আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-৩৮+৩৯

0
531

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৩৮
লিখা- Sidratul Muntaz

উষসীকে দেখে ইয়ামিনের ঠোঁট দু’টো হেসে উঠল। চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল হলো। হৃদয় থেকে নেমে গেল যেন এক আকাশসম পাষাণ ভার। ছাতা হাতে উষসী কাছে এসে দাঁড়ালো। কঠিন মুখে কণ্ঠে অনেকটা গম্ভীরতা ঢেলে বলল,” এতো দাঁত বের করে হাসার কিছু নেই। আমি এসব আম্মুর জন্য করছি। আপনি বৃষ্টিতে ভিজে অসুস্থ হলে আম্মু বাংলাদেশ থেকে দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠবেন। আমি আম্মুকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাই না৷ এবার উপরে চলুন।”

ইয়ামিন হাসিমুখে উষসীর সাথে এগিয়ে গেল। এই অতি আকাঙ্খিত মুহূর্তটির জন্যই আজ সারাদিন অপেক্ষা করেছে সে। তার সব অপেক্ষা অবশেষে স্বার্থক! সে ধন্য।

উষসী রুমে এসে দরজা আটকাতেই পেছন থেকে ইয়ামিন শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরল তাকে। ঘাড়ে, পিঠে চুমু দিয়ে বলল,” আই মিসড ইউ।”

উষসী রাগে অঙ্গার হয়ে উঠল। ইয়ামিনকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে বলল,” খবরদার, আমার থেকে দূরে থাকুন। আপনাকে এই জন্য রাস্তা থেকে তুলে আনিনি বুঝেছেন? সীমা অতিক্রম করবেন না।”

ইয়ামিন কাছে এসে একহাতে উষসীর কোমর জড়িয়ে বলল,” সীমা অতিক্রম কোথায় করলাম? ইউ আর মাই ওয়াইফ। আই ক্যান ডু এনিথিং।”

উষসী চোখ বড় করে বলল,” আমি কিন্তু তৃষাণ ভাইয়াকে ডাকব।”

উষসীর ফাঁকা হুমকি ইয়ামিনকে হাসাল। সে অকপটে বলল,” পারবে না। সেটা করার হলে আগেই করতে পারতে। এভাবে লুকিয়ে আমাকে ঘরে নিয়ে আসতে না।”

এবার উষসীও হেসে উঠল। হাত ভাঁজ করে বলল,” আপনার সমস্যাটা কি জানেন? আপনি আমাকে টেকেন ফর গ্রান্টেড ভেবে রেখেছেন। আপনি ভাবছেন আপনার কিছু হলে আমি মরেই যাবো। কনফিডেন্টস থাকা ভালো কিন্তু ওভার কনফিডেন্টস মোটেও ভালো না। আপনি কি ভাবেন নিজেকে? আর আপনি আমাকেই বা কি ভাবেন? আপনাকে ছাড়া কি আমি সত্যি ম-রে যাবো? আমাকে টেকেন ফোর গ্রান্টেড ভেবে রাখলে আপনি বিরাট ভুল করবেন৷ এখন আর আমার কোনোকিছুই আগের মতো নেই। আপনার প্রতি আমার সব অনুভূতি শেষ হয়ে গেছে…”

উষসীর কথার মাঝেই ইয়ামিন হঠাৎ তার ঠোঁটের উপর আঙুল চেপে ধরে বলল,” আই লভ ইউ।”

উষসী দ্রুত পলক ঝাঁকালো। কান গরম হয়ে উঠল মুহূর্তেই। একবার সে ভাবল ভুল শুনেছে। তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে ইয়ামিন পুনরায় বলল,” আই লভ ইউ। আই লভ ইউ, আই লভ ইউ, আই লভ ইউ।”

চোখ বন্ধ করে কেবল একটাই বাক্য সে আওড়ে গেল। তারপর চোখ খুলে বড় করে একবার শ্বাস নিয়েই বলল,” আই লভ ইউ, উষসী। মোর দ্যান মাই লাইফ, মোর দ্যান মাই পাস্ট, প্রেজেন্ট, ফিউচার এন্ড মোর দ্যান এনিথিং। ”

