#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৯
লিখা- Sidratul Muntaz
কামলা সিংএর গেস্ট হাউজের ঠিক বরাবর একটি বিচ্ছিন্ন ব্যালকনিতে কালো জ্যাকেট আর মাফলার পরে ইয়ামিন বসে আছে। সুন্দর চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থাসম্পন্ন শীতল, শ্বেত, শুভ্র আবহাওয়ায় আপেল- টিউলিপ গাছে ঘেরা ব্যালকনিটিতে এই মুহুর্তে হিমাচলের ঠান্ডা বাতাস হু হু করে প্রবেশ করছে। ইয়ামিনের কানে ধারালো ছুরির মতো আক্রমণ করছে সেই বাতাস। আজকে তাপাত্রা ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। গরমকালেই যদি এ অবস্থা হয় তাহলে শীতকালের পরিণতি চিন্তা করেই গাঁয়ে কাটা দিচ্ছে। এই শীতের মধ্যে শ্যুটিং করতে খুব কসরত পোহাতে হবে। হাত-পা এখনি জমে যাচ্ছে।
একটু পরেই একটা গোলাপী শাল গাঁয়ে জড়িয়ে অল্পবয়স্ক একটি মেয়ে দুই বেণী দুলাতে দুলাতে এগিয়ে এলো। মেয়েটার শরীর কাঁপছে। ঠান্ডায় কাঁপছে না উত্তেজনায় কাঁপছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ইয়ামিনের সামনে এসে দাঁড়াতেই মেয়েটা স্ট্যাচু হয়ে রইল। তার হাত-পায়ের সাথে সাথে এখন চোখের পলকও কাঁপছে। ইয়ামিন বুঝতে পারল শীতের জন্য না, এই কম্পনের উৎস উত্তেজনা! মেয়েটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মুচকি হেসে ফেলল ইয়ামিন। মেয়েটা সাথে সাথেই মাথায় হাত রেখে ভূমিতে বসে পড়ল। অস্পষ্ট স্বরে হিন্দি বলল,” কাহি ইয়ে কয়ি সাপ্না তো নেহি!”
ইয়ামিন উঠে দাঁড়ালো। সে বিনয়ের সাথে মেয়েটাকে দুইহাতে তুললো। মেয়েটা ভয়ানকভাবে কাঁপতে লাগল। তার ফরসা মুখ লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে গেছে। ইয়ামিনের দিকে টলমল দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে দ্রুত পালালো। অপরিচিতার এমন অদ্ভুত কান্ডে ইয়ামিন কি করবে খুঁজে পেল না। পুনরায় নিজের জায়গায় এসে বসে রইল।
তখনি আগমন ঘটল কামলা সিংএর। আঠাশ বছরের তরুণী কামলা সিংকে দেখে ইয়ামিন ভীষণ রকম একটা ধাক্কা খেল। কৈশোরের পুরনো আবেগ যেন নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে ফিরে এলো। কামলাকে দেখতে যেন পুরোপুরি উষ্ণতার মতো। তার হাঁটার ভঙ্গি, চাল-চলন, হাসি, সবকিছুই যেন উষ্ণতারই কার্বন কপি। সে সামনে এসে যখন হঠাৎ হেসে উঠল, ইয়ামিনের বুক কেঁপে উঠল তীক্ষ্ণভাবে। এই শীতেও ভদ্রমহিলার গাঁয়ে স্লিভলেস টপ আর সফট টাইডস। ইয়ামিনের সামনে এসে হাসিমুখে বসল কামলা। খুব সপ্রতিভ স্বরে বলল,” হাই!”
