আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-১৪+১৫

0
522

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ১৪
লিখা- Sidratul Muntaz

উষসী কিছুতেই হোটেল থেকে বের হতে পারবে না। তাকে সত্যি ঘরবন্দী করে রাখা হয়েছে। ম্যানেজার আব্দুল একটু পর পরই এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন। উষসী ঠিক করেছে আরেকবার যদি তিনি সামনে আসেন তাহলে লোকটার মাথায় গরম পানি ঢেলে দিবে। বদলোক একটা! তার ব্যবহার আরশোলার থেকেও খারাপ। আরশোলার মতো তাকেও যদি স্প্রে মেরে ভস্ম করে দেওয়া যেতো! পোকা-মাকড় দূর করার স্প্রে আছে তাহলে মানুষ দূর করার স্প্রে নেই কেন?

উষসী ঘরের এই মাথা থেকে ওই মাথা পায়চারী করছিল অস্থির ভঙ্গিতে। বিকাল পাঁচটা বাজতে যাচ্ছে তখন। ডোনা এবং যুথি অন্যরুমে গিয়েছিলেন নামায পড়তে। তারা নামায শেষে ঠিক করলেন হাঁটতে বের হবেন। উষসী এতোক্ষণে আশার আলো দেখতে পেল।

যুথি আর ডোনার কাছে হাতজোড় করে উষসী অনুরোধ করল, ” আমার মিষ্টি মা, আমার মিষ্টি ভালো আন্টি, প্লিজ আমাকেও তোমাদের সাথে নিয়ে যাও।”

ডোনা ও যুথি একে-অপরের দিকে চেয়ে হেসে ফেললেন। ডোনা বললেন,” তুই আমাদের সাথে গিয়ে কি করবি? আমরা দুই বেয়াইন সুখ-দুঃখের আলাপ করবো আর হাঁটবো। তুই বোর হবি আমাদের আলাপ শুনতে।”

উষসী মনে মনে বলল,” তোমাদের আলাপ শোনার ইচ্ছেও আমার নেই। আমাকে শুধু একবার এখান থেকে বের হতে দাও৷ আমার খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!”

মুখে বলল,” কোনো সমস্যা নেই। ঘরে বসে আমি এমনিও বোর হচ্ছিলাম। বাইরে গিয়ে তোমাদের সাথে হাঁটবো৷ শরীর চাঙ্গা লাগবে।”

যুথি বললেন,” ভালো কথা। তোর না জ্বর? তুই বাইরে কিভাবে যাবি? এখন কত ঠান্ডা জানিস?”

” সমস্যা নেই। আমার জ্বর ভালো হয়ে গেছে। এই দেখো, কপাল ঠান্ডা, গলা ঠান্ডা, আমি ঠিক হয়ে গেছি মা। প্লিজ নিয়ে যাও না আমাকে! তোমার পায়ে পড়ি।”

উষসী সত্যি সত্যি পায়ে ধরার জন্য এগিয়ে এলো। ডোনা বাঁধা দিয়ে বললেন,” আরে, আরে, কি করে পাগলিটা? ঠিকাছে চল। আমরা দুইজন যে যাবো একটা পাহারাদারও তো দরকার। তুই না হয় আমাদের পাহারা দিবি। ঠিকাছে?”

কথা শেষ করে হেসে ফেললেন ডোনা। উষসী আনন্দে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” ওকে।”
উষসী আবার আগের মতো নীল শাড়ি, গোলাপী ব্লেজার পরে সুন্দর করে সাজল। এবারের সাজটা আগের চেয়েও বেশি ভালো হলো। কিন্তু বের হওয়ার সময় আব্দুল নামের ম্যানেজার বাঁধ সাধতে এলেন। উষসীকে দেখেই তিনি সামনে এসে বললেন,” কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

উষসী হাত ভাঁজ করে অন্যদিকে তাকাল। লোকটির আচরণ দেখে মনে হচ্ছে যেন তারা জেলখানার কয়েদী। এই মাথা থেকে ওই মাথায় যেতেও প্রধানমন্ত্রীর সিগনেচার করা অনুমতিপত্র লাগবে। কি আশ্চর্য!

ডোনা বললেন,” এইতো বাইরে যাচ্ছি ভাই। একটু হাঁটতে বের হতাম।”

আব্দুল ভাই বললেন,” আপনারা যান সমস্যা নেই। কিন্তু উনি কোথায় যাচ্ছেন? উনার তো বের হওয়া নিষেধ। ”

উষসী চোখ বড় করে বলল,” এক্সকিউজ মি, আমার মা মানে আমার গার্ডিয়ানের সাথে বের হচ্ছি। আপনি কে আমাকে আটকানোর?”

” নিষেধ আছে। শুধু গার্ডিয়ান কেন? গার্ডিয়ানের চৌদ্দ গুষ্টি এলেও বের হতে দেওয়া যাবে না। যতক্ষণ না স্যার পারমিশন দিচ্ছেন।”

” দেখেছো মা, কত্তবড় সাহস? একটা থাপ্পড় দাও। কষে একটা থাপ্পড় দাও এই অভদ্র লোককে!”

শেষ কথাটা উষসী ফিসফিসিয়ে যুথির কানে কানে বলল।

যুথি বেগম মুখে আঙুল ঠেকিয়ে বললেন,” চুপ, বেয়াদব! আসলে বাবা, আমরা তো জানতাম না। কে নিষেধ করেছে ওকে বের হতে?”

” তৃষাণ স্যার।”

উষসী কপালে হাত ঠেকালো। শেষ, খতম, ফিনিশ! তৃষাণের নাম বলা হয়েছে মানে এখন ভূমিকম্প হয়ে গেলেও মা অথবা ডোনা আন্টি উষসীকে হোটেল থেকে বের হতে দিবেন না। এতে যদি তার মৃত্যু হয়, তাও হোক!

ডোনা ও যুথি সম্মিলিতভাবে উষসীকে বোঝাতে শুরু করল। তৃষাণ যখন বলেছে, ভালোর জন্যই বলেছে। উষসীর জন্য বাইরে বের হওয়া ঠিক না। তারা উষসীকে রেখেই বের হয়ে গেল। মানে যেই লাউ সেই কদু। বিচার মানেই তালগাছ আমার!

উষসী তবুও হার মানার পাত্রী নয়। তার ভেতরে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ চলছে। হঠাৎ মাথায় একটা খুব সহজ-সরল বুদ্ধি এলো। আচ্ছা, এতো ভালো বুদ্ধিটা সে আগে ভাবেনি কেন?

যুথি বেগম সবসময়ই বোরখা পরেন। এবারও তিনি রঙ-বেরঙের বোরখা নিয়ে এসেছেন। সেই বোরখা আছে উষ্ণতাদের রুমের লাগেজে। উষসী যদি কোনোভাবে সেখান থেকে বোরখাটা চুরি করে নিজের গায়ে পরে তারপর হোটেল থেকে বের হয়, কেউ নিশ্চয়ই তাকে চিনতে পারবে না। ওই আরশোলা মুখো আব্দুল ভাইও দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করবে না, ” আরে, আরে, যাচ্ছেন কই? আপনার তো বের হওয়া নিষেধ! ”

যেই ভাবা সেই কাজ! যেহেতু কোনো চেষ্টাই কাজে লাগছে না, এই শেষ একটা ছোট্ট চেষ্টা করে দেখাই যাক! উষসী উষ্ণতাদের রুমে ঢুকে লাগেজ থেকে বোরখা চুরি করল। তারপর সেটা নিয়ে হোটেলের ওয়াশরুমে চলে গেল। সে চাইলে নিজের রুমে বসেই চেঞ্জ করতে পারতো। কিন্তু নিজের রুম থেকে বোরখা পরে বের হলে ম্যানেজার আব্দুল সন্দেহ করবে। তার শকুনি দৃষ্টি তো সর্বদা উষসীর রুমের দিকে নিবদ্ধ থাকে। উষসী বোরখা-নিকাব, হাতমোজা,পা মোজা পরে যখন বের হলো, তখন ম্যানেজার আব্দুল আশেপাশে কোথাও নেই৷ উষসী লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোতে লাগল। তারপর আচমকা ধাক্কা খেল ম্যানেজার আব্দুলের সাথে। উষসীর হৃৎপিন্ড ছলাৎ করে লাফিয়ে উঠল।

আব্দুল ভাই উষসীকে ‘স্যরি” বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। অর্থাৎ চিনতেই পারলেন না৷ উষসী বড় করে একটা শ্বাস ছেড়ে আরও দ্রুত হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে একেবারে হোটেলের বাহিরে চলে এলো। কেউ বাঁধাও দিল না আবার কিছু জিজ্ঞেসও করল না। সন্দেহী দৃষ্টিতে একবার তাকাল পর্যন্ত না! উষসীর ইচ্ছে করছে বোরখাটা খুলে এখানেই ধুম-ধারাক্কা নাচতে! কিন্তু এতো নিয়ন্ত্রণ হারালে তো চলবে না। উষসী বোরখা খুলবে একদম গন্তব্যে পৌঁছানোর পর। ফিরে আসার সময়ও বোরখা পরে আসবে৷

ইয়ামিন সারাদিন অপেক্ষায় ছিল। বার-বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল কখন সন্ধ্যা হবে! উষ্ণতা যদি আসে, একবার যদি দেখা হয়! আর মাত্র কিছুক্ষণ! এর মধ্যেই তো তাদের চলে আসা উচিৎ। শ্যুটিং শুরু হতে যাচ্ছে। ইয়ামিনকে মেকাপ দেওয়া হয়েছে। রোহান মেকাপ দিতে দিতে বলল,” স্যার, আপনাকে ন্যাচরাল শেডের একটা লিপস্টিক লাগিয়ে দেই প্লিজ! এই লুকের সাথে আসলে লিপস্টিক না হলে যাচ্ছে না।”

ইয়ামিন কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো। রোহান নিচু গলায় বলল,” স্যরি স্যার।”

রোহান ইয়ামিনের পারসোনাল মেকাপম্যান। ও ছাড়া ইয়ামিন কারো থেকেই মেকাপ নেয় না। কিন্তু রোহানের কাছে আজও এই ব্যাপারটা ধোঁয়াশা! কেন তার স্যার লিপস্টিক নিতে চান না? অন্যসব মেকাপে তার সমস্যা নেই৷ শুধু লিপস্টিক নেওয়ার কথা বললেই রেগে যান। একেক মানুষের একেক ধরণের রোগ। ইয়ামিন ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল,” মিস কামলার মেকাপ হয়েছে?”

রোহান এইবার অতি উৎসাহ নিয়ে বলল,” জ্বী স্যার। আমি একটু আগেই দেখে এলাম। ম্যাম নিজের মেকাপ নিজেই করে ফেলেছেন। তাকে যে কি সুন্দর লাগছে! কীর্তি ম্যাডামের থেকেও সুন্দর লাগছে স্যার।”

ইয়ামিন হাসল,কিছু বলল না। রোহান বলল,”স্যার, ম্যাডামকে আজ খুব প্রাণবন্ত লাগছে। তিনি হয়তো কোনো ব্যাপার নিয়ে অনেক খুশি!”

ইয়ামিনের কাছে অপেক্ষাটা আরও কঠিন লাগছে। উফফ, ঘড়ির কাটা এগোচ্ছে না কেন? হঠাৎ আরমান জোহারের চিৎকার শোনা গেল। তাদের শ্যুটিংস্পটে একজন অপরিচিত’র আগমন ঘটেছে। স্যুট টাই পরা বেশ সুদর্শন ভদ্রলোক। বয়স ত্রিশের উপরে হবে। আরমান ভাই তার সঙ্গে কোলাকুলি করে কথা বলছেন। এমনভাবে কথা বলছেন যেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি! ইয়ামিন ঠোঁটের নিচে আঙুল রেখে জিজ্ঞেস করল,” কে উনি?”

রোহান হাসিমুখে বলল,” উনি হচ্ছেন আর্জুন খান্না। কামলা ম্যামের স্পেশাল গেস্ট।”

” ও আচ্ছা।”

কামলার স্পেশাল গেস্ট শুনে লোকটার প্রতি ইয়ামিনের আচমকাই একটা বিরক্তিসূচক মনোভাব সৃষ্টি হলো। ঠিক বিশমিনিট পর কামলা ইয়ামিনকে ফোন করে ব্যালকনির পেছনে নিরিবিলি জায়গাটায় আসতে বলল। সেখানে ছোট-খাটো একটা লেক আছে।

ইয়ামিনের ভালো লাগছিল না তাও সে গেল। সেখানে আর্জুন খান্না আর কামলা একসাথে বসে ছিল। কামলার চোখমুখ ঝলমল করছে! ইয়ামিনকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো কামলা।

লাজুক গলায় বলল,” ওহ মিস্টার সিংগার, এসো পরিচিত হও। আমার ফিয়্যান্সে। সামনের মাসের পাঁচতারিখ আমাদের বিয়ে হতে যাচ্ছে।”

আর্জুন খান্না ইয়ামিনকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। কামলা বলল,” আর তুমি তো ওকে চেনোই। আমার সিংগার, ইয়ামিন ইব্রাহীম।”

আর্জুন খান্না খুব বিনয়ের সাথে বললেন,” চিনি মানে? খুব ভালো করে চিনি। আরে আমি তো উনার বিগেস্ট ফ্যান। জানেন স্যার, আমার আজকে এখানে আসার প্ল্যানই ছিল না। শুধুমাত্র আপনার সাথে দেখা করতে আমি সেই দিল্লী থেকে এসেছি। আপনি তো আমার গুরু স্যার!”

এই কথা বলেই আর্জুন খান্না ইয়ামিনের সাথে হ্যান্ডশেক করতে আসলেন। ইয়ামিন হ্যান্ডশেক করল না। দুইহাত পকেটে গুঁজে রাখল। ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,” আমি আসছি।”

এইটুকু বলেই ইয়ামিন হেঁটে চলে যেতে লাগল। আর্জুন খান্নার চেহারা শুকিয়ে থমথমে হয়ে গেল। মনে মনে কিছুটা আঘাত পেলেন তিনি। ইয়ামিন ইব্রাহীমকে খুব সহৃদয়বান মানুষ ভেবেছিলেন অর্জুন। যে ভক্তদের সাথে বন্ধুর মতো মিশতে পারে! যার মধ্যে বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। কিন্তু আজকে তাঁর এহেন ব্যবহারে প্রচন্ড অহংকারী বলেই মনে হলো। কামলাও কিছুটা অপ্রস্তুতবোধ করল।

শ্যুটিংস্পটে বেজায় ভীড়। মানুষ মানুষের মাথা খেয়ে নিচ্ছে। উষসী সবাইকে ঠেলে কিছুতেই ভেতরে যেতে পারছে না। এমন হলে সে ইয়ামিনের সাথে দেখা করবে কি করে? হঠাৎ উষসীর পা একটা সুন্দরী মেয়ের গাউনের উপর পড়ে গেল। মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠল,” আউচ! হচ্ছেটা কি? ”

উষসী দ্রুত পা সরিয়ে বলল,” আই এম স্যরি আপু!”

মেয়েটার সাথে তার বন্ধুরাও ছিল। তাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে রে?”

মেয়েটা নাগিনের মতো ফুসতে ফুসতে বলল,” জানি না কোথ থেকে আসে এসব! ফালতু, মানে কোনো হুশ-জ্ঞান নেই।”

উষসীর এতো রাগ লাগল! দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা বাঙালী। কিছুক্ষণ আগে ইয়ামিন ইব্রাহীমকে নিয়ে আলোচনা করছিল। যেই মেয়েটার ড্রেসে উষসীর পা পড়ল, সে ইয়ামিনের অনেক বড় ভক্ত! কলকাতা থেকে কাশমীর এসেছে শুধু ইয়ামিনের সাথে দেখা করার জন্যই! উষসী মেয়েটাকে বেশি পাত্তা দিল না। কোথায় সে আর কোথায় উষসী! ইয়ামিনকে সে ব্যক্তিগতভাবে চেনে। ইয়ামিন তাকে এইখানে শ্যুটিং দেখার জন্য নিজে থেকে ইনভাইট করেছে। সে হচ্ছে ইয়ামিনের স্পেশাল গেস্ট। তার এসব ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে ভাবলে চলবে না। উষসী ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতে গেলেই রোহান এসে বাঁধা দিল,” এক্সকিউজ মি, কোথায় যাচ্ছেন?”

রোহানের মুখে হিন্দি শুনে উষসীও হিন্দিতে উত্তর দিল,
” আমি ইয়ামিন ইব্রাহীমের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।”

” বললেই তো দেখা করা যায় না। এখানে একটু পর শ্যুটিং শুরু হবে। তাই প্লিজ আপনারা জায়গা খালি করুন।”

উষসীর সাথে আরও যারা সাধারণ জনতা ছিল সবাইকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। অপমানে উষসী ফুঁসে উঠলো,” আপনি জানেন আপনি কাকে কি বলছেন? আমি ইয়ামিন ভাইয়ার পরিচিত। তিনি নিজে আমাকে শ্যুটিং দেখার জন্য ইনভাইট করেছেন। আমি উনার গেস্ট!”

রোহানের পাশাপাশি অন্যসবাই অবাক হওয়ার দৃষ্টিতে তাকালো। যেই মেয়েটার ড্রেসে উষসীর পা পড়েছিল সেও বড় বড় চোখে তাকালো। উষসী ভাব নিয়ে সবার তাক খাওয়া দৃষ্টি উপভোগ করছে।

মেয়েটা হঠাৎ ফিসফিস করে বলল,” যত্তসব পাগল!”

উষসীর মেজাজ চড়ে গেল। এই মেয়েটা তাকে কি ভেবেছে? সমস্যা নেই, জবাবটা ইয়ামিন এলেই দেওয়া যাবে। যখন সবার সামনে ইয়ামিন উষসীর সাথে হাসিমুখে কথা বলবে, তখন দেখা যাবে এই সুন্দরীর মুখের অবস্থা কি হয়! রোহান সন্দেহী দৃষ্টিতে বললেন,” আপনি সত্যি বলছেন তো?”

” হান্ড্রেড পারসেন্ট সত্যি। বিশ্বাস না হলে নিজেই জিজ্ঞেস করুন ইয়ামিন ভাইয়াকে। আমার নাম উষসী। তিনি আমাকে খুব ভালো করে চিনেন।”

জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হলো না। পকেটে হাত গুঁজে সাদা স্যুট পরিহিত ইয়ামিনকে এদিকেই আসতে দেখা গেল। সবাই হামলে পড়ল ইয়ামিনের সাথে কথা বলার জন্য। বড় বর্ডার দিয়ে তাদের আটকে দেওয়া হলো। কেউ ভেতরে ঢুকতে পারল না। কিন্তু চিৎকার-চেঁচামেচি করেই যাচ্ছে সবাই।

রোহান উষসীকে ভেতরে ঢুকতে দিল। উষসী দৌড়ে গেল ইয়ামিনের সামনে। লাজুকমুখে কাঁপতে কাঁপতে বলল,” ভাইয়া ভালো আছেন? আমি উষসী। আপনি আমাকে আসতে বলেছিলেন।”

ইয়ামিন উষসীর কথার কোনো জবাবই দিল না। এমনকি একবার তাকালো পর্যন্ত না৷ রোহানকে বলল,” রোহান,আমার ঘরে এক কাপ কফি দেওয়ার ব্যবস্থা করো। আজকে শ্যুটিং ইন্টেরাপ্ট। সবাইকে জানিয়ে দাও। আমি ভেতরে যাচ্ছি।”

” জ্বী স্যার, জ্বী স্যার।”

ইয়ামিন উষসীকে পাশ কাটিয়ে অবলীলায় চলে গেল। উষসী স্তম্ভিত, হতভম্ব! রোহান যাওয়ার সময় রাগী দৃষ্টিতে উষসীকে বলে গেল,” ভেতরে ঢোকার জন্য এতোবড় মিথ্যে না বললেও পারতেন। এখনি বের হোন আপনি।”

অপমানে উষসীর বামচোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল! প্রত্যেকে উষসীর দিকে তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। ওই মেয়েগুলোর মুখেও এখন পৈশাচিক আনন্দের হাসি ঝুলছে। এতো অপমান নিয়ে উষসী এক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে গেল শ্যুটিংস্পট থেকে। বুকের মধ্যে অদ্ভুত চিনচিনে ব্যথাটা পুরো শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতেও বুক ফেটে যাচ্ছে। কান্নারা বাঁধ মানছে না। উষসীর মন চাইছে চিৎকার করে কেঁদে ফেলতে!

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ১৫
লিখা- Sidratul Muntaz

হঠাৎ করে শ্যুটিং স্থগিতের ঘোষণা শুনে সবাই বিরক্ত হলো। মিউজিক ডিরেক্টর আরমান জোহার মেজাজ খারাপ করে বললেন,” ছেলেটার যা মন চায় তাই করবে নাকি? এতোক্ষণ ধরে সবাই প্রস্তুতি কেন নিল তাহলে? ক্যামেরা, শট সবকিছু রেডি, মডেলের মেকাপও ডান, আর এখন ইচ্ছে হলো তাই শ্যুট ক্যান্সেল? বললেই হয়ে গেল? কোনো যথাযথ কারণ তো থাকতে হবে!”

ইয়ামিনের সাথে কথা বলার জন্য আরমান তার রুমে যাচ্ছিলেন। তখন রোহান আটকালো,” স্যরি আরমান ভাই, এখন যাওয়া যাবে না। স্যার কারো সাথে দেখা করতে চাইছেন না।”

আরমান জোহারের প্রচন্ড মেজাজ গরম হলেও তিনি রাগ দমন করলেন। বিখ্যাত শিল্পীদের নিয়ে এই একটা সমস্যা। তারা ক্ষমতার অপব্যবহারটা খুব ভালো জানে। এইযে বলা হলো শ্যুটিং স্থগিত! তার মানে স্থগিতই। মুখের উপর কথাও বলা যাবে না। শুধু শুধু এতোগুলা সময় নষ্ট হলো। এই তামাশা দেখার জন্যই কি মুম্বাই থেকে কাশ্মীর এসেছিলেন তিনি। রেগে-মেগে আরমান বললেন,” যা ইচ্ছা তাই হোক। আমি আর এইসবে নেই।”

সবকিছু গুছিয়ে ফেলা হচ্ছে। ক্যামেরা উঠিয়ে ঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যে মানুষরা শ্যুটিং দেখবে বলে ভীড় জমিয়েছে তারাও একে একে চলে যাচ্ছে। অর্জুন কামলার পাশে দাঁড়িয়ে চিন্তিত গলায় বলল,” মনে হচ্ছে ইয়ামিন ইব্রাহীমের কোনো পারসোনাল প্রবলেম হয়েছে। উনি কি কোনো কারণে ডিপ্রেসড? কামলা তুমি জানো কিছু?”

কামলা কোনো জবাব দিল না। আর কেউ না বুঝুক, অন্তত কামলা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে কেন ইয়ামিন এইরকম করেছে! অর্জুনকে দেখার পর তার প্রফুল্ল চেহারার ঋনাত্মক পরিবর্তন দেখেই কামলা বুঝে গেছে। কিন্তু অপরাধবোধে দগ্ধ হয়ে কিছু বলতে পারেনি তখন। তবে এখন মনে হচ্ছে বলতেই হবে!

ইয়ামিনের সাথে জরুরী ভিত্তিতে তার কথা বলা দরকার। কামলা বিচলিত কণ্ঠে বলল,” রোহান, আমি একটু ইয়ামিনের সাথে দেখা করতে চাই।”

” কিন্তু ম্যাম, স্যার এখন…

রোহানের অনুমতির অপেক্ষা করল না কামলা। ফট করে ঢুকে গেল ভেতরে। কিন্তু ঘরের কোথাও ইয়ামিনকে দেখতে পেল না সে। শুধু মেঝেতে তার সাদা স্যুট পড়ে আছে। কামলা সাদা স্যুটটা হাতে নিয়ে রুমের আরও ভেতরে ঢুকল। আশেপাশে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিল। এবার ইয়ামিনকে খুঁজে পাওয়া গেল বারান্দায়। এলোমেলো ভাবে ডিভানে বসে থাকা অবস্থায়।

গাঁয়ের শার্টটা আগলা করে পরে আছে সে। শার্টের সামনের কয়েকটা বোতাম খোলা। মাথার রেশমী চুলগুলো এলোমেলো। হিমশীতল বাতাসে দুলছে। ইয়ামিন যে এইভাবে অবহেলায় বসে আছে, ঠান্ডা লেগে যায় যদি? আরেকটু এগোতেই কামলা খেয়াল করল ইয়ামিনের হাতে সিগারেট। এজন্যই ধূমায়মান হয়ে আছে পুরো বারান্দাটা। তার করা একটা ভুলের জন্য এতোবড় ঘটনা ঘটে যাবে এটা ভাবতেও পারেনি কামলা।

ইয়ামিনের পাশে বসে ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই ইয়ামিন অবাক হয়ে বলল,” কি ব্যাপার কামলা? নক না করে তুমি আমার ঘরে ঢুকেছো কেন?”

কামলার চোখে তখন অশ্রু। ইয়ামিন কাঁদছে না, কিন্তু কামলা কাঁদছে! ইয়ামিন অতি স্বাভাবিক কণ্ঠে আদেশ দিল,” যাও এখান থেকে।”

কামলা নম্র কণ্ঠে বলল,” আই এম স্যরি।”

এই কথা বলে ইয়ামিনের কাঁধে হাত রাখতে নিচ্ছিল সে। ইয়ামিন সরে গেল। কামলা বলল,” জানি আমি অন্যায় করেছি। সেদিন আমাদের ওই প্রাইভেট মোমেন্ট…”

“শাট আপ। আমি তোমার সাথে এই ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চাই না। গেট আউট।”

” ইয়ামিন তুমি এখন আমাকে ভুল বুঝছো! অর্জুনের সাথে আমার ব্রেকাপ হয়েছে তিনমাস আগে। আজ সে হঠাৎ আমার সাথে প্যাচাপ করতে এসেছে। আমাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করেছে। তাই আমি ওকে নিষেধ করতে পারিনি। তাছাড়া আমি ভাবিনি তোমার মতো একটা ছেলে আমাকে নিয়ে এতো অবসেসড হবে! এগুলো তো তোমার কাছে খুব নরমাল বিষয়। তুমি ওই ব্যাপারটাকে…

ইয়ামিন রূঢ় স্বরে বলল,” আমি মোটেও তোমাকে নিয়ে অবসেসড না কামলা সিং। নিজেকে এতো ইম্পোর্ট্যান্ট ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই।”

” তাহলে তুমি শ্যুটিং কেন ইন্টারাপ্ট করলে? কেন অর্জুনের সাথে দেখা হওয়ার পরেই তোমার মুড চেঞ্জ হয়ে গেছে? কেন এভাবে অন্ধকার ঘরে.. ”

ইয়ামিন গর্জন করে বলল,” দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস।

সে আচমকা ডিভানে একটা লাথি মারল। কামলা ভয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ইয়ামিনকে থামানোর জন্য বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল,” আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু তুমি শান্ত হও প্লিজ!”

ইয়ামিন শান্ত হয়ে বলল,” গেট লস্ট।”

কামলা বের হয়ে গেল। ইয়ামিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না। ধপ করে বসে পড়ল মেঝেতে। আবার একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে নিজের মনেই হাসল একবার। কামলার ওই অপরাধী দৃষ্টি, ক্ষমা চাওয়া, মায়াকান্না, এসব দেখে অন্তত এইটুকু তো ধারণা করাই যায় যে সে ইয়ামিনকে নিয়ে শুধুই একটা খেলা খেলেছিল। তার কাছে নিজের প্রয়োজন মেটানোর মাধ্যম ছিল ইয়ামিন। আর যেই প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল, তখনি সে ইয়ামিনকে উপড়ে ফেলতে চাইল। পৃথিবীতে কত রকমের নারী আছে। উষ্ণতার মতো মায়াবতীও আছে আবার কামলা-কীর্তির মতো বিষধরীও আছে। ছাব্বিশ বছরের এই দীর্ঘ জীবনটা ইয়ামিনকে কতকিছুই না শেখালো! কিন্তু সে আটকে আছে তার সতেরো বছরের হওয়া প্রথম প্রেমেই। তার উষ্ণতা মিস!

সিগারেট ফেলে উঠে দাঁড়ালো ইয়ামিন। সিদ্ধান্ত নিল এখানে থাকবে না সে। কামলার সাথে কাজ করার প্রশ্নই আসে না। আজকের পর থেকে কখনও কোনো ‘মেয়ে’ নামক বস্তুকে নিজের জীবনে প্রবেশ করতে দিবে না সে।

_____________
উষসীর যেন আজ শুধুই কাঁদার দিন। জীবনে শেষ কবে এতো কষ্ট আর অপমান সইতে হয়েছিল মনে পড়ছে না। তবে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ খারাপ ঘটনাটি ঘটেছে আজকে! এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। চারদিকে এখন ঘুটঘুটে আঁধার! পাহাড়ী অঞ্চল হওয়ায় সূর্য ডুবলেই অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে প্রকৃতি। উষসী বিরাট একটা গাছের ছায়াতলে বসে ফুপিয়ে কাঁদছিল। হঠাৎ কেউ উষসীর কাঁধে হাত রাখল। উষসী ভয়ে চমকে গেল। তড়াক করে ঘাড় ঘুরাতেই দেখল প্রীতম, আকুতিভরা দৃষ্টি নিয়ে উষসীর দিকে তাকিয়ে আছে। উষসীর চোখে জল দেখে প্রীতমের ভ্রু কুচকে গেল,” তুই কাঁদছিস নাকি উষু?”

উষসী জবাব দিল না। প্রীতম এবার গাঁ ঘেঁষে ওর পাশে বসল। উষসীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তীব্র আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল,” বল কি হয়েছে?”

কাঁদতে কাঁদতে প্রীতমের হাত নিজের বাহু থেকে সরালো উষসী। জেদী, একরোখা গলায় বলল,” কিছু হয়নি। তুই আমার সামনে থেকে প্লিজ চলে যা!”

প্রীতমের হৃদয় আরও বিচলিত, ব্যাকুল, অশান্ত হয়ে উঠলো! আজ সারাদিন এই অশান্ত মনের তোলপাড় নিয়ে রাস্তায় হেঁটে বেরিয়েছে সে। উষসীর সাথে অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সুযোগ হয়নি। তৃষাণ, আহমেদ, উষ্ণতা তাকে খুব অনুরোধ করেছিল ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু প্রীতম যায়নি। তার ধারণা উষসীও একই কারণে যায়নি। কালকের পর থেকে তাদের সহজ-সরল বন্ধুত্বের সম্পর্কে ভয়ানক ফাটল ধরেছে!

কি করলে তা আবার আগের মতো সম্পর্কটা জোড়া লাগবে প্রীতম জানে না। তবে এখন প্রীতমের চাহিদা আরও বেশি। সে শুধু বন্ধু হিসেবে না, উষসীকে প্রেয়সী হিসেবেও চায়!

আর যতদিন সেটা না হচ্ছে, ততদিন সে হার মানবে না। প্রীতমকে তখনও পাশে বসে থাকতে দেখে উষসী সিদ্ধান্ত নিল নিজেই উঠে চলে যাবে। এই মুহুর্তে তার ভীষণ একাকিত্ব প্রয়োজন। কাউকে সহ্য হচ্ছে না নিজের পাশে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে! অন্তত মনকে শান্ত করার জন্য হলেও তাকে কাঁদতে হবে। মনের আঘাত চোখের জলে মুছতে হবে! প্রীতম তাও উষসীর পেছন পেছন আসছিল। উষসী হঠাৎ খুব ক্ষেপে গেল।

পেছন ফিরে প্রীতমকে থাপ্পড় দেওয়ার জন্য হাত তুলে বলল,” আর একবার আমার পিছু নিলে কঠিন চড় খাবি তুই!”

প্রীতম উষসীর হাতটা নিয়ে নিজের গালের সাথে ঠেকিয়ে বলল,” নে মার চড়। প্লিজ মার! একটা চড় মেরে যদি তোর রাগ কমে তাহলে মার।”

উষসী হাত ছাড়িয়ে নিল। কিন্তু প্রীতম থামল না। কয়েক কদম এগিয়ে এসে বলল,” এরপর যদি আরও মারতে ইচ্ছে হয় তাহলে মারবি! প্রয়োজনে একশোটা চড় মারবি। তাও আমি কিছু মনে করবো না। যখন থেকে তোকে ভালোবেসেছি, আমার জীবনের সব অধিকার তোকে দিয়ে দিয়েছি! আমি পুরোটাই তোর। আমাকে তুই মারবি, কাটবি, যা মন চায় তাই করবি…”

প্রীতমের কথা শেষ হওয়ার আগেই চোখমুখ কুচকে ধিক্কার জানালো উষসী,” ছি! আমাকে এ ধরণের কথা বলতে তোর লজ্জা করল না? তোকে তো আমি ভাই ভেবেছিলাম।”

প্রীতম আহত দৃষ্টিতে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।’ ভাই’ শব্দটা তার কানে তীক্ষ্ণভাবে বাজতে লাগল। যন্ত্রণা দিতে লাগল! উষসী চলে যেতে নিচ্ছিল। প্রীতম তার হাত ধরে টেনে কাছে এনে বলল,” এই, যাচ্ছিস কোথায়? আগে উত্তর দিয়ে যা। ভাই মানে? কে তোর ভাই? আমি কি কোনোদিন বলেছি যে আমি তোর ভাই? তুই আমার বোন? কোন সাহসে আমাকে ভাই বললি তুই?”

প্রীতমের এতো আক্রমণাত্মক ব্যবহারে উষসী থতমত খেয়ে গেল। কথা বলার জন্য শব্দ খুঁজে পেল না। চিরপরিচিত বন্ধুটির হঠাৎ এই অপরিচিত ব্যবহারে উষসী স্তব্ধ হয়ে গেল! প্রীতম উষসীর কোমড় শক্ত করে চেপে ধরে নেশায় আসক্ত হয়ে যাওয়ার মতো বলল,” আমি তোকে খুব ভালোবাসি উষসী। তুই এটা কবে বুঝবি আমি জানি না। কিন্তু তোকে বুঝতেই হবে। আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না। তুই যতই আমাকে চড় মার, লাথি মার, যা ইচ্ছা তাই কর, কিন্তু আমি তোকে ছাড়া আর কিচ্ছু ভাবতে পারছি না। আমি ভাবতে চাইও না!”

উষসী যথাসাধ্য চেষ্টা করছে ছাড়া পাওয়ার। কিন্তু প্রীতম যেন তার হুশে নেই। শরীরে অসুরের শক্তি ভর করেছে তার। যতই উষসী ছোটার চেষ্টা করছে ততই প্রীতমের স্পর্শ গাঢ় হচ্ছে। উষসীর মনে হচ্ছে অনেকগুলো বিষপোকা একসাথে তাকে কামড়ে ধরেছে! অসহ্য লাগছে সবকিছু!

উষসী কাঁদতেও ভুলে গেছে। প্রীতম বলে যেতে লাগল, “কালরাতের পর থেকে আমি একটুও ভালো নেই বিশ্বাস কর! একফোঁটা ঘুমাতে পারিনি সারারাত। আজ সারাদিন আমার ভয়ংকরভাবে কেটেছে! কতবার গাড়ি এক্সিডেন্ট করতে নিয়েছিলাম জানিস? হয়তো আজই মরে যেতাম কিন্তু করুণাময় আমাকে তোর জন্য বাঁচিয়ে রেখেছে। তুই আমার উষসী, শুধুই আমার। এই কথাটা মেনে নে প্লিজ।”

” আমি কোনো সম্পত্তি না যে বললেই তোর হয়ে যাবো। তুই আমাকে ছাড় প্রীতম, বাড়াবাড়ি করিস না। খুব খারাপ হবে।”

” খারাপ হওয়ার বাকি কি আছে? যা খারাপ হওয়ার কালরাতেই হয়ে গেছে। যখন আমরা একসাথে ঘোড়ায় উঠলাম, তুই আমার হাতে হাত রাখলি, পড়ে যাওয়ার ভয়ে আমার বুকের টি-শার্ট খামচে ধরলি, আমি তোর চুলের গন্ধ নিলাম, সর্বনাশটা তখনি হয়ে গেল।”

” তার মানে আমি না, আমার শরীর তোকে আকর্ষণ করেছে।”

” না, এটা মিথ্যে! এতোটা নিচ ভাবিস না আমাকে প্লিজ! আমি তো তোকে ছোট্টবেলা থেকে ভালোবাসি উষসী। সেই ক্লাস নাইন থেকে তুই আমার স্বপ্নের প্রেয়সী!”

” তাহলে এতোদিন কেন বলিসনি? কেন কালই তোর বলতে হলো? এতোগুলো দিন যে ধৈর্য্য রাখতে পেরেছে সে এখন কিভাবে এতো ধৈর্য্যহারা হয়ে যাচ্ছে? আসলে তোর এটা ভালোবাসা না, শুধুই আকর্ষণ। এতোদিন তোর আমাকে ভালোলাগতো। কিন্তু এখন তুই আমাকে চাহিদা বানাতে চাইছিস। তোর এই আকাশচুম্বী চাহিদা তোকে এতোটাই হিংস্র বানিয়ে দিয়েছে যে নিজেও বুঝতে পারছিস না কতটা অন্যায় তুই করছিস এখন!”

” এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লভ এন্ড ওয়ার। যদি এটা অন্যায় হয়, তো হোক! আমি ভালোবাসা আদায়ের জন্য সব করতে পারি।”

” ভালোবাসা আদায়ের ব্যাপার না। অনুভবের ব্যাপার। আমি যতক্ষণ তোর জন্য অনুভব না করবো, তুই আমাকে জোর করে কিছুতেই অনুভব করাতে পারবি না!”

উষসী ছুটতে নিলে প্রীতম আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।।উষসী চোখমুখ খিচে প্রাণপনে বলল,” প্রীতম প্লিজ আমি ব্যথা পাচ্ছি! তোর কাছে নিজেকে সুরক্ষিত ভাবতাম। কিন্তু এখন তুই-ই আমার সবচেয়ে বড় ক্ষতি করতে চাইছিস? কেন?”

” আমার কাছে তুই অবশ্যই সুরক্ষিত। কিন্তু মানতে চাইছিস না বলে তোর ক্ষতি মনে হচ্ছে। একবার শুধু মেনে নে আমায়।”

” না, এ আমার জন্য অসম্ভব! আমি অন্যকাউকে ভালোবাসি।”

” তোর ভালোবাসা কি ওই ইয়ামিন ইব্রাহীম? ”

উষসী কেঁদে ফেলল এবার। পুনরায় কষ্টের কথা মনে পড়ে গেল। তাকে কেঁপে কেঁপে কাঁদতে দেখে প্রীতম শক্ত করে গাল চেপে ধরল,”একদম কাঁদবি না। আমার সামনে দাঁড়িয়ে তুই অন্য পুরুষের জন্য কাঁদবি এটা আমি সহ্য করবো না!”

ইয়ামিন ওই মুহুর্তে ওই রাস্তা দিয়েই উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছিল। উষসীর গোঙানি শুনে তার দৃষ্টি সচকিত হলো। আশেপাশে খোঁজার চেষ্টা করল, শব্দটা কোথথেকে আসছে? কেউ কি কাঁদছে? হঠাৎ প্রীতমের গর্জনও শুনতে পেল সে। ঠিক তার পরের মুহুর্তেই বড় একটা গাছের পেছনে দুইজন ছেলে-মেয়েকে দেখতে পেল। দূর থেকে অন্তত এইটুকু বোঝা যাচ্ছে যে মেয়েটার উপর জুলুম করা হচ্ছে। মেয়েটার সম্মতি নেই তবুও ছেলেটা তাকে স্পর্শ করতে চাইছে! কান গরম হয়ে গেল ইয়ামিনের। রাক্ষুসে মেজাজ নিয়ে ছুটে গেল প্রীতমের দিকে।

প্রীতম উষসীকে চুমু দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। কিন্তু উষসী বার-বার মুখ সরিয়ে নিচ্ছিল বিধায় সে সফল হচ্ছিল না। হঠাৎ কেউ একজন বিরাট থাবায় তার শার্টের কলার টেনে ধরল। এক থাবায় প্রীতমের গলার চামড়া মাংসসহ ছিড়ে গেল।

তারপর মনে হলো সে শূন্যে উঠে যাচ্ছে। দানবীয় এই শক্তির উৎস খুঁজতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই বিকট শব্দে চোয়াল ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়ার মতো চার-পাঁচটা ঘুষি একাধারে খেল সে। তারপর আরও কঠিন মার খেল। প্রীতম নিঃশ্বাস নেওয়ারও সুযোগ পাচ্ছিল না। তার নাসারন্ধ্র গরম হয়ে সেখান থেকে গলগল করে উত্তপ্ত রক্ত বের হচ্ছে। ইয়ামিন বিস্ফোরিত চিৎকারে বলতে লাগল,” না বলার পরেও কেন ধরলি তাকে? কেন ধরলি বল!”

প্রীতম যে মরে যাচ্ছে সেদিকে হুশ নেই উষসীর। সে কান্ডজ্ঞান হারিয়ে বোকার মতো ইয়ামিনের কান্ড দেখছে। নিজের চোখকেও বিশ্বাস হচ্ছে না, কানকেও না! কয়েক মুহুর্ত স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর যখন উষসীর ধ্যান ভাঙল, তখনি প্রীতমের অবস্থা দেখে শিউরে উঠলো সে। এতো বেশি রক্তাক্ত হয়ে গেছে যে চেনাই যাচ্ছে না! উষসী চিৎকার করে উঠল,” থামুন, আল্লাহর দোহাই লাগে থামুন! মরে যাবে ও।”

উষসী ভয়ে কেঁদে ফেলল। কাঁপতে কাঁপতে কাঁদছিল সে। ওর ভয় পাওয়া দেখে ইয়ামিন ছেড়ে দিল। ছাড়ার সাথে সাথেই প্রীতম বেহুশের মতো ধপ করে পড়ে গেল রাস্তায়। তার মুখ নিঃসৃত দীর্ঘশ্বাস হতে হালকা ধুলো উড়লো। উষসী গলাকাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে লাগল ভয়ে।প্রীতমের পাশে বসে ডাকতে লাগল,” দোস্ত, এই দোস্ত, উঠ না। তুই কি ঠিকাছিস?”

উষসীর গলা একদম শুকিয়ে গেছে। ইয়ামিন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,” ঠিক নেই। ওকে হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থা করো। আর আমাকে পানি দাও।”

কথাটা বলেই ধপ করে রাস্তার মধ্যে ডিভানের মতো সামান্য উঁচু জায়গায় বসে পড়ল ইয়ামিন। উষসী ওর কথা শুনে উঠে দাঁড়িয়ে গেল।হতভম্ব দৃষ্টি নিয়ে বলল,” এখন আমি পানি কোথায় পাবো?”

ইয়ামিনের নির্লিপ্ত উত্তর,” জানি না। তোমার জন্য এতো কষ্ট করে একজনকে মেরে বেহুশ বানালাম আর তুমি সামান্য পানি খাওয়াতে পারছো না?”

উষসী বাকরুদ্ধ! এখন কি রাত-বিরাতে সে রাস্তায় হেঁটে পানি খুঁজবে নাকি? ইয়ামিন আবারও বলল,” পানি খাবো। দ্রুত পানি দাও!”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে