আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-৪০+৪১

0
570

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৪০
লিখা- Sidratul Muntaz

(অতীত)
বিয়ের সাতদিনের মাথায় ইয়ামিন নববধূ রেখে বিদেশ চলে যাওয়ায় সবার মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ইয়ামিনের বাবা-মা পর্যন্ত সন্দেহ করতে ছাড়ল না। তারা তো উষসীকে এই বিষয়ে প্রায়ই জিজ্ঞাসাবাদ করতো। উষসী বহু কষ্টে নিজের মধ্যে সব চেপে রেখেছে। কাউকে কখনোই কিছু বুঝতে দেয়নি।

দীর্ঘ এক বছর পর ইয়ামিন হঠাৎ দেশে ফিরে আসে। উষসী ভেবেছিল এবার বুঝি সব ঠিক হয়ে যাবে। ইয়ামিন হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরে উষসীর কাছে ক্ষমাও চাইবে। উষসী প্রথমে মানতে চাইবে না। ইয়ামিনকে শাস্তি দিবে। তারপর একদিন সব মেনে নিবে।

অথচ উষসীর ভাবনার মতো কিছুই হলো না। ইয়ামিন বিন্দুমাত্র বদলালো না। দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে সে বলেছিল ফিরে এসে উষসীকে ডিভোর্স দিবে। তারপর পরিবারের সবাইকে একটা বানোয়াট কারণ দেখিয়ে বোঝাবে যে তারা সুখে নেই। সবাই তাদের বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত সহজেই মেনে নিবে। দেশে ফিরে সত্যি সেটাই করল ইয়ামিন। একদিন রাতে সে বলল,” আগামীকাল সকালে ডিভোর্সের জন্য কোর্টে যাবো আমরা। তৈরী থেকো।”

উষসী নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ওই একটি কথায় তার দুনিয়া উলোটপালোট হয়ে গেল। অথচ ইয়ামিন কেমন নির্বিকার! যেন সকালে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা বলছে সে। একটা বিয়ে ভাঙা বুঝি এতোই সহজ তার কাছে!

তারপর সারারাত উষসীর ঘুম এলো না। ডিভোর্সের পর বাড়িতে সবাইকে কি জবাব দিবে এই নিয়ে চিন্তা করতে করতে তার মাথা ব্যথা হয়ে গেল। একবার তো ভীষণ কান্নাও পেল। অথচ ইয়ামিনের পাষাণ হৃদয় এতোটুকু গললো না।

সকালে উষসী পাথুরে মূর্তির মতো ইয়ামিনের সব কথা মেনে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। কিন্তু নিয়তির ইচ্ছেটা হয়তো অন্যরকম ছিল। ইয়ামিন কি মনে করে যেন তার কিশোর বয়সের বাইক নিয়ে সকালে বের হয়েছিল। তখনি এক্সিডেন্টটা হয়। উষসী কোর্টে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়েছিল। কিন্তু তাকে যেতে হলো হাসপাতালে।

গুরুতর এক্সিডেন্টে ইয়ামিনের পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। এছাড়াও অনেক মেজর ইনজুরি হয় পায়ে। আর্থোপেডিক্স আশংকা করেছিলেন, হয়তো ইয়ামিনের ডান পা আর কখনোই ঠিক হবে না। এই ঘটনার পর হাহাকার নেমে আসে তাদের বাড়িতে। পুরো দেশজুড়ে খবরটি নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

নিজের এহেন করুণ অবস্থাতেও ইয়ামিন কিন্তু ডিভোর্সের কথা ভুলে যায়নি। সে নির্দ্বিধায় উষসীকে প্রস্তাব দিল,” তুমি চাইলে মুক্তি নিয়ে চলে যেতে পারো। আমি সুস্থ থাকলে এতোদিনে আমাদের ডিভোর্স হয়েই যেতো। অসুস্থতার বাহানায় তোমাকে আমি আটকে রাখতে চাই না।”

উষসী মুখ ভার করে বলে ফেলল,” আমি তো এই অবস্থায় আপনাকে ডিভোর্স দেবো না!”

ইয়ামিন তাচ্ছিল্য হেসে শুধাল,” কেন? দয়া দেখাতে চাও নাকি?”

উষসীও হেসে ফেলল। গভীর হতাশাময় নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” আপনাকে দয়া দেখানোর আমি কে বলুন? আমি আপনাকে ছেড়ে গেলেও আপনার জন্য মেয়ের অভাব হবে না। আপনি হলেন বিখ্যাত ইয়ামিন ইব্রাহীম, সবার চোখের মণি। ভক্তকূল আপনার জন্য প্রাণ নিবেদন করতেও প্রস্তুত। সেখানে আমার স্পর্ধা কিভাবে হবে আপনাকে দয়া দেখানোর? কিন্তু আপনাকে ছেড়ে গেলে যে আমি সবার কাছে দোষী হবো! আপনি অসুস্থ, এই অবস্থায় আপনাকে ছেড়ে গেলে মানুষ আমাকে স্বার্থপর ভাববে। কেউ তো আর জানবে না যে আমাদের আগেই ডিভোর্স হওয়ার কথা ছিল। বরং সবাই ভাববে… এক্সিডেন্টে আপনার পা ভেঙে যাওয়ার কারণে আমি আপনাকে ডিভোর্স দিয়েছি। শুধু শুধু নিজের এতোটা বদনাম আমি করতে চাই না৷ যখন আপনি সুস্থ হবেন… ডিভোর্স তখনি হবে। ততদিন না হয় আমি অপেক্ষা করব।”

ইয়ামিন উষসীর কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে ভাবল। এক পর্যায় মাথা নেড়ে বলল,” ভালোই বলেছো। এই অবস্থায় ডিভোর্স হলে মানুষ তোমাকে স্বার্থবাদী ভাববে আর আমাকে সিমপ্যাথি দেখাবে। অথচ ব্যাপারটা তো উল্টো হওয়ার কথা ছিল, তাই না? নিজের স্বার্থের জন্য আমিই তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি। স্বার্থবাদী তো আমিই হলাম।”

” সেসব কথা থাক। আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন এই কামনা করি।”

ইয়ামিন প্রথমে উষসীর কথা বিশ্বাস করেছিল। সে ভেবেছিল হয়তো সত্যিই উষসী নিজের বদনাম হওয়ার ভয়ে ডিভোর্স নিতে চাইছে না। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল, উষসীর উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ আলাদা। সে ইয়ামিনের অসহায় অবস্থায় তাকে ছেড়ে যেতে চায়নি বলেই ডিভোর্স নেয়নি। নিজের ইমেজ খারাপ হওয়ার ভয়ে না। উষসীর মতো মেয়েরা কখনও নিজেকে নিয়ে এতো ভাবে না৷ তারা যাকে ভালোবাসে, মন উজাড় করে বাসে। খুব সরল মনে, নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে সে ইয়ামিনকে ভালোবেসেছিল। পৃথিবীর শুদ্ধতম ভালোবাসা।

টানা ছয়মাস ইয়ামিনকে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়। এই এতোগুলো দিন শিমলাও হয়তো মা হিসেবে নিজের ছেলের এতোটা যত্ন করতে পারেননি, যতটা যত্ন উষসী করেছে। ইয়ামিনের বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হবে ভেবে সে সারারাত জেগে থাকে। মুখ দিয়ে ডাকার আগেই হাজির হয়ে যায়। কখন কোন ঔষধ খেতে হবে, কয়ঘণ্টা হাঁটতে হবে, কয়ঘণ্টা ঘুমাতে হবে… সব উষসীর নখদর্পনে চলে আসে মাত্র কয়েক দিনেই। এমনও হয়েছে ইয়ামিন বাথরুমে যাওয়ার জন্য ওঠার চেষ্টা করছে তখন স্বয়ংক্রিয় উষসীর ঘুম ভেঙে যায়। সে আন্তরিক হেসে বলে,” আরে, আমাকে ডাকবেন না?”

তারপর অতি যত্নে ইয়ামিনের হাত নিজের কাঁধে নিয়ে তাকে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে ওঠায়। সুস্থ হলেই যাকে ডিভোর্স দিতে হবে তার জন্য এতো কষ্ট, এতো ত্যাগ কোনো সাধারণ নারীর পক্ষে করা কি সম্ভব?

ইয়ামিন ক্লান্ত হয়ে একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেলল,” এসব করে তোমার কি লাভ হয় উষসী? আমাকে ঋণী বানাতে চাও?”

উষসী উচ্চশব্দে হেসে বলল,” এটা ঋণ হবে কেন? আমি আপনার স্ত্রী৷ এসব আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আর আমি কখনও নিজের দায়িত্বের অবহেলা করি না।”

ইয়ামিন অবাক চোখে তাকাতেই উষসী বলল,”মজা করলাম। আসলে আমি এসব না করলে মা-বাবা কি ভাববে বলুন? ভাববে তাদের ছেলের প্রতি আমার কোনো ভালোবাসাই নেই। আমি নিজের ইমেজ তাদের কাছে খারাপ করতে চাই না। যা করছি সব নিজের জন্যই করছি। আপনি ভাববেন না যে আপনার জন্য করছি। এখানে আপনার গিল্টি ফীল করারও কিছু নেই।”

মুখে এসব বললেও উষসী মন থেকে যে কি চায় তা ইয়ামিন বেশ ভালোই জানে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে সেই চাওয়াটা সে কখনোই উষসীকে দিতে পারবে না। নিজের প্রতি উষসীর ভালোবাসা সম্পর্কে সে আগেই অবগত ছিল। কিন্তু কখনও উপলব্ধি করেনি। ছয়মাস বেডরেস্টে থাকা অবস্থায় সেই ভালোবাসার উত্তাপ উপলব্ধি করার সুযোগ হয়৷ তখন সে নিজের কাছে অপরাধী হতে শুরু করে আর উষসীর কাছে অতি নগন্য!

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙলে সে দেখে উষসী নামাযে বসে ফুপিয়ে কাঁদছে, তার চোখ ফুলে যাচ্ছে, মগ্ন হয়ে সে এবাদত করছে। দোয়া পড়ে ইয়ামিনের গায়ে এসে ফু দিচ্ছে আবার কখনও কাতর হয়ে কপালে দিচ্ছে চুমু। ফজরের নামায শেষ করে উষসী ঘুমাতে আসে রোজ। অথচ ইয়ামিন সারারাত জেগে থাকে। এতোটুকু ঘুমাতে পারে না। তার বিবেক তাকে জাগিয়ে রাখে প্রতিটি রাত। দিনের পর দিন তার উষসীর প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ে আর নিজের প্রতি বাড়ে তীব্র ঘৃণা।

ভাগ্যের জোরেই হোক কিংবা উষসীর দোয়ার জোরেই হোক, ইয়ামিন সুস্থ হতে পেরেছিল অবশেষে। তাদের পুরো পরিবার অপারেশনের জন্য কানাডায় যায়। তার সুস্থতা উপলক্ষ্যে সবার মাঝে আনন্দের ঢেউ পরিলক্ষিত হয়। ইয়ামিনের মনে হয়, সে একটা নতুন জীবন পেয়েছে। তার দূর্ভাগ্য বদলে গেছে। এই পুরো ক্রেডিট শুধু উষসীর। সবার সামনে ইয়ামিন ঘোষণা করে যে সে কতটা ভাগ্যবান বলে উষসীর মতো স্ত্রী পেয়েছে! তাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য ইয়ামিন চেরি গার্ডেনে একটা পার্টির ব্যবস্থা করে।

তাদের জুটি দেখে মানুষ ঈর্ষান্বিত হয়। শিমলা আর আজগর দোয়া করেন যেন কখনোই তাদের সম্পর্কে নজর না লাগে। অথচ আড়ালের খবর তো কেউই জানে না। তবে এতোকিছুর পরে উষসী আবারও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। ভেবেছিল এবার বুঝি ইয়ামিন তার ভালোবাসা বুঝবে। আর কখনও ডিভোর্সের কথা বলবে না।

কিন্তু সবই মিথ্যা ছিল। ইয়ামিন তৃতীয়বারের মতো উষসীর স্বপ্ন ভঙ্গের কারণ হলো। তাকে চোখে আঙুল দিয়ে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিল যে সবার জন্য সবকিছু না। বাংলাদেশে ফিরেই ইয়ামিন ডিভোর্সের প্রসঙ্গ তুলে। কানাডায় সবার সামনে সে যা কিছু বলেছিল তা সব যেন মুহূর্তেই বদলে যায়।

ইয়ামিন একদিন তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছে। উষসীর ধারণা ছিল ইয়ামিন তার কাছে ক্ষমা চাইবে। নিজের ভুল স্বীকার করে সারাজীবন একসাথে থাকার অঙ্গীকার করবে। রূপকথার গল্পের মতো হ্যাপি এন্ডিং হবে। কিন্তু হলো সব উল্টা। ইয়ামিন ভালোবাসার কথা বলার পরিবর্তে বলল অন্যকথা,” তুমি খুব ভালো মেয়ে উষসী। কিন্তু আমি তোমার যোগ্য না। তুমি আমার চেয়ে অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করো। তাই আমাদের ডিভোর্স হওয়াই ভালো।”

উষসীর কণ্ঠে কান্নারা এসে আটকে যায়। চোখে অশ্রু টলমল করে। সে আলগোছে চোখের পানি মুছে সায় দিল। এছাড়া অন্যকোনো উপায়ও তার কাছে নেই। ছেলে হলে বোধহয় সে ইয়ামিনের পায়ে ধরতো। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে ভালোবাসা ভিক্ষা চাইতো। ভালোবাসা পাওয়ার লোভে বেহায়া হতো। কিন্তু মেয়ে হওয়ায় সে ঠেঁকে গেছে। মেয়েরা চাইলেই বেহায়া হতে পারে না। মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা স্বীকার করতেও তাদের অনেক দ্বিধা!

ইয়ামিন বলল,” তাহলে আমি ডিভোর্সের ব্যবস্থা করি। তুমি তোমার বাড়িতে কি বলবে ঠিক করেছো?”

উষসী শক্ত কণ্ঠে বলল,” সেসব নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি সব সামলে নিবো।”

” শিউর?”

” হুম।”

“ওকে।”

উষসী বাড়ি ফিরে সারারাত হাউমাউ করে কাঁদল। এবার বুঝি তাদের ডিভোর্সে আর কোনো বাঁধা নেই। এতোদিন তো ইয়ামিনের অসুস্থতার বাহানার ডিভোর্স ঠেঁকিয়ে রাখা গিয়েছে, কিন্তু এবার কি হবে? ইয়ামিনকে হারানোর ভয় এমনভাবে তাকে জেঁকে ধরে যে একবার মনে হয়, কখনও ইয়ামিন সুস্থ না হলেই বুঝি ভালো ছিল।

নিজের স্বার্থপর মনোভাবের জন্য উষসী নিজেকে ধিক্কার দেয়। কিন্তু তার ভীষণ কষ্ট হয়। এতোকিছুর পরেও কেন ইয়ামিন তাকে বুঝল না? কেন তাকে ছেড়ে চলে যাবে? সে ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে এটা কত সহজেই বলে দিল। অথচ উষসীর মন কি চায় তা একবারও জানতে চাইল না! এতো নির্দয় সে, এতো পাষাণ!

প্রতিদিন ইয়ামিনের যত্ন নেওয়া তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। উষসী পারবে না বাকি জীবন ইয়ামিনকে ছাড়া কাটাতে। কিন্তু এখন তো ইয়ামিন সুস্থ হয়ে গেছে। তার আর উষসীর সাহায্যের প্রয়োজন নেই। এবার সে উষসীর থেকে শুধু ডিভোর্স চায়। উষসী ঠিক করল সে ইয়ামিনকে মুক্তি দিবে।

গভীর রাতে শিমলা দরজায় নক করলেন। উষসী কান্না মুছে মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে দরজা খুলল।স্বাভাবিক স্বরে বলল,” কিছু বলবেন আম্মু?”

” রাত বারোটা বাজে। ছেলেটা কি এখনও ফেরেনি মা?”

উষসী ভুলেই গেছিল যে ইয়ামিন এখনও বাড়ি ফিরেনি। সে বিচলিত গলায় বলল,” না তো মা। টেনশন করবেন না। সে মাঝে মাঝে একটু রাত করেই ফেরে।”

” সেজন্য বলছি না। আসলে আমি আর তোমার বাবা একটু ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। ইয়ামিন এলে ওকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিও। ও ফোনটাও ধরছে না।”

” এতোরাতে আপনারা কোথায় যাচ্ছেন আম্মু? সব ঠিকাছে তো?”

” আসলে আমার খালা খুব অসুস্থ। তাকে দেখতেই গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। ওই… মাইমুনার কথা মনে আছে না তোমার?”

” জ্বী।”

” মাইমুনার নানী।”

” আচ্ছা আম্মু। সাবধানে যেয়েন। পৌঁছে কিন্তু ফোন করবেন।”

” ঠিকাছে। ছেলেটা ফিরলে খেতে দিও। খাবার ফ্রীজে আছে। আয়শাকে বললেই গরম করে দিবে।”

” আচ্ছা।”

ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে সাথে লোডশেডিং। জেনারেটরের অবস্থা ভালো নেই। অন্ধকার বাড়িতে উষসী কেবল মোমবাতি জ্বেলে রেখেছে। এমন ঘন আঁধারে প্রায় দু’বছর আগের সেই অভিশপ্ত রাতটির কথা মনে পড়ল। যে রাতের কারণে আজ তাদের সম্পর্ক এতোদূর গড়িয়েছে। একটা ভুল সবকিছু বদলে দিয়েছে। কিন্তু ভুলের পরিণাম কখনোই ভালো হয় না। সেজন্যই বুঝি আজ তাদের সম্পর্কের পরিণতি এরকম! এসব চিন্তা করে উষসী একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

নিজের করা কাজগুলোর জন্য ইয়ামিন সারাক্ষণ হীনমন্যতায় ভুগছে। তার বার-বার মনে হয় সে উষসীর অযোগ্য। তাই নিজের কাছে উষসীকে বেঁধে রাখতে চায় না। উষসীর মতো মেয়ে অনেক ভালো জীবন ডিজার্ভ করে। যা ইয়ামিনের কাছে থাকলে সে পাবে না৷ তাই বাধ্য হয়ে ইয়ামিন ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এতোদিন একসাথে থাকার পর একটা অকৃত্রিম মায়া সৃষ্টি হয়ে গেছে উষসীর প্রতি। ইয়ামিন সেই মায়ার বাঁধন ছেড়ে বের হতে পারছে না। তার নিজেকে শূন্য লাগছে।

ডিভোর্সের কথা বলার সময় সে ভেবেছিল উষসী নিষেধ করবে। কিন্তু সে এতো সহজে মেনে গেল যে ইয়ামিন এখন নিজেই সেটা মানতে পারছে না। উষসীকে ছেড়ে থাকতে হবে এটা চিন্তা করেই কেমন দমবন্ধ লাগছে। এমন কেন হচ্ছে? এমন হওয়ার তো কথা ছিল না কখনোই। কিন্তু পরিস্থিতিই এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে ইয়ামিন চাইলেও আর উষসীকে নিজের কাছে রাখতে পারবে না। সেটা করতে গেলে স্বার্থপরতা হবে। ইয়ামিন নিজের স্বার্থের জন্য উষসীকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। সে আর স্বার্থপর হতে চায় না। এবার উষসীকে মুক্তি দেওয়া বাঞ্চনীয়।

ঘরে ঢুকে উষসী চমকে উঠল ইয়ামিনকে দেখে। বুকে হাত চেপে বলল,”ওমা, আপনি কখন এলেন?”

ইয়ামিন যন্ত্রের মতো জবাব দিল,” এইতো, একটু আগে।”

” ঠিকাছে বসুন। আসলে বাড়িতে কেউ নেই। আম্মু আর বাবা কিছুক্ষণ আগে বের হয়েছেন। তারা টাঙ্গাইল যাচ্ছেন। আপনাকে জানাতে বলল।”

“ও।”

” আপনার নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়েছে? আমি আয়শাকে বলে দিয়েছি ও খাবার গরম করছে। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।”

ইয়ামিন খেয়াল করল উষসীর মধ্যে ডিভোর্স নিয়ে কোনো উদ্দীপনা নেই। সে যথেষ্ট স্বাভাবিক আছে। অথচ ইয়ামিন নিজের সিদ্ধান্তে খামোখাই কষ্ট পাচ্ছে। সে ডাকল,” শোনো।”

” জ্বী, বলুন?”

অন্ধকারে ইয়ামিনের রক্তিম দৃষ্টি উষসীর নজরে পড়ল না। তাই তার ভাঙা কণ্ঠের আর্তনাদও টের পেল না। ইয়ামিন বলল,” আমাদের ডিভোর্সের ব্যাপারটা নিয়ে মনে হয় আরেকবার আলোচনা করা উচিৎ। ”

সে এই কথাটা বলেছিল ডিভোর্স নিয়ে উষসীর মনোভাব জানার উদ্দেশ্যে। কিন্তু উষসী ভাবছিল অন্যকিছু। ডিভোর্স তো ঠিক হয়েই গেছে। এখন সেটা নিয়ে কথা বাড়িয়ে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মানেই হয় না। সে বলল,” এই ব্যাপারে আলোচনার আর কিছু নেই। আপনি ডিভোর্সের ব্যবস্থা করুন। আমার কোনো সমস্যা নেই।”

এইটুকু বলে উষসী ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। যা অন্ধকারে ইয়ামিন দেখল না। এদিকে তার উত্তর শুনে ইয়ামিনের হৃযয়ে হু হু করে বয়ে যাচ্ছে অবাধ ঝড়। তা উষসীর পক্ষেও টের পাওয়া সম্ভব নয়।

টেবিলে খাবার সাজিয়ে উষসী আবার ঘরে এলো ইয়ামিনকে ডাকতে। সে তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির তীব্র ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার পুরো শরীর। অথচ সে কত নির্বিকার! উষসী বিস্ময় নিয়ে বলল,” পাগল হয়েছেন? বৃষ্টির মধ্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভিজছেন কেন? ভেতরে চলুন।”

ইয়ামিন কোনো জবাব দিল না। উষসী বারান্দায় এসে ইয়ামিনের হাত ধরল। তখনি ইয়ামিন গাঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,” উইল ইউ মিস মি?”

উষসী হতচকিত হলো,” মানে?”

” ডিভোর্সের পর কি আমাকে মিস করবে তুমি?”

” হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”

” উত্তর দাও।”

উষসী অভিমান নিয়ে বলল,” কি যায়-আসে? আমার উত্তরে তো কোনোকিছু বদলাবে না, তাই না?”

ইয়ামিন ক্রোধে কিড়মিড় করে বলল,” হেয়ালি করবে না একদম। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও উষসী। তুমি কি চাও?”

উষসীর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, শুধু আপনাকে চাই। আমি আমার এক জীবনে শুধু আপনাকেই চাই। যদি মৃত্যুর পর আরেকটা জীবন পাওয়ার সুযোগ হয়… তাহলে সেই জীবনেও শুধু আপনাকেই চাইব আমি।”

কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলা সম্ভব হলো না। বজ্রপাতের ঝলকে এক মুহূর্তের জন্য আলোকিত হলো আকাশ। সেই তীব্র আলোয় ইয়ামিন দেখল উষসীর চোখে অশ্রু। সে আশ্চর্য হয়ে বলল,” কাঁদছো কেন?”

উষসী ভাঙা গলায় বলল,” জানি না।”

সে যেতে নিলে ইয়ামিন বারান্দায় দরজা আটকে দিল। পুনরায় প্রশ্ন করল,” বলো, কেন কাঁদছো? না বললে যেতে দিবো না।”

উষসী এবার সবচেয়ে অদ্ভুত কাজটা করল। ঝটিতে ইয়ামিনের ঠোঁটে তীব্র চুমু আঁকল। বিবাহিত জীবনের পর তাদের প্রথম স্পর্শ। একটা স্বর্গীয় মুহূর্তের সৃষ্টি হলো। চিরায়ত ঘোরে ডুবে গেল দু’জনেই। হঠাৎ উষসীর হুশ ফিরতেই সে ছিটকে সরে গেল। ভুলটা করে ফেলার পর মন চাইল হাওয়ায় মিশে যেতে। আবেগের বশে সে যেটা করেছে সেজন্য নিজের গালেই থাপড়াতে মন চাইল। ইয়ামিন কেমন বিভ্রম নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। লজ্জায় উষসী দৌড়ে পালাতে নিলেই ইয়ামিন টেনে ধরল তার হাত। উষসী ঝাঁকি মেরে হাত সরিয়ে ছুটতে চাইল। তখন ইয়ামিন টেনে ধরল শাড়ির আঁচল।

উষসী লজ্জায় দিশেহারা। এমন একটা ভুল করার পর কোনো অবস্থাতেই আর ইয়ামিনের মুখের দিকে তাকানোর সাহস নেই। সে নিজেকে মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে গা থেকে শাড়ি খুলেই পালিয়ে গেল। তার এমন আচরণে ইয়ামিন কিংকর্তব্যবিমুঢ়। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। উষসী দরজার কাছে গিয়ে থেমে দাঁড়ালো। এই অবস্থায় সে ঘরের বাইরে যেতে পারবে না। অথচ ভেতরেও থাকতে পারবে না। কি অদ্ভুত দোটানা!

উষসী দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বড় বড় শ্বাস নিতে লাগল। তার পুরো শরীর কাঁপছে। ইয়ামিন এসে দরজা আটকে দিতেই আত্মা কেঁপে উঠল তার। সে আর্তনাদ করে বলল,” প্লিজ, আমাকে যেতে দিন।”

ইয়ামিন এগিয়ে বলল,” এতো সহজে?”

উষসী মাথায় হাত রেখে বেহুশ হয়ে গেল। হঠাৎ এমন ঘটনায় থতমত খেল ইয়ামিন। উষসীকে কোলে চড়িয়ে বিছানায় আনল। তার গালে, হাতে মালিশ করতে লাগল। কিন্তু উষসী কোনো সাড়া প্রদান করল না। দাঁত-মুখ খিচে বেহুশের মতো পড়ে রইল। লজ্জা থেকে বাঁচতে এর চেয়ে ভালো পদ্ধতি আর মাথায় আসছিল না। কিন্তু ইয়ামিন কিভাবে যেন বুঝে গেল ব্যাপারটা।

সে আলতো করে উষসীর কোমরে সুরসুরি দিতেই নড়েচড়ে চোখ মেলে তাকাল উষসী৷ ইয়ামিন হেসে ফেলল। উষসী অস্বস্তিতে পুনরায় চোখ বন্ধ করে অপরাধীর মতো বলতে লাগল,” আই এম স্যরি। আমাকে মাফ করে দিন। আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনও এমন হবে না…”

ইয়ামিন উষসীর ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে কঠিন গলায় বলল,” শশশ, এতোবড় ভুল করে আবার কথা বলছো, লজ্জা নেই তোমার?”

উষসী চুপসে গেল। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল।অনুনয়ের স্বরে বলল,” আমার শাড়িটা দিয়ে দিন, প্লিজ।”

” শাড়ি পেলেই তো তুমি আবার পালাবে।”

” না৷ সত্যি বলছি পালাবো না। প্লিজ, শাড়িটা দিন।”

” উহুম। আগে শাস্তি, তারপর শাড়ি।”

উষসী বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চাইল,” শাস্তি মানে?”

” ভুল যখন করেছো… শাস্তি তো পেতেই হবে। তাই না?”

উষসীর মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। তীব্র লজ্জায় উচ্চারণ করল,” কি শাস্তি দিবেন?”

” সেটা তো আমি বুঝবো। আমার ব্যাপার। ”

উষসীর গলা শুকিয়ে গেল। অপমানে আর লজ্জায় খুব কাঁদতে মন চাইল। চোখ থেকে গড়গড় করে অশ্রু ঝরতে লাগল। ইয়ামিন আলতো হাতে সেই অশ্রু মুছে ফিসফিসিয়ে বলল,” কাঁদছো কেন বোকা মেয়ে? এখনও তো কিছুই করলাম না।”

” আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দিন।”

” মাঝে মাঝে ভুল ভালোর জন্য হয়।”

” মানে? আমার এই ভুলে কি ভালো হলো?”

” আমার ভালো হলো।”

” কিভাবে.. ” উষসী তার কথা শেষ করতে পারল না। ইয়ামিন ফট করে তার ঠোঁটে দীর্ঘ, প্রলম্বিত আর গাঢ় চুমু দিল। উষসীর চোখ দু’টো বিস্ময়ে যেন ফেটে বেরিয়ে আসবে কোটর থেকে। কাঁপতে লাগল হাত-পা। বাইরে থেকে আয়শা আওয়াজ দিল,” আপা, খাবার তো ঠান্ডা হয়া গেল। কই আপনারা?”

উষসী কাঁপা স্বরে বলল,” আয়শা… ডাকছে।”

ইয়ামিন দায়সারা উত্তর দিল,” ডাকুক।”

সে অবলীলায় উষসীকে জড়িয়ে ধরল শক্ত হাতে। উষসীর প্রাণস্পন্দন থেমে আসতে চাইল। বুকে কি অবাধ্য তোলপাড়! গলায় ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব হতেই বিছানার চাদর খামচে ধরল উষসী। এই অসহ্য সুখব্যথা অনুভব করার চেয়ে ভালো তার মৃ*ত্যু হোক!

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৪১
লিখা- Sidratul Muntaz

” তুই কেমন আছিস, বোন আমার?” উষসীর চিবুকে হাত রেখে প্রশ্নটা করল উষ্ণতা।

” খুব, খুব, বেশি ভালো আছি আপু৷ তুমি কেমন আছো?”

হলুদ রঙা শাড়িতে বেশ প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে উষসীকে। চেহারায় স্নিগ্ধতার আভা। চোখ-মুখ বেশ উজ্জ্বল। বিয়ের পর বোধ হয় এই প্রথমবার বোনকে এতো হাস্যোজ্জ্বল দেখছে উষ্ণতা। সে হাসিমুখে বলল,” আমিও ভালো আছি। তুই একা এলি যে? ইয়ামিন আসেনি কেন?”

” জানি না আপু…. ওর নাকি কি জরুরী কাজ আছে।”

” তোদের মধ্যে সবকিছু ঠিক চলছে তো?”

উষসী লাজুক হাসল। এটা ঠিক যে বিয়ের পর থেকে প্রায় দেড়বছর তাদের মধ্যে কিছুই ঠিক চলছিল না৷ তারা তো ডিভোর্সের সিদ্ধান্তেই অটল ছিল। কিন্তু এখন আর সেই ভয় নেই। তারা সত্যি অনেক ভালো আছে। শুধু একটাই সমস্যা। উষসী ইয়ামিনকে বুঝতে পারছে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, ইয়ামিন তাকে ভালোবাসে। আবার কখনও মনে হয় বাসে না! সে নিজের মুখে এখনও ভালোবাসার কথাটা স্বীকার করেনি।

উষ্ণতা বলল,” ইয়ামিন এতো লম্বা সময়ের জন্য বিদেশ ছিল… তোর খারাপ লাগেনি?”

” খারাপ কেন লাগবে?”

উষসী মিথ্যা বলল৷ তার আসলে অনেক খারাপ লেগেছে। উষ্ণতা বলল,” অদ্ভুত মানুষ তোরা। তোর তৃষাণ ভাই দুইদিনের জন্য ঢাকার বাইরে গেলেও আমার অস্থির লাগে। আর তোরা মাসের পর মাস একজন-অন্যজনকে না দেখে কিভাবে থাকিস?”

উষসী মিষ্টি হেসে উষ্ণতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ” সবাই তো আর তোমার লাকি না।”

” লাকি না বলতে?”

” তুমি যদি তৃষাণ ভাইয়াকে আদেশ করো সারাজীবন তোমার সামনে বসে থাকতে তাহলে সে বিনা প্রশ্নে সেটাই করবে। কিন্তু ইয়ামিন এরকম না। সবাই তো আর তৃষাণ ভাইয়ার মতো হয় না।”

উষসীর কণ্ঠের বেদনা উষ্ণতা অচিরেই টের পেয়ে গেল। উষসীর গালে হাত রেখে সে আশঙ্কাভরা কণ্ঠে শুধাল,” তুই কি সুখে আছিস ইয়ামিনের সাথে?”

” অবশ্যই আছি। কেন সুখে থাকব না?”

” এবার কিন্তু ইয়ামিনকে কোনোভাবেই বিদেশ যেতে দিবি না। স্বামী-স্ত্রী আলাদা থাকা উচিৎ না৷ তুইও ওর সঙ্গে যাবি।”

” যাবোই তো আপু। আমার ভিসা-পাসপোর্ট সব রেডি আছে। তাছাড়া ইয়ামিন এবার আমাকে রেখে কোনোভাবেই যাবে না বলেছে।”

” সত্যি?”

” একদম সত্যি।”

” যাক, এটাই ভালো। ” উষ্ণতার ফোন বেজে উঠল। তৃষাণের নাম্বার। উষসী বলল,” দুইমিনিটও কথা না বলে থাকতে পারে না দেখছি৷ মাত্র কিছুক্ষণ হলো বাইরে গিয়েছে৷ এর মধ্যেই ফোন?”

উষ্ণতা বলল,” আরে… কোনো দরকারে ফোন দিয়েছে বোধ হয়।”

” হুম, বুঝি তো কি দরকার!”

উষসী খিলখিল করে হাসছে। উষ্ণতা মুগ্ধ চোখে তাকাল। এই প্রথম উষসীকে এতো খুশি দেখাচ্ছে। সে সবসময় এভাবে হাসি-খুশি থাকুক মনে মনে শুধু এটাই প্রার্থনা করে উষ্ণতা।

আজ উষ্ণতাদের বাড়িতে অনুষ্ঠান৷ তৃষ্ণার জন্মদিন। উষসী সকাল-সকাল সেজে-গুজে হাজির হয়েছে। ইয়ামিন তাকে ড্রপ করে দিয়েছে ঠিক, কিন্তু ভেতরে আসেনি। কেন যে সে এই বাসায় আসতে চায় না তা বোঝেনা উষসী। অথচ তাকে দেখলে সবাই কত খুশি হতো!অবশ্য আজ এখানে আসার পর থেকে উষসী ইয়ামিনকে একটু একটু মিস করছে। সে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে ইয়ামিনকে ফোন করল।

” হ্যালো, কি করছেন?”

” গাড়িতে আছি।”

” কোথায় যাচ্ছেন?” উষসী খুব উদ্বেগের সাথে প্রশ্নটা করল। যেন ভয়ংকর কিছু আশংকা করে ফেলেছে। ইয়ামিন বলল,” তোমাকে ড্রপ করে একটু সুপার শপে গিয়েছিলাম… এখন বাসায় ফিরছি।”

” ও আচ্ছা… তাই বলুন।”

” তুমি কি ভেবেছো? কারো সাথে পালাচ্ছি?”

উষসী হেসে বলল,” হুম, বলা তো যায় না। পালাতেও পারেন! ”

” পালিয়ে আর কোথায় যাবো বলো? দিনশেষে তো তোমার কাছেই আসতে বাধ্য আমি।”

” আচ্ছা, তাই? বাধ্য না হলে বুঝি আসতেন না?”

” কি জানি? সেটা তো ভেবে দেখিনি।”

উষসী আশাহত হলো। সে নানান কৌশলে ইয়ামিনের মুখ থেকে শুধু একটা কথাই বের করতে চায়। সেটা হলো,” ভালোবাসি।”

কিন্তু ইয়ামিন মনে হয় না কখনও মুখ ফুটে সেই কথা বলবে। উষসী হঠাৎ খুব অন্যমনস্ক হয়ে বলল,” মাঝে মাঝে আমার কি মনে হয় জানেন?”

” কি?”

” আপনি যদি সাধারণ কেউ হতেন… তাহলেই আমাদের জীবনটা বেশি সুন্দর হতো।”

” মানে? বুঝলাম না।”

” এইযে দেখুন না…আপনি বাইরে বের হলেই কত ক্রেজ শুরু হয় মানুষের মধ্যে। আপনার সামান্য পোস্ট নিয়েও শোরগোল পড়ে যায়। মেয়ে ভক্তদেরও অভাব নেই আপনার। মাঝে মাঝে তাদের কমেন্ট পড়লে আমার কত ঈর্ষা হয় জানেন? ইচ্ছে করে তাদের চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলি।”

ইয়ামিন হেসে উঠল। উষসী ম্লান কণ্ঠে বলল,” এসব না থাকলে জীবনটা কত সহজ হতো, তাই না? আপনি যদি খুব সাধারণ একটা চাকরি করতেন আর আমরা ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতাম। সারাদিন আমি ঘরের কাজ করতাম আর রাতে আপনার বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করতাম। আপনি ফিরলে আমরা একসাথে খাবার খেতাম। বৃষ্টি হলেই ছাদে চলে যেতাম। একসাথে ভিজতাম। মাঝে মাঝে ছুটির দিন আপনার সাথে রিকশায় করে ঘুরতাম। ভাবতেই কত মজা লাগছে, তাই না?”

” হুম, শুধু ভাবতেই মজা লাগছে। ”

উষসী চোখের জল মুছে বলল,”আচ্ছা আমি রাখছি। পরে কথা বলব।”

ফোন রেখে উষসী কিছুক্ষণ কাঁদল। সে ইয়ামিনকে যতটা ভালোবাসে… ইয়ামিনও কি তাকে ততটা ভালো কোনোদিন বাসবে?

সন্ধ্যায় কেক কাটার কথা। কিন্তু তৃষাণ এখনও বাড়ি ফিরেনি। ফোনটাও বন্ধ দেখাচ্ছে। উষ্ণতা দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল। ক্রমাগত পায়চারী করছে সে। যুথি আর ডোনা তাকে সামলানোর চেষ্টা করছে। উষসী তৃষ্ণার সাথে মোবাইলে গেইমস খেলায় ব্যস্ত। এমন সময় ইয়ামিনের ফোন এলো। সে উষসীকে বলেছে নিচে নামতে। হঠাৎ ইয়ামিনের আগমন একেবারেই প্রত্যাশা করেনি উষসী। সে খুব খুশি মনে নিচে নেমে দেখল, ইয়ামিন পার্কিং সাইডে গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷

উষসী কাছে যেতেই ইয়ামিন তাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে কিস করল। লজ্জায় গুটিয়ে গেল উষসী। কাঁচুমাচু হয়ে অপ্রস্তুত গলায় বলল,” হঠাৎ এইসময়? আপনি তো আসবেন না বলেছিলেন। ”

” আই ওয়াজ মিসিং ইউ অল দ্যা টাইম।”

খুশির একটা মাতাল ঢেউ বয়ে গেল সারা শরীর বেয়ে। আজ সারাদিন অযথাই কষ্ট পেয়েছে সে। ইয়ামিন যখন তার সঙ্গে এই বাড়িতে আসতে রাজি হলো না, তখন খুব মনখারাপ হয়েছিল উষসীর। মাঝে এটাও মনে হয়েছিল যে ইয়ামিন বুঝি তাকে একদম ভালোবাসে না। কিন্তু এখন সেই ধারণা ভুল মনে হচ্ছে। ভালো না বাসলে মিস করবে কেন?

উষসী হেসে বলল,” সত্যি মিস করেছেন?”

” হুম।”

” তাহলে উপরে চলুন।”

ইয়ামিন দ্বিধা নিয়ে বলল,”এখন না, আমাকে আসলে একটা ফ্রেন্ডের বাসায় যেতে হবে। এই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম তাই মনে হলো তোমার সাথে দেখা করি।”

উষসীর হৃদয়ে বয়ে চলা কলকলে খুশির ঢেউয়ে ভাটা পড়ল এবার। সে ভেবেছিল ইয়ামিন শুধু তার সঙ্গে দেখা করতে এতোদূর এসেছে। তাকে মিস করছিল বলে! কিন্তু এখন বোঝা গেল সে এমনি এসেছে। কারণ এই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিল তাই।

উষসী মলিন মুখে বলল,” অন্তত সবার সাথে দেখা করে যান। আপনাকে দেখে সবাই খুব খুশি হবে।”

” দেরি হয়ে যাবে। নাহলে যেতাম। প্লিজ ডন্ট মাইন্ড। হুম?”

উষসী হাসার ভাণ করে মাথা দুলাল। ইয়ামিন তার কপালে চুমু দিয়ে বলল,” আসছি, হুম?”

উষসী ভাঙা গলায় বলল,” আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

” বলো।”

অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ কাটিয়ে অবশেষে প্রশ্নটা করেই ফেলল সে,” আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন?”

ইয়ামিন সামান্য অবাক হলো। হাসার চেষ্টা করে বলল,” এটা কেমন প্রশ্ন?”

উষসী নিশ্বাস আটকে চোখ-মুখ খিচে বলল,” উত্তর দিন, প্লিজ।”

ইয়ামিন চুপ করে তাকিয়ে রইল। তার মনে অপরাধবোধের তীব্র দহন শুরু হলো হঠাৎ। সে কি ধোঁকা দিচ্ছে উষসীকে?এখনও সে সত্যিটা জানাতে পারেনি। অথচ সবকিছুর আগেই তো তার উচিৎ ছিল আসল সত্যি উষসীকে জানানো। ইয়ামিন ভুল করেছে। কিন্তু সত্যিটা উষসী কতটুকু মানবে সেটাও একটা প্রশ্ন। যদি মানতে না পারে? যদি কষ্ট পায়? ইয়ামিন উষসীর মন ভাঙতে চায় না।

উত্তরের আশায় উষসী অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে। ভারী নিশ্বাসে তার বুক কাঁপছে। সে তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করল,” কথা বলছেন না কেন? সামান্য একটা উত্তর দিতে এতো সময় লাগে?”

ইয়ামিনের কাছে এসে তার পাঞ্জাবীর কলার ধরে ঝাঁকাতে লাগল উষসী,” বলুন না, প্লিজ।”

ইয়ামিন অকপটে বলল,” আমি আসলে কনফিউজড।”

রাগে কপালের শিরা ফুলে উঠল উষসীর। খিটমিট করে বলল,” মানে?”

” মানে অন্য সময় বলব।”

উষসী হিংস্র হয়ে বলল,” এখনও আপনি ওই মেয়েটিকেই ভালোবাসেন, তাই না? তাকে ভুলতে পারেননি। সেজন্যই এতো কনফিউজড আপনি।”

” ওকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না। কিন্তু তোমার জায়গা আলাদা।”

উষসী এই উত্তরে সন্তুষ্ট হলো না। কেঁদে ফেলল ঝরঝর করে। ইয়ামিন তার মাথাটা বুকে নিয়ে হাত বুলিয়ে বলল,” আই এম স্যরি। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না৷ কিন্তু ওর কথা আমাকে আর কখনও জিজ্ঞেস কোর না।”

” আমি মানতে পারছি না… আমি তো আপনাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলাম। তাহলে আপনি কেন ভালোবাসলেন না? কি দোষ ছিল আমার?”

” তোমার কোনো দোষ নেই৷ সব দোষ আমার।”

উষসী হাউমাউ করে কান্না শুরু করল। ইয়ামিন আশেপাশে চেয়ে বলল,” কেউ দেখলে কি ভাববে? কান্না থামাও, প্লিজ।”

উষসী নিজেকে শান্ত করতে পারছে না৷ ইয়ামিন তাকে নিয়ে গাড়ির ভেতরে ঢুকল। মনে হচ্ছে আর দেরি করা ঠিক হবে না। উষসীকে সত্যি জানানোর সময় এবার এসে গেছে। যা হওয়ার হবে… কিন্তু ইয়ামিন আর উষসীর থেকে কিছু গোপন করবে না। তাই সে বলল,” তোমাকে অনেক কথা বলার আছে। প্রথম দিনই এসব বলা উচিৎ ছিল৷ আমি বলতে পারিনি, এটা আমার ব্যর্থতা। কিন্তু তোমার সব জানার অধিকার আছে।”

উষসী বাচ্চা শিশুর মতো কেঁদে যাচ্ছে। ইয়ামিন শান্ত গলায় বলল,” আমি যাকে ভালোবাসি… তাকে তুমি চেনো। সে আমার ছোটবেলার প্রেম। তখন ভালোবাসা কি সেটাও বুঝতাম না। কিন্তু তার জন্য পুরো দুনিয়া তোলপাড় করতে প্রস্তুত ছিলাম।”

উষসী সহ্য করতে না পেরে বলে উঠল,” প্লিজ চুপ করুন। আমি শুধু একটা কথাই জানতে চাই… আপনি তাকে এখনও ভালোবাসেন কি-না?”

” প্লিজ আমার পুরো কথা আগে শোনো। তারপর তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিবো।”

উষসী আর্তনাদ করে বলল,” না… আগে আপনি আমার এই প্রশ্নের উত্তর দিন। তারপর আমি বাকি কথা শুনবো। এখনও ভালোবাসেন আপনি তাকে? এখনও চান?”

” তাকে পাওয়া তখনও সম্ভব ছিল না… আর এখনও সম্ভব না।” ইয়ামিনের কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ল গাঢ় আক্ষেপ।

উষসীর বুক ছিঁড়ে যাওয়ার মতো ব্যথা হচ্ছে। বেদনায় সিক্ত হয়ে আসা দৃষ্টিতে বলল,” যদি পাওয়া সম্ভব হয়… তাহলে?”

ইয়ামিন বিপর্যস্ত গলায় বলল,” আমি এসব ভাবতেই চাই না, প্লিজ।”

” আপনাকে বলতে হবে।”

” শী ওয়াজ মাই ফার্স্ট লভ। কখনও ভুলতে পারব না তাকে আমি।”

উষসীর হৃদয় ছিন্ন হয়ে গেল এক নিমেষে। কিয়ৎক্ষণ ইয়ামিনের মুখের দিকে আহত দৃষ্টিতে চেয়ে থেকেই গাড়ি থেকে নামার জন্য উদ্যত হলো। ইয়ামিন তার হাত চেপে ধরে বলল,” উষসী প্লিজ, তুমি কিন্তু এখনও আমার পুরো কথা শোনোনি।”

উষসী তীব্র কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। আমার হাত ছাড়ুন আপনি।”

ইয়ামিন ছাড়ল না। শক্ত করে ধরে থেকে বলল,” এভাবে অর্ধেক কথা শুনে আমি তোমাকে যেতে দিবো না। সবটা তোমাকে শুনতেই হবে আর বুঝতেও হবে।”

” আমি কিছু বুঝতে চাই না। কিছু শুনতেও চাই না। প্লিজ আমাকে এভাবে শাস্তি দেওয়া বন্ধ করুন।”

তাদের বাক-বিতণ্ডার মাঝেই বাইরে থেকে বিকট চিৎকার ভেসে এলো। ইয়ামিন-উষসী ভয়ে তটস্থ হয়ে সেদিকে গেল। উষ্ণতা মেঝেতে বসে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। তার সাথে কাঁদছেন ডোনাও। যুথি দুইহাতে মেয়েকে সামলে রেখেছেন।

ইয়ামিন উতলা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,”কি হয়েছে?”

অনুপমা বলল,” এক্সিডেন্ট করেছে তৃষাণ ভাই।”

এই কথা শুনে উষসী ছুটে গিয়ে আরেকপাশ থেকে উষ্ণতাকে ধরল। উত্তেজিত গলায় বলল,” আপু, তুমি এভাবে ভেঙে পড়ো না। প্লিজ শান্ত হও। ভাইয়ার কিছু হবে না, দেখো!”

উষ্ণতা দূর্বল গলায় আওড়াল,” সকাল থেকে তোর তৃষাণ ভাইয়ের ফোন সুইচড অফ। এখন ওর নাম্বার থেকে একজন ফোন দিয়ে বলছে, ও নাকি এক্সিডেন্ট করেছে। রক্তাক্ত অবস্থা!”

উষ্ণতা এটুকু বলেই অজ্ঞান হয়ে গেল। তার মাথা ঢলে পড়ল উষসীর বুকে। এবার যেন উষসীর নিশ্বাস আটকে আসার উপক্রম হলো। দুইহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল সে।

ইয়ামিন উচ্চশব্দে একবার ডাকল,” উষ্ণতা মিস!” তারপর দ্রুত উষ্ণতাকে পাজাকোলায় নিল সে। উষসী মেঝেতে নিথর হয়ে বসে আছে তখনও। ধাক্কাটা সামলাতে সময় লাগছে তার।

অনুপমা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল ইয়ামিনের দিকে। সে এক্সিডেন্টের বিষয় নিয়ে অস্থির না হয়ে উষ্ণতার প্রতি ইয়ামিনের ব্যাকুল আচরণ দেখে অস্থির হয়ে পড়ল।

দুইঘণ্টা পর, ইয়ামিন বারান্দায় এসে সিগারেট ধরিয়েছে। বিছানায় উষ্ণতা শায়িত। তার শরীর খুব দূর্বল। জ্ঞান এখনও ফিরেনি। এতোক্ষণ উষ্ণতার হাত ধরে পাশেই বসেছিল ইয়ামিন। বাড়ির বাকি সবাই হসপিটালে চলে গেছে। উষসী উষ্ণতাকে দেখা-শুনা করার জন্য এখানেই থেকে গেছে। কি থেকে কি হয়ে গেল। সকালেও কত খুশি ছিল সবাই। আজকের দিনেই কেন এমন একটা কান্ড হতে হলো?

বারান্দা থেকে ইয়ামিন উষসীকে ডাকল। মাথা নিচু করে এগিয়ে গেল উষসী। ইয়ামিন ঠান্ডা গলায় জানতে চাইল,” এখনও কি রেগে আছো?”

” এই বিষয়ে কথা বলার সময় এটা না। আমি শুধু উষ্ণতা আপুকে নিয়ে চিন্তা করছি।”

” ভালো। আর টেনশনের কিছু নেই। রেস্ট করলেই ঠিক হয়ে যাবে তোমার আপু।”

উষসী টলমল দৃষ্টিতে বলল,” রেস্ট করলে শরীরটা না হয় ঠিক হবে… কিন্তু মন? সেটা কি এতো সহজে ঠিক হবে?”

উষসীর কথার ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হলো না ইয়ামিনের। সে হাতের সিগারেট ফেলে উষসীকে কাছে টেনে বলল,” আই এম স্যরি।”

” আপনি কেন স্যরি বলছেন? এটা আমার বলা উচিৎ। ভুল করে আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি, স্যরি।”

” তুমি ভুল করে ভালো না বাসলে আমার জীবনটা সবসময় ভুলের মধ্যেই থেকে যেতো উষসী। তুমি ভুলের পরে ফুল হয়ে এসেছো। তোমার সুগন্ধে আমার জীবন পরিপূর্ণ হয়েছে। আমি আর তোমাকে হারাতে চাই না।”

উষসী স্তব্ধ হয়ে আসা কণ্ঠে বলল,” কিন্তু আপনি অন্যকাউকে ভালোবাসেন।”

ইয়ামিন তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” সে আমার অতীত। আর তুমি বর্তমান, ভবিষ্যৎ…সবকিছু। তাই এবার থেকে শুধু তোমাকে ভালোবাসব। কথা দিলাম।”

” জোর করে ভালোবাসতে হবে না, ছাড়ুন আমাকে।”

উষসী বারান্দা থেকে বের হয়ে গেল। ইয়ামিন একটা চেয়ার টেনে উষ্ণতার বিছানার কাছে বসল৷ তার ঘুমন্ত মুখের দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থেকে হঠাৎ ফিসফিস করে বলল,” থ্যাংকস।”

নিজের বেডরুমে এসে দরজা আটকে দিল উষসী। উষ্ণতাকে তার দেখে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। ইয়ামিন নিজেই সব করছে। উষসী খুব অবাক হয়েছে। তৃষাণ ভাই থাকলে তার আপুর অসুস্থতার জন্য যা যা করতো ইয়ামিনও ঠিক তাই করছে।

সে চিন্তায় অস্থির, চোখ ভরা ক্লান্তি নিয়েও দিব্যি বসে আছে উষ্ণতার সামনে। এক মুহুর্তের জন্যেও সরছে না। এসব দেখে ক্ষণে ক্ষণেই বিস্মিত হচ্ছে উষসী। তার ধারণাই কি তবে সঠিক?

ছোটবেলার কথাগুলো সবই স্পষ্ট মনে আছে তার। ইয়ামিনের ভুলের জন্য একসময় উষ্ণতা আপুকে কতই না সাফার করতে হয়েছিল। বিদায়ের সময় ইয়ামিন উষসীকে বলেছিল, সে যেন উষ্ণতার খেয়াল রাখে।

তখনি উষসীর ধারণা হয়েছিল তৃষাণ ভাইয়ের মতো তার রাক্ষসমানবও বুঝি তার উষ্ণতা আপুকে ভালোবাসে। কিন্তু সে কখনও ভাবেনি এভাবে তার ধারণা সত্যি প্রমাণ হবে। ইয়ামিনের ভালোবাসার সেই মেয়েটি যে উষ্ণতাই হবে! আচ্ছা, উষ্ণতাও কি এই ব্যাপারে জানে? তার তো কিছু মনে থাকার কথা নয়।

তবুও নিজের আপন বোনের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি হলো উষসীর৷ অকারণেই মনে হতে লাগল, তার এই দুঃখময় জীবনের পেছনে কোনো না কোনোভাবে উষ্ণতাই দায়ী৷ নিজের এমন অন্যায় ভাবনার জন্য নিজেকেই ধিক্কার জানাল উষসী। তবুও এমন চিন্তা থেকে বের হতে পারল না সে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে উঠল সে। তারপর কখন জানি তার চোখ লেগে এলো। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ছুটে গেল তার। সে যখন ঘর থেকে বের হয়ে উষ্ণতার বেডরুমে ঢুকল… তখনি দেখল, ইয়ামিন উষ্ণতার পায়ের কাছে মাথা রেখে শুয়ে আছে। এমন দৃৃশ্য দেখে উষসীর গায়ের শক্তি ক্ষয়ে গেল। দম বন্ধ একটা কষ্টময় যন্ত্রণা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল হঠাৎ।

নেক্সট পর্বে অতীতের আরও কিছু অংশ থাকবে। তারপরেই বর্তমান। কি মনে হয় আপনাদের? এখানে কার দোষ বেশি? উষসীর কি ইয়ামিনকে ক্ষমা করা উচিৎ?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে