#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৪৯
লিখা- Sidratul Muntaz
রাত গভীর হচ্ছে। ঘড়ির টিকটিক শব্দটা মাথা ব্যথার উদ্রেক করছে। সামান্য ঘড়ির শব্দও কি এতো বিরক্তিকর হতে পারে? ঘুম আসছে না একদম। উষসী বিছানা ছেড়ে নেমে গেল৷ বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
রাতের শহরটাকে মনে হচ্ছে কোনো রহস্যপুরী। নক্ষত্রপুঞ্জের মতো ছোট ছোট আলো ভেসে আছে দূরের ওই পরিচ্ছন্ন হাইওয়েতে। তার পেছনেই বিশাল বিশাল এপার্টমেন্টের সারি। ওই ব্যস্ত শহরের মধিখানে উষসীদের বাগানবাড়িটা যেন সমাজ থেকে বিচ্যুত এক টুকরো সুখের নীড়।
ঘন সবুজাভ মাঠ। ভোর হলেই পাখিদের মিষ্টি কলকাকলি শোনা যায়। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে কাঠবিড়ালি, খরগোশের মতো আদুরে কিছু জীব। দূর থেকে মিউজিকের শব্দ ভেসে আসছে। একটু খেয়াল করতেই উষসী বুঝতে পারল, মিউজিকের শব্দটা আসছে ইয়ামিনের ঘর থেকে। এতোরাতে সে না ঘুমিয়ে জেগে আছে কেন এখনও?
ধীরপায়ে হেঁটে পাশের ঘরে গেল উষসী। দরজাটা হাঁট করে খোলা। বাইরে দাঁড়িয়েই বিছানাটা নজরে পড়ছে। আশ্চর্য ব্যাপার! সে কি এভাবেই দরজা খোলা রেখে ঘুমায় নাকি প্রতিদিন? মানুষের প্রাইভেসি বলেও তো কিছু থাকা উচিৎ। আয়শা যদি কখনও উপরে আসে তাহলে কি হবে? উষসী কখনও চায় না সে ছাড়া অন্যকেউ ইয়ামিনকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখুক। এই অধিকার শুধুমাত্র তার।
বিছানায় ইয়ামিনকে দেখা যাচ্ছে না। সে স্টাডি টেবিলের উপরে বসে মনোযোগের সাথে গিটার বাজাচ্ছে। চোখ দু’টো বন্ধ। গুণগুণিয়ে গানও গাইছে বোধহয়। ঠোঁট নড়ছে। কি গান সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবুও শুনতে ভালো লাগছে। উষসীর এখন চোখ জুড়িয়ে ঘুম পাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে এখানে বেশিক্ষণ থাকলে ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘুমাতে শুরু করবে।
হঠাৎ মিউজিক থেমে গেল। ইয়ামিন শান্ত স্বরে বলল,” উষু, কিছু বলার থাকলে ভেতরে আসো। ”
উষসী চমকে উঠল। সে তো ঘাড় ঘুরিয়ে একবারও পেছনে তাকায়নি। তাহলে বুঝল কিভাবে পেছনে কেউ আছে? ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে উষসী প্রশ্ন করল,” বুঝলেন কিভাবে আমি?”
ইয়ামিন হাতের গিটার নামিয়ে রাখল। চেয়ারে মাথা এলিয়ে প্রগাঢ় শ্বাস টেনে বলল,” আই ক্যান ফিল ইউর প্রেসেন্স।”
উষসী অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে হাসল। ভ্রু নাচিয়ে বলল,” মিথ্যা কথা। আপনি নিশ্চয়ই অন্যকোনো ভাবে ইঙ্গিত পেয়েছেন। উম…. আমার পারফিউমের ঘ্রাণ পেয়েছেন, রাইট?”
” এতো দূর থেকে ঘ্রাণ কিভাবে পাবো? আমাকে কি তোমার কুকুর মনে হয়?”
উষসী না চাইতেও হেসে ফেলল। তারপর হঠাৎ খুব সঙ্গিন হয়ে বলল,” সবাই তো জানে আপনি গান ছেড়ে দিয়েছেন। অথচ মাঝরাতে প্রায়ই গিটার নিয়ে গুণগুণ করেন৷ এতোই যদি গানের প্রতি ভালোবাসা… তাহলে ছাড়লেন কেন?”
ইচ্ছে করেই ইয়ামিন প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। ভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে বলল,” তুমি এতোরাতে এখানে কি করছো? এখনও ঘুমাওনি কেন?”
” ঘুম আসছে না, মাথা ধরেছে আমার। ঘড়ির টিকটিক শব্দটা খুব বিরক্তিকর। মনে হয় যেন কেউ মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করছে।”
” এক কাজ করো, ঘড়ির ব্যাটারি খুলে ফেলো।”
আইডিয়াটা উষসীর পছন্দ হলো। মৃদু হেসে বলল,” ভালো বলেছেন। সেটাই করতে হবে।”
সে বের হয়ে যেতে নিয়েও আবার ফিরে এলো। কি একটা ভেবে জিজ্ঞেস করল,” আপনার কি কিছু লাগবে?”
ইয়ামিন হতবাক চিত্তে তাকাল। তাকে এমন অবাক হতে দেখে অপ্রস্তুত হলো উষসী। অস্বচ্ছন্দ কণ্ঠে বলল,” এভাবে তাকানোর কি আছে? কিছু লাগলে বলুন।”
ইয়ামিন নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,” হঠাৎ আমার প্রতি এতো দয়া?”
” দয়া হবে কেন? আয়শা মনে হয় ঘুমাচ্ছে, সেজন্য বললাম। যদি কিছু প্রয়োজন হয় তাহলে আমাকে বলতে পারেন। ”
ইয়ামিন উষসীর গলার নিচের কালো তিলটির দিকে চেয়ে বলল,”হুম, প্রয়োজন। অনেক।”
” কি প্রয়োজন?”
উষসী কাছে এগিয়ে আসতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল ইয়ামিন৷ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” থাক, তুমি দিবে না।”
” দিবো না মানে? কি চান আপনি?”
ইয়ামিন তাকাল। নির্দ্বিধায় বলল,” চুমু, অনেকগুলো চুমু চাই আমি। দিবে?”
উষসী থমকে গেল। লজ্জায় হতবিহ্বল হয়ে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকল। তারপর দরজার দিকে পা বাড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,” অসভ্য লোক।”
ঘরে এসে সর্বপ্রথম দেয়াল থেকে ঘড়িটা নামাল সে। ব্যাটারি খুলে ফেলল। এবার শান্তি লাগছে। টিকটিক শব্দটা আর নেই। কিন্তু মনটা দপ করে খারাপ হয়ে গেল তার। অতিরিক্ত নিস্তব্ধতার কারণে এখন আরও ঘুম আসছে না। উষসীর খুব মন চাইছে ইয়ামিনের কণ্ঠে একটা গান শুনতে। আগে সে নেশাগ্রস্তের মতো ইয়ারফোন কানে গুঁজে গান শুনতো। সেই ভয়ংকর নেশা এখনও কাটেনি।
হঠাৎই পাশের রুম থেকে শব্দ ভেসে এলো। ইয়ামিন গাইছে,” এখন অনেক রাত, তোমার কাঁধে আমার নিশ্বাস… আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায়! ছুঁয়ে দিলে হাত, আমার বিদ্ধ বুকে তোমার মাথা চেপে ধরে টলছি কেমন নেশায়…”
উষসী মৃদু হাসল৷ ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে এখন। বহুদিন পর আবার সেই শান্তির ঘুম।
____________
উষসী এমনভাবে খাচ্ছে যেন সে বহুদিনের ক্ষুধার্ত। ইয়ামিন মনোযোগ দিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। হঠাৎ বলল,” আস্তে খাও উষু, খাবার কেউ নিয়ে যাচ্ছে না।”
আয়শা হেসে উঠল এই কথায়। উষসী গরম চোখে তাকাল,” আমি কিভাবে খাবো সেটা আমার ব্যাপার। আপনাকে দেখতে কে বলেছে?”
” তোমার শরীর কিন্তু আগের চেয়ে অনেক ভারী হয়ে যাচ্ছে।”
” আপনি কি আমাকে মোটা বলছেন?”
উষসী রেগে তাকাল। ইয়ামিন হাসল,” হ্যাঁ বলছি৷ কিন্তু তোমাকে এভাবেই ভালো লাগে। বেবি হওয়ার পরও তুমি এরকমই থেকো। স্লিম হওয়ার কোনো দরকার নেই।”
” সেটা আমার ব্যাপার। আমি বুঝবো যে আমি কিভাবে থাকব। আপনাকে ভাবতে হবে না।”
তারপর বিড়বিড় করে বলল,” বয়েই গেছে উনার জন্য মোটা হতে। তারপর আমাকে দেখতে বাজে লাগলে ফ্যান গার্লদের নিয়ে ফূর্তি করে বেড়ানোর জন্য?”
” কি বললে তুমি?”
” কিছু না।
ইয়ামিন জরুরী গলায় বলল,” শোনো, আমাকে কিছুদিনের জন্য স্টেটের বাইরে যেতে হবে। মিডিয়ায় আমার খুব ক্লোজ একজন ফ্রেন্ড অসুস্থ। সে আমার সাথে দেখা করতে চায়।”
” ও।”
” শুধু ও? তুমি কিছু বলবে না?”
” আমি আবার কি বলব?”
” মানে তুমি আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছো?”
উষসী অবাক হয়ে বলল,” আমি অনুমতি না দিলে কি আপনি যাবেন না?”
” অফকোর্স না।”
উষসী এবার হেসে বলল, ,” আপনার ইচ্ছা। আমি এই ব্যাপারে অনুমতি দেওয়ার কে? এমনিতেও মানুষ ভাবছে আমার জন্য আপনি গান ছেড়ে দিয়েছেন। এখন যদি বাড়ি থেকে বের হওয়াও বন্ধ করে দেন তাহলে নিশ্চিত সবাই ভাববে আমি আপনাকে কালোজাদু করেছি। হাহাহা!”
ইয়ামিন বলল,” তুমি কি এটাও জানতে চাইবে না যে আমি কাকে দেখতে যাব?”
” না, সেটা দিয়ে আমার কি কাজ? তাছাড়া আপনি তো বললেনই আপনার ক্লোজ ফ্রেন্ড। এর বেশি আমি জেনে আর কি করব?”
” আমি কীর্তির কথা বলছি।”
উষসী একটু থামল। কীর্তি মানে ইয়ামিনের প্রাক্তন। একসময় যার ছবি দেখলেও ঈর্ষায় পুড়ে যেতো সে। এখনও তাই হয়। কিন্তু এখন উষসী নিজের অনুভূতি লুকাতে জানে। সে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলল,” ও আচ্ছা। তাহলে তো আপনার অবশ্যই তাকে একবার দেখতে যাওয়া উচিৎ। ”
” তুমি শিউর?”
” হুম, শিউর। তাছাড়া আমাদের এমনিতেও ডিভোর্স হবে। তাই আপনার ব্যাপারে আমার কিছু যায়-আসা উচিৎ না।”
” সবসময় ডিভোর্সের কথাটা না বললে কি হয় না?” ইয়ামিন ধাক্কা মেরে টেবিলের পাশের বড় ফ্লাওয়ার বাজটা ভেঙে ফেলল।
আয়শা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো,” কি হয়েছে স্যার?”
উষশী ঠোঁটে মুচকি হাসি এঁটে বলল,” তেমন কিছু না৷ তোমার স্যারের মাথা গরম হয়ে গেছে। উনাকে বরফ দিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত দাও।”
উষসী তার ঘরে চলে এলো। আর ইয়ামিন রেগে-মেগে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। সারাদিন আর ফিরল না।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। একটু পর আয়শা লেবুর শরবত নিয়ে ঢুকল। উষসী সেই শরবত খ্যাক করে ফেলে দিয়ে বলল,” এতো টক কেন হয়েছে? এটা খাওয়া যায় নাকি? চিনি তো মনে হয় এক দানাও দাওনি।”
আয়শা বলল,” ম্যাডাম আপনিই না মোটা হয়ে যাচ্ছেন বলে চিনি দিতে নিষেধ করেছেন? সেজন্যই তো আমি চিনির জায়গায় লবণ দিয়েছি। ”
উষসী তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বলল,” আমার সামনে থেকে যাও। আর কখনও আমার জন্য শরবত বানাবে না তুমি। গেট লস্ট।”
আয়শা ভ্যাবাচেকা খেয়ে দ্রুত বিদায় হলো। উষসী নিজেও বুঝতে পারল না কেন এতো রাগ উঠছে তার। ইয়ামিন কীর্তিকে দেখতে যাবে বলে? অসুস্থ মানুষকে দেখতে যাওয়া তো অপরাধ না। কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় সে ইয়ামিনকেই কেন দেখতে চাইবে? অন্যের স্বামীকে দেখার এতো শখ কেন তার? ডাইনি যেন কোথাকার!
রাত অনেক হয়েছে। ইয়ামিন এখনও ফিরছে না। তার তো কাল যাওয়ার কথা ছিল। আজকেই চলে গেল না তো আবার? দুশ্চিন্তায় উষসী পায়চারী করতে লাগল এদিক-সেদিক। করিডোরে গাড়ি ব্রেক-এর শব্দ পেতেই দ্রুত ছুটে গেল বারান্দায়। ইয়ামিনকে গাড়ি থেকে নামতে দেখা যাচ্ছে। সে নিশ্চিন্ত হলো। একটু পরেই ইয়ামিন গুটুরগুটুর পায়ে হেঁটে তার ঘরে ঢুকল।
উষসী হকচকিয়ে বলল,” কি ব্যাপার? কিছু বলবেন?”
” হুম, বলব।”
ইয়ামিন দরজা বন্ধ করল। উষসী ভ্রু কুঁচকে তাকাল,” দরজা কেন বন্ধ করলেন? আজব!”
ইয়ামিন এগিয়ে আসতে আসতে বলল,” তুমি আমার বউ৷ তোমার ঘরে এসে আমি দরজা আটকাতেই পারি৷ এজন্য নিশ্চয়ই আমার ফাঁসি হবে না? বলো, ফাঁসি হবে?”
উষসী খেয়াল করল তার গলা শুকিয়ে আসছে। কণ্ঠ থেমে যাচ্ছে। অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” কথা বলার জন্য দরজা বন্ধ করা জরুরী না।”
ইয়ামিন তার বাহু টেনে ধরল। তেজ নিয়ে বলল,” অবশ্যই জরুরী। তোমার কাছে জরুরী মনে না হলেও আমার কাছে অনেক বেশি জরুরী।”
” কি আশ্চর্য, আপনি চিৎকার করছেন কেন?”
ইয়ামিন আগের চেয়েও দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলল,”আমি আর সহ্য করতে পারছি না এই দূরত্ব। বার-বার ডিভোর্সের হুমকি দিয়ে তুমি আমাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছো। কেন এমন করছো উষসী? আর কতভাবে শাস্তি দিবে আমাকে? এসব না করে একেবারেই মে-রে ফেলো প্লিজ, কিল মি!”
ইয়ামিন উষসীর দুইহাত নিয়ে নিজের গলায় চেপে ধরল শক্তভাবে। উষসী কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,” প্লিজ ছাড়ুন আমাকে।”
ইয়ামিন করুণ গলায় বলল,”কেন তোমার কিছু যায়-আসে না? সত্যিই কি আমাদের বিচ্ছেদ এতো সহজ? দূরত্ব কি তোমার জন্য এতোই আনন্দের? কিভাবে এতোটা নিষ্ঠুর হলে তুমি? আমাকেও শেখাও প্লিজ। আমার দম বন্ধ লাগছে। আমি ম-রে যাচ্ছি। এভাবে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। প্লিজ হেল্প মি আউট।”
” আপনি নিজেই কীর্তির কাছে যেতে চেয়েছেন। এখানে আমি কেন বাঁধা দিবো আপনাকে?”
” কারণ আমি তোমার হাজব্যান্ড৷ ইউ হ্যাভ দ্যা রাইটস। ইউ শ্যুড বি পজিসিভ এবাউট মি। ইউ শ্যুড অউন মি।”
” না৷ আমি ইচ্ছে করলেই আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে চাইতে পারি না। আপনি কখনোই সাধারণ ছিলেন না। সেলিব্রিটি আপনি৷ আমি আপনাকে নিজের দখলে রাখতে পারি না।”
” কিন্তু আমি চাই। আমি তোমার দখলে থাকতে চাই। তুমি প্রশ্ন করেছো না কেন গান ছেড়েছি? কারণ আমি শুধু তোমার জন্য গান গাইতে চাই। আমার সবকিছু শুধু তোমার। তোমার ব্যক্তিগত। এভাবে নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছি তাও কেন তুমি গ্রহণ করতে চাইছো না? প্লিজ, বি মাই টিউন। আই উইল বি ইউর ওয়ার্ডস।”
উষসীর বাম চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। ঝিম ঝরা কণ্ঠে বলল,” এর মানে শুধু আমার জন্যই গান ছেড়েছেন আপনি?”
” তুমিই একবার বলেছিলে, আমি যদি সাধারণ কেউ হতাম তাহলে আমাদের ছোট্ট একটা বাড়ি হতো, ছিমছাম সংসার হতো। তুমি সেই সংসারে বেশি সুখে থাকতে। একটা বিলাসবহুল জীবনের চেয়েও ভালোবাসাময় সাধারণ জীবন তুমি বেশি প্রেফার করেছিলে। আমি তো সেটাই করছি উষসী৷ তাহলে কেন তুমি আমাকে মানতে পারছো না এভাবে?”
” আমার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। আমার জন্য আপনার স্বপ্ন শেষ হবে…”
ইয়ামিন উষসীর ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে বলল,” আমার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন তুমি। তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি এমন হাজারটা স্বপ্ন ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু সেটা তুমি বিশ্বাস করলে তো?”
” আপনি ছেলেমানুষী করছেন। ম্যাচিউর মানুষ কখনও এভাবে চিন্তা করে না।”
” আমি ম্যাচিউর হতে চাই না। আমি শুধু তোমাকে চাই। আই লভ ইউ উষসী।”
ইয়ামিন প্রচন্ড পিপাসা নিয়ে উষসীর ঠোঁটে চুমু দিতে শুরু করল। একপা, দুপা করে পিছিয়ে যেতে লাগল উষসী। দেয়ালে পিঠ ঠেঁকে গেল। ইয়ামিন তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল শক্ত করে। তীব্র স্পর্শে চুমু দিল গলার ওই কালো তিলে। উষসী চোখ বন্ধ করে বলল,” আমার ভালো লাগছে না। যান এখান থেকে। ”
ইয়ামিন আসক্ত কণ্ঠে শুধাল,” যদি না যাই?”
” তাহলে আপনার নামে মেরিটাল রেইপের কেইস করব আমি।”
কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। ইয়ামিনের কান ঝাঁ করে উঠল। বিস্ময়ে মূক হয়ে বলল,” হোয়াট?”
” ঠিক শুনেছেন। আপনি যদি আমার নামে এবোর্শনের কেইস করতে পারেন তাহলে আমিও আপনার নামে টরমেন্টিং এর কেইস করতে পারি। এটা আপনিই আমাকে শিখিয়েছেন, ইয়ামিন ইব্রাহীম।”
ইয়ামিন অনেকক্ষণ কিছু বলতে পারল না। উষসীকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়াল। স্তব্ধীভূত হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল,” তুমি এই কথা বলতে পারলে?”
” হ্যাঁ পারলাম। যেভাবে আপনি আমাকে বলতে পেরেছিলেন, সেভাবে আমিও পারলাম।”
ইয়ামিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। ক্রমশ তার নাক-মুখ লাল হয়ে উঠল। তারপর আচমকা ড্রেসিংটেবিলের কাছে গিয়ে লাথি মেরে আয়না ভেঙে ফেলল। উষসী ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। ইয়ামিন থামল না। শোপিস স্ট্যান্ডের কাছে গিয়ে সমস্ত কাঁচের জিনিস টেনে ফেলতে লাগল। বিছানার চাদর উল্টে ফেলল। বালিশগুলো ছুঁড়ে মারল। মুহূর্তেই পুরো ঘরটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। উষসী এক কোণায় দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল আবেগশূন্য দৃষ্টিতে।
ইয়ামিন বের হতে নিয়েও ফিরে এলো আবার। উষসীর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,” আর কখনও তোমার সামনে আসব না। আই প্রমিস, ইউ উইল নেভার সি মাই ফেইস এগেইন।”
উষসী কিছু বলল না৷ ইয়ামিন চলে গেল। পরদিন একপ্রকার জেদ করেই সে এয়ারপোর্টে রওনা হলো। কীর্তিকে দেখতে যাওয়া শুধুই বাহানা মাত্র। আসলে সে রাগ করে চলে যাচ্ছে, এটা উষসী নিজেও বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু সে বাঁধা দেয়নি।
সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপারটা ঘটল সন্ধ্যায়।বিমান দূর্ঘটনার খবর দেখে আয়শা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো,” ভাবী, সর্বনাশ করেছে। আমি মাত্র খবরে দেখেছি ভাবী। স্যার যেই বিমানে উঠেছিল সেটা ক্র্যাশ হয়ে গেছে।”
উষসীর প্রথমে মনে হলো, এটাও একটা নাটক। কারণ কথায় কথায় নাটক সাজানোই ইয়ামিনের স্বভাব। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরেই বাড়িতে পুলিশ এলো। ডেডবডি শনাক্তকরণের জন্য উষসীকে হাসপাতালে যেতে হবে৷ এই কথা শোনা মাত্রই সে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলল।
চলবে