আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-১৮+১৯

0
559

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ১৮
লিখা- Sidratul Muntaz

তৃষ্ণা ইয়ামিনের কোলে উঠে বসে আছে। তার বায়না হলো ইয়ামিনের কাছে গিটার বাজানো শিখবে। ইয়ামিনের ব্যাগে বড় গিটার দেখেই তার এমন ইচ্ছার উদয় হয়েছে। একটু পর পর শুধু গিটারটা ছুঁয়ে দিচ্ছে সে। তার দেখাদেখি যখন আইলাও ছুঁতে যাচ্ছে, সে তখন আইলাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিচ্ছে।

তৃষ্ণা ইয়ামিনের দিকে ঘুরে বলল,” তুমি আমার কি হও?”

ইয়ামিন হাসার চেষ্টা করে বলল,” আঙ্কেল।”

তৃষ্ণা এই উত্তর শুনে সন্তুষ্ট হলো না। কিছু একটা ভেবে বলল,”তোমাকে তো আঙ্কেলের মতো লাগে না! আর আঙ্কেলরা তো গিটার বাজায় না।”

” তাহলে কারা গিটার বাজায়?”

” যারা শিল্পী। তুমি কি শিল্পী?”

” হুম।”

” কোন গানের শিল্পী?”

” সবগানের।”

” এর মানে তুমি সব গান পারো?”

” মোটামুটি। তোমার কোন গান পছন্দ? ”

তৃষ্ণা ঠোঁটের নিচে আঙুল রেখে গভীর চিন্তায় মত্ত হলো। যেন খুব জটিল হিসাব মিলাচ্ছে। উষ্ণতা মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। এর আগে এতো শান্ত সে তৃষ্ণাকে কোনোদিন দেখেনি। ছেলেটা যেখানেই যায় ঝড়-তুফান তুলে দেয়। অথচ আজ মনে হচ্ছে এমন লক্ষী বাচ্চা দ্বিতীয়টি নেই। ইয়ামিন জাদু করল নাকি?

উষ্ণতা হঠাৎ করেই বলল,” আচ্ছা ইয়ামিন, তোমার তো এখানে কাজ শেষ তাই না?তাহলে আমাদের সাথে বাংলাদেশ যাবে? ”

এমন প্রস্তাবে ইয়ামিন চমকে তাকাল। অনুপমা সায় দিয়ে বলল,” হ্যাঁ। অনেক ভালো হয়। তোমার ফ্যামিলিও তো বাংলাদেশে। এই সুবাদে ফ্যামিলির সাথেও দেখা করে নিলে?”

তৃষাণ বিরক্ত হয়ে আহমেদের দিকে তাকালো। আহমেদ চোখের ইশারাতেই তৃষাণের আদেশ বুঝে যায়। সে নিজের বউ অনুপমাকে ধমক দিল,” ধূর, কি বলছো এসব? উনি কি যেতে বললেই যেতে পারবে নাকি? তাদের কত শিডিউল মেইনটেইন করে চলতে হয়। হয়তো মুম্বাই ফিরে উনার আরও ইম্পোর্ট্যান্ট কাজ আছে।”

উষ্ণতা মরিয়া হয়ে উঠল,” প্লিজ ইয়ামিন, কোনোভাবে কি ম্যানেজ করা যায় না? তুমি গেলে আমাদের খুব ভালো লাগতো। আর তৃষ্ণাও খুব খুশি হতো। তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে কালই আমরা টিকিট বুক করি। কি বলো তৃষাণ?”

তৃষাণ কোনো কিছু বলতে না পেরে নখ কামড়াচ্ছিল। উষ্ণতার প্রশ্ন শুনে খানিক হকচকিয়ে গেল। ঋনাত্মক মন্তব্য করার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে উষ্ণতার সন্দেহ হবে। তাই শুধু বলল,” তোমার ইচ্ছা।”

উষ্ণতা হেসে ফেলল।অনুপমা চট করে বলে উঠল,”তাহলে তুমি আমাদের সাথে যাচ্ছো এটা কনফার্ম তাই না?”

ইয়ামিন বলার আগেই উষ্ণতা বলল,” অবশ্যই কনফার্ম!”

ইয়ামিন অপ্রতিভ স্বরে বলল,” আসলে নেক্সট মান্থের আগে তো আমার কোনো শিডিউল ফ্রী নেই। তাই ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারছি না।”

উষ্ণতা ভাবল ইয়ামিন লজ্জায় নিষেধ করছে। তাই সে বার-বার অনুরোধ করতে লাগল। এক পর্যায় তৃষাণ অধৈর্য্য হয়ে বলল,” বাদ দাও না। ও যখন যেতে চাইছে না তাহলে কি তুমি জোর করে নিয়ে যাবে নাকি?”

” আমি জোর কোথায় করলাম? আমি তো শুধু অনুরোধ করছি!”

” অনুরোধ একবার দুইবার করা যায়। তাই বলে বার-বার?”

” আরে আজব! তুমি এতো হাইপার হচ্ছো কেন?”

” স্যরি।” তৃষাণ নিভল।

অনুপমা ফিসফিস করে ইয়ামিনকে বলল,” প্লিজ ভাই, তুমি রাজি হয়ে যাও। সবাই অনেক খুশি হবে।”

ইয়ামিন শুধু উষ্ণতাকে খুশি দেখতে চায়। তাই তার দিকে চেয়েই বলল,”ঠিকাছে আমি আরেকবার শিডিউল চেক করে জানাবো।”

” সত্যি?”

” হুম।”

উষ্ণতার মনে জেগে উঠা ভুল ধারণাটা এখন আরও পাকাপোক্ত রূপ ধারণ করল। উষসীর প্রতি আগ্রহ না থাকলে ইয়ামিন হঠাৎ যেতে রাজি হবে কেন? তাছাড়া ছোটবোনের বর হিসেবে ইয়ামিনকে তার মাথায় করে রাখার মতো ভালো লেগেছে। উষ্ণতার মন আনন্দে ভরে গেল!

_____________________
নিস্তব্ধ করিডোরে এলোমেলো পা ফেলে হাঁটছে ইয়ামিন।
দম আটকে আসার মতো কষ্ট অনুভব হচ্ছে তার।অতীতের স্মৃতি মস্তিষ্কে বিচরণ করছে৷ আটবছর আগের সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা, উষ্ণতার ভাইরাল ভিডিও, তার আর্তনাদ, আহাজারি, এসব মনে করে ইয়ামিনের দুঃসহ অনুভব হচ্ছে।

এখনও উষ্ণতার কান্নার তীক্ষ্ণ গর্জন যেন এখনও স্পষ্ট শুনতে পায় সে৷ তার হৃদয়ে সেই অসহ্য সুর দামামা বাজায়। নিজেরও আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করতে মন চায়। আটটি বছর ধরে অপরাধে দগ্ধ তার আত্মা। সে আজও নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না। মহান করুণাময়ের কাছে বার-বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, ভাগ্যিস উষ্ণতা সব ভুলে গিয়েছিল। নয়তো উষ্ণতার সামনে কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতো না সে!

উষ্ণতা তো এক্সিডেন্টের পর সব ভুলে গিয়ে সুখেই আছে। ইয়ামিন তো এতোবছর চেষ্টা করেও ভুলতে পারল না। তাহলে সে কি করে সুখে থাকবে?

তৃষাণ অনেকক্ষণ ধরেই ইয়ামিনকে খুঁজছে। এতোক্ষণ সে শুধু অপেক্ষা করছিল ইয়ামিনকে কখন একা পাবে। ইয়ামিন যখন সবার মাঝ থেকে উঠে চলে গেল তখন তৃষাণও উঠে এসেছে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর সে ইয়ামিনকে পূর্ব পাশের করিডোরে দেখতে পেল।

আশেপাশে কেউ নেই। তৃষাণ শার্টের হাতা ভাঁজ করতে করতে আক্রমণাত্মক গতিতে ইয়ামিনের সামনে গেল। তার কঠিন চোখ দু’টি ক্রোধানলে জ্বলছে। ইয়ামিন হঠাৎ তৃষাণকে দেখে একটু হকচকিয়ে গেল। তারপর হাসল। তৃষাণ হঠাৎ শক্ত থাবায় ইয়ামিনের কলার চেপে ধরে ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল,” সমস্যা কি?”

ইয়ামিন আচমকা আক্রমণের ধাক্কা সামলাতে না পেরে দুই কদম পিছিয়ে গেল। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,” মানে?”

” বুঝতে পারছো না?”

ইয়ামিন নিজের কলার থেকে তৃষাণের হাত সরিয়ে বলল,” না, পারছি না। ঠিক করে বোঝান!”

ইয়ামিনের ঘাড়ত্যাড়া উত্তর শুনে তৃষাণের রাগের মাত্রা তুঙ্গে পৌঁছালো। কপালে একহাত ঠেঁকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,” আমার পরিবার থেকে দূরে থাকো। তুমি কি ভেবেছো তোমার উদ্দেশ্য আমি বুঝি না? বোকা মনে হয় আমাকে?”

ইয়ামিন আবার হেসে ফেলল।আগুনে ঘি ঢালার মতো হাসি! তৃষাণের চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছিল ক্রমাগত। সে আবারও দুইহাতে ইয়ামিনের কলার টেনে ধরে হুমকি দিল,” একদম খু*ন করে ফেলবো কিন্তু।”

ইয়ামিনের চেহারার বিদ্রুপময় হাসি তখনও মুছে যায়নি। সে টিটকিরি মেরে বলল,” এতো ইনসিকিউরড কেন ফীল করছেন আপনি?”

তৃষাণের দৃষ্টি বিস্ফারিত হলো। মুখ দিয়ে খুব খারাপ একটা গালি বের হতে নিচ্ছিল। খুব কষ্টে গিলে নিল গালিটা। এইখানে বেশি ঝামেলা করা যাবে না। নিজের পরিবারকে সমস্ত বিপদ থেকে মুক্ত রাখতে চায় সে।

,” সাহস থাকলে আমার সাথে বাইরে দেখা করো।”

” কি করবেন? মারবেন?”

ইয়ামিন আবারও হাসল। তৃষাণের মাথা থেকে পা পর্যন্ত কাঁপছে। শরীর থেকে ক্রোধের আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। মূলত উষসীর থেকে দূরে থাকার ব্যাপারেই বোঝাতে চেয়েছে সে ইয়ামিনকে। কিন্তু ইয়ামিন সেটা বুঝতে পারেনি। উষসীকে নিয়ে প্রেম সংক্রান্ত কোনো চিন্তা তার ধারণারও বাইরে! তার সমস্ত জগৎ জুড়ে তো শুধুই উষ্ণতা।

ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” মিস তো সবকিছু ভুলে গেছে। তাহলে আপনার ভয় কিসের? আমি এখানে আপনাদের আলাদা করতে আসিনি। হয়তো এটাই ভাগ্যে ছিল যে আমাদের আবার দেখা হবে। তাই দেখা হয়েছে…”

তৃষাণ ইয়ামিনকে ধাক্কা মেরে বলল,” আমি কিছু বুঝি না? আমাকে বোকা মনে হয়?”

” ভাইয়া… আপনি অযথাই রাগ করছেন।”

” চুপ। আর কখনও যেন তোমাকে আমার পরিবারের আশেপাশেও না দেখি। গেট আউট।”

ইয়ামিন হাসতে হাসতে বলল,” আপনাদের সাথে বাংলাদেশ যাবো বলেছি দেখে ভয় পেয়েছেন নাকি? এজন্য আমাকে তাড়াতে চাইছেন? চিন্তা করবেন না। সেটা এমনি বলার জন্য বলেছিলাম। আমি যাবো না।”

” তোমার ছায়াও যেন আমার পরিবারের উপর না পড়ে। তাহলে জানে খতম করে ফেলবো। এখন শুধু ওয়ার্ন করলাম। এরপর আর ওয়ার্ন করবো না! ”

ইয়ামিন প্রাণ খুলে হাসার চেষ্টা করল। ওই হাসি দেখে তৃষাণের হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো। নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ইয়ামিনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হলো। কিন্তু হঠাৎ উষসীর আগমনে তারা দু’জনেই শান্ত হয়ে গেল।

“তোমার এখানে কি কাজ?”রোষপূর্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করল তৃষাণ।

উষসী ভয়ে মাথা নিচু করে বলল,” কিছু না।”

ইয়ামিনের দিকে আঁড়চোখে চেয়েই তৃষাণ বলল,” যাও এখান থেকে।”

উষসী ভয়ে দ্রুত চলে গেল কিন্তু বার-বার পেছন ফিরে ইয়ামিনের দিকে তাকাচ্ছিল। তৃষাণ আঙুল উঠিয়ে বলল,” লাস্ট ওয়ার্ণিং।”

ইয়ামিন কোনো কথা বলল না। তৃষাণ চলে যাওয়ার পরেই সে উষসীর কাছে গেল। উষসী খোলা বারান্দার মতো একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। রেইলিং-এ হাত রেখে। নিচে দেখা যাচ্ছে শ্বেতাভ রাস্তা। হু হু করে ঠান্ডা বাতাস গা ছুঁয়ে দিচ্ছে। তাতেও তেমন কষ্ট হচ্ছে না। উষসী অন্য চিন্তায় মগ্ন। পেছন থেকে ইয়ামিন ডাকল,” এইযে, পিচ্চি।”

পিচ্চি ডাক শুনে চমকে পেছনে তাকাল উষসী। অভিমানে ঠোঁট ফুলে উঠল। আঠারো বছরে এসেও ক্রাশের মুখে পিচ্চি ডাক শুনতে হচ্ছে। কি ভাগ্য তার! ইয়ামিন বলল,” আমাকে কিছু বলতে এসেছিলে তখন?”

উষসী মাথা নাড়ল। তৃষাণের ভয়ে তখন বলতে পারেনি। ইয়ামিন এগিয়ে এসে বলল,” বুঝতে পেরেছিলাম। বলো।”

উষসী কথাটা বলতে নিয়ে কেঁদে ফেলছিল। ইয়ামিন তার মাথায় হাত রেখে বলল,” কাম ডাউন, প্লিজ। কথায় কথায় এতো কাঁদো কেন?”

উষসী খুব কেঁপে কেঁপে বলল,” আমি প্রীতমের সামনে যেতে পারছি না। কিন্তু ও আমার সাথে বার-বার দেখা করতে চাইছে। কিভাবে ওকে এড়িয়ে চলবো বলে দিন প্লিজ? আমার খুব খারাপ লাগছে। এতোটা অসহ্য আগে কখনও লাগেনি।”

” অসহ্য লাগছে কেন?”

” কেন লাগছে সেটা মেয়ে না হলে আপনি কোনোদিন বুঝবেন না!”

ইয়ামিন ভ্রু কুচকালো। কি এমন ব্যাপার যা বুঝতে গেলে মেয়ে হতে হবে? উষসী কাঁদতে কাঁদতে একটু পর নিজেই বলল, “ওর মধ্যে আমি যেই হিংস্র রূপটা দেখেছি সেটা আমার পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব না! যখনি ও আমার সামনে আসবে, আমার আজকে রাতের এই ভয়ংকর ঘটনাগুলো মনে পড়বে। আমি কিছুতেই ওই বাজে স্পর্শগুলো ভুলতে পারছি না।”

উষসী তার হাতের জখমের জায়গাটা চেপে ধরল। করুণ স্বরে বলল,” এই খারাপ স্মৃতি নিয়ে আমি কিভাবে ওর সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক রেখে চলবো? আমি পারবো না। খুব কষ্ট হবে আমার।”

ইয়ামিন প্রস্তুরীভূত হয়ে উষসীর কান্না দেখছে। ওই মুহুর্তে একটা ব্যাপার তার খুব করে উপলব্ধি হলো যে দুনিয়ার অন্যতম ভয়ানক বর্বরতা কোনো মেয়েকে সম্মতির বিরুদ্ধে স্পর্শ করা! কিন্তু এই জঘন্য অন্যায়টি প্রায় অনেকেই করে। তারা যদি বুঝতো তাদের একটা ভুল পদক্ষেপ মেয়েটির জীবনে কতবড় প্রভাব ফেলবে তাহলে কাজটি করার আগেই তাদের হৃদয় কাঁপতো!

যেমন ইয়ামিনের এখন হৃদয় কাঁপছে। ভয়ংকরভাবে কাঁপছে! কারণ ইয়ামিনও তো করেছিল…..আটবছর আগে, খোলা রাস্তায়, উষ্ণতার অনুমতির বিরুদ্ধেই তাকে কিস করেছিল। ভাগ্যিস সেই কালরাতের কথা উষ্ণতার এখন মনে নেই। নাহলে ইয়ামিন কি করে এই মুখ নিয়ে উষ্ণতার সামনে আবার দাঁড়াতো? নিজেকে চতুষ্পদ প্রাণীর চেয়েও নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে তার। উষসী প্রশ্ন করল,” আমি এখন কি করবো বলে দিন প্লিজ?”

ইয়ামিন কোনমতে বলল,” জানি না।”

তারপর সে খুব দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। উষসী কান্না থামিয়ে ইয়ামিনের আচমকা চলে যাওয়া দেখল অবাক হয়ে!

_________________

উষসী, যুথি, ডোনা, অনুপমা, উষ্ণতা আর বাচ্চারা একটা ট্যাক্সিতে উঠেছিল। প্রীতম, তৃষাণ, আহমেদ, ইয়ামিন এরা সবাই অন্য ট্যাক্সিতে। এই রাতে ট্যাক্সি পেতে খুবই কষ্ট করতে হলো। উষসী তো পুরো সময় বিবশ হয়েছিল।ইয়ামিনের সাথে কাটানো শেষ মুহুর্তটুকু বার-বার অনুভব করছে। আবার কবে দেখা হবে কে জানে? উষসীর বিরহী মন আরও বিরহে কাতর হয়ে যাচ্ছে। সে এখনও জানে না যে ইয়ামিন তাদের সঙ্গে বাংলাদেশে যাবে। উষ্ণতাই তাকে জানায়নি। সারপ্রাইজ হিসেবে রেখেছে।

আজ ইয়ামিনের মুম্বাই ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উষ্ণতা জোর করেই ইয়ামিনকে তাদের হোটেলে নিয়ে যাচ্ছে। তার পরিকল্পনা হচ্ছে আগামীকাল সবাই একসাথে বাংলাদেশের জন্য রওনা হবে। যদিও কাশ্মীরে আরও ঘোরা-ফেরা করার ইচ্ছে ছিল তাদের।কিন্তু ইয়ামিন ব্যস্ত মানুষ। সে নিজের কাজ ফেলে উষ্ণতাদের সাথে ঘোরাঘুরি করতে পারবে না। বাংলাদেশে সে যাবে সাতদিনের জন্য। উষ্ণতা চেষ্টা করছে এই সাতদিনেই চমৎকার কিছু ঘটিয়ে ফেলতে!

উষসী অনেক ভাবার পর অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল প্রীতমের সাথে দেখা করবে। চাইলেই সব ভুলে থাকা যায়। এমনও হতে পারে যে প্রীতমের সাথে দেখা হওয়ার পর সে সত্যিই সব ভুলে গেল। এসব ভেবে উষসী হোটেলে ফিরে আসার পর রাতে প্রীতমের রুমের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ল। ভেতরে একদক ঢুকবে না সে। শুধু বাইরে থেকে কথা বলবে। একটু পর দরজা খুলেই দরাজ গলায় প্রীতম বলল,” তোর সমস্যা কি? খবরদার আমার সামনে আসবি না। যা এখান থেকে! ন্যাকা, ঢংগী!”

উষসী নিচু গলায় বলল,” দোস্ত রাগ করেছিস?”

প্রীতম চোখ গরম করে বলল,” কতবার ডেকেছি তোকে? একবারও আসলি না। আমার সাথে কথা বললে কি তোর মুখে বটগাছ উঠতো?”

” স্যরি।”
” এখন বল, আমি পাহাড় থেকে কিভাবে পড়লাম?”

উষসীর পেট গুলগুলিয়ে হাসি পেয়ে গেল। মিথ্যে ঘটনাটা তাহলে প্রীতমও বিশ্বাস করে নিয়েছে? হায় কপাল! উষসী মনে মনে হাসলেও তার মুখের বাহ্যিক অভিব্যক্তিতে কিন্তু তা প্রকাশ পেল না। ভ্রু কুচকে বলল,” তোর মনে নেই? আমার সাথে যে পাহাড়ে উঠলি?”

” মনে থাকলে তোকে জিজ্ঞেস করবো কেন? বিষয়টা যথেষ্ট গোল-মাল লাগছে। হাত-পা এমনভাবে ব্যথা করছে যেন কেউ মেরে হাড্ডি গুঁড়া করে দিছে। পাহাড় থেকে পড়লে এমন হয় নাকি?”

উষসী এইবার একটু শব্দ করেই হেসে ফেলল। বেচারা যে এমন বেরধক মার খেয়েছে সেটা কি আসলেই মনে নেই তার? নাকি নাটক করছে?

প্রীতম চোখ বড় করে বলল,” হাসছিস কেন শাকচুন্নি? আমার অবস্থা দেখে হাসি পায় কিভাবে তোর? বন্ধু নামের কলঙ্ক তুই। ঘোড়ায় উঠে আবেগের বশে কখন কি বলেছিলাম, সেটা ধরে এখনও মহারাণীর মতো ভাব নিয়ে বসে আছিস। যা, যা, তোর মতো ভাবওয়ালীকে আমার বুড়ো আঙুলও ভালোবাসবে না।”

ভালোবাসার কথা শুনে হালকা অস্বস্তিতে পড়ে গেল উষসী। প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য বলল,” আসলে দোস্ত, আমি তোকে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তুই যখন পাহাড় থেকে উল্টে পড়ে যাচ্ছিলি তখন আমি যা ভয় পেয়েছি! সেই ভয় থেকে আমি বেহুশই হয়ে যেতাম। যদি ইয়ামিন ভাই না আসতেন তাহলে এতোক্ষণে তুই আর আমি ওখানেই লটকে থাকতাম। আমি পাহাড়ের চূড়ায় লটকে থাকতাম, আর তুই নিচে পাহাড়ের পাদদেশে লটকে থাকতি।”

উষসীর কথা শুনে পেছনে থেকে কেউ হেসে উঠল। উষসী ঘাড় বাড়িয়ে দেখল ইয়ামিন বিছানায় বসে আছে। তার হাতে ফোন। তাকে দেখে উষসী হতভম্ব হয়ে গেল। আসলে সে হোটেলে ঢুকেই নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। ইয়ামিনও যে এসেছে সেটা দেখেওনি!

উষসী উত্তেজনায় স্থবির হয়ে আসা গলায় প্রশ্ন করল,” আপনি এইখানে কি করছেন?”

প্রীতম ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকালো ইয়ামিনের দিকে। তারপর বলল,” ইয়ামিন ভাই আজকে আমার রুমে থাকবে। আর খবরদার তুই আমার রুমে ঢুকবি না।”

উষসীর প্রচন্ড আনন্দ হলো। উৎফুল্ল হয়ে বলল ,” তোর ঘরে কেন থাকবে?”

” তাহলে কি তোর ঘরে থাকবে?”

” উফ, আমি শুধু কারণ জানতে চাইছি। উনি আমাদের সাথে হোটেলে কেন এলেন?”

” উষ্ণতা আপু রিকোয়েস্ট করেছিল সেজন্য এসেছে। সকালেই হয়তো চলে যাবে মুম্বাই।”

উষসী অবাক হয়ে তাকাল,” কই, আমাকে তো আপু কিছুই বলল না।”

তার মধ্যে সীমাহীন ভালোলাগা কাজ করছে। চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাহলে কি আরও কিছু সময় ইয়ামিনের সাথে কাটানো যাবে? এই ভেবে উষসীর চোখ থেকে ঘুম-টুম সব উড়ে গিয়ে খুশিতে ঝুমঝুম করতে লাগল মন। প্রীতমকে ধরে বলল,” দোস্ত, চল আজ আমরা সারারাত আড্ডা দেই।”

কিন্তু প্রীতম তাকে ঘরে ঢুকতেই দিবে না। উষসী বলল,” প্লিজ দোস্ত, আমি একটু..”

প্রীতম বাঁধা দিয়ে বলল,” না, না, না! তোর আসা নিষেধ। চুপচাপ ঘরে যা। গেট আউট।”
মুখের উপর ধড়াম করে দরজা আটকে দিল প্রীতম। উষসী কোমড়ে হাত রেখে রাগে কাঁপতে লাগল। এই প্রীতমের পেটে এতো হিংসা! অবশ্য উষসীর একটা বিষয় ভেবে হাসিও পাচ্ছে। যার হাতে ধোলাই খেয়ে প্রীতম হসপিটালে গিয়েছিল এখন তার সাথেই এক বিছানায় ঘুমাবে। বাহ, একেই বলে নিয়তির উপহাস!

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ১৯
লিখা- Sidratul Muntaz

প্রীতম দরজা আটকে ধপ করে বিছানায় বসল। বুকের বামপাশে হাত রেখে হাঁপাতে লাগল। ইয়ামিন বলল,” কি হয়েছে?”

প্রীতম ইয়ামিনের দিকে চেয়ে নরম গলায় বলল,” কি করবো ভাই? ওর সামনে দাঁড়ালেই নর্ভাস লাগে। এতো জোরে হার্টবিট বাড়তে থাকে যে সামলাতেই পারি না। এজন্যই ধমক-টমক দিয়ে কথা বলি। যেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।”

বড় একটা নিশ্বাস ছাড়ল প্রীতম। যেন মাত্র কোনো ভয়ানক কোনো বিপদ থেকে পালিয়ে এসেছে।

ইয়ামিন হাসল। প্রীতমের ছেলেমানুষী তাকে হাসাচ্ছে। আসলে এখন বয়সটাই এমন! ইয়ামিন অবশ্য প্রীতমের বয়সে এমন ছিল না। সে খুব জেদী আর একরোখা ছিল। তার ভুলের জন্যই উষ্ণতাকে কষ্ট পেতে হয়েছে। ইয়ামিন তার অতীতের কথা ভেবে প্রতিনিয়ত কষ্ট পায়। নিজেকে কোনোদিন মাফ করতে পারবে কি সে?

ঠিক রাত বারোটায় তৃষাণ প্রীতমের রুমে এসে দরজায় কড়া নাড়ল। ইয়ামিন তখনও ঘুমায়নি। কিন্তু প্রীতম ঘুমে বিভোর। তাই বাধ্য হয়ে দরজা ইয়ামিন খুলল। তৃষাণকে দেখে সামান্য বিব্রত হয়ে পড়ল সে। রক্তলাল একজোড়া চোখ দিয়ে যেন গিলে খাবে তৃষাণ তাকে। উত্তপ্ত দৃষ্টিতে ইয়ামিনকে দেখতে দেখতে সে ডাকল,” প্রীতম!”

ইয়ামিন নিচু গলায় বলল,” ঘুমিয়েছে ও।”

তৃষাণ এমনভাবে তাকাল যেন ইয়ামিনের কথা বলাও অপরাধ। সে ইয়ামিনকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকল৷ ইয়ামিন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল নির্বিকার হয়ে। তৃষাণ তাকে সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু উষ্ণতার অনুরোধ ঠেঁকিয়ে সে এখান থেকে যেতেও পারছে না। যাকে একবার দেখার জন্য এতো পিপাসার্ত ছিল, তার একটা অনুরোধ রাখবে না?

তৃষাণ প্রীতমকে ডাকার চেষ্টা করছে। তার গাল চেপে ধরে ঝাঁকি মেরে বলল,” ওঠো প্রীতম।”

প্রীতম ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে বলল,” উষু, তুই আবার এসেছিস?”

তৃষাণ রাগী কণ্ঠে বলল,” আমি উষসী না, আমি তৃষাণ ভাই।”

প্রীতম হঠাৎ চোখ খুলে তৃষাণের ক্রোধান্বিত চোখমুখ দেখে ভয়ে ঘাবড়ে গেল,” ভাই, ভাই, আপনি এখানে কি করছেন?”

তারপর আশেপাশে তাকিয়ে বলল,” ইয়ামিন ভাই কই?”

ইয়ামিন তখনও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তৃষাণ ভেতরে আছে বিধায় সে ঢুকছে না। প্রীতমের কানের কাছে মুখ নিয়ে তৃষাণ ফিসফিস করে বলল,” এটাকে ঘর থেকে বের করে দাও। সকালে উঠে যেন আমি ওর চেহারাও না দেখি।”

প্রীতম বিপর্যস্ত গলায় বলল,” মানে ভাই? কি বলছেন? আমি উনাকে কিভাবে বের করবো?”

” ও এখানে থাকলে ওর বিপদ আছে। নিজের ভালো চাইলে যেন সকালের মধ্যে এখান থেকে চলে যায়।”

প্রীতম কিছু না বুঝে তাকিয়ে রইল কেবল। তৃষাণ বলল,” কাজটা যদি করতে পারো তাহলে তোমার পুরষ্কার আছে। পাঁচহাজার টাকা দিবো।”

প্রীতম চোখ বড় করে ফেলল। তৃষাণ তার ওয়ালেট থেকে দুইহাজার বের করে প্রীতমের হাতে গুঁজে দিল। তারপর বলল,” বাকি টাকা কাজ শেষ হওয়ার পর পাবে। তোমার কাছে সকাল পর্যন্ত সময়৷ এর মধ্যেই লাথি মেরে এটাকে বের করবে। আমাদের আশেপাশেও যেন না থাকে। সবচেয়ে ভালো হয় এমন কিছু করলে যেন উষ্ণতা নিজেই ওকে বের করে দেয়। করতে পারবে না এমন কিছু?”

প্রীতম টাকা হাতে নিয়ে বোকার মতো বসে রইল। কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। তৃষাণ প্রীতমের কাঁধে হাত রেখে বলল,” অবশ্যই পারবে। সকালে উঠে যেন এর চেহারাও না দেখি আমি।”

তৃষাণ হিংস্র দৃষ্টিতে ইয়ামিনকের দিকে তাকাল একবার। তারপর বের হয়ে গেল। দরজা আটকে ইয়ামিন বিছানায় এসে বসল। হাসিমুখে প্রশ্ন করল,” বড়ভাই কি বললেন?”

প্রীতম হতভম্ব কণ্ঠে বলল,” আপনাকে ঘর থেকে বের করে দিতে বললেন।”

ইয়ামিন হাসল। প্রীতম বলল,” কাজটা করতে পারলে নাকি আমাকে পাঁচহাজার টাকাও দিবেন। দুইহাজার এডভান্স করে গেছেন।”

ইয়ামিন এবার উচ্চশব্দে হেসে উঠল। প্রীতম চিন্তিত গলায় বলল,” ভাই, ব্যাপারটা সিরিয়াস লাগছে। তৃষাণ ভাই বলেছেন আপনি এখান থেকে চলে না গেলে আপনার নাকি বিপদ আছে।”

” তুমিও তো চাও যে আমি এখান থেকে চলে যাই, তাই না?”

প্রীতমের মুখ শুকিয়ে গেল। সে আসলেই ইয়ামিনকে সহ্য করতে পারছে না। কারণটা হলো উষসী। ইয়ামিন প্রীতমের কাঁধে হাত রেখে বলল,” ডন্ট ওরি। উষসীর মামলায় আমি সাহায্য করব তোমাকে।”

প্রীতম অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাল,” জ্বী ভাই?”

” হুম৷ আমি উষসীকে বোঝালেই ও বুঝবে। আমার কথা ও শুনবে এটা তো তুমি জানোই। তুমি যদি উষসীকে গার্লফ্রেন্ড হিসেবে চাও তাহলে আমার হেল্প তোমার দরকার?”

” জ্বী ভাই, দরকার। অবশ্যই দরকার।”

” তাহলে আমি যা বলছি তা করতে হবে।”

প্রীতম এক নিশ্বাসে বলল,” আমি সব করব ভাই। আপনি আমার গুরু ভাই।”

সে দুইহাজার টাকা রেখে দিয়ে বলল,” আপনাকে বের করার জন্য ঘুষ নিয়েছি। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি পাপী, আমি অধম।”

সে কান ধরে ফেলল। ইয়ামিন প্রীতমের কাঁধ চাপড়ে বলল,” গড ব্লেস ইউ।”

সকালে ব্রেকফাস্টের সময় ইয়ামিনকে দেখেই তৃষাণের মেজাজ সপ্তম আসমানে উঠে গেল। উষসী সেজেগুজে বের হয়েছে। ঠিক ইয়ামিনের পাশে এসেই বসেছে। অতি উৎসাহে আর আহ্লাদে ইয়ামিনকে সে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। এসব দেখে উষ্ণতা আর অনুপমা মুখ টিপে হাসলেও তৃষাণ রাগে ফুঁসছে। সে প্রীতমের দিকে চাইল কঠিন দৃষ্টিতে। ভয়ে প্রীতম ভয়ে চিমসে গেল। তৃষাণ বলল,” এদিকে এসো প্রীতম। তোমার সাথে কথা আছে।”

প্রীতম ইয়ামিনের দিকে তাকাল। ইয়ামিন চোখের ইশারা দিল। সাথে সাথেই প্রীতম বুঝল তাকে কি করতে হবে। সে পকেট থেকে দুইহাজার টাকা বের করে তৃষাণের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,”স্যরি ভাই। কাজটা আমি করতে পারলাম না।”

সবার সামনে প্রীতম টাকা ফেরত দেওয়ায় তৃষাণের মুখ অপমানে থমথমে হয়ে উঠল। উষ্ণতা ভ্রু কুচকে বলল,” কিসের টাকা এটা? প্রীতম, কি কাজের কথা বলছো?”

প্রীতম বলতে নিলেই তৃষাণ ব্যস্ত গলায় বলল,” তেমন কিছু না। ওই একটা জিনিস কেনার জন্য বলেছিলাম। ও মনে হয় খুঁজে পায়নি। ঠিকাছে প্রীতম। লাগবে না। টাকা তোমার কাছে রাখো।”

প্রীতম মুখ মলিন করে বলল,” না ভাই, আপনার টাকা আপনি রেখে দিন। আমি ঘুষ- টুষ রাখতে পারব না।”

ইয়ামিন অন্যদিকে চেয়ে হাসছে। সে যা বলেছিল ঠিক তাই করছে প্রীতম। তৃষাণের দৃষ্টি রক্তিম হয়ে এলো। রাগে ভেতরে ভেতরে ফুঁসলেও মুখে কিছু বলতে পারল না। উষ্ণতা তার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে,” ঘুষ মানে? কিসের ঘুষ?”

প্রীতম সত্যি কথা বলে দিতেই নিচ্ছিল৷ তৃষাণ তাড়াহুড়ো করে বলল,” তেমন কিছু না। তোমরা বুঝবে না।”

উষ্ণতা হাসার ভাণ করে বলল,” তোমার আচরণ আসলেই আমি বুঝতে পারছি না। কাল থেকেই কেমন অদ্ভুত আচরণ করছো৷ রাতে তো ঘুমাতেও দেখলাম না তোমাকে। আমরা বরং বিকালের ফ্লাইটে যাই। তুমি এখন একটু ঘুমিয়ে নাও।”

তৃষাণ ইয়ামিনের দিকে চেয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল,” না।”

যতক্ষণ ইয়ামিন এখানে থাকবে, সে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে না। উষ্ণতা বলল,” কেন?”

” সকালের ফ্লাইটের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। আমরা একটু পরেই বের হবো।”

উষসী প্রথমে বিকালে থাকার ব্যাপারে খুশি হতে নিয়েছিল। কিন্তু তৃষাণের উত্তর শুনেই মনখারাপ হয়ে গেল আবার। ইশ, কেন সবসময় তৃষাণ এমন করে? তার খুশিতে বাগড়া দেওয়াই যেন তৃষাণের প্রধান কাজ।

ফ্লাইটে উঠার আগে উষসী জানতো ইয়ামিন শুধু তাদের সাথে দিল্লি পর্যন্তই যাবে। কিন্তু ফ্লাইটে উঠার পর অনুপমার কাছে শুনল, ইয়ামিন আসলে তাদের সাথে বাংলাদেশেই যাচ্ছে! উষসী অনেকক্ষণ থম মেরে তাকিয়ে রইল। তার দুনিয়া দোলনার মতো দুলছিল। সে কি আসলে স্বপ্ন দেখছিল? নিজের হাতে বড় করে একটা চিমটি কেটে দাগ বানিয়ে ফেলার পর বুঝলো, আসলে স্বপ্ন না! এই সুন্দর সকালটা বাস্তব।

হঠাৎ করেই উষসীর পুরো দুনিয়া অন্যরকম হয়ে গেল। ইয়ামিনকে ছেড়ে যাওয়ার বিষণ্ণতায় ডুবে ছিল সে। আর এখন সবকিছু স্বর্গীয় লাগছে। উষসী তো কিছুক্ষণ আগেও ভাবছিল, ইয়ামিন যখন দিল্লীতে নেমে যাবে তখন সে কাঁদতে কাঁদতে সাগর বানিয়ে ফেলবে। বিরহ বিলাস করবে। তবে এখন আর বিরহ বিলাস না। এখন শুধু হবে সুখ বিলাস। উষসী মনে মনে পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে লাগল। যে পাখি কেবল ইয়ামিন নামক গাছের ডালেই বসতে চায়।

উষসী এতো পাগলামি করছিল যে অনুপমা ওর খুশি দেখে আসল কথাটাই আর বলার সাহস পেল না। এখন যদি সে বলে দেয় যে উষ্ণতা ইয়ামিনের সাথে তার বিয়ের কথা ভাবছে তাহলে মনে হয় এই মেয়ে খুশিতে বেহুশ হয়ে যাবে!

উষসীর পাশের সিটে হঠাৎ প্রীতম এসে বসে পড়ল। রেগে তাকাল উষসী,” খবরদার এখানে বসবি না তুই। যা বলছি!”

” আরে, এমন করছিস কেন? আমি না বসলে কি ইয়ামিন ইব্রাহীম আসবে তোর পাশে বসার জন্য?”

” অবশ্যই সে বসবে। তুই তৃষ্ণার সাথে গিয়ে বস।”

” না। আমি উঠবো না। এটাই আমার জায়গা।”

এবার উষসী নিজেই উঠে গেল। তার উড়ু উড়ু পাখির মতো মনটা শুধুই ইয়ামিন নামক গাছের ডালে ছুটে যেতে চাইছে। কিন্তু লজ্জায় এই কথা কাউকে বলতে পারছে না সে। তারপর উষ্ণতা নিজেই উষসীকে বলল,” উষু, তুই না উইন্ডো সিট চেয়েছিলি? আয় এখানে এসে বোস। উইন্ডো আছে।”

উষসীর হৃৎপিন্ড ছলাৎ করে উঠল। উষ্ণতা আপু কি বলে এইসব? সে তো প্লেনের উইন্ডো সিট ভয় পায়। জানালার দিকে তাকালেই ভয়ে প্রেশার বেড়ে যায় তার। আর এটা তো উষ্ণতা আপুর ভালো করে জানার কথা!তবুও কেন বলছে?

রহস্য জানতে উষসী এগিয়ে গেল। উষ্ণতা যেখানে বসেছে তার দুইধাপ পড়েই একটা উইন্ডো সিটে উষসীকে বসতে বলা হয়েছে। আর পাশেই বসে আছে ইয়ামিন। উষসী খুশিতে টইটম্বুর হয়ে তাকাল উষ্ণতার দিকে। উষ্ণতা তাকে চোখ মারল। উষসী নিজের খুশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সারাজীবন প্লেনের উইন্ডো সিট ভয় পেয়ে আসা মেয়েটা ভালোবাসার টানে সেখানে গিয়েই বসল। মানুষ তো ভালোবাসার টানে অগ্নিপরীক্ষাও দেয়। আর উষসী সামান্য এইটুকু পারবে না?

প্লেন তখনও উড্ডয়ন করেনি। প্রীতম এসে দেখল উষসী ইয়ামিনের পাশে বসে গেছে। আজব তো! তবে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। ইয়ামিন তো বলেছিল তাকে সাহায্য করবে৷ তাই ভয়ের কারণ নেই। সে নিজের সিটে ফিরে এসে ইয়ামিনকে মেসেজ লিখল,” ভাই।”

ইয়ামিন রিপ্লাই করল,”কি?”

” উষসী তো আপনার পাশে বসেছে। ওকে আমার সম্পর্কে একটু ভালো ভালো কথা বলেন। যেন একটু হলেও আমার প্রতি আগ্রহী হয়। মেয়েটা আজকাল আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।”

” ঠিকাছে, বলে দিবো। নো টেনশন।”

প্রীতম স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। ইয়ামিন ফোন রেখে উষসীর দিকে তাকাল। উষসী কেমন কাঁপছে। ইয়ামিন অবাক হয়ে বলল,” কি হলো তোমার?”

উষসী কিছু বলতে পারছে না। বিমান উড্ডয়নের পাঁচমিনিট পূর্বে সবার মোবাইল ফ্লাইট মোডে করতে হলো। তাই প্রীতম আর ইয়ামিনকে মেসেজ করার সুযোগ পেল না। যখন বিমান উড্ডয়নশীল, উষসীর হাত-পা তখন থরথর করে কম্পনশীল। চোখ বুঁজে সে বিভিন্ন দোআ পড়তে লাগল। তার ভয় লাগছে। ভয়ে একদম আধমরা অবস্থা। সে উচ্চতা ভয় পায়, আবার উইন্ডো সিটে উঠেছে।

ইয়ামিন মনে হয় বিষয়টা বুঝতে পেরেই উষসীকে নিজের সাথে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,” এতোই যখন ভয় তাহলে উইন্ডো সিটে কেন বসলে?”

উষসী লজ্জায় একদম লালিমা হয়ে গেল। সে কেন এইখানে বসেছে সেটা ইয়ামিনকে কিভাবে বলবে? উষসীকে কাঁপতে দেখে ইয়ামিন খুব ভয় পাচ্ছে। সে উষসীকে সাহস দেওয়ার জন্য তার মাথা নিজের কাঁধে নিয়ে চেপে ধরল। উষসী চোখ বন্ধ করে ফেলল। মনে মনে বলল,” যেখানে আপনি আছেন, সেখানে আমার কোনো ভয় নেই। আপনার প্রত্যেকটা শব্দ আমার সাহস। আপনার শক্ত একজোড়া হাত আমার অবলম্বন। আর আপনার এই কাঁধটা আমার পরম সম্বল!”

উষসী থরথর করে কাঁপছিল আর ইয়ামিনের কাঁধে মুখ গুঁজে ছিল। ইয়ামিন তার কাঁপাকাঁপি দেখে খুব ঘাবড়ে গেছে। তাইতো আরও ভালো করে ধরে রাখল। যাদের উচ্চতাভীতি আছে তারা অনেক সময় ভয়ে অজ্ঞানও হয়ে যায়। ইয়ামিন উষসীকে সাহস দিতে বিভিন্ন কথা বলতে লাগল। তারপর হঠাৎ ভাবল, প্রীতমকে নিয়েই কিছু বলা যাক। উষসীর ভয়টাও কাটবে। ইয়ামিন ডাকল,” এই উষসী।”

উষসী জড়ানো গলায় শুধু বলল,” হু?”

ইয়ামিন বলল,” প্রীতমের থেকে দূরে থাকবে। বন্ধু হলেও কার মনে কি আছে তুমি কিন্তু জানো না….”

ইয়ামিন তার পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু উষসী এসব শুনছে কই? সে তো বুদ হয়ে আছে ইয়ামিনের গলার কাছে লেগে থাকা পারফিউমের নেশা ধরানো ঘ্রাণে! প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে সে কাতর হয়ে পড়ছে। আহা,এই ঐশ্বরিক মুহুর্ত কোনোদিন শেষ না হোক!

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে