আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-৩০+৩১

0
552

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৩০
লিখা- Sidratul Muntaz

ইয়ামিন বাড়িতে গিয়ে জানিয়ে দিল, সে বিয়ে করতে রাজি। প্রথমে শিমলা ভেবেছিলেন ছেলেকে রাজি করানোর জন্য অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে। তিনি আবার অসুস্থতার অভিনয় করবেন। প্রয়োজনে না খেয়ে থাকবেন। কিন্তু তার গুণধর ছেলে যে এতো সহজে রাজি হবে তা কে জানতো? বিস্ময়ে, আনন্দে শিমলা শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করলেন,” হঠাৎ এতো সুবুদ্ধি হলো কিভাবে তোর?”

ইয়ামিন হেসে জবাব দিল,” যাকে ভালোবাসি তার ভালো’র জন্য সব করা যায়। তবে এটা সুবুদ্ধি না কুবুদ্ধি বলতে পারছি না মম।”

ছেলের উত্তর শুনে ভীষণ প্রফুল্ল হলেন শিমলা। খুশি মেশানো গলায় বললেন,” মাশাল্লাহ!”

ইয়ামিন উষসীকে ভালোবাসে, শিমলার কাছে এর চেয়ে ভালো খবর আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু আসল ব্যাপার তো ভিন্ন! ইয়ামিন বিয়ে করছে ভালোবাসার মানুষের খুশির জন্য…ভালোবাসার মানুষকে নয়!

_______________________
উষসী বাড়ি ফেরার পর তৃষাণ আছাড় মেরে তার মোবাইল ভেঙে ফেলল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল,” মোবাইল নিয়ে বাইরে গেলে যদি সুইচড অফ করেই রাখতে হয় তাহলে মোবাইল রাখার কোনো প্রয়োজন আমি দেখি না। ”

রাগে আর ভয়ে উষসী কোনো জবাব দিল না। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে ফেলল। তৃষাণ গজগজ করে বলল,” উষু, দরজা খোলো। খোলো বলছি।”

কোনো জবাব এলো না। ওই পাশ থেকে শুধু ফ্যাচফ্যাচ কান্নার শব্দ পাওয়া গেল। তৃষাণ ধৈর্য্য ধারণ করতে কপালে হাত রেখে সোফায় বসল। ডোনা নরম গলায় বললেন,” এতো রাগ দেখানোর কি দরকার ছিল? মেয়েটার ফোনটাই ভেঙে ফেললি?”

তৃষাণ তীক্ষ্ণ মেজাজে বলল,” একদম ঠিক করেছি যে ভেঙে ফেলেছি। ও আমার ফোন ধরবে না কেন? আবার সুইচড অফ করবে কেন? ওর হাতে ফোন দেওয়াটাই সবচেয়ে বড় ভুল ছিল।”

“ভার্সিটিতে পড়া একটা মেয়ে ফোন ছাড়া কিভাবে চলবে? তাছাড়া আমি জানি ও কেন বাইরে গিয়ে তোর ফোন ধরেনি। ও ইয়ামিনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল।”

” হোয়াট?” তৃষাণ আরও রেগে গেল। তার চোখ দু’টো অগ্নিবলয়ের মতো উৎক্ষীপ্ত। ডোনা তোয়াক্কা না করে বললেন,” যার সঙ্গে বিয়ে হবে তার সঙ্গে আলাদা কথা বলবে, দেখা করবে, এসব তো স্বাভাবিক। আর উষ্ণতা বলেছে ইয়ামিন বিয়েতে রাজি। তুই কেন অযথা বাগড়া দিচ্ছিস বাবা? মেনে নে না!”

তৃষাণ কাঠ কাঠ গলায় বলল,” তুমি ভালো করেই জানো মা, এই বিয়ে আমি কোনো অবস্থাতেই মানব না।!

তৃষাণ উঠে নিজের বেডরুমে গেল। ডোনা উপায়ন্তর না পেয়ে উষ্ণতাকে ফোন করে পুরো ঘটনা জানালেন। এসব শুনে উষ্ণতা আতঙ্কিত হলো। তৃষাণ যদি এমন করতে থাকে তাহলে বিয়েটা কিভাবে হবে? ডোনা বললেন,” তুমিই একমাত্র ওকে সামলাতে পারবে মা। দ্রুত বাড়ি এসো।”

” আমি আসছি, মা। চিন্তা করবেন না।”

ডিনারে সবাই খেতে বসেছে। অনুপমা এসে বলল,” ভাবী, উষু এখনও বের হয়নি। ওর খাবার কি ভেতরে দিয়ে আসবো?”

উষ্ণতা আঁড়চোখে তৃষাণকে দেখল। অনুপমার কথা শুনে তৃষাণ রূঢ় আওয়াজে বলল,” খাবার ভেতরে দিয়ে আসতে হবে কেন? এখানে আসতে কি সমস্যা ওর?”

উষ্ণতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” কি সমস্যা সেটা তুমিই জানো। ও সারাদিন ঘর থেকে একবারও বের হয়নি। কিছু খায়ওনি। মায়ের কাছে শুনলাম তুমি নাকি ধমক দিয়েছো?”

সবাই অবাক হয়ে তৃষাণের দিকে তাকাল। তৃষাণ অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” আমি ধমক কেন দিবো? শুধু বলেছিলাম বাইরে থাকলে যেন ফোন সুইচড অফ না রাখে।”

উষ্ণতা মৃদু হেসে বলল,” এটা বলার জন্য আছাড় মেরে মোবাইল ভেঙে ফেলতে হবে?”

তৃষাণ রেগে তাকাল,” ওকে ফাইন। আমার জন্যই সব হয়েছে। আহ্লাদ মাখিয়ে ওকে খেতে বসাও এখন। মেয়েটা দিন দিন শুধু বেয়াদব হচ্ছে। ওর থেকে এসব দেখে আইলা আর তৃষ্ণাও শিখবে।”

উষ্ণতা অকপটে বলল,” লাভ নেই। যতই আহ্লাদ মাখানো হোক, ও খেতে বসবে না। অনশন জারি করেছে তোমার শালি। ”

” অনশন মানে? ”

” না খেয়ে থাকার অনশন।”

“ওর দাবিটা কি?”

” দাবি কি সেটা তুমি জানো। কিন্তু আমার মুখ থেকে শুনতে চাইলে বলতে পারি।”

” শুনি?”

ডোনা উষ্ণতার হাত চেপে ধরলেন। উষ্ণতা চোখের ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করে সাবধানে বলল,” উষু বলেছে, যতক্ষণ তুমি বিয়ে না মানছো… ততক্ষণ ও কিছুই খাবে না। পানিও না।”

সবার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। তৃষাণের চোখমুখ ক্রমশ লাল হচ্ছে। সামনে থাকা পানির গ্লাসটা আছাড় মেরে ভেঙে বলল,” এসব কি ধরণের নাটক?”

তৃষ্ণা দুইহাত কানে লাগিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বলল,”জানতাম এটাই হবে।”

তৃষাণ উঠে দাঁড়াল। অনড়ভাবে বলল,” ও না খেয়ে মরে গেলেও আমি বিয়ে মানবো না। ”

ডোনা জেদ করে বলল,” তাহলে আমিও কিছু খাবো না।”

” মানে? তুমি খাবে না কেন?”

” যেখানে আমার ভালো মেয়ে না খেয়ে আছে… সেখানে আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে কি করে?”

তৃষাণ রাগ সংবরণ করে প্রশমিত গলায় বলল,” মা, তোমাকে নিয়মিত ঔষধ খেতে হয়। না খেয়ে থাকা তোমার জন্য রিস্কি।”

” অতশত বুঝি না। উষু না খেয়ে থাকলে আমি খাবো না। মানে কিছুতেই না।”

উষ্ণতা বলল,” মা, আপনি যদি না খান… তাহলে আমিও খাবো না।”

যুথি বলল,” ঠিকাছে, আমিও তাহলে খাবো না।”

তৃষাণ করুণ দৃষ্টিতে তাকাল,” মা, আপনিও এই কথা বলছেন?”

” যেই বাড়িতে আমার দুই মেয়ে উপোস থাকবে, সেই বাড়িতে আমি মা হয়ে কিভাবে খাবো?”

অনুপমা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বলল,” ভাবী খাবে না, উষু খাবে না, খালাম্মারা কেউ খাবে না… সেখানে আমি কিভাবে খাই? না আমিও খাবো না।”

তৃষ্ণা বলল,” আমিও খাবো না। এই আলু, তুই খাবি?”

আইলা বড় বড় চোখে তাকাল। তৃষ্ণা ওকে কানে কানে শিখিয়ে দিল,” বল, আমিও খাবো না।”

আইলা আধো কণ্ঠে বলল,” আমিও তাবো না।”

তৃষাণ আহমেদের দিকে তাকাল। আহমেদ অসহায় কণ্ঠে বলল,” আমার বউ, আমার বাচ্চা মেয়ে যেখানে না খেয়ে থাকবে সেখানে আমি কিভাবে খাই,ভাই? এই খাবার কি আমার গলা দিয়ে নামবে?”

উষ্ণতা বলল,” ঠিকাছে.. অনু, শুধু তোমার ভাই ছাড়া আমাদের সবার খাবার নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দাও। আজকে আমরা সবাই উপোস থাকব। ”

” জ্বী ভাবী।”

অনুপমা খাবার তুলতে লাগল। তৃষাণ হার মানল না। কণ্ঠে উত্তাপ মিশিয়ে বলল,”আমারটাও নিয়ে যাও।কেউই যখন খাবে না তখন আমিও খাবো না। তবুও এই বাড়িতে কোনো বিয়ে হবে না। এন্ড দ্যাটস ফাইনাল।”

এই কথা বলে হনহন করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল তৃষাণ। সবাই একটা হতাশার নিশ্বাস ত্যাগ করল। ডোনা বললেন,” আমি আগেই বলেছিলাম। লাভ হবে না। ও মানবে না”

যুথি বললেন,” তাহলে এখন উপায়?”

উষ্ণতা সবাইকে আশ্বস্ত করে বলল,” অপেক্ষা করো। ওকে আমি চিনি। কিছুক্ষণ রাগ দেখাবে। কিন্তু পরে সব মেনে নিবে। এতোগুলো মানুষের অনুরোধ ও ফেলবে না।”

___________________
রাতেই তৃষাণ গাড়ি নিয়ে সোজা ইয়ামিনের বাড়ির দিকে রওনা হয়। তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা বাজছে। গলিতে ঢুকেই তৃষাণ ফোন করে ইয়ামিনকে নিচে আসার জন্য বলে। ইয়ামিন চায় না বাড়ির ভেতরে সিন ক্রিয়েট হোক। এতোরাতে ছেলেকে বাইরে যেতে দেখে আজমল সাহেবও পিছু নেন। তিনি ড্রয়িংরুমে অন্ধকারে বসেছিলেন। ইয়ামিন সেটা খেয়াল করেনি।

তৃষাণ ইয়ামিনকে দেখেই তেড়ে এসে তার কলার চেপে ধরে গর্জে উঠল,” আমার ফ্যামিলি থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম না? তবুও কেন আসছো? উষসীকে বিয়ে করতে চাওয়ার পেছনে উদ্দেশ্য কি তোমার?”

ইয়ামিন শক্ত কণ্ঠে বলল,” আপনি এখানে এভাবে সিন ক্রিয়েট করবেন না, প্লিজ।”

তৃষাণ ঘুষি মেরে ইয়ামিনের নাক ফাটিয়ে দিল। র-ক্ত নির্গত হচ্ছে নাক থেকে। তৃষাণ উন্মত্ত কণ্ঠে বলল,” উষসীর জীবন নষ্ট করার সুযোগ তোমাকে দেওয়া হবে না।”

” কিন্তু আমি উষসীকেই বিয়ে করব।”

” আচ্ছা? এতো সাহস তোমার? কিভাবে বিয়ে করবে আমি যদি হতে না দেই?”

” উষ্ণতা মিস আমার উপর ভরসা করেছেন। আমি এই ভরসা ভাঙতে দিবো না। তাকে আমি কথা দিয়েছি, উষসীকে সবসময় ভালো রাখব।”

” তোমার উপর ভরসা? উষসীর নাম আরেকবার তোমার মুখে শুনলে…” তৃষাণ আবার হাত উঠিয়েছিল ঘুষি মারার উদ্দেশ্যে। তখনি পেছন থেকে আজমল সাহেব হুংকার ছাড়লেন,” থামো।”

বাবার কণ্ঠ শুনে ইয়ামিন চমকে উঠল। পেছন ফিরে দেখল সাদা পাঞ্জাবী পরিহিত বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। ইয়ামিন অস্বস্তি মাখা কণ্ঠে বলল,” বাবা… তুমি এখানে কেন এসেছো?”

আজমল সামনে এগিয়ে এলেন। ইয়ামিনের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে তৃষাণকে উদ্দেশ্য করে বললেন,” আমার ছেলে যখন বলেছে, সে উষসীকে ভালো রাখবে…তখন অবশ্যই রাখবে। ওর উপর তোমার ভরসা করা উচিৎ। ও কখনও কাউকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয় না।”

আজমল সাহেবের কথা শুনে তৃষাণের মন না গললেও ইয়ামিন হতভম্ব হলো। কতবছর হয়ে গেছে বাবা তার সঙ্গে ঠিক করে কথাই বলেন না। অথচ তাঁর মনে যে একমাত্র ছেলের জন্য এমন অগাধ বিশ্বাস রয়েছে সেটা আজকের এমন পরিস্থিতি তৈরী না হলে ইয়ামিন কখনও বুঝতো না।

তৃষাণ বলল,” উষসী শুধু আমার শালি না, ও আমার বোন। ছোট থেকে আপন বোনের চেয়েও বেশি আদরে মানুষ করেছি ওকে। ওর জীবনটা আমি কোনো অনিশ্চয়তায় ছেড়ে দিতে পারি না। দুঃখিত আঙ্কেল, কিছু মনে করবেন না। কিন্তু আপনার ছেলেকে আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করব না।”

” আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে। আমার কথার কোনো নড়চড় হবে না। উষসী এই বাড়িতে সবচেয়ে সুখে থাকবে। আমার ছেলে এই প্রথম কোনো মেয়েকে ভালোবেসেছে। তাই আমি চাই যেকোনো মূল্যে উষসীর সাথেই ওর বিয়েটা হোক।”

ইয়ামিন অবাক হয়ে তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। ঘুটঘুটে অন্ধকারের এই রাতে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আজমল সাহেব প্রায় আধাঘণ্টা তৃষাণের সঙ্গে তর্ক করলেন। অবশেষে তৃষাণ কিছুটা নরম হলো। ইয়ামিনের দিকে চেয়ে বলল,” যদি কখনও উষসীকে কষ্ট পেতে দেখি তাহলে তোমাকে আমি ছাড়ব না, ইয়ামিন ইব্রাহীম।”

আজমল আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন,” সেই সুযোগ তোমাকে দেওয়া হবে না। উষসী কখনও কষ্টে থাকবে না।”

” আমি আসছি।”

” ভেতরে বসো। অন্তত চা খেয়ে যাও।”

” আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। এতোরাতে ভেতরে যাবো না। ভালো থাকবেন।”

” তুমিও ভালো থেকো।”

তৃষাণ যখন চলে যাচ্ছিল তখন আজমল ইয়ামিনের দিকে ফিরে বললেন,” যেই মেয়েকে তুমি বিয়ে করতে যাচ্ছো, সে শুধু একটা মেয়ে না৷ তার পরিবারের চোখের মণি। সবাই মিলে তাকে যত ভালোবাসা দিয়েছে এখন থেকে তোমাকে একাই সেই ভালোবাসা দিতে হবে। তুমি কি পারবে?”

এই কথা শুনে দূরে গিয়েও থামল তৃষাণ। ইয়ামিন তার সিক্ত হয়ে আসা দৃষ্টি মুছে বলল,” আমি চেষ্টা করব।”

” শুধু চেষ্টা করলেই হবে না। তোমাকে অবশ্যই পারতে হবে,বাবা। না পারলে মেয়েটার সাথে অন্যায় করা হবে। আর আমার ছেলে কখনও কারো সাথে অন্যায় করতে পারে না।”

ইয়ামিন তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” বাবা, আই লভ ইউ।”

আজমল ঝাপসা কণ্ঠে বললেন,” এন্ড আই এম প্রাউড অফ ইউ মাই সান।”

তৃষাণ নিঃশব্দে গাড়িতে এসে বসল। সে দ্বিধা কাটাতে পারছে না। ইয়ামিনকে মেনে নেওয়া তার পক্ষে সহজ না।

__________
সকালে ঘুম ভেঙে উষসী দেখতে পেল জানালার কাছে একটা নতুন হ্যান্ডসেট। সে দৌড়ে গিয়ে ফোনটা হাতে নিল। সাথে একটা রঙিন নোট-“‘I am sorry..
বিয়ের কনে হিসেবে না খেয়ে থাকার ব্যাপারটা একদম ভালো দেখায় না। তোমার জন্য বাড়ির সবাই অভুক্ত। খেয়ে নাও উষুমনি। Good night. ”

তৃষাণ নিশ্চয়ই রাতে এসব নিয়ে এসেছিল। কিন্তু দরজা তো বন্ধ ছিল। সে ভেতরে কিভাবে ঢুকল? নিশ্চয়ই ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে। কিন্তু এতো সহজে তৃষাণ বিয়ের জন্য রাজি হবে… উষসী ভাবতেও পারেনি এটা!

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৩১
লিখা- Sidratul Muntaz

উষসীকে এইভাবে মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে বিয়ে করাটা কি ঠিক? যদি বিয়ের পর সে উষসীকে ভালোবাসতে না পারে… তখন কি হবে? তাছাড়া এভাবে বিয়ে হলে উষসীকে ঠকানো হবে। সে যদি কোনোভাবে সত্যি জানতে পেরে যায় তাহলে ব্যাপারটা আরও দুঃখজনক হবে। এসব চিন্তা ইয়ামিনকে খুব পীড়া দিচ্ছে।

সে তার বাবার কথাও ভাবছে। মনে মনে বাবা তার প্রতি এতোটা প্রত্যাশা রাখে তা সে জানতো না। বাবা বলেছেন নিজের ছেলের প্রতি তিনি গর্বিত। কিন্তু এই গর্হিত কাজের কথা জানলে তিনি কি লজ্জিত হবেন না?

বিয়ের সময় যেন খুব দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। তাড়াহুড়োর মধ্যে বিয়ে হলেও আয়োজনে কোনো কমতি নেই। একমাত্র ছেলের বিয়েতে মিসেস শিমলা রাজকীয় আয়োজন করবেন। এটা তার কতদিনের স্বপ্ন!

বিয়ের এক সপ্তাহ আগে থেকে পুরো এলাকা সাজিয়ে রাখা হলো। রাস্তার চারদিকে আলোকসজ্জা, ফুল দিয়ে হুলুস্থুল করা হলো। শহরের অর্ধেক মানুষ দাওয়াত করা হলো। এমন বিশাল আয়োজনের বিয়ে সচরাচর দেখাই যায় না। সোশ্যাল মিডিয়াতেও চলছে তোলপাড়।

ইয়ামিন ইব্রাহীমের বিয়ে নিয়ে তরুণী, কিশোরী ভক্তদের যেন হাহাকারের শেষ নেই। উষসী সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিদিন মজার মজার পোস্ট দেখছে। পুরো দেশে একটা আলোড়ন তৈরী হয়ে গেছে।

উষসীও রীতিমতো ভাইরাল! ইয়ামিনের নামের পাশে তার নাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসছে আজ-কাল। সেও এখন সেলিব্রিটি। তার ফ্যানবেজ তৈরী হয়ে গেছে। ফেসবুকের ফলোয়ার হু হু করে বাড়ছে। ইন্সটাগ্রামে সে মেহেদী রাঙা হাতের ভিডিও পোস্ট করলে তাতে একদিনেই ওয়ান মিলিয়ন ভিউ হয়ে গেছে।

ছেলেদের কাছে উষসী ক্রাশ হলেও মেয়েদের কাছে যেন চক্ষুশূল। সেদিন একটা নিউজ দেখা গেল। হেডলাইনে বড় অক্ষরে লেখা,” হাজারো রমণীর মন ভেঙে ইয়ামিন ইব্রাহীম বিয়ে করে নিচ্ছেন লামিয়া ইমরোজ উষসীকে!”

নিউজটা সময় নিয়ে উষসী পুরোটা পড়ল। তার খুবই হাসি পাচ্ছিল। এইসব ছোট-খাটো ব্যাপারও তাকে খুব আনন্দ দিচ্ছে। হলুদে সে যেভাবে সেজেছে, বিউটি ভ্লগাররা সেই মেকাপের লুক ক্রিয়েট করে রিলস বানাচ্ছে। ঠিক উষসীর মতো শাড়ি পরে তার মতোই সাজছে। সে যেই শাড়ি পরেছে সেটা এখন লাখটাকায় বিক্রি করা সম্ভব।

মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে নিজের বিয়ের এতো এতো পাবলিসিটি এবার উষসীর বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম প্রথম বিষয়টা উপভোগ করলেও এখন তার খুব পেইন মনে হয়। সে ঘর থেকে পর্যন্ত বের হতে পারে না। স্কার্ফ দিয়ে মুখ ঢাকতে হয়। নয়তো মানুষ চিনে ফেলে। সেলফি তুলতে ছুটে আসে।

উষসী অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। এভাবে চললে তো তাদের হানিমুনের ছবিও ভাইরাল হয়ে যাবে! ছি, সেলিব্রিটি বলে কি তাদের কোনো প্রাইভেসি নেই?

_______________
ঠিক রাত বারোটা বাজে। ইয়ামিন বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে আছে। তার দৃষ্টি আকাশে। মৃদুমন্দ বাতাস চারদিকে। মেঘের ঘন আস্তরণে ঢাকা পড়েছে চাঁদ। তবুও ওই অন্ধকার আকাশ দেখতে ভালো লাগছে। ইয়ামিনের আকাশ দেখতে কখনোই খারাপ লাগে না। আকাশ আর সমুদ্র তার সবচেয়ে পছন্দের জিনিস। বিশালতার মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়।

ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠল। উষসী লিখেছে, “Happy marriage day to my beloved..”

ইয়ামিন অবাক হয়ে লিখল,” ম্যারেজ ডে মানে?”

” আজ থেকে এক বছর পর আমরা এই দিনেই ম্যারেজ এনিভার্সেরী পালন করব। কখনও ডিলিট করবেন না কিন্তু মেসেজটা আপনার ফোন থেকে। প্রত্যেকবছর আমি দেখতে চাইবো। মনে থাকবে?”

ইয়ামিন ঘড়ির দিকে তাকাল। ক্যালেন্ডার দেখল। কাল সকালেই তাদের বিয়ে। বারোটা বেজে গেছে। তার মানে বলা যায় আজকেই বিয়ে। অথচ ইয়ামিনের মনেও নেই। বিয়ে নিয়ে তার মধ্যে কোনো উৎসাহও নেই। সে শুধু চায় দ্রুত সব ঝামেলা মিটে যাক!

উষসী ভিডিওকল দিল। ইয়ামিন রিসিভ করতেই দুইহাত মেলে হাতের মেহেন্দী দেখালো উষসী। লাজুক মুখে প্রশ্ন করল,” কেমন লাগছে?”

ইয়ামিন নিরস কণ্ঠে বলল,” একবার তো বলেছিই… চমৎকার। আবার কেন জিজ্ঞেস করছো?”

উষসী মনখারাপ করে মনে মনে বলল,” আপনি এতো আনরোমান্টিক? ধূর…”

মুখে বলল,” পার্লারের ওই মেয়েটা আপনার নাম লিখতে ভুলে গেছিল। তাই বাসায় এসে আমিই লিখেছি। দেখুন।”

উষসী তার হাত ক্যামেরার সামনে ধরল। ইয়ামিন অনাগ্রহে উচ্চারণ করল,” ও আচ্ছা।”

উষসী আহত হলো। সে তার হাতের তালুতে লিখেছে,” রাক্ষসমানব।” ভেবেছিল ইয়ামিন এই নিয়ে প্রশ্ন করবে। অথচ সে কোনো প্রশ্নই করল না। আজব!

উষসী যে ছোটবেলায় তাকে ‘রাক্ষসমানব’ বলে ডাকতো এটা নিশ্চয়ই তার মনে নেই।ক্ষণিকের মনখারাপ ভাবটা চট করে মুছে ফেলল উষসী। চঞ্চল কণ্ঠে বলল,” আচ্ছা, কাল সকালে আপনি আমাদের বাড়িতে কখন আসবেন?”

” যখন আসার সময় হবে… আসব।”

” একটু দ্রুত আসবেন প্লিজ… আমার অপেক্ষা করতে একটুও ভালো লাগে না। আর শুনুন, আমার কাজিনরা কিন্তু অবশ্যই আপনার জুতো চুরি করবে। আপনি এক্সট্রা জুতো সাথে নিয়ে আসবেন কিন্তু। তাহলে সবাই চমকে যাবে আর বুঝবে আপনি খুব বুদ্ধিমান। কিন্তু কেউ জানবেই না যে আপনাকে বুদ্ধিটা কে দিয়েছিল। হাহাহা! কি ভাগ্য আপনার বলুন… আমার মতো বুদ্ধিমতী বউ পাচ্ছেন?”

উষসী হাসতে লাগল। ইয়ামিন তাকিয়ে রইল শান্তভাবে। সে নিজের বিয়ে নিয়ে এতোটুকু উত্তেজনা অনুভব করছে না। অথচ উষসীর দুই চোখ ভর্তি উচ্ছ্বাস!

তার এই হাসি, এই সরলতা.. ইয়ামিনের অপরাধবোধ বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে তুলছে। সে অনুভব করছে ব্যথা। উষসীর সাথে অন্যায় হচ্ছে। বিরাট অন্যায়! এটা উচিৎ নয়। ইয়ামিন ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,” এখন রাখি উষসী প্লিজ… আমার ঘুম পাচ্ছে।”

উষসী চোখ বড় করে তাকাল,” সত্যিই আপনার ঘুম পাচ্ছে? আপনি কি মানুষ? আমার তো এক্সায়েটমেন্টে ঘুমই উড়ে গেছে। বিয়ের আগের রাতেও কোন বলদে ঘুমায়?”

ইয়ামিন তাকাতেই উষসী জিভ কেটে বলল,” স্যরি… আপনাকে বলদ বলিনি।”

সে কানে ধরে অনুতপ্ত হওয়ার ভঙ্গি করল। ইয়ামিন নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল,” আমার সত্যিই ঘুম পাচ্ছে।”

” ওকে। গুড নাইট।”

উষসী হতাশ হয়ে ফোন রাখল। ইয়ামিন বড় করে নিশ্বাস ছাড়ল এবার। নাহ, এভাবে চলছে না। উষসীকে সত্যিটা জানাতে হবে।

মিথ্যা দিয়ে সম্পর্ক শুরু করার কোনো মানেই হয় না। কিন্তু সত্যি জানার পর উষসী হয়তো বিয়েটাই করতে চাইবে না। তাতে কি? বিয়ে না হলে আরও ভালো। ইয়ামিন শুধু নিজের মনের এই অশান্তি দূর করতে চায়।

মোবাইলের ভিডিও অন করে ইয়ামিন ক্যামেরা স্ট্যান্ডের সামনে বসল। তার মনের যতরকম কথা ছিল…. সবকিছু সাবলীলভাবে প্রকাশ করতে লাগল। উষ্ণতার ব্যাপারে, নিজের ব্যাপারে, নয়বছরে ঘটে যাওয়া সবকিছুর ব্যাপারে সত্যি স্বীকার করল। তারপর সেই ভিডিও ক্লিপটা উষসীকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালো। কিন্তু এতো দীর্ঘ ভিডিও সেন্ড হচ্ছিল না। তাই ইয়ামিন ফেসবুক থেকে উষসীকে ট্যাগ দিয়ে ভিডিওটা অনলি মি করে আপ্লোড করল। তারপর উষসীর কাছে মেসেজ লিখল,” ফেসবুকে একটা ভিডিও দিয়েছি। আর্জেন্ট। এখনি চেক করো… তারপর সিদ্ধান্ত জানাও। আই এম ওয়েটিং।”

এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। ইয়ামিন দরজা খুলতেই মিসেস শিমলা হাসি মুখে বললেন,” এখনও ঘুমাসনি? ভালোই হয়েছে। তোর সঙ্গে একটা জরুরী ব্যাপার নিয়ে আলাপ করার ছিল, বাবা।”

কথা বলতে বলতে শিমলা বিছানায় এসে বসলেন। তিনি ঠিক করেছেন বরযাত্রী যাওয়ার জন্য ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করবেন। প্রাইভেট কার তো এখন কমন। রাজা-বাদশাদের মতো ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে গেলেই না মনে হবে রাজকীয় বিয়ে!

ইয়ামিন নিজের মনে বলল,” বিয়ে হয় নাকি আগে দেখা যাক। তারপর ঘোড়ার গাড়ির চিন্তা।”

কিন্তু মুখে বলল,” এটা মোটেও ভালো আইডিয়া না। আমাকে ঘোড়ার গাড়িতে দেখলে মানুষ সামনে এগোতেই দিবে না। যদি রাস্তা ব্লক করে ফেলে সেলফি তোলার জন্য?”

শিমলা উচ্চশব্দে হেসে উঠলেন,” সেটাও তো কথা। আমি ভুলেই গেছিলাম আমার ছেলে ফেমাস বয়।”

শিমলা আদর করে ইয়ামিনের নাক টেনে দিলেন।

” তুমি ঘুমাও তো মম। সারাক্ষণ খালি এসব নিয়েই চিন্তা করছো। সকালে কত কাজ, তার উপর তোমার ব্লাড প্রেশার বেড়ে গেলে কি হবে?”

” সেটাও ঠিক। তুইও ঘুমা বাবা। এতো রাত অবধি জেগে থাকলে সুন্দর চেহারাটা নষ্ট হয়ে যাবে না? যদি মুখ থেকে পিম্পল বের হয়? বিয়ের দিন বরের মুখে পিম্পল দেখলে মানুষ কি বলবে?”

শিমলা আবারও হাসছেন। ইয়ামিন মনখারাপ নিয়ে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। বিয়েটা ভেঙে গেলে সবচেয়ে বেশি আঘাত পাবেন মা! তার সব আনন্দে ভাঁটা পড়বে। তবু ইয়ামিন মনকে শক্ত করল। সে উষসীকে কোনো ধোঁকার মধ্যে রাখতে চায় না।

সব জানার পর হয়তো উষসী বিয়ে করতেই চাইবে না। কিন্তু কাউকে ধোঁকা দেওয়ার মতো অপরাধবোধ থেকে অন্তত ইয়ামিন নিস্তার পাবে।

শিমলা চলে যাওয়ার সাথে সাথেই ইয়ামিন মেসেজ চেক করল। কিন্তু উষসী অনলাইনে নেই। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ইয়ামিন আর ফোন করতে গেল না। সকালে উঠেই না হয় দেখবে। এটা ভেবে সেও নিশ্চিন্তে ঘুমাতে গেল। কিন্তু সকালেও উষসীর কোনো মেসেজ এলো না।

অনেকক্ষণ ধরে ইয়ামিন অপেক্ষা করল। শিমলা তাগাদা দিয়ে ইয়ামিনকে গোসলে পাঠালেন। বরযাত্রী যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। বাতাসের গতিতে যেন সময় এগোচ্ছে।

ইয়ামিন অগত্যা শেরোয়ানি পরে তৈরী হলো। তার মন এখনও বলছে, বিয়েটা হবে না। কিন্তু উষসীর কোনো খোঁজই নেই। মিনিটে মিনিটে যেই মেয়ে ফোন করে সে সকাল থেকে একটা মেসেজ পর্যন্ত দেয়নি। ব্যাপারটা অদ্ভুত। আচ্ছা, ভিডিওটা দেখার পর সে আবার কান্নাকাটি করছে না তো?

বাধ্য হয়ে ইয়ামিন নিজেই ফোন করল উষসীকে। কিন্তু উষসীর ফোন রিসিভ করল অনুপমা,” হ্যালো।”

” হ্যালো, আপু উষসী আছে?”

অনুপমা ফিক করে হেসে উঠল। ইয়ামিন ধৈর্য্য ধরতে পারছে না। উষসী কোথায়? অনুপমা কেন তার ফোন ধরল? সেদিনের মতো ঔষধ খায়নি তো আবার? তাহলে তো অনুপমা এভাবে হাসতো না। উফ, কি টেনশন!

অনুপমা বলল,” পার্লারে আছে। খুব ব্যস্ত সে এখন। কথা বলা যাবে না। যা বলার আমাকে বলো। আমি মেসেজ ডেলিভারি করে দিবো।”

ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তার মানে উষসী এখনও ভিডিও দেখেনি। সে বলল,” থাক, আমিই পরে কথা বলে নিবো।”

অনুপমা ঠাট্টার স্বরে বলল,” বুঝেছি… পারসোনাল টকিং তাই না? সমস্যা নেই। এখানেই তো আসছো। দেখা হলেই কথা বলে নিও।”

কিন্তু উষসীকে এরপর একবারের জন্যেও একা পাওয়া গেল না। বিয়ের স্টেজ সাজানো হয়েছে বাড়ির বাগানে। বাড়ি ভর্তি মেহমান। গান-বাজনা, হৈ-হুল্লোড়, চিৎকার-চেঁচামেচিতে গিজগিজ করছে সারাবাড়ি।

ইয়ামিন সুযোগ খুঁজছিল উষসীকে একবার একা পাওয়ার। কিন্তু বিয়ে বাড়িতে সবার নজর শুধু বউয়ের দিকেই থাকে। তাই উষসীকে কেউ একা ছাড়ছিল না।

তবুও এক পর্যায় সুযোগ পাওয়া গেল। উষসী বাথরুমে যাওয়ার জন্য যখন করিডোর দিয়ে যাচ্ছিল তখন ইয়ামিন দৌড়ে এসে তার হাত ধরে তাকে একটা কোণায় নিয়ে এলো। হঠাৎ তার এমন আচরণে উষসী লজ্জায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। সংকোচ মেশানো গলায় বলল,” কি করছেন এসব? কেউ দেখলে কি বলবে?”

ইয়ামিন হাঁপাতে হাঁপাতে প্রশ্ন করল,” ভিডিওটা দেখেছো?”

” কিসের ভিডিও?”

” কালরাতে পাঠিয়েছিলাম।”

” আমি সকাল থেকে একবারও অনলাইনে যাইনি। আসলে নিজের বিয়েতে এতো ব্যস্ত যে সময়ই পাচ্ছি না। কিসের ভিডিও ওটা?”

” উফ… উষসী দ্রুত ওই ভিডিওটা দেখো প্লিজ। ইটস ভেরি আর্জেন্ট।”

ইয়ামিন আর কিছু বলতে পারল না। উষসীর কাজিনরা এসে ভীড় জমিয়েছে। তাদের এই অবস্থায় দেখে সবাই মজা নেওয়ার উদ্দেশ্যে নানান কথা বলতে লাগল। কেউ কেউ ছবি তুলছে। উষসী লজ্জায় মুখ লুকানোয় ব্যস্ত হলো আর ইয়ামিন বিরক্তিতে!

_________________
স্টেজে তাদের একসাথে বসিয়ে ছবি তোলার সময়ও ইয়ামিন ভিডিওর ব্যাপারে প্রশ্ন করল। ক্যামেরাম্যান বিভিন্ন পোজ দেখাচ্ছেন। অনেকরকম এংগেল থেকে ছবি তুলছেন। ইয়ামিন এই ফাঁকে ফিসফিস করে বলল,” তুমি কি ভিডিওটা দেখেছো উষসী?”

চারদিকে এতো গান-বাজনার আওয়াজ যে উষসী কিছু শুনল না।

” হুম? কি বললেন?”

” ভিডিওর কথা বলছি।”

“কোন ভিডিও?”

” আরে সকালে বলেছিলাম যে… মনে নেই?”

” ও ওইটা? হ্যাঁ দেখেছি।”

ইয়ামিন বিস্মিত কণ্ঠে বলল,” তারপর?”

” তারপর আর কি?”

” মানে তুমি পুরোটা দেখেছো? কিছু বুঝেছো?”

” বুঝবো না কেন? অনেক ফানি ছিল।”

ইয়ামিন আশ্চর্য হয়ে বলল,” ফানি মানে? এটা আমাদের সারা জীবনের প্রশ্ন। আর তোমার কাছে ফান মনে হচ্ছে?”

উষসী হাসতে হাসতে বলল,” এতো সিরিয়াস হচ্ছেন কেন? এই যুগে এসব কোনো ব্যাপারই না। আরও কত হচ্ছে!”

স্টেজ থেকে নেমে বান্ধবীদের সাথে ছবি তুলতে গেল উষসী। ইয়ামিন বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে তখনও। মেয়েটা পাগল নাকি?

খাবার টেবিলে সবার মাঝখানে এই বিষয়ে কথা বলা সম্ভব না। উষ্ণতা যখন উষসীর পাশে বসতে গেল তখন ইয়ামিন ছুটে এসে বাগড়া দিয়ে বলল,” আমি এখানে বসি?”

সবার মুখে একটা চাপা হাসি খেলে গেল। উষ্ণতা খানিক বিব্রত হয়ে বলল,” তোমার প্লেট তো ওদিকে সাজানো হয়েছে। তোমার বন্ধুদের সাথে।”

অনুপমা বলল,” এটা তো আমাদের ভুল হয়ে গেল, তাই না ভাবী? বর আর বউকে একসাথে বসতে দেওয়া উচিৎ ছিল। চিন্তা কোরো না ইয়ামিন, তুমি এখানেই বসো। আমি তোমার প্লেট এনে দিচ্ছি।”

ইয়ামিন বলল,” জ্বী, প্লিজ। এটা করলেই ভালো হয়।”

সবাই এবার জোরেই হাসতে লাগল। একজন মুরব্বি তো বলেই বসলেন,” এমন বউপাগল বর হওয়াই তো ভালো।”

উষসীর মুখ আলতারাঙা হয়ে উঠল। ইয়ামিন আজ এমন কেন করছে সবার সামনে? খেতে বসার পর সে আবারও ফিসফিস করে বলল,” এতো ইজিলি কিভাবে মেনে নিচ্ছো সব?”

উষসী অবাক হয়ে তাকাল,”মানে? কি মেনে নিচ্ছি?”

” ভিডিওর কথা বলছি।”

” আপনি এখনও ওই ভিডিও নিয়ে পড়ে আছেন? উফ, আচ্ছা মেনে না নিয়ে উপায় কি বলুন? আমি না মানলেই কি মানুষ ট্রল করা থামিয়ে দিবে?”

” কিসের ট্রল? আমি কি বলছি আর তুমি কি বলছো?” ইয়ামিন হতভম্ব।

উষসী বলল,” আপনি ওই রোস্টিং ভিডিওটার কথা বলছেন না? আপনার আর আমার বিয়ে নিয়ে যে তৈরী হলো?”

ইয়ামিনের বিরক্তির মাত্রা চরমে পৌঁছে গেল এবার। ক্ষীপ্ত হয়ে বলল,” ড্যামেট… এসব স্টুপিড ভিডিওর কথা কেন বলব? তোমাকে কালরাতে আমি একটা ভিডিও পাঠিয়েছিলাম। সেটা দেখেছো কি-না? ”

” আপনি আমাকে আবার কখন ভিডিও পাঠালেন?”

” তার মানে তুমি এখনও দেখোনি?”

” আচ্ছা…চেক করব পরে।”

উষ্ণতা দুষ্টমি করে বলল,” খাওয়ার সময় এতো ফিসফিস করতে হয় না। গল্প করার জন্য সারারাত পড়ে আছে!”

টেবিল জুড়ে হাসির রোল পড়ে গেল। আবারও উষসী লজ্জায় আড়ষ্ট। ইয়ামিন বিরক্ত!

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ইয়ামিনের সব বন্ধুরা স্টেজে উঠে আড্ডা দিচ্ছে। কাজী সাহেব এখনও আসেননি। এতো দেরি হচ্ছে কেন কেউ বুঝতে পারছে না। কিন্তু ইয়ামিনের জন্য এটাই ভালো। কবুল বলার আগেই উষসীর ভিডিওটা দেখে ফেলার উচিৎ। কিন্তু তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না কেন? ইয়ামিন স্টেজের কাছে গিয়ে বলল,” উষসী কোথায়?”

সোহানা উত্তর দিল,”আমরা এখানে বসে তোর বউয়ের নজরদারি করছি নাকি? নিজে খুঁজে দ্যাখ।”

ইয়ামিন চলে যেতে নিলেই ফাহিম ডাকল,” এই বউ পাগলা, এদিকে আয়। তুই কি? এতোবছর পর দেখা হলো অথচ আমাদের সাথে একবারও বসছিস না। খাওয়ার সময়ও বউয়ের সাথে। মানুষ তো বিয়ের পর বদলায়, তুই দেখি বিয়ের আগে থেকেই বদলে গেছিস।”

সোহানা টিপ্পনী কেটে বলল,” বাদ দে৷ ও এখন পুরোপুরি জরুকা গোলাম।”

সবাই হাসল। ইয়ামিন চোয়াল শক্ত করে বলল,” উষসীর সাথে আমার খুব জরুরী দরকার আছে। সেজন্যই খুঁজছি। কথা শেষ হলেই তোদের কাছে আসব।”

অভিমান করে অরণ্য বলল,” থাক, তোকে আর আসতে হবে না। বউয়ের কাছেই থাক।”

সোহানা বলল,” হুম সেটাই। এমনিতেও আমাদের তুই ভুলে গেছিস।”

ইয়ামিন হেসে বলল,” তোদের আমি কিভাবে ভুলি, বল?”

“আরিশা যে এবসেন্ট সেটা একবারও খেয়াল করেছিস?”

ইয়ামিন চুপ হয়ে গেল। আরিশা তার বিয়েতে আসবে না এটা সে আগেই জানতো। তাই এই ব্যাপারে অবাক হওয়ার কিছু নেই। হঠাৎ উষসীকে দেখতে পেয়ে ইয়ামিন সেদিকে চলে গেল।

মিসেস শিমলা মাঝপথে তাকে থামিয়ে বললেন,” কোথায় কোথায় থাকিস বাবা? চেহারা ঘেমে কি অবস্থা হয়েছে! বেশি গরম লাগছে? চল এসির নিচে বসবি।”

ইয়ামিন ভাবল এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর হয় না। সে সবার সামনেই বলে ফেলল,” উষসীকেও নিয়ে যাই?”

সবাই চোখ বড় করে তাকালেন। শিমলা হাত দিয়ে ছেলের বাহুতে চাপড় মেরে চাপা স্বরে বললেন,” নির্লজ্জ!”

সবাই হাসতে শুরু করেছে। অনুপমা বিড়বিড় করে বলল,” এতো তাড়া কিসের? সবুর করো না ভাই। রাত তো পড়েই আছে।”

উষ্ণতা অনুর কাঁধ চেপে ধরে উচ্চারণ করল,” ধূর, তুমিও কম না।”

উষসী লজ্জায় মাথা তুলতে তাকাতে পারছে না। ইয়ামিন ইতস্তত করে বলল,” আসলে উষসীর সাথে আমার একটু জরুরী দরকার আছে।”

অনুপমা বলল,” হুম.. কি জরুরী দরকার সেটা আমরা বুঝি…”

উষসী হাত দিয়ে চোখ ঢাকল। ইয়ামিন নির্বিকার। সে উষসীর হাত ধরে অবলীলায় বলল,” প্লিজ একটু এদিকে এসো।”

মেহমানরা রসিকতার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। উষসীর কাজিন দুষ্টমি করে বলল,” আহারে, বেচারার মনে হয় ধৈর্য্য কুলাচ্ছে না। যা একটু।”

উষসী চোখ বড় করে চারপাশে তাকাল। ফিসফিস করে বলল,” প্লিজ…সবাই কি ভাববে?”

ইয়ামিন কর্ণপাত করল না। উষসীকে টেনে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল৷ তৃষাণ এইসব দেখে রাগান্বিত স্বরে বলল,”ম্যানারলেস ছেলে-মেয়ে। কোনো কমন সেন্স নেই।”

লজ্জায় মাথা হেঁট করে উষসী বিছানায় বসল। ইয়ামিন অস্থিরচিত্তে বলল,” ভিডিও দেখেছো?”

উষসী অবাক না হয়ে পারল না,” আপনি এই প্রশ্ন করার জন্য আমাকে সবার সামনে থেকে তুলে এনেছেন?”

” তুমি বুঝতে পারছো না যে ব্যাপারটা কত ইম্পোর্ট্যান্ট। এটলিস্ট কবুল বলার আগে তোমার এটা দেখা উচিৎ। ”

” কবুল বলার পরে দেখলে কি হবে?”

ইয়ামিন গরম দৃষ্টিতে তাকাল,”এটা কোনো মজা না।”

উষসী হেসে বলল,” ওকে বাবা, কাম ডাউন। আমি দেখছি।”

উষসী তার মোবাইল বের করল। কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপে কোনো ভিডিও পাওয়া গেল না।

” কোথায় আপনার ভিডিও?”

” এখানে না, মেসেঞ্জারে দেখো। মানে ফেসবুকে।”

উষসী তার কপাল চেপে ধরল। ইয়ামিন তার হাত টেনে উদগ্রীব কণ্ঠে বলল,” কি হয়েছে?”

” উফ, ছাড়ুন। হাতে ব্যথা লাগছে। একটা ভিডিওর জন্য এমন করতে হয়? আমি ভিডিও দেখতে পারব না।”

” কেন?”

উষসী মাথায় হাত রেখে বলল,” কপাল! আমি তো এক সপ্তাহ ধরে আমার আইডিতেই ঢুকতে পারছি না। তৃষাণ ভাইয়া আমার ফোন ভেঙে ফেলেছিল। তারপর ফেসবুক, জিমেইল, সবকিছুর পাসওয়ার্ড ভুলে গেছি। আর রিসেট করাও হয়নি। ভিডিওটা কি বেশি আর্জেন্ট ছিল?”

ইয়ামিন হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মাথার পাগড়ি খুলে ফেলল। মুহূর্তেই তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। উষসী তার পাশে এসে বলল,” আই এম স্যরি। আপনি আমাকে আগে বলবেন না? আচ্ছা আপনার ফোনে নিশ্চয়ই ভিডিওটা আছে… এখনি দেখব দিন।”

ইয়ামিন নিরস কণ্ঠে বলল,” দরকার নেই।”

” কেন দরকার নেই? আপনার কাছে যখন ভিডিওটা এতোই ইম্পোর্ট্যান্ট তখন দেখি আমি….”

” কোনো জরুরী ভিডিও না… এমনি। টাইম ওয়েস্ট।”

ইয়ামিন এই কথা বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। উষসী ঠোঁট উল্টে বলল,” অদ্ভুত! ”

এই ঘটনার পর থেকেই ইয়ামিনের আচরণ খুব বদলে গেল। সে খুব শান্ত হয়ে গেল। কারো সাথে কথা বলল না। কেমন নিষ্প্রভ একটা ভাব। সে প্রচন্ড সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে লাগল।

বিয়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইয়ামিন আর উষসী বরাবর বসেছে। খিলখিল করে প্রতিটি কথায় হাসছে উষসী। এমন হাসি-খুশি আর প্রাণচঞ্চল বধূ বিয়ে বাড়িতে কমই দেখা যায়। ইয়ামিন নিষ্পলক উষসীর দিকে তাকিয়ে আছে।

তার দমবন্ধকর কষ্ট হচ্ছে। এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো, সে বিরাট ভুল করে ফেলেছে। উষসীর মুখের দিকে তাকাতেই নিজেকে নিকৃষ্ট অপরাধী মনে হচ্ছে। এই মেয়েটিকে সে কিভাবে ভালো রাখবে? তাকে দেওয়ার মতো ইয়ামিনের কাছে কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই। না মন আর না ভালোবাসা!

সারাজীবন অভিনয় করে কাটানো কি সম্ভব? ইয়ামিন যদি ক্লান্ত হয়ে যায়? তার জীবনটা বিরাট এক নাট্যশালা হয়ে যায়নি তো? যেখানে তার কাজ শুধু ভালোবাসার অভিনয় করে যাওয়া!

কাজী সাহেব কাগজপত্র ঠিক করছিলেন এমন অবস্থায় ইয়ামিন হঠাৎ উঠে বলল,” আমি উষসীর সাথে আলাদা কথা বলতে চাই।”

ইয়ামিনের আচরণ দেখে বিয়ে বাড়িতে হাসির রোল পড়ে গেল এবার। এমন অদ্ভুত বর বোধ হয় কেউ দেখেনি। একটু পর পর যে শুধু বউয়ের সাথে আলাদা করে কথা বলতে চায়! একজন মুরব্বি বললেন,” শান্ত হও বাবা। আর মাত্র কয়েক মিনিট পরেই তোমাদের বিয়ে হয়ে যাবে। তারপর সারাজীবন তো আলাদাই কথা বলবে।”

হাসির শব্দ বৃদ্ধি পেল। উষসী লজ্জায় মুখ চেপে ধরে আছে। কিন্তু ইয়ামিন ঘামছে। ডোনা বললেন,” বসো বাবা। শুভকাজে বাগড়া দিতে হয় না। বিয়ে মিটে গেলে তোমাদের আলাদা ঘরে পাঠানো হবে। তখন যত ইচ্ছা কথা বলে নিও।”

যুথিও একই কথা বললেন। সবার অনুরোধ রক্ষার্থে ইয়ামিন বসতে বাধ্য হলো। তারপর তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল… তাদের বিয়েটা হয়ে গেল। এই ভুল শোধরানোর এখন আর কোনো উপায় নেই। ইয়ামিনের মনে হচ্ছে…জীবনের চলার পথ যেন আগের চেয়ে অনেকটা কঠিন হয়ে গেল।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে