#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৭
লিখা- Sidratul Muntaz
জানালায় মাথা ঠেঁকিয়ে উদাস ভঙ্গিতে বসে আছে উষসী। পৃথিবী অসহ্যবোধ হচ্ছে তার। প্রীতম দুই মগ ব্ল্যাক কফি এনে তার সামনে রাখল। আগ্রহী কণ্ঠে বলল,” তারপর? কি খবর, বল।”
উষসী বাইরে দৃষ্টি ন্যস্ত রেখে নিরস কণ্ঠে বলল,” আমি প্রেগন্যান্ট। ”
প্রীতমের হাত থেকে কাঁচের কফি মগ দু’টো পিছলে পড়ে গেল। একটা ভাঙল অন্যটা সে ধরে ফেলল। উষসী তার এহেন কান্ডে হেসে উঠল খিলখিল করে। কতদিন পর হাসল সে! প্রীতম অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে হঠাৎ শুধাল,” মানে কি? এসব কিভাবে সম্ভব? ইয়ামিন ভাই আর তুই…. মানে তোদের মধ্যে তো স্বাভাবিক সম্পর্কই ছিল না কখনও।”
উষসী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আবারও মনে পড়ে যায় সেই অভিশপ্ত রাতটির কথা। যে রাত তার জীবন বদলে দিয়েছে। কৈশোর থেকে মনের মধ্যে যত্ন করে পুষে রাখা স্বপ্ন এক নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে৷ ভাবতেই কেমন দমবন্ধ বোধ হলো। ওদিকে প্রীতম প্রশ্ন করেই চলেছে৷ এক মুহূর্তও শান্ত হয়ে বসতে পারছে না সে। তার চেহারায় তীব্র কৌতুহল,” উষু, এটা কিভাবে সম্ভব? তুই কি শিউর যে তুই প্রেগন্যান্ট?”
উষসী তার প্রেগন্যান্সি রিপোর্টটা বের করে সরাসরি প্রীতমের হাতে দিল। প্রীতম খুঁটিয়ে দেখতে লাগল রিপোর্ট। উষসী যন্ত্রের মতো বলল,” গত কয়েকদিন ধরেই সন্দেহ হচ্ছিল। প্রচুর বমি হয়। মাথা ঘুরায়। আর সব খাবারেই কেমন আঁশটে গন্ধ। তাই কনফার্ম হওয়ার জন্য টেস্ট করিয়েছিলাম। সেই রিপোর্ট আজ হাতে পেয়েছি। বড্ড খারাপ লাগছে৷ এই অবস্থাতেও আমি অতিরিক্ত ড্রিংক করেছি। বাচ্চার কি কোনো ক্ষতি হবে?”
” তুই তোর বাচ্চার ক্ষতি নিয়ে ভাবছিস? এই বাচ্চা কি আদৌ ইয়ামিন ভাইয়ের? নাকি তুই প্রতারণা করেছিস তার সঙ্গে? ”
উষসী মুচকি হেসে বলল,” তোর কি তাই মনে হয়? আমি আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছি ঠিক, কিন্তু এতোটাও বদলে যাইনি যে ক্যারেক্টারলেস হয়ে যাব।”
প্রীতম দিশেহারার মতো জানতে চাইল,” তাহলে বাচ্চা? এটা কিভাবে এলো?”
” বাচ্চা কিভাবে এলো সেটাও কি তোকে এক্সপ্লেইন করতে হবে এখন?”
উষসীর স্পষ্ট প্রশ্নে প্রীতম অপ্রস্তুত হলো। হকচকানো কণ্ঠে বলল,” স্যরি… মানে আমি কখনও চিন্তা করিনি যে তোদের সম্পর্ক এতো সহজে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”
উষসী বেদনাতুর কণ্ঠে বলল,” আমাদের সম্পর্ক কখনোই স্বাভাবিক ছিল না। আর হওয়ার প্রশ্নও আসে না৷ এটা একটা এক্সিডেন্ট বলা যায়। আমি এই বাচ্চা রাখতে চাই না৷ কিন্তু ফেলতেও পারব না৷ তাই ঠিক করেছি, ইয়ামিনকে ওর কথা জানতেই দিবো না৷ এর আগেই আমি ইয়ামিনের থেকে ডিভোর্স নিবো।”
” কি বলছিস তুই? আসলেই ডিভোর্স নিবি?”
