#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৪৮
লিখা- Sidratul Muntaz
প্রেগন্যান্সির সময় কি মেয়েরা বেশি সুন্দর হয়ে যায়? উষসীকে আজ-কাল দেখতে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। সকালে সে গোসল সেরে বারান্দায় চুল ঝারছিল, তখন ইয়ামিন বাগানের একপাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। স্বাস্থ্য কিছুটা বেড়ে যাওয়ার কারণে মুখটা ফোলা দেখায়। গাল দু’টো টসটসে লাল হয়ে থাকে সবসময় এতো মায়াবী লাগে দেখতে! হঠাৎ উষসী নিচে তাকাতেই ইয়ামিন দ্রুত সরে গেল। যেন চোর ধরা পড়ে গেছে। উষসী অবশ্য তা খেয়াল করল না। ইয়ামিন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। নিজের স্ত্রীকে দেখার জন্যেও কত লুকোচুরি করতে হচ্ছে। কি কপাল তার! একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে ঘরে ঢুকল।
দুপুরের রান্নাটা ইয়ামিন নিজের হাতেই করল। দীর্ঘদিন বিদেশে একা থাকার সুবাদে রান্না করার অভ্যাস তার আছে। রাতে উষসী মোমো স্যুপ খেতে চেয়েছিল। ইয়ামিন ঠিক করেছে নিজের হাতেই রান্নাটা করবে। উষসী ঝাল খেতে খুব পছন্দ করে৷ তাই অনেক বেশি ঝাল দিতে হবে৷ রান্না-বান্নার পর্ব শেষ করে ইয়ামিন বাইরে চলে গেল। ফ্রীজের খাবার সব শেষ হয়ে গেছে। উষসী আজ-কাল অনেক বেশি খাওয়া-দাওয়া করছে। তিনজনের খাবার সে একাই খেয়ে নিতে পারে। তাই ইয়ামিন উষসীর পছন্দের সব খাবার এনে ঘর ভরে রাখে।
দুপুরে খেতে বসে উষসী মুগ্ধ হয়ে গেল। এতো ভালো রান্না! ঝালটাও একদম পারফেক্ট হয়েছে। অনেক দিন পর খেতে বসে চোখে পানি চলে এসেছে। উষসী তৃপ্ত কণ্ঠে বলল,” রান্না খুব ভালো হয়েছে আয়শা। তুমি এতো মজা করে স্যুপ রান্না শিখলে কোথা থেকে? ”
” সত্যি ভালো লেগেছে ম্যাডাম?”
” হুম। আসলেই অনেক টেস্ট হয়েছে। এটা আবার রান্না করো৷ আমি রাতেও খাবো। ইশ, ইচ্ছে তো করছে সব আমি একাই খেয়ে ফেলি।”
“একাই খান ম্যাডাম। স্যার তো ঝাল খান না। সব আপনার জন্যই।”
” সত্যি?” উষসী আনন্দিত হয়ে প্যানের সবটুকু স্যুপ বাটিতে ঢেলে নিল। তাকে এতো আরাম করে খেতে দেখে আয়শা মুখ ফসকে বলেই ফেলল,” আজকে কিন্তু স্যুপ আমি রাঁধিনি ম্যাডাম। স্যার রান্না করেছেন। এজন্যই এতো মজা হয়েছে। আপনার টেস্ট স্যারের চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে?”
উষসীর খাওয়া থেমে গেল। চোখমুখ শক্ত করে বলল,” তুমি এই কথাটা এতোক্ষণে কেন বললে?”
আয়শা সামান্য ঘাবড়ে গেল। আপস্টেয়ার থেকে উষসীর খাওয়ার দৃশ্য দেখছিল ইয়ামিন। কিন্তু আয়শার কথা শোনার পর সেও হকচকিয়ে গেল। এই মেয়ের জীবনে শিক্ষা হবে না। সবসময় সে ইয়ামিনকে ধরা খাওয়াবেই। কি দরকার ছিল এই কথা বলার?
” তাতে কি হয়েছে ম্যাডাম? স্যার কি আপনার জন্য রান্না করতে পারে না?”
” আমি কি তাকে একবারও বলেছি আমার জন্য রান্না করতে? তার রান্না করা জিনিস আমি খাবো এটা সে ভাবল কি করে? আমি খাবো না এই স্যুপ। এটা এখন আমার জন্য বিষ। ”
উষসী একবার উপরে তাকাল। ইয়ামিন অসহায়ের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আয়শার চেহারায় অপরাধী ভাব। সে বিরাট ভুল করেছে। ইশ, কোনোভাবে যদি ভুলটা মুছে ফেলা যেতো! উষসী প্লাস্টিকের ব্যাগ নিল। সেই ব্যাগে স্যুপ ঢেলে, ব্যাগের মুখ বেঁধে সেটা ডাস্টবিনে ফেলে দিল। আয়শা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,” এটা কি করলেন ম্যাডাম? কি করলেন?”
উষসী উপরে দিকে চেয়ে কঠিন স্বরে বলল,” এখন থেকে আমার জন্য আর কাউকে রান্না করতে হবে না। নিজের রান্না আমি নিজেই করে খেতে পারি।”
এই কথা বলে নিজের ঘরে ঢুকে শব্দ করে দরজা আটকে দিল সে। আয়শা টলমল দৃষ্টিতে বলল,” স্যরি স্যার, আমি বুঝতে পারিনি যে ম্যাডাম এতো রেগে যাবে।”
ইয়ামিন হতাশ হয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। একটা মানুষ এতো জেদি কি করে হতে পারে? অবশ্য গর্ভাবস্থায় নাকি এসব নরমাল। সে শুনেছিল এই সময় মেয়েদের ঘন ঘন মুড সুয়িং হয়৷ তাই ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি ভাবল না ইয়ামিন। ধৈর্য্য ধারণ করল। সেও তো একসময় উষসীকে অনেক কষ্টে রেখেছিল।
মাঝরাতে ক্ষুধায় ঘুম ভেঙে গেল। এই রাতের বেলা হঠাৎ চীজকেক খেতে ইচ্ছে করছে কেন সে বুঝতে পারছে না। আশ্চর্য ব্যাপার! উষসী রুম থেকে বের হয়ে কিচেনে এলো। ঠান্ডা পানি নেওয়ার উদ্দেশ্যে ফ্রীজ খুলতেই দেখল ফ্রীজে এত্তোবড় একটা চীজকেক। উষসী হতভম্ব হয়ে গেল। মুখে উচ্ছল হাসি ফুটল। সে চীজকেক খেতে পছন্দ করে এটা তো ইয়ামিন জানে৷ সেজন্যই হয়তো আনিয়ে রেখেছে। মনে মনে সে অসম্ভব কৃতজ্ঞতাবোধ করল। কিন্তু এটা ইয়ামিনকে কোনোভাবেই বুঝতে দেওয়া চলবে না।
উষসী ছু/রি দিয়ে একপিস কেক কাটল। সেটা দেখে তার মন ভরল না। তাই গোটা কেকটাই প্লেটে তুলে নিল। খেতে খেতে তার মনে হচ্ছিল এতো মজার কেক জীবনেও খায়নি। আচমকা পেছন থেকে কেউ বলে উঠল,” সাবধানে খাও। গলায় আটকাবে তো।”
উষসী বিষম খেল। সত্যি তার গলায় খাবার আটকে গেল। জোরে কাশতে লাগল সে। ইয়ামিন পানি এগিয়ে দিল। তার হাসিমুখ দেখে উষসী লজ্জায় পড়ে গেল। সে ইয়ামিনের হাত থেকে পানির গ্লাস নিল না। নিজেই পানি ঢেলে খেল। ইয়ামিন তার পাশের চেয়ারে বসল। গালে হাত রেখে বলল,”তোমাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছিল… চুরি করে কেক খাওয়ার সময়।”
উষসী কটমট করে তাকাল। তারপর হঠাৎ হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে সরাসরি ছুঁড়ে মারল ইয়ামিনের মুখে৷ তার এহেন আচরণে বিস্মিত ইয়ামিন। হতবাক হয়ে বলল,” নিজের দোষে ধরা খেয়েছো, সেই রাগও আমার উপর ঝারবে নাকি?এটা কেমন বিহেভিয়ার?”
উষসী বিড়বিড় করে বলল,” ফাজিল।”
সে রেগে-মেগে উঠে চলে যেতেই নিচ্ছিল, তখনি গিটারের টিউন বেজে উঠল। উষসীর পা স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে গেল। পেছন ফিরে সে বিহ্বল হয়ে দেখল ভেজা চুল আর ভেজা মুখ নিয়েই ইয়ামিন হাসছে। তার দৃষ্টিতে অনুরাগ। হাত দিয়ে গিটারে সুর তুলছে অবলীলায়। হঠাৎই গাঢ় কণ্ঠে গেয়ে উঠল,
” দেখো, দেখো রাঙানো যে লালে তোমার ওই গালে… জমেছে কত না রাগ!
জানি মাফ করবে না, জানি জানি! তুমি অভিমানী, তবু দাও না আমায় এক ভাগ!”
তারপর সে উঠে দাঁড়ালো। হেঁটে আসতে আসতে গাইল,” তুমি বলো,’ দেবো না তোমায় পড়েছি কি দায় বলো জানো তুমি জানো কি?’
আমি বলি,’ যদি দূরে যাই, তোমায় ভুলে যাই, বাসবে ভালো তখনও কি?’
এবার সে কাছে এসে উষসীর কোমড় জাপটে ধরল। তাকে ঘুরিয়ে এনে চোখে চোখ রেখে ডান্স করতে লাগল। উষসী এতো অবাক হলো যে বাঁধাও দিতে পারল না। কিন্তু হুশ ফিরতেই সে ইয়ামিনকে সজোরে ধাক্কা মারল। ইয়ামিন গিটার হাতে নিয়ে আবার গাইতে লাগল,” তোমায় শোনাবো আমি গান, শোনো পেতে কান, কোরো না অভিমান আর।”
এটুকু গেয়েই সে কাছে এলো পুনরায়। উষসীকে জড়িয়ে ধরল। ধীর কণ্ঠে আবার গাইল,”জানি এ মনেরই ফুল, আজ করে ভুল, তবুও আমি শুধু তোমার!”
উষসী ইয়ামিনকে ছেড়ে লিভিংরুমের সোফায় গিয়ে বসল। ইয়ামিন গিটার হাতে নিয়ে বাজাতে লাগল। সেও হেঁটে এলো সোফার কাছে। উষসীর পাশে বসল। গানের সুরে বলল,” দেখো দেখো এসেছি তো কাছে, তোমারই পাশে, তবু কেন এতো অভিমান?”
উষসী দূরে গেল। ইয়ামিন আরও কাছে এলো। উষসী আরও দূরে যেতে নিলেই সে হাত টেনে ধরল। উষসীর মুখটা দুইহাতে নিল। তৃষ্ণার্তের মতো তার চোখ স্পর্শ করল। তারপর আবারও গান গাইতে লাগল,” ভেজা ভেজা চোখ, কেঁদে আঁকা মুখ, তবুও দাও না আমায় এক ভাগ! তুমি বলো,’ দেবো না তোমায় পড়েছি কি দায় বলো জানো তুমি জানো কি?’
আমি বলি, যদি দূরে যাই, তোমায় ভুলে যাই, বাসবে ভালো তখনও কি?”
উষসী উঠে দাঁড়িয়ে গেল। ইয়ামিন দরাজ গলায় বলল,” এনাফ উষসী। প্লিজ, আর কত শাস্তি দিবে? এবার অন্তত মাফ করো। আই এম স্যরি! কিভাবে মাফ চাইলে তুমি আমাকে মাফ করবে জানতে পারি?”
উষসী ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে ফট করে একটা কাঁচের গ্লাস ভেঙে ফেলল। তার কান্ডে আশ্চর্য হয়ে গেল ইয়ামিন। উষসী ক্রোধমাখা দৃষ্টিতে বলল,” এই গ্লাসটা আগের মতো জোড়া লাগাতে পারবেন আপনি? চেষ্টা করে দেখুন তো! যদি না পারেন… তাহলে আর কখনও ক্ষমা চাইতে আসবেন না আমার কাছে। যেভাবে এই কাঁচের গ্লাস ভেঙেছে তার চেয়েও জঘন্যভাবে আমার মন ভেঙেছেন আপনি। তাও একবার না, বার-বার!”
ইয়ামিন আর কোনো কথা বলার মতো খুঁজে পেল না এবার। উষসী হনহন করে তার ঘরে চলে গেল। আর ইয়ামিন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল অপরাধীর মতো।
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করতে এসেই উষসী একটা সারপ্রাইজ পেল। টেবিলে খুব সুন্দর করে তার প্রিয় লাল গোলাপ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। একটা দারুণ ফ্লাওয়ার টবের উপর ফুলগুলি দেখতেও দারুণ লাগছে। সে হাতে নিয়ে টবটি নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল৷ রংতুলি দিয়ে চমৎকারভাবে আঁকা হয়েছে অপূর্ব নকশা। সে মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,” ওয়াও, এটা কে এনেছে আয়শা?”
আয়শা টোস্টে মাখন লাগাতে লাগাতে বলল,” এটা হাতে বানানো জিনিস ম্যাডাম। সকালে স্যারকে দেখলাম ভাঙা গ্লাসের টুকরা দিয়ে কি যেন করছেন। আমি তো চেয়েছিলাম ফেলে দিতে। কিন্তু স্যার বললেন সব জিনিস ভেঙে গেলেই ফেলে দিতে হয় না। মন থেকে চেষ্টা করলে ভাঙা জিনিস দিয়েও অনেক সুন্দর কিছু তৈরী করা যায়। দেখেন, এখন গ্লাসটা দেখতে আগের চেয়েও অনেক সুন্দর লাগছে না? আপনি কি বুঝেছিলেন যে এই সুন্দর টবটা ভাঙা গ্লাস দিয়ে বানানো হয়েছে?”
উষসী নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল। না, সে একদম বুঝতে পারেনি যে এই সুন্দর ফুলের টব সেই ভাঙা গ্লাস দিয়ে তৈরী করা হয়েছে।
চলবে