#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৪৪
লিখা- Sidratul Muntaz
তৃষাণের উপস্থিতিতে ইয়ামিনের হাস্যজ্জ্বল- চকচকে মুখটা শুকনো আর খরখরে হয়ে উঠল নিমেষেই। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে একবার উষসীর দিকে চাইল সে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে উষসী। ইয়ামিন প্রশ্ন করল নম্র গলায়,” ভাইয়া, কেমন আছেন?”
তৃষাণ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পকেটে হাত গুঁজে বলল,” ভালো। ”
ইয়ামিন কিঞ্চিৎ ইতস্তত হয়ে বলল,” হঠাৎ আপনি এই সকাল সকাল? কি মনে করে?”
” তোমার এখানে আসার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিল না। কিন্তু আমি এসেছি উষসীর জন্য।”
তৃষাণ উষসীর দিকে চেয়ে মুচকি হাসল। উষসীও হাসল। ইয়ামিনের মুখ গম্ভীর হলো। তৃষাণ আরও বলল,” ওকে আমার অনুমতি ছাড়া এখানে নিয়ে আসাটা তোমার একদম উচিৎ হয়নি।”
ইয়ামিনের বলতে মন চাইল,” আমার বউকে আমি যখন ইচ্ছা নিয়ে আসব, তাতে আপনার বাপের কি?”
ভদ্রতার খাতিরে সে অশোভন কথাটি বলতে পারল না। নিশ্চুপ রইল চোয়াল শক্ত করে। কিন্তু তৃষাণ যখন বলল,” উষুকে আমি নিয়ে যেতে এসেছি।” তখন আর চুপ করে থাকতে পারল না সে। ভ্রু কুটি করে শুধাল,” মানে? ”
” মানে উষসী এখন আমার সাথে বাসায় যাবে। ”
“অসম্ভব। উষসী কোথাও যাবে না।” কথাটা বলেই প্রাণপণ শক্তিতে উষসীর হাত চেপে ধরল ইয়ামিন। তৃষাণ অবাক হলো ইয়ামিনের ধৃষ্টতা দেখে। যথেষ্ট ধৈর্য্য ধারণ করে বলল,” উষসী, তুমি কি চাও?”
খুব নির্লিপ্তে ইয়ামিনের হাতটা ছেড়ে উষসী তৃষাণের সন্নিকটে গিয়ে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে আওড়াল,” তোমার সাথে যেতে চাই তৃষাণ ভাইয়া।”
ইয়ামিনের বুকে পাহাড় ধ্বসে পড়ল। দিশেহারা হলো চিত্ত। তৃষাণ আলতো হেসে ইয়ামিনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,” তোমার কি আর কিছু বলার আছে?”
ইয়ামিন কাতরভাবে অনুরোধ করল,” উষসী প্লিজ, এইভাবে চলে যাওয়াটা কোনো সমাধান না। আমরা ভালোভাবে কথা বললেই সব ঠিক হয়ে যেতে পারে।”
অনুভূতিশূন্য কণ্ঠে উষসীর পক্ষ থেকে উত্তর এলো,” কথা বলে সমাধান করার মতো কিছু বাকি নেই আর। যা বলার আমি আপনাকে বলেই দিয়েছি। আপনি মানতে পারছেন না সেটা আপনার প্রবলেম… আমার না।”
ইয়ামিন এগিয়ে এসে উষসীর হাত ধরতে উন্মুখ হলেই বাঁধ সাধল তৃষাণ। বামহাতে তার কাঁধ চেপে ধরে কড়া গলায় বলল,” খবরদার, যা বলার দূর থেকে বলো। কাছে আসবে না।”
ইয়ামিন নিজেকে আর সামলাতে পারল না। ভীষণ ক্রোধে প্রতাপ নিয়ে বলল,” আমার স্ত্রীর সাথে আমি কিভাবে কথা বলব সেটা কি আপনি বলে দিবেন আমাকে? আমি আপনার কথা শুনবো কেন? হু দ্যা হেল আর ইউ?”
উষসী রোষাবিষ্ট দৃষ্টিতে চাইল,” ইয়ামিন,উনি আমার তৃষাণ ভাই।আপনি কার সাথে কিভাবে কথা বলছেন? ”
” যে-ই হোক, আই ডন্ট কেয়ার। তুমি আমার স্ত্রী। তোমার সাথে কথা বলতে কারো পারমিশন কিংবা সাজেশনের আমার কোনো দরকার নেই।”
তৃষাণ হেসে ফেলল। ঠান্ডা গলায় বলল,” তাই? তা কিসের এতো অধিকার দেখাচ্ছো শুনি? আজকে তোমাদের ডিভোর্স হলে কালকে তুমি ওর কেউ না। তাছাড়া ও তোমার সাথে থাকতেও চায় না। সেজন্যই সকাল-সকাল আমাকে ফোন করে এখানে ডেকে এনেছে। কারণ তুমি নাকি ওকে ঘর থেকেই বের হতে দিচ্ছ না। এইভাবে ফোর্স করলে তোমার নামে থানায় এলিগেশন দিতে বাধ্য হবো আমি।”
” আপনার যা ইচ্ছা করুন। উষসী আমার স্ত্রী। আমার সন্তানের মা। তাই ও শুধু আমার কাছেই থাকবে। কেউ ওকে নিয়ে যেতে পারবে না এখান থেকে। ”
তৃষাণ এক মুহূর্তের জন্য একটু চমকাল,” সন্তানের মা? মানে কি?”