উষসী বিস্ময়ে হতবাক। তার হিঁচকি ওঠার উপক্রম হলো। তাদের বিবাহিত জীবনের দুইবছরে এই প্রথমবার ইয়ামিন ভালোবাসার কথা বলেছে তাকে। এর আগে কখনও, কোনো অবস্থাতেই সে বলেনি এমনকি উষসীও আশা করেনি যে ইয়ামিনের মুখ থেকে কখনও এমন কথা শুনবে সে। তাই এই অবিশ্বাস্য কান্ড ঘটায় উষসীর শরীর রীতিমতো ঝিম ধরে গেছে। সে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।

ইয়ামিন ফিসফিস করে বলল,” হঠাৎ আমি রিয়েলাইজ করেছি আমার জীবনের সবকিছুই মিথ্যা ছিল একমাত্র তুমি ছাড়া। তুমি আমার জীবনের ধ্রুব সত্যি। তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি আমি, আই লভড ইউ উইথ মাই হোল হার্ট।”

নিজের অজান্তেই উষসীর চোখে জল চলে এলো। ভালোবাসার তৃষ্ণায় খা খা করা হৃদয়ে যেন বৃষ্টি নামল। সে কিছুটা পিছিয়ে এসে বিড়বিড় করে বলল,” মিথ্যা, আপনি মিথ্যা বলছেন।”

ইয়ামিন উতলা হয়ে বলল,” বিশ্বাস করো উষসী প্লিজ। আমি সত্যি বলছি। তুমি বিশ্বাস না করলে আমি মরে যাবো।”

“এখন আর আপনার কোনো কথাই বিশ্বাস করি না আমি।”

” কিন্তু এটা তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে। আই লভ ইউ।”

“না, আপনি আবারও মিথ্যা বলছেন।”

” উহুম। আমি এতো বেশি সত্যি কখনও বলিনি।প্লিজ আমার কথা একবার বিশ্বাস করো।”

উষসী ক্ষীপ্রতার সাথে দুইপাশে মাথা নাড়তে লাগল। ইয়ামিন হঠাৎ তার মুখটা চেপে ধরে রাগী স্বরে বলল,” কেন বিশ্বাস করবে না? আমি সত্যি বলছি!এতোদিন মিথ্যা বলেছি অথচ তুমি সব বিশ্বাস করেছো। আর এখন সত্যি বলছি তাহলে কেন বিশ্বাস করছো না? তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে আমার কথা। এছাড়া অন্যকোনো অপশন নেই তোমার কাছে। বুঝেছো?”

উষসী চুপ হয়ে গেল। তার চোখ এখনও ভেজা। টুপটুপ করে অশ্রু পড়ছে চোখ থেকে। ইয়ামিন শক্ত করে তার ঠোঁট দু’টো চেপে ধরতেই চোখ বন্ধ করে নিল উষসী। বাঁধা দেওয়ার বদলে দুইহাতে জড়িয়ে ধরল ইয়ামিনের পিঠ। ইয়ামিন নিচু হয়ে উষসীর কোমর চেপে ধরে তাকে উপরে তুলল। কোনো এক স্বর্গীয় অনুভূতির খোঁজে ভেসে যেতে লাগল দু’জনেই। হঠাৎ দরজায় তীক্ষ্ণ শব্দে করাঘাত হতেই তারা একে-অপরকে ছেড়ে দিল। লজ্জায় উষসী খুব অপ্রস্তুত হয়ে গেল।

দরজা খুলতে নিয়ে খেয়াল করল সে দরজা খুলতেই পারছে না। তার হাত চলছে না। লক ধরে সে ঘুরাচ্ছে, টানছে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। পেছন থেকে ইয়ামিন এসে লক টেনে খুলে দিতেই উষসী বিব্রত হয়ে তার দিকে তাকাল। দরজার ওইপাশ থেকে যুথি বলে উঠল,” কি হয়েছে মা? ঘুমুচ্ছিলি নাকি? দরজা খুলতে এতো সময় লাগল যে?”

ইয়ামিন দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। উষসী মাথা নিচু করে বলল,”রেস্ট নিচ্ছিলাম। শরীরটা ভালো লাগছিল না।”

” সারাদিন শুয়ে-বসে থাকলে শরীর তো খারাপ লাগবেই। আমাদের সাথে বাইরে ঘুরতে যাবি, চল। তাহলে ভালো লাগবে।”

” আমি কোথাও যাব না, মা। বললাম তো আমার শরীর ভালো নেই।”

” সেকি, শরীর কি বেশি খারাপ নাকি? তাহলে অন্তত ডাক্তারের কাছে তো যাওয়া উচিৎ। ”

যুথি এই কথা বলে ভেতরে ঢুকতে নিলেই উষসী বাঁধা দিয়ে বলল,” সেরকম সিরিয়াস কিছু হয়নি। ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবে।”

” তৃষাণের ফ্রেন্ড এসেছিল। তোর সাথে দেখা করতে চাইছে।”

” আমার কারো সাথে এখন দেখা করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সকালে দেখা করি?”