” তোর কি মনে হয়, এতোকিছুর পরেও ওর সঙ্গে আমার সংসার করা উচিৎ? ”
প্রীতম নিশ্চুপ হয়ে গেল। মনে মনে সে বলল কিছু একটা। যা উষসী ভাবতেও পারবে না। ঘড়ির দিকে চাইতেই টনক নড়ল উষসীর। অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ রাত সাড়ে আটটা বাজে। প্রীতম তার এপার্টমেন্টে ছিল না। উষসী অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করেছে। কিন্তু এতোরাত হয়ে যাবে এটা সে ভাবেনি।
ইউএসএ’তে স্কলারশিপ পেয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার একটা ইউনিভার্সিটিতে ভতি হয়েছে প্রীতম। উষসীর সাথে তার মাত্র কয়েকদিন আগে যোগাযোগ হয়েছে৷ এতোদিন বাড়ি থেকে বের হওয়ার ফুরসত পায়নি সে। তাই আজ সুযোগ পেয়েই প্রীতমের সঙ্গে দেখা করতে চলে এসেছে। জীবনের সমস্যাগুলো নিয়ে যদি বিশ্বস্ত কারো আলোচনা করা যায় তাহলে মন অনেকটা হালকা হয়। উষসী জানে না, তার মন হালকা হয়েছে কি-না! সে হতাশ কণ্ঠে বলল,” অনেক দেরি হয়ে গেছে। এবার বরং উঠি।”
” মাত্রই তো আসলি। ঘণ্টা দুয়েক বস।”
” আমি মাত্র আসিনি। সেই বিকাল থেকে এখানে এসে অপেক্ষা করেছি। তুই মাত্র আসলি সেটা বল।”
” বলিস কি? এতোক্ষণ ধরে অপেক্ষা করেছিস? আমাকে ফোন করলেই তো পারতি।”
” ইচ্ছে করেই ফোন করিনি। মোবাইল সুইচড অফ রেখেছি। নাহলে দেখা যাবে ইয়ামিন লোকেশন ট্র্যাক করে এখানেও চলে এসেছে!” উষসী উপহাস করল।
প্রীতম ভ্রু কুচকে বলল,” ভাই মনে হয় তোর ব্যাপারে খুব সিনসিয়ার!”
তাচ্ছিল্য হাসল উষসী। ম্লান কণ্ঠে বলল,” এটাকে আগে আমি ভালোবাসা ভেবে ভুল করতাম। কত বোকাই না ছিলাম আমি! এসব সিনসিয়ারিটি, দায়িত্ববোধ, সবই ছিল উষ্ণতা আপুর জন্য। উষ্ণতা আপুকে দেওয়া কথা রাখার জন্য। তার ধ্যান-জ্ঞান সবসময়ই ছিল শুধু উষ্ণতা আপু। এখানে আমি কোথাও নেই। কখনও ছিলামই না।”
উষসীর দৃষ্টি টলমল করছে। সে চোখ মুছল মাথা নিচু করে। প্রীতম বুঝতে পারছে না, তার কি সান্ত্বনা দেওয়া উচিৎ? কেবল আফসোস করে বলল,” সত্যি…. তৃষাণ ভাই কত ভালো মানুষ। অথচ উষ্ণতা আপু তার সঙ্গে কি কাজটাই না করল। আর তুই তো তার একমাত্র ছোটবোন। জেনে-শুনে কেউ কিভাবে পারে নিজের বোনের জীবন নষ্ট করতে?”
উষসী দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,” এই ব্যাপারে আমি আর কথা বলতে চাচ্ছি না। অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরতে হবে।”
” ডিনার করে যা।”
” সময় নেই।”
প্রীতম উতলা গলায় বলল,” ঠিকাছে, অন্তত তোকে পৌঁছে দেই?”