ইয়ামিন স্পষ্ট করে বলল,” উষসী প্রেগন্যান্ট।”
কথাটা যেন বিশ্বাস করতে পারল না তৃষাণ। কৌতুহল নিয়ে উষসীর দিকে তাকাতেই নিস্পন্দ তালে মাথা নাড়ল উষসী। যার অর্থ ঘটনা সত্যিই। তৃষাণ ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” যাই হোক, আসল কথা হচ্ছে উষসী এখানে থাকতে চায় না। তাই আমি ওকে নিয়ে যাবোই।”
” উষসী, তুমি কোথাও যাবে না।”
উষসী রূঢ় কণ্ঠে বলল,” আমি কি করব আর কি না করব সেটা আপনি ঠিক করে দিবেন না।”
অতঃপর তৃষাণের হাত ধরে বলল,” ভাইয়া চলো।”
তৃষাণ আর উষসী সামনে হাঁটতে লাগল। ইয়ামিন তাদের পেছনে এলো। উষসীর হাত ধরে তাকে থামানোর চেষ্টা করল,” প্লিজ উষসী, আমার কথাগুলো শোনো।”
” আমার হাত ছাড়ুন। দোহাই লাগে।”
ইয়ামিন চিৎকার করে বলল,” ছাড়ব না। তোমাকে আমি যেতে দিবো না ড্যামেট।”
তৃষাণ সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ইয়ামিনকে ঘুঁষি মারতেই কাউচের ওপর উল্টে পড়ে গেল সে। তৃষাণ শার্টের হাতা গুটিয়ে বলল,” অনেক সহ্য করেছি, আর না।”
উষসী আতঙ্কে অস্থির হয়ে বলল,” প্লিজ ভাইয়া, এখান থেকে চলো।”
ইয়ামিনের ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। তাই দেখে উষসীর বুক হু হু করে উঠলেও সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখল। তৃষাণের হাত ধরে চলে যেতে নিচ্ছিল। ইয়ামিন আহত অবস্থাতেই পুনরায় তেড়ে এলো। উষসীর পথ আটকে দাঁড়াল। তৃষাণ রেগে আবার কিছু করতে নিলেই উষসী থামাল তাকে,” প্লিজ, না।”
তৃষাণ থেমে গেল। উষসী নিষ্ঠুর কণ্ঠে বলল,” আমাকে যদি যেতে না দেন তাহলে আমি আত্মহত্যা করব। কি চান আপনি? আমার মৃত্যু?”
এই কথার পর ইয়ামিন থমকে গেল। অসহায় হয়ে বলল,” মোটেও না। তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চাই।”
” আমি চাই না। সরে দাঁড়ান নয়তো খুব খারাপ কিছু হবে যা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।”
” উষসী প্লিজ, আর পরীক্ষা নিও না আমার। তুমি চলে গেলে আমি আমাকে মাফ করতে পারব না। আমি থাকতে পারব না। তুমি আমার, শুধু আমার।”
” এসব আগে চিন্তা করা উচিৎ ছিল। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি আর এখানে এক মুহূর্ত থাকতে পারছি না। তৃষাণ ভাইয়া, চলো।”
নিঃস্ব, শূন্য, ভঙ্গুর ইয়ামিনকে পাশ কাটিয়ে তৃষাণের হাত ধরে উষসী বের হয়ে গেল অবলীলায়।
গাড়িতে বসেই উষসী কান্না শুরু করল। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে মাথায় হাত রাখল তৃষাণ। উষসী অনুতাপ নিয়ে বলল,” আই এম স্যরি, আমার জন্য তোমাকে অপমানিত হতে হলো। ইয়ামিন যে এইভাবে তোমার সাথে বেয়াদবি করবে সেটা আমি বুঝিনি।”
” বাদ দাও ওর কথা। তুমি বলো উষু, কি চাও তুমি? ইয়ামিনের থেকে ডিভোর্স নিতে চাও?”
উষসী মাথা নাড়ল। তৃষাণ বলল,” ঠিকাছে তাহলে সেটাই হবে। বাকি কাজ তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও। আর কেঁদো না। ”
উষসী চোখের জল মুছল। তৃষাণ দ্বিধান্বিত হয়ে বলল,” কিন্তু এই অবস্থায় তো তোমাদের ডিভোর্স সম্ভব না। তুমি কি বাচ্চাটাকে রাখতে চাও? নাহলে আমি এবোর্শনের ব্যবস্থা….”
উষসী আৎকে উঠল। তৃষাণকে থামিয়ে বলল,” একদম না, ভাইয়া। ওর তো কোনো দোষ নেই। ও নিষ্পাপ। কিছুই জানে না। তাহলে আমাদের ভুলের শাস্তি ও কেন পাবে? আমি ওকে অবশ্যই পৃথিবীতে আনবো। যাই হয়ে যাক।”
” তুমি ভালো থাকলেই আমরা খুশি। তবে একটা কথা তুমি ঠিক বলেছো৷ বাচ্চাটার কোনো দোষ নেই৷ সে কিছু জানে না। তেমনি ইয়ামিনের অপরাধের জন্য উষ্ণতাকে শাস্তি দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? সেও তো কিছু জানতো না এই ব্যাপারে।”
উষ্ণতা চুপ করে গেল। তৃষাণ কোমল গলায় বলল,” তোমার উচিৎ হবে ওকে ক্ষমা করে দেওয়া। খুব কষ্ট পাচ্ছে ও। সারাক্ষণ তোমার কথা ভেবে কাঁদে। প্লিজ উষু, তোমার আপুকে ক্ষমা করে দাও।”
সবাই চিন্তিত হয়ে অপেক্ষা করছিল। উষসী ফেরার পর তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটল। ডোনা আর যুথি দুই দিক থেকে উষসীকে জড়িয়ে ধরল। যুথি বলল,” জামাইয়ের সাথে রাগ করে আবার চলে এসেছিস? নাকি এবার সে নিজের ইচ্ছায় আসতে দিয়েছে?”
তৃষাণ বলল,” আসতে দিচ্ছিল না। আমি জোর করে এনেছি।”
যুথি বলল,” ওমা, কি দরকার ছিল?”
ডোনা বলল,” অবশ্যই দরকার ছিল। উষসী তো ওখানে থাকতে চায় না। তাহলে কেন আসবে না?”
যুথি অসন্তুষ্ট হয়ে বলল,” সবকিছু কি ওর মর্জিমতো হতে হবে?”
শাশুড়ী মায়ের কথা শুনে তৃষাণ কিছুটা অবাকই হলো। তিনি এখনও ইয়ামিনের পক্ষ নিয়ে কথা বলছেন কোন হিসাবে? উষ্ণতা দরজার এক কোণায় মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। উষসী হঠাৎ সেদিকে এগিয়ে গেল। কোমল গলায় ডাকল,” আপু, কেমন আছো?”
উষ্ণতা কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। অবাক হওয়া দৃষ্টিতে তাকাল তৃষাণের দিকে। তৃষাণ মুচকি হাসল। উষ্ণতার চোখ দু’টো অশ্রুতে ভরে এলো। উষসী সজোরে উষ্ণতাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল,” আই এম স্যরি আপু। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। প্লিজ।”
উষ্ণতা উষসীর কপালে গালে চুমু দিয়ে বলল,” আমার লক্ষী বোন, মিষ্টি বোন, তোর উপর আমি একদম রাগ করিনি। তাহলে ক্ষমা কেন করব?”
” আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি, ভুল বুঝেছি।”
” না, একদম না। আমার কোনো কষ্ট হয়নি৷ আমি জানতাম আমার বোন বেশিদিন আমার সাথে কথা না বলে থাকতেই পারবে না।”
দুইবোনের মিলন দেখে সবার মুখে হাসি ফুটল। বিকালে সবাই খোশমেজাজে চায়ের আড্ডায় বসল। ঠিক সেই সময় তৃষাণ ডিভোর্সের প্রসঙ্গটা তুলল। যা শুনে যুথির মুখ আঁধার হয়ে গেল। উষ্ণতা বলল,” উষু যখন চাইছে, তখন সেটাই হোক। ”
যুথি বলল” সেটাই হোক মানে? এটা কি কোনো সমাধান হলো? ইয়ামিন কি এমন অন্যায় করেছে যে জন্য ডিভোর্স দিতে হবে? আমি কিছুতেই এর অনুমতি দিবো না। আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট হবে।”
উষ্ণতা বোঝানোর চেষ্টা করল,” ডিভোর্স হওয়া মানেই জীবন নষ্ট হওয়া না মা।”
তৃষাণ বলল,” আমি তো এখনি ডিভোর্সের কথা বলছি না। আপাতত ওরা সেপারেশনে থাকুক৷ এই অবস্থায় ডিভোর্স হওয়াও অসম্ভব।”
ডোনা প্রশ্ন করল,” অসম্ভব কেন?”
তৃষাণ সবার অবগতির উদ্দেশ্যে জানাল,” উষু প্রেগন্যান্ট।”
এই কথা শুনে যুথি বেজায় খুশি হলো। কিন্তু অন্যরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। যুথি হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,” মাশআল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। দেখলি মা, আল্লাহও চায় না যে তোদের ডিভোর্স হোক। নাহলে এই সময়ই কেন এমন সুসংবাদ আসবে বল? আমি তোকে বলি মা, সবকিছু ভুলে যা। সংসারটা নতুনভাবে শুরু কর। ডিভোর্স কোনো সমাধান না, এটা একটা সর্বনাশ। তুই ওই পথে যাস না মা। তুই না আমার লক্ষী মেয়ে?”
উষসী মায়ের কথার কোনো জবাব না দিয়ে বৈঠক থেকে উঠে চলে গেল। উষ্ণতা রেগে বলল,” তোমার কি দরকার ছিল এসব বলার মা? এমনিও মেয়েটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। তোমার কথায় ও আরও আপসেট হয়ে যাবে। জীবনটা তো ওর নিজের। সিদ্ধান্ত ওকেই নিতে দাও।”
” ও নিজের ভালো কতটুকু বুঝে? আর ভুলটা কি বললাম আমি? শুধু আমার মেয়ের ভালো চাই এটাই কি আমার দোষ? তোরা কুবুদ্ধি দিয়ে ওর মাথা খাওয়া বন্ধ কর। কোনো ডিভোর্স হবে না। কেউ এই শব্দ আমার সামনে উচ্চারণ করবে না, বলে রাখলাম।”
যুথি এই কথা বলে উঠে চলে গেল। তৃষাণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। উষ্ণতা বিরক্তিতে মাথায় হাত চেপে ধরল। ডোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল,” মায়েরা এমনই হয়। উষু আমার মেয়ে হলে হয়তো আমিও একই কথা বলতাম। নিজের মেয়ের সংসার ভাঙুক এটা কোন মা চাইবে?”
এক সপ্তাহ কেটে গেল। এর মধ্যে ইয়ামিন অসংখ্যবার উষসীর সাথে দেখা করতে এসেছে। কিন্তু একবারও তাকে দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। উষসী নিজেই দেখা করতে চায়নি। সে এই কয়েকদিন একদম ঘর থেকে বের হয়নি। দেখতে দেখতে কেটে গেল পনেরো দিন। ইয়ামিনও বিরক্ত করা থামিয়ে দিল। উষসী খুব অবাক। কিছুদিন ধরে ইয়ামিন একদম আসছে না৷ দুই দিন আগে উষসী উষ্ণতার সাথে একটু শপিং এ বের হয়েছিল। ভেবেছিল মনটা ভালো হবে। উল্টা মন খারাপ হয়ে গেল। কারণ ইয়ামিনকে বাড়ির আশেপাশে কোথাও দেখা গেল না। এতোদিন সে সবসময় বাড়ির আশেপাশেই ঘুরঘুর করেছে৷ তাহলে এখন কোথায় গেল? উষসী মনের অজান্তেই ইয়ামিনকে মিস করছে। যা সে মানতে না চাইলেও ব্যাপারটা তাকে পীড়া দিচ্ছে। জড়তার কারণে মুখ ফুটে কাউকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেসও করতে পারছে না সে।
একদিন সকালে উষসী মাত্র ঘুমিয়েছে.. ইদানিং রাতে ঘুম হয় না তার। সকালে একটু চোখ লেগে এসেছিল। তখনি খটখট শব্দ হলো দরজায়। উষসী হাই তুলে দরজা খুলতেই যুথি সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল তার গালে।
হঠাৎ এমন আক্রমণে উষসী থতমত গেল। যুথি উত্তপ্ত স্বরে ধমক দিল,” তোর জন্য এসব হয়েছে, বেয়াদব মেয়ে! কি চাস তুই? ছেলেটার জীবন ধ্বংস করতে চাস?”
উষসীর বুক ধ্বক করে উঠল,” কি হয়েছে মা?”
” দ্যাখ কি হয়েছে।”
হাতের ফোন উষসীর দিকে বাড়িয়ে দিল যুথি। জনপ্রিয় ওয়েবসাইটের ব্রেকিং নিউজ, ইয়ামিন ইব্রাহীম গুরুতর এক্সিডেন্টে হাসপাতালে ভর্তি। জানা গেছে অতি শীঘ্রই গান ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি। আর কখনোই গানের জগতে ফিরবেন না। কারণটা এখনও জানা যায়নি৷ অতিরিক্ত মানসিক বিষণ্ণতাও এমন সিদ্ধান্তের কারণ হতে পারে বলে ধারণা করছে নেটিজেনরা। সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব নিয়ে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। উষসী বেশ কিছুদিন ধরে ফোন হাতে নেয় না বলে এসব কিছুই জানতে পারেনি।
যুথি বলল,” আমার সাথে চল, হাসপাতালে জামাইকে দেখে আসব।”
উষসী হাতের ফোন ফিরিয়ে দিয়ে বলল,” আমি কোথাও যাবো না। তোমার যেতে ইচ্ছে করলে তুমি যাও।”
যুথি এই কথা শুনে পুনরায় উষসীর গালে একটা কষে থাপ্পড় মেরে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
চলবে
#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৪৫
লিখা- Sidratul Muntaz
খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের জল ফেলছে উষসী। ইতোমধ্যে হৃদয়ে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। সময়টা কেমন বিষাক্ত বোধ হচ্ছে। নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। ডোরবেলের শব্দ কানে আসতেই সমস্ত অস্থিরতা নিয়ে প্রাণপনে ছুটে ঘরের বাইরে এলো উষসী।
যুথি আর ডোনা হাসপাতালে গিয়েছিল ইয়ামিনের সাথে দেখা করতে৷ তাদের সাথে ক্লাইভও ছিল। ক্লাইভ তৃষানের বন্ধু, এই বাড়ির মালিক। দিনের বেশিরভাগ সময় সে বাইরেই থাকে।
উষসী মায়ের সামনে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না। কিন্তু ডোনাকে একা পেতেই ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলল,” ভালো আন্টি, গিয়ে কি দেখলে তোমরা? উনি কেমন আছে?”
ডোনা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বললেন,” সেটা শুনে তোর কাজ নেই মা।”
“আমার কাজ নেই মানে?”
” তোদের না ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে?” ডোনা ফোঁড়ন কাটলেন।
উষসী কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,” আরে, ডিভোর্স হচ্ছে বলে কি আমি কিছু জানতেও পারব না? অন্তত মানবতার খাতিরে তো জিজ্ঞেস করতেই পারি যে সে কেমন আছে?”
ডোনা চেয়ে দেখলেন উষসীর চোখ দু’টো জলে পরিপূর্ণ। আরেকটু হলেই মেয়ে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলবে। মেয়েটাকে আর জ্বালাতে ইচ্ছে হলো না। মুখের হাসি গোপন করে তিনি বললেন,” আছে… ভালোই আছে।”
উষসী উন্মুখ হয়ে শুধাল,” সত্যি ভালো আছে? তুমি এভাবে বলছো কেন? একটু ডিটেলস বলো না! এক্সিডেন্ট কিভাবে হলো?”
এমন সময় যুঁথি ঢুকলেন। রাগী স্বরে জবাব দিলেন,” কেন? তোর এতো ডিটেলস জানার প্রয়োজন কেন? যখন আমি যেতে বললাম তখন তো বললি তোর কোনো দরকার নেই। তাহলে এখন এতোকিছু জানতে চাইছিস কেন?”
ডোনা নরমভাবে বলল,” আহা আপা, বাদ দাও।”
” না। বাদ দিবো কেন? ছেলেটা প্রত্যি বাক্যে শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করছিল। উষসী কোথায়, উষসী কোথায়? আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি৷ জামাইয়ের সামনে মাথা হেঁট হয়ে গেছে। শত্রু অসুস্থ হলেও তো মানুষ ভদ্রতার খাতিরে দেখা করতে যায়।”
উষসী চোখে পানি নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ডোনা বললেন,” বেশি হয়ে গেল না আপা?”
” এইটুকু বেশির প্রয়োজন ছিল। ও যেটা করেছে সেটাও অনেক বেশি। বেয়াই ফোন করে ওর কথা জিজ্ঞেস করেছিল। কত বিশ্বাস নিয়ে বলছিল উষসী থাকলে নাকি ইয়ামিনের দেখা-শোনার কোনো ত্রুটি হবে না৷ এখন আমি বেয়াইকে কিভাবে বলি যে আমার পাষাণ মেয়ে ওকে হাসপাতালে দেখতে পর্যন্ত যায়নি?”
ডোনা নিজেও উষসীর আচরণে অবাক হয়েছেন। বুকভরা মায়া যেই মেয়ের, সে এমন নিষ্ঠুর আচরণ কিভাবে করল? তবে এখন তিনি বুঝেছেন, উপরে যতই শক্ত খোলস ধারণের চেষ্টা করুক সে… ভেতরে এখনও নরম!
