#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ১৬
লিখা- Sidratul Muntaz
এখন প্রায় নয়টা বাজে। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। নিজেকেই দেখা যাচ্ছে না, উষসী পানির দোকান কি করে দেখবে? আর আশ্চর্য ব্যাপার, যে লোক একটা মানুষকে মেরে অবস্থা খারাপ করে ফেলল উষসী তার জন্যই পানি খুঁজতে এসেছে! যদিও ইয়ামিন মেরে কোনো ভুল কিছু করেনি। প্রীতম যেটা করতে যাচ্ছিল সেটাই ভুল ছিল। ইয়ামিন যদি আজ না আসতো, তাহলে প্রীতমের জায়গায় হয়তো উষসীকেই হসপিটালে যেতে হতো! আরেকটু হলেই প্রীতমের অত্যাচারের ভয়ে উষসী বেহুশ হয়ে যাচ্ছিল।
উষসী দৌড়ে ইয়ামিনের কাছে গিয়ে বলল,” আমাদের দ্রুত ওকে হসপিটালে নিতে হবে। নাহলে ওর কিছু হয়ে গেলে আপনি ফেঁসে যাবেন। আমি চাই না এর জন্য আপনার কিছু হোক।”
ইয়ামিন তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো। উষসীকে এইবার ঘাড় উঁচু করতে হলো। ইয়ামিনের চেহারা ভালোমতো দেখার জন্য একটু পিছিয়েও যেতে হলো। লোকটা যে তার চেয়ে দ্বিগুণ লম্বা! ইয়ামিন ভ্রু কুচকে বলল, “পানি পেয়েছো?”
” পানির জন্য বসে থাকলে যদি কেউ দেখে ফেলে? আপনাকে তো পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে।”
” সেসব তোমার ভাবতে হবে না।”
” অবশ্যই আমার ভাবতে হবে।”
ইয়ামিন বিরক্ত গলায় বলল,” কেন?”
উষসীর দৃষ্টি মোহাচ্ছন্ন। সে বিভোর গলায় বলল,” কারণ আমি আপনাকে…” এক মুহুর্ত থামল সে। লম্বা শ্বাস টেনে নিয়ে আবার বলল,” আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। তাই আমিও আপনাকে বাঁচাতে চাই।”
ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” লেটস গো দেন।”
রাস্তায় পড়ে থাকা ব্যাগটা কাঁধে নিল ইয়ামিন। উষসী এতোক্ষণে খেয়াল করল ইয়ামিনের সাথে ব্যাগও আছে। এতোরাতে ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে কোথায় যাচ্ছিল সে?
প্রীতমকে হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এলো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। উষসী আর ইয়ামিনকে ইন্সপেক্টরের সঙ্গে কথা বলতে হলো। ইন্সপেক্টর আফজাল প্রথমেই জানতে চাইলেন,” ছেলেটার এই অবস্থা কিভাবে হলো?”
ইয়ামিন সত্যিটাই বলতে নিচ্ছিল। কিন্তু উষসী তাড়াহুড়োয় উত্তর দিল,” পাহাড় থেকে পড়ে গেছিল ও।”
আফজাল চোখ বড় করে তাকালেন,” ও তাই? পাহাড় থেকে পড়েই এই অবস্থা?”
ইয়ামিন অবাক হওয়া দৃষ্টি নিয়ে তাকাল উষসীর দিকে। উষসী কনফিডেন্সের সাথে মিথ্যা বলল,” জ্বী। আমরা পাহাড়ে উঠেছিলাম। তারপরেই তো এই এক্সিডেন্ট…”
ইন্সপেক্টর আড়চোখে ইয়ামিনকে দেখে বললেন,” পেশেন্টের তাহলে গলায়, মুখে, হাতে স্ক্র্যাচ কিসের? পাহাড় থেকে পড়লে তো এমন হওয়ার কথা না। দেখে মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছে করে মে-রেছে।”
উষসী নিজের উপস্থিত বুদ্ধির প্রয়োগ করল,” কুকুরের ধাওয়া খেয়ে ও পাহাড় থেকে পড়েছে। স্ক্র্যাচগুলো তখনি হয়েছিল।”
ইয়ামিন রাগী দৃষ্টিতে তাকাল। শেষমেষ সে কি-না কুকুর হয়ে গেল? উষসী কোমল হাসি দিল যার অর্থ -” রাগ করবেন না প্লিজ। আপনাকে বাঁচানোর জন্যই তো সব করছি।”
ইন্সপেক্টর বললেন,” আপনি শিউর এগুলো কুকুরের স্ক্র্যাচ?”
উষসী একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। মানুষের স্ক্র্যাচ আর পশুদের স্ক্র্যাচে কি পার্থক্য থাকে? পুলিশ তো বুঝেও ফেলতে পারে!
সে আমতা-আমতা করে বলল,” আমি কখন বললাম যে এগুলো কুকুরের স্ক্র্যাচ? মানে ওকে বাঁচাতে গিয়ে আমাদের হাত থেকেই স্ক্র্যাচ লেগেছে। ইয়ামিন ভাইয়া ওর কলার টেনে ধরেছিল উপরে তোলার জন্য। তাই ওর শার্ট ছিড়ে গেছে দেখুন! আর আমি হাত টেনে ধরেছিলাম। এইতো আমার হাতেও জখমের দাগ আছে!”
প্রথমে প্রীতমের সাথে ধস্তাধস্তি করার সময় উষসীর হাতে জখম হয়েছিল। সেই জখমের দাগটাই দেখানোর চেষ্টা করল সে। ইয়ামিন উষসীর চিকন বুদ্ধি দেখে হতবাক। আফজাল তখনও সন্দেহের দৃষ্টিতে বললেন,”আপনারা এতোরাতে পাহাড়ে কি করছিলেন?”
উষসী কোমড়ে হাত গুঁজে বলল,” আশ্চর্য ব্যাপার! কাশ্মীর তো আমরা ঘুরতে এসেছি, তাই না? দিনে ঘুরবো না রাতে ঘুরবো এটা তো আমাদের চয়েজ। আমরা নিশাচর প্রাণী। তাই রাতে ঘুরতেই বেশি ভালোবাসি। আর আপনি এতো কুয়েশ্চন করলে ডাক্তার ট্রিটমেন্ট করবেন কখন? পেশেন্ট ম-রে যাক সেটাই চান নাকি?”
ইয়ামিন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসল। বাচ্চা একটা মেয়ে, অথচ কেমন ননস্টপ মিথ্যা বলে যাচ্ছে। পুলিশকে পর্যন্ত কথার প্যাঁচে ধরাশায়ী করে দিচ্ছে। আফজাল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,” আচ্ছা, আগে ট্রিটমেন্ট হোক। এই বিষয়ে পরে আরও বিস্তারিত কথা হবে আমাদের। পেশেন্ট সুস্থ হলে আমি আবার আসব।”
উষসী খুব স্বাভাবিক মুখে বলল,” ওকে, আসবেন।”
পুলিশ চলে যাওয়ার পর ইয়ামিন উষসীর দিকে তাকিয়ে হাসল৷ তার খুব ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়ে গেছে। তখন উষসীর কেবল আটবছর।ইয়ামিনের সতেরো। উষসীকে মাঝরাস্তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছিল সে। উষসী হারিয়ে গেছিল। তৃষাণ, উষ্ণতা, সবাই ছোট্ট উষসীকে তন্নতন্ন করে খুঁজছিল। পরে অবশ্য ইয়ামিনই তাকে খুঁজে বের করেছে। কিন্তু তখনও উষসী কাউকে বলেনি ইয়ামিনের জন্যই যে তার বিপদটা হয়েছিল। বরং সে এভাবেই মিথ্যা বলে ইয়ামিনকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। তখন তৃষাণের কাছে মিথ্যা বলেছিল উষসী। আর এখন পুলিশের কাছে বলেছে। প্রত্যেকবারই ইয়ামিনকে বাঁচানোর জন্য।
উষসী ভ্রু কুচকে বলল,” আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে কি ভাবছেন?”
” কিছু না তো!” কাঁধ ঝাঁকালো ইয়ামিন। উষসী চোখ মেরে বলল,” কেমন দিলাম বেটা পুলিশকে?”
ইয়ামিন বলল,” আরেকটু হলেই তো আমাকে কুকুর বানিয়ে দিচ্ছিলে।”
উষসী কানে হাত রেখে বলল,” স্যরি। আমি নর্ভাস হয়ে গেছিলাম। কিভাবে ম্যানেজ করব বুঝতেই পারছিলাম না। কুকুরের ব্যাপারটাই কেন যেন মাথায় আসল।”
” সত্যিটা বললেই হতো।”
উষসী জেদি গলায় বলল,” মোটেও হতো না। আপনাকে পুলিশ থানায় নিয়ে যেতো আর সেটা কি আমি তাকিয়ে দেখতাম?”
ইয়ামিন সামান্য হেসে বলল,” চলো।”
” কোথায়?”
” ক্যান্টিনে। পানি এখনও খাওয়া হলো না আমার।”
” ওহ, স্যরি! ভুলেই গেছিলাম। চলুন, চলুন।”
উষসী ক্যান্টিনে গিয়ে নিজের হাতে ইয়ামিনকে পানি ঢেলে খাওয়ালো। ইয়ামিন ততক্ষণে খাবার অর্ডার করে ফেলেছে। উষসীর নিজেরও খুব ক্ষিদে পেয়েছিল। মনে হচ্ছে কত বছর ধরে না খাওয়া! কাশমীরের কোনো খাবারই উষসীর পছন্দ হয়নি। সব খাবার অতিরিক্ত মশলাযুক্ত। কিন্তু সৌভাগ্যবশত এইখানে বিরিয়ানি পাওয়া গেছে।
ইয়ামিন উষসীকে জিজ্ঞেস করে বিরিয়ানিই অর্ডার করল। হসপিটালের ক্যান্টিনেও যে বিরিয়ানি পাওয়া যাবে উষসী চিন্তাই করেনি। কিন্তু খাওয়ার সময় বোঝা গেল, বাংলাদেশী বিরিয়ানি আর কাশ্মীরি বিরিয়ানির মধ্যে পার্থক্য কতটা!
ইয়ামিন মনে হয় সবকিছুতেই অভ্যস্ত। সে চুপচাপ খাচ্ছে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,” আচ্ছা, ছেলেটার সাথে তোমার ফ্রেন্ডশীপ কয়দিনের?”
” চার-পাঁচবছর!”
” যতই গভীর ফ্রেন্ডশীপ হোক, কাউকে এতোটা বিশ্বাস করা উচিৎ না যে রাতের অন্ধকারে একা রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হবে। তোমার নিজের উপর প্রটেক্টিভ হওয়ার দরকার ছিল। সাথে বড় কাউকে আনলে না কেন? ওই সময় আমি না এলে কি হতো তোমার?”
উষসী মাথা নিচু করে বলল,” আমি ওর সাথে রাস্তায় ঘুরে বেড়াইনি বিশ্বাস করুন। আমাদের হঠাৎ দেখা হয়েছে।”
” তুমি একা একটা মেয়ে মানুষ হয়ে এতোরাতে বের হলেই কেন? দেখছো না এলাকাটা কত নীরব? এটা মোটেও মেয়েদের জন্য সেইফজোন না।”
উষসী এবার কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,” আপনার জন্যই তো বের হয়েছি আমি। এখন আপনিই দোষ দিচ্ছেন?”
” আমার জন্য বের হয়েছো মানে? আমি বলেছি বের হতে?” রেগে তাকাল ইয়ামিন।
উষসী বলল,” আপনি আমাকে শ্যুটিং দেখার জন্য আসতে বলেছিলেন। সেজন্যই তো আমি কত কায়দা করে বের হয়েছিলাম হোটেল থেকে।”
” তাহলে তো তোমার আসার কথা ছিল বিকালে। তুমি সন্ধ্যায় আসবে কেন?”
উষসী চোয়াল শক্ত করে বলল,” আমি সময়মতোই এসেছিলাম। কিন্তু আপনি আমাকে দেখেননি।”
” মানে?”
” কিছু না। বাদ দিন।”
” বলো!”
উষসী অভিমানী গলায় বলল,” আমি আপনার সামনেই দাঁড়িয়েছিলাম। এমনকি কথাও বলেছি। আপনি না দেখেছেন আর না শুনেছেন!”
ইয়ামিন বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,” আই এম স্যরি। হয়তো আমি তোমাকে নোটিশ করিনি। তোমার মতো একহাজার মানুষ ছিল ওখানে।”
উষসী একটু আহত হলো। সে কি সবার মতো? একটুও আলাদা কেউ নয়? ইয়ামিন তাকে নোটিশই করল না!
হঠাৎ করেই হোটেলের কথা মনে পড়ল উষসীর। এখন রাত দশটা বাজছে। সবাই নিশ্চয়ই তাকে খুঁজতে খুঁজতে কাহিল! দ্রুত হোটেলে একটা ফোন করে জানানো দরকার। কিন্তু উষসীর সাথে মোবাইল নেই। সে ইয়ামিনকে বলল,” আপনার কাছে ফোন হবে?”
” হ্যাঁ।”
” আমি মাকে একটা ফোন করবো।”
” ফোন নাম্বার মুখস্ত আছে?”
হয়ে গেল না বিপদ! উষসীর আসলে কারো নাম্বার এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না। চিন্তায় নখে কামড় দিয়ে বলল,” কারো নাম্বারই মুখস্ত নেই। এইবার কি হবে?”
উষসী অস্থির হয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পায়চারী করতে করতে বলল,” সবাই টেনশনে মরে যাবে।”
” রিল্যাক্স! তোমরা যেই হোটেলে উঠেছো সেই হোটেলের নাম মনে আছে?”
” আছে।”
উষসী হোটেলের নাম বলল। ইয়ামিন গুগল সার্চ করে হোটেলের ফোন নাম্বার বের করে দিল। তারপর রিসেপশনে কল করা হলো। রিসিভ করলেন হোটেলের ম্যানেজার। উষসীরা যেই নাম দিয়ে টিকিট বুক করেছিল সেই নামের নাম্বারটা জানতে চাইল ইয়ামিন। ম্যানেজার বললেন,” আপনি কি তৃষাণ স্যারের নাম্বার চাইছেন? কি দরকার আমাকে বলুন?”
উষসী কণ্ঠ শুনেই বুঝে গেল এটা আরশোলা মুখো সেই ম্যানেজারের কণ্ঠ। ঝট করে ইয়ামিনের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলল,” আমার মাকে ডেকে দিন। মায়ের সাথে আমার কথা আছে।”
” আপনি কি উষসী ম্যাম?”
” জ্বী।”
” আগে বলুন আপনি বের হলেন কিভাবে?আপনাকে সবাই কত খুঁজছে জানেন?” লোকটির কণ্ঠে আগুন সমান উত্তাপ।
উষসী ফিচেল হেসে বলল,” আপনিই তো আমাকে বের হতে সাহায্য করেছেন। মনে নেই?”
” হোয়াট? আমি?”
” হুম। আপনার কঠোর তত্ত্বাবধানে থাকার পরেও আমি কিভাবে বের হলাম বলেন তো? যদি না আপনি সাহায্য করেন?”
“মিথ্যে অভিযোগ লাগাবেন না।”
“নিশ্চয়ই লাগাবো। এই মিথ্যে অভিযোগেই আমি আপনাকে ফাঁসাবো যদি আপনি আমাকে হেল্প না করেন।”
” আমি আপনাকে কি হেল্প করবো?”
” সেটা সময়মতো জানবেন। আপাতত আমার পরিবারের মানুষদের জানিয়ে দিন আমি আল-বার্ক হসপিটালে আছি। তারাও যেন এখানে চলে আসে। আমার কিছু হয়নি। তবে প্রীতম একটু আহত হয়েছে।”
উষসী ফোন রেখে ইয়ামিনের উদ্দেশ্যে বলল,” আচ্ছা, আপনি ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন?”
“মুম্বাই।” ইয়ামিন ফোন পকেটে ভরে শান্ত স্বরে জবাব দিল।
উষসী চোখ বড় করে বলল,” মানে? ফিরে যাচ্ছেন নাকি?”
” হুম।”
” কিন্তু আমি তো জানি আপনি কাশ্মীর আরও অনেকদিন থাকবেন! এইখানে আপনার নতুন মিউজিক ভিডিওর শ্যুটিং হবে না?”
ইয়ামিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” মানুষ যা পরিকল্পনা করে তা সবসময় হয় না। মাঝে মাঝে খুব অপ্রত্যাশিত কিছু হয়ে যায়।”
” কি হয়েছে?”
” কিছু না৷ এসব বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এখন। ”
” বলুন না, কামলা সিং এর সাথে কি আপনার শ্যুটিং হবে না? মেয়েটা তো খুব কিউট। জানেন, তাকে অনেকটাই উষ্ণতা আপুর মতো দেখতে লাগে।”
ইয়ামিন হেসে বলল,” তোমার আপুর কাছে কামলা কিছুই না। সে একটা ডিভা। শী ইজ কুইন!” মুগ্ধতা ঝরে পড়ল ইয়ামিনের কণ্ঠ থেকে।
উষসী মুচকি হেসে বলল,” আপনি আপুকে এতো পছন্দ করেন! অথচ আপু মনে হয় আপনাকে চিনতেও পারবে না। ”
উষসীর মনখারাপ হয়ে গেল। ইয়ামিন বিষাক্ত নিশ্বাস ত্যাগ করল। এটাই তো তার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ যে উষ্ণতা কখনও তাকে চিনবে না!
উষসী হঠাৎ বলল,” আচ্ছা, কীর্তি ম্যাডামের সাথে আপনার একটা মিউজিক ভিডিও আসার কথা ছিল না?”
ইয়ামিন কেমন যন্ত্রের মতো বলল,” আসবে না। ”
” তাহলে কার সাথে আসবে?”
” কারো সাথেই না।”
” কেন?”
” কারণ আমি শপথ করেছি, এখন থেকে কোনো মেয়ে কো-আর্টিস্টের সাথে কাজ করবো না। মেয়েদের সংস্পর্শেও যাবো না। মেয়েজাতি বয়কট করলাম।”
উষসী এমন মজার কথা শুনে না হেসে থাকতেই পারল না। ইয়ামিন এমন সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছে তা সে জানে না। তবে তার অদ্ভুত শান্তি লাগছে। ইয়ামিনের পাশে তো এমনিও সে কোনো মেয়েকে সহ্য করতে পারে না৷ আর এখন মেয়েই বয়কট! ওয়াও! উষসী খোঁচানোর উদ্দেশ্যে বলল,” কিন্তু এখনও তো একটা মেয়ের সংস্পর্শেই আছেন আপনি।”
ইয়ামিন ‘চ’ এর মতো বিরক্তিসূচক শব্দ উচ্চারণ করল,” তুমি আর মেয়ে কি এক হলে?”
” মানে? আমাকে কি আপনার মেয়ে মনে হয় না?”
উষসীর কণ্ঠে বিস্ময়! ইয়ামিন হেসে বলল,” মনে হয়। কিন্তু তুমি তো ছোট। বাচ্চা মেয়ে!”
উষসী এই কথা শুনে হতভম্ব। বড় বড় চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ সামনে যেতে লাগল। ইয়ামিন বলল,” কোথায় যাচ্ছো?”
উষসী জবাব দিল না। থামলও না। অনেকটা দূর চলে গেল। একদম হসপিটালের করিডোরে এসে থামল। একবার একটা চেয়ার টেনে বসল৷ তারপর আবার দাঁড়াল। একটুও ভালো লাগছে না তার। আঠারো বছর বয়সেও কেউ বাচ্চা কিভাবে হয় উষসীর মাথায় ঢুকছে না। একটা লোক উষসীর কান্ডকারখানা অবাক হয়ে দেখছিল। উষসী তার কাছে গিয়ে বলল,” আচ্ছা একটা কথা বলুন তো?”
” কেয়া বাত হ্যায়?”
লোকটির মুখে হিন্দি শুনে উষসীও হিন্দিতেই বলল,” আমাকে দেখে আপনার কি মনে হয়? বলতে পারবেন আমার বয়স কত?”
লোকটা উষসীকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল,” আপনি নিজে জানেন না আপনার বয়স কত?”
” জানি। কিন্তু আপনার কি মনে হচ্ছে? আমাকে দেখে কি বাচ্চা মনে হয়? আটবছরের পিচ্চির মতো লাগে?”
” আপনাকে দেখে আটবছর কেন মনে হবে? মনে হচ্ছে আঠারো-উনিশ বছর!”
উষসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,” এই কথাটা একজনকে বুঝিয়ে বলতে পারবেন, প্লিজ? সে আমাকে আটবছর বয়সে দেখেছিল। এখন আবার দেখা হয়েছে। কিন্তু সে এটাই বুঝতে পারছে না যে আমি এখন বড় হয়ে গেছি!”
লোকটা পলক না ফেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কে জানে? মনে হয় উষসীকে পাগল ভাবছিল!
চলবে
#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ১৭
লিখা- Sidratul Muntaz
হসপিটালে ঢুকেই যুথি উষসীকে জোরে একটা থাপ্পড় মা-রলেন। পরিবারের সবার সামনে এমনকি ইয়ামিনের সামনেও জোরালো চড় খেয়ে উষসীর তেমন কোনো ভাবান্তর হলো না। হোটেল থেকে পালিয়ে সে প্রায় চার-পাঁচঘণ্টা সবাইকে যে পরিমাণ হয়রানি করেছে সে তুলনায় এমন হালকা-পাতাল কয়েকটা চড় কিছুই না!
চড় খেয়ে গালে হাত রেখে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উষসী হাসল। উষ্ণতার দিকে ফিরে প্রশ্ন করল,” আপু, তোমরা না পেহেলগাম গিয়েছিলে? এতো জলদি ফিরে এলে কেন?”
উষ্ণতার গা জ্বলে যাচ্ছে রাগে। দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে গেছিল সেও। ফট করে চড় মারল উষসীর অন্যগালে। ধমক দিয়ে বলল,”সবকিছুই কি ফাজলামি পেয়েছিস তুই? কোন সাহসে হোটেল থেকে বের হলি?”
চড়ের ধাক্কায় উষসীর মুখ ঘুরে গেল তৃষাণের দিকে। এবার সে হেসে তৃষাণকে বলল, ” তৃষাণ ভাইয়া,আমাকে নিয়ে খুব টেনশনে পড়ে গিয়েছিলে নাকি তোমরা? অযথাই টেনশন করেছো। দেখো, আমার কিন্তু কিছুই হয়নি!”
তৃষাণের খুব মেজাজ খারাপ হলেও সবার মতো উষসীকে চড় মারল না সে। মেঘের মতো গম্ভীর কণ্ঠে বলল,” আমি এতো নিষেধ করার পরেও তুমি কোন সাহসে হোটেল থেকে বের হয়েছো? কিছু হয়নি বুঝলাম। কিন্তু যদি হয়ে যেতো?”
উষসী ফিক করে হেসে ফেলল। ওর আচরণে প্রত্যেকে বিস্মিত। সবচেয়ে বেশি ইতস্ততবোধ করছে ইয়ামিন।
উষসীকে পরপর দুইবার চড় খেতে দেখে কিছুটা ভড়কেও গেছে সে। তাছাড়া এমন পারিবারিক ব্যাপারের মধ্যে নিজেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বস্তু মনে হচ্ছে। তার কি এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা উচিৎ? বার বার নজর চলে যাচ্ছে উষ্ণতার দিকে। হৃদয়ে শুরু হয়েছে অস্বাভাবিক আলোড়ন।
একবার সে ভাবল এখান থেকে সরে যাবে। কিন্তু এখনও কেউ তাকে লক্ষ্য করেনি। সরতে গেলেই বোধ হয় লক্ষ্য করবে। ইয়ামিন কারো নজরবন্দী হতে চায় না। তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল এক কোণায়। খুব সাবধানে নিজের গলায় ঝুলানো মাস্কটা মুখে পরে নিল। কেউ যাতে তার দিকে তাকালেও সে অস্বস্তিবোধ না করে।
ডোনা কাছে এসে উষসীর মাথাটা বুকে নিয়ে বললেন,” আহারে! আমার সোনা মেয়েটাকে এভাবে মারছো কেন তোমরা? ফরসা টসটসে গালে দাগ পড়ে গেলে কেমন হবে?”
তৃষাণের জিদ উঠে গেল মায়ের কথা শুনে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” তোমার আশাকারা পেয়েই ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।”
ডোনা অবাক হয়ে বললেন,” আজব! আমি কি করলাম? তোরা সবাই মিলেই না মেয়েটার উপর হামলে পড়েছিস। আচ্ছা ওর কি নিজের শখ-আহ্লাদ বলতে কিছু নেই? আমাদের দুই বুড়ির সাথে সারাদিন বসে বোর হচ্ছিল বলেই তো প্রীতমের সাথে একটু বাইরে গিয়েছিল।”
তৃষাণ চোখ ছোট করে বলল,” প্রীতমের সাথে বাইরে গিয়েছিল মানে? আব্দুল তো আমাকে অন্যকথা বলল! ”
” ওই মেনেজারের কথা কি তুই আমার চেয়ে বেশি বিশ্বাস করিস? আমি নিজের চোখে দেখেছি প্রীতম এসে উষসীকে নিয়ে গেছে। উষু তো যেতেই চায়নি।”
ডোনার মিথ্যা শুনে উষসী চোখ পিটপিট করে তাকাল। তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে ভালো আন্টি তাকে বাঁচানোর জন্য আদরের ছেলের সাথে এই ভাবে মিথ্যা বলছে! কিন্তু তৃষাণও এতো সহজে মিথ্যা গেলার পাত্র নয়।
রাগী গলায় বলল,” তাহলে তুমি এতোক্ষণ এই কথা না বলে এখন বলছো কেন? আমরা সবাই যে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হলাম?”
” আমার মনে ছিল না। এখন উষুকে দেখে মনে পড়েছে।”
ডোনা কথা শেষ করে অন্যদিকে তাকাল। তৃষাণের সন্দেহী দৃষ্টি তার মায়ের মুখের দিকে। ছেলের চোখে চোখ মিলিয়ে মিথ্যে বলতে পারেন না ডোনা। ঠিকই ধরা পড়ে যাবেন।
উষসীর বেশ মজা লাগছে সিচুয়েশনটা। ডোনা আলগোছে উষসীকে ইশারাও দিলেন। উষসী সাথে সাথে ঘাড় নাড়িয়ে বলল,” হ্যাঁ, তাইতো। প্রীতম জোর করছিল বলেই না আমি বের হয়েছি। বিশ্বাস না হলে মেনেজার আব্দুল ভাইকে ফোন করে জিজ্ঞেস করো! উনি নিশ্চয়ই আমার সামনে তোমাকে মিথ্যে বলবেন না।”
তৃষাণ যেন তৈরীই ছিল।সে সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে ফোন নিয়ে আব্দুলকে কল দিল। ওই পাশ থেকে আব্দুল বলল,”হ্যালো স্যার।”
” আব্দুল, আমি কি শুনছি এসব? উষসী নাকি প্রীতমের সাথে বের হয়েছিল?”
” না তো স্যার!”
তৃষাণ কঠিন দৃষ্টিতে উষসীর দিকে তাকাল। উষসী ফোনটা তৃষাণের থেকে নিয়ে বলল,” মিথ্যে বলছেন কেন আব্দুল ভাই? হুম? আমি কিন্তু মিথ্যা অভিযোগ করিনি। আপনার অনুমতি নিয়েই বের হয়েছিলাম তাই না? বলুন, আপনার মনে নেই?”
” স্যরি ম্যাম। আমার মনে পড়ছে না।”
” তাহলে আপনার কি মনে পড়ছে বলুন? আমাকে একা বের হতে দেখেছেন আপনি? অথবা পালাতে দেখেছেন? প্রমাণ করতে পারবেন?”
আব্দুল চুপ হয়ে গেল। উষসীকে সে আটকাতে পারেনি এটা তার গাফিলতি। তৃষাণ বলল,” কি ব্যাপার আব্দুল? তুমি চুপ কেন?”
আব্দুল একটু পর বলল,” আমার এখন মনে পড়েছে স্যার। ম্যাম আসলে প্রীতম স্যারের সাথেই বের হয়েছিলেন। প্রীতম স্যার বললেন আপনিই নাকি বলেছেন উষসী ম্যামকে নিয়ে যেতে।”
তৃষাণ এবার চমকে গেল। আশ্চর্য! আব্দুল হঠাৎ এমন পল্টি খাচ্ছে কেন? সন্দিহান চোখে আবার উষসীর দিকে তাকালো তৃষাণ। উষসী চোখ পিটপিট করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। তৃষাণ রেগে বলল,” এই কথা তুমি এতোক্ষণ বলোনি কেন আব্দুল?”
” এক্সট্রিমলি স্যরি, স্যার। আমার মনে পড়ছিল না। এইমাত্র ম্যামের কথা শুনে মনে পড়েছে।”
” সবার কেন এখনি সব মনে পড়ছে? আশ্চর্য! ”
তৃষাণ ফোন রেখে উষসীর দিকে তাকাল,” যাই হোক, না বলে বের হয়ে একদম ঠিক করোনি তুমি। এই ব্যাপারে পরে কথা হবে। এখন বলো প্রীতমের কি অবস্থা?”
” ডাক্তার জানে!” উষসী দায়সারাভাবে উত্তর দিল। তৃষাণ আহমেদকে বলল,” চলো তো আহমেদ, শুনে আসি ডাক্তার কি বলে।”
যাওয়ার আগে তৃষাণ উষসীকে আরও একবার শাসিয়ে গেল,” তোমার সাথে এই ব্যাপারে পরে আবার কথা হবে। উষসী। সত্যিটা আমি বের করেই ছাড়ব।”
উষ্ণতা আফসোস করে বলল,” ছেলেটা আমাদের সাথে কেমন বিপদে পড়ল। ওর বাবা-মা জানলে কি ভাববে? ইশ…”
উষসী বলল,” আমার তো মনে হয় ওর সাথে ঠিকই হয়েছে। ও এটাই ডিজার্ভ করে।”
” একটা চড় মা-রব।” যুথি রেগে গেল উষসীর কথায়।
উষ্ণতা কঠিন গলায় বলল,” এটা কোনো মজা করার বিষয় না উষু। যদি আরও খারাপ কিছু হতো? ঘটনা ঘটল কিভাবে?”
উষসী সহজ গলায় বলল,” এক্সিডেন্ট হয়েছে। পাহাড় থেকে পড়ে গেছিল প্রীতম।”
” তোরা পাহাড়ে উঠেছিলি নাকি?” যুথি ভয়ে আৎকে উঠলেন। উষসী কিছু বলার আগেই অনুপমা চেঁচিয়ে উঠলো,” ওমা, এটা কে গো?”
সবার নজর এবার স্থির হলো ইয়ামিনের দিকে। ইয়ামিন কি বলবে বুঝতে না পেরে মাস্কটা খুলল। যেহেতু সবাই কৌতুহল নিয়ে তাকাচ্ছে, মাস্ক না খুললে অভদ্রতা হয়।
ইয়ামিন মাস্ক খোলা মাত্রই সবার কৌতুহল বিস্ময়ে পরিণত হলো। ইয়ামিন উদ্দেশ্যহীনভাবে সবাইকে সালাম দিল। অনুপমা তাক লেগে তাকিয়ে রইল। উষ্ণতা সামান্য হেসে বলল,” চেনা চেনা লাগছে। কে যেন তুমি?”
উষসী মাথা নিচু করে বলল,” একসময় তোমার স্টুডেন্ট ছিল আপু। কিন্তু এখন মুম্বাইয়ের পপুলার সিংগার। ইয়ামিন ইব্রাহীম।”
উষ্ণতা আশ্চর্য গলায় বলল,” তাই নাকি? আমার স্টুডেন্ট তুমি? মনে পড়েছে, প্রিয়ন্তী আপু তো প্রায়ই তোমার কথা বলে আমাকে। মা, আপনি চিনতে পেরেছেন?”
ডোনার দিকে প্রশ্ন নিয়ে তাকালো উষ্ণতা। ডোনা বললেন,” হ্যাঁ, হ্যাঁ! চিনতে পেরেছি তো। প্রিয়ন্তীর কাজিন হয়। শিমলা আপার ছেলে না তুমি?”
যুথি বেগম বললেন,” তুমি তো দেখছি আগের মতোই আছো একদম। শুধু এখন মনে হচ্ছে হাত-পা গুলো আগের চেয়েও লম্বা হয়ে গেছে!”
এই কথায় সবাই একসাথে হেসে ফেলল। ইয়ামিনের চোখেমুখে প্রকান্ড অস্বস্তি। উষ্ণতার সামনে এলে এমন একটু-আধটু অস্বস্তি লাগবে এটা সে আগেই জানতো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা এতো সহজ না। ক্ষণে ক্ষণেই পুরনো স্মৃতি সব মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। যা বেশিক্ষণ মোকাবিলা করা কঠিন! উষ্ণতা উষসীর উদ্দেশ্যে বলল,” তুই ওকে পেলি কোথায়?”
” এইখানে উনি মিউজিক ভিডিও’র শ্যুটিং এ এসেছিলেন। তারপর কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গেছে।”
উষ্ণতা সন্দিহান গলায় বলল,” আসলেই কি কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়েছে? নাকি…”
উষসী লাজুক গলায় বলল,” মানে আমারও দেখা করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আসলেই কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়েছে বিশ্বাস করো।
উষ্ণতা ফিচেল হাসি দিয়ে বলল,” আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। উনার ছবিই তো তুই বালিশের তলায় নিয়ে ঘুমাস, তাই না?”
এই কথা শুনে উষসী লজ্জায় কোথায় মুখ লুকাবে বুঝতে পারল না। রেগে বলল,” আপু প্লিজ, এইসব মিথ্যা কথা।”
বাকিরা সবাই হাসছে। শুধু হাসল না ইয়ামিন। সে তো উষ্ণতার কথাটাও বোঝেনি। কেবল তৃপ্ত দৃষ্টিতে দেখছে উষ্ণতাকে, উষ্ণতার হাসি মাখা মুখ, কতদিন পর!
উষ্ণতা ইয়ামিনের উদ্দেশ্যে বলল,” আমার বোন কিন্তু তোমার বিগ ফ্যান! ও এমনিতেই একটু পাগল, তোমার জন্য পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে।”
উষসীর এতো লজ্জা লাগছিল! উষ্ণতার বাহু খামচে ধরে বলল,” আপু প্লিজ তুমি চুপ করো, আল্লাহর দোহাই!”
অনুপমা টুশকি মেরে বলল,” উফ, দেখো উষুরানীর গাল কেমন লাল হয়ে যাচ্ছে!”
সবাই হাসতে লাগল। উষসীর লজ্জায় মরি মরি অবস্থা!তৃষাণ ডাক্তারের সাথে কথা বলতে বলতে করিডোরে আসছিল। তখনি উষ্ণতা তাকে ডাকল,” এই, এদিকে শুনে যাও প্লিজ।”
তৃষাণ এগিয়ে এলো। উষ্ণতার সামনে ইয়ামিনকে দাঁড়ানো দেখেই থমকে গেল তার পা। উষ্ণতা হাসি-খুশি কণ্ঠে বলল,” দেখোতো, চিনতে পারো কি-না! মনে আছে ওর কথা?”
“হু?” তৃষাণ অপ্রস্তুত হলো। যেন চিনতেই পারছে না।
অথচ সে প্রথম দেখাতেই চিনতে পেরেছে এবং খুব ভালোমতোই তার মনে আছে। সব মনে আছে। ভেসে উঠল সেই কালোরাত্রির স্মৃতি। যেই রাতে তৃষাণের পৃথিবী উলোটপালোট হয়ে গেছিল। নিজের চোখে ইয়ামিন আর উষ্ণতাকে কিস করতে দেখেছিল সে! তারপর আরও কত বীভৎস স্মৃতি! সেসব ভাবলেও গা কাটা দেয়।
কিছু মানুষ যতই চোখের আড়ালে থাকুক, তাদের কখনও ভোলা যায় না। ইয়ামিন হলো তৃষাণ-উষ্ণতার জীবনের এমন একজন মানুষ, যাকে কখনও ভোলা যায় না। উষ্ণতা ভুলে গিয়ে বেঁচে গেছে, কিন্তু তৃষাণ তো ভুলতে পারেনি।
উষ্ণতা খুব আত্মগৌরব নিয়ে বলল,” আমার ছোটবেলার স্টুডেন্ট ছিল ও। এখন বিখ্যাত সিংগার ইয়ামিন ইব্রাহীম হয়েছে। প্রিয়ন্তী আপু মাঝে মাঝে বলতো না?মনে নেই তোমার?”
তৃষাণ ঘাড় নাড়িয়ে বলল,” ও হ্যাঁ… মনে পড়েছে। কিন্তু ও এইখানে কিভাবে?” জোর করে মুখে হাসি এনে প্রশ্নটা করল তৃষাণ।
উষ্ণতা উষসীকে ইশারা করে বলল,” উষসীর সাথে কাশ্মীরে আসার পর ওর দেখা হয়েছে। উষু তো ওর বিগ ফ্যান! তুমি জানো নিশ্চয়ই? ”
তৃষাণ ঘাড় ঘুরিয়ে উষসীর দিকে তাকালো। সাথে সাথে উষসী ভয়ে উষ্ণতার পেছনে লুকিয়ে গেল। তৃষাণ নিজের রাগ সামলে মাথা দুলিয়ে বলল,” হ্যাঁ.. জানি।”
” শুধু হ্যাঁ হ্যাঁ করছো কেন? ওর সাথে পরিচিত হও। ইয়ামিন, এটা আমার হাসব্যান্ড।”
ইয়ামিন কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল,” ভালো আছেন?”
তৃষাণ শক্ত চোখে ইয়ামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে উত্তর দিল,” হুম। নাইস টু মীট ইউ।”
তারপর হাত বাড়াল হ্যান্ডশেকের উদ্দেশ্যে। ইয়ামিনও হাত বাড়ালো। দু’জন হ্যান্ডেশেক করছিল ঠিকই, কিন্তু অদ্ভুতভাবে একে-অন্যের দিকে তাকিয়ে ছিল কয়েক সেকেন্ড। না ইয়ামিন কোনো কথা বলল আর না তৃষাণ! তবে মনে মনেই তাদের মধ্যে ভয়ানক প্রলয়ের ঘোষণা শুরু হয়ে গেল।
একজন নার্স এসে জিজ্ঞেস করলেন,” এইখানে উষসী কে আছেন?”
উষসী বলল,” এইতো আমি।”
” পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। শুধুমাত্র আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন তিনি।”
উষসী কেমন আতঙ্কিত হয়ে ইয়ামিনের দিকে তাকালো। ইয়ামিন চোখের ইশারায় অনুমতি দিল। তখন উষসী যেতে রাজি হলো। এই ব্যাপারটা অনেকেই খেয়াল করল। বিশেষ করে তৃষাণের চেহারা গম্ভীরের চেয়েও গম্ভীর হয়ে এলো। ইয়ামিন আর উষসীর মধ্যে গোপন কি চলছে?
উষ্ণতা আর অনুপমা ব্যাপারটা খেয়াল করে একে-অন্যের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। তারা নিজেদের মতো কিছু ভেবে খুশিও হয়ে গেল।
উষসী প্রীতমের কেবিনে ঢুকতে খুব ভয় পাচ্ছিল। ভয়ে তার পা কাঁপতে লাগল। প্রীতম যদি আবার তখনের মতো পাগলামি করে? একবার উষসীর ইচ্ছে করল নার্সের হাত ধরে বলতে,” সিস্টার, আপনিও আমার সাথে ভেতরে থাকবেন প্লিজ?”
উষসী কেবিনে ঢোকার আগেই ডাক্তার বের হলো।
” ওহ, আপনি পেশেন্টের কে হোন?”
উষসী নরম গলায় বলল,” বন্ধু।”
“আচ্ছা শুনুন, পেশেন্ট এক্সিডেন্টের আগে প্রচুর নেশাদ্রব্য পান করেছিল। এখন থেকে তার নেশা করা কিন্তু নিষেধ।”
উষসী যেন আকাশ থেকে পড়ল,” কি? প্রীতম নেশা করেছিল?”
” হ্যাঁ। বিশ্বাস না হলে এইযে দেখুন। অ্যালকোহল টেস্ট করানো হয়েছে। ” ডাক্তার একটা ফাইল এগিয়ে দিল। উষসীর মাথা ভনভন করছে। সে ফাইলটা হাতে নিয়ে কেমন স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। ডাক্তার আরও অনেক কথা বলছেন। কিন্তু উষসীর মস্তিষ্কে আটকে গেছে এই একটি কথাই। প্রীতম নেশা করেছিল! ওহ গড! এজন্যই বুঝি তার আচরণ তখন এতোটা অসংলগ্ন ছিল? অথচ উষসী ভেবেছিল প্রীতম ইচ্ছে করে তার সাথে অসভ্যতা করেছে। এখন নিশ্চয়ই প্রীতমের তখনের কথা কিছু মনে নেই। কিন্তু উষসী ভুলবে কি করে?
ডাক্তারের সাথে কথা শেষ করে উষসী চুপচাপ বেরিয়ে এলো। প্রীতমের সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। হঠাৎ খুব কান্না পেয়ে গেল। উষসী দৌড়ে একটা নীরব জায়গায় এসে স্থির হলো। বেশ কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল উষসী। হঠাৎ পেছন থেকে কারো আওয়াজ কানে এলো,” হোয়াট হ্যাপেনড?”
উষসী ঘুরে দেখল ইয়ামিন দাঁড়িয়ে আছে। তার কান্নার জোর এবার আরও বেড়ে গেল। ইয়ামিন ব্যগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে উষসী? প্রীতম আবার কিছু করেছে তোমার সাথে?”
ইয়ামিন প্রচন্ড রেগে প্রীতমের কেবিনের দিকে যেতে নিচ্ছিল। উষসী তাকে থামিয়ে বলল,” দাঁড়ান। ও কিছু করেনি। আমি এখনও ওর সাথে দেখা করতেও যাইনি।”
ইয়ামিনের দৃষ্টি কোমল হলো। কণ্ঠ নরম হলো,” তাহলে কেন কাঁদছো?”
উষসী চোখের জল মুছতে মুছতে খুব শান্ত কণ্ঠে বলল,” ভেবেছিলাম, প্রীতমের সাথে দেখা হলেই তাকে একটা কষে চড় মারবো। ও যেই কাজ করেছে তারপরেও ওর সাথে কোনো বন্ধুত্ব রাখার রুচিই আমার হচ্ছিল না। কিন্তু ডাক্তার বললেন, এক্সিডেন্টের আগে নাকি সে নেশাক্ত ছিল। মানে আপনি বুঝতে পারছেন?”
” কি?”
” মানে প্রীতম নিজের ইচ্ছায় কিছু করেনি। তার বোধহয় এখন কিছু মনেও নেই। অর্থাৎ আমি চাইলেও তাকে এই বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না।”
ইয়ামিন চুপ হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছে উষসী এই বিষয়ে অনেকটাই বোকা। নেশা করলেই যে মানুষ খারাপ কাজ করে, এমন তো না। যার ভেতরটা আসলেই খারাপ, নেশা করার পর সেটা বের হয়ে আসে। প্রীতম তখন উষসীর সাথে যে অন্যায় করতে যাচ্ছিল সেটাই তার মানসিকতা। এটা উষসী বুঝতে পারছে না। যদি বুঝতো, তাহলে এভাবে বোকার মতো কাঁদতো না।
সে আলতো করে উষশীর কাঁধে হাত দিয়ে বলল,” তাহলে তো তোমার খুশি হওয়া উচিৎ। প্রমাণ হয়ে গেল যে প্রীতম জেনে-বুঝে অন্যায় করেনি। তুমি কাঁদছো কেন?”
হঠাৎ ইয়ামিন এতো কাছে আসায় উষসী এলোমেলো হয়ে গেল। তার মনখারাপ, কান্না, সব কোথায় যেন হারিয়ে গেল। মিষ্টি অনুভূতি আচ্ছন্ন করল তাকে। মোহগ্রস্ত হয়ে ইয়ামিনের দিকে তাকাল। ইয়ামিন তার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,” ডন্ট ক্রাই। এখানে তোমার একদম দোষ ছিল না। যা হয়েছে ভুলে যাও। কিন্তু তবুও প্রীতমের থেকে সাবধানে থাকা ভালো। ”
উষসী কোনো কথা না বুঝেই শুধু মাথা নাড়ল। নিজের মনে বিভোর হয়ে বলল,” আপনি নিজের হাত দিয়ে আমার অশ্রু মুছে দিয়েছেন, তাই আমি আর কখনও কাঁদবো না! শুধু আমাকে কখনও ছেড়ে যেয়েন না, প্লিজ।”
চলবে