ইয়ামিন কথা বলল না। স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।হিমাচলের রুক্ষ বাতাসে কামলার কোঁকড়া চুলগুলো উড়ছে।সৃষ্টি হয়েছে এক অন্যরকম স্নিগ্ধ পরিবেশের। ইয়ামিনের বুকের তোলপাড় বেড়ে গেছে বহুগুণে।
________________________
গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে বিমানে করে রওনা দিয়েছিল উষসীরা। আজ দুপুরের মধ্যে তারা দিল্লির ইন্ধিরা গান্ধী বিমানবন্দর হয়ে শ্রীনগর আসে। হোটেল আগে থেকেই বুকড ছিল। কিন্তু হোটেল অবধি যেতে আরও একঘণ্টার মতো লাগবে। সবাই খুব ক্ষুধার্ত ছিল তাই একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চের জন্য ঢুকল। তৃষাণ আর আহমেদ খাবার অর্ডার দিয়ে ব্যাংকে চলে গেল। টাকা বদলে রুপিতে কনভার্ট করতে হবে। কার্ড থাকলেও হাতে কিছু ক্যাশ রাখা প্রয়োজন।
উষসী ভেবেছিল তারা কলকাতা হয়ে যাবে। কিন্তু সরাসরি দিল্লী হয়ে আসায় সে কিছুটা বিরক্ত! প্রীতমকে বলল,” দেখেছিস তৃষাণ ভাইয়া কত শয়তান? আমি কলকাতা যাবো বলেছিলাম, তাই উনি কলকাতা দিয়ে না এসে ডিরেক্ট দিল্লীতে নিয়ে এসেছেন। যাতে আমার কলকাতা দেখার ইচ্ছে পূরণ না হয়।”
প্রীতম অতি বিরক্ত গলায় বলল,” তুই শুধু আজাইরা চিন্তা করিস কেন? কলকাতা থেকে শ্রীনগরের সরাসরি কোনো ফ্লাইট নেই। তাই দিল্লী হয়ে আসতে হয়েছে। মূর্খ একটা!”
” এই তুই আমাকে মূর্খ বললি কেন? তোর কান টেনে ছিঁড়ে ফেলবো আমি।”
অনুপমা আইলাকে উষসীর কোলে দিয়ে বলল,” উষু, ওকে একটু রাখো তো। তোমার ভাইয়া থাকলে ওর কাছেই দিতাম। কিন্তু সে তো নেই। আমি ওয়াশরুম হয়ে আসছি।”
” ঠিকাছে যাও আপু।”
উষসী আইলাকে কোলে নিতেই সে কাঁদতে শুরু করল। উষসী বলল,” কি হয়েছে আইলামনি? তুমি কাঁদছো কেন?”
প্রীতম ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলল,” কাঁদবে না? এমন ভূতের মতো হরিবল চেহারা দেখে যেকোনো বাচ্চারই আত্মা কেঁপে উঠবে। আচ্ছা, তুই হরর মুভির জন্য অডিশন দিচ্ছিস না কেন?”
” আমি ঘুষি মেরে তোর খাড়া নাকটা চ্যাপ্টা বানিয়ে দেই এটাই কি চাইছিস তুই?”
প্রীতম হু হা করে হেসে লুচি চিবোতে লাগল।
কাশ্মীর আসার পর থেকেই কীর্তি অবিরত ফোন করে যাচ্ছে ইয়ামিনকে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও আনব্লক করে ম্যাসেজ দিতে শুরু করেছে। অথচ সে নিজেই বলেছিল ইয়ামিনের সাথে যোগাযোগ রাখতে চায় না। এখন হঠাৎ করে কি হলো মেয়েটার? বার-বার কেটে দেওয়ার পরেও কল দিয়েই যাচ্ছে কীর্তি। এতো যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ইয়ামিন ফোনটা ধরল।
” হ্যালো।”
” ইয়ামিন, তুমি কি কাশ্মীর গিয়েছো?”
” হ্যাঁ এসেছি। তাতে আপনার কি?”
” তুমি আমাকে আপনি করে কেন বলছো? উই আর বেস্টফ্রেন্ডস, রাইট?”
” ছিলাম কিন্তু এখন নেই।”
” মানে?”
” যা বলার দ্রুত বলুন। আমার এখানে অনেক কাজ আছে।”
” তুমি আমাকে কাজ দেখিও না। এটলিস্ট আমার চেয়ে বেশি ব্যস্ত তুমি না। সাতটি বিজ্ঞাপনের শ্যুটিং বন্ধ রেখে আমি তোমার সাথে কথা বলছি।”
” এটা আপনার পারসোনাল প্রবলেম। কেন বলছেন?”
” ইয়ামিন, তুমি আমার সাথে এমন করতে পারো না। তুমি বলেছিলে তোমার নিউ গানের শ্যুটিংএ তোমার কো-আর্টিস্ট হিসেবে আমি থাকবো। এখন তুমি আমাকে বাদ দিয়ে কামলা সিংকে নিচ্ছো? সে কি আমার চেয়ে বেটার?”
” আমি আপনাকে বাদ দেইনি। আপনি নিজেই আমাদের মধ্যে যে ডিল হয়েছিল সেটা ভেঙে দিয়েছেন। একবারও চিন্তা করেননি এইজন্য আমাকে কতটা সাফার করতে হবে। আমাকে বিপদে ফেলে মজা দেখতে চেয়েছিলেন। লাকিলি সময়মতো আমি কামলা সিং এর সন্ধান পেয়েছি। তাই এ যাত্রায় উতরে যেতে পেরেছি। তিনি আমাকে নিজে ইনভাইট করেছেন। তাঁর গেস্ট হাউজে শ্যুটিং এর আইডিয়াও দিয়েছেন। সো, এখন আমার আপনাকে আর কোনো দরকার নেই মিস কীর্তি শর্মা। ভালো থাকবেন।”
” নো,নো,নো, তুমি এটা করতে পারো না ইয়ামিন।”
” আপনি যদি সামান্য একটা পারসোনাল প্রবলেমকে কেন্দ্র করে এতোবড় ড্রামা করে ফেলতে পারেন তাহলে এইটুকু তো আমাকে করতেই হবে।”
” সামান্য? এই প্রবলেম তোমার সামান্য মনে হচ্ছে? নিজের বুকে হাত রেখে বলতে পারবে যে তুমি আমার সাথে বিট্রে করোনি?”
” আমি আপনাকে কখনও ভালোবাসার কথা বলিনি। শুধু আপনার সাথে ফ্রেন্ডলি ছিলাম। এখন আমার এই ফ্রেন্ডলি বিহেভিয়ারের জন্য যদি আপনি অন্য কিছু ভেবে বসেন তাহলে আমার কিছু করার নেই। আই এম স্যরি।”
কীর্তির চোখ দিয়ে নিঃশব্দে জল পড়ল। ফোনের ওইপাশে অবস্থানরত ইয়ামিন তা জানে না। কীর্তি স্থবির হয়ে আসা কণ্ঠে বলল,” ফ্রেন্ডলি বিহেভ? রাতের পর রাত জেগে তুমি আমাকে প্রেমের গান লিখে পাঠিয়েছো। তোমার সব পারসোনাল প্রবলেম আমার সাথে শেয়ার করেছো। এমনকি লাস্ট ইয়ার যখন আমরা সিডনি গেলাম, তুমি আমার সাথে ওয়ান নাইট স্টে করেছো। এতোকিছু আমি কিভাবে ভুলে যাই?”
” সিডনিতে এমন কিছুই হয়নি মনে রাখার মতো। আমরা জাস্ট এক রুমে ছিলাম। ভুল কিছুই করিনি। বরং আপনি করতে যাচ্ছিলেন এবং সেটাও আমি সামলেছি। আর গান পাঠানোর কথা বলছেন? সেটা আমি সব কো-আর্টিস্টকেই পাঠাই। তাছাড়া আপনাকে ফ্রেন্ড ভেবে পারসোনাল প্রবলেমগুলো শেয়ার করতাম। আপনি এমন উল্টো ভেবে বসবেন জানলে কখনোই বলতাম না।”
” তুমি কি সারাজীবন সিঙ্গেল থাকবে? সালমান খান হতে চাও? একদিন না একদিন তোমাকে মুভঅন করতেই হবে ইয়ামিন। ছোটবেলায় কাকে না কাকে ভালোবেসেছিলে, যে তোমাকে এখন ভুলে পর্যন্ত গেছে, স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে আছে, সেই তার কথা ভেবে কেন নিজেকে এতো কষ্ট দিচ্ছো? এটা পাগলামী ছাড়া আর কি?”
ওই পাশ থেকে জবাব এলো না৷ কীর্তি আবার বলল,” কাউকে না কাউকে তোমার বিয়ে করতেই হবে। মানুষ একা বাঁচতে পারে না। তুমিও পারবে না। নতুন কেউ তোমার জীবনে নিশ্চয়ই আসবে। আর সেই কেউটা যদি আমি হই, তাহলে প্রবলেম কি ইয়ামিন? বলো না!”
” এ বিষয়ে আমাদের মধ্যে অনেক আগেই কথা হয়ে গেছে। তাহলে আবার কেন পুরনো বিষয় তুলে আনা?”
” তুলে আনছি কারণ আমি আর পারছি না!আই এম ফেডআপ। নাউ আই নীড ইউ ব্যাডলি।”
ইয়ামিন বাধ্য হয়ে লাইন কেটে দিল। দু’ফোঁটা গাঢ়, উত্তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ল কীর্তির মোবাইল স্ক্রিনে। নির্ণিমেষ সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল কীর্তি। ইয়ামিন কবে বুঝবে তাকে?
ইয়ামিন ফোন রেখে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছল। ক্লান্তি ভর করেছে শরীরে। গোসল শেষ করার পর এখন অনেকটাই চাঙ্গা লাগছে। একটু কফি পাওয়া গেলেই এখন ষোলকলা পূর্ণ হতো। কামলার গেস্ট হাউজটা অনেক বড়। ইয়ামিনকে যেই রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে তা দক্ষিণ দিকে। কাঁচের দেয়ালে ঘেরা পুরো ঘর। যেদিকেই চোখ যায় শুধু শুভ্র পাহাড়। অসাধারণ দৃশ্য! এ যেন কোনো স্বর্গলোক।
এখানে আপেল গাছের অভাব নেই। আর কিছুদিন পরেই গাছে গাছে রঙিন আপেল দেখা যাবে। কাঁচের দেয়ালে কুয়াশা জমে ঝাপসা আবরণ সৃষ্টি করেছে। ইয়ামিন পকেট থেকে টিস্যু বের করে ঝাপসা আবরণ টুকু মুছে নিল। এইবার ঝকঝকে শীতল পরিবেশ দেখা যাচ্ছে। এ ধরণের কাঁচ সূর্যের উত্তাপ ধরে রাখতে সহায়ক। তাই ঠান্ডা কম লাগে। তবে রাতের বেলা খবর হয়ে যায়। কারণ তখন সূর্যের উত্তাপ থাকে না। ইয়ামিন টি-শার্টের উপর হুডি, ট্রাউজার আর স্নিকার্স পরে তৈরী হচ্ছিল বাইরে বের হওয়ার জন্য। এমন সময় কেউ দরজায় কড়া নাড়ল। ইয়ামিন বলল,” কাম ইন। ”
কামলা একজন মেইডকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। ইয়ামিনের জন্য ট্রে’তে করে কফি আর হালকা স্ন্যাকস আনা হয়েছে। মনে মনে ইয়ামিন কফিটাই চাইছিল। তার চেহারায় সন্তুষ্টির হাসি ফুটল। কামলা হিন্দিতে বলল,” কোথাও বের হচ্ছো?”
” হুম। এলাকাটা একটু ঘুরে আসি।”
” চলো আমিও যাবো।”
” তুমিও?”
” হুম। আগে কফি খেয়ে নেই তারপর।”
কামলা ইয়ামিনের হাতে কফির মগ দিয়ে নিজেও নিল। তারপর ইয়ামিনের বিছানায় বসতে বসতে বলল,” তুমি কাশ্মীরে ঘুরতে এসেছো কখনও?”
” এমনি ঘুরতে কখনও আসা হয়নি। কিন্তু শ্যুটিং এর জন্য বেশ কয়েকবার এসেছি।”
” শ্যুটিং এর জন্য আসা আর ঘুরতে আসা তো এক না। দুইটা ভিন্ন ব্যাপার।”
” শ্যুটে আসলে তো এমনিই ঘোরা হয়ে যায়।”
” উহুম। এটা একটা ভুল কথা। তখন মেইন ফোকাস শ্যুটিং এ থাকে, ঘোরাঘুরিতে না। ঘোরাঘুরি করতে হয় মন-প্রাণ উজাড় করে, প্রকৃতির সাথে নিজের অস্তিত্ব মিশিয়ে দিয়ে! আজকে আমরা শুধু ঘুরবো। নো কাজ, নো ক্যামেরা,নো শ্যুটিং। ওকে?”
” তাহলে শ্যুট?”
” কাল থেকে শুরু করবে।”
ইয়ামিন হেসে বলল,” ওকে!”
হোটেলে পৌঁছেই সবাই যার যার রুমে ঢুকে গেল। লম্বা জার্ণির পর সবার শরীরে ক্লান্তি ভর করেছে।এখন লম্বা একটা ঘুম প্রয়োজন। মোট চারটি রুম বুক করা হয়েছিল। উষসী, তৃষ্ণা, ডোনা আর যুথি চারজনের জন্য প্রথম রুম। প্রীতমের জন্য একাই দ্বিতীয় রুম! তৃতীয় রুমে উষ্ণতা আর তৃষাণ। আহমেদ,অনুপমা, আইলা চতুর্থ রুমে। দুপুরে অল্প-স্বল্প বিশ্রামের পর বিকালে সবাই ঘুরতে বের হলো। কাশ্মীর ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য স্বর্গ।
শ্রীনগর হচ্ছে কাশ্মীরের কেন্দ্র। এখানের মোঘল গার্ডেন, ডাল লেক, নাগিন লেক, শিকারা রাইড, হযরত বাল মসজিদ দর্শনের মতো উল্লেখযোগ্য জায়গা। তবে উষসীর মূল আকর্ষণ ছিল সোনামার্গের সিন্ধু নদী, ওয়াটারফল যেখানে বজরঙ্গী ভাইজান ও রাম তেরা গঙ্গা মেরে ছবির শ্যুটিং হয়েছিল। একদিনের মধ্যে এতো জায়গা ঘুরে বেড়ানো সম্ভব না। আজ তারা শুধু শ্রীনগরেই ঘুরে বেড়ায়। কাল সোনামার্গ যাবে। আর রাত ৮টার পর সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে পরিবেশ নীরব হয়ে যায়। তাই উষসীরা ঘুরাঘুরি শেষ করে ৮টার আগেই হোটেলে ফিরে আসে।
উষসী ভেবেছিল বন্ধুরা দলবেঁধে এলে ইচ্ছেমতো বাঁদরামি করা যাবে। বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের মতো ঘোরা হবে। কিন্তু উষসীর বন্ধুরা কেউ এলো না। শুধু এসেছে প্রীতম। তাকে নিয়ে তো যেখানে-সেখানে ঘুরতে চলে যাওয়া যায় না। সারাক্ষণ তৃষাণ ভাইয়ের রেস্ট্রিকশনে থাকতে হচ্ছে। কি মুশকিল! আর প্রীতমও যা-ইচ্ছে তাই। উষসী তাকে একবার বলেছিল,” দোস্ত চল আমরা একসাথে নৌকায় উঠি।”
প্রীতম ধমক মেরে বলেছে,” তোর মতো ঢঙ্গীকে নিয়ে আমি নৌকায় উঠবো? খেয়ে কাজ নেই আমার? পরে দেখা যাবে লাফ-ঝাঁপ মেরে আমাকেই পানিতে ফেলে দিবি।”
ঘড়িতে এখন সাড়ে আটটা বাজছে। ডোনা আর যুথি গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। তৃষ্ণা তার ট্যাবে গেমস খেলছে। আর উষসী একা একা বোর হচ্ছে। একবার প্রীতমের ঘর থেকে ঘুরে আসলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ! উষসী একটা কালো-সাদার মিশেলের শাড়ি পরল। লম্বা চুল পেছনে ছেড়ে কানের পাশে টিউলিপ ফুল গুঁজল। এই ফুলগুলো আজ প্রীতম তাকে টিউলিপ গার্ডেন থেকে চুরি করে এনে দিয়েছিল। উষসী ফুলগুলো নেওয়ার সময় দুষ্টুমির ছলে বলেছিল,” এসব আমাকে দিচ্ছিস কেন? আমি কি তোর গার্লফ্রেন্ড লাগি?”
প্রীতম মুখ গোমরা করে বলেছে,” গার্লফ্রেন্ড তো নেই। তাই তোকেই দিতে হচ্ছে। কি করবো বল?”
উষসী তখন বলেছিল,” ঠিকাছে, আমি তাহলে এগুলো নিজের কাছে গচ্ছিত রাখি। যদি কখনও তোর গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা হয় তাহলে দিয়ে দিব।”
উষসী খুব সুন্দর করে চোখে কাজল আর ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে সেজেগুজে রুম থেকে বের হলো। তাকে অস্বাভাবিক সুন্দর লাগছে দেখতে। উষসী খুব সাবধানে তৃষাণদের রুম এড়িয়ে প্রীতমের রুমে চলে গেল। প্রীতম আরাম করে বিছানায় শুয়েছিল। উষসীকে দেখে ভারী বিরক্ত গলায় বলল,” কিরে? এই রাত-বিরাতে তুই ফুলকুমারি সেজেছিস কেন?’
” ইচ্ছে হয়েছে তাই সেজেছি। এখন চল, আমার চা খেতে ইচ্ছে করছে। টং এর দোকান খুঁজি।”
” এটা কি বাংলাদেশ পেয়েছিস যে রাত বারোটা পর্যন্ত টং এর দোকান খোলা থাকবে? এখানে আটটার মধ্যে সব বন্ধ হয়ে যায়। আর রাত দশটা মানে নিশুতি রাত। কোথাও কিছু নেই। যা ঘুমিয়ে থাক। চা সকালে খাবি।”
” আমি এখনি বের হবো। আর তুই যদি আমার সাথে না আসিস তাহলে আমি একাই যাবো।”
” বাড়াবাড়ি করিস না উষু।”
” বাড়াবাড়ি তুই করছিস প্রীতি। কাশ্মীর আমি ঘুমাতে আসিনি। প্রথমবার এই জায়গায় এলাম। একটু ঘোরাঘুরি করবো না? প্লিজ চল দোস্ত।”
” বাইরে গিয়ে অপেক্ষা কর। আমি হুডি নিয়ে আসছি। আর তুই এই পাতলা শাল পরেছিস কেন? তাপমাত্রা দেখেছিস? পাঁচ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। বাহিরে তুষারপাত হচ্ছে।”
উষসী নিজের ঘরে গিয়ে জ্যাকেট নিয়ে এলো। কিন্তু হোটেলের বাইরে তারা বের হতে পারল না। গার্ড মেইন দরজা আটকে রেখেছে। উষসী মনখারাপ করে তাকাতেই প্রীতম একটা বুদ্ধি বের করল। একটা লোহার মোটা ড্রাম চুরি করল তারা। সেটির মাধ্যমে দেয়াল টপকে লাফিয়ে ওই প্রান্তে চলে গেল প্রীতম। কিন্তু উষসী তো শাড়ি পরে এতোবড় লাফ দিতে পারবে না।
অসহায়ের মতো বলল,” এবার কি হবে দোস্ত?”
” ভালো হয়েছে। ঢং করে শাড়ি পরতে গেছিলি কেন?”
উষসী কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,” কিছু একটা কর প্লিজ।”
” দাঁড়া দেখছি। ”
প্রীতম এইবার উবু হয়ে ঘোড়ার মতো বসল। উষসীকে নির্দেশ দিল তার পিঠে পা রেখে নেমে আসতে। উষসী প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। প্রীতম বলল,” কাহিনি করিস না। এক চড় মেরে ঘরে দিয়ে আসবো। তখন কেঁদে কুল পাবি না।”
উষসী আর উপায়ন্তর না পেয়ে ওইভাবেই প্রীতমের পিঠে ভর দিয়ে দেয়াল টপকে ওই প্রান্তে পৌঁছালো। প্রীতম বলল,” দ্যাখ,,চারদিকে কেমন তুষারপাত হচ্ছে। রাস্তায় কোনো মানুষ নেই। কোথায় যাবো আমরা?”
উষসী প্রীতমের হাত ধরে মিষ্টি করে বলল,” চল হাঁটি।”
প্রীতম জানে কাজটা ঠিক হচ্ছে না। এইরকম জায়গায় অযথা ঘুরাঘুরি করলে যেকোনো সময় তারা বিপদে পড়তে পারে। কিন্তু উষসীর এমন মিষ্টি আবদার ফেলতেও মায়া লাগছে। মনে হচ্ছে থাক না, স্মৃতির ডায়েরীতে কিছু রোমাঞ্চকর অনুভূতি, মায়াবী রাতের হাসি-ঠাট্টা ভরা গল্প, কিছু একান্ত সুন্দর মুহুর্ত! হয়তো এমন একটা সময় আসবে যখন উষসী তার পাশে থাকবে না। থাকবে এই অন্ধকার শীতল রাতের পাগলামিভরা দুষ্টুমিগুলোই!
চলবে