আজ সারাদিন তৃষাণ বাড়িতে ছিল না। রাতে সে ফিরলেই উষ্ণতা জানাল ইয়ামিনের এক্সিডেন্টের খবর। এসব শোনার পর থেকে উষসী শুধু কান্নাকাটিই করছে। সারাদিন কিছু খায়নি। সবকিছু শুনে উষসীর ঘরে খাবার নিয়ে গেল তৃষাণ।
তখনও উষসী বিছানায় বসে কাঁদছিল। তৃষাণকে দেখে দ্রুত হাতে চোখের জল মুছল।
” তোমার আপুর কাছে শুনলাম, সারাদিন নাকি কিছু খাওনি তুমি?”
” আসলে আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। খাবার মুখে দিলেই বমি আসছে।”
” এখন একবার চেষ্টা করো। খেতে তো হবেই।”
উষসী হাসার ভাণ করে বলল,” রেখে যাও। খেয়ে নিবো আমি।”
তৃষাণ যাওয়ার আগে বলল,” আমি তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি, যদি তুমি চাও।”
এই কথা শুনে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল উষসী। নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না। ভুল শুনেছে কি-না বুঝতে প্রশ্ন করল,” সত্যি?”
উষসীর উদ্দীপনা দেখে তৃষাণ বলল,” কিন্তু আগে খাবার শেষ করতে হবে।”
উষসী মাথা নাড়ল আর খুব দ্রুত খাওয়া শুরু করল। হাসপাতালে গিয়ে জানা গেল ইয়ামিনের রিলিজ হয়ে গেছে। এই কথা শুনে উষসীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। কত আশা নিয়ে এসেছিল সে। অথচ দেখাটাই হলো না। তৃষাণ প্রশ্ন করল,” তুমি কি ওর বাসায় যেতে চাও?”
উষসী অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চাইল৷ তৃষাণ স্থির কণ্ঠে বলল,” এসেছোই যখন দেখাটা করেই যাও। মন শান্ত হোক।”
উষসী ঘাড় নাড়ল। তৃষাণ গাড়ি ঘোরাল। গাড়ি থামল একেবারে ইয়ামিনের বাড়ির সামনে। তৃষাণ বলল,” তুমি ভেতরে যাও। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।”
” আচ্ছা।”
উষসী গাড়ি থেকে নামতে নিয়ে থামল। পেছনে একবার চেয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,”থ্যাঙ্কিউ। ”
তৃষাণ মুচকি হাসল। উষসী বলল,” আমার বেশিক্ষণ লাগবে না। দশমিনিটের মধ্যে চলে আসব।”
” সমস্যা নেই। টেইক ইউর টাইম৷ আমি অপেক্ষা করব।”
কৃতজ্ঞতায় চোখ দু’টো ঝলমল করে উঠল উষসীর।দ্রুতপায়ে সে গাড়ি থেকে নামতে নিয়ে একবার হোঁচট খেল। তৃষাণ বলল,” সাবধানে!”
উষসী হেসে ফেলল। তার পায়ের জোর এতোটুকু কমল না। তাকে ঢুকতে দেখে আয়শা উত্তেজনায় চিৎকার দিয়ে বলল,” ভাবী, আপনি এসেছেন? আল্লাহ, আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না ভাবী।”
” ইয়ামিন কোথায়? ঘুমিয়ে গেছে নাকি?”
” না, স্যার তো জেগেই আছেন। ভাবী আপনি কি রাতে থাকবেন? ডিনার করবেন? কি রাঁধবো আপনার জন্য?”
উষসী হেসে ফেলে বলল,” এতো অস্থির হওয়ার কিছু নেই। আমি একটু পরেই চলে যাবো। রোগী দেখতে এসেছি। ”
আয়শার তুমুল আনন্দে ভাঁটা পড়ল। মুখ মলিন করে বলল,” ও। স্যার উপরের ঘরে আছেন। কিন্তু আপনি এখন যেয়েন না।”
” যাব না কেন?” উষসী ভ্রুকুটি করল। আয়শা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” মানে.. ওইযে, উপরে আর কি..”
আয়শার পুরো কথা শোনার ধৈর্য্য পেল না উষসী৷ ধুপধাপ শব্দে সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে গেল। ইয়ামিন তার বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। ডান হাতেও ব্যান্ডেজ। বামপায়েও ব্যান্ডেজ। আসলে কোন জায়গায় আঘাত লেগেছে তা ঠিক করে বোঝা সম্ভব নয়৷ শুধু ব্যান্ডেজের উপর ব্যান্ডেজই দেখা যাচ্ছে শরীরে।
কীর্তি বিরক্তিসূচক কণ্ঠে বলল,” ব্যাপারটা খুব সিলি, ইয়ামিন। তুমি কি সত্যি গান ছেড়ে দিবে?”
” এই বিষয়ে এখন কথা বলাটা কি খুব জরুরী, কীর্তি? আমি টায়ার্ড! ”
” আশ্চর্য! তোমার কাছে কি জরুরী মনে হচ্ছে না ব্যাপারটা? তোমার এতো সুন্দর বাঁধা ক্যারিয়ার শুধুমাত্র একটা মেয়ের জন্য নষ্ট হয়ে যাবে? তাও সেই মেয়ে, যে কোনোদিন তোমার মূল্যই বুঝল না?”
” উষসীর ব্যাপারে আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি না, প্লিজ। তুমি ওকে চেনো না, কখনও দেখোনি৷ তাই ও কিরকম সেটা তোমার বোঝার কথা না। যাও এখান থেকে। লীভ মি এলোন। আমি ঘুমাবো। ”
ইয়ামিন তার মুখে মালিশ করল। যদিও সে ভালো করেই জানে তার ঘুম আসবে না। গত পনেরো দিন ধরে একটা রাতও ভালো করে ঘুমিয়েছে কি-না মনে পড়ছে না। চোখের নিচে গাঢ় দাগ পড়ে গেছে। দেখাচ্ছে অসুস্থ রোগীর মতো। উষসীর সাথেও দেখা হচ্ছে না।
মন-মেজাজ অত্যন্ত খারাপ। এই অবস্থায় মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে জুটেছে কীর্তি। এক্সিডেন্টের খবর পেয়েই মুম্বাই থেকে ছুটে এসেছে। কে বলেছে তাকে আসতে? যার আসার দরকার সে তো আসে না!
বিরহে কাতর ইয়ামিনের মন৷ কবে শুধু একবার দেখবে উষসীকে! ব্রেকিং নিউজ ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই ফ্যানদের যন্ত্রণায় টিকে থাকা মুশকিল হয়ে উঠেছে। ফুল দিয়ে হাসপাতালের কেবিন, ইয়ামিনের বাড়ি, গাড়ি ভরে যাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ দেখা করতে আসছে। অথচ যার জন্য এতোকিছু সে-ই নেই। যেন তার কিছু যায়ই আসে না। এসব ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল ইয়ামিন। মেয়ে মানুষ বুঝি এতো নিষ্ঠুরও হয়?
কীর্তি ইয়ামিনের কাঁধে হাত রেখে বলল,” তোমাকে খুব আপসেট দেখাচ্ছে। উষসীকে তুমি খুব ভালোবাসো তাই না? ”
” হ্যাঁ। খুব ভালোবাসি।” ইয়ামিনের চোখ উজ্জ্বল দেখাল।
কীর্তি মনমরা হয়ে বলল,” কিন্তু সে তো তোমাকে ভালোবাসে না৷ ভালোবাসলে কি এভাবে ছেড়ে চলে যেতো? আর এতোবড় একটা নিউজ পেয়েও কি অন্তত একবার হলেও দেখা করতে আসতো না? কিন্তু সে কি এসেছে বলো? প্লিজ, ওর প্রতি তুমি এক্সপেক্টেশন কমাও। পরে নিজেই কষ্ট পাবে। গেট আ লাইফ। এইভাবে তোমাকে দেখতে আমার একদম ভালো লাগছে না।”
উষসী এই দৃশ্য দেখে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইল। ইয়ামিন চোখ বন্ধ করে বলল,” তোমাকে দেখতে কে বলেছে? না দেখলেই পারো।”
” ইয়ামিন, আমি কিন্তু মজা করছি না। আমি শুধু তোমাকে ভালো সাজেশন দিচ্ছি।”
” সেটাই তো৷ কেন দিচ্ছো?তোমার কাছে সাজেশন চাইনি আমি৷ এই ব্যাপারে আমার কারো সাজেশন প্রয়োজন নেই। এটা আমার খুব ব্যক্তিগত বিষয়। ”
” এর মানে কি তুমি ওই মেয়েটাকে ছাড়বে না? নিজের অবস্থা দেখেছো তুমি? রিলেশনে মানুষ রিফ্রেশমেন্টের জন্য যায়। আর সেই রিলেশনই যখন হয় ডিপ্রেশনের কারণ তখন সেটা আগলে ধরে বসে থাকার কি মানে? এইটা বোকামি ছাড়া আর কি?”
আয়শা খাবার হাতে ঘরে ঢুকতে নিয়ে দেখল উষসী বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে এখনও। সে অবাক হয়ে বলল,” ম্যাডাম…”
সাথে সাথে উষসী তাকে থামাল। চুপ হওয়ার নির্দেশ দিল। আয়শা ফিসফিস করে বলল,” স্যারকে দেখতে ভেতরে যাবেন না ম্যাডাম?”
” তোমার স্যার তো ব্যস্ত আছেন। আমি আর গিয়ে কি করব বলো?”
” ভুল বুঝবেন না ম্যাডাম। উনি স্যারের কলীগ হয়। এক্সিডেন্টের খবর শুনে দেখা করতে এসেছেন। ব্যস, এটুকুই।”
” ও। সেজন্যই বুঝি বেডরুম ঢুকে একদম গায়ের উপর হাত রেখে বসে আছে?” উষসীর মুখ দেখেই বোঝা গেল ঈর্ষায় পুড়ছে সে। যেই হাত দিয়ে কীর্তি ইয়ামিনের কাঁধ স্পর্শ করেছে, সেই হাতের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন হাতটাই ভেঙে ফেলতে চায়।
আয়শা বুদ্ধি করে বলল,” ম্যাডাম, একটা কাজ করুন। আপনি এই খাবার নিয়ে ভেতরে যান।”
” না থাক।”
” প্লিজ ম্যাডাম, যান। কীর্তি ম্যাডাম আপনাকে দেখলেই সরে যাবে। সকাল থেকে স্যারকে খুব বিরক্ত করছে। যান না ম্যাডাম!”
উষসী বাধ্য হয়ে খাবারের ডিস হাতে নিল। কীর্তি আফসোস করে বলছে,” নিজের ভালো তুমি কবে বুঝবে ইয়ামিন? আগের মেয়েটিও তোমার যোগ্য ছিল না। সে তোমার অর্ধেক জীবন নষ্ট করেছে। আর বাকি অর্ধেক নষ্ট করছে উষসী। এরা কেউই তোমাকে ডিজার্ভ করে না।নিজের ভালোবাসা তুমি অপাত্রে দান করছো।”
উষসী পেছনে এসে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল,” আচ্ছা তাই? আপনি এসব কিভাবে জানেন?”
কীর্তি চমকে উঠল। ইয়ামিন বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলে উঠল,” তুমি এখানে?”
উষসী মৃদু হেসে খাবারের ডিসটা টেবিলে রাখল। তারপর কীর্তিকে পাশ কাটিয়ে বিছানায় ইয়ামিনের পাশে বসল। ইয়ামিন পলক না ফেলে উষসীকেই দেখছিল তৃষ্ণার্তের মতো। যেন প্রাণ ফিরে পেল বহুদিন পর। এক টুকরো সুখের মেঘ ছুঁয়ে গেল মন। বিষণ্ণ, মলিন মুখটা মুহূর্তেই প্রাণবন্ত আর ঝলমলে হয়ে উঠল।
কীর্তিকে কিছুটা বিব্রত দেখাচ্ছিল। উষসী বলল,” হায়, আমি লামিয়া ইমরোজ উষসী। যার সম্পর্কে এতোক্ষণ আপনি গসিপ করছিলেন!”
কীর্তি নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে বলল,” জ্বী। চিনতে পেরেছি।”
” আমার মনে হয় আপনাকে এখন আর দরকার নেই। কারণ আমার স্বামীর খেয়াল রাখার জন্য আমি নিজেই এনাফ। ঠিক না?”
উষসী ইয়ামিনের দিকে তাকাল। ইয়ামিনের বিশ্বাস হচ্ছে না। পুরো বোকার মতো তাকিয়ে থেকে শুধু মাথা নেড়ে বলল,” হ্যাঁ। একদম ঠিক। ”
উষসী কীর্তির দিকে চেয়ে খিলখিল করে হাসল। কীর্তি একটা ভদ্রতার হাসি দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। উষসী নিজের মনে অসীম শান্তি অনুভব করল তখন। সে বের হয়ে যেতেই ইয়ামিন দুইহাতে তীব্রভাবে জড়িয়ে ধরল উষসীকে। তারপর উত্তালভাব গালে চুমু দিল।
” জানতাম তুমি না এসে থাকতে পারবে না। আমার উষুপাখি, আমার জান, আমার পরী, আই লভ ইউ।”
” ইশ, ছাড়ুন। মানবতার খাতিরে এসেছি৷ এটাকে ভালোবাসা ভাববেন না।”
” কেন ভাববো না? এটা তো ভালোবাসাই।”
” ঢং করবেন না। কীর্তিকে নিয়ে তো ভালোই ফূর্তিতে ছিলেন দেখলাম।”
ইয়ামিন হতভম্ব চিত্তে শুধাল,” মানে? আমি কীর্তিকে নিয়ে ফূর্তিতে ছিলাম?”
“অবশ্যই ছিলেন। ও আপনার বেডরুমে কেন এলো? আপনার কাঁধে হাত কেন রাখল? আপনি কিছু বললেন না কেন?”
” যা বলার তুমিই তো বলে দিলে। আমার কি আর কিছু বলার দরকার আছে?”
উষসী জবাব না দিয়ে খাবারের ডিশটা হাতে নিল। ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল,” এতোরাত হয়ে গেছে, এখনও ডিনার করেননি কেন?”
” কিভাবে খাব? হাতে ব্যথা যে!”
ইয়ামিন তার ব্যান্ডেজ করা হাতটা দেখাল। উষসী ক্ষীপ্ত হয়ে বলল,” আমাকে জড়িয়ে ধরার সময় তো ব্যথা দেখলাম না। আর খাওয়ার সময়ই ব্যথা? বাহানা যত! হাঁ করুন। পাঁচমিনিটে খেতে হবে। তারপর আমি চলে যাব।”
” কোথায় যাবে?”
” নিচে তৃষাণ ভাই দাঁড়িয়ে আছে।”
ইয়ামিন বিষম খেল,” উনি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে? সত্যি?”
উষসী পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বলল,” এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ ন্যূনতম মানবতাবোধ তারও আছে। আমি চেয়েছিলাম বলেই নিয়ে এসেছে।”
” বাহ, তোমরা শালি-দুলাভাই দু’জনেই দেখছি মানবতার ভান্ডার।”
উষসী তেরছা দৃষ্টিতে চাইল,” মজা করছেন আমাদের নিয়ে?”
” না। তুমি কি একটা রাতও থাকবে না? এসেই চলে যাবে?”
” আপনার সাথে আমি কেন থাকব শুনি? দুইদিন বাদে আমাদের ডিভোর্স হতে যাচ্ছে। এক্সিডেন্ট করেছেন মানেই যে সব বদলে যাবে এমন ভাববেন না আবার।”
ইয়ামিন বিরস মুখে খাবার খেতে লাগল। উষসী জিজ্ঞেস করল,” এক্সিডেন্ট কেন হলো?”
” ভালোর জন্য।”
ইয়ামিনের নির্লিপ্ত উত্তর শুনে উষসী চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,” মানে?”
” এক্সিডেন্ট না হলে তো তুমি এখানে আসতে না। এভাবে যত্ন করে খাইয়েও দিতে না। থ্যাংক গড যে আমার এক্সিডেন্ট হয়েছিল৷ তাই পনেরো দিন পর হলেও তোমার দেখা পেয়েছি। মানবতার জয় হোক। আর এমন এক্সিডেন্ট আমার প্রতিদিন হোক।”
” একটা চড় মারব ফালতু কথা বললে। এক্সিডেন্ট কিভাবে হয়েছিল সেটা জিজ্ঞেস করেছি আমি।”
” ব্রেইক ফেইল হয়ে গেছিল। গাড়ির ইঞ্জিন গরম হয়ে গাড়িতে আগুন লেগে গেল।”
” ওমা, তারপর?”
” তারপর আর কি? গাড়ি থেকে লাফ দিয়েছি।”
” ব্যথা লাগেনি?”
” লেগেছে তো। এইখানে, এইখানে তবে সবচেয়ে বেশি ব্যথা ছিল এইখানে।”
ইয়ামিন তার বুকের বামপাশে হাত রাখল। তারপর মুচকি হেসে বলল,” এখন সেরে গেছে। তোমাকে দেখে। ”
উষসী সজোরে একটা ঘুঁষি মারল তার বুক বরাবর। ইয়ামিন শব্দ করে হেসে উঠল। খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই ফোন বেজে উঠল উষসীর। তৃষাণের নাম্বার দেখে সে বলল,” এইতো, ভাইয়া মনে হয় নিচে নামার জন্য ফোন করছে।”
ইয়ামিন ফট করে উষসীর থেকে মোবাইলটা কেঁড়ে নিল। চোখ বড় করে তাকাল উষসী,”দেখুন,আমার ফোন দিন।”
” না। তুমি আজকে যেতে পারবে না।”
” অবশ্যই আমি যাবো।”
” উহুম। অসম্ভব।”
উষসী জোরাজুরি শুরু করলেই ইয়ামিন চেঁচিয়ে উঠল,” আউ, ব্যথা…”
” স্যরি…” উষসী নরম হলো।
ইয়ামিন এমন ভাব করল যেন হাতের ব্যথায় সে মরেই যাচ্ছে। এই ফাঁকে নিজের ফোন কেঁড়ে নিল উষসী। ইয়ামিন রেগে বলল,” এটা চিটিং। ”
উষসী জীভ বের করে মুখ ভেঙচাল। তারপর দূরে গিয়ে তৃষাণকে ফোন করল,” হ্যালো ভাইয়া।”
” উষু, কখন আসবে তুমি? আমি ওয়েট করব নাকি চলে যাবো?”
এই সুযোগে উষসী বলে ফেলল,” তোমার দাঁড়াতে বেশি কষ্ট হলে চলে যেতে পারো। সকালে না হয় এসো!”
এই কথা শুনে হাসল ইয়ামিন। তৃষাণ প্রশ্ন করল,” সকালে কখন?”
” আমি ফোন করব।”
” ঠিকাছে।”
ফোন রাখতেই সে দেখল ইয়ামিন বত্রিশ পাটি বের করে হাসছে। প্রাণ খুলে হাসলে যে কাউকে সুন্দর লাগে। কিন্তু ইয়ামিনকে চমৎকার লাগছে। উষসী বেশিক্ষণ তাকাল না। সে ধরা খেতে চায় না। এমনিতেও এই হাড় বজ্জাত লোকের বজ্জাতির প্রেমে পড়ে তার অর্ধেক জীবন শেষ। এখন আবার নতুন করে হাসির প্রেমে পড়ে সে বাকি জীবন শেষ করতে চায় না।
ইয়ামিন বলল,” থ্যাঙ্কিউ। ”
” এতো থ্যাঙ্কিউ বলার কিছু নেই। আমি আম্মুর জন্য এটা করছি। কাল আম্মু এখানে এসে যদি দেখে আমি নেই তাহলে কি ভাববে আমার সম্পর্কে? ”
ইয়ামিন আবারও হাসল। উষসী মুখ গম্ভীর করে বিছানায় বসেই সতর্ক সংকেত দিল,” খবরদার, কোনো উনিশ-বিশ করার চেষ্টা করলে কিন্তু ঘুষি খাবেন। আমরা একহাত দূরত্ব বজায় রেখে শোবো। আপনি খাটের ওই প্রান্তে আর আমি…”
উষসী তার কথা শেষ করতে পারল না। এর আগেই ইয়ামিন ‘উনিশ-বিশ’ টা করে ফেলল। হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল তার কোমড়ে আর ঠোঁট দিয়ে ধরল ঠোঁট। ঘটনার আকস্মিকতায় উষসী ঝিম মেরে গেল একদম। গাঢ় অনুভূতিতে চোখে অশ্রু জমতে লাগল।
বেশ কিছুক্ষণ পর ইয়ামিন অনুভব করল উষসী কাঁদছে… তখন অচিরেই ছেড়ে দিল তাকে। অবাক হয়ে বলল,” কি হয়েছে উষুপাখি?”
কান্নামাখা গলায় খেঁকিয়ে উঠল উষসী,” আপনি একদম টাচ করবেন না আমাকে। একদম না।”
” ঠিকাছে।”
” ছাড়ুন আমাকে। ছাড়ুন।”
” কিন্তু আমি কিভাবে ছাড়ব? তুমিই না আমাকে ছাড়বে।”
উষসী খেয়াল করল ইয়ামিন তাকে বহু আগেই ছেড়ে দিয়েছে। বরং কঠিন হাতে ইয়ামিনকে ধরে আছে সে নিজেই! লজ্জা পেয়ে গেল উষসী। ইয়ামিন হেসে বলল,” দেখলে, তুমি নিজেই আমার আদর পেতে উন্মুখ হয়ে আছো। তবুও কেন অস্বীকার করছো উষুপাখি? নিজেও কষ্ট পাচ্ছো, আর আমাকেও কষ্ট দিচ্ছো।”
উষসী ইয়ামিনের মুখটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,”মোটেও না, আপনার আদর আমার একদম চাই না।”
এই কথা বলে উন্মাদের মতো ইয়ামিনের কপালে, নাকে, গালে চুমু দিতে লাগল সে। কাতর গলায় বলতে লাগল,” আমি আপনাকে একটুও ভালোবাসি না।”
তারপর গলায় চুমু দিতে দিতে বলল,” যদি আর কখনও আমাকে ছেড়ে যান অথবা আমার সাথে মিথ্যা বলেন, তাহলে আমি আপনাকে মেরে ফেলব। বুঝেছেন?”
ইয়ামিন শক্ত করে উষসীকে জড়িয়ে ধরে বলল,” বুঝেছি, কিন্তু তুমি তো আমার বুকে ঝড় তুলে দিলে একদম। এবার ঝড়ের পরিণাম সামলাতে পারবে তো জান?”
উষসী কাঁদতে কাঁদতে বলল,” আপনি একটা শয়তান, রাক্ষস।”
ইয়ামিন ঘোর মেশানো কণ্ঠে বলল,” আর তুমি আমার জান। আমার আদরের বউ, উষুপাখি।”
চলবে