#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ২০
লিখা- Sidratul Muntaz
উষ্ণতা ঠিক করেছে, ইমনের সাথে বিয়েটা ভেঙে দিবে। তারপর ইয়ামিনের সাথেই বিয়ে দিবে নিজের আদরের বোনকে। তার কাছে নিজের বোনের খুশি সবার আগে। ইয়ামিনকেও তার অনেক পছন্দ হয়েছে। ছেলেটা ডিসেন্ট, হ্যান্ডসাম, বাচনভঙ্গিও সুন্দর, বড়দের সম্মান করে, বিনয়ী। সেলিব্রিটি হয়েও বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। এমন হীরের টুকরোকে হাতছাড়া করা তো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না।
গতকাল সারারাত উষ্ণতা জেগে থেকে এসব চিন্তা করেছে। ইমনকে উষসী পছন্দ করে না। আর পুলিশ পাত্র উষ্ণতারও পছন্দ না। তবুও তৃষাণের কথায় সে সায় দিয়েছিল। তখন তো হাতের কাছে অন্য ভালো কোনো পাত্র ছিল না। কিন্তু এখন আছে! তাই উষ্ণতা অবশ্যই বোনের সুখের জন্য লড়বে। যুথির পাশে গিয়ে উষ্ণতা খুব আগ্রহ নিয়ে বলল,” মা, ইয়ামিনকে তোমার কেমন লেগেছে?”
যুথি বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন,” কেন?”
উষ্ণতা হাসি মাখা মুখে বলল,” আমি ঠিক করেছি উষসীর সাথে ওর বিয়ে দিবো।”
যুথি হতবাক হয়ে উষ্ণতার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর কাশতে লাগলেন। দ্রুত উষ্ণতা মাকে পানি ঢেলে খাওয়ালো। যুথি কোনমতে নিজেকে সামলে বললেন,” তোর কি মাথাখারাপ হয়ে গেছে?”
কথাটা একটু জোরেই বলে ফেলেছিলেন যুথি।আশেপাশের মানুষ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।
উষ্ণতা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,” মাথা খারাপ হবে কেন? ইমনকে আমার এমনিও পছন্দ ছিল না। উষসীও বিয়েটা নিয়ে খুশি না। তুমি নিজের মেয়ের খুশি দেখতে চাও না?”
যুথি অবলীলায় বললেন,”না।”
উষ্ণতা আশাহত হলো মায়ের কথায়। যুথি খুব রেগে গেছে। তার মুখ পাথরের মতো শক্ত। ইয়ামিনের কাজগুলো আজও ভুলতে পারেননি তিনি। তখন ইয়ামিন অনেক ছোট ছিল। না বুঝে ভুল করেছে, এসব কথা তিনি মানতে চান না। তিনি কখনও ইয়ামিনকে ক্ষমা করতে পারবেন না। থমথমে কণ্ঠে বললেন,” এটা অসম্ভব উষ্ণ। এই বিষয়ে আমি তোর সাথে কোনো কথা বলব না। আমার উত্তর একটাই, না মানে না।”
যুথিকে রাগান্বিত দেখাচ্ছে। তিনি যেন এই বিয়ের ঘোর বিরোধী। উষ্ণতা ভড়কে গেল। মা এতো তেঁতে উঠলেন কেন বিয়ের কথা শুনে? ইয়ামিনের দোষ কোথায়? পাত্র হিসেবে সে কোনদিক দিয়ে খারাপ! যুথি একটু পর প্রশ্ন করলেন,” তৃষান এসব জানে?”
উষ্ণতা গম্ভীর গলায় উত্তর দিল,” না। এখনও ওকে জানাইনি।”
” তাহলে জানাও আগে। ”
” সে যদি রাজি হয় তাহলে কি তুমি রাজি হবে?”
তৃষাণ মরে গেলেও রাজি হবে না সেটা জেনেই যুথি ভর্ৎসনার সাথে বললেন,” হ্যাঁ। তৃষাণ রাজি হলে আমিও রাজি।”
উষ্ণতা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল এবার। সে তো ভেবেছিল মাকে কোনোভাবেই রাজি করানো যাবে না। হয়তো ইয়ামিন মিডিয়া জগতের মানুষ বলে মা তাকে খারাপ ভাবছেন। কিন্তু তৃষাণ যদি রাজি হয়, তাহলে তিনিও রাজি হবেন। তৃষাণকে রাজি করানো উষ্ণতার কাছে চুটকির ব্যাপার। সে কিভাবে তৃষাণকে রাজি করাবে সেটা নিয়ে ভেবে একটা উপায় বের করে ফেলল। তখনি হাজির হলো তৃষাণ। তীক্ষ্ণ মেজাজ নিয়ে প্রশ্ন করল,” উষু কোথায় উষ্ণ? ওকে দেখছি না কেন?”
উষ্ণতা চোখের ইশারায় উষসীকে দেখিয়ে দিল। অনেকটা পেছনে ইয়ামিনের সাথে বসে গল্প করছে উষসী। ইয়ামিন কথা বলছে আর উষসী হাসিতে ঢুলে পড়ছে। চেহারায় তার লাজুক আভা। তৃষাণ কটমট করে বলল,” ওকে ওখানে কে বসিয়েছে?”
উষ্ণতা হেসে বলল,” আমি। কেন, কোনো সমস্যা?”
তৃষাণ তুমুল গতিতে সেদিকে এগিয়ে গেল। উষ্ণতা আশ্চর্য হলো। এতো রেগে যাওয়ার কি হলো এখানে? তৃষাণ এতো কনজার্ভেটিভ হচ্ছে কেন? উষসীদের সামনে গিয়ে তৃষাণ বলল,” তোমার না উইন্ডো সিট ভয় লাগে? তাও এখানে কেন বসেছো? যাও, সামনে গিয়ে অনুপমা আপুর সাথে বসো।”
উষসীর হাসি মাখা মুখ গেল শুকিয়ে। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে সে উঠে দাঁড়ালো। বিমানের অনেকেই তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। উষসী কাঁপা কণ্ঠে বলল,” ভাইয়া আমাকে এখানে উষ্ণ আপু বসতে বলেছে।”
” এখন আমি বলছি উঠে যেতে। যাও।”
” ভাইয়া প্লিজ…”
” যাও।” তৃষাণ একটা কঠিন ধমক দিল।
উষসীর ছোট্ট আত্মা কেঁপে উঠল। অপমানে চোখে পানি চলে এলো। বিমানের সবাই তামাশা দেখছে কৌতুহল নিয়ে। সে দ্রুত হেঁটে সামনে চলে গেল। ইয়মিন শান্ত হয়ে বসে আছে চুপচাপ। তার হাতে একটা কোল্ড্রিংকের গ্লাস। উষসী চলে যেতেই তৃষাণ ইয়ামিনের পাশে বসল। এমনভাবে তাকাল যেন চোখ দিয়েই ভস্ম করে ফেলতে চায় তাকে। ইয়ামিন মৃদু হেসে বলল,” মাথা ঠান্ডা করুন ভাইয়া। কোল্ড্রিংক্স নিন?”
ইয়ামিন তার গ্লাস এগিয়ে দিল। তৃষাণ সেই গ্লাস নিয়ে পুরোটা তরল ইয়ামিনের মুখে ছুড়ে মারল। কিছু মানুষ অদ্ভুত দৃষ্টিতে এই দৃশ্য দেখে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি শুরু করেছে। কিন্তু ইয়ামিন অপমান গায়ে মাখল না। সে পকেট থেকে টিস্যু বের করে নিজের মুখটা মুছল। হতাশ কণ্ঠে খুব বিনয়ের সাথে বলল,” দিজ ইজ নট ফেয়ার, ভাইয়া।”
তৃষাণ ধারালো গলায় বলল,” এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লভ এন্ড ওয়ার।”
ইয়ামিন অবাক হয়ে তাকাল,” লভ না ওয়ার? ”
তৃষাণ হালকা ঝুঁকে এসে বলল,” দিজ ইজ থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার, ইয়ামিন ইব্রাহীম। বি প্রিপেয়ারড। মনে রেখো আমি কখনও তোমাকে আমার পরিবারের ক্ষতি করার সুযোগ দিবো না। উষসীকে টোপ বানিয়ে তুমি যদি মনে করো উষ্ণতার সান্নিধ্য হাসিল করতে পারবে… তাহলে আনফরচুনেটলি ইউ আর আ ডে ড্রিমার। আমি বেঁচে থাকতে সেটা কখনোই সম্ভব না। মাইন্ড ইট।”
ইয়ামিন হাসল। তৃষাণ গা শীতল করা দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে জায়গা ত্যাগ করল।
দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরে বিমান অবতরণ করে। তৃষাণের ধমক খেয়ে উষসী একদম চুপ হয়ে গেছে। এয়ারপোর্টে নেমে তৃষাণ তাকে বলল,” তোমার আপু কোথায় উষু?”
উষ্ণতা উষসীর কাছে ব্যাগ, ফোন আর তৃষ্ণাকে রেখে বাথরুমে গেছে। সেই কথা উষসী বলল না। অভিমানে সে কোনো জবাবও দিল না। তৃষাণের সঙ্গে কথাই বলতে চায় না সে। এটা বুঝতে পেরে তৃষাণও তেমন পাত্তা দিল না। অন্যসময় হলে উষসীর মান ভাঙানোর চেষ্টা করতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। সে উষসীর আচরণে মারাত্মক বিরক্ত হয়েছে। আর যতক্ষণ ইয়ামিন এখানে থাকবে, তৃষাণের আচরণ স্বাভাবিক হবে না!
তৃষাণ আরেকটু সামনে যেতেই দেখল ইয়ামিন এয়ারপোর্টের সুপার শপের সামনে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। তখন সামান্য নিশ্চিন্ত হলো তৃষাণ। ইয়ামিন এখানে আছে মানে সে উষ্ণতার সাথে নেই। এটাই স্বস্তির বিষয়। কিন্তু উষ্ণতা গেল কই?
ইয়ামিন ফোন রেখে তৃষাণের দিকে হেঁটে এলো,” ভাইয়া, কাউকে খুঁজছেন? উষ্ণতা মিস ওয়াশরুমে আছেন।”
তৃষাণ ভ্রু কুচকে তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল,” তুমি জানলে কিভাবে?”
” আপনার নজর তো সারাক্ষণ আমার দিকেই থাকে। আর আমার নজর থাকে মিসের দিকে… এজ ইউ নো।”
তৃষাণ ঝট করে ইয়ামিনের কলার চেপে ধরল। আশেপাশের কিছু মানুষ অবাক হয়ে চাইতেই নিজেকে ধাতস্থ করল সে। ইয়ামিনের কাঁধে হাত রেখে ধীরে তবে রূঢ় কণ্ঠে বলল,” আমি চাই না বাচ্চাদের সামনে তোমাকে নিয়ে ঝামেলা করতে। আমি কন্ট্রোলের বাইরে কিছু করার আগে ভালো হয় তুমি এখান থেকে চলে যাও। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। তুমি কেন নিজের ভালো বুঝতে পারছো না? এখান থেকে চলে যাও ইয়ামিন।”
ইয়ামিন মধুর কণ্ঠে বলল,” আপনি এমনিতেও সিন ক্রিয়েট করতে পারবেন না ভাইয়া। কারণটা হলো উষ্ণতা মিস।”
ঠিক সেই সময় উষ্ণতা ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে। তাদের সামনে এসে বলল,” কি ব্যাপার? তোমরা দু’জন একটু পর পর একে-অন্যের সাথে কি এতো আলাপ করো?”
তৃষাণ থতমত খেল। ইয়ামিন হাসিমুখে বলল,” কিছু না মিস। ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন আপনি কোথায়? খুব ভয় পেয়ে গেছিলেন আপনাকে না দেখে। হি রিয়েলি মিসড ইউ।”
ইয়ামিনের থেকে এমন কথা শুনে লজ্জায় চোখমুখ ছোট হয়ে উষ্ণতার। সে দেখল তৃষাণেরও ফরসা মুখ লাল হয়ে আছে। নাকের ডগা ফুলে গেছে। সে হেসে তৃষাণের বাহু ধরে নরম কণ্ঠে বলল,” ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম, বাবা! এটা নিয়ে এতো অস্থির হওয়ার কি আছে? তুমিও না… চলো।”
উষ্ণতা লাজুক হাসছে। সে ভেবেছে তৃষাণ তাকে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য দেখতে না পেয়েই অস্থির হয়ে উঠেছে। কিন্তু তৃষাণের অস্থিরতার কারণ ভিন্ন। সে উষ্ণতার সাথে হাঁটছে ঠিকই কিন্তু কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইয়ামিনের দিকে।
সবাই খুব ক্লান্ত আর পরিশ্রান্ত অবস্থায় হোটেলে পৌঁছালো। উষসীর মুড অফ। ক্ষণে ক্ষণেই সে বিরক্ত হচ্ছে। তৃষাণ জিজ্ঞেস করল,” সবার নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়েছে? কে কি খেতে চাও, বলো। আমি অর্ডার দিতে যাচ্ছি।”
উষসী বলল,” আমি কিছু খাবো না।”
এই বলে সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তৃষাণ চোয়াল শক্ত করে চুপ রইল। উষ্ণতা রাগী দৃষ্টিতে তাকাল,” উষু তোমার উপর রেগে আছে কেন? তুমি আবার ওকে বকেছো তাই না?”
তৃষাণ বলল,” বাদ দাও ওর কথা। এমনি ঠিক হয়ে যাবে।”
উষ্ণতা বাদ দিল না। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” কিচ্ছু ঠিক হবে না। ইয়ামিনের জন্য এমন করছো তুমি তাই না?”
তৃষাণ জবাব দিল না। উষ্ণতা কাছে এলো। তৃষাণের গালে হাত রেখে একটু বোঝানোর উদ্দেশ্যে বলল,” আমি জানি তুমি উষুর ভালো চাও। কিন্তু ইয়ামিন ছেলে হিসেবে অনেক ভালো। তুমি শুধু শুধু কেন ওকে অপছন্দ করছো? শুরু থেকেই দেখছি, তোমার ব্যবহার ইয়ামিনের প্রতি খুব রুড। জোর করে ওকে আমাদের সাথে এনেছি। ও নিজে কিন্তু আসতে চায়নি। তুমি যদি এমন করো তাহলে ছেলেটা কি ভাববে? তুমি তো প্রীতমের সাথেও এতো রেগে কথা বলো না। তাহলে ইয়ামিনের সাথে কেন?”
তৃষাণ শক্ত মুখে বলল,” আমি যেটা জানি, তুমি সেটা জানো না উষ্ণ।”
” মানে? আমি কি জানি না?”
” কিছু না।”
তৃষাণ ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আশ্চর্য, এতো অদ্ভুত আচরণ কেন তার? উষ্ণতা বুঝতে পারল না। মিনিট পাঁচেক পরেই উষসী দৌড়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল,” ইয়ামিন চলে গেছে, আপু!”
উষ্ণতা হতবিহ্বল হয়ে শুধাল,” মানে? কোথায় গেছে?”
” জানি না। ও নাকি আমাদের সাথে বাংলাদেশেও যাবে না। অনুপমা আপুর থেকে বিদায় নিয়ে গেছে। ”
” বলিস কি? আমাকে না জানিয়েই চলে গেল? নিশ্চয়ই তৃষাণ ওকে কিছু বলেছে। উফ, তোর তৃষাণ ভাই এমন করছে কেন? কি শুরু করল সে? আচ্ছা, তুই কাঁদিস না। আমি দেখছি….ইয়ামিনের ফোন নাম্বার আছে?”
” না নেই। কিন্তু ইন্সটাগ্রাম আছে।”
উষ্ণতা খুব দুশ্চিন্তায় পডে গেল। তার অস্বস্তিও লাগছে। কি এমন হলো যে ইয়ামিন এভাবে কাউকে না জানিয়ে চলে গেল? উষ্ণতা বলল,” অনুপমাকে ডাক তো।”
উষসীর কিছু ভালো লাগছে না। সে কাঁদতে কাঁদতে ছুটল অনুপমাকে ডাকার জন্য। মাঝপথে দেখা হলো প্রীতমের সাথে। সে উষসীর হাত ধরে আটকে বলল,” শোন উষু, আমি বাইরে যাচ্ছি। চল আমার সাথে।”
উষসী খিটমিট করে বলল,” আমার হাত ছাড়।”
” কেন ছাড়ব? এতো সহজ? চল আমার সাথে।”
উষসী সজোরে প্রীতমের গালে চড় মারল৷ হোটেলের স্টাফরা এই ঘটনায় মজা পেয়ে খুব উদগ্রীব হয়ে তাকাল। প্রীতম অপমানে কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক রইল। ততক্ষণে উষসী নিজের হাত ছাড়িয়ে চলে গেছে।
অনুপমা রিসিপশন থেকে একটা লাল গোলাপের বুকেট রিসিভ করেছে। সেটাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছে। কি সুন্দর আর যত্নে সাজানো হয়েছে জিনিসটা। রিসিপশনিস্টের ভাষ্যমতে ইয়ামিন এই বুকেট রেখে গেছে। কিন্তু কার জন্য রেখে গেছে সেটা বলেনি। উষসী দৌড়ে এসে বলল,” অনু আপু, তোমাকে উষ্ণ আপু ডাকছে। বলো না ইয়ামিন কখন গেছে? সে কি কিছু বলে গেছে? সে কি আর আসবে না? তৃষাণ ভাইয়ের আচরণে কি সে রাগ করেছে?”
উষসী তার কান্না থামাতে পারছে না। অনুপমা তাকে শান্ত করে বলল,” চুপ কর পাগলি। এই দ্যাখ, ইয়ামিন তোর জন্য কি রেখে গেছে। এরপরেও এভাবে কাঁদবি?”
উষসী এতোক্ষণ খেয়াল করেনি। অনুপমার হাতে ফুলের বুকেট দেখেই তার দৃষ্টি চকচক করে উঠল। হাসিমুখে ফুলের বুকেট নিল সে। এর মধ্যে ছোট্ট একটা নোটও পেল,” ভালো থেকো।”
উষসী আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ল৷ ইয়ামিন কিভাবে বুঝল যে তার লাল গোলাপ পছন্দ? মানুষটা কি তাকে এতো ভালোভাবে অবজার্ভ করেছে যে তার মনের কথাও বুঝে গেছে! প্রবল আনন্দে উষসীর আবার কান্না পেল। সে ফুলের বুকেট জড়িয়ে ধরে কেঁপে কেঁপে কাঁদছে। অথচ তার মনে নেই, উষ্ণতারও যে লাল গোলাপ খুব পছন্দ…
চলবে
#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ২১
লিখা- Sidratul Muntaz
দীর্ঘ পাঁচবছর পর বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরে সবকিছু অন্যরকম ঠেঁকছে ইয়ামিনের। আচ্ছা, দেশটা কি বদলে গেছে? নাকি সে বহুদিন পর এসেছে বলে এই দেশ তাকে পর করে দিয়েছে? কেমন আছে তার মা-বাবা,পরিবার, পরিজন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনেরা? কতদিন দেখা হয় না সবার সাথে!
ভাবতেও অবাক লাগে যে বছরের পর বছর ফুরানোর পরেও ইয়ামিন এক মুহুর্তের জন্য শেকড়ের টানে ফিরে আসার প্রয়োজন অনুভব করেনি। বাংলাদেশ মানেই ইয়ামিনের চোখে ভেসে উঠতো উষ্ণতার সুখময় স্বপ্নের সংসার। যে স্বপ্নে, যেই সুখে ইয়ামিনের কোনো হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। ইয়ামিন তার ভালোবাসা নামক কালো ছায়া নিয়ে কখনও উষ্ণতার স্বপ্নময় জীবনে অবতরণ করতে চায়নি। তাইতো পালিয়ে গিয়েছিল নিজের আপন মানুষদের ছেড়ে।
আজ, এতোদিন পর মা কি ইয়ামিনকে দেখে অবাক হবেন? নিশ্চিত জড়িয়ে ধরে কাঁদতে বসবেন। আর বাবা? তিনি কি বলবেন?
এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে না হতেই ফ্যানেরা এসে হামলে পড়ল ইয়ামিনের উপর। সবার ছবি তোলার প্রয়াস, উত্তেজনার প্রকাশ , অতি আবেগী কেঁদে ফেলার চেষ্টা, এসব ইয়ামিনকে বিব্রত করল খুব। সে দ্রুত ট্যাক্সিতে উঠল। তার বাড়ির কেউই জানে না যে ইয়ামিন ফিরেছে। কিন্তু এই ঘটনা নিশ্চয়ই এতোক্ষণে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার হয়ে যাবে। ইয়ামিন তার মাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। সেটা বুঝি আর সম্ভব হলো না।
ইয়ামিনদের বাড়িতে অনেককিছুই পরিবর্তন হয়েছে। পুরনো দারোয়ান বদলে গেছে। এই নতুন দারোয়ান ইয়ামিনকে চিনতে পারল না। তাই তাকে সদর দরজায় আটকে দিল। ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল,” কি চাই? আপনি কে?”
ইয়ামিন নিজের পরিচয় দিল না। দিলেও দারোয়ান নিশ্চয়ই ইন্টারকমে ফোন করতে পারে। সেক্ষেত্রে মা আগেই জেনে যাবেন। তাই সে বলল,” মিসেস শিমলার সাথে দেখা করতে এসেছি। ম্যাডাম কি বাড়িতে আছেন?”
” হো আছে। আপনার নাম কি?”
ইয়ামিন তার এক বন্ধুর নাম বলল,” ফাহিম।”
দারোয়ান ইন্টারকমে ফোন করে অনুমতি নিল। তারপর গেইট খুলে দিল। ইয়ামিন ভেতরে প্রবেশ করে চারপাশ দেখল। সবকিছু আগের মতো আছে। বাড়ির পেছনে খোলা মাঠ, ছোট্ট বাগান, দরজার সামনে বড় বকুলফুলের গাছটা। কত মায়াময় স্মৃতি বিজড়িত এই ঘর। ইয়ামিন কিভাবে পারল এতোদিন নিজের বাড়ি ছেড়ে ভিনদেশে পড়ে থাকতে?
ভালোবাসার সুখ যেমন মানুষকে নরম করে তেমনি ভালোবাসা থেকে পাওয়া কষ্টও কি মানুষকে পাষাণ বানিয়ে দেয়? যেমন ইয়ামিন পাষাণ হয়েছে। তার হৃদয় গলানোর চেয়ে পাথর গলানোও অনেক সহজ!
ইয়ামিন বেল চাপলো। দরজা খুলল অল্পবয়সী একটি মেয়ে। দেখে বোঝাই গেল মেয়েটা এই বাড়ির নতুন গৃহকর্মী। সে প্রশ্ন করল কর্কশ গলায়,” কেডা আপনে?”
” মিসেস শিমলা আছেন?”
” ও, খালাম্মার কাছে আইছেন? ভেতরে আহেন।”
ইয়ামিন ভেতরে ঢুকল। মেয়েটি দরজা আটকাতে আটকাতে বলল,” আপনের নাম কি ফাহিম?”
” আমার নাম পরে বলবো। আগে তুমি তোমার খালাম্মাকে ডেকে আনো।”
মেয়েটা কোমড়ে হাত রেখে বলল,” আমারে আপনে চিনেন?”
” না৷ কি করে চিনবো?আমি তো তোমাকে এই প্রথম দেখলাম।”
” তয় আমিও তো আপনেরে প্রথম দেখলাম। কিন্তু মন কইতাছে আগেও কই জানি দেখছি। আচ্ছা, অপরিচিত মানুষরে ভদ্রতা কইরা আপনে ডাকতে হয়। তাই আমি ভদ্রতা করছি। আপনিও করেন।”
” মানে? আমাকেও কি তোমাকে আপনি ডাকতে হবে?”
” অবশ্যই হবে। আপনেরা শিক্ষিত মানুষ হইয়াও ভদ্রতা শিখেন নাই?”
ইয়ামিন বুঝল মেয়েটা অপ্রয়োজনীয় কথা একটু বেশিই বলে। সে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,” মম কোথায়?”
” মোম মানে?”
” মানে মিসেস শিমলা। ”
” উনি আপনার মোম?”
ইয়ামিন কিছু বলল না।মেয়েটা ইয়ামিনকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে চলে গেল। একটু পর মেয়েটা আবার ফেরত এসে বলল,” চলেন। খালাম্মা আপনেরে নিয়া যাইতে কইছে।”
ইয়ামিন মেয়েটার সাথে ডাইনিংরুমে ঢুকল। তখন দুপুর হয়েছে। শিমলা আর আজমল ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছেন। ইয়ামিনকে দেখে কয়েক মুহুর্তের জন্য দু’জনেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ইয়ামিন যে এইভাবে না বলে-কয়ে চলে আসবে আর একটা খবরও পাঠাবে না এইটা কেউ চিন্তাও করতে পারেনি।
যে ছেলে সপ্তাহে একবার ফোন পর্যন্ত করে না সে হুট করে মা-বাবাকে দেখতে বাংলাদেশ চলে এলো? এ স্বপ্ন না সত্যি? বেশ কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটল। একটু পর মিসেস শিমলা খাবার মাখা এঁটো হাতেই দৌড়ে এলেন। ডানহাতটা গুটিয়ে রেখে শুধু বামহাত দিয়েই ছেলেকে জাপটে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন।
ইয়ামিন আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল। এমন ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল সে। কিন্তু এখন কেন যেন লজ্জা লাগছে। মিসেস শিমলা কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ শুরু করলেন,” আমার বাবা, এতোদিন পর মায়ের কথা মনে পড়ল তোর? কেমন আছিস? কিভাবে ছিলি এতোদিন আমাদের ছাড়া? এতো নিষ্ঠুর তুই? একটাবার বাড়ি আসা যেতো না? ছয়টি বছর আমি কিভাবে কাটিয়েছি তোর কোনো ধারণা আছে? এমন কোনো দিন নেই যে তোর কথা মনে করে আমি চোখের জল ফেলিনি। আয়শাকে জিজ্ঞেস কর, ও তো আমাকে প্রতিদিন কাঁদতে দেখে। আর প্রতিদিন বকে। বলে, ছেলে কি আপনার একলারই আছে?”
শিমলা কান্নামাখা মুখেও হাসলেন। ইয়ামিনের চেহারা হাতড়ে মালিশ করে দিতে লাগলেন। স্নেহময় পরশ! ইয়ামিন কি বলবে বুঝতে পারল না। মা’কে জড়িয়ে ধরে তারও কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু লজ্জায় পারছে না। আয়শা নামের মেয়েটা তার দিকে ড্যাব ড্যাব তাকিয়ে আছে। একটু পর বলল,” আপনেই তাইলে ছোটভাইজান? হায় হায় ভাইজান! আমি আপনেরে ক্যান চিনলাম না? আমি যে আপনের কতবড় ফ্যান তা তো আপনি জানলেন না। প্রতিদিন টিকটকে আমি আপনের গান শুনি। আপনি যে কি ফেমাস! এল্লিগাই তো কই, ক্যান এতো পরিচিত লাগে?”
শিমলা ধমক দিলেন,” তোর ফালতু কথা রাখ। আমার ছেলে এতোবছর পর আমার কাছে এসেছে। ওর খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে না? ফ্রীজে কি আছে জলদি বের কর। প্রয়োজনে বাজারে চলে যা। আমি লিস্ট লিখে দিচ্ছি। এই, তুমি কিছু বলছো না কেন? এখনও বসে আছো যে? দেখো তোমার ছেলে ঘরে ফিরেছে!”
আজমল সাহেব কোনো কথা বললেন না। তিনি খাওয়া শেষ করে আয়শাকে বললেন,” কফিটা আমার বেডরুমে পাঠিয়ে দিও।”
এতোই গম্ভীরভাবে আদেশ জারি করলেন যে আয়শা প্রতিউত্তরে ভিন্ন কিছু বলতে পারল না। শুধু ঘাড় হেলিয়ে বলল,” জ্বী খালুজান।”
আজমল সাহেব নিজের বেডরুমে চলে গেলেন। মিসেস শিমলা হতবাক হয়ে সেই চলে যাওয়া দেখলেন। ইয়ামিনের চেহারায় মনখারাপের ছায়া গাঢ় হলো। বাবা তার উপর রেগে থাকবেন এটা সে জানতো। কিন্তু তাই বলে এতোবছর পর দেখা হওয়ার পরেও কথা বলবেন না? মিসেস শিমলা ঘটনাটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য অন্য গল্প শুরু করলেন৷ কিন্তু ইয়ামিনের মনখারাপ তাতে বাড়লো বৈ কমলো না।
___________________
উষসীরা কাশ্মীর ভ্রমণ করে ফিরেছে প্রায় পনেরো দিন হবে। এর মাঝে একবারও উষসীর মুখে হাসি দেখা যায়নি। সে অন্যরকম হয়ে গেছে। যেন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। সারাক্ষণ একা একা থাকে। মনখারাপ নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে যায়। আগে প্রীতমের সাথে তার মেলা-মেশা ছিল। দুইদিন পরপরই প্রীতম বাসায় আসতো। এখন প্রীতমের কোনো হদিশও নেই। উষসীই তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে। ইউনিভার্সিটিতে দেখা হলেও এড়িয়ে যায়।
আগে যেই মেয়ে প্রজাপতির মতো সারা বাড়ি উড়ে বেড়াতো, সে এখন দিনের পুরোটা সময় অন্ধকার ঘরে কাটায়। এসব দেখে উষ্ণতা তৃষাণের সাথে রোজ ঝগড়া করে। কি দরকার ছিল সেদিন ইয়ামিনের সাথে খারাপ ব্যবহার করার? এরপর থেকে ইয়ামিন তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি। উষসী ইন্সটাগ্রামেও কত মেসেজ দিয়েছে, ইয়ামিন রিপ্লে করেনি। এই ব্যাপারগুলো উষসীকে যেন একটা ট্রমার মধ্যে নিয়ে গেছে। সে সহ্য করতে পারছে না ইয়ামিনের শূন্যতা। কাশ্মীরের যে সময়টুকু ইয়ামিন তার সঙ্গে ছিল, সেটা তার জীবনের সেরা সময়!
তৃষাণ উষসীর আচরণ পর্যবেক্ষণ করেছে। তার ধারণা আর কয়দিন গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। যুথিও মেয়ের অবস্থা দেখে কিছু বলছেন না। যেন এটাই স্বাভাবিক। উষ্ণতা ভেবে পায় না তার মা আর স্বামী এতো পাষাণ হৃদয়ের মানুষ কবে থেকে হয়ে গেল? তারা তো উষ্ণতার চেয়েও উষসীর বেশি খেয়াল রাখতো। তৃষাণ তো ছোট থেকে কখনও উষসীর কান্না সহ্য করেনি। উষসীর একটু মনখারাপ হলেও উষ্ণতার আগে সে নিজেই পাগল হয়ে যায়। সেই তৃষাণ এখন উষসীর এমন কঠিন অবস্থাতেও এতোটুকু নরম হচ্ছে না। তার প্রবলেম কি?
উপায়ন্তর না পেয়ে উষ্ণতা তার শাশুড়ীর কাছে গেল। ডোনা উষ্ণতাকে বেশ ভালো একটা পরামর্শ দিলেন। প্রিয়ন্তী ডোনার সৎমেয়ে। তৃষাণের সৎবোন। সে আবার সম্পর্কে ইয়ামিনের কাজিন হয়। বিদেশে থাকে। তার কাছে ইয়ামিনের নাম্বার সহজেই পাওয়া যাবে। উষ্ণতা আর দেরি করল না। তখনি প্রিয়ন্তীর সাথে যোগাযোগ করল।
প্রিয়ন্তীর থেকে জানা গেল, ইয়ামিন নাকি বাংলাদেশেই আছে। তার ব্যক্তিগত নাম্বার উষ্ণতাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিল প্রিয়ন্তী। উষ্ণতা সেদিনই ইয়ামিনকে ফোন করল।ইয়ামিন তখন ভরপেট খেয়ে ভাতঘুম দিয়েছে।এতোবছর পর একমাত্র ছেলেকে কাছে পেয়ে মিসেস শিমলা যেন পাগল হয়ে গেছেন। প্রায় সাত পদের খাবার রান্না করেছিলেন আজ। সব জোর-জবরদস্তি ইয়ামিনকে খাইয়েছেন তিনি। ইয়ামিনও বাধ্য হয়েছে খেতে।
ফোনের আওয়াজে আরামের ঘুম নষ্ট হলো। কিন্তু উষ্ণতার গলা শুনে সব ঘুম যেন নিমেষেই উধাও হয়ে গেল। ইয়ামিন তড়িঘড়ি করে উঠে বসল। উষ্ণতা বলল,” কেমন আছো ইয়ামিন?”
ইয়ামিন শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলল,” ভালো। আপনি?”
উষ্ণতা অপরাধী স্বরে বলল,” একদম ভালো নেই।”
ইয়ামিনের আত্মা ছলাৎ করে উঠল,” কেন? কি হয়েছে মিস?”
” আমার বোন যেখানে ভালো নেই, সেখানে আমি কি করে ভালো থাকি বলো?”
” আপনার বোনের কি হয়েছে?”
” এটাও কি আমাকে বলতে হবে? তুমি জানো না?”
ইয়ামিন কিছুই বুঝতে পারছে না। সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তার অস্থির লাগছে। উষ্ণতা কেন ভালো নেই? কেন ভালো থাকবে না? শুধু উষ্ণতার ভালোর জন্য সে তার পুরো জীবন দান করতে পারে। তবুও উষ্ণতা ভালো থাকুক। তার মুখের উষ্ণ হাসি অম্লান হোক!
উষ্ণতা বলল,” আমি জানি না তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে… কেন সেদিন তুমি দিল্লী থেকে কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেছিলে? আমি ধরে নিলাম তোমার সাথে এমন কিছু হয়েছিল যে কারণে তুমি হয়তো এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছো৷ তাই না?উষসী তোমার ফুলের বুকেট পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল সেদিন। কিন্তু বিশ্বাস করো, এরপর থেকে একবারও ওর মুখে আমি হাসি দেখিনি। খুব মনখারাপ করে আছে মেয়েটা। ”
উষ্ণতার গলা ধরে এলো। ইয়ামিনের বুক কেঁপে উঠল। উষ্ণতা কি কাঁদছে? সে ব্যাকুল হয়ে বলল,” আই এম স্যরি। আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনাকে জানিয়ে আসা উচিৎ ছিল।”
“ইটস ওকে… তুমি চাইলেই এখন সব ঠিক করে দিতে পারো।”
” অফকোর্স। আমি সব ঠিক করে দিবো।” মুখে এই কথা বললেও ইয়ামিন মনে মনে বলল,”আপনার সুখের জন্য ছোটবেলায় দেশত্যাগ করেছিলাম মিস, এখন যদি প্রয়োজন হয় পৃথিবীও ত্যাগ করব। তবুও আপনার এতোটুকু কষ্ট হতে দিবো না।”
উষ্ণতা হাসিমুখে ইয়ামিনকে তাদের বাড়িতে ডিনারের দাওয়াত করল। এই কথা শুনে তৃষাণ নিশ্চয়ই একটু রাগ দেখাবে। কিন্তু তাতে কি? উষসী তো খুশি হবে! উষ্ণতা বোনের খুশির জন্য সব করতে পারে!
সে বেশ কড়াভাবে বলে দিল,” তোমাকে আসতে কিন্তু হবেই সিংগার। নাহলে আমি খুব রাগ করব।”
ইয়ামিন হাসার চেষ্টা করে বলল,” আপনাকে রাগ করার সুযোগটাই দিবো না, মিস। আমি নিশ্চয়ই আসবো। সন্ধ্যার মধ্যেই পৌঁছে যাবো।”
” তোমার গিটারও নিয়ে এসো কিন্তু। আমরা সবাই তোমার গান শুনবো। সন্ধ্যার আসর জমে যাবে।”
ইয়ামিন মিষ্টি করে হাসল৷ আনন্দের ঢেউয়ে তার মন উদ্বেলিত হচ্ছিল৷ আচ্ছা, তার কি সত্যি যাওয়া উচিৎ? উষ্ণতা কেন তাকে নিজের পরিবারের সাথে এতো জড়াতে চাইছে?
আচ্ছা, উষ্ণতার যদি সবকিছু মনে থাকতো তখনও কি সে ইয়ামিনের সাথে এমন ব্যবহার করতো? না, তখন হয়তো ঘৃণায় কথাই বলতে চাইতো না! আর উষ্ণতার চোখের দিকে চোখ রাখার ক্ষমতাও ইয়ামিনের থাকতো না। এখনও নেই। যতবার ওই উজ্জ্বল দৃষ্টি সে দেখে, ততবার নিজেকে ভয়ংকর অপরাধী মনে হয়। কিন্তু তবুও ইয়ামিন উষ্ণতার কথায় আজ ডিনারের আমন্ত্রণে যাবে৷ উষ্ণতা যদি তাকে মরে যেতে বলে, সে তাও রাজি। আর ডিনার কি এমন বড় বিষয়?
উষসী মনমরা হয়ে জানালায় তাকিয়ে ছিল। তার আজ শুধু প্লেনের ঘটনাগুলো মনে পড়ছে। উড্ডয়নের সময় ইয়ামিন তাকে কত গভীরভাবে ধরেছিল। দিল্লীর হোটেলে রেখে যাওয়া ইয়ামিনের ফুলের বুকেটের সব ফুল শুকিয়ে গেছে। উষসী সেই শুকনো পাপড়িগুলোও অতি যত্নে সংরক্ষণ করেছে নিজের কাছে। এতো ভালোবাসাময় একটা চিরকুট দিয়েছে ইয়ামিন। মাত্র দু’টি শব্দ লেখা। তাও কেমন মন উতলা করা অনুভূতি! সে কেন চলে গেল? দীর্ঘশ্বাসে বুক ভারী হয়ে আসছে উষসীর। ইয়ামিনের সাথে আবার কবে দেখা হবে?
অনুপমা হঠাৎ উষসীর মুখের কাছে এসে অদ্ভুত শব্দে বলল,” ভাউউ!”
উষসী চমকে উঠলো। তারপর অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল,” বিরক্ত করো না তো অনু আপু।”
” আরে পাগলী, এমন গুড নিউজ নিয়ে এসেছি না? একবার যদি বলি তাহলে তুই নিজেই আমার পেছন পেছন ঘুরে আমায় বিরক্ত করা শুরু করবি।”
” মানে?”
” ভাবী তোর সিংগারকে আজকে ডিনারের ইনভাইট করেছে আমাদের বাসায়।”
” আমার সিংগার?”
অনুপমা চোখ মেরে বলল,” ইয়ামিন ইব্রাহীম। সে তো বাংলাদেশেই আছে। খবর কি কিছুই রাখিস না? আমি মাত্র ইউটিউবে দেখলাম। এয়ারপোর্ট থেকে সে বের হওয়ার সময় ফ্যানরা ছবি তুলছিল। এইযে দ্যাখ!”
উষসী অস্থিরচিত্তে বলল,” সে যে বাংলাদেশে আছে এটা আমিও জানি। কিন্তু সে কি সত্যি আমাদের বাড়ি আসবে?”
” অবশ্যই আসবে। উষ্ণতা ভাবী বলেছে। সে কি মিথ্যা বলবে, তোর মনে হয়?”
উষসীর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। উত্তেজনা আর উদ্দীপনার হাসি ফুটল ঠোঁটে। অনুপমা বলল,” এইতো, কতদিন পর মেয়েটা হেসেছে! হাসলে কি মিষ্টি দেখায় তোকে। আমার কি মনে হয় জানিস উষু? তোর উপর নিশ্চয়ই ইয়ামিনের আকর্ষণ আছে।”
এই কথা শুনে উষসী বুকের মধ্যে এক লজ্জাময় অপ্রতিরোধ্য চাপ অনুভব করল। কিন্তু মুখে বলল,” ধ্যাত! আজাইরা।”
” সত্যি বলছি। নাহলে দাওয়াত করার সাথে সাথেই কেন আসতে রাজি হয়ে গেল? তার মতো এতোবড় সিংগার কি আমাদের বাড়িতে এসে ডিনার করার মানুষ? আর আমাদের কথাতেই তো সে বাংলাদেশে এলো। যেখানে তার আসার কোনো প্ল্যানই ছিল না। তবুও কেন এলো বলতো? কিসের টানে?”
উষসী ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অনুপমার দিকে। অনুপমার চেহারায় দুষ্টু হাসি। উষসী লজ্জায় জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,” উফফ, আপু তুমি যাও তো। আমার ভালো লাগছে না।”
মুখে এই কথা বললেও উষসীর অন্তরের ভেতর-বাহিরে তখন সুখের বাতাস বইছে। অনুপমা নিজের কাঁধ দিয়ে উষসীকে একটা ধাক্কা মেরে বলল,” কুচ কুচ হোতা হ্যায় পাগলী। তু নেহি সামজেহগী।”
উষসী চোখ রাঙিয়ে তাকালো। তারপর জোরপূর্বক অনুপমাকে ঘর থেকে বের করে দরজা আটকে দিল। মনে মনে বলল,”পাগল।” অথচ সে নিজে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে তখন। উফফ, বুকের মধ্যে যেন কেউ দামামা বাজাচ্ছে। এতো অস্থির কেন লাগছে?
চলবে