আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-২৬+২৭

0
563

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ২৬
লিখা- Sidratul Muntaz

সকাল থেকে তৃষাণ উষ্ণতার সাথে কথা বলছে না। উষ্ণতারও এই বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে মনের সুখে ব্রেকফাস্ট বানালো। তৃষ্ণাকে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি করালো। ব্রেকফাস্টের সময় টেবিলে খাবার দিলে তৃষাণ নিজেও খেল না আর তৃষ্ণাকেও বলল,” চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে। আজকে আমরা বাইরে খাবো, বাবা। বাড়ির খাবার পঁচা।”

তৃষ্ণা অবাক হয়ে বলল,” এতোদিন তো তুমি বলতে বাড়ির খাবার ভালো আর বাইরের খাবারে অসুখ হয়।”

উষ্ণতা কোমরে হাত গুঁজে বলল,” সমস্যা কি তোমার? ছেলেকে এসব কি শেখাচ্ছো? তোমার খেতে ইচ্ছে না করলে বের হয়ে যাও। আমার ছেলে আমার সাথে খাবে। ওকে আমি বাইরে খেতে দিবো না।”

তৃষাণ উষ্ণতার কথার কোনো জবাব না দিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল,” চলো বাবা।”

তৃষ্ণা ভয় ভয় দৃষ্টি নিয়ে মায়ের দিকে তাকাল। এখন কি আবারও ঝগড়া শুরু হবে? সে বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখতে দেখতে ক্লান্ত। উষ্ণতা বলল,” ওকে স্কুলে আমি পৌঁছে দিবো। তোমার লেইট হলে তুমি চলে যেতে পারো।”

তৃষাণ এবারও কোনো কথা বলল না। চুপচাপ জুতো পরতে লাগল। তৃষ্ণা অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। একবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার বাবার দিকে। উষ্ণতা আদুরে কণ্ঠে বলল,” তৃষ্ণা, খেতে বসো বাবা।”

” আমার স্কুলে ক্লাস শুরু হতে আর মাত্র বিশমিনিট বাকি। এরপর গেইট লাগিয়ে দিবে। তোমার সাথে গেলে আমার লেইট হয়ে যাবে।”

” আমার সাথে গেলে লেইট হবে কেন?”

” তুমি রেডি হতে অনেক সময় নাও। এর মধ্যে আমি চারবার পাপার সাথে স্কুলে চলে যেতে পারব।”

উষ্ণতা ছেলের মুখে এমন কথা শুনে অপমানে হতভম্ব হয়ে গেল। তৃষাণ মৃদু হাসছে। ছেলের কথায় যেন সে খুব মজা পেয়েছে। উষ্ণতা রোষাবিষ্ট কণ্ঠে বলল,” এইসব শেখাচ্ছো তুমি ছেলেকে? তোমার সমস্যা কি?”

তৃষ্ণা এবার বলল,” আমি কি কিছু দেখি না? পাপা কেন শেখাবে? তোমার তো ড্রেস সিলেক্ট করতেই একঘণ্টা লাগে।”

উষ্ণতা ধমক মেরে বলল,” এতোই যখন প্রবলেম, যা তুই তোর বাপের সাথে। আমার এতো গরজ নেই যে সকালে উঠে তোর জন্য ব্রেকফাস্ট বানাবো, তোকে স্কুলেও দিয়ে আসবো আবার তোর চটাং চটাং কথাও শুনবো। যত্তসব!”

অনুপমা প্রায় দৌড়ে এলো। তাকে এমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে যে উষ্ণতা একটু ঘাবড়েই গেল,” কি হয়েছে অনু?”

” উষু… উষু…” অনুপমা কথাই বলতে পারছে না। খুব হাঁপাচ্ছে। তৃষাণ বলল,” রিল্যাক্স… আগে একটু দম নাও তারপর কথা বলো। কি হয়েছে?”

” একঘণ্টা ধরে দরজা ধাক্কাচ্ছি ভাইজান। কিন্তু উষু তো দরজা খুলছে না। আমি নিশ্চিত ভেতরে কিছু একটা হয়েছে। মেয়ের কোনো সাড়া নেই।”

এই কথার পর সবার চেহারায় একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। যদিও যুথি এবং তৃষাণ উষসীর উপর মারাত্মক রেগে আছে। কিন্তু এবার তারাও ভয় পেয়ে গেল।

অনেক দরজা ধাক্কানোর পরেও ভেতর থেকে কোনো সাড়া নেই। বাধ্য হয়ে তৃষাণ আর আহমেদ দরজার লক ভাঙল। সবাই ভেতরে গিয়ে দেখল উষসী বিছানায় এলোমেলো অবস্থায় শুয়ে আছে। তার কোনো হুশ নেই।

উষ্ণতা এই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে উঠল। তৃষাণ দেখল উষসীর বিছানার পাশে ঔষধের বক্স। প্রচন্ড ঘাবড়ে গিয়ে সে উচ্চারণ করল,” ও মাই গড!”

অনুপমা বলল,” কি হয়েছে ভাইজান?”

তৃষাণ যন্ত্রের মতো আওড়াল,’ মায়ের ঔষধের বক্স এখানে কেন? গতকালই আমি ঔষধ এনেছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে আমার। এখানে প্রায় দশটার মতো ট্যাবলেট মিসিং।”

যুথি এই কথা শুনে শব্দ করে কাঁদতে লাগল। ডোনা চেঁচিয়ে বলল,” আমি আগেই বলেছিলাম মেয়েটাকে জোর করার কোনো দরকার নেই৷ তোদের জন্য এসব হয়েছে। কি দরকার ছিল না বলে-কয়ে ইমনদের নিয়ে আসার?”

উষ্ণতা আক্ষেপ করে বলল,” বিয়েটা তো ভেঙে গেছিল। তবুও উষু এমন কেন করল?”

যুথি বলল,” আমার জন্য হয়েছে সব। গতরাতে রাগের মাথায় মেয়েটাকে কতকিছু বলে ফেলেছি। আর এখন এসব কি হয়ে গেল? হায় আল্লাহ! মেয়েটা যে এতো অভিমানী তা আমি আগে বুঝিনি।”

তৃষাণ কাঁপা হাতে উষসীর পালস রেট চেক করল। তারপর লম্বা শ্বাস টেনে বলল,” রিল্যাক্স হও সবাই। আমি এখনি এম্বুলেন্স ডাকছি। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

উষ্ণতার হঠাৎ মনে পড়ল ইয়ামিনের কথা। উষসীর পড়ার টেবিলে একটা ছোট্ট গিটার আর ইয়ামিনের অনেকগুলো ছবি লাগানো। সেটা দেখেই মনে পড়ল ইয়ামিনকে জানাতে হবে। তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু হয়েছিল নাহলে উষসী এমন একটা স্টেপ কেন নিবে?

তখন সকাল সাড়ে নয়টা বাজছে। ইয়ামিন মর্ণিং ওয়াক থেকে এসে গোসল সেরে নিয়েছে। এখন মাত্র ব্রেকফাস্টে বসবে। মিসেস শিমলা পরম স্নেহে ছেলের জন্য খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। ইয়ামিন অভিযোগের স্বরে বলল,” প্রবলেম কি মা? তোমাকে একবার না বলেছি আমি পরোটা খাবো না? শুধু টোস্ট দাও।”

শিমলা আহত কণ্ঠে বললেন,” ছোটবেলায় তুই পরোটা খেতে কত ভালোবাসতি। একদম তোর পছন্দ মতো বানিয়েছি। একটু খেয়ে দ্যাখ না বাবা।”

ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। মা বোঝে না যে সে আর আগের মতো নেই। এখন তার নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে খুব সচেতন থাকতে হয়। পরোটা, বিরিয়ানি, পোলাওয়ের মতো ভারী খাবার তার জন্য বিষাক্ত! কিন্তু মাকে খুশি করার জন্য জোর করে খেতে হয়। তাছাড়া সে এখানে থাকবেই আর ক’দিন? দুইদিন পরেই আবার চলে যেতে হবে মুম্বাই।

ইয়ামিন খাবার মুখে তুলবে ঠিক এমন সময় উষ্ণতার ফোন আসে। ইয়ামিন মায়ের সামনে কথা বলতে পারবে না সেজন্য উঠতে নিলেই শিমলা ছেলের হাত ধরে বললেন,” উফ, এখন রাখতো। খবরদার ফোন ধরবি না। আগে খাওয়া শেষ কর।”

ইয়ামিন বলল,” ইমারজেন্সী কল মা। ধরতেই হবে।”

শিমলা বেশ বিরক্ত হলেন। কি এমন ইমারজেন্সী যে ধরতেই হবে! কিন্তু ইয়ামিনের জীবনে তো উষ্ণতার চেয়ে বড় ইমারজেন্সী আর কিছু নেই।

” হ্যালো মিস।”

” ইয়ামিন কোথায় তুমি? দ্রুত বাসায় আসো?”

উষ্ণতার বিচলিত কণ্ঠ ইয়ামিনকে অস্থির করে তুললো। উৎকণ্ঠায় উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল সে,” কি হয়েছে মিস?”

উষ্ণতা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,” উষসী সুইসাইড এটেম্পট করেছে। ”

” হোয়াট?”

” হ্যাঁ। ওকে এখন আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। তৃষাণ গেছে এম্বুলেন্স ডাকতে। তুমি যত দ্রুত পারো চলে এসো।”

” কিন্তু ও এমন একটা কাজ কেন করল? কাল তো সব ঠিক হয়ে গেছিল৷ তাই না?”

” সেটাই তো আমি ভাবছি। ও এমন কেন করবে? আচ্ছা, তোমাদের মধ্যে আবার কিছু হয়নি তো?”

ইয়ামিন এই প্রশ্ন শুনে অবাক হলো। তাদের মধ্যে আবার কি হবে? উষ্ণতা তাড়াহুড়ো করে বলল,” আচ্ছা যাইহোক, তুমি আসো। আমি রাখছি।”

ইয়ামিন ঘরোয়া পোশাক বদলে দ্রুত তৈরী হয়ে নিল। তাকে বের হতে দেখে মিসেস শিমলা দৌড়ে এলেন,” আরে, আরে, কোথায় যাচ্ছিস?”

” কাজ আছে মা। এখনি যেতে হবে।”

” মানে? এখানে তোর কি কাজ? কোথায় যাচ্ছিস?”

” ফিরে এসে সব বলব। এখন বলারও সময় নেই।”

ইয়ামিন বের হয়ে গেল। মিসেস শিমলা বিস্ময় নিয়ে ছেলের চলে যাওয়া দেখলেন। ইদানীং ইয়ামিন এতো অদ্ভুত আচরণ কেন করছে?

এম্বুলেন্স ডাকা হলো। উষসীকে অচেতন অবস্থায় এম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে। এমন সময় ইয়ামিন হাজির হলো। তাকে দেখে তৃষাণের রুক্ষ মেজাজ আরও রুক্ষ হয়ে গেল। ক্ষীপ্ত হয়ে সে বলল,” এটাকে কে খবর দিয়েছে?”

অনুপমা ভীত কণ্ঠে বলল,” উষ্ণতা ভাবী।”

তৃষাণ রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালালো। উষ্ণতা আজ-কাল তার কোনো কথাই শুনছে না। সে ঠিক সেটাই করবে যাতে তৃষাণ সবচেয়ে বিরক্ত হয়। উষ্ণতা ইয়ামিনকে দেখে আনন্দিত কণ্ঠে বলল,” তুমি এসে গেছো? থ্যাঙ্কিউ এতো দ্রুত আসার জন্য।”

ইয়ামিন হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইল। সে এই প্রথমবার উষসীর ঘরে এসেছে। চারদিকে নিজের ছবি, গিটার, মিউজিক ইন্স্ট্রুমেন্টস দেখে সে প্রস্তুরীভূত। সবাই বের হয়ে যাওয়ার পরেও ইয়ামিন সেই ঘরে একা দাঁড়িয়ে রইল। উষসীর পড়ার টেবিলের কাছে যেতেই একটা ফটো ফ্রেম নজরে এলো। একটা ফ্রেমে উষসীর নিজের ছবি, অন্য ফ্রেমে ইয়ামিনের ছবি। ফ্রেমটা হাতে নিয়ে ইয়ামিনের হাত কাঁপতে লাগল। এমন পাগলামি আটবছর আগে সেও করেছিল। উষ্ণতার ছবি এঁকে নিজের ঘর ভরে ফেলেছিল।

” ইয়ামিন।”

উষ্ণতার ডাকে ইয়ামিনের হুশ ফিরল। দ্রুত ফটো ফ্রেমটা রাখতে নিয়ে শেলফ থেকে ভুল করে একটা ডায়েরী ফেলে দিল সে। সেই ডায়েরী থেকে বের হয়ে এলো একটা লকেট। বেশ পুরনো জিনিসটা। কিন্তু ইয়ামিন চিনতে ভুল করল না। আটবছর আগে এই লকেট সবসময় তার গলায় থাকতো। উষসী একদিন এটা ছিঁড়ে ফেলেছিল। তারপর বলেছিল জিনিসটা সে ঠিক করে আনবে।

ইয়ামিন লকেটটা তুলে ডায়েরীতে রেখে দিতে নিলেই ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ল কতগুলো গোলাপের পাপড়ি৷ সেই সাথে একটা চিরকুট। ইয়ামিনের লেখা- ভালো থেকো।

এই চিরকুট দেখার পর ইয়ামিনের বুঝতে বাকি নেই যে ফুলের পাপড়িগুলো তার বুকেটের। সেই দিল্লীতে রেখে যাওয়া বুকেট আর চিরকুট। এগুলো সে উষ্ণতার উদ্দেশ্যে রেখে গিয়েছিল। যদিও সে জানতো যে এগুলো উষ্ণতা কখনও পাবে না। পেলেও তার কাছে এসবের কোনো মূল্য থাকবে না। কিন্তু উষসী যে সবকিছু এতো যত্ন করে তুলে রাখবে তা কে জানতো? ইয়ামিন তার নিজের ছোটবেলার একটা ছবিও পেল। রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। ছবির পেছনে উষসী লিখে রেখেছে,” আমার রাক্ষসমানব,

তার বড় বড় ওই আগুনের চোখে তাকানোই ভুল।

আমার মনে তবু কেন ঝরে ফাগুনের ফুল? ”

এটা দেখার পর ইয়ামিন হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছিল না।

উষ্ণতা ইয়ামিনকে ডাকতে ডাকতে পুনরায় ঘরে ঢুকেছে তখন। ইয়ামিনকে সে দেখে বলল,” তুমি এখনও দাঁড়িয়ে আছো? কি করছো?”

ইয়ামিন তার হাতের ডায়েরী দ্রুত ভাঁজ করে রেখে দিল। উষ্ণতা এই দৃশ্য দেখে মৃদু হাসল। ইয়ামিনের কাঁধে হাত রেখে বলল,” উষসী কেন এমন করল ইয়ামিন? তোমাদের মধ্যে কি ঝগড়া হয়েছিল?”

ইয়ামিন আশ্চর্য হলো। সে কি করে জানবে উষসী কেন এমন করেছে? আর তাদের মধ্যে ঝগড়া হবেই বা কেন? বিস্মিত গলায় বলল,” আমাদের মধ্যে তো কিছুই হয়নি।”

” তাহলে? রাতেও সে এতো খুশি ছিল। হঠাৎ কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। তুমি চলে যাওয়ার পর ও ঘর থেকে একবারও বের হয়নি। তারপর সকালে এই কান্ড… তোমার সাথে ওর লাস্ট কবে কথা হয়েছিল?”

ইয়ামিন মনে করার চেষ্টা করল। উষসী তার কথার জবাব না দিয়ে মুখের উপর দরজা আটকে দিয়েছিল। তারপর তো তাদের আর দেখাও হয়নি। পর মুহূর্তেই তার মনে হলো… উষসী কি কোনো কারণে তার জন্যই এমন করেছে? এই কথা মনে হতেই অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে এলো শরীর। এটা অসম্ভব। যদি সত্যি এরকম কিছু হয় তাহলে ইয়ামিন আর কখনও উষসীর সামনে যাবে না।

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ২৭
লিখা- Sidratul Muntaz

হাসপাতাল থেকে সুস্থভাবেই উষসী বাড়ি ফিরেছিল। কিন্তু এরপর থেকে সে কেমন বদলে গেছে। প্রথমদিকে খুব মনমরা থাকতো। কিন্তু আজ-কাল সে খুব বেশি কথা বলে। অকারণেই হাসে। একটা সাধারণ ঘটনা নিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মাতামাতি করে। তার এমন অস্বাভাবিক আচরণ সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে।

সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, উষসী যেদিন হাসপাতালে ছিল সেদিন তার জ্ঞান ফেরার কিছুসময় পরেই ইয়ামিন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। একবারের জন্যেও উষসীর সাথে দেখা করতে কেবিনে যায়নি সে। তাদের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্কের ব্যাপারে তারা নিজেরাই স্বীকার করেছিল। কিন্তু তাদের ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল যেন কখনোই কিছু ছিল না তাদের মাঝে। কেউ উষসীকে জোর দিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাও করেনি এই ব্যাপারে। তাকে নিজের মতো ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

ইয়ামিনেরও কোনো খোঁজ নেই। উষ্ণতা বুঝতে পারছে যে তাদের মধ্যে বড় কোনো ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এবার সে ঠিক করেছে আর তাদের মাঝে ঢুকবে না। তারা নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেরাই করুক। সে আগ বাড়িয়ে কিছু করতে গেলে অযথাই তৃষাণের সাথে ঝগড়া হবে। উষ্ণতা তার সংসারের অশান্তি আর বাড়াতে চায় না। কিন্তু প্রিয় ছোটবোনের মনের অশান্তিও তাকে ভীষণভাবে পীড়া দিচ্ছে। আর কেউ না বুঝলেও উষ্ণতা ঠিকই বুঝে উষসীর হাসি মুখের আড়ালে তীব্র ব্যথা লুকিয়ে আছে। যেটা সে প্রকাশ করছে না।

গতরাতে উষ্ণতার ঘুম আসছিল না। সে গল্প করার জন্য উষসীর ঘরে গেছিল। তখন জানালা দিয়ে দেখল উষসী মেঝেতে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে। কান্নার দমকে পুরো শরীর কাঁপছে তার। দুই হাতে মাথা চেপে সে নিজেকে সামলাতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। এই অবস্থা দেখে উষ্ণতা হতভম্ব। সাবধানে উষসীর ঘরের দরজায় টোকা মারল সে।

উষসী কান্না থামিয়ে কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে প্রশ্ন করল,” কে?”

” উষু আমি। দরজা খোল।”

উষসী চটজলদি বিছানায় উঠে মুখে বালিশ চেপে ধরে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল,” শুয়ে পড়েছি আপু। সকালে এসো। এখন যাও।”

উষ্ণতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তার ছোটবোন কবে থেকে এতো অভিনয় শিখে গেছে? সে বুঝতেও পারল না! সবার সামনে হাসি-খুশি থাকার ভাণ করে অথচ মাঝরাতে ঠিকই সে নিঃশব্দে কাঁদে!

উষসীর মন ভালো করার নিমিত্তে উষ্ণতা সিদ্ধান্ত নিল তারা কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি ঘুরতে যাবে। বুদ্ধিটা তৃষাণেরও খুব ভালো লাগল। তবে সে কাজের জন্য যেতে পারবে না। উষ্ণতা আর উষসীর সাথে যুথি আর ডোনাকে পাঠানো হবে। তৃষ্ণা অনুপমার কাছেই থাকবে। তার স্কুলে পরীক্ষা চলছে। ডোনা তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তাব দিল। এই মাসেই নাকি ওই বাড়ির মেয়ের বিয়ে। এই ফাঁকে বিয়েও খাওয়া হবে আবার ঘুরাঘুরিও হবে। উষসী খুব আনন্দিত হওয়ার ভাণ করল বেড়াতে যাবার কথা শুনে। তবে আনন্দ ছিল না তার মনে। ঠিক যাওয়ার আগের দিন রাতে উষসী বিরস মুখে বলল,” আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। সামনে আমার পরীক্ষা।”

ডোনা প্রতিবাদের সুরে বললেন,” এটা কেমন কথা? যাবি না মানে? তোর জন্যই তো যাওয়ার এতো আয়োজন। ঘুরতে গেলে তোর মন ভালো হবে।”

উষসী ভ্রু কুচকে বলল,” আমার মন খারাপ এই কথা তোমাকে কে বলল?”

উষ্ণতা চোখের ইশারা দিল ডোনাকে। ডোনা চুপ হয়ে গেল।

উষসী বলল,” আমি একা থাকলে সমস্যা কি? বরং আমার তো একা থাকতেই ভালো লাগে।”

সবার মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হলো। যেই মেয়ে হৈ-হুল্লোড় ছাড়া দুই মিনিট থাকতে পারে না সে এখন একা থাকতে চাইছে। কি আশ্চর্য পরিবর্তন! যুথির চোখে জল চলে এলো। তার প্রাণচঞ্চল মেয়েটা এমন নিষ্প্রাণ কেন হয়ে গেল? কার কুনজর লাগল?

উষ্ণতা উষসীর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল,” ওইখানে আমাদের একটা পাকা বাড়ি আছে। তোর ইচ্ছা করলে পুরো বাড়িতে একা থাকিস। কোনো সমস্যা নেই। তবুও চল। তোকে যেতেই হবে। যদি তুই না যাস তাহলে আমরা কেউ যাবো না। তোর জন্য আমরা সবাই না গিয়ে মনখারাপ করে বসে থাকি এটাই কি চাস তুই?”

উষসী বাধ্য হয়ে যেতে রাজি হলো। উষ্ণতা একবার ভেবেছিল উষসীকে প্রশ্ন করবে যে কি এমন হয়েছে ইয়ামিন আর তার মধ্যে? কেন ইয়ামিন সেদিন হাসপাতাল থেকে চলে গেল? তারপর আর কোনো যোগাযোগ নেই! কিন্তু এই প্রশ্নটা উষসীকে জিজ্ঞেস করলে সে আহত হতে পারে ভেবে উষ্ণতা কখনও কিছু জিজ্ঞেস করেনি।

ঘাটাইল উপজেলার রসুলপুরের গ্রামটি ভীষণ সুন্দর। সবুজ গাছপালায় ঘেরা একটা মায়া মায়া পরিবেশ। শহর থেকে মেহমান এলে গ্রামের মানুষ যারপরনাই খুব ব্যস্ততা দেখায়। অনেক আপ্যায়নের চেষ্টা করে। এবারও তাই হলো। তৃষাণ- উষ্ণতার বিয়ের পর একবার তারা এই গ্রামে এসেছিল। তখন উষসীর বয়স মাত্র আটবছর। সেই সময় যাদের সাথে দেখা হয়েছিল তারা এখন খুব বড় হয়ে গেছে। রোগা-পাতলা একটা ছেলে হাতে ম্যাজিক পাউডার নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে সামনে এসে দাঁড়ালো। উষসীর দিকে চেয়ে লাজুক মুখে বলল,” ভালো আছেন? আমারে চিনছেন?”

উষসী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। কে এই ছেলে? সে চিনতে পারেনি। ডোনা বলল,” আমার খালার বড় ছেলে এটা। মুরাদ। তোর মনে নেই? আগেরবার এসে যখন তুই আমগাছে পা আটকে বসেছিলি তখন ও-ই তোকে কোলে করে আমগাছ থেকে নামিয়েছিল।”

এই কথা বলতে বলতে ডোনা হেসে দিল। ছেলেটিও ফিক করে হাসল। একটা অদ্ভুত অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে গেল উষসীর শরীর। কি আশ্চর্য বিরক্তিকর ব্যাপার। এতো বছর আগের কথা সে মনে রেখে বসে আছে নাকি? আর তখন সে ছোট ছিল৷ ভালো আন্টি কেন তাকে এই কথা বলে অস্বস্তিতে ফেলছে? রাগ লাগল উষসীর। সে আলোচনা সভা থেকে উঠে ভেতরে চলে গেল।

ঘরের ভেতর বসেছিল মুরাদের বোন মাইমুনা। তার বিয়েতেই সবাই এসেছে এই গ্রামে।মেয়েটির গায়ের রঙ কালো। মাথাভরা চুল। আর চেহারা খুব মায়াবী। উষসী স্বাভাবিক থাকলে এই মেয়েটার সাথে তার ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যেতো। কিন্তু উষসীর আজ-কাল মানুষের উপস্থিতিই বিরক্ত লাগে। তাই কাউকে সহ্য হচ্ছিল না।

মাইমুনা উষসীর সাথে নানান গল্প করতে লাগল। ছোটবেলায় নাকি তারা একসঙ্গে খেলেছে। উষসীর আবছা আবছা মনে আছে। মাইমুনা খুব ভালো দৌড়াতে পারতো। একজন বৃদ্ধা মহিলা এসে উষসীর মাথায় হাত বুলিয়ে খুব আদর করতে লাগলেন। এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন যে উষসীর নিশ্বাস আটকে যাওয়ার যোগাড়।

দূর সম্পর্কের সব মামী, খালারা এসে খুব আহ্লাদ শুরু করল৷ অথচ উষসী কাউকেই চিনতে পারছে না। উষ্ণতা সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তবুও উষসীর কিছু মনে পড়ল না। মুরাদ নামের ছেলেটি শুধু তাদের আগে-পিছেই ঘুরাঘুরি করছে। তার মনে হয় কোনো কাজ নেই। হঠাৎ মুরাদ মাইমুনাকে ডেকে তার কানে কানে কি যেন একটা বলল। ব্যাপারটা উষসী খেয়াল করেছিল। একটু পরেই মাইমুনা এসে বলল,” ঘুরতে যাইবা?”

“কোথায়?”

” এইতো, আশেপাশেই। গ্রাম ঘুরায় দেখামু তোমারে। লও যাই।”

উষ্ণতা আগ্রহ নিয়ে বলল,” যা, ঘুরে আয়। ভালো লাগবে।”

উষসী দেখল মুরাদ দরজার পেছনেই দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। নিশ্চয়ই সে মাইমুনাকে এখানে পাঠিয়েছে। উষসী বলল,” আমার ভালো লাগছে না। খুব টায়ার্ড আমি। একটু ঘুমাবো।”

মাইমুনা উষসীর হাত টেনে বলল,” আরে অনেক ঘুমাইতে পারবা। এহন চলোতো।”

উষসী কিছুতেই গেল না। উষ্ণতা বলল,” থাক, ও যখন যেতে চাইছে না… ওকে জোর কোরো না।”

ওদিকে মুরাদের মন খুব খারাপ হয়ে গেল৷ বেচারা হয়তো ভেবেছিল উষসীকে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাবে। তার মনের আশা পূরণ হলো না। উষসী উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” আমাকে একটা খালি ঘর দেখিয়ে দাও মাইমুনা। আমি শান্তিতে ঘুমাতে চাই।”

” আইচ্ছা আসো।”

মাইমুনা উষসীকে একটা বড় ঘরে নিয়ে এলো। সেই ঘরের বিছানায় আগে থেকেই একজন শুয়ে আছে। উষসী বলল,” আমি কি উনার সাথে ঘুমাবো?”

” ঘুমাইতে পারো। উনি খুবই ভালো। খাড়াও ডাকতাছি।”

মাইমুনা ভদ্রমহিলাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। তাকে দেখে উষসীর বিস্ময়ের সীমা রইল না। মিসেস শিমলা! উষসী শুনেছিল ইয়ামিনদের সাথে তাদের একটা পারিবারিক যোগসূত্র আছে। তৃষাণের সৎবোন প্রিয়ন্তীর কাজিন হয় ইয়ামিন। সেই দিক বিবেচনায় ডোনা মিসেস শিমলার আত্মীয়। তাই মাইমুনার বিয়েতে তারা আসবে এটা তো স্বাভাবিক! কিন্তু ইয়ামিনকে তো কোথাও দেখা যায়নি। তাছাড়া সে এই গ্রামে এলে তো শোরগোল পড়ে যেতো। নিশ্চয়ই সে আসেনি। এই ভেবে উষসীর কেন মনখারাপ হলো? সে তো ইয়ামিনকে ভুলতেই চায়। তার সঙ্গে দেখা না হওয়াই তো ভালো। কিন্তু উষসীর অবচেতন মন সবসময় চায়, ইয়ামিনকে দেখতে।

মাইমুনা মিসেস শিমলার সাথে উষসীর পরিচয় করালো। অবশ্য শিমলা উষসীকে চিনতে একদম ভুল করলেন না। তাদের একবার শপিংমলে দেখা হয়েছিল। শিমলা বললেন,” তুমি বলেছিলে আমার বাড়িতে আসবে। এলে না কেন?”

উষসী হেসে বলল,” স্যরি আন্টি। ভুলে গেছিলাম। আপনি কেমন আছেন?”

” খুব ভালো। তোমার আপু এসেছে?”

” জ্বী এসেছে। দেখা করবেন?”

” পরে করবো।”

তাদের বেশ ভালো গল্প হলো। এর মাঝে একবার ইয়ামিন ফোন করেছিল। মিসেস শিমলা উষসীর সামনে বসেই ইয়ামিনের সাথে কথা বলেছেন। পুরোটা সময় উষসীর বুক কাঁপছিল তখন। কেমন একটা টনটনে ব্যথা সৃষ্টি হচ্ছিল গলার কাছে। চোখ ভরে আসছিল অশ্রুজলে। ইয়ামিন নাকি কালকের ফ্লাইটেই মুম্বাই চলে যাবে। এই কথা শুনে শিমলা খুব রাগারাগি করে ফোন কেটে দিলেন।

উষসী হাসার ভাণ ধরে জানতে চাইল,” কি হয়েছে আন্টি?”

শিমলা অভিযোগের স্বরে বলতে লাগলেন,” আর বোলো না… ছেলেটা এতো বছর পর বাড়ি ফিরেছে। কোথায় আমি ভাবলাম তিন-চারমাস থাকবে। তা না, সে এখনি ফ্লাইটে ওঠার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আর একবার বিদেশ গেলে বছরের পর বছর কেটে গেলেও আসার নাম নেয় না। এতো পাষাণ ছেলে। আমি তো মা হই ওর, আমার কষ্ট হয় ওকে ছাড়া থাকতে। কিন্তু এটা ও বুঝলে তো! এতোদিন আটকে রেখেছিলাম। কারণ আমি জানতাম আমি বাড়ির বাইরে গেলেই সে দেশের বাইরে চলে যাবে। এখন আমি দুইদিনের জন্য এসেছি আর সেও পালাতে চাইছে।কি করি বলোতো!”

উষসী মুচকি হেসে বলল,” আপনি চাইলেই উনার যাওয়াটা ক্যান্সেল করতে পারেন।”

” মারে,তুমি আমার ছেলেকে চেনো না দেখেই এই কথা বলছো। ও জীবনেও আমার কথা শোনেনি। এবারও শুনবে না। ওকে আটকানোর জন্য আমাকে মনে হয় আজকেই ঢাকা ফেরত যেতে হবে।”

” ঢাকা যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনি চাইলে আপনার ছেলেই এখানে চলে আসবে।”

উষসী তার বিখ্যাত দুষ্ট বুদ্ধির ঝুলি বের করে হাসল।শিমলা বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,” সেটা কিভাবে সম্ভব?”

“বুদ্ধি থাকলে সবই সম্ভব আন্টি।”

ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় ইয়ামিনের কাছে খবর গেল মিসেস শিমলা মেঠোপথে হাঁটতে গিয়ে উষ্টা খেয়েছেন। কোমরের হাড় ভেঙে ফেলায় তাকে জিলা হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এই খবর শুনে ইয়ামিন রাত সাড়ে দশটার মধ্যে ঘাটাইল হাজির হলো। তখন বাইরে অনেক বৃষ্টি। রীতিমতো ঝড় হচ্ছে। ঘরে বিদ্যুৎ নেই। মাইমুনার দাদী ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। গ্রামের মানুষ একটু দ্রুতই ঘুমায়। তবে আজ সবাই জাগ্রত ছিল। কারণ রাত নয়টায় মাইমুনার চাচী আম্মার প্রসব বেদনা ওঠে। তাকে নিয়ে সবাই হাসপাতালে গেছে। উষসী ঘুমিয়ে ছিল বিধায় যেতে পারেনি।

তার ঘুম ভাঙল দরজা ধাক্কানোর শব্দে। উষসী ভাবল সবাই চলে এসেছে বুঝি। কিন্তু দরজা খোলার পর ইয়ামিনকে দেখে স্তম্ভের ন্যায় স্তব্ধীভূত হয়ে গেল সে। ইয়ামিনের পুরো শরীর ভেজা। সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি ঢোকানো যায়নি। আর অন্ধকার বৃষ্টির রাতে রিকশা-ভ্যানও খুঁজে পায়নি। তাই ভিজে ভিজেই চলে এসেছে।

তাকে এভাবে দেখে উষসী কি বলবে বা করবে বুঝতে পারল না। ব্যালকনি থেকে তোয়ালে এনে দিল মাথা মোছার জন্য। ইয়ামিন প্রশ্ন করল,” মা কোথায়?”

উষসী কথা বলতে নিয়ে দেখল তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। অদ্ভুতভাবে সব কথা গলার কাছে এসেই জড়িয়ে যাচ্ছে। কি আজব! উষসী বহু কষ্টে উচ্চারণ করল,” হাসপাতালে।”

” হাসপাতালে কেন? মা তো বলেছিল বাড়িতে এসে গেছে।”

উষসী মোমবাতি জ্বালতে জ্বালতে বলল,” আন্টির কিছু হয়নি। চিন্তা করবেন না। মাইমুনার চাচী অসুস্থ। বাচ্চা হবে। তাই সবাই হাসপাতালে গেছে।”

” ও। ” ইয়ামিন চেয়ারে বসল। মিসেস শিমলা তাকে মিথ্যা বলে এখানে আনিয়েছেন। এটা বুঝেই ভীষণ বিরক্ত লাগল তার। সে আবার উষসীর মুখোমুখি হতে চায়নি। কিন্তু নিয়তির পরিহাসে তাদের দেখা হয়েই গেল।

উষসী বলল,” আপনাকে চা দিবো?”

” লাগবে না।”

ইয়ামিন তোয়ালেটা ফেরত দিল। অন্ধকারে কেউ কারো মুখ দেখতে পাচ্ছে না। তোয়ালে নেওয়ার সময় ইয়ামিনের হাতের সাথে স্পর্শ লাগল উষসীর হাতে৷ সে কেঁপে উঠল আচমকা। এতো ঠান্ডা কেন ইয়ামিনের হাত? যেন হিমালয় থেকে এসেছে সে। উষসী কৌতুহলবশত ইয়ামিনের কপালে হাত রাখল।

ইয়ামিন বিস্মিত হয়ে বলল,” কি করছো?”

উষসী আৎকে ওঠা কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” আপনার তো দেখছি ভীষণ জ্বর!”

ইয়ামিন একটু সময় চুপ থেকে বলল,” বৃষ্টিতে ভেজার কারণে হয়তো।”

” আপনি ভেতরে চলুন। এখানে অনেক ঠান্ডা বাতাস। ভেতরে গিয়ে শুয়ে থাকবেন।”

” দরকার নেই। মা কখন আসবে জানো?”

” আমি এতোকিছু জানি না। আপনাকে ভেতরে যেতেই হবে। উঠুন বলছি।”

ইয়ামিন জোরে একটা হাচি দিল। উষসী শিউরে উঠল,” আরে, আবার ঠান্ডাও লেগেছে দেখছি। আদা চা খেলে ঠিক হয়ে যাবে। আপনি বিছানায় শুয়ে পড়ুন। আমি এখনি চা নিয়ে আসছি।”

বিছানায় না যাওয়া পর্যন্ত মনে হচ্ছে উষসী শান্ত হবে না। তাই বাধ্য হয়ে ইয়ামিনকে উঠতে হলো। এমনিতেও তার খুব শীত লাগছে। ঠান্ডার কারণে সে সবকিছু ঝাপসা দেখতে পাচ্ছে। উষসী ইয়ামিনকে বিছানায় শুয়িয়ে একটা মোটা কাঁথা তার গায়ে টেনে দিল। কিছুক্ষণ আগে উষসী এই বিছানাতেই শুয়েছিল। এই বালিশেই মাথা রেখেছিল। তার শ্যাম্পুর গন্ধ লেগে আছে বালিশে। যা ইয়ামিনের অস্বস্তির মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলছে। নিজের প্রতি উষসীর এমন বাড়াবাড়ি রকমের ব্যস্ততা তাকে সহজ হতে দিচ্ছে না। ক্ষণে ক্ষণেই তার মনে হচ্ছে সে অপরাধী। তার উষসীর থেকে দূরে যাওয়া উচিৎ।

উষসী চা বানাতে রান্নাঘরে গেল। একটু পর যখন সে চা নিয়ে ফিরল তখন ইয়ামিন ঘুমিয়ে পড়েছে। চারদিকে ঘোর অন্ধকার। মোমবাতি নিভে গেছে। উষসী আলতো হাতে আবার মোমবাতি জ্বালল।

বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। ঠান্ডা বাতাসের শীতল পরিবেশ। গ্রামের আবহ একটা মোহঘোর সৃষ্টি করেছে। এই মন তোলপাড় করা অন্ধকার রাতে মোমের সোনালি, নরম আলোয় উষসী তার প্রিয়তমের ঘুমন্ত সুন্দর মুখটি দেখছে মুগ্ধ হয়ে।

এতো সুন্দর লাগছে ইয়ামিনের ঘুমন্ত মুখটা! উষসী আবছা একটা ঘোর নিয়ে তাকিয়ে রইল। ইয়ামিনকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগছে। এতো সাহস তার কিভাবে এলো সে জানে না। কিন্তু ইয়ামিনের মাথায় সে হাত বুলাতে লাগল। ইয়ামিন নড়েচড়ে উঠল। উষসী কেঁপে উঠে হাত সরাতে নিলেই ইয়ামিন তার হাতটা ধরে ফেলল। বিড়বিড় করে কিছু বলতে লাগল যেন। যদিও ইয়ামিন এসব ঘুমের ঘোরে করছে। তবুও উষসীর কান্না পেয়ে গেল। ইয়ামিন তার হাতটা ছাড়েনি। উষসীও ছাড়ানোর চেষ্টা করেনি। এভাবেই ভোর হয়ে গেল। কখন যে উষসী ইয়ামিনের পাশে একই বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল তা সে নিজেও জানে না। কিন্তু যখন তার ঘুম ভাঙল, তখন পুরো দুনিয়া বদলে গেছে!

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে