#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ১০
লিখা- Sidratul Muntaz
কামলা আর ইয়ামিন সারাদিন ঘুরা-ফেরা করে বেশ রাতে গেস্ট হাউজে ফিরে এলো। ইয়ামিন এরই মধ্যে অনেকগুলো মিউজিক ভিডিওর থিম খুঁজে পেয়েছে। সে থিম খুঁজে পায় প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে। যেখানে যেই থিম পায় সেখানেই লিখতে বসে যায়। নয়তো পরে আর মনে থাকে না। কিন্তু আজকে ইয়ামিনের কাছে না মোবাইল ছিল আর না নোটপ্যাড! কামলা তার সবকিছু ছিনতাই করে রেখে দিয়েছিল। অবশ্য এইজন্য সে কামলার কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ এতোদিন তার সমস্ত চিন্তা হতো কাজ কেন্দ্রিক। কিভাবে ভিডিও শ্যুট করবে, কিভাবে গান লিখবে, কোথায় কোথায় রেকর্ডিং করবে, এই সমস্ত একঘেয়েমি থেকে বের হয়ে ইয়ামিন যেন জীবনটাকে নতুন করে অনুভব করতে পেরেছে আজ।
ক্যারিয়ারের বাইরেও যে আলাদা একটা মনস্তাত্ত্বিক জগৎ আছে এটা বোধহয় ভুলতেই বসেছিল সে। কামলা তাকে সেই সত্যি অনুধাবন করিয়েছে। প্রকৃতির সাথে আসলে মানুষের মনের একটা আশ্চর্য মেলবন্ধন আছে। মানুষ যখন কোনো বিষয় নিয়ে খুব বেশি বিচলিত হয়, কোনো সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে খুঁজতে হাঁপিয়ে যায়, হতাশায় ডুবে যেতে থাকে, তখনি দরকার প্রকৃতির সাথে একটা উষ্ণ আলিঙ্গন। যা মনের সমস্ত হতাশা, অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা এক নিমেষে দূর করে দিতে পারে। মন শান্ত হয়ে যায় মুহুর্তেই। যেমন ইয়ামিন এখন খুব শান্তি অনুভব করছে। এতোটা শান্তি শেষ কবে লেগেছিল মনে পড়ছে না তার।
কামলার গেস্ট হাউজের টিউলিপ-আপেল গাছে ঘেরা বিচ্ছিন্ন ব্যালকনির সেই আশ্চর্য সুন্দর জায়গাটিতে এখন বসে আছে ইয়ামিন। আকাশের দিকে চেয়ে সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো নক্ষত্ররাজি দেখছে। চাঁদশূন্য আকাশে এতো তারার সমারোহ আজ! চমৎকার লাগছে দেখতে! ইয়ামিন আগে এসব খেয়াল করতো না। কিন্তু আজ প্রকৃতির প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বিষয় সে অনুভব করছে। বাতাসেও যেন একটা মায়াবী গন্ধ ছড়িয়ে আছে। এই গন্ধ কাশমীরি গন্ধ। ইয়ামিন মুম্বাই ফিরে গেলে গন্ধটা খুব মিস করবে।
একটু পর কামলা এলো। তার গাঁয়ে কালারফুল শাল, মাথায় কানটুপি। ইয়ামিনের পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল,” কি ভাবছো?”
ইয়ামিন বড় করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,” ভাবছি অনেককিছুই! কোনটা বলবো?”
” তুমি আজ সারাদিনে একবারও গান গাইলে না তো? মিউজিক প্র্যাকটিস করো কখন?”
” আমি সারাক্ষণই মিউজিক প্র্যাকটিস করি। কিন্তু আজকে সময় কোথায় পেলাম? সারাদিন তো তোমার সাথেই ছিলাম।”
” ঠিকাছে এখন একটা খালি গলায় একটা গান গাও তো, শুনি!”
কামলা গালে হাত রেখে একদম তৈরী হয়ে বসল গান শোনার জন্য। ইয়ামিন কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হেসে দিল। কামলা ভ্রু কুচকে বলল,” হাসছো কেন?”
” খালি গলায় আমি কখনও কারো সামনে গান গাইনি।”
” তো কি হয়েছে? আমার সামনে গাও। বাদ্যযন্ত্রে গান শুনতে আমার ভালো লাগে না। কেমন যেন মেকী মেকী লাগে। চলো, তোমার গান খালি গলাতেই শুনবো।”
ইয়ামিন কিছু একটা ভেবে বলল,” কি গান শুনবে?”
” তোমার যা ইচ্ছা।”
” ওকে..”
ইয়ামিন গান গাইতে শুরু করল। নিজের পছন্দের একটি বাংলা গান।
ইয়ামিন তার গানটা গাইছে একদম নিজের মতো, নিজের সুরে৷ যদিও তার কাছে কোনো বাদ্যযন্ত্র নেই। তাও মনে হচ্ছে কণ্ঠেই অনুভূতির বাদ্যযন্ত্র লাগানো আছে। সে যেমন টিউন বের করতে চাচ্ছে তেমনটাই বের হচ্ছে।
নিশিরাতের নীরব পরিবেশ আর হিমাচলের ঠান্ডা হাওয়া ইয়ামিনের মোহনীয় কণ্ঠস্বরের সাথে মিশে এক নৈসর্গিক মুহুর্তের সৃষ্টি করেছে। কামলা বাংলা ভাষা বোঝে না। এর আগে কখনও এতো মনোযোগ দিয়ে বাংলা গান শোনা হয়নি তার। তবুও আজ বাংলা ভাষায় এই গানটি শুনে অজান্তেই তার চোখে অশ্রু জমতে লাগল। এতো অনুভূতি দিয়ে বুঝি কেউ গাইতে পারে?আহা, আহা, একেই বলে গড গিফটেড ভয়েস! কামলা মন্ত্রমুগ্ধের মতো চোখ বন্ধ করে গান শুনতে লাগল এবং জীবনে প্রথমবারের মতো অনুভব করল, বাংলা ভাষার মতো শৈল্পিক ও চমৎকার ভাষা হয়তো বিশ্বে দ্বিতীয়টি নেই!
প্রীতম আর উষসী অনেক দূর পর্যন্ত হাঁটল। হঠাৎ একজন ঘোড়ার মালিককে ঘোড়া নিয়ে যেতে দেখে উষসী বায়না করল ঘোড়সাওয়ারী করবে। প্রীতম জানতো উষসীকে নিয়ে বের হলে সে হুটহাট এমন আবদার করবেই৷ তাই সাথে যথেষ্ট টাকা নিয়েই বের হয়েছিল। কিন্তু এইসময় যখন সব দোকানপাট বন্ধ তখন এই লোক ঘোড়া নিয়ে ঘুরছে কেন?
প্রীতমের একটু সন্দেহ হলো। জিজ্ঞেস করে জানা গেল তিনি পেহেলগাম ভিউপয়েন্টে ঘোড়ার গাড়ি চালান। আজকে একটা দূর্ঘটনাবশত বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। উষসী আর প্রীতম ঘোড়ায় উঠলো।
নিস্তব্ধ রাতের শহরে ঘোড়সাওয়ারি! এতো সুন্দর সুখময় স্মৃতি নিয়ে প্রীতম বাঁচবে কি করে? তার ইচ্ছে করছে উষসীকে সাথে নিয়ে এখনি মরে যেতে। উষসী সামনে বসেছিল আর প্রীতম পেছনে। উষসী বার-বার শুধু পড়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছে। তাই প্রীতম শক্ত করে তার কোমড় ধরে রেখেছে। উষসীর লম্বা চুলের সুগন্ধ তার নাকে-মুখে প্রবেশ করছে। প্রীতম নেশায় হারিয়ে যাচ্ছে। বার-বার শুধু খেই হারাচ্ছে। উষসী এতো বকবক করছে কিন্তু এসব শোনার সময় কই তার? সে তো উষসীর লম্বা- কালো চুলের নেশায় ডুবে যাচ্ছে।
উষসীর শারিরীক মিষ্টি গন্ধ তার পুরো জগৎটাই আলোড়িত করে তুলছে। এক পর্যায় প্রীতম খুব দুঃসাহসিক একটা কাজ করে বসল। উষসী তখনও বকবক করে যাচ্ছিল। প্রীতম হঠাৎ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,” উষু আই লভ ইউ।”
উষসী গোল গোল চোখে চেয়ে কিছুক্ষণ পলক ঝাঁকালো। তারপর ঝারি মেরে প্রীতমের হাত সরিয়ে বলল,” কি বললি?”
প্রীতম বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়ছে। একবার ভয় ভেঙে গেলে আর সেটা ফিরে আসে না। সাহস শুধু বাড়তেই থাকে। প্রীতমেরও সাহস বেড়েছে৷ সে আগের মতোই জোরালো কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” আই লভ ইউ।”
উষসী ফিক করে হেসে প্রীতমের মাথায় গাট্টা মারল,” ফাজলামি হচ্ছে?”
” না, সত্যি আই লভ ইউ। তুই বিশ্বাস কর! ”
উষসী বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। প্রীতম আবারও বলল,” সেই ক্লাস নাইন থেকে। তোকে যেদিন প্রথমবার দেখেছিলাম সেদিন থেকেই।”
প্রীতম তখনও বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না যে সে মিথ্যে বলছে। তাছাড়া প্রীতম এতো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে ফান করার মতো ছেলে না। হঠাৎ প্রীতম খুব জোরে চিৎকার করে উঠল,” আই লভ ইউ উষসী! আই লভ ইউ মোর দ্যান মাই লাইফ!”
তার উচ্চারিত বাক্য পুরো এলাকা জুড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল বার-বার। উষসী দুইহাতে কান চেপে ধরল। অস্থির গলায় বলল,” আমি নামবো।”
” তুই ঠিকাছিস?”
উষসী চিৎকার করল,” আমি নামতে চাই!”
প্রীতম ইতস্তত হয়ে ঘোড়ার মালিককে বলল,” এই মামা, ঘোড়া থামান।”
মামা ঘোড়া থামানোর আগেই উষসী ধস্তাধস্তি শুরু করে দিল। প্রীতম ওকে শক্ত করে চেপে ধরে বলল,” সাবধান উষু, পরে যাবি তো।”
উষসী রাগে তেতে উঠল,” খবরদার আমাকে ধরবি না তুই। ”
এর মধ্যে ঘটল আরেক কাহিনী। ঘোড়া আচানক লাফালাফি শুরু করেছে। একবার ডানে যাচ্ছে তো একবার বামে যাচ্ছে। আরেকবার সোজাপথে পাগলের মতো ছুটছে। প্রীতম রক্তহিম করা শীতল কণ্ঠে বলল,” ভাইরে ভাই, পাগলা ঘোড়ায় উঠলাম নাকি?”
উষসী ভয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। তার চিৎকার শুনে ঘোড়ার গতিবেগ আরও বেড়ে যাচ্ছে। এতোক্ষণে প্রীতম বুঝতে পারল ঘোড়ার মালিক কেন এতোরাতে ঘোড়া নিয়ে ঘুরছিলেন আর কি দূর্ঘটনা ঘটেছিল! এখন সেই একই দূর্ঘটনা তাদের সাথেও ঘটবে না তো? আর কিছু ভাবার সুযোগ হলো না। বিশাল একটা গাছের সাথে ধাক্কা লেগে ঘোড়া শরীর ঝাড়া দিতেই প্রীতম আর উষসী দুই দিকে ছিটকে পড়ল। উষসী সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
ইয়ামিনের গান শেষ হয়েছে। এখন কামলা কবিতা বলতে শুরু করেছে। ইংরেজি সাহিত্যের কবি ইলিয়টের একটি বিখ্যাত কবিতা।
ইয়ামিন বিভোর হয়ে কবিতা শুনছিল। এতো সুন্দর হৃদয় দিয়েও কবিতা আবৃত্তি করা যায় তা ইয়ামিন কখনও জানতো না। মনে হচ্ছে প্রত্যেকটা শব্দ কামলা অন্তর থেকে বের করে উগড়ে দিচ্ছে৷ তার অন্য কোনো দিকে মনোযোগ নেই। শুধু কবিতায় মগ্ন সে।
আর ইয়ামিন মগ্ন কামলার আবৃত্তিতে। কবিতা শুনতে শুনতে কৈশোরের কিছু অবিস্মরণীয় স্মৃতি ভেসে উঠল মনে। সেই চমৎকার রাত। উষ্ণতার মায়াবী মুখ। ইয়ামিনের জীবনের প্রথম চুম্বন। সবচেয়ে মূল্যবান মুহূর্ত!
এক পর্যায় কামলার আবৃত্তি শেষ হলো। কামলা চোখ খুলতেই ইয়ামিনকে দেখল। ইয়ামিনের মনে হলো কামলা নয়, উষ্ণতা বসে আছে তার সামনে। তার ঘোর লাগা দৃষ্টিতে নেশা জড়ানো অনুভূতি। ঠান্ডা বাতাস শরীরে কাটার মতো হানা দিচ্ছে।
কিন্তু ওদের কারোই সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই৷ তারা জীবনের একান্ত সুন্দর মুহুর্ত বিচরণে ব্যস্ত। ইয়ামিন চেয়ে আছে কামলার ঘাঁয়েল করা দৃষ্টিতে, কামলা দেখছে ইয়ামিনের পুরু ভ্রুযুক্ত অপূর্ব দুইচোখ, ঘন পাপড়িতে ঘেরা গাঢ় কালো মণি যা তাকে ব্ল্যাকহোলের মতো আকর্ষণ করছে। নিজের দিকে টেনে নিতে চাইছে। ওই আহ্বানে সাড়া না দেওয়া যেন মস্ত অপরাধ!
কামলা অপরাধ করল না, সাড়া দিল। কয়েক মুহুর্ত খুব নিস্তব্ধতায় কাটল। শো শো বাতাসের শীতল শব্দ আর নিঃশ্বাসের উত্তপ্ত স্পর্শ দুইয়ে মিলে অনুভূতিরা হলো মুক্ত। কামলা ইয়ামিনের ঠোঁট ছুঁয়ে দিল পরম আবেশে।
ইয়ামিন তীব্র অনুভূতিতে ভেসে যাচ্ছিল। হঠাৎ দমকা শব্দে ছুটে এলো কামলার গেস্ট হাউজের হাবিলদার ওয়াকিল খান। কামলা আর ইয়ামিনের ঘোর কাটল। দুইজন দুইদিকে সটকে পড়ল মুহুর্তেই।
হাবিলদার ওয়াকিল ভীত সন্ত্রস্ত। তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। কাঁচুমাচু চেহারা নিয়ে বললেন,” সামনের বড় রাস্তায় দুইটা ছেলে-মেয়ের লাশ পড়ে আছে। রক্তাক্ত অবস্থা।”
ইয়ামিন আর কামলা তড়িৎ গতিতে ছুটে গেল। নীল রঙের হুডি গাঁয়ে একটা উনিশ-বিশ বছরের ছেলে আর প্রায় একই বয়সের সাদা-কালো শাড়ি পরিহিত একটি মেয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। মেয়েটা বেহুশ অবস্থায় থাকলেও ছেলেটা নড়াচড়া করছে। তবে মাথায় প্রচন্ডরকম আঘাত পেয়েছে। এদের মধ্যে কেউই লাশ নয়। হাবিলদার ওয়াকিল দূর থেকে দেখে ভুল খবর দিয়েছিল। কামলা আর ইয়ামিন দু’জনকেই তাদের গেস্ট হাউজে তুলে আনল।
প্রীতমের মাথায় ব্যন্ডেজ আর উষসী চোখেমুখে পানির ছটা দেওয়া হলো। উষসী চোখ পিটপিট করে তাকাতেই কামলার চেহারা দেখতে পেল। ভ্রু কুচকে তড়াক করে উঠে বসল। ভয়ে ভয়ে বলল,, ” আপনি কে? আমি কোথায় এসেছি?”
কামলা হিন্দিতে বলল,” শান্ত হও। তোমার এক্সিডেবট হয়েছিল। আমরা তোমাদের রাস্তা থেকে তুলে এনেছি। তোমার নাম কি?”
উষসী আশেপাশে তাকালো। আতঙ্কিত অবস্থায় সে হিন্দি বুঝতে পারছে না। প্রীতমের কথা মনে পড়ছে তার। কামলা সেটা বুঝতে পেরে বলল,” তোমার সাথের ছেলেটিকে খুঁজছো? সে পাশের রুমেই আছে। ভয় পেও না। আমাকে তোমার নাম বলো।”
উষসী কিছু একটা বলতে নিচ্ছিল। এর মাঝেই ইয়ামিন ঘরে ঢুকল। সাথে সাথেই উষসীর কথা বন্ধ হয়ে গেল। সাথে বন্ধ হলো হৃৎস্পন্দন। কামলা ইয়ামিনকে জিজ্ঞেস করল,” ছেলেটার কি অবস্থা?”
ইয়ামিন জানাল, “ছেলেটা ভালো আছে। রক্তক্ষরণ বন্ধ করা গেছে। কিছুক্ষণ রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
এই কথা বলে ইয়ামিন উষসীর দিকে তাকালো। কামলা বলল,” মেয়েটারও জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু আমার কথার জবাব দিচ্ছে না। মনে হয় আমার ভাষা বুঝতেই পারছে না।”
উষসী নিষ্পলক তখনও তাকিয়ে আছে ইয়ামিনের দিকে। কয়েক মুহুর্ত অতিবাহিত হলো। এরপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে উষসী পুনরায় বেহুশ হয়ে গেল।
(বর্তমান)
সারারাত উষসী দরজা খোলেনি। রাতে না খেয়ে ঘুমিয়েছে। কিংবা আদৌ ঘুমিয়েছে কি-না কে জানে? ইয়ামিনের হঠাৎ করেই মনে পড়ল যে উষসী প্রেগন্যান্ট। এই অবস্থায় না খেয়ে থাকা একদমই উচিৎ নয়। সে দ্রুত উষসীর ঘরে গিয়ে দরজায় নক করতে লাগল। তখন সকাল ছয়টা বাজে। উষসী দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। একটা কাঠবিড়ালি অনেকক্ষণ ধরে ঘাসের উপর গড়াগড়ি করছে। দেখতে ভালো লাগছে। দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনতে পেয়েও উষসী কোনো সাড়া দিল না। থম মেরে দাঁড়িয়ে সে দেখতে লাগল কাঠবিড়ালিটির কান্ড।
ইয়ামিন দরাজ গলায় বলছে,” উষসী, দরজা খোলো প্লিজ। আমি খুব স্যরি। আমার সব দোষ। তুমি যা শাস্তি দিবে তাই মানবো। তবুও প্লিজ দরজাটা খোলো।”
অনেক আকুতি-মিনতি করেও যখন কাজ হলো না তখন ইয়ামিন রেগে বলল,” দরজা খোলো নয়তো ভেঙে ফেলব। আর আমাকে যদি দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকতে হয় তাহলে কিন্তু সেটা তোমার জন্য একটুও ভালো হবে না।”
কড়া হুমকি শুনে উষসীর মেজাজ চড়ে গেল। খট করে দরজা খুলে সে রূঢ়ভাবে বলল,” আপনার কি সমস্যা? নিজেকে আপনি কি ভাবেন?”
ইয়ামিন উষসীকে ধাক্কা মেরে ঘরে ঢুকে পড়ল। শান্ত গলায় বলল,” রাতেও কিছু খাওনি৷ আগে খাওয়া, তারপর কথা।”
উষসী দেখল ইয়ামিনের হাতে প্লেট। প্লেটে দু’টো চকলেট ডোনাট আর এককাপ কফি। সে রাগে গজগজ করে বলল,” আমি কি আপনার খেলনা? যখন যেটা বলবেন সেটাই করব?”
” হ্যাঁ তুমি আমার খেলনা। আমি যা বলব তোমাকে তাই করতে হবে।”
উষসী রাগে ইয়ামিনের হাতের প্লেট নিয়ে আছাড় মারতে চাইল৷ কিন্তু পারল না। ইয়ামিন শক্ত করে প্লেট চেপে রেখে বলল,” খবরদার। এটা করলে খুব খারাপ হবে।”
উষসী চিৎকার করে বলল,” আমি খাবো না। এখনি আমার রুম থেকে বের হয়ে যান।”
ইয়ামিন চারিপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বলল,” আমার বাড়ি। আমার রুম। এখানে সবকিছু আমার। এমনকি তোমার শরীরে যে আছে, সেও আমার।”
উষসী ত্বরিতে হাত রাখল নিজের পেটে। ইয়ামিন জানল কি করে? ইয়ামিন আরেকটু কাছে এসে বলল,” তাই তোমার শরীরও আমার। এই শরীরের খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব। এদিকে এসো।”
ইয়ামিন হাত ধরে টেনে উষসীকে বিছানায় বসালো। চামচ দিয়ে ডোনাটের ছোট অংশ কেটে তার মুখের সামনে ধরল। উষসী বাঁধা দিয়ে বলল,” খাবো না আমি।”
” তোমার মুখের অবস্থা দেখেছো? শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে। আর কিছুক্ষণ না খেয়ে থাকলে মনে হচ্ছে বেহুশ হয়ে যাবে।”
একটু থেমে ইয়ামিন মুচকি হেসে বলল,” কাশ্মীরে আমাদের প্রথম দেখার কথা তোমার মনে আছে উষসী? তুমি আমাকে দেখেই বেহুশ হয়ে গেছিলে, ওহ গড! সেদিন যা ভয় পেয়েছিলাম আমি!”
লজ্জায় উষসীর মুখ থমথমে হয়ে উঠল। সেদিনের কথা মনে পড়তেই কেমন শিরশির করে উঠল গা। ইশ, কতই না বোকা ছিল সে তখন। ইয়ামিন মাঝে মাঝেই তাকে সেই ঘটনা মনে করিয়ে খোচা মা-রতে ভোলে না। প্রীতম ঠিকই বলতো, সে একটা আস্তো আঁতেল!
চলবে
#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ১১
লিখা- Sidratul Muntaz
ডোরবেল বাজছে। আয়শা ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিল। বাইরে লম্বা, রোগা-পাতলা দেহের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে। সে বিনয়ের স্বরে বলল,” গুড মর্ণিং।”
” গুড মর্ণিং, কে আপনি?”
” উষসী বাড়িতে আছে? আমি প্রীতম চৌধুরী। উষসীর ফ্রেন্ড।”
আয়শা ভ্রু কুচকে তাকাল। তার মনে পড়ছে গতরাতের ঘটনা। প্রীতম নামটা স্পষ্ট মনে আছে। এই ছ্যাচরার জন্যই তো ঝগড়া লেগেছিল স্যার আর ম্যাডামের। হঠাৎ সকাল সকাল এই লোকটা এখানে কেন এসেছে? এখন একে দেখে আবার যদি ঝগড়া লাগে!
এমনিতেও বাড়িতে অশান্তির শেষ নেই। আয়শা কখনোই চায় না ইয়ামিন আর উষসীর ডিভোর্স হয়ে যাক। তাদের দু’জনকে একসাথে দেখতে কত সুন্দর লাগে! ঠিক যেন মেইড ফোর ইচ আদার। অথচ তাদের মধ্যে কখনও মিল-মোহাব্বত হয় না। তার উপর প্রীতমের মতো উটকো ঝামেলা যদি আসে তাহলে তো তারা আরও দূরে সরে যাবে।
আয়শার মন চাইল মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দিতে। এই লোককে সে ঘরে ঢুকতে দেবে না। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে সেটা করতে পারল না। রুক্ষভাষায় বলল,” ম্যাডাম বাড়িতে নেই। আরেকদিন আসুন।”
পেছন থেকে উষসী তীক্ষ্ণ গলায় বলল,” কে বলেছে আমি বাড়িতে নেই? এইতো আমি।”
আয়শা ভয়ে জীভ কাটল। কাঁচুমাচু মুখ করে উষসীর দিকে ফিরে বলল,” স্যরি ম্যাডাম। আপনাকে সকাল থেকে দেখিনি তো, তাই মনে হচ্ছিল আপনি বুঝি বাড়িতেই নেই।”
উষসী কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল আয়শার দিকে। এই মেয়েকে সে নিষেধ করেছিল প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটা ইয়ামিনকে না জানাতে। তাও সে জানিয়েছে। এখন আবার প্রীতমকেও মিথ্যা বলে বিদায় করতে নিচ্ছিল। এসব কি ইয়ামিন শিখিয়ে দিয়েছে তাকে? কেন সে ইদানিং এতো বাড়াবাড়ি করছে?
আয়শা ধীরপায়ে লাউঞ্জরুম থেকে চলে গেল। উষসী প্রীতমের দিকে চেয়ে বলল,” ভেতরে আয় দোস্ত।”
প্রীতম ঢুকতে ঢুকতে বলল,” আজ ইউনিভার্সিটিতে যেতে ইচ্ছে করছিল না। ভাবলাম তোর সাথে দেখা করি। রাতে তো তোর মন ভালো ছিল না। এখন মন ভালো হয়েছে?”
আপস্টেয়ার থেকে উষসীর বেডরুমের সামনে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা দেখছিল ইয়ামিন। তার চোখেমুখে উত্তাপ। উষসী বলল,” এতোক্ষণ মন ভালো ছিল না। কিন্তু তোকে দেখে খুব ভালো লাগছে। এসে খুব ভালো করেছিস।”
প্রীতম চমৎকার করে হাসল। উষসী উপরে চেয়ে কেমন ক্ষোভ নিয়ে বলল,” এই বাড়িতে আমার এমনিতেও দমবন্ধ লাগে। তুই এলে অন্তত নিশ্বাস নিতে পারব।”
এই কথা শুনে ইয়ামিনের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো। এই বাড়িতে দমবন্ধ লাগে মানে? সে কি সবসময় উষসীর গলা টিপে ধরে রাখে নাকি? আজব! আর প্রীতম এলেই কেন সে নিশ্বাস নিতে পারবে? প্রীতম কি তার অক্সিজেন? ইয়ামিনের ক্রমশ মেজাজ খারাপ হচ্ছে।
প্রীতম কাউচে বসতে বসতে বলল,” বাই দ্যা ওয়ে, আমি কিন্তু আজ ব্রেকফাস্ট করিনি। ভেবেছি তোর সাথেই করব। তাই আমাদের দু’জনের জন্য পিজ্জা এনেছি। তুই তো পিজ্জা অনেক পছন্দ করিস।”
কথা শেষ করে সেন্টার টেবিলের উপর দুইটা বড় বড় প্যাকেট রাখল প্রীতম। উষসীর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। খুশিতে কেমন গদগদ ভাব নিয়ে বলল,”থ্যাঙ্কিউ দোস্ত। আমার খুব পিজ্জা খেতে মন চাইছিল। তুই ছাড়া আমার মন আর কে বুঝবে, বল?”
প্রীতম উচ্চশব্দে হাসল। উষসীও হাসতে লাগল। তাদের হাসির শব্দ বিষের মতো বাজছে ইয়ামিনের কানে। সকাল সকাল প্রীতমকে দেখেই গায়ে আগুন জ্বলছে। তার উপর উষসীর এমন আদিখ্যেতা একটুও সহ্য করা যায় না। সে ক্রোধের সাথে চেঁচিয়ে ডাকল,” আয়শা।”
আয়শা রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো, “জ্বী স্যার?”
ইয়ামিন প্রীতমকে শুনিয়েই গজগজ করে বলল,” দরজা কেন খুলেছো তুমি? লুকিং গ্লাসে না দেখে যাকে-তাকে বাড়িতে ঢুকতে দিবে না। আগেও নিষেধ করেছিলাম। তবুও ভুল কিভাবে হলো?”
প্রীতমের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। উষসী বলল,” এদিকে তাকা, কারো কথা শুনতে হবে না। তুই আমার কাছে এসেছিস৷”
ইয়ামিন দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” এই বাড়ি আমার। তাই এখানে আমার পারমিশন ছাড়া কেউ ঢুকতে পারবে না। তোমার ম্যাডামকে এই কথা জানিয়ে দাও আয়শা।”
আয়শা কেবল ইতস্তত ভঙ্গিতে উষসীর দিকে তাকাল। উষসী রূঢ় কণ্ঠে বলল,” আপনি যদি আরেকটা সিন ক্রিয়েট করেন তাহলে আমি এখান থেকে বের হয়ে যাবো। আপনার বাড়ি আপনি কোলে নিয়ে বসে থাকুন, চিবিয়ে খান। যেখানে আমার কোনো স্বাধীনতা নেই, সেখানে আমি থাকব না।”
উষসী উঠে দাঁড়ালো। প্রীতম কি করবে বুঝতে না পেরে সে নিজেও দাঁড়ালো। সে খুব বিব্রতবোধ করছে। এখানে আসাটা ভুল হয়েছে তা বুঝতে পারছে। ইয়ামিন চোয়াল শক্ত করে বলল,”হেই ইউ, গেট আউট। আর কখনও তোমাকে এই বাড়ির আশেপাশে দেখলে খুব খারাপ হবে।”
প্রীতমের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছে ইয়ামিন। উষসী তীব্র রাগ নিয়ে প্রতিবাদ করল,” আপনার প্রবলেম কি? খবরদার ওকে ইনসাল্ট করার চেষ্টাও করবেন না। তাহলে খুব খারাপ হবে। ও আমার বেস্টফ্রেন্ড। ও যদি বের হয় তাহলে আমিও বের হয়ে যাবো।”
” তোমাকে বের হতে দিলেই তো তুমি বের হবে।আমার অনুমতি ছাড়া তুমি কোথাও যেতে পারবে না। আয়শা, গার্ডকে বলো এই লোককে বের করে মেইন গেইট বন্ধ করতে এখনি। ”
উষসীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত জ্বলছে। সে কাঁপতে কাঁপতে বলল,” ওভাবে উপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অর্ডার না দিয়ে সাহস থাকে তো নিচে এসে কথা বলুন।”
ইয়ামিন প্রায় বাতাসের গতিতে নিচে নামল। তাকে এতো এগ্রেসিভ দেখাচ্ছে যে উষসী সামান্য ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল। ইয়ামিন প্রীতমের দিকে আগুন ঝরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। প্রীতমের কণ্ঠ কেমন শুকিয়ে এলো। কাশ্মীরে একবার উষসীকে টিজ করার জন্য সে ভয়ংকর মা-র খেয়েছিল ইয়ামিনের হাতে। সেই কথা এখন হঠাৎ কেন মনে পড়ল কে জানে? তখনকার পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি তো সম্পূর্ণ আলাদা! এখন তো সে জানে ইয়ামিন আর উষসীর ডিভোর্স হয়ে যাবে। অথচ ইয়ামিনের রিয়েকশন দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই। যাকে ডিভোর্স দেবে তার প্রতি এতো অধিকার ফলানোর মানে কি? প্রীতম বুঝতে পারছে না ইয়ামিনের মতলব।
ইয়ামিন প্রীতমের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উষসীর হাত চেপে ধরল৷ তারপর তাকে টেনে বাড়ির বাইরে একদম পার্কিং লটের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। উষসী ছটফট করে বলল,”আরে, আশ্চর্য! আমাকে ছাড়ুন, আপনি আবারও হার্ট করছেন আমাকে। আমি হাতে ব্যথা পাচ্ছি।”
ইয়ামিন গাড়ির দরজা খুলে উষসীকে এক ধাক্কায় ভেতরে ঢোকাল। তার এমন আচরণে বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেল উষসী৷ ইয়ামিন ঝুঁকে এসে থমথমে গলায় বলল,” তুমি হার্ট করোনি আমাকে? সকালে উঠে এই প্রথম আমি তোমার জন্য ব্রেকফাস্ট বানিয়েছি। কিন্তু তুমি সেটা না খেয়ে প্রীতমের সাথে বসে হাসতে হাসতে পিজ্জা খাচ্ছো? আমি এসব টলরেট করব তুমি ভাবলে কি করে?”
উষসী কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে ক্ষীপ্ত কণ্ঠে বলল,” আপনি এই কথা বলছেন? আমার ভাবতেই হাসি পায় যে আপনি এসব বলছেন! সামান্য এইটুকু বিষয়ে এতো ইগো হার্ট হলো আপনার? তাহলে আমার কথা চিন্তা করুন, আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন জেনে আমার কতটা রাগ দেখানো উচিৎ? ”
” আমি আগেও বলেছি, এটা আমার কন্ট্রোলে নেই। জোর করে ভালোবাসা হয় না। কিন্তু এখন…”
ইয়ামিনকে কথা শেষ করতে দিল না উষসী। এর আগেই গর্জে উঠল,” আপনার বেলায় জোর করে কিছু হয় না কিন্তু আমার বেলায় জোর করে সব হতে হবে তাই না?”
ইয়ামিন শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল। নরম স্বরে কিছু বলার আগেই উষসী পুনরায় চেঁচিয়ে উঠল,” আপনি সকালে আমার জন্য কি ব্রেকফাস্ট বানিয়েছিলেন? চকলেট ডোনাটস! অথচ চকলেট আমি খাই না। আমাকে জীবনে চকলেট খেতে দেখেছেন আপনি? আমার পছন্দ-অপছন্দের বিষয়ে কখনও খেয়াল রেখেছেন? অথচ প্রীতমকে দেখুন৷ সে আমার হাজব্যান্ডও না, বয়ফ্রেন্ডও না। জাস্ট ফ্রেন্ড। তবুও আমার কত কেয়ার করে। আমার মনখারাপ জেনে সে আজ ভার্সিটি পর্যন্ত যায়নি। সরাসরি এখানে চলে এসেছে আমার মন ভালো করার জন্য। পিজ্জা নিয়ে এসেছে কারণ আমি পছন্দ করি…”
ইয়ামিন খুব তীব্র গলায় বলল,” শাট আপ।”
তারপর সে খুব জোরে গাড়ির ছাদে থাপ্পড় মা-রল। উষসী কেঁপে উঠল। সাথে সাথে চুপ করে গেল। ইয়ামিন আক্রমণাত্মক গতিতে ড্রাইভিং সিটে এসে বসল। এতো দ্রুত ড্রাইভ করতে লাগল যে উষসী ভয়ে শিটিয়ে গেল৷ যদি এক্সিডেন্ট হয়?
ইয়ামিন গাড়ি নিয়ে সরাসরি আমাজন ফ্রেশে চলে গেল। সারারাত ঘুম হয়নি তার। শরীর ক্লান্ত। এই অবস্থায় হাঁটতেও ইচ্ছে করছে না তবুও ইয়ামিন অনেক হাঁটল। একটা আলাদা উত্তেজনা তার শরীরে শক্তি যুগিয়ে দিয়েছে।
উষসীর যত ধরণের খাবার পছন্দ ছিল সব কিনে নিতে লাগল ইয়ামিন। এসব দেখে উষসী কি বলবে বুঝতে পারল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল পাগলের কান্ড।
উষসী কোল্ড্রিংক্স খেতে পছন্দ করে। ইয়ামিন অনেক ধরণের কোল্ড্রিংক্স এর বোতল নিল। এছাড়াও উষসীর পছন্দের চিপস, কুকিজ, আইসক্রিম কিনল। সে বোঝাতে চায় উষসীর পছন্দের ব্যাপারে খুব ভালো করেই তার জানা। একজন সেলস গার্ল ইয়ামিনকে এতো শপিং করতে দেখে প্রশ্ন করল,” আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি, স্যার?”
মেয়েটি কথা বলার সময় ইচ্ছাকৃত ইয়ামিনের বাহু ছুঁয়ে দিল। তাই দেখে উষসীর ব্রক্ষতালু জ্বলে উঠল ঈর্ষায়।
ইয়ামিন বলল,” হ্যাঁ নিশ্চয়ই। ”
উষসী বলল,” কোনো দরকার নেই।” এই কথা বলার পর সে নিজেই কেমন অস্বস্তিতে পড়ে গেল। মেয়েটি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে। উষসী মাথায় হাত রেখে লজ্জিত স্বরে বলল,” স্যরি।”
মেয়েটি ইয়ামিনের দিকে ঘুরে বলল,” এতো খাবার কিনছেন… বাড়িতে কি পার্টি আছে?”
ইয়ামিন উত্তর দিল,” না। আসলে আমার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট। এই সময় মেয়েদের খুব মুড সুইং হয়। পছন্দের খাবার না পেলে বাড়ি থেকে বের হয়ে জাস্টফ্রেন্ডের কাছে চলে যেতে পারে। সেজন্য ওর পছন্দের সব খাবার কিনে স্টক করছি।”
উষসী রাগে আর অস্বস্তিতে কপালে হাত ঠেঁকালো। সেলসগার্ল মিষ্টি করে বলল,” সো সুইট! কংগ্রাচুলেশনস বোথ অফ ইউ।”
উষসী কোনো কথা বলল না। ইয়ামিন বলল,” থ্যাংক ইউ।”
” কিন্তু স্যার, আপনি ম্যামের জন্য এতো আনহেলদি খাবার কিনছেন… এটা তো ঠিক না। এতো সফট ড্রিংক্স এই অবস্থায় একদমই খাওয়া উচিৎ না।”
ইয়ামিন সিরিয়াস গলায় বলল,” তাই নাকি?”
” জ্বী। আপনি ম্যামের জন্য ফলের জুস নিতে পারেন। অনেক টেস্টি। আর চিপস, কুকিজ, এইসব না নিয়ে হেলদি খাবার নিন। যেমন বিনস, চীজ, ফ্রুটস।”
” ওকে।”
ইয়ামিন খুব মনোযোগ দিয়ে শপিং শেষ করল। সেলসগার্ল সব প্যাক করে দিতে দিতে বলল,” আপনি অনেক কেয়ারিং হাসব্যান্ড। ম্যাম সত্যি খুব লাকি।”
উষসী এই কথা শুনে তাচ্ছিল্য হাসল। ফিসফিস করে বলল,” নিয়তির চরম নিষ্ঠুরতা যে এই লোক আমার কপালে জুটেছে।”
মানুষ অতিরিক্ত দুঃখ সহ্য করতে করতে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। উষসীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সে নিজের অজান্তেই ইয়ামিনের উপর প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। ইয়ামিন তো তার উপর কম অন্যায় করেনি। অথচ সে, অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিল ইয়ামিনকে। কাশ্মীরে তাদের সেই প্রথম দেখার কথা আবারও মনে পড়ছে। সেদিন থেকেই তো শুরু হয়েছিল উষসীর জীবনের সর্বনাশ!
চলবে