#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
শেষ পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz
অন্ধকার কমন রুমে একাকি বসে জানালার ফাঁক দিয়ে উষসীকে দেখার চেষ্টা করছে সাজিদ। এই কাজটা সে রোজই করে। এই সময় ব্রেকটাইমে কমন রুমের ব্যাকসাইডে দাঁড়িয়ে স্মোক করতে করতে তাকে দেখতে এতো ভালো লাগে যে এক মুহুর্তও চোখের পলক ফেলা যায় না।
সাজিদ মুগ্ধ হয়ে দেখে। একটা মেয়ে মানুষের শান্ত হয়ে বসে থাকার মধ্যেও কি করে এতো শৈল্পিক ভাব থাকতে পারে?
সাজিদের মনে উষসীকে নিয়ে একটা অদ্ভুত কল্পনার জগৎ তৈরী হয়েছে। এই উদ্ভট ভাবনাগুলো ভুল করেও যদি উষসী জেনে যায় তাহলে নিশ্চয়ই খুব হাসবে।সাজিদ তার প্রিয় রমণীর কাছে হাসির পাত্র হতে চায় না। কিন্তু আজ সে ধরা পড়ে গেল। তাও হাতে-নাতে ধরা।
” কিছু বলবেন সাজিদ ভাই?”
সাজিদ চমকে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। উষসী তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একহাতে সিগারেট নিভিয়ে ছুঁড়ে ফেলল সে। কখন যে উষসী এখানে চলে এসেছে তা টেরও পায়নি সাজিদ। আমতা-আমতা করে বলল, “কিছু না, ম্যাডাম।”
” আপনার সমস্যা কি? আমাকে বলুন তো। সারাদিন দেখছি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রিভিয়াস মিটিং-এও খুব অন্যমনস্ক ছিলেন। আপনার মতো সিনসিয়ার ইমপ্লয়ির থেকে এমন আচরণ আশা করা যায় না।”
সাজিদ মাথা নিচু করে ভাবল, সেদিন প্রেজেন্টেশনে ছিল উষসী। সে একটা লেবুপাতা রঙের শাড়ি পরেছিল। কি অসম্ভব মিষ্টি লাগছিল তাকে! ওই মুহূর্তে উষসী ছাড়া অন্যকিছু চিন্তা করাই সাজিদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। তাছাড়া সে আশেপাশে থাকলে সাজিদের কাছে এ পৃথিবী তুচ্ছ মনে হয়। ইচ্ছে করে ওই মুখের দিকে আজন্ম চেয়ে থাকতে।
উষসী দুঃখিত গলায় বলল,” কোনো ফ্যামিলি প্রবলেম?”
সাজিদ হাসতে চেষ্টা করল। উষসীর গাঁয়ে একরঙা শাড়ি। মুখে না আছে কোনো প্রসাধন আর গায়ে না আছে কোনো অলংকার। সে এভাবেই সাধারণ থাকে। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ খুব সাজে। সেদিন হাত ভরে এক ডজন চুড়ি পরে এসেছিল। কালো চুড়ি আর সোনালি শাড়িতে তাকে যে কি মানাচ্ছিল! সাজিদ সেদিনই ঠিক করেছে উষসীকে এক ডজন চুরি গিফট করবে। কিন্তু করলে কি সে সেটা পরবে? কে জানে? ব্যাপারটা হয়তো খারাপ দেখাবে। সে সাধারণ ইমপ্লয়ি হয়ে মেনেজারকে চুড়ি গিফট করতে পারে না।
উষসী বলল,” সাজিদ ভাই, আপনি অন্ধকারে একা বসে কি করছিলেন?”
” মঈনুলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম ম্যাডাম। ও আমাকে এইখানে বসিয়ে রেখে বাথরুমে ঢুকেছে। এখনও আসছে না।”
উষসীর ভ্রু কুঁচকে গেল। হতাশ গলায় বলল,” আপনার কি হয়েছে সাজিদ ভাই? মিথ্যা কেন বলছেন? মঈনুলের সাথে আমার একটু আগেই তিনতলায় দেখা হয়েছিল। সে তো নিজেই আপনাকে খুঁজছে!”
এই কথার পর সাজিদের খুব অস্বস্তিবোধ করা উচিৎ ছিল। কিন্তু সে অস্বস্তি বোধ করল না৷ কারণ উষসী কথাটা বলে খুব সুন্দর করে হেসেছে। সাজিদের ধারণা এই মহিলা জাদুবিদ্যা জানে। তার অর্ধেক জাদু হাসিতেই লুকানো। কেউ যদি খুব জটিল কোনো সমস্যায় পড়ে আর এই মহিলা তার সামনে গিয়ে একবার হাসে তাহলে মুহুর্তেই সেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ম্যাজিকের মতো!
উষসীর বাড়ি ফিরতে আজ খুব রাত হয়নি। আজ-কাল সে দ্রুত বাড়ি ফেরার চেষ্টা করে। রাত যত গভীর হয় ততই বিপদের আশংকা বৃদ্ধি পায়। উষসী যতটা না বিপদের পরোয়া করে তার থেকেও পরোয়া করে নিয়ম-কানুনের। সে সময় সম্পর্কে সচেতন থাকতে পছন্দ করে।
সাতবছরে উষসীর জীবনে আরও অনেক পরিবর্তন এসেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হলো সে এখন সাবলম্বী। বাড়িতে তার কথা ছাড়া একটা ধুলিকণাও কেউ সরাতে পারে না। এখানে সে নিজেই কর্তা আবার নিজেই কর্তী। উষসী কখনও চিন্তা করেনি তার জীবন এইভাবে বদলে যাবে। বাড়িতে ঢুকতেই আয়শা দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিল,” আসসালামু আলাইকুম আপা, আজকে এতো দেরি করলেন? আপনার জন্য ডিনার নিয়ে বসে আছি। এখন খাবেন?”
উষসী আয়শার দিকে তাকিয়ে শুধু একটু হাসল।তারপর ভেতরের ঘরে চলে গেল। আয়শা তার পেছন পেছন আসছে। দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করল সে। ঘরটা হিমশীতল। এসি খুব জোরে চলছে। উষসী নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল,” এসি’র পাওয়ার এতো কম কেন?”
” মামণির নাকি সন্ধ্যা থেকে খুব গরম লাগছে।”
উষসী দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। হঠাৎ গরম, হঠাৎ ঠান্ডা… এসব তো কোনো ভালো লক্ষণ না। সে আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকল।
চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে মাইশা। ঘুমাচ্ছে নাকি জেগে আছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। উষসী তার একটা হাত আদরের মেয়ের কপালে রাখল। ওমনি মেয়েটি চোখ খুলে তাকাল। চোখ খোলার আগেই তার মুখে একটু হাসি ফুটেছিল। অর্থাৎ সে মায়ের স্পর্শ চেনে।উষসী মিষ্টি করে বলল,” কেমন আছে আমার আম্মু?”
” তুমি কখন এসেছো মাম্মা?”
” এইতো, মাত্রই এলাম।”
” ডিনার করেছো?”
” তোমার সাথে দেখা না করে আমি কখনও ডিনার করি?”
এই কথা বলেই মেয়ের কপালে চুমু দিল উষসী। মাইশা আহ্লাদী হাসল। উষসী বলল,” এইতো এখন যাবো। ফ্রেশ হয়ে ডিনার করবো। তুমি বলো। আজকে সারাদিন কি কি করেছো?”
” আয়শা আন্টি যা রান্না করে দিয়েছে তাই খেয়েছি। টিভি দেখেছি।”
” খাবার ভালো লাগে?”
” হ্যাঁ।”
” আয়শা, তোমাকে না বলেছি ওকে গল্পের বই পড়ে শোনাতে? শোনাও?”
” শোনাই তো আপা। আজকেও শুনিয়েছি৷ তিনটি বই পড়ে শুনিয়েছি। কিন্তু ও শুধু বাইরে যেতে চায়। ”
উষসী মেয়েকে আদর করে বুঝিয়ে বলল,” সবসময় বাইরে যেতে হয় না, মা।”
মাইশা মুখ গোমরা করে বলল,” কি করব? সারাদিন শুয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে না।”
” ঠিকাছে, ছুটির দিন আমি তোমাকে অনেক দূরে ঘুরতে নিয়ে যাব। হ্যাপি?”
মাইশা মাথা নাড়ল। সে খুব খুশি।
” ওকে। আমি খুব টায়ার্ড মা। যাই খাওয়া-দাওয়া করি। তারপর এসে তোমাকে গল্প শোনাবো। আমি আজকেও তোমার সাথেই থাকবো।”
” থ্যাংকিউ।”
” আয়শা, আমি ফ্রেশ-টেশ হয়ে আসি। তুমি ততোক্ষণ মাইশার কাছে বসে থাকো। ওকে একা রাখার দরকার নেই।”
” আচ্ছা ভাবি।”
উষসী ঘর থেকে বের হয়েও উঁকি দিয়ে আবার ভেতরে তাকাল। তৃপ্তি নিয়ে নিজের মেয়েটাকে দেখল। মাত্র ছয় বছর বয়সী মেয়েটার জীবন একটা ছোট্ট ঘরে আটকে আছে। এই বয়সে বাচ্চারা কত চঞ্চল হয়। এই ঘর, সেই ঘর দৌড়ে বেড়ায়। অথচ তার মেয়েটা…. চাপা ব্যথায় বুক হু হু করে উঠল উষসীর। ছয়বছর আগে যখন মাইশার জন্ম হয়েছিল তখন সবাই ধরেই নিয়েছিল বাচ্চাটা মৃ”ত। প্রায় দেড় ঘণ্টা যাবৎ সে কোনো শব্দ করেনি। নড়াচড়াও না। কাঁদতে কাঁদতে সবাই অস্থির হয়ে পড়েছিল। সেই অভিশপ্ত দিনের কথা মনে পড়লে আজও উষসীর গা কাটা দেয়। তারপর হঠাৎ মাইশা কেঁদে ওঠে। উষসী তার মোমের মতো ফরসা পুতুলটাকে চোখের সামনে জীবন্ত হতে দেখে। তার প্রাণ ফিরে আসে। সেজন্যই ওর নাম রাখা হয়েছে মাইশা। যার অর্থ-জীবন্ত। হোক না সে প্রতিবন্ধী, দুই পা প্যারালাইজড। তবুও তো সে জীবন্ত। এটাই উষসীর কাছে বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ। জীবনের একমাত্র সুখ।
বেডরুমে এসে বিছানায় বসেছে মাত্র, ওমনি উষসীর মোবাইল বেজে উঠলো। সে জানে ইয়ামিনের ফোন এসেছে। উষসী এটাও জানে যে ঠিক এইসময় ফোনটা আসবে। উষসী যতক্ষণ ফোন না ধরবে ততক্ষণ বাজতেই থাকবে।
সাজিদ ক্যান্টিনে বসে আছে। তার থেকে দশফুট দূরত্বের একটি টেবিলে বসেছে উষসী। একহাতে ফোন টিপছে, অন্যহাতে খাবার খাচ্ছে। হঠাৎ সাজিদ নিজের টেবিল ছেড়ে উঠে উষসীর কাছে এসে বসল। ভদ্রতার খাতিরে মুচকি হাসল উষসী।
সাজিদ বলল,” ম্যাডাম, কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম।”
সে রীতিমতো ঘামছে। উষসী হেসে বলল,” এতো হেজিটেড ফীল করার কিছু নেই। আপনি বলতে পারেন।”
” মানে… সেদিন আপনি আপনার হাজব্যান্ডের ব্যাপারে বলছিলেন। হঠাৎ আপনার জরুরী ফোন এসে গেল। মাইশা মামনির অসুস্থতার খবর শোনার পর আপনি দ্রুত বের হয়ে গেছিলেন। পুরো কাহিনীটা আর শোনা হয়নি। কিন্তু বাকিটা আমি জানতে চাই।”
উষসী মৃদু হেসে টোস্টে কামড় দিয়ে বলল,” ও আচ্ছা। তাই বলুন। কোথায় যেন ছিলাম আমরা?”
” ওইতো… প্লেন ক্র্যাশ করেছিল৷ তারপর পুলিশ এলো ডেডবডি আইডেন্টিফিকেশনের জন্য। আর আপনি জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।”
উষসীর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ থম মেরে স্বচ্ছ পানির গ্লাসের দিকে চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল একটা। ধরা গলায় বলতে লাগল,” সেদিনের কথা মনে করলেও আমার দম বন্ধ হয়ে আসে সাজিদ ভাই৷ ওই একটা ঘটনা আমার পুরো পৃথিবী বদলে দিতে পারতো।”
” কি হয়েছিল? ওই ডেডবডি আপনি কি পরে চিনতে পেরেছিলেন?”
উষসী ভ্রু কুঁচকে বলল,” একদম না। চিনতে পারার প্রশ্নই আসে না। কারণ ওটা ইয়ামিনের ডেডবডি ছিল না।”
” ছিল না?” সাজিদ হতভম্ব।
উষসী উৎফুল্ল চিত্তে বলল,” না। ইয়ামিন আসলে ওই প্লেনে ওঠেনি সেদিন। আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। হসপিটালের একটা কেবিনে নিয়ে আমাকে সেলাইন দেওয়া হলো। আমি পুরোপুরি সেন্সলেস ছিলাম। তারপর হঠাৎ ইয়ামিন আমার কেবিনে ঢুকল। তাকে দেখে প্রথমে মনে হলো আমি বুঝি স্বপ্ন দেখছি। তারপর সে যখন আমার কপালে হাত রাখল, আমি বুঝতে পারলাম ওটা স্বপ্ন ছিল না। সত্যি ছিল! আমি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। তাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। ডাক্তার, নার্স এবং কেবিনের পেশেন্টরা আমার কান্ডে স্তম্ভিত। ইয়ামিন লজ্জা পেয়ে কি বলল জানেন? ‘ছাড়ো উষুপাখি, সবাই দেখছে তো। কি ভাববে? তুমি তো আমাকে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছো।’ আমি বললাম,’যে যা খুশি ভাবুক। আমি আপনাকে ছাড়ব না। কখনও না। কথা দিন যে আমাকে ছেড়ে আর যাবেন না। কথা দিন। সে কথা দিয়েছিল। আর সে তার কথা রেখেছেও।’
উষসী হাসল। টিস্যু দিয়ে চোখের জল মুছল। সেই আনন্দময় মুহূর্তের কথা চিন্তা করে তার আবারও কান্না পাচ্ছে। সুখের কান্না। সাজিদ বলল,” স্যার এয়ারপোর্টে গিয়েছিলেন অথচ ফ্লাইটে উঠলেন না কেন?”
” জানি না। হয়তো শেষ মুহূর্তে তার মন সায় দেয়নি। সে বুঝতে পেরেছিল ফ্লাইটে উঠলে আমার সাথে আর দেখা হবে না। ভাগ্যিস সে ওঠেনি সেদিন। নাহলে আমি তাকে কোথায় পেতাম, বলুন?”
সাজিদ তাকিয়ে আছে হা করে। উষসী হাসিমুখে কাঁদছে। তার দেহ এখানে থাকলেও মনটা ফিরে গেছে সাতবছর আগের স্মৃতিতে। মেসেজ টোন বেজে উঠল হঠাৎ। উষসী ফোনটা হাতে নিয়েই হৃষ্টচিত্তে বলল,” এইতো, ও মেসেজ করছে। নিচে দাঁড়িয়ে আছে হয়তো। আজকে আমি হাফ ডে নিয়েছি। কারণ আমরা শপিং-এ যাবো। আচ্ছা, আমি উঠছি, হ্যাঁ? ওকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করানো ঠিক হবে না। ভালো থাকবেন সাজিদ ভাই। কাল দেখা হবে।”
সাজিদ কিছু বলল না। উষসীর চোখ ঝলমল করছে। সে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে চঞ্চল পায়ে হাঁটতে লাগল। তার চলে যাওয়ার দিকে বিষণ্ণ চোখে চেয়ে রইল সাজিদ। একহাতে চোখের জল মুছে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইয়ামিন। উষসী দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,” কেমন আছো তুমি? এতোক্ষণ পর মনে পড়ল আমার কথা? জানো আমি কত্ত মিস করেছি তোমাকে?”
