#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৩২
লিখা- Sidratul Muntaz
(বর্তমান)
সেদিন বিয়ের খুশিতে কত পাগলামিই না করেছিল উষসী। তৃষাণও কিভাবে যেন সব মেনে নিয়েছিল। উষসীর আনন্দের কোনো সীমা ছিল না। সেসব ভাবলে এখন নিজেকে বড্ড বোকা মনে হয়। ভীষণ আফসোস হয়। বিয়ের আগে যেই সময়টাকে শ্রেষ্ঠ বলে ভ্রম হয়েছিল… বিয়ের ঠিক পরের দিন থেকেই সেই ধারণা ভেঙে চুরচুর হয়ে যেতে লাগল। এখন আর উষসী স্বপ্ন দেখে না। ইয়ামিনের কথায় মনে আনন্দের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ে না।
তার জীবনে ইয়ামিন শুধুই একটা গিরগিটি। যে প্রতি মুহূর্তে রঙ বদলিয়েছে। যার প্রত্যেকটি পদক্ষেপ উষসীর জীবন তছনছ করে দিয়েছে!
উষসী এখন বড্ড ক্লান্ত। তার মনটাও ভাঙতে ভাঙতে পরিশ্রান্ত। এক চিলতে বিশ্বাসও অবশিষ্ট নেই সেখানে। হয়তো উষসী চাইলেও কখনও ইয়ামিনকে আগের মতো ভালোবাসতে পারবে না। তাদের সম্পর্কের সমীকরণ বড় জটিল রূপ ধারণ করেছে।
রাত এগারোটা বেজে পাঁচমিনিট। বাড়ি ফিরে ইয়ামিন আয়েশার কাছে প্রশ্ন করল,” উষসী কি করে, আয়শা? শুয়ে পড়েছে নাকি?”
আয়েশা মলিন মুখে বলল,” না স্যার। ম্যাম তো এতো তাড়াতাড়ি ঘুমায় না। কালরাতেও ঘুমায়নি।”
” কালকের কথা জানতে চাইনি। এখন কি করছে সেটা বলো। ”
” কে জানে? ম্যাডাম তো দরজাই খুলছে না। আর একটু আগে বড় ম্যাডাম ফোন করেছিল। আপনার সাথে কথা বলতে চান।”
ইয়ামিন ভুল করে মোবাইল বাড়িতেই ফেলে গেছিল। সেজন্যই হয়তো আয়েশা রিসিভ করেছে। এখন বাংলাদেশে নিশ্চয়ই সকাল! ইয়ামিন মোবাইল হাতে নিয়ে মাকে ফোন করল,” হ্যালো মম।”
ওই পাশ থেকে হুংকার ছাড়লেন শিমলা,” তুই নাকি আমার বউমার গায়ে হাত তুলেছিস? এই কথা কি সত্যি?”
ইয়ামিন অপ্রস্তুত হয়ে আয়েশার দিকে তাকাল। ভয়ে আয়েশা দ্রুত রান্নাঘরে চলে যাচ্ছে। ইয়ামিনের মেজাজ খারাপ হলো। এই মেয়ের পেটে একটা কথাও যদি থাকতো।
মিসেস শিমলা তেজ নিয়ে উচ্চারণ করলেন,” কথা বলছিস না কেন ? সত্যি হাত তুলেছিস?”
ইয়ামিন গম্ভীর স্বরে বলল,” রাগের মাথায় একটা চড় দিয়েছিলাম খালি। সাথে সাথে স্যরিও বলেছি।”
” মানে? স্যরি বললেই কি চড় মিথ্যা হয়ে গেল? কাউকে খু-ন করে যদি আমি বলি স্যরি তাহলে কি সে আবার জেগে উঠবে?”
” এখানে খু-নের প্রসঙ্গ আসছে কেন মম? আমি কি ওকে শাসন করতে পারি না?”
” এটা আবার কেমন শাসন? তুই আমার ছেলে হয়ে এমন বিশ্রী কাজ কিভাবে করলি? উষসীকে ফোন দে। আমি ভিডিওকল করছি। তুই আমার সামনে ওর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবি। ”
” মানে?” ইয়ামিন বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ।
সে পায়ে ধরবে উষসীর! মগের মুল্লুক নাকি? তাছাড়া ছোটবেলায় একবার উষসীও তার গালে চড় মেরেছিল। সেই কথা অবশ্য কেউ জানে না। কই, সেজন্য তো উষসী কখনও ক্ষমা চায়নি! কিন্তু ইয়ামিন বাচ্চা মানুষ ভেবে নিজে থেকেই ক্ষমা করে দিয়েছিল। তার এই মহানুভবতার কথা কেউ কোনোদিন জানবে না।
তাছাড়া কাল যেটা ইয়ামিন করেছে সেটা ঠিকই করেছে। প্রীতমের সাথে যদি আরেকবার উষসী দেখা করে তাহলে এর চেয়েও ভয়ংকর কিছু হবে। ইয়ামিন প্রীতমের হাড়গোড় ভেঙে ফেলবে। প্রয়োজনে উষসীর হাতে-পায়ে শিকল পরিয়ে ঘরে বন্দী করে রাখবে।
শিমলা কড়া কণ্ঠে বললেন,” তুই যে অপরাধ করেছিস সেজন্য এটাও অনেক কম শাস্তি। আমার তো ইচ্ছে করছে এখনি লস এঞ্জলসে এসে তোর কান ধরে বউমা’র কাছে ক্ষমা চাওয়াই।”
” তোমার বউমা কি করেছে সেটা শুনলে তুমি আর এই কথা বলতে না।”
শিমলা শান্ত গলায় বললেন,” সে যা ইচ্ছা করুক, কিন্তু তুই ওর গায়ে হাত তুলবি কেন? তুই ধমকাতে পারিস, বোঝাতে পারিস, শাসন করতে পারিস, কিন্তু তাই বলে গায়ে হাত তুলবি?”
” আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে। কিন্তু সেজন্য ক্ষমা চাওয়ার চান্সও তো তোমার বউমা দিচ্ছে না আমাকে। সারাদিন দরজা আটকে বসে আছে। কারো সাথে কথা বলছে না। খাওয়া-দাওয়াও করছে না।”
” একদম ঠিক করেছে। তোর সাথে এটাই হওয়া উচিৎ। ”
ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল,” কিন্তু এজন্য শাস্তি কে পাচ্ছে মম? কষ্ট তো ওরই হচ্ছে। এই অবস্থায় না খেয়ে থাকা কি ঠিক?”
” কোন অবস্থায়?”
” প্রেগন্যান্ট…” ইয়ামিন মুখ ফসকে কথাটা বলেই আফসোস করল। ওই পাশ থেকে মিসেস শিমলা তীব্র আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন,” কি বললি তুই? উষসী প্রেগন্যান্ট? সত্যি?”
ইয়ামিন লজ্জিত হলো। শিমলা খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন,” এতো দেরিতে এই কথা আমাকে জানতে হলো কেন?”
” আমি নিজেই জানতে পেরেছি কালরাতে।”
” আমি অনেক খুশি হয়েছি। অনেক এক্সাইটেড লাগছে আমার। শোন আমি কিন্তু এই সপ্তাহের মধ্যে ইউএসএ’তে আসব। বউমাকে জানিয়ে দে আমাকে এতোবড় সুসংবাদ দেওয়ার জন্য ওর স্পেশাল গিফট আছে। তুই কিন্তু বউমাকে একদম রাগাবি না। এখনি ওর রাগ ভাঙিয়ে ওকে খেতে বসা। ওর যত্নের যেন কোনো ত্রুটি না হয়। এই অবস্থায় তুই আবার ওর গায়েও হাত তুলেছিস। কি অসম্ভব ব্যাপার! আমার চিন্তা করতেই রাগ লাগছে। আর যদি কখনও আমি শুনেছি যে তুই ওর গায়ে হাত দিয়েছিস তাহলে তোর একদিন কি আমার…”
মিসেস শিমলা প্রায় আধঘণ্টা বকবক করে অবশেষে ফোন রাখলেন। মায়ের সাথে কথা শেষ করে ইয়ামিন একটা লম্বা দম ছাড়ল। যেন সে বড় কোনো ঝামেলা থেকে নিস্তার পেয়েছে।
উষসীর রুমের দরজায় ধাক্কা মা-রতেই খুলে গেল। হাত ভাঁজ করে ভারী মুখে বিছানায় বসে রয়েছে উষসী। ইয়ামিন খুব শান্তভাবে নিচু গলায় বলল,” মম ফোন করেছিল। মনে হয় এই সপ্তাহের মধ্যেই আসবে। তোমাকে জানাতে বলল।”
উষসী মনে মনে ভীষণ খুশি হলো। কতদিন পর শাশুড়ীর সাথে দেখা হবে তার! কিন্তু সেই খুশিটা সে প্রকাশ করল না। রূঢ় কণ্ঠে বলল,” তো এখন আমি কি করব? নাচবো?”
” মমকে তোমার গুড নিউজটা বলেছি। খুব খুশি হয়েছে মম।”
” কিন্তু আমি খুশি না। এটা আমার জন্য ব্যাড নিউজ। আর এই বাচ্চা তো আমি রাখব না। সে এসেছে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে।”
” ইচ্ছার বিরুদ্ধে ?”
উষসী ঝগড়ুটে হয়ে বলল,” হ্যাঁ অবশ্যই।”
ইয়ামিন চোখ ছোট করল। ঘুরে এসে বলল,” ব্যাক, তুমি কি সামহাউ এটা বলতে চাচ্ছো যে সেদিন তোমার কোনো কনসেন্ট ছিল না? আমি জোর করেছি?”
উষসী খানিক চুপসে গিয়ে বলল,” এতে কি কোনো সন্দেহ আছে? এটাই তো সত্যি!”
” আমার দিকে তাকিয়ে বলো, এটাই সত্যি?”ইয়ামিন এক ভ্রু উঁচু করে কটাক্ষ ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
উষসী অন্যদিকে চেয়ে অপ্রতিভ স্বরে বলল,” তাকানোর কিছু নেই। এটাই সত্যি।”
ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মৃদু হাসল,” এতো কনফিডেন্টলি একটা মানুষ কিভাবে মিথ্যা বলতে পারে?”
উষসী জবাব দিল না। ইয়ামিন একটু সময় চুপ থেকে চিন্তিত গলায় বলল,” মম এখন সব জানে। বেবি না রাখলে মমকে কি বলবে?”
” যা সত্যি তাই বলব। আম্মুরও সব জানা উচিৎ।”
উষসীর কথায় ইয়ামিন বাকরুদ্ধ। চোখ বড় করে বলল,” মায়ের এসব জানা দরকার? সিরিয়াসলি? লজ্জা কি সব খেয়ে ফেলেছো? ”
“আমি কেন লজ্জা পাবো? আমি ভিক্টিম। আপনি হচ্ছেন ক্রিমিনাল। আমার সাথে যে অন্যায় করেছে লজ্জা তার পাওয়া উচিৎ।”
ইয়ামিন কিছুক্ষণ হা করে চেয়ে থেকে বলল,” তাহলে আমার সাথে যা অন্যায় হয়েছিল সেটাও আমার বলা উচিৎ।”
” মানে? আপনার সাথে আবার কবে অন্যায় হলো?”
” শুনতে চাও? তুমি আমাকে সেদিন কয়বার কিস করেছিলে সেটা..”
উষসী সাথে সাথে ইয়ামিনের মুখ চেপে ধরল। দরজার দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বলল,”আয়েশা এসে শুনে ফেললে কি হবে? এতো জোরে কথা বলছেন কেন? আস্তে বললে কি আমি শুনতে পাই না?”
ইয়ামিন হাত সরিয়ে বলল,” না। সত্যি কথা জোরেই বলতে হয়। আর শুনলেও প্রবলেম কি? তোমার তো কোনো ভুল নেই। তুমি না ভিক্টিম?”
উষসীর মুখ লাল হয়ে এলো। কাঁচুমাচু গলায় বলল,”কিন্তু আপনার ভুল বেশি।”
” এখন আর সেটাকে ভুল মনে করি না আমি।”
” আমি মনে করি। আর সারাজীবন মনে করব। আরে আপনাকে বিয়ে করাটাই সবচেয়ে বড় ভুল ছিল আমার।”
ইয়ামিন গাঢ় স্বরে বলল,” আমরা ভুল করলেও ও নিষ্পাপ। এসবের জন্য ও কেন শাস্তি পাবে?”
সে আলতো করে উষসীর পেটের উপর হাত রাখল। রাগে ফুঁসে উঠল উষসী। হাত সরিয়ে বলল,” খবরদার,আপনি আমার বাবুকে ধরবেন না।”
” ও আমারও বাবু।”
” কিন্তু ও এখন ওর মায়ের পেটে আছে। তাই আপনি চাইলেই ওকে স্পর্শ করতে পারেন না।”
ইয়ামিন আর্দ্র কণ্ঠে বলল,” আমি চাইলে দু’জনকেই স্পর্শ করতে পারি। দু’জনেই আমার।”
উষসী অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। হাত উঠিয়ে ঘুষি মারার ভঙ্গি করে বলল,” কি বললেন আরেকবার বলুন?”
ঘড়িতে ডং ডং করে ঘণ্টা বেজে উঠল হঠাৎ। ভয়ে চমকে তাকাল উষসী। ইয়ামিন ফিসফিস করে বলল,” লাউঞ্জরুমে এসো।”
এই কথা বলেই উঠে দাঁড়ালো সে। হাত বাড়ালো যাতে উষসী তার হাত ধরে উঠে আসতে পারে। কিন্তু উষসী উঠল না। ইয়ামিন হেসে বলল,” কোলে উঠতে চাইছো বললেই হয়।”
উষসী প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগেই ইয়ামিন তাকে কোলে তুলে নিল।
উষসী কটমট করে বলল,” আমাকে নিচে রাখুন। নয়তো আপনার চুল ছিঁড়ে ফেলব।”
” তুমি কি চাও? আমাদের বাচ্চা পৃথিবীতে এসে বাবাকে টাকলু দেখুক?”
” একদম ফাজলামি করবেন না আমার সাথে…”
উষসীর কণ্ঠ স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে গেল। লাউঞ্জরুম পুরোপুরি অন্ধকার। তারা প্রবেশ করতেই রঙিন আলো জ্বলে উঠল চারদিকে। দেয়ালের মাঝখানে উষসী আর ইয়ামিনের বিয়ের বিরাট একটা ছবি। সেই ছবিতে কত প্রাণবন্তভাবে হাসছে উষসী! অথচ ইয়ামিনের মুখ গম্ভীর। ছবিটি দেখেই কেমন স্মৃতিকাতরতায় বুঁদ হয়ে গেল উষসী। কত সুন্দর ছিল সেই সময়গুলো!
ইয়ামিন ফুড কার্টে করে কেক নিয়ে এসেছে। বড় বড় দু’টো ক্যান্ডেলস নিজের হাতে জ্বালল।
উষসী স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে। ইয়ামিন নরম কণ্ঠে বলল,” হ্যাপি টু ইয়ার এনিভার্সেরী, মাই কুইন।”
উষসী ভীষণ অবাক হয়ে গেল এবার। আজ তাদের এনিভার্সেরী নাকি? অথচ তার মনেও নেই!
উষসীর হাতে ছু*রি দিয়ে ইয়ামিন বলল,” তোমার মতো নিজের হাতে আমি কেক বানাতে পারিনি। কিন্তু কাস্টমাইজড অর্ডার করেছি। তোমার সবচেয়ে প্রিয় ফ্লেভার। খেয়ে দেখো।”
উষসী কোনো কথা বলছে না। তার বিস্ময় এখনও কাটেনি। ইয়ামিন অনুতপ্ত কণ্ঠে বলল,” আগে যা হয়েছে তার সবকিছুর জন্য আই এম এক্সট্রিমলি স্যরি।”
উষসী মুচকি হাসল। ইয়ামিন পেছন থেকে উষসীর ঘাড় জড়িয়ে ধরল। কপালে কপাল ঠেঁকিয়ে কাছে এসে বলল,”দুইবছর আগে ঠিক এই দিনে তুমি আমাকে একটা মেসেজ করেছিলে। মনে আছে? শর্ত ছিল সেই মেসেজটা যদি এনিভার্সেরীর দিনে দেখাতে পারি তাহলে সেদিন আমি যা চাইবো তাই পাবো।”
রুদ্ধ হয়ে এলো উষসীর নিঃশ্বাস। বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল গতবছরের অপমানের ঘটনা। সে এভাবেই কেক এনে ইয়ামিনকে উইশ করেছিল। অথচ ইয়ামিন তার বানানো কেক ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে বলেছিল, এসব এনিভার্সেরী পালন করা তার একদমই পছন্দ না।
এই ঘটনায় উষসীর ছোট্ট মন খুব আঘাত গ্রস্ত হয়েছিল। অথচ আজ ইয়ামিন নিজে থেকেই কেক নিয়ে উইশ করতে এসেছে। একবছরে কি কেউ সত্যি এতোটা বদলে যেতে পারে?
উষসী ধাক্কা মেরে ইয়ামিনকে সরিয়ে বলল,” পুরনো কথা আমার মনে নেই। আর মনে রাখতেও চাই না।”
ইয়ামিন আহত কণ্ঠে বলল,” আমি আমার ভুল স্বীকার করেছি। খুব বড় পারভার্ট আমি। আমাকে মাফ করে দাও… প্লিজ!”
উষসী কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে হঠাৎ ইয়ামিনের গালে একটা চড় মারল। আচমকা এহেন আচরণে ইয়ামিন কিংকর্তব্যবিমুঢ়।
উষসী কোমল গলায় বলল,” আই এম স্যরি… আমি আমার ভুল স্বীকার করছি। আমি খুব বড় ইডিয়েট। প্লিজ…আমাকে মাফ করে দিন। সবকিছু ভুলে যান। ”
ইয়ামিন স্থিরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। এই মাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনাটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে তার। বিয়ের পর জীবনে এই প্রথমবার উষসী এমন আচরণ করল। যা ইয়ামিন কখনও আশা করেনি।
উষসী তাচ্ছিল্য হেসে বলল,” কি? পারবেন না, তাই না? মাত্র দুই সেকেন্ডের একটা চড় সাথে সাথে মাফ করা আপনার পক্ষে সম্ভব হলো না। অথচ দুইবছর ধরে যে আমার মনে আঘাত করে যাচ্ছেন আপনি? আমি কিভাবে একরাতেই সব ভুলে যাবো বলতে পারেন? ”
ইয়ামিন নিজেকে ধাতস্থ করল। কাছে এসে কাতর গলায় কিছু বলতে নিলেই উষসী সরে দাঁড়ালো। হাত দিয়ে বাঁধা প্রদান করে বলল,” আগের উষসী আর এখনের উষসীর মাঝে অনেক পার্থক্য, ইয়ামিন ইব্রাহীম। সেই সহজ-সরল বোকা মেয়েটি মরে গেছে। আপনি মেরে ফেলেছেন তাকে।”
ইয়ামিন জড়ানো গলায় বলল,” সবাই একটা সেকেন্ড চান্স ডিজার্ভ করে। অন্তত আজকের দিনে আমি তোমার খুশির জন্য কিছু করতে চাই, প্লিজ।”
” আমাকে একা থাকতে দিন। তাহলেই আমি খুশি হবো।”
এই কথা বলে সে ঘরে চলে যাচ্ছিল। ইয়ামিন ডাকল,”শোনো।”
উষসী থামল কিন্তু পেছনে তাকাল না। ইয়ামিন বলল,” তুমি কি আমার সাথে একবার বাইরে হাঁটতে যাবে? ”
উষসী শক্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করল,”না।”
_______________
সকালে উষসী যত্ন করে ইয়ামিনের জন্য ব্রেকফাস্ট বানাল। সব ইয়ামিনের পছন্দের খাবার। ঘুম থেকে উঠে ইয়ামিন টেবিলে গরম গরম খাবার সাজানো দেখে অবাক হয়। পরোটা, পায়েস, আলুর দম, মাংস কষা। খাবারের মেন্যু দেখে মায়ের রান্নার কথা মনে পড়ে খুব। বাংলাদেশে গেলে মা বেশিরভাগ এগুলোই রান্না করেন। উষসীও শাশুড়ীর থেকে শিখে নিয়েছে। যেন ইয়ামিন বিদেশে এসেও মায়ের হাতের রান্না মিস না করে।
ইয়ামিন খোশমেজাজে প্রশ্ন করল,” রান্না কে করেছে আয়েশা?”
আয়েশা হাসিমুখে উত্তর দিল,” এমন সুন্দর রান্না ম্যাডাম ছাড়া আর কে করবে স্যার? আজকে নাকি আপনাদের এনিভার্সেরী! হ্যাপি এনিভার্সেরী স্যার! আপনাদের বন্ধন চিরস্থায়ী হোক। আপনারা সারাজীবন হাসি-খুশি থাকেন এই কামনা করি”
এক পশলা শীতল বাতাস এসে যেন ছুঁয়ে গেল ইয়ামিনের মন। আজকের দিনটা এতো সুন্দর কেন? আকাশটা কি একটু বেশিই নীল লাগছে? বাতাসে যেন একটু বেশিই স্নিগ্ধতা। বাগানের গাছগুলোও বেশি সবুজ লাগছে। সবকিছু যেন আজ একটু বেশিই প্রাণবন্ত। ইয়ামিন বড় করে শ্বাস নিল। প্লেটে খাবার নিতে নিতে প্রশ্ন করল,” উষসী কোথায়?”
” ম্যাডাম গোসলে গেছে স্যার। আপনি খান।”
ইয়ামিন থেমে বলল,” থাক, ও এলে একসাথেই খাবো।”
” কিন্তু স্যার, ম্যাডাম বলেছে আপনাকে খেয়ে নিতে। তার আসতে দেরি হবে।”
” তাই? ওকে।”
ইয়ামিন পরোটা আর মাংস নিল। উষসী কি সত্যি নিজের হাতে এতোকিছু করেছে? বিশ্বাসই হচ্ছে না। কতদিন পর! পরম আবেশে খাবার মুখে দেওয়ার সাথে সাথেই ইয়ামিনের কান ঝাঁ করে উঠল। গিলতে পারল না সে।ঝালে ঝলসে উঠল চোখমুখ। চিৎকার করে বলল,” পানি, পানি…”
আয়শা দ্রুত পানি ঢেলে দিল। সেই পানি খেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হলো ইয়ামিন। কিন্তু এতো ঝাল! মনে হচ্ছে যেন মুখ পুড়ে গেছে। জিহ্বা ঝলসে গেছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলছে। আয়শা তাড়াহুড়ো করে বলল,” একটু পায়েস খান স্যার। ঝালটা কম লাগবে।”
পায়েস মুখে দিয়ে ইয়ামিন আরও হতাশ হলো। চিনির জায়গায় লবণ দিয়ে ভর্তি করে রাখা হয়েছে। এই পায়েশ খাওয়ার চেয়ে বিষ খাওয়া অনেক ভালো।
আয়শা বলল,” স্যরি স্যার। আমি জানতাম না। এগুলো রাখুন। আমি এখনি আপনার জন্য অন্য কিছু বানিয়ে আনছি।”
ইয়ামিন গম্ভীর গলায় বলল,” লাগবে না।”
“কেন স্যার?”
” এমনি। তুমি যাও এখান থেকে। ”
আয়শা দাঁড়িয়েই রইল। ইয়ামিন চোখ বড় করে তাকাল,” যেতে বললাম না?”
এবার আয়শা মাথা নিচু করে চলে গেল। ইয়ামিন টেবিলে সাজানো খাবারগুলো দেখছে। উষসী সকাল থেকে সব রান্না করেছে। এতোদিন পর, এতো আগ্রহ নিয়ে সে ইয়ামিনের জন্য কিছু করেছে, তাদের এনিভার্সেরী উপলক্ষ্যে! অসুস্থ শরীর নিয়ে এতো রান্না করা তো চারটি খানিক কথা নয়। তবুও সে করেছে ইয়ামিনের খুশির জন্য! এগুলো ইয়ামিন কি করে ফেলে দিবে? উষসী নিশ্চয়ই ইচ্ছাকৃত বেশি মশলা মেশায়নি। ভুল তো হতেই পারে।
দেড়ঘণ্টা সময় নিয়ে উষসী শাওয়ার নিয়েছে।তার আজকে বেশ শান্তি লাগছে। এতোদিন গোসল করেও ফ্রেশ লাগতো না। কিন্তু আজ খুব ফ্রেশ লাগছে। আয়শা কফি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। উষসী রিল্যাক্স হয়ে ইজিচেয়ারে বসেছে। ধোঁয়া ওঠা গরম কফিতে চুমুক দিল। তারপর আগ্রহভরা গলায় প্রশ্ন করল,” তোমার স্যার ব্রেকফাস্ট করেছে?”
আয়শা বিরস মুখে বলল,” করেছে ম্যাডাম।”
” কিছু বলেনি?”
” না। ”
উষসী চোখ প্রসারিত করে তাকাল,”আমি যা রান্না করেছি, সব দিয়েছো?”
” জ্বী দিয়েছি। স্যার সব খেয়েছেন।”
” সব খেয়ে ফেলেছে?” উষসীর বিস্ময় মাত্রা ছাড়ালো। এতো লবণ আর মরিচ মেশানো খাবার ইয়ামিন খেল কিভাবে? ওগুলো কি মুখে নেওয়া যায়?
” খাবারের টেস্ট সম্পর্কে কোনো অভিযোগ করেনি?”
আয়শা দুইপাশে মাথা নাড়ল,” না। খাবারে লবণ, মরিচ খুব বেশি হয়েছিল। স্যার ঝাল সহ্যই করতে পারেন না। তবুও জোর করে খেয়েছেন।”
” জোর করে খেয়েছে?” উষসী অবাক।
আয়শা বলল,” আপনি এতো কষ্ট করে রেঁধেছেন, এজন্য এই খাবার উনি ফেলতে দেননি। আমি এতো নিষেধ করলাম তাও শুনলেন না। একটু আগেই বমি করে ভাসিয়েছেন। তাও বলছেন সমস্যা নেই। ”
উষসী হতবিস্মিত! সে তো ইচ্ছে করেই ইয়ামিনকে শিক্ষা দিতে এভাবে রান্না করেছিল। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে একটু বেশিই হয়ে গেছে। এগুলো খেয়ে ইয়ামিনের শরীর খারাপ হোক… এটা সে চায়নি।
চলবে
#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৩৩
লিখা- Sidratul Muntaz
বাইরে বৃষ্টি। ইয়ামিন এখনও বাড়ি ফেরেনি। উষসীর অবশ্য সেই খেয়াল নেই। সে ট্যারেসে দাঁড়িয়ে শহুরে বৃষ্টি উপভোগ করছে অন্যমনস্ক হয়ে। বাংলাদেশের সাথে এই বৃষ্টির অনেক তফাৎ। নিজের দেশের বৃষ্টির গন্ধ আলাদা, ছন্দ আলাদা, সৌন্দর্য্য আলাদা। এখানকার বৃষ্টিটা নিজস্ব লাগে না। সুন্দর, মসৃণ সড়কে বৃষ্টি স্নিগ্ধতা আনে ঠিক… কিন্তু মেঠোপথের সুপরিচিত গন্ধ পাওয়া যায় না। অবশ্য এই দেশের কোনোকিছুই উষসীর নিজস্ব লাগে না। যাকে একান্ত নিজস্ব মনে করার কথা ছিল, তাকেও না।
বিয়ের আগে উষসী ভাবতো তার নিজের মানুষটা হবে তার সবচেয়ে কাছের। সে হবে ওই মানুষটির হৃদয়ের একমাত্র রাণী! মানুষটি তাকে মন উজাড় করে ভালোবাসবে!
কিন্তু সব আশায় গুড়ে বালি। তার স্বপ্নের রাজমহল তৈরী হওয়ার আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে! একটা নিষ্ঠুর ধ্রুব সত্য এক নিমেষে ছাড়খাড় করে দিয়েছে উষসীর মন। এবার সে তিলে তিলে শেষ করছে প্রাণশূন্য দেহটাও।
যথেষ্ট রাত হয়েছে তখন। আয়েশা সারাবাড়ির কোথাও উষসীকে খুঁজে না পেয়ে ছাদে উঠল। বৃষ্টিতে ভিজে শাড়িটা গায়ের সাথে লেপ্টে আছে উষসীর। সে থরথর করে কাঁপছে ঠান্ডায়। তাও নিচে নামছে না।
আয়শা বলল,” ম্যাডাম, এতো রাতে বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক নয়। নিচে নামুন।”
” আমি নামবো না আয়েশা। বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত আমি ভিজতেই থাকব। ”
উষসী কেমন যন্ত্রমানবীর মতো কথাটা বলল। সে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে ছাদের মাঝখানে। বৃষ্টির ফোঁটা তাকে স্পর্শ করলেও সে নির্বিকার! তার চোখ দুঁটো গাঢ় লাল। আবছা আলোয় আয়শা উষসীর লালচে চোখ দেখে ভয় পেয়ে গেল। এই অবস্থায় কি বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক? তাও এমন অন্ধকারে? যদি জ্বর চলে আসে?
দুশ্চিন্তা হলেও উষসীকে শাসন করার অধিকার তাকে দেওয়া হয়নি। সে মিনমিন করে বলল,” স্যার যে সেই কখন বের হয়েছিলেন… এখনও তো ফিরলেন না ম্যাডাম।”
উষসী নিরুত্তর। ইয়ামিনের ফিরে আসা না আসায় তার এখন আর কিছু যায়-আসে না।
আয়েশা চিন্তিত স্বরে বলল,” স্যার তো অসুস্থ ছিলেন। এই অবস্থায় কোথায় উধাও হয়ে গেলেন, বলেন তো? আমার খুব টেনশন লাগছে।”
উষসী হাত দিয়ে ভেজা মুখটা মুছতে মুছতে সম্পূর্ণ নির্বিকারচিত্তেই বলল,” এতো টেনশনের কিছু নেই! তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো।”
” এভাবে কিভাবে শুয়ে পড়ব? স্যারকে ফোন করেছি। উনি ধরছেন না।যতক্ষণ না আসবেন… আমাকে তো জেগে বসেই থাকতে হবে।”
উষসী হাসল। তার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি এলেই কেবল সে এমন করে হাসে। আয়শা উষসীকে হাসতে দেখে অবাক হলো। বহুদিন পর সে তার ম্যাডামকে এইভাবে হাসতে দেখছে।
উষসী কাছে এসে বলল,” এক কাজ করো।অনম ভাইকে আসতে বলো।”
” কেন ম্যাডাম? কোনো দরকার?”
” অবশ্যই। খুব জরুরী দরকার।”
আয়শা চলে যেতেই উষসী আজকে সকালের ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণ করতে লাগল।
ইয়ামিন অতিরিক্ত মশলা মেশানো খাবার খেয়ে বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছে। উষসী ভদ্রতার খাতিরে তাকে দেখতে তার রুমে গেল। ইয়ামিন এতোদিন পর উষসীকে নিজের রুমে দেখে অবাক হলো এবং একই সাথে খুশিও। তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসে নরম গলায় বলল,” হঠাৎ এইখানে?”
উষসী গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করল,” শরীর কেমন?”
” ভালো… মনে হয় অনেকদিন পর হেভি খাবার খাওয়ায় এসিডিটি হয়ে গেছে।”
” কে বলেছিল জোর করে খেতে? সব জায়গায় হিরোগিরি দেখাতে হয় না। এবার মজা বুঝুন।”
ইয়ামিন ভ্রু কুচকে বলল,”রান্না খুব ভালো ছিল। তাই বেশি খেয়ে ফেলেছি।”
উষসী কঠিনমুখে বলল,” আমাকে খুশি করার জন্য মিথ্যা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি জানি রান্না কেমন হয়েছে। তাছাড়া আমি ইচ্ছে করেই ঝাল দিয়েছি, এক্সট্রা লবণ দিয়েছি যেন আপনার খেতে কষ্ট হয়। আমার ইচ্ছেটা আপনি পূরণ করেছেন। সব খাবার খেয়ে নিজের শাস্তি ভোগ করেছেন। সেজন্য ধন্যবাদ।”
ইয়ামিন হতবাক হয়ে বলল,” তুমি ইনটেনশনালি এটা করেছো?”
উষসী তাচ্ছিল্য হাসল,” অবশ্যই। আপনি কি মগা নাকি? ইচ্ছে করে কেউ পায়েসে চিনির জায়গায় লবণ দেয়! প্রয়োজনের অতিরিক্ত মরিচ কেউ রান্নায় মেশায়? এতোদিন ধরে রান্না করছি… কখনও দেখেছেন আমাকে ভুল করতে?”
ইয়ামিন সহজ গলায় বলল,” আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য তোমার এতো কষ্ট করার কোনো দরকার ছিল না। তোমার মন খারাপ দেখলে আমি এমনিই কষ্ট পাই।”
উষসী এবার হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে উঠল। ইয়ামিন তার একহাত ধরে টেনে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,” বিশ্বাস করো, তোমার চোখের পানি বুকের ঠিক এইখানে আঘাত করে।”
” তাই নাকি? আগে যখন আমি কাঁদতে কাঁদতে রাত্রী পার করতাম তখন তো আপনি ফিরেও তাকাতেন না। তখন বুঝি বধির ছিলেন? নাকি অন্ধ?”
ইয়ামিন পরাস্ত হলো। অতীত টেনে আনলেই তাকে নিশ্চুপ হয়ে যেতে হয়। সে অপরাধী। এটা সে কখনও অস্বীকার করেনি। কিন্তু প্রায়শ্চিত্তের কি কোনো উপায় নেই?
উষসী নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল এবং কটমট দৃষ্টিতে তিরস্কার মিশিয়ে বলল,” আপনাকে আমি কতটা ঘৃণা করি তা আপনি এখনও কল্পনাও করতে পারছেন না।”
” আমি বিশ্বাস করলাম না। তুমি আমাকে আগে যেমন ভালোবাসতে… এখনও তেমনি বাসো।”
” আপনার ভুল ধারণা। কল্পনার জগৎ থেকে বের হয়ে আসুন। বাস্তবতা খুব তিক্ত।”
ইয়ামিন তার টি-শার্ট খুলে ফেলল। এই অবস্থা দেখে উষসী দ্রুত অন্যদিকে ঘুরে তাকাল। ইয়ামিন হেসে বলল,” আমাকে দেখলে তোমার চোখ খসে পড়বে না।”
উষসী বিড়বিড় করে বলল,” আমি দেখতে চাই না তাকে, যে কখনও আমার ছিলই না।”
ইয়ামিন আলমারি থেকে ইস্ত্রি করা শার্ট বের করল। খুব আলগোছে শার্টের সবচেয়ে সামনের বোতামটা ছিঁড়ে পকেটে রাখল। তারপর সেই শার্ট পরতে পরতে হঠাৎ বলল,”যদি প্রমাণ করতে পারি, তুমি এখনও আমাকে ভালোবাসো তাহলে আমি কি পাবো?”
উষসী থতমত খেয়ে তাকাল,” মানে? কিভাবে প্রমাণ করবেন?”
ইয়ামিন বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল,” ওহ শিট, শার্টের একটা বাটন খুলে গেছে। উষসী, প্লিজ হেল্প মি।”
উষসী দুই কদম পিছিয়ে রুক্ষ গলায় বলল,”আশ্চর্য! আয়েশাকে বলুন। এটা আমার কাজ না।”
ইয়ামিন এক ভ্রু উঁচু করে তাকাল। ঠাট্টার স্বরে বলল,” ও। তাহলে কি এটা আয়েশার কাজ? সে বেডরুমে এসে আমার শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিবে?”
উষসী আমতা-আমতা করে বলল,” তাহলে অনম কিসের জন্য আছে? তাকে ডাকুন।”
” অনম? সে সুই ধাগা দিয়ে বোতাম সেলাই করবে? সিরিয়াসলি?”
উষসী হাত ভাঁজ করে বলল,” আপনার কি শুধু একটাই শার্ট? অন্যটা পরুন।”
” ছোট্ট একটা কাজ। এমন করছো কেন? সব কাজ সবাইকে দিয়ে হয় না, উষু। কিছু কাজের জন্য শুধু তোমাকেই লাগবে।”
ইয়ামিন দুই কদম এগিয়ে এলো। উষসী আরও পিছিয়ে গেল। সুই আর সুতার বাক্সটা ঠিক উষসীর সামনে রাখল ইয়ামিন।
দ্বিধায় পড়ে গেল উষসী। কিছু একটা চিন্তা করে বলল,” আপনার শার্ট খুলে দিয়ে দিন। আমি ঘর থেকে সেলাই করে আনছি।”
ইয়ামিন ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল,” অনেক লেইট হয়ে গেছে অলরেডি। আমাকে পাঁচমিনিটে বের হতে হবে। যা করার দ্রুত করো।”
উষসী রেগে তাকাল। রূঢ় ভঙ্গিতে বলল,” এতো লেইট হলে নিজের কাজ নিজে করুন। আমি পারব না।”
এই বলে সে দরজার দিকে পা বাড়াল। ইয়ামিন দ্রুত সুইটা হাতে নিয়েই জোরে শব্দ করে বলল,” আউচ।”
উষসী থেমে গেল,” কি হয়েছে?”
” হাতে সুই ফুটল মনে হয়। ব্যাপার না।”
উষসী প্রায় তেড়ে এলো। ইয়ামিনের হাত ধরে ব্যাকুল হয়ে বলল,” ঢেড়স একটা! সামান্য সুই পর্যন্ত ধরতে পারেন না। কিভাবে এতো সহজে আঙুলে সুই ফুটে যায়? দেখি রক্ত বের হচ্ছে কি-না?”
ইয়ামিন হাসল। উষসী খুব বিরক্ত হওয়ার ভং ধরছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে অস্থির! যেন সুই ইয়ামিনের আঙুলে ফুটেনি, ফুটেছে উষসীর হৃদয়ে।
উষসী ইয়ামিনের হাসি দেখে নিজেকে দ্রুত সামলানোর চেষ্টা করল। তাকে এতো উতলা হওয়া মানায় না এখন আর। কড়া গলায় সে বলল,” দিন সিলিয়ে দিচ্ছি। আমি অকৃতজ্ঞ না। শত হলেও আপনার বাড়িতে থাকছি, আপনার খাচ্ছি… তাই আপনার কাজ তো করতেই হবে।”
মুহূর্তেই ইয়ামিনের মুখের রঙ বদলে গেল। উষসীর হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল,” এসব কি ধরণের কথা আবার? এজন্য আমি তোমাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছি?”
উষসী হাত ছাড়িয়ে বোতাম সেলাই করতে করতে বলল,” সত্যি কথাই তো।”
” ফালতু কথা। আর কখনও বলবে না।”
” কেন বলব না? আপনি আমার দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনার জন্যই আমি ম্যারিকায় এমন গ্ল্যামারাস লাইফ লীড করতে পারছি। পৃথিবীতে ইয়ামিন ইব্রাহীমের স্ত্রী হিসেবে সবাই এখন আমাকে চিনে। এইসবের বিনিময়ে হলেও আমার উচিৎ আপনার আদেশ মেনে চলা। তাই নয় কি?”
” উষসী, স্টপ।”
” যদি স্টপ না করি?”
উষসী দেখল ইয়ামিনের চোখমুখ লাল হয়ে উঠছে। সে আচম্বিতে উষসীর মাথার পেছনের চুল চেপে ধরল। তারপর গভীরভাবে তার ঠোঁট স্পর্শ করল। উষসী হতচকিত! তার হাত ইয়ামিনের বুকের মধ্যে দেবে গেল। সুইয়ের খোঁচায় রক্তাক্ত হতে লাগল ইয়ামিনের শক্ত বুক। তবুও সে নির্বিকার। গাঢ় আবেশে অমৃত সুধা পান করতে ব্যস্ত। উষসীর চোখে অশ্রু জমে উঠল।
” ম্যাডাম, ডেকেছেন?”
অনম ট্যারেসের সামনে এসে দাঁড়াতেই ভাবনার ঘোর কাটল উষসীর। সে মাথায় হাত রাখতেই অনুভব করল, তার মাথাটা ঘুরছে। প্রচন্ড মাথাব্যথা হচ্ছে। সকালে তাদের মধ্যে খুব বাজে একটা ঝগড়া হয়ে গেছিল। তারপর ইয়ামিন ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। এখনও ফেরেনি। উষসী বৃষ্টিতে ভিজছে কেবল নিজের দুঃখ লুকানোর চেষ্টায়। বৃষ্টির পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে কাঁদলে কেউ আর তার চোখের পানি দেখবে না!
উষসী অনমের উদ্দেশ্য কিছু বলতে নিচ্ছিল। কিন্তু তার গলা দিয়ে শব্দ আসছে না। শরীর কেমন দূর্বল লাগছে। হঠাৎ উষসী মাথা ঘুরে পড়ে গেল মেঝেতে। অনম আর আয়েশা দৌড়ে এলো।
(অতীত)
বিয়ের কার্যক্রম শেষ করে ইয়ামিন ছাদে চলে গেল। তার দমবন্ধকর কষ্টটা আবার হচ্ছে। সারাজীবন অভিনয় করে কাটানো কি সম্ভব? ইয়ামিন যদি ক্লান্ত হয়ে যায়? তার জীবনটা বিরাট এক নাট্যশালা হয়ে যায়নি তো? যেখানে তার কাজ শুধু ভালোবাসার অভিনয় করে যাওয়া!
উষসীর হঠাৎ মনে হলো, আজ তাদের বিয়ের দিন। অথচ একবারও সে ইয়ামিনের মুখে হাসি দেখেনি। দেখেছে শুধু অস্থিরতা আর দুশ্চিন্তা! পালকিতে উষসী একাই বসেছিল। তার মনটা হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে উঠল। পালকির দরজা এতটুকু ফাঁক করতেই সে দেখল আঁধার রাত। তখনও উষসী জানতো না, নিজের জীবনটা নিয়ে সেও কোনো আঁধার-মিনারেই ডুব দিচ্ছে!
শ্বশুর বাড়ি পৌঁছাতেই উষসী চমক খেল। বিশাল বাড়িটি মরিচ বাতি আর ফুল দিয়ে এমনভাবে সজ্জিত যেন রাজপ্রাসাদ! দুইপাশে ব্যান্ড পার্টি সানাই বাজিয়েই চলেছে। ছেলে-মেয়েরা ফুল হাতে দাঁড়ানো। পালকি থেকে উষসী নামতেই অজস্র সাংবাদিক, ক্যামেরা, লাইট নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। গার্ড দিয়ে তাদের সরানো হচ্ছিল। যারা ফুল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল তারা ফুল ছিটিয়ে উষসীকে স্বাগতম জানাতে লাগল। উষসীর এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো এটা আসলেই কোনো রাজপ্রাসাদ। আর সে হচ্ছে রাণী! এই রাজ্যের যুবরাণী হিসেবে বুঝি তার অভিষেক হচ্ছে আজ।
সারাদিনের ধকল শেষ করে রুমে আসতে খুব রাত হয়ে গেল। বিবাহিত জীবনের সূচনা পর্বের সবচেয়ে বিশেষ সময় এটা। উষসী ধীর পায়ে ইয়ামিনের বেডরুমে ঢুকল। ভাগ্যিস ইয়ামিন এই মুহুর্তে এখানে নেই। নয়তো উষসী বিছানায় বসতেও ইতস্তত বোধ করতো।
সে এখন রিল্যাক্সে বিছানায় বসল। চোখ ঘুমে জড়িয়ে এলেও বুকের ভেতরটা খুব দুরুদুরু করছে। এই বিশেষ রাতটি নিয়ে একসময় অনেক জল্পনা-কল্পনা এঁকেছিল সে। যে মানুষটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো তার সাথেই তো বিয়ে হলো। তবুও উষসীর কেন মনে হচ্ছে যে কিছু একটা নেই?
কেন মনে হচ্ছে যে তার বাসর রাত আর পাঁচটা সাধারণ বাসর রাতের মতো হবে না! স্বপ্নের মতো তো একদমই নয়। বিয়েটা যত জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে শেষ হয়েছে বাসর রাতে তার কিছুই পায়নি উষসী। মিসেস শিমলা জানিয়েছেন, ইয়ামিনের নাকি ফুলে এলার্জী। তাই সে বিছানা সাজাতে নিষেধ করে দিয়েছে।
রুমটা পরিপাটি করে গুছানো হলেও দেখে মনেই হচ্ছে না যে আজ একটি বিশেষ রাত। ফুলের সৌরভ ছাড়া কি এই বিশেষ রাতের আদৌ কোনো বিশেষত্ব থাকে?
আচ্ছা, ফুলের মতো এতো সুন্দর একটা জিনিসেও কি কারো এলার্জী থাকতে পারে? এটা কেমন কথা? একটু পর দরজায় আওয়াজ হলো। কেউ কি ভেতরে আসছে? উষসীর হাত-পা সংকুচিত হয়ে গেল। নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগল সে। আচ্ছা, ইয়ামিনের সাথে তো এটা তার প্রথম দেখা না। তবুও এতো ভয় কেন লাগছে? কেন গলা শুকিয়ে আসছে এভাবে?
উষসী সারারাত অপেক্ষা করল। ইয়ামিন নিজের ঘরে প্রবেশ করল ভোররাতে, গিটার হাতে। উষসী তখনও ঘুমায়নি। ইয়ামিনের সাথে কথা বলার স্পৃহা তাকে জাগিয়ে রেখেছে। কিন্তু ইয়ামিন তার সাথে কথাই বলল না৷ সরাসরি বারান্দায় গিয়ে বসল।
উষসী কিছু বলতে নিয়েও বলতে পারল না। অদ্ভুতভাবে তার সব কথাগুলো ব্যথা হয়ে গলার মধ্যে, বুকের কাছে জমাট বেঁধে রইল।
ডিভানে বসে গিটার বাজাতে শুরু করল ইয়ামিন। ভারী কণ্ঠে তাকে গানও গাইতে শোনা গেল। তার চোখের পাতা শুকনো ছিল না। গান গাওয়ার সময় কখনোই ইয়ামিনের চোখের পাতা শুকনো থাকে না। নিজের অজান্তেই কাঁদতে শুরু করে সে। আজও ইয়ামিন গান গাইতে গাইতে কাঁদছিল। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল তাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছিল।
এদিকে বিছানায় বসে অপেক্ষার দহনে ছাড়খাড় হয়ে কাঁদছিল উষসী নিজেও। কিন্তু তার কান্নায় সংগীতের মতো সুর ছিল না, ভাব প্রকাশের অর্থবোধক শব্দ ছিল না। কেবল ছিল নীরবতা! সেই নীরবতার কান্নার কথা, বুকভরা তীক্ষ্ণ ব্যথার কথা কেউ জানল না।
চলবে