” কিন্তু ও তো আমাদের বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেতে চাইছে। তুই না গেলে ভালো লাগবে, বল? তোর জন্যই তো আমরা আরও প্ল্যান-ট্যান করলাম। যাতে তোর মন ভালো হয়।”

উষসী হেসে বলল,” আমার মনখারাপ এই কথা কে বলল? আমি একদম ঠিকাছি। তোমরা যাও। শরীর ভালো লাগলে আমিও যেতাম। কিন্তু ভালো লাগছে না।”

” তুই কি নিশ্চিত? ঘরে একা থাকবি? আমিও বরং তোর সঙ্গে থেকে যাই।”

” না মা, প্লিজ। আমার সাথে কাউকে থাকতে হবে না বললাম তো। আমি সত্যি ঠিকাছি৷ তুমি যাও প্লিজ।”

উষসী এক প্রকার জোর করেই যুথিকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে। মেয়ের এমন আচরণে যুথি কিছুটা অবাক হলো। মনখারাপ করে বলল,” তুই এমন করছিস কেন? জামাইকে বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ায় কি আমাদের উপর রাগ করেছিস মা?”

উষসী থতমত খেয়ে বলল,” মানে? আমি কেন রাগ করব এজন্য?”

” তুই যে জামাইকে কত ভালোবাসিস সেটা তো আমি বুঝি। যখন উষ্ণ আর তৃষাণ ওকে বের করে দিচ্ছিল… তুই একবারও বাইরে আসিসনি৷ ভেতরে বসে কাঁদছিলি। আমি দেখেছি।”

উষসী আঁড়চোখে ইয়ামিনের দিকে তাকাল। ইয়ামিন দেয়ালে মাথা ঠেঁকিয়ে হাসছে। লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে উঠল উষসীর মুখ। সে স্পষ্ট গলায় ঘোষণা দিল,” আমি তাকে মোটেও ভালোবাসি না। তুমি ভুল ভাবছো, মা।”

ইয়ামিন এক ভ্রু উঁচু করে ঠোঁটের ইশারায় বলল,” তাই?”

উষসী রূঢ় গলায় বলল,” একদম তাই।”

যুথি বলল,” হয়েছে আর মিথ্যা বলতে হবে না। আমি তোর মা। তোকে জন্ম দিয়েছি। তোর পেটের কথা আমার চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে? আমি জানি তুই ভেতরে ভেতরে কত কষ্ট পাচ্ছিস। কিন্তু তৃষাণের ভয়ে কিছু বলতে পারছিস না। শোন উষু, তুই চাইলে কিন্তু আমি ইয়ামিনের সাথে তোর দেখা করার ব্যবস্থা করে দিবো।”

উষসী খুব বিরক্ত হয়ে বলল,” অসম্ভব। আমি ওর মুখও দেখতে চাই না। মা, তুমি যাওতো এখান থেকে প্লিজ। এমনিতেও আমার মাথা ব্যথা করছে। তোমার সাথে দাঁড়িয়ে বকবক করলে আরও মাথা ব্যথা বাড়বে।”

” আচ্ছা যাচ্ছি। কিন্তু আমি আবার আসব খোঁজ নিতে।”

উষসী দরজা আটকে হাঁফ ছাড়ল। তখনি দেখল ইয়ামিন তার একদম সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। উষসী ভয়ে আৎকে উঠল কিছুটা। ইয়ামিন দরজার উপর হাত রেখে ঝুঁকে এসে বলল,” আমি না হয় ওভার কনফিডেন্স দেখাচ্ছি। কিন্তু মাও কি ভুল বলছে?”

” হ্যাঁ অবশ্যই ভুল বলেছে। মায়ের কথা শুনে এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই। আমার মা সবসময় দুই লাইন বেশি বুঝে। ”

” হুম। সবাই বেশি বোঝে। তুমি যে আমাকে একদম ভালোবাসো না, তার প্রমাণ তো একটু আগেই পেলাম।”

” মানে? কি প্রমাণ পেলেন আপনি?”

” আমাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখে তুমি ছাতা নিয়ে বাইরে এলে। সবার চোখের আড়ালে আমাকে ঘরে আনলে। তারপর… ”

ইয়ামিনকে থামিয়ে উষসী চটপটে গলায় বলল,” এসব আমি আম্মুর জন্য করেছি। সেটা আগেও বলেছি আপনাকে।”

” আচ্ছা? এটা না হয় আম্মুর জন্য। তাহলে বাকি গুলো কিসের জন্য?”

” বাকিগুলো মানে?”

” মানে আমি যখন তোমাকে টাচ করলাম, তখন তুমি সাথে সাথে আমাকে বের করে দিতে পারতে। কিন্তু তুমি করোনি। আমার মুখে আই লভ ইউ শুনে তোমার চোখে পানি এসে গেল। আর আমি যখন তোমাকে কিস করলাম তখন তুমি একবারও বাঁধা দিলে না।”

” কে বলেছে বাঁধা দেইনি? আমি বাঁধা দেওয়ার আগেই মা চলে এলো। নাহলে দেখতেন আমি আপনার কি অবস্থা করতাম।”

“ও তাই?”

পুনরায় দরজায় করাঘাত হলো। এবার এসেছে তৃষাণ। উষসী হাসিমুখে বলল,” কিছু বলবে ভাইয়া?”

” মায়ের কাছে শুনলাম, তোমার নাকি শরীর খারাপ?”

” ওই একটু মাথা ব্যথা আর কি…. তেমন কিছু না।”

” ও। আমাদের সাথে বাইরে চলো। তাহলে নিশ্চয়ই তোমার ভালো লাগবে।”

” আসলে মাকেও আমি বলে দিয়েছি। আমার বাইরে যেতে ভালো লাগছে না। তোমরা যাও প্লিজ। আমি ঘরেই থাকবো।”

” ঠিকাছে… তাহলে তুমি কি খেতে চাও বলো। তোমার জন্য ডিনারে নিয়ে আসব।”

“আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। যেকোনো কিছু আনলেই হবে।”

” ওকে।”

তৃষাণ চলে যেতেই উষসী দ্রুত দরজা আটকে দিল। সিঁড়ির কাছে উষ্ণতা দাঁড়িয়ে ছিল৷ তৃষাণকে দেখে প্রশ্ন করল সে,” কি বলল উষু? সে কি যাবে না?”

তৃষাণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” না।”

“তোমার মাকে পাঠিয়ে একবার রিকয়েস্ট করাব?”

“লাভ নেই। এখন উষসী কোনো অবস্থাতেই বাইরে যেতে রাজি হবে না।”

” কেন?” উষ্ণতা ভ্রু কুঁচকালো। তৃষাণ সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে অকপটে বলল,” ভেতরে ইয়ামিন আছে।”

উষ্ণতার চোখ দু’টো বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল,” তুমি এটা কিভাবে বুঝলে?”

তৃষাণ হাসল,” ছোট থেকে উষুকে বড় করেছি। ওর ব্যাপারে এই সামান্য বিষয় না বোঝার কিছু নেই।”

ইয়ামিন খুব জোরে একটা হাচি দিল। উষসী ব্যস্ত হয়ে তাকে বিছানায় বসালো। নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা মুছে দিতে লাগল। ইয়ামিন হঠাৎ উষসীর কোমর জড়িয়ে ধরল। বুকে মুখ গুঁজে বলল,” বাড়ি চলো উষসী প্লিজ। তোমাকে ছাড়া সেখানে একদম শান্তি নেই।”

উষসী ঠান্ডা গলায় বলল,” সম্ভব না।”

” কেন?”

“যেখান থেকে একবার চলে এসেছি, সেখানে আবার ফিরে যেতে নেই।”

” চেষ্টা করলেই যাওয়া যায়।”

” আমি চেষ্টা করতে চাই না। সবাই যখন বাড়ি থেকে চলে যাবে, তখন আপনিও বের হয়ে যাবেন।”

ইয়ামিন চোয়াল শক্ত করে বলল,” তোমাকে নিতে এসেছি, না নিয়ে কোথাও যাবো না।”

উষসী কোনো উত্তর না দিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। তার কান্না পাচ্ছে। দ্রুত চোখ মুছে নিল। নিচে সবাইকে দেখা যাচ্ছে৷ তারা গাড়িতে উঠছে। লম্বা করে ওই বাদামী চুলের মানুষটা সম্ভবত তৃষাণের বন্ধু। উষসী তাদের চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর ভেতরে এসে ইয়ামিনকে বলল,” সবাই চলে গেছে। বাইরে বৃষ্টিও নেই। এবার আপনি নিশ্চিন্তে যেতে পারেন।”

ইয়ামিন মাথা নিচু করে বসে আছে। একধ্যানে মেঝের দিকে চেয়ে থেকে বলল,” তোমাকে ছেড়ে যাবো না, আগেও বলেছি।”

” জেদ করে লাভ নেই। আমি আপনার সাথে যাবো না।”

ইয়ামিন তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো এবার। আচম্বিতে উষসীকে পাজাকোলায় নিয়ে বলল,” দেখি কিভাবে না যাও।”

উষসী ডাঙায় তোলা মাছের মতো তড়পে উঠল,” কি করছেন? আমাকে ছাড়ুন, আমি কিন্তু চিৎকার করব। হেল্প, হেল্প মি।”

ইয়ামিন বিড়বিড় করে বলল,” শেষমেষ নিজের বউকে কিডন্যাপ করতে হচ্ছে। কত দূর্ভাগ্য আমার!”

চলবে
#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৩৯
লিখা- Sidratul Muntaz

মেঘলাটে আকাশ। ঘন অন্ধকারে ঢেকে আছে শহর। কৃত্রিম আলোয় ভরা সন্ধ্যাটা ঝলমল করছে। উষসী গাড়ির জানালা খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ। পেছন থেকে অনম বলল,” আপনি না থাকলে আমাদের স্যারের কি হবে ম্যাডাম?কেন আপনি স্যারকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন? এটা তো খুবই নিষ্ঠুরতা।”

উষসী কর্কশ গলায় বলল,” ফালতু কথা বলবেন না। আমি না থাকলে আপনাদের স্যার বেশ ভালোই থাকবে। সব জানা আছে আমার।”

” আপনি আজও স্যারকে চিনতেই পারলেন না ম্যাডাম। আফসোস!”

” শাট আপ। স্যারের হয়ে ওকালতি না করে ভালো হয় যদি আপনি আমাকে এখান থেকে বের হতে সাহায্য করেন। নাহলে কিন্তু আপনাদের দু’জনের নামেই মামলা করব আমি। জোর করে আমাকে অপহরণ করা হচ্ছে।”

ইয়ামিন হেসে উঠল উচ্চ শব্দে। অনম বলল,”এভাবে বলবেন না ম্যাডাম। আপনি স্যারের স্ত্রী। কখনও কি শুনেছেন নিজের স্ত্রীকে কেউ অপহরণ করে? এই কথা কি মানুষ বিশ্বাস করবে?”

” আপনার স্যারের মতো রাক্ষস সব করতে পারে।”

ইয়ামিন ভ্রু উঁচু করে বলল,” উহুম পুরোটা বলো, শুধু রাক্ষস তো না। রাক্ষসমানব!”

” হেল্প, হেল্প, আমাকে কিডন্যাপ করা হচ্ছে। হেল্প মি।”

” চিৎকার করে লাভ নেই ম্যাডাম। এই হাইরোডে কেউ আপনার গলার আওয়াজ শুনবে না।”

উষসী কিড়মিড় করে বলল,” তৃষাণ ভাইয়া যখন বাড়ি ফিরে দেখবে আমি নেই তখন আপনার খবর আছে।”

” তাই নাকি? আচ্ছা। দেখা যাক তোমার তৃষাণ ভাই কি করে।”

পার্কিং লটে গাড়ি থামিয়ে ইয়ামিন নামল। উষসীকেও নামার জন্য দরজা খুলে দেওয়া হলো। কিন্তু উষসী নামবে না। শক্ত হয়ে বসে থেকে রক্তিম দৃষ্টিতে প্রায় কাঁপতে কাঁপতে বলল,” ভালোয় ভালোয় আমাকে ফেরত নিয়ে চলুন। তৃষাণ ভাই জানলে আপনাকে আস্তো রাখবে না।”

” তোমার তৃষাণ ভাইকে আমি ভয় পাই নাকি?

উষসী ছটফট করে বলল,” জোর করে কয়দিন আমাকে আটকে রাখবেন? সুযোগ পেলে আমি আবার পালাবো।”

” সেই সুযোগ তোমাকে আর দেওয়া হবে না।”

ইয়ামিন উষসীর হাত টেনে তাকে কোলে তুলতে উদ্যত হলো। ঠিক সেই মুহূর্তে উষসী খুব অদ্ভুত একটা কাজ করল। ইয়ামিনের হাতে কাম-ড় মেরে লাফিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। এক সেকেন্ডের জন্য ইয়ামিন ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলায় উষসীকে ধরতে সক্ষম হলো না। তবে সে চিৎকার করে বলল,” পাগলামি কোরো না উষসী৷ এটা কেমন ছেলেমানুষী? ”

উষসী মেইন গেইট ক্রস করে বের হতে পারল না। গেইট লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে দারোয়ানের উদ্দেশ্যে বলল,” আঙ্কেল প্লিজ গেইট খুলে দিন। আমি আপনাকে নগদ পঞ্চাশ ডলার দিবো। ”

দারোয়ান বলল,” স্যরি ম্যাম, গেইট খুললে আমার চাকরি চলে যাবে।”

উষসী তর্কে জড়াল না। পেছনে ইয়ামিন আসছে। যে কোনো সময় তাকে ধরে ফেলবে। উষসী উল্টো দিকে দৌড় দিল। সে জানে এখান থেকে পালানো সম্ভব নয়। তবুও এমন বৃথা চেষ্টা কেন করছে তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না। এদিকে উষসীকে এমন উথাল-পাথাল দৌড়াতে দেখে ইয়ামিন ভড়কে গেল। মেয়েটা পাগল নাকি? এই অবস্থায় কেউ ওইভাবে দৌড়ায়? একটা আছাড় খেলেই তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। ইয়ামিন মিনতি করে বলল,” দোহাই লাগে উষসী, তুমি থামো প্লিজ।”

উষসী প্রাণপণে চেঁচিয়ে বলল,” আপনি আমাকে কোনোভাবেই ধরতে পারবেন না।”

” আচ্ছা আমি তোমাকে ধরব না, প্রমিস করছি। তবুও থামো প্লিজ।”

উষসী পেছনে তাকিয়ে দেখল ইয়ামিন আসলেই তাকে ধরতে আসছে না। দূরে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেমুখে আতঙ্কের গভীর ছাপ। হঠাৎ একটা ভেজা স্যাতস্যাঁতে জায়গায় আসতেই উষসীর পা পিছলে গেল। ইয়ামিন ভয়ে চিৎকার করে উঠল,” সাবধানে…”

উষসী ধপ করে সুইমিংপুলে পড়ে গেল। ইয়ামিন মাথায় হাত চেপে ধরল। তারপর সেও দৌড়ে এসে সুইমিংপুলে ঝাঁপ দিল।

উষসী বিড়বিড় করে বলতে লাগল,” আমি ডুবে গেলাম, ডুবে গেলাম। আমি সাতার জানি না!”

ইয়ামিন তাকে দুইহাতে আগলে ধরে হেসে বলল,” তিন ফিট পানিতে তুমি ডুববে না, চিল।”

উষসী নিচে তাকিয়ে দেখল তার পা ভূমি স্পর্শ করছে। শুধু বুক পর্যন্ত ডুবে আছে শরীর। সে একটু লজ্জা পেয়ে গেল। নিজেকে বোকা বোকা লাগছে। ইয়ামিন বলল,” আগেই দৌড়াতে নিষেধ করেছিলাম। পানিতে আছাড় খেয়ে কেমন লাগছে এখন?”

ইয়ামিনের কটাক্ষ ভরা হাসি দেখে রাগে ছ্যাঁত করে উঠল উষসীর শরীর। ঝাঁকি মেরে তাকে সরিয়ে বলল,” সবকিছু অনেক মজা মনে হচ্ছে আপনার কাছে, তাই না? আমি কি শখ করে এই বাড়ি থেকে চলে গেছিলাম? জোর করে আমাকে উঠিয়ে এনে কি বোঝাতে চান আপনি? আমাকে ভালোবাসেন? এসবের নাম ভালোবাসা?”

ইয়ামিন আলতো করে উষসীর মুখটা আঁজলায় নিয়ে বলল,” উষসী, শোনো…”

” কিচ্ছু শুনবো না। আপনি শুনুন, সামান্য আই লভ ইউ বললেই আমি সবকিছু ভুলে আবার আগের মতো হয়ে যাব সেটা আপনি ভাবলেন কিভাবে? একবার মনে করে দেখুন যে আমার সাথে আপনি কি কি করেছিলেন। উত্তর পেয়ে যাবেন। আমি আপনার সাথে এক মিনিটও থাকতে চাই না এখানে।”

উষসী পাড়ে ওঠার জন্য স্টিলের উপর হাত রাখতেই ইয়ামিন ধাক্কা মেরে আবারও পানিতে ফেলে দিল তাকে। উষসীর গলা পর্যন্ত ডুবে গেল নীল জলে। হঠাৎ এমন আক্রমণে সে হতভম্ব। ইয়ামিন শক্ত করে তার বাহু চেপে ধরে তাকে উপরে তুলে বলল,” মানছি যে আমি ভুল করেছিলাম। আমি আমার অপরাধ বার-বার স্বীকার করেছি। কিন্তু তুমি নিজে কি করেছো? একবারও কি বিশ্বাস করেছো আমার কথা?”

” আপনাকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। আপনি বিশ্বাসের যোগ্য না।”

” সেটা তোমার ধারণা। কিন্তু একবারও আমি নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার সুযোগ পাইনি।”

” আপনি প্রতারণা করেছেন আমার সাথে। আপনার ভালোবাসার সেই মেয়েটি উষ্ণতা আপু ছিল। আপনি তা গোপন করেছেন দিনের পর দিন।”

“না কিচ্ছু গোপন করিনি। বিয়ের দিনই সব বলতে চেয়েছিলাম তোমাকে। মনে আছে সেই ভিডিওর কথা? সবকিছু সত্যি কনফেস করেছিলাম ভিডিওতে। বিয়ের আগেই চেয়েছিলাম তোমাকে সবকিছু জানিয়ে দিতে। বিশ্বাস না হলে তুমি তোমার পুরনো আইডি ঘেঁটে দেখতে পারো। সবকিছুতেই তো প্রুভ লাগবে তোমার, তাই না?”

উষসী বিস্ময় নিয়ে উচ্চারণ করল,” ওই ভিডিও আপনি আমাকে দেওয়ার জন্য শ্যুট করেছিলেন?”

” তা নয়তো কি?”

” তাহলে বিয়ের পরে একবারও বললেন না কেন?”

” তখন বলেও বা লাভ কি হতো? ডিভোর্স দেওয়া ছাড়া তুমি আর কি করতে পারতে? সেটা আমাদের কারো জন্যই ভালো হতো না, তাই বলিনি। ভেবেছিলাম যদি কখনও আমাদের ডিভোর্স হয় তাহলে তোমাকে সব জানাব।”

” তাহলে ডিভোর্স দিলেন না কেন আমাকে? সব সত্যি জানার পর তো আমি মুক্তিই চেয়েছিলাম আপনার কাছে। কেন আমাকে ডিভোর্স দেননি তখন? যার মনে কখনও আমি ছিলাম না তার জীবনেও আমি থাকতে চাই না। এই কথা বলিনি আপনাকে?”

ইয়ামিন গাঢ় স্বরে বলল,” হ্যাঁ বলেছো। কিন্তু এখন সবকিছু বদলে গেছে উষসী। বিশ্বাস করো, আমি আর আগের মতো নেই। আমি সত্যি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি। এতটুকু মিথ্যা বলছি না, ট্রাস্ট মি।”

উষসী থমকালো। যন্ত্রের মতো আওড়াল,” কিভাবে এতো বদলে গেল সবকিছু? কি এমন হয়েছে যে আপনি এতোবছরের আবেগ ভুলে হঠাৎ আমাকে ভালোবাসতে শুরু করলেন?”

উষসী শেষ প্রশ্নটা করল শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে৷ ইয়ামিন নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল,” আমার এক্সিডেন্টের পর থেকেই সবকিছু বদলানো শুরু হয়েছে। ”

উষসী তাচ্ছিল্য হাসল,” এক্সিডেন্ট তো আরও একবছর আগের কথা। এতোগুলো দিন তো কখনও ভালোবাসার কথা বলেননি আপনি৷ তাহলে আজ কেন বলছেন?”

উষসী নিজের পেট খামচে ধরে শুধাল,” বাবুর জন্য? ভাবছেন আপনার সন্তান জন্ম দিচ্ছি বলে এখন আমাকে গ্রহণ করতে আপনি বাধ্য? চিন্তা করবেন না, ডিভোর্সের পরেও আপনার সন্তান আপনারই থাকবে। আমি এতো সেলফিশ না যে বাবার থেকে বাচ্চাকে আলাদা রাখব।”

ইয়ামিন কাতর হয়ে বলল,”আবারও ভুল ভাবছো তুমি আমাকে। তুমি যে আমার জন্য কতোটা ইম্পোর্ট্যান্ট তা আমি বুঝতে পেরেছি এক্সিডেন্টের পর থেকে। তবে ভালোবাসাটা অনুভব করিনি তখনও। কিন্তু ওই রাতের পর সব বদলে গেছে। আমি আরও গভীরভাবে জড়িয়ে গেছি তোমার সাথে। এখন কোনো অবস্থাতেই আর তোমাকে হারাতে পারব না।”

উষসী এবার ভ্রু কুঁচকালো,” রাতের পর থেকে মানে?”

” সেদিন রাতে তুমি কি করেছিলে মনে করে দেখো! কোনো নরাধমের পক্ষেও সম্ভব হতো না তোমাকে অগ্রাহ্য করা। আর আমি তো সাধারণ মানুষ। এতো ক্ষমতা আমার নেই। আমি প্রেমে পড়ে গেছি উষসী, তোমার ভালোবাসা আমাকে আটকে দিয়েছে।”

উষসীর মুখ লালচে হয়ে উঠল। খানিক বিব্রত হয়ে বলল,” আমি কিছু মনে করতে চাই না। ছাড়ুন আমাকে।”

” তোমাকে অবশ্যই মনে করতে হবে। নাহলে তুমি এখান থেকে যেতে পারবে না।”

” আমার ঠান্ডা লাগছে।” উষসী জোর করে কাশার ভং ধরল। ইয়ামিন উদ্বিগ্ন হয়ে তাকে পাজাকোলায় নিয়ে সুইমিংপুল থেকে পাড়ে উঠে এলো। আয়শা তাদের দু’জনকে একসাথে ঢুকতে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,” ম্যাডাম, আপনি ফিরে এসেছেন? শুকুর আলহামদুলিল্লাহ! কিন্তু কি হয়েছে আপনাদের? ভিজে এই অবস্থা কিভাবে হলো? ”

ইয়ামিন আর উষসী কেউই কোনো উত্তর দিল না। নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে গেল তারা। উষসী ঠান্ডায় থরথর করে কাঁপছে। ইয়ামিন বারান্দা থেকে তোয়ালে এনে বলল,” বেশি শীত লাগলে তুমি শাড়িটা খুলে ফেলতে পারো। আমি কিছু মনে করব না।”

উষসী রাগী দৃষ্টিতে তাকাল। দুইহাত সামনে তাক করে বলল,” আমি কিন্তু ইউটিউব থেকে ক্যারাটে শিখেছি।”

ইয়ামিন আরও জোরে হেসে উঠল। উষসী চোখ বড় করে তাকাল,” মজা না, সত্যি বলছি। কাছে এলেই আপনাকে একদম কুপোকাত করে দিবো। দেখবেন?”

ইয়ামিন বলল,” তোমার চুল থেকে পানি পড়ছে। কাছে আসার অনুমতি দিলে মাথাটা মুছে দিতাম।”

উষসী আবার ধরা খেল নিজের বেশি বোঝার প্রতিভার কারণে। অস্বস্তিতে কাঁচুমাচু হয়ে গেল তার মুখ। ফট করে ইয়ামিনের হাত থেকে তোয়ালে কেঁড়ে নিয়ে বলল,” আমি নিজেই মুছতে পারি আমার মাথা। সেজন্য আপনাকে লাগবে না।”

সে তোয়ালে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলেই পেছন থেকে শাড়ির আঁচল টেনে ধরল ইয়ামিন। স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে গেল উষসীর পা। চোখ দু’টো বিস্ময়ে গোল হয়ে গেল। ইয়ামিন এক-পা, দু’পা করে কাছে আসছে তা অনুভব করতেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেতে লাগল তার। বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। ইয়ামিন একটু ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,” এখন কি করবে? সেদিনের মতো কি আবার শাড়ি ছেড়েই পালাবে?”

অতীতের কথা মনে পড়তেই উষসীর কান গরম হয়ে উঠল। মুখমন্ডল লাল হয়ে গেল। সে কনুই দিয়ে ইয়ামিনের পেটে ধাক্কা মেরে দৌড়ে বের হয়ে গেল।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে