বেজে উঠল। পদ্মজা পাশের ঘরে চলে গেল। কালো সোয়েটারটা খুঁজে বের করতেই হবে। এ সোয়েটারটা পরে সে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আমির টেলিফোন রেখে পদ্মজাকে ডেকে জানাল, সে বের হবে। জরুরি দরকার। পদ্মজা সোয়েটার খোঁজা রেখে তাড়াতাড়ি করে খাবার পরিবেশন করল। গরুর মাংস গরম করল। আমির খাওয়াদাওয়া শেষ করে নিয়মমতো পদ্মজার কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে গেল। পদ্মজা তৈরি হয় রোকেয়া হলে যাওয়ার জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে রোকেয়া হলের অনেক মেয়েকেই চিনে। আজ মনার স্কুল নেই। সে একাই বাসায় থাকবে। পদ্মজা হলে যাচ্ছে এক ছোট বোনের সাথে দেখা করার জন্য। আমিরের তো কখনোই ছুটি নেই। নিজের ব্যবসা। যখন তখন কাজ পড়ে যায়।

রোকেয়া হলের চারপাশ সবুজ গাছে আবৃত। পদ্মজা গেইটের বাইরে গাড়ি রেখে এসেছে। হিম শীতল বাতাসে চোখজোড়া ঠান্ডায় জ্বলছে। তার পরনে বোরকা। মুখে নিকাব। রোকেয়া হলের ‘ক’ ভবনে এসে জানতে পারল যার খুঁজে সে এসেছে সে নেই। চারিদিক নিরিবিলি। প্রায় সবাই ক্যাম্পাসে। নির্জন পরিবেশে এমন ঠান্ডা বাতাস রোমাঞ্চকর অনুভূতি। রোকেয়া হলে এ নিয়ে অনেকবার এসেছে সে। পদ্মজা ‘ক’ ভবনের নিচ তলার শেষ মাথার কাছাকাছি অবধি গিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় ফিরে যাওয়ার জন্য। তখন অতি সূক্ষ্ম একটা শব্দ কানে ভেসে আসে। পদ্মজা থমকে দাঁড়াল। দুই পা পিছিয়ে চোখ বুজে শোনার চেষ্টা করল। শব্দটা তীব্র হয়েছে! যেন কাছে কোথাও ধস্তাধস্তি হচ্ছে। পদ্মজার মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠে। অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ফিরে তাকায়। একটা মেয়ের চাপা কান্নার শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই পদ্মজা দ্রুতগামী ঘোড়ার মতো ছুটে আসে শেষ কক্ষের দরজার সামনে। পৌঁছেই দেখতে পেল অর্জুন এবং রাজু একটা মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে কক্ষ থেকে বের করতে চাইছে। ক্যাম্পাসের ছাত্রসংগঠনের নেতা এরা। ছয় মাস হলো ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে এসেছে। আর এখনই ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করেছে। পদ্মজার উপস্থিতি টের পেয়ে অর্জুন,রাজু তাকাল। মেয়েটা ভয়ে কাঁপছে। পদ্মজাকে দেখে মেয়েটা ছুটে আসতে চাইলে অর্জুন ধরে ফেলে। পদ্মজা বেশ শান্তভাবেই বলল,’ক্ষমতার অপব্যবহার করতে নেই। ছেড়ে দাও মেয়েটাকে।’
পদ্মজার কণ্ঠ মেয়েটা চিনতে পারল। অস্ফুটভাবে ডাকল,’পদ্ম আপা।’
এরপর বলল,’পদ্ম আপা,আমি মিঠি। পদ্ম আপা ওরা আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে বাঁচাও।’
পদ্মজা ভালো করে খেয়াল করে চিনতে পারল মিঠিকে। অর্জুন মিঠির গালে শরীরের সব শক্তি দিয়ে থাপ্পড় মেরে রাজুকে বলল,’এরে ঘাড়ে উঠা। এই আপনি সরেন। মাঝে হাত ঢুকাবেন না। বিরক্ত করা একদম পছন্দ না আমার।’
পদ্মজা বাধা হয়ে দাঁড়াল। বলল,’দেখো, মা জাতিকে এভাবে অপমান করতে নেই। হাতে ক্ষমতা পেয়েছো সৎভাবে চলো। সবার ভালোবাসা পাবে। এভাবে নিজেরা অন্যের ইজ্জত নষ্ট করছো সেই সাথে নিজেদের পাপী করছো।’
‘এই ফুট এখান থেকে। নীতি কথা শোনাতে আসছে।’
‘ভালোভাবে বলছি,ভেজাল না করে ছেড়ে দাও। নারীকে নারীরূপে থাকতে দাও। শক্ত হতে বাধ্য করো না।’
অর্জুন রাগে দাঁতে দাঁত কামড়ে বলল,’আর একটা কথা বললে জামাকাপড় খুলে মাঠে ছেড়ে দেব।’

কথাটা শেষ করে অর্জুন চোখের পলক ফেলতে পারল না। তার আগে পদ্মজার পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে যায় তার ফর্সা গালে। অর্জুন রক্তিম চোখে কিড়মিড় করে তাকায়। মিঠিকে ছেড়ে পদ্মজার গলায় চেপে ধরে। পদ্মজা সঙ্গে সঙ্গে অর্জুনের অণ্ডকোষ বরাবর লাথি বসিয়ে দিল। অর্জুন কোঁকিয়ে উঠল। অণ্ডকোষে দুই হাত রেখে বসে পড়ল। রাজু বিশ্রি গালিগালাজ করে পদ্মজার দিকে তেড়ে আসে। পদ্মজা মেঝে থেকে ইট তুলে রাজুর মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারে। মিঠি ভয়ে চোখ খিঁচে ফেলে। রাজুর কপাল ফেটে রক্তের ধারা নামে। অর্জুন আকস্মিক তেড়ে এসে পদ্মজার নিকাব টেনে খুলে। ঘোলা চোখের ভয়ংকর চাহনি,রক্তজবার মতো ঠোঁটের কাঁপুনি অর্জুনের অন্তর কাঁপিয়ে তুলে। তবুও দমে থাকেনি। পদ্মজাকে হামলা করার জন্য প্রস্তুত হয়। পদ্মজা তার কাঁধের ব্যাগ থেকে ছুরি বের করে অর্জুনের গলায় টান বসায়। এই দৃশ্য দেখে মিঠির শরীর কাঁপতে থাকে। অর্জুন চিৎকার করে বসে পড়ে। গলায় হাত দিয়ে দেখে গলাটা শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায়নি। চামড়া ছিঁড়েছে শুধু। তার হৃৎপিণ্ড যেন মাত্রই মৃত্যু সাক্ষাৎ পেল। পদ্মজার অভিজ্ঞ হাত তার কলিজা শুকিয়ে দিয়েছে। মেঝেতে বসে হাঁপাতে থাকে। পদ্মজা ছুরির রক্ত অর্জুনের গেঞ্জিতে মুছে বলল,’তোমাদের ভাগ্য ভালো পদ্মজার হাতে পড়েছো। হেমলতার হাতে পড়োনি।’

এরপর মিঠিকে প্রশ্ন করল,’আমার জানামতে তুমি ১ম বর্ষে আছো। আর হলে দ্বিতীয় তলায় থাকার কথা। এখানে আসলে কী করে?’
মিঠির ভয় এখনও পুরোপুরি কাটেনি। সে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,’আমি গত কয়দিন অসুস্থ ছিলাম। ক্যাম্পাসে যেতে পারিনি। অর্জুন দাদা নাজমাকে দিয়ে আমাকে ডেকেছিল।’
‘ওমনি চলে এসেছো? কয়দিন আগে ৩য় বর্ষের একটা মেয়ের কী হাল হয়েছে দেখোনি,শুনোনি? এরপরও এদের ডাকে সাড়া দিলে কেন?’
‘না দিয়েও উপায় নাই।’

পদ্মজা আর কিছু বলতে পারল না। মিঠিকে নিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়ে। এরপর নিকাব পরতে পরতে বলল,’এসব বেশিদিন সহ্য করা যায় না। মেয়েরা হলে এসে থাকে পড়াশোনার জন্য। আর এসব নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়। তোমার চেনাজানা আরো যারা মানসিক,শারিরীকভাবে ভুক্তভোগী আছে সবার নামের তালিকা আমাকে দিতে পারবে?’
মিঠি জানতে চাইল,’কেন?
‘সবাইকে নিয়ে প্রশাসনের কাছে যাব। তাদের নিরবতা আর মেনে নেব না। ক্যাম্পাসে আসার পর থেকে নেতাদের অপকর্ম দেখছি। থামানোর চেষ্টা করেছি। একজন,দুজন থামে আরো দশজন বাড়ে। এইবার আমাদের আন্দোলন করতে হবে।’
মিঠি মিনমিনিয়ে বলল,’কেউ ভয়ে আন্দোলন করতে চায় না। অনেকবার দিন তারিখ ঠিক হয়েছে শুনেছি। এরপর যাদের আসার কথা ছিল তাদের মধ্যে আশি ভাগই আসতো না। অনেককে বাসায় আক্রমণ করা হয়েছে।’
পদ্মজার বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। সমাজে মেয়েরা এতো দূর্বল! তাদের দেহের লুকায়িত আকর্ষণীয় ছন্দগুলো না থাকলে হয়তো তারাও সাহসী হতো। ছন্দ হারানোর ভয় থাকত না। কাউকে ভয় পেতে হতো না। পদ্মজা মিঠিকে বলল,’তুমি বরং কয়দিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসো। এখানে থাকা তোমার জন্য এখন বিপদজনক। আমি আগামীকাল গ্রামে যাচ্ছি। আমার আম্মার মৃত্যুবার্ষিকী। ছোট বোনের মেট্রিক পরীক্ষা দেড় মাস পর। আরেক বোনের বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছি। দেড়-দুই মাসের মতো গ্রামে থাকব। এরপর এসে এই নেতাদের ব্যবস্থা করব। তোমাদের বর্ষের শিখা আছে না? বেশ সাহসী মেয়েটা। ওর মতো আরো কয়টা মেয়ে পাশে থাকলেই হবে। তুমি যাও এখন। দ্রুত বাড়ি ফেরার চেষ্টা করো। যতক্ষণ এখানে আছো একা চলাফেরা করো না। শিখাও তো মনে হয় হলেই থাকে?’
‘জি।’
‘ওর সাথে থেকো।’
‘কখনো কথা হয়নি।’
‘এখনতো ক্যাম্পাসে বোধহয়। আচ্ছা বিকেলে আমি আবার আসব। ওর সাথে কথা বলব। আমি আসছি এখন।’
‘পদ্ম আপা?’
পদ্মজা তাকাল। মিঠি পদ্মজাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। ভেজাকণ্ঠে বলল,’অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।’
‘বাঁচার সংগ্রামে ভীতু হলে চলে না মিঠি।’
‘ভেবেছিলাম জীবনটা শেষ হয়েই গেল বুঝি।’
‘কখনো এমন ভাববে না। বিপদে সামর্থ্য মতো যা পারো করবে। শরীরের শক্তি নিশ্চয় কম নয়। মনের জোরটা কম। সেই জোরটা বাড়াবে। মনের জোর বাড়াতে টাকা লাগে না। কঠিন জীবন সহজ করে তোলার দায়িত্ব নিজেরই নিতে হয়।’
মিঠি মাথা তুলে তাকাল। একটু সরে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছল। এরপর বলল,’দ্রুত ফিরবে পদ্ম আপা। আমরা আমাদের নিরাপত্তার যুদ্ধে নামব।’
পদ্মজা হেসে বলল,’ফিরব। দ্রুত ফিরব।’

গাড়ি বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটছে। বাড়ির নাম আগে ছিল,আমির ভিলা। বছর ঘুরতেই আমির বাড়ির নাম পাল্টে দিল,পদ্ম নীড়। পদ্মজা জানালার কাচ তুলে বাইরে তাকাল। রাস্তাঘাটে মানুষজন কম। ঠান্ডা বাতাস। সূর্যের আলোয় একদমই তেজ নেই। যেন থুড়থুড়ে বৃদ্ধ হয়ে গেছে। পদ্মজা আকাশপানে তাকিয়ে তিনটা প্রিয় মুখকে খোঁজে। চোখ দুটি টলমল করে উঠে। কোথায় আছে তারা? আবার কবে হবে দেখা? পদ্মজা কাচ নামিয়ে দিল। রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজল।

_________________
নিস্তব্ধ বিকেল ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে অলন্দপুরের আটপাড়া। সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে যায় নূপুরধ্বনিতে। পূর্ণার চঞ্চল কাদামাখা দুটি পা দৌড়ে ঢুকে মোড়ল বাড়ি। পায়ের নূপুরজোড়া রিনঝিন রিনঝিন সুর তুলে ছন্দে মেতেছে। পরনে লাল টুকটুকে শাড়ি। আঁচল কোমরে গোঁজা। শাড়ি গোড়ালির অনেক উপরে পরেছে। । বাড়িতে ঢুকেই চেঁচিয়ে ডেকে উঠল,’বড় আম্মা। ও বড় আম্মা।’
বাসন্তী রান্নাঘর ছেড়ে দৌড়ে আসেন। হাতের চুড়িগুলো ঝনঝন করে উঠে। মুখে বয়সের ছাপ পড়েছে। তাও কিঞ্চিৎ। পূর্ণাকে এভাবে হাঁপাতে দেখে প্রশ্ন করলেন,’বাড়িতে ডাকাত পরছে?’
‘আপার চিঠি।’ পূর্ণা হাতের খামটা দেখিয়ে বলল।

আপার চিঠি শুনে প্রেমা বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। সে পড়ছিল। ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানা। ষোড়শী মনে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সবার চেয়ে আলাদা হয়েছে। খুব ভীতু এবং লাজুক সে। পূর্ণা বড় বোন হয়ে সারাদিন বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। আর সে ঘরে বসে পড়ে,বাড়ির কাজ করে। স্কুলে যায়। পদ্মজার কথামতো প্রতিদিনের রুটিন অনুসরণ করে। সে বলল,’কী বলছে আপা? চিঠি দাও।’

পূর্ণা কপাল কুঁচকে বলল,’তোর পড়তে হবে না। বলছে,মাঘ মাসের ১৯ তারিখ আসছে। অনেকদিন থেকে যাবে।”
‘আজ কত তারিখ?’ প্রশ্ন করলেন বাসন্তী।
পূর্ণা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,’১৯ শে মাঘ।’

বাসন্তীর চোখ দুটি যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললেন,’আজই! বিকেল তো হয়ে গেছে।’

পূর্না অস্থির হয়ে বাসন্তীর কাছে দৌড়ে আসে। দুই হাতে ধরে করুণ স্বরে বলল,’তাড়াতাড়ি সালোয়ার কামিজ বের করো আমার। এই রূপে দেখলে একদম মেরে ফেলবে আপা।’

বাসন্তী আরোও করুণ স্বরে বললেন,’মা, আমি আগে আমার রূপ পাল্টাই। তুমি তোমারটা খুঁজে নাও।’

কথা শেষ করেই বাসন্তী ঘরের দিকে যান। বুক দুরুদুরু কাঁপছে। পরনে ঝিলমিল, ঝিলমিল করছে টিয়া রঙের শাড়ি। দুই হাতে তিন ডজন চুড়ি। কপালে টিপ,ঠোঁটে লিপস্টিক। এ অবস্থায় পদ্মজা দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তিনি সাজগোজ পূর্ণার কথায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপর পূর্ণার কথায়ই দুজন মিলে আবার শুরু করেছেন। পদ্মজা এক-দুই দিনের জন্য প্রতি শীতে বাড়ি আসে তখন সব রঙ-বেরঙের জিনিস লুকিয়ে রাখা হয়। পূর্ণা চিঠি প্রেমার হাতে দিয়ে ঘরে যায়। ট্রাঙ্ক খুলে সাদা-কালো রঙের সালোয়ারকামিজ দ্রুত পরে নেয়। হাতের চুড়ি খুলতে গিয়ে কয়টা ভেঙে যায়। অন্যবার দুই-তিন দিন আগে চিঠি আসে। আর আজ যেদিন পদ্মজা আসছে সেদিনই চিঠি আসতে হলো! দশ দিন আগে চিঠি পাঠিয়েছে পদ্মজা। ডাকঘর থেকেই দেরি করেছে। পূর্ণা মনে মনে ডাকঘরের কর্মচারীদের গালি দিয়ে চৌদ্ধ গুষ্ঠি উদ্ধার করছে। সে দ্রুত জুতা পরে বারান্দায় আসে। প্রেমাকে তাড়া দিল,’জলদি পানি নিয়ে আয়।’

প্রেমার বেশ লাগছে। সে মনেপ্রাণে দোয়া করছে,পদ্মজা এখুনি এসে যাক আর দেখুক পূর্ণার সাজগোজ। কিন্তু প্রকাশ্যে পূর্ণার আদেশ রক্ষার্থে কলসি নিয়ে কলপাড়ে গেল। পূর্ণা মনে মনে আয়তুল কুরসি পড়ছে! এই বুঝি পদ্মজা এসে গেলো! গতবার মার তো খেয়েছেই। তার সাথে পদ্মজা রাগ করে তিন মাস চিঠি লিখেনি। বাতাসের বেগে পাতায় মড়মড় আওয়াজ হচ্ছে। আর পূর্ণার মনে হচ্ছে, এইতো তার রাগী আপা হেঁটে আসছে। নাহ পানির জন্য অপেক্ষা করা যাবে না। পূর্ণা কলপাড়ে ছুটে যায়। কলসি থেকে পানি নিয়ে পায়ের কাদা,ঠোঁটের লিপস্টিক ধুয়ে ফেলে। কপালের টিপ খুলে কলপাড়ের দেয়ালে লাগিয়ে রাখে। হাতের চুড়ি, গলার হার,কানের বড় বড় দুল ট্রাঙ্কের ভেতর রেখে এসেছে। পায়ের দিকে আবার চোখ পড়তেই, সে আঁতকে উঠল। নূপুরজোড়া হাঁটার সময় অনেক আওয়াজ তুলে। এ রকম নূপুর পরা নাকি ইসলামে নিষিদ্ধ। আবার দৌড়ে গেল ঘরে। দৌড়ার সময় বার বার হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিচ্ছিল। নূপুর দুটো খুলে ট্রাঙ্কের ভেতর রেখে দিয়ে মাটিতে ধপ করে বসে লম্বা করে নিঃশ্বাস নিল। বিড়বিড় করে বলল,’বাঁচা গেল!’

এরপর হাঁটুতে থুতুনি রেখে মিষ্টি করে হাসল। আজ তার আপা আসবে। তার জীবনের সবচেয়ে দামী এবং ভালোবাসার মানুষটা আসবে। ঈদের আনন্দের চেয়েও বেশি এই আনন্দ। পূর্ণা মাথায় ঘোমটা টেনে রান্নাঘরে যায়। প্রায় বছর খানেক পর আবার রান্নাঘরে ঢুকেছে সে। বাসন্তী সাদা রঙের শাড়ি পরেছেন। তাড়াহুড়ো করে এটা ওটা রাঁধছেন। পূর্ণা সাহায্য করার জন্য হাত বাড়াল। বাসন্তী বললেন,’প্রান্তরে বল গিয়ে লাল রঙের দাগ দেয়া রাজহাঁসটা ধরতে।’

পূর্ণা চুলায় লাকড়ি আরেকটা দিয়ে লাহাড়ি ঘরের দিকে যায়। প্রান্তকে লাহাড়ি ঘরেই বেশি পাওয়া যায়। প্রেমা পদ্মজার জন্য হেমলতার ঘরটা গুছাচ্ছে।

চলবে….
®ইলমা বেহরোজ

আমি পদ্মজা – ৪৭
____________________
ইট-পাথরের শহরের সবই কৃত্রিম। কৃত্রিমতা ছেড়ে ছায়ায় ঘেরা মায়ায় ভরা গ্রাম, আঁকা-বাঁকা বয়ে চলা নদী-খাল, সবুজ শ্যামল মাঠের প্রাকৃতিক রূপ দেখে তৃষ্ণার্ত নয়নের পিপাসা মিটাতে গিয়ে পদ্মজা আবিষ্কার করল,তার চোখে খুশির জল! সবেমাত্র অলন্দপুরের গঞ্জের সামনে ট্রলার পৌঁছেছে। ট্রলারটি হাওলাদার বাড়ির। আলমগীর ও মগা উপস্থিত রয়েছে। তারা দুজন ট্রলার নিয়ে রেলষ্টেশনের ঘাটে অপেক্ষা করছিল। আমির পদ্মজার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াতেই পদ্মজা বলল,’ইচ্ছে হচ্ছে জলে ঝাঁপ দেই।’
আমির আঁতকে উঠল,’কেন?’
পদ্মজা আমিরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। এরপর বলল,’অল্পতে ভয় পেয়ে যান কেন? বলতে চেয়েছি,অনেকদিন পর চেনা নদীর জল দেখে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। ডুব দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। ‘
আমির এক হাতে পদ্মজার বাহু চেপে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে বলল,’ তাই বলো!’
পদ্মজা আমিরের দিকে তাকাল। আমিরের গাল ভর্তি দাঁড়ি। ঘন হয়েছে খুব। চোখের দৃষ্টি গাঢ়,তীক্ষ্ণ। পঁয়ত্রিশ বছরের পুরুষ! অথচ,একটা সন্তান নেই। বাবা ডাক শুনতে পারে না। মানুষটার জন্য দুঃখ হয়। পদ্মজা গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

আযান পড়ছে। ট্রলার মোড়ল বাড়ির ঘাটে ভীড়ে। প্রথমে পদ্মজার চোখে পড়ে রাজহাঁসের ছুটে চলা। ঝাঁক ঝাঁক রাজহাঁস দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকছে।
হাঁসের প্যাঁক প্যাঁক শব্দে চারিদিক মুখরিত। ট্রলারের শব্দ শুনে পূর্ণা,প্রেমা,প্রান্ত,ছুটে আসে ঘাটে। আগে আগে আসে পূর্ণা। পদ্মজা প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতেই পূর্ণা জান ছেড়ে ডেকে উঠল,’আপা।’
পূর্ণাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে পদ্মজা ভয় পেয়ে যায়। সাবধান করে,’আস্তে পূর্ণা।’
বলতে বলতে সিঁড়িতে পূর্ণার পা পিছলে গেল। পদ্মজা দ্রুত আঁকড়ে ধরে। এখুনি অঘটন ঘটে যেত! পদ্মজা পূর্ণাকে ধমক দিতে প্রস্তুত হয়, তখনই পূর্ণা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পদ্মজাকে। বুকে মাথা রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে উচ্চারণ করল,’আপা! আমার আপা!’

পদ্মজার বুক বিশুদ্ধ ভালোলাগায় ছেয়ে গেল। মৃদু হেসে পূর্ণাকে কিছু বলার জন্য আবার প্রস্তুত হয়,তখন প্রেমা,প্রান্ত এসে জড়িয়ে ধরল। পদ্মজা টাল সামলাতে না পেরে শেষ সিঁড়ি থেকে নদীর জলে পড়ে যাচ্ছিল,ট্রলারের আগায় দাঁড়িয়ে থাকা আমির দুই হাতে দ্রুত পদ্মজাকে আঁকড়ে ধরে তার খুঁটি হলো। পদ্মজা চোখ খিঁচে ফেলে। যখন বুঝতে পারল সে পড়েনি,তার ভাইবোনেরাও পড়ে যায়নি তখন চোখ খুলল। ঘাড় ঘুরিয়ে তার সহধর্মীর মুখ দেখে হাসল। এরপর সোজা হয়ে দাঁড়াল। পূর্ণা, প্রেমা হেঁচকি তুলে কাঁদছে! খুশিতে কেউ এভাবে কাঁদে? তবে পদ্মজার ভালো লাগছে। বাসন্তীকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পদ্মজা তার ভাই-বোনদের বলল,’আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দিবি না তোরা?’
পূর্ণা চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,’চলো।’

পদ্মজা সিঁড়ি ভেঙে বাসন্তীর সামনে এসে দাঁড়াল। সাদা রঙের শাড়ি পরে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকা এই মানুষটার প্রতি পদ্মজার অনেক ঋণ। হেমলতা মারা যাওয়ার ছয় মাসের মাথায় মোর্শেদ পৃথিবী ছাড়েন।
শোকে খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। ফেলে যান কিশোরী দুই মেয়ে,বউ এবং এক ছেলেকে। অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেয়। সংসার চলে না। আমির সাহায্য করতে চেয়েছিল। পদ্মজার আত্মসম্মানে লাগে। সে কিছুতেই স্বামীর টাকায় বাবার বাড়ির সংসার চালাবে না। নিজেরও কাজ করার উপায় ছিল না। এমতাবস্থায় বাসন্তী চাইলে ফেলে চলে যেতে পারতেন। তিনি যাননি। এক পড়ন্ত বিকেলে পদ্মজাকে বললেন,’নকশিকাঁথা সেলাই করতে পারি আমি। শখে সেলাই করতাম। দুই তিনজন পয়সা দিয়ে কিনতে চাইত। টাকার দরকার ছিল না,তাই বিক্রি করিনি। তুমি বললে,আমি নকশিকাঁথা গঞ্জে বেঁচার চেষ্টা করতাম।’

পদ্মজা সেদিন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। বাসন্তী ছুটে ঘরে যান। একটা নকশিকাঁথা নিয়ে আসেন। পদ্মজাকে দেখান। অসম্ভব সুন্দর হাতের কাজ! আমির নকশিকাঁথা দেখে মুগ্ধ হলো। সঙ্গে সঙ্গে বলল,বড় ভাইয়া যখনি ঢাকা যাবে নকশিকাঁথা দিয়ে দিবেন। শহরে নকশিকাঁথার চাহিদা রয়েছে অনেক। আপনাদের সমস্যা কিছুটা হলেও ঘুচে যাবে। এক কাজ করলেই তো পারেন আরো দুই-তিনজনকে নিয়ে নকশিকাঁথা বানানো শুরু করেন। তাহলে অনেকগুলি হবে। তাদের পারিশ্রমিক দিয়ে দিবেন। ঢাকা বিক্রির পর দ্বিগুণ টাকা আসবে।’

এ প্রস্তাবে পদ্মজা অমত করল না। সেদিন থেকে বাসন্তী দুই হাতে দিনরাত পরিশ্রম করছেন। পূর্ণাকে মেট্রিক অবধি পড়ালেন। প্রেমা,প্রান্তকে এখনও পড়াচ্ছেন। পূর্ণার যেকোনো আবদার পূরণ করে চলেছেন। বাসন্তীর পা ছুঁয়ে পদ্মজা সালাম করল। এরপর বলল,’কেমন আছেন আপনি?’
‘ভালো আছি মা। তুমি, জামাইবাবা সবাই ভালো আছোতো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আগের চেয়ে শুকিয়েছেন। ত্বক ময়লা হয়েছে। নিজের যত্ন নেওয়া ভুলে গিয়েছেন?’
বাসন্তী চোখ নামিয়ে হাসেন। এক হাতে নিজের মুখশ্রী ছুঁয়ে বলল,’সেই বয়স কী আর আছে? বিধবা মানুষ!’
‘পূর্ণা খুব জ্বালায় তাই না? বাধ্য করে রঙিন শাড়ি পরতে,সাজতে।’
বাসন্তী চমকে তাকালেন। পদ্মজা হাসছে। পূর্ণা মাথায় ব্যাগ নিয়ে পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়াল। আহ্লাদী হয়ে অভিযোগ করল,’আপা তুমি নাকি মুচির সাথে আমার বিয়ে দিতে এসেছো?’
পদ্মজা হাসি প্রশস্ত হয়। আমিরের দিকে তাকিয়ে এরপর পূর্ণার দিকে তাকাল। বলল,’কে বলেছে? তোর ভাইয়া?’
পূর্ণা আমিরকে ভেংচি কেটে পদ্মজাকে বলল,’আর কে বলবে? আপা আমি মুচি বিয়ে করব না। আমার ফর্সা, চকচকে জামাই চাই।’
মগা পূর্ণাকে রাগানোর জন্য বলল,’মেট্রিক ফেইল করা ছেড়িরে ধলা জামাই হাঙ্গা করব না।’
পূর্ণা কিড়মিড় করে তাকাল। পদ্মজা পূর্ণার গাল টেনে দিয়ে বলল,’আচ্ছা,এসব নিয়ে পরে আলোচনা হবে। অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে চারপাশ। বাড়িতে চল।’

তারপর দুই হাতে দুই বোন-ভাইকে জড়িয়ে ধরে বাড়ির উঠানে পা রাখে সে। সতেজ হয়ে জামাকাপড় পাল্টে নেয় আমির ও পদ্মজা। এরপর রাজহাঁস ভূনা আর গরম গরম ভাতের ভোজন হয়। আলমগীর, মগাও ছিল। আলমগীর বাড়ি ফেরার আগে আমির-পদ্মজাকে বলে যায়,’আগের স্মৃতি আর কতদিন বুকে রাখবি তোরা? দাদু মরার পথে। চাচি আম্মা আত্মগ্লানি আর তোদের না দেখার শোকে শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে গিয়েছে।
এবার অন্তত বাড়িতে আসিস। অনুরোধ রইল আমার। পদ্মজা তুমি আমিরকে বুঝিয়ো।’
পদ্মজা আশ্বস্ত করে বলল,’এবার বাড়ির সবাইকে গিয়ে দেখে আসব। আপনি নিশ্চিন্তে যান।’
‘অপেক্ষায় থাকব।”
‘আসব ভাইয়া।’ বলল পদ্মজা।
আলমগীর, মগা চলে গেল। আমির পদ্মজাকে বলল,’আমি যাব না।’
‘এবার যাওয়া উচিত। অনেক তো হলো। চার বছর কেটেছে। ভয়ংকর রাতটা আজীবন বুকে তাজা হয়ে থাকবে। তাই বলে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারি না। ইসলামে সম্পর্ক ছিন্ন করা হারাম।’
‘ওই বাড়িতে গেলে আমার দমবন্ধকর কষ্ট হয় পদ্মজা।’
‘সে তো আমারও হয়। কিন্তু আম্মার কথা খুব মনে পড়ে। আম্মারতো কোনো দোষ ছিল না। তবুও শাস্তি পাচ্ছেন।’
‘ছিল দোষ।’
‘যে আসল দোষী তার দেখা আজও পেলাম না। অথচ,যিনি দোষী না তিনি সবার চোখে দোষী।’
‘আম্মা সেদিন কেন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? এটাই আম্মার দোষ।’
‘জোর করে ঘুম আটকিয়ে রাখা যায়? আমরা আগামীকাল যাচ্ছি,এটাই শেষ কথা।’
‘পদ্মজ….’

আমিরের বাকি কথা পদ্মজা শুনল না। সে হেমলতার ঘরের দিকে এগুলো। হেমলতার ঘরের দরজা খুলতেই অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। শিহরিত হয়ে কেঁপে উঠে সে। ছয় বছর আগের মতোই সব। নেই শুধু মা! পদ্মজা ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে। আলমারি খুলে হেমলতার শাড়ি বের করে ঘ্রাণ শুঁকে। বুকের সাথে জড়িয়ে রাখে। গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। হাউমাউ করে কান্নাটা আসে না অনেকদিন। কষ্টগুলো চেপে থাকে বুকের ভেতর। পূর্ণা দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার আপাকে দেখছে। পদ্মজা বার বার নাক টানছে। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে মায়ের শাড়ি। যেন সে শাড়ি না তার মাকেই চুমু দিচ্ছে। পূর্ণার মন ব্যথায় ভরে উঠে। তার কী মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে নাকি আপার কান্না দেখে কষ্ট হচ্ছে? জানে না পূর্ণা। শুধু উপলব্ধি করছে,তার কান্না পাচ্ছে।

কান্নার শব্দ শুনে পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। পূর্ণাকে কাঁদতে দেখে,দ্রুত চোখের জল মুছে হাতের শাড়ি আলমারিতে রাখল। এরপর পূর্ণাকে ডাকল,’আয় এদিকে।’
পূর্ণা ফোঁপাতে ফোঁপাতে এগিয়ে আসে। পদ্মজা বিছানায় বসল। পূর্ণা পদ্মজার কোলে মাথা রেখে কাচুমাচু হয়ে শুয়ে পড়ল। পদ্মজা বলল,’বয়স একুশের ঘরে। মনটা তো সেই চৌদ্ধ-পনেরো বছরেই পড়ে আছে।’
পূর্ণা পদ্মজার এক হাত মুঠোয় নিয়ে বলল,’আমার খুব কান্না পাচ্ছে।’
‘কাঁদিস না।’
‘ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসছে তো।’
‘থামানোর চেষ্টা কর।’
‘থামছে না।’
‘তুই তো আরো কাঁদছিস।’
‘বেড়ে যাচ্ছে তো।’
পদ্মজা ঠাস করে পূর্ণার গালে থাপ্পড় বসাল। সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণার কান্না থেমে যায়। চোখ বড় বড় করে তাকায়। পদ্মজা আওয়াজ তুলে হেসে উঠে। পূর্ণা দ্রুত উঠে বসে। হাত ঝাড়তে ঝাড়তে হেসে বলল,’থেমে গেছে।’

পদ্মজার হাসি বেড়ে গেল। মুখে হাত চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করে।
হাসির ঠ্যালায় চোখে জল চলে আসে। পূর্ণা কান্না নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। থামাতে বললে,আরো বেড়ে যায়। ব্যাপারটা যে কেউ উপভোগ করে। প্রেমা ঘরে ঢুকে অভিমানী কণ্ঠে বলল,’আমাকে ছাড়া কী নিয়ে কথা বলে হাসা হচ্ছে?’
পদ্মজা হাসতে হাসতে বলল,’পূর্ণা কাঁদছিল। থামাতে পারছিল না।’
প্রেমা হেসে বিছানায় উঠে বসে। দুই পা ভাঁজ করে বসে বলল,’ বড় আপা,ছোট আপা নামায পড়ে না।’

পদ্মজা হাসি থামিয়ে পূর্ণার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল,’কী রে? তুই নামায পড়িস না কেন? চিঠিতে তো বলিস অন্য কথা।’
পূর্ণার ইচ্ছে হচ্ছে প্রেমাকে লবণ,মরিচ দিয়ে ক্যাচ ক্যাচ করে কাঁচা আমের মতো কামড়ে খেতে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সামলাতে হবে। সে পদ্মজাকে বোঝানোর চেষ্টা করল,’আপা,বিশ্বাস করো শুধু এক ওয়াক্ত পড়িনি। আর…আর প্রেমাকে আমি আমার…হ্যাঁ আমার চুড়ি দেইনি বলে…’
‘মিথ্যে বলবি না। কতবার বলেছি,মিথ্যা কথা ছাড়তে। সত্য স্বীকার কর। কীসের কাজ তোর? পড়ালেখা ছেড়েছিস,চার বছর। মেট্রিকটা আবার পড়লি না। বিয়ে করতে চাস না বলে বিয়ের জন্যও জোর করিনি। তার মূল্য এভাবে কথা না শুনে দিবি? এটা তো আমারও কথা না। যিনি সৃষ্টি করেছেন উনার আদেশ।’

পূর্ণা মাথা নত করে রাখে। পদ্মজা বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল,’ঘুমাব না তোদের সাথে।’
প্রেমা আর্তনাদ করে উঠল,’আপা,আমার দোষ কী?’
পূর্ণা পদ্মজার কোমর জড়িয়ে ধরে। কিছুতেই যেতে দিবে না। পদ্মজা বলল,’ছাড় বলছি।’
পূর্ণা আকুতি করে বলল,’যেও না। এখন থেকে প্রতিদিন পড়ব। সত্যি বলছি।’
‘সত্যি তো?’ বলল পদ্মজা।
‘সত্যি।’
পদ্মজা বিছানায় পা তুলে বসল। পূর্ণা আড়চোখে প্রেমাকে দেখল। দৃষ্টি দিয়ে যেন হুমকি দিল,’আমারও দিন আসবে!’

গ্রামে আসলে আমির প্রান্তর সাথে ঘুমায়। পদ্মজাকে তার বোনদের সাথে ছেড়ে দেয়। আজও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। দুই বোনকে নিয়ে শুয়ে পড়ে পদ্মজা। কত কত গল্প তাদের! পদ্মজা শুধু শুনছে আর হাসছে। প্রেমার মুখ দিয়ে সহজে কথা আসে না,পদ্মজা আসলে কথার ঝুড়ি নিয়ে বসে। পূর্ণা নিজের বিয়ে নিয়ে বেশি কথা বলছে। পরিকল্পনা করছে। তখন প্রেমা ব্যাঙ্গ করে বলল,’ছোট আপার লজ্জার লেশমাত্র নেই।’

তখন পূর্ণা ক্ষেপে গিয়ে বলল,’তুই যে প্রান্তরে বলছিলি শহরে গিয়ে সাহসী পুলিশ বিয়ে করবি। আমি কাউকে বলেছি? বলেছি,তোর লজ্জা নাই?
প্রেমা লজ্জায় জবুথবু হয়ে যায়! তার বড় আপার সামনে ছোট আপা কী বলছে! লজ্জায় কান দিয়ে ধোয়া বেরোতে থাকে। পদ্মজা হাসল। প্রেমাকে বলল, ‘লজ্জার কিছু নেই। অভিভাবকদের নিজের পছন্দ জানানো উচিত। তোর বিয়ে পুলিশের সাথেই হবে। আর পূর্ণার বিয়ে হবে পূর্ণার পছন্দমত।’

পদ্মজার কথায় পূর্ণা ভারি খুশি হলো। সে আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল,’ নায়কের মতো জামাই চাই। একদম লিখন ভাইয়ার মতো। ওহ আপা, জানো লিখন ভাইয়া এখানে শুটিং করতে আসছে। এক সপ্তাহ হলো।’
পদ্মজা জানতে চাইল,’কার বাড়ি?’
‘সাতগাঁয়ের হান্নান চাচার বাড়ি। বিশাল বড় টিনের বাড়ি।’

পদ্মজা চুপ হয়ে গেল। এই মানুষটা শুধুমাত্র তার স্মৃতি। কিন্তু মানুষটার জীবনের পুরোটা জুড়ে সে। এইতো মাস চারেক আগে, পদ্মজা পত্রিকা পড়তে বসেছিল। তৃতীয় পৃষ্ঠায় লিখন শাহর ছবি সাথে উপরের শিরোনাম দেখে বেশ অবাক হয় পদ্মজা। শিরোনামে লেখা, ‘লিখন শাহর পদ্ম ফুল’। পদ্মজা আগ্রহ নিয়ে প্রতিটি লাইন পড়ে। সাংবাদিক লিখনকে প্রশ্ন করেছেন, ‘ত্রিশ তো পার হয়েছে। বিয়ে করবেন কবে?’
লিখন জানিয়েছে,’সে যখন আসবে।’
‘আমরা কী জানতে পারি,কে সে? যদি দ্বিধা না থাকে।’
‘জানাতে আমার বাধা নেই। সে পদ্ম ফুল। আমার সাতাশ বছরের কঠিন মনে তোলপাড় তুলে দিয়েছিল। সেই তোলপাড়ের তাণ্ডব বুকের ভেতর আজও হয়। সেই ফুলের সুবাস নাকে আজও লেগে আছে। শুধু আমি তাকে জয় করতে পারিনি।’

লিখন শাহর সাক্ষাৎকারের কথোপকথন বেশ তোলপাড় তুলে ঢাকায়। এরকম একজন সুদর্শন পুরুষকে কোন নারী অবহেলা করেছে? তা নিয়ে মানুষের কত কল্পনা-জল্পনা, আলোচনা -সমালোচনা। পদ্মজার অস্বস্তি হয় খুব।

পূর্ণা পদ্মজাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকল,’ঘুমিয়ে গেলে আপা?’
‘না। তারপর বল।’ নিস্তরঙ্গ গলায় বলল পদ্মজা।

ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক,শিয়ালের হাঁক ভেসে আসছে কানে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। তবুও কথা শেষ হচ্ছে না পূর্ণা-প্রেমার। পদ্মজাও মানা করছে না। বরং অবাক হচ্ছে,তার বোনেরা কত কথা লুকিয়ে রেখেছে তার জন্য!

_____________
কাক ডাকা ভোর। ঘন কুয়াশায় চারপাশ ডুবে আছে। বাতাসের বেগ বেশি। ঠান্ডায় ঠোঁট কাঁপছে। পদ্মজার পরনে দামী,গরম সোয়েটার। আবার শালও পরেছে। বাসন্তী সুতি সাদা শাড়ি পরে রান্না করছেন। মাঝে মাঝে কাঁপছেন। পদ্মজা দ্রুত পায়ে রান্না ঘরে ঢুকল। বাসন্তী পদ্মজাকে দেখে হেসে বললেন,’কিছু লাগবে?’
পদ্মজা খেয়াল করে দেখল বাসন্তীর মুখটা ফ্যাকাসে। ঠান্ডায় এমন হয়েছে। সে শক্ত করে প্রশ্ন করল,’আপনার শীতের কাপড় নেই?’
বাসন্তী হেসে বলল,’আছে তো।’
‘তাহলে এভাবে শীতে কাঁপছেন কেন? নামায পড়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। বয়স হয়েছে তো। যান ঘরে যান।’
‘ভাত বসিয়েছি।’
‘আমি দেখব।’
‘সারারাত তো সজাগ ছিলে আম্মা। তুমি ঘুমাও। আমি রাতে ঘুমিয়েছি।’
‘তাহলে সোয়েটার পরে আসেন।’
বাসন্তী মাথা নত করে বসে রইলেন। পদ্মজা বেশ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এরপর নিজের গায়ের শাল বাসন্তীর গায়ে দিয়ে বলল,’নিজের জন্যও কিছু কেনা উচিত। পূর্ণা বয়সে বেড়েছে বুদ্ধিতে না। ও পারে না কিছু সামলাতে। শুধু আবদার করতে পারে। যতদিন বেঁচে আছেন নিজের যত্ন নিন। আমি ঘরে যাচ্ছি।’

পদ্মজা রান্নাঘর ছেড়ে বারান্দার গ্রিলে ধরে বাইরে তাকাল। কুয়াশার জন্য বাড়ির গেইটও দেখা যাচ্ছে না। সে ঘুরে দাঁড়াল ঘরে ঢোকার জন্য। তখন মনে হলো, উঠানে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজা আবার ঘুরে তাকাল। দেখতে পেল,তার শ্বাশুড়ি ফরিনাকে। তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে আছে। শুকিয়েছে খুব বেশি। গায়ে লাল-সাদা রঙের মিশ্রণে শাড়ি। ফরিনার চারপাশে উড়ো কুয়াশা। কুয়াশার দেয়াল ভেদ করে যেন তিনিই শুধু আসতে পেরেছেন। পদ্মজা হন্তদন্ত হয়ে বের হলো। কাছে এসে দাঁড়াতেই বুকটা হুহু করে উঠল। ফরিনা পদ্মজাকে দেখে কেঁদে দিলেন। পদ্মজা ফরিনার খুব কাছে এসে দাঁড়াল। পা ছুঁয়ে সালাম করল। এরপর ফরিনার ঠান্ডা দুই হাত ধরে বলল,’এতো সকালে কেন আসতে গেলেন? আমরা তো যেতামই।’
‘এতো রাগ তোমার?’
‘না,আম্মা। আপনার প্রতি কোনো রাগ নেই আমার। আট মাস আপনি আমার যে যত্ন নিয়েছেন মায়ের অভাববোধ করিনি। মনে হয়েছিল, আমার মা ছিল আমার পাশে।’
‘তাইলে কেরে যাও না আমার কাছে? আমার ছেড়ায় কেন মুখ ফিরায়া নিছে আমার থাইকা?’
‘উনি পাগল। আম্মা, আপনি কেমন আছেন? দেখে বোঝা যাচ্ছে,ভালো নেই। আম্মা বিশ্বাস করুন,আপনার প্রতি আমাদের রাগ নেই। ওই বাড়িটা দেখলে খুব কষ্ট হয় আম্মা। খুব যন্ত্রনা হয়। এজন্য যাই না। আপনাকে অনেকবার চিঠি লিখেছি, যেন ঢাকা গিয়ে কয়দিন থেকে আসেন। গেলেন না কেন?’
ফরিনা অবাক হয়ে বললেন,’আমার কাছে তো কুনু চিডি আসে নাই।’
‘সেকী! আমি তো এই চার বছরে ছয়টা চিঠি লিখেছি আপনার নামে। পাঠিয়েছিও।’
‘আমি তো পাই নাই।’
ফরিনা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পদ্মজা বলল, ‘আচ্ছা এ ব্যাপারে কথা বলব উনার সাথে। আমি যখন আম্মার কবর জিয়ারত করতে আসি তখনও তো এসে আমাকে আর উনাকে দেখে যেতে পারতেন আম্মা।’
‘তোমরা বাড়িত যাও না বইলা,আমি ভাবছি আমারে ঘেন্না করো তোমরা তাই সামনে আইতে পারি নাই। আমার জন্যও আমার নাতনিডা…’

ফরিনা হুহু করে কেঁদে উঠলেন। পদ্মজার চোখ ছলছল করে উঠল। সে ফরিনাকে বলল,’আপনার জন্য কিছু হয়নি আম্মা। আপনি এভাবে ভাববেন না। কান্না থামান।’

‘যতই বলো মা,কান্না থামাবে না। চার বছর ধরে এভাবে কাঁদছে।’
মজিদের কণ্ঠস্বর শুনে পদ্মজা দ্রুত ঘোমটা টেনে নিল। মজিদকে সালাম করে বলল,’ভালো আছেন আব্বা?’
‘এইতো আছি কোনোমতে।’
‘আম্মা,আপনি কান্না থামান। আমার খারাপ লাগছে।’
ফরিনা আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছলেন। এরপর বললেন,’আমার বাবু কই?’
‘ভেতরের ঘরে ঘুমাচ্ছে। ডেকে দিচ্ছি।’
‘না,থাহক। ঘুমাক।’

পদ্মজা শ্বশুর, শ্বাশুড়িকে সদর ঘরে নিয়ে আসে। আস্তে আস্তে সবার ঘুম ভাঙে। আমির যত যাই বলুক, মাকে দেখেই নরম হয়ে যায়। জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করে। মজিদ ছেলে আর ছেলের বউকে ছাড়া কিছুতেই বাড়ি যাবেন না। কম হলেও চার-পাঁচ দিন থেকে আসতে হবে। অবশেষে, আমির রাজি হলো। প্রেমার সামনে পরীক্ষা তাই প্রেমাকে সাথে নিল না। বাসন্তী, প্রেমা,প্রান্ত বাড়িতে রয়ে যায়। পূর্ণা সাথে যায়।

_______________
হাওলাদার বাড়ির গেইট পেরিয়ে ভেতরে পা দিতেই পদ্মজার সর্বাঙ্গ অদ্ভুত ভাবে কেঁপে উঠে। সূর্য উঠেনি। দমকা বাতাস হচ্ছে। সেই বাতাসে সাঁ সাঁ শব্দ হচ্ছে। মাথার উপর দিয়ে বাজপাখি উড়ে যায়। সেই পাখির ডাক অদ্ভুত হাহাকারের মতো। যেনও মনের চেপে রাখা কষ্ট ও ক্ষোভ নিয়ে কেউ আত্মচিৎকার করছে। নাকি এটা নিছকই পদ্মজার ভাবনা? চারদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে আলগ ঘর পেরিয়ে অন্দরমহলের সামনে এসে দাঁড়াল সে। চার বছর পূর্বেই তো এখানে এই জায়গাটায় তার আদরের তিন মাসের কন্যা পারিজার রক্তাক্ত লাশ পড়ে ছিল! পদ্মজার বুক কেমন করে উঠল! বুকে হাত রেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। আমির উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল,’খারাপ লাগছে?’
পদ্মজা স্বাভাবিক হয়ে বলল,’না।’
থামল, নিঃশ্বাস নিল। এরপর বলল,’ পূর্ণাকে দেখুন,কেমন পাগল।’

আমির সামনে তাকাল। পূর্ণা মাথার উপর ব্যাগ নিয়ে সবার আগে বড়ই খেয়ে খেয়ে কোমর দুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে! অন্দরমহলের সামনে এবং আলগ ঘরের পিছনের মধ্যিখানে টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। হেমন্তকালে ধান কাটা হয়েছে,তখন কামলারা আলগ ঘরে থেকেছে। তাদের জন্যই এই টিউবওয়েল বসানো হয়েছিল। টিউবওয়েলের চারপাশে গোল করে সিমেন্ট দিয়ে মেঝেও করা হয়েছে। সব মিলিয়ে একটা কলপাড় তৈরি হয়েছে। পূর্ণা নারিকেল গাছের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। কলপাড়ে এক সুদর্শন যুবক পিঁড়িতে বসে গোসল করছে। পরনে লুঙ্গি। রানি গামছা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী যেন বলছে। পূর্ণা ব্যাগ রেখে হা করে সেই যুবককে পরখ করে। সুঠম,সুগঠিত শরীর,মায়াবী- ফর্সা স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ত্বক। প্রশস্ত বুকে ঘন পশম। চওড়া পিঠ। শক্তপোক্ত দেখতে দুই হাত। ডান হাতে ছোট কলস নিয়ে মাথায় পানি ঢালছে। সেই জল চুল থেকে কপাল,কপাল থেক ঠোঁট,ঠোঁট থেকে বুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ চুল ঝাঁকি দিয়ে উঠল। জলের ছিটা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। রানি যুবকটিকে বকতে বকতে দূরে সরে দাঁড়ায়। যুবকটি আবারও মাথায় পানি ঢেলে চুল ঝাঁকায়। উদ্দেশ্য, রানিকে ভিজিয়ে দেয়া। পূর্ণা মুগ্ধ হয়ে গেল। সে দ্রুত ব্যাগ মাটিতে রেখে দিল। ওড়না ঠিক করে,চুল ছেড়ে দিল। এরপর কলপাড়ের দিকে হেঁটে গেল। ঠোঁটে তার হাসি। চোখের দৃষ্টি দেখলে যে কারো মনে হবে, পূর্ণা অপরিচিত এই যুবকটিকে চোখ দিয়ে পিষে ফেলছে। কলপাড়ের পাশে ভেজা কাদা ছিল। পূর্ণা পা রাখতেই পিছলে পড়ে যায়। ধপাস শব্দ শুনে যুবকটি লাফিয়ে উঠে ভরাট কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, ‘বোয়াল মাছ! বোয়াল মাছ!’

চলবে…
®ইলমা বেহরোজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