ইয়ামিন হকচকিয়ে বলল,” সিরিয়াসলি? তুমি আমাকে মিস করেছো? কি সৌভাগ্য আমার!”
উষসী বামহাতে ইয়ামিনের বাহুতে চাপড় দিল। এবার ফিক করে হেসে উঠল সে। সেই হাসির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে উষসী বলল,” দুইদিন পর আমাদের মেয়ের জন্মদিন। মনে আছে?”
ইয়ামিন তার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,” নিশ্চয়ই মনে আছে মিষ্টি বউ। তার আগে তুমি বলোতো, এই অবস্থা কেন তোমার? দেখতে খুব পানসে লাগছে। একটুও সাজোনি৷ তোমাকে না বলেছি, সবসময় সাজ-গোজ করবে?”
” বুড়ো বয়সে এতো সাজলে মানুষ কি বলবে?”
” বুড়ো মানে? কে বুড়ো?”
” এখন আমি একবাচ্চার মা। ভুলে গেছো? বুড়োই তো। আগের মতো এতো সাজতে ভালো লাগে না।”
” ভালো না লাগলেও সাজতে হবে। আমার জন্য। আমি দেখব।”
উষসী লাজুক মুখে বলল,” আচ্ছা বাবা, ঠিকাছে৷ সাজবো৷ এবার চলোতো। তোমার মেয়ের জন্য একটা ইলেকট্রিক চেয়ার কিনবো আমি। পছন্দ করে রেখেছিলাম৷ মাইশার প্রিয় কালার।”
” তাই নাকি?”
” হুম। ওই চেয়ার পেলে আশা করি সে দ্রুত হাঁটতে শিখবে।”
” তুমি চিন্তা কোরো না উষু। ও আমার মেয়ে। অবশ্যই ও খুব দ্রুত হাঁটা শিখবে। তোমার সব কষ্টের অবসান হবে।”
উষসী ইয়ামিনের কাঁধে মাথা রেখে বলল,” আমার কোনো কষ্ট নেই বিশ্বাস করো। তুমি আমার পাশে আছো। এক জীবনে এর থেকে বেশি আমি আর কিছুই চাই না।”
উষসীর চোখে পানি জমে উঠল। ইয়ামিন আলতো হাতে সেই পানি মুছে দিয়ে আদুরে গলায় বলল,” আমার মিষ্টি বউ। একদম কাঁদে না।”
উষসী তখনি হাউমাউ করে কান্না শুরু করল।
আজ মাইশার সপ্তম জন্মদিন। বাড়ি ভর্তি মেহমান। উষসী একদম নিশ্বাস ফেলার ফুরসত পাচ্ছে না। খুবই ব্যস্ত সে। মাইশা হুইল চেয়ারে করে পুরো বাড়ি ঘুরছে। কোথায় কোন জিনিস লাগাতে হবে, কেমন ডেকোরেশন তার পছন্দ, এসবের তদারকি করছে।
” হ্যাপি বার্থডে মাই ডিয়ার সিস।”
পেছনে চাইতেই একগুচ্ছ সাদা গোলাপ আর একটা বড় র্যাপিং পেপারে মোড়ানো গিফট হাতে দেখা গেল তৃষ্ণাকে। মাইশা চেঁচিয়ে বলল,” তৃষ্ণা ভাইয়া, তুমি এসেছো? আমি তো ভেবেছিলাম আসবেই না!”
শেষ বাক্যে অভিমান প্রকাশ পেল। তৃষ্ণা নিচু হয়ে মাইশার গাল টেনে বলল,” তোর বার্থডেতে আমি আসব না মানে? পাগল হয়েছিস?”
” কিন্তু খালামণির কাছে শুনলাম তোমার নাকি এক্সাম?”
” এক্সাম চুলায় যাক। আমার বোনের হাসি সবার আগে।”
মাইশা খিলখিল করে হেসে উঠল। তার মন আজকে সারাদিন খারাপ ছিল। কিন্তু তৃষ্ণাকে দেখে এখন অসম্ভব ভালো লাগছে। তৃষ্ণা ওর হাতে গোলাপের বুকেট আর গিফট তুলে দিয়ে বলল,” এর মধ্যে কি আছে? গেস করতে পারবি?”
গিফটের সাইজ দেখেই মাইশা বুঝে গেল। চোখ ছোট করে সামান্য রহস্যের ভঙ্গিতে বলল,” গিটার নাকি?”
তৃষ্ণার চোখ বড় হয়ে গেল। বিস্ময় নিয়ে বলল,” বুঝলি কিভাবে তুই?”
” তুমিই একবার বলেছিলে… আমাকে জন্মদিনে গিটার গিফট করবে। আমি ভুলিনি।”
” ও এই ব্যাপার? এখন তাহলে গিটারটা বাজিয়ে দেখা।”
” না ভাইয়া। এটা আজকে তোলা থাকুক। আমি মাকে প্রমিস করেছিলাম, আজকে শুধু বাবার গিটার বাজাবো।”
” ওহ, ঠিকাছে।”
” আচ্ছা, তুমি একা কেন? নানুরা কোথায়?”
” আসছে সবাই। ওইতো।”
তৃষ্ণা মাইশার হুইল চেয়ার টেনে তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেল। যুথি, ডোনা, উষ্ণতা আর তৃষাণের কাছে। সবাই মাইশাকে জন্মদিনের অভিবাদন জানিয়ে আদর করে দিল। তারপর মাইশা গিটার বাজিয়ে একটা গান ধরল।
রান্নাঘর থেকে সেই গানের সুর শুনে উষসী উত্তেজিত হয়ে উঠল হঠাৎ। ইয়ামিন বলল,” কে গান গাইছে?”
” কে আবার? তোমার মেয়ে! একদম তোমার মতো হয়েছে। কি সুন্দর গিটার বাজাচ্ছে দেখেছো?”
” হুম৷ তাইতো দেখছি। একদিন দেখবে ও আমাকেও ছাড়িয়ে যাবে।” ইয়ামিন গর্ব করে বলল। উষসীর চোখে আবার পানি চলে আসছে। সে দৌড়ে লিভিংরুমে গেল। মাইশাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। ছোট্ট হাতে গিটার বাজিয়ে কি সুন্দর গান গাইছে মাইশা। উষসী মুগ্ধ হয়ে দেখছে। মেয়ের মধ্যে বাবার ছায়া উপলব্ধি করে সে এক অকৃত্রিম শান্তি পায়। ইয়ামিন তার পাশে এসে দাঁড়াল হঠাৎ। কাঁধে হাত রাখল। ফিসফিস করে বলল,” আমার মেয়ে।”
উষসী বলল,” উহুম। আমাদের মেয়ে। আমাদের চোখের মণি।”
সাজিদ আশেপাশে উষসীকে খুঁজছে। কোথাও সে নেই। উষ্ণতা সবাইকে কোল্ডড্রিংক সার্ভ করছে। সাজিদের কাছে আসতেই সে বলল,” আপনি মনে হয়, তৃষাণ স্যারের ওয়াইফ। তাই না?”
” জ্বী। আপনি?”
” আমি উষসী ম্যাডামের কলিগ। অফিসে উনার আন্ডারেই কাজ করি।”
উষ্ণতা হেসে বলল,” ও আচ্ছা। তৃষ্ণার বাবার কাছে একবার শুনেছিলাম আপনার কথা।”
” আচ্ছা, ম্যাডাম কোথায়?”
উষ্ণতা আশেপাশে তাকাল। উষসী এখানে নেই। হয়তো রান্নাঘরে আছে। সে সবসময় একাই থাকে। ভীড়ের মধ্যে আসতে চায় না। কেক কাটার সময়ও তাকে পাওয়া গেল না। এদিকে মাইশা জেদ ধরে বসে আছে। মাকে ছাড়া সে কিছুতেই কেক কাটবে না।
যুথি ফিসফিস করে উষ্ণতাকে বললেন,” কোথায় আছে মেয়েটা? একটু খুঁজে দ্যাখ।”
উষ্ণতা মাথা নেড়ে উষসীকে খুঁজতে গেল৷ দুইতলার করিডোরে একা দাঁড়িয়ে আছে উষসী। তার হাতে এক মগ ধোঁয়া ওঠা গরম কফি৷ একই রকম আরেকটা কফির মগ সামনে। সেই মগের দিকে চেয়ে উষসী আপন মনে বিড়বিড় করছে। উষ্ণতা তার কাছে গিয়ে কাঁধ চেপে ধরল,” উষু, বোন আমার! নিচে সবাই তোর অপেক্ষায় আছে। তুই এখানে একা দাঁড়িয়ে কি করছিস বোন?”
উষসী গম্ভীর গলায় বলল,” অদ্ভুত কথা বলবে না আপু। আমি মোটেও একা দাঁড়িয়ে নেই। আমার সাথে ইয়ামিন আছে। তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না ওকে?”
উষ্ণতার চোখ ভিজে এলো। দূর্বল গলায় বলল,”এসব কি বলছিস? এখানে তো কেউ নেই। আমার কথা বিশ্বাস কর লক্ষী বোন।”
” তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো। প্লিজ, আমার সুখ নষ্ট কোরো না। যাও এখান থেকে। ”
উষসী উষ্ণতাকে ধাক্কা মারতে লাগল। উষ্ণতা সরল না। শক্ত হাতে বোনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল,” বোন আমার। প্লিজ তুই পাগলামিটা বন্ধ কর। তোর মেয়েটার কথা ভাব। তুই যদি এখনও এমন করিস তাহলে মাইশার কি হবে বল?”
উষসী পাথরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। কোনো কথা বলল না।
অনেকক্ষণ পর উষসীকে নিয়ে নিচে নামল উষ্ণতা। সবাই দেখল উষসীর মুখ শক্ত। অনুভূতিহীন মানুষের মতো হেঁটে আসছে সে৷ তৃষাণ কাছে গিয়ে উষসীর কাঁধে হাত রাখল। নরম কণ্ঠে বলল” কি ব্যাপার উষু? এতোক্ষণ কোথায় ছিলে? তোমার জন্য মাইশা অপেক্ষা করছে তো। এসো।”
উষসী শান্ত পায়ে হেঁটে গেল মেয়ের কাছে। মেয়ের মাথায় হাত রাখল। যুথি উষসীর অবস্থা দেখে চোখের জল মুছছেন। আয়শারও কান্না পাচ্ছে। বিগত সাত বছর ধরেই উষসীর এই হাল। সে চিকিৎসাধীন আছে। ডাক্তার বলেছেন সবসময় তাকে ব্যস্ত রাখতে হবে। তাই তৃষাণ নিজের অফিসের মেনেজারের পদে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে উষসীকে। কিন্তু আফসোস, তার অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।
মাইশা চারদিকে তাকিয়ে দেখল হঠাৎ করেই যেন সবার মনখারাপ হয়ে গেছে। খুশি খুশি পরিবেশটা আর নেই। সে দুঃখী দুঃখী পরিবেশেই কেক কাটল। মাকে কেক খাইয়ে দিল। উষসীও তার মেয়ের মুখে কেক দিল। তারপর এক টুকরো কেক নিয়ে সে ভীড় থেকে বের হয়ে এলো। তার চোখমুখ বিষণ্ণ লাল। তাকে কেউ বাঁধা দিল না।
সাজিদ উষসীর পেছনে আসতে আসতে বলল,” ম্যাডাম, কোথায় যাচ্ছেন?”
উষসী থামল। তার চোখ ভর্তি জল। সে অপরাধী কণ্ঠে বলল,” সাজিদ ভাই, আমাকে মাফ করে দিবেন।”
” এই কথা কেন বলছেন ম্যাডাম?”
উষসী কাঁদতে শুরু করল। সাজিদ তড়িঘড়ি করে পকেট থেকে রুমাল বের করল। উষসী অবশ্য রুমাল নিল না। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে নিয়ে হতাশ গলায় বলল,” আমি আপনাকে মিথ্যা বলেছিলাম। সেদিন হাসপাতালে কেউ আসেনি। ডেডবডিটা ছিল ইয়ামিনের। কিন্তু আমি সেটা মানতে পারিনি। আজও মানতে পারিনি।”
উষসীকে অবুঝ শিশুর মতো কাঁদতে দেখা যাচ্ছে। সাজিদ ব্যথিত কণ্ঠে বলল,” আমি জানি ম্যাডাম। আপনি কষ্ট পাবেন না, প্লিজ।”
উষসী এই কথার জবাব দিল না। ধীরপায়ে হেঁটে যেতে লাগল বাইরে। বাগানে আসতেই ইয়ামিনের দেখা পাওয়া গেল। ছাতিম গাছের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে হাসি। আকাশের দিকে চেয়ে বলল,” আজকে কত সুন্দর জোৎস্না পড়েছে দেখেছো?”
উষসীও তাকাল আকাশের দিকে। মাথা নেড়ে বলল,” হুম৷ অনেক সুন্দর। কিন্তু তোমার চেয়ে সুন্দর কোনোকিছুই না।”
ইয়ামিন কাছে এসে দাঁড়ালো। উষসীর একহাত নিয়ে চুমু দিয়ে বলল,” আমাকে অনেক ভালোবাসো তাই না?”
” অনেক, অনেক, অনেক, অনেক! প্লিজ আমাকে ছেড়ে আর যেও না।”
ইয়ামিন হাসল। উষসী বলল,” দেখো, তোমার জন্য কেক এনেছি। তোমার মেয়ের জন্মদিনের কেক।”
” আমি কেক খাবো না৷ তুমি খাও। আমি দেখব।”
উষসী মাথা নাড়ল। ইয়ামিনের কোনো অনুরোধ সে ফেলতে পারে না। তাই নিজেই কেক খেল। ইয়ামিন উষসীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” নিজেকে ক্ষমা করো উষু। আমার মৃত্যুতে তোমার কোনো দোষ ছিল না৷ এটা আমার ভাগ্যেই ছিল।”
” কেন এমন হলো? আমি তোমাকে হারিয়ে ফেললাম। নিয়তি আমার সাথে এতোবড় নিষ্ঠুরতা না করলেও পারতো।”
ফুঁপিয়ে কাঁদছে উষসী। ইয়ামিন তার মুখটা উপরে তুলে বলল,” এই বোকা মেয়ে, এইভাবে কাঁদতে হয় না৷ তুমি এইভাবে ভেঙে পড়লে আমার মেয়ের কি হবে বলো?”
উষসী কাতর গলায় বলল,” ওর এই অবস্থার জন্যেও আমি দায়ী৷ তোমাকে হারানোর পর আমি যদি সুইসাইড এর চেষ্টা না করতাম, যদি ওই ঔষধগুলো না খেতাম, তাহলে আজকে আমার মেয়েটা সুস্থ-স্বাভাবিক হয়ে জন্মাতো।”
” না। যা হয় ভালোর জন্য হয়। এটাই হওয়ার ছিল।এসব ভেবে আফসোস কোরো না। তোমাকে সুস্থ হতে হবে উষুপাখি। তুমি এমন করলে আমি কিভাবে শান্তিতে থাকব? তোমাকে আবার আগের মতো হাসতে হবে। নিজেকে ভালো রাখতে হবে। আমার মেয়েকেও ভালো রাখতে হবে। তুমি ছাড়া তার কে আছে বলো?”
” আমি সুস্থ হতে চাই না। ডাক্তার বলেছে সুস্থ হয়ে গেলে আমি আর তোমাকে দেখব না। ক্ষণিকের এই সুখ থেকে আমাকে বঞ্চিত কোরো না প্লিজ। আমাকে আবার ছেড়ে চলে যেও না। কথা দিচ্ছি, আর কখনও তোমাকে কষ্ট দিবো না আমি। আর কখনও তোমার উপর রাগ করব না৷ তুমি যা বলবে শুধু তাই করব৷ প্লিজ, তবুও আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি সহ্য করতে পারব না।”
দূর থেকে সাজিদ দেখল, জোৎস্না ঝরানো রাতে এক অমায়িক রূপবতী মেয়ে ছাতিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। সে মেয়েটির নাম দিল-‘দুঃখবিলাসী কন্যা’।
সমাপ্ত