” আমি একা যেতে পারব।” উষসীর কণ্ঠ নির্বিকার।
প্রীতম দৃঢ়চিত্তে বলল,” আমি তোকে একা যেতে দিবো না।”
______________
উষসীকে খুঁজতে আবার বের হয়েছিল ইয়ামিন। তখনি দেখল বাইরে বড় একটা কালো রঙের মার্সিডিজ এসে থেমেছে। সে কৌতুহল নিয়ে দেখল, মার্সিডিজ থেকে বের হচ্ছে উষসী। তার দুই সেকেন্ড পরেই প্রীতমকে বের হতে দেখা গেল। উষসীর কাঁধে হাত রেখে কি যেন বলছে সে। উষসীর ঠোঁটে মৃদু হাসি। ইয়ামিনের মুখের পেশি ক্রমশ শক্ত হয়ে গেল। তীব্র মেজাজ নিয়ে সে এগিয়ে গেল মেইন গেইটের সামনে। তাকে দেখতে পেয়েই উষসী তার মুখ গম্ভীর করে ফেলল। প্রীতম ভদ্রতার খাতিরে সালাম দিল ইয়ামিনকে। কিন্তু ইয়ামিন তার দিকে ফিরেও তাকাল না। সে উষসীর দিকে চেয়ে ধারালো কণ্ঠে বলল,
” কোথায় ছিলে এতোক্ষণ? এটা কি বাড়ি ফেরার সময়? ঘড়িতে কয়টা বাজে খেয়াল আছে?”
সে খুব রূঢ় কণ্ঠে কথাগুলো বলছিল। উষসী তোয়াক্কা না করেই প্রীতমের দিকে ফিরে বলল,” থ্যাংকস দোস্ত। আজকে আমার অনেকটা হালকা লাগছে। আবার দেখা হবে। বায়।”
প্রীতম বলল,” বায়।”
সে গাড়িতে উঠে বসল। উষসী ইয়ামিনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। ইয়ামিন অচিরেই তার হাত চেপে ধরল। এতো শক্ত করে ধরল যে উষসী মোটামুটি ঘাবড়ে গেল। আশেপাশে চেয়ে বলল,” সমস্যা কি আপনার? ”
” আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তুমি ভেতরে যেতে পারবে না।”
উষসী বিরক্ত হয়ে বলল,” রাস্তার মাঝে সিন ক্রিয়েট করবেন না। আমার হাত ছাড়ুন।”
সে ঝারি মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। ইয়ামিন তার পেছনে যেতে যেতে ক্রুদ্ধ গলায় বলল,” সিরিয়াসলি উষসী? তুমি প্রীতমের সাথে দেখা করতে গেছিলে?তাও এভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে?”
উষসী ত্যাড়া জবাব দিল,” আপনি কখনও আমাকে কিছু জানিয়ে করেছেন যে আমি আপনাকে জানাবো?”
তারা লাউঞ্জরুমে চলে এসেছে। ইয়ামিন রুক্ষভাবে উষসীর হাত চেপে ধরল আবারও। তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তেজ নিয়ে বলল,” তাই বলে প্রীতম? তুমি খুব ভালো করেই জানো যে ওকে আমার একদম পছন্দ না। তুমি কোন সাহসে ওর সঙ্গে দেখা করেছো? এনসার মি।”
উষসীও সমান তালে তেজ দেখালো,” আর আপনি কি করেছেন? নিজের বেলায় সাত খু’ন মাফ। শুধু আমার বেলাতেই সর্বনাশ?”
” কি এমন করেছি আমি?”
উষসী বিস্মিত নয়নে বলল,” আবার প্রশ্ন করছেন? আপনি জানেন না আপনি কি করেছেন? আমার অগোচরে উষ্ণতা আপুর সঙ্গে দেখা করেননি? তার জন্য আমাকে ধোঁকা দেননি? দিনের পর দিন প্রতারণা করেননি আমার সাথে?”
ইয়ামিন তার মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করে ঠান্ডা গলায় বলল,” সেটা আলাদা বিষয়। তখন পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল।”
” এখনও পরিস্থিতি অন্যরকম। তখন হয়তো আপনি পরিস্থিতির স্বীকার ছিলেন আর এখন আমি পরিস্থিতির স্বীকার।”
ইয়ামিন কঠিন গলায় বলল,” তুমি আর কখনোই প্রীতমের সঙ্গে দেখা করবে না।”
উষসী জেদ ধরে বলল,” আমার যতবার মন চাইবে আমি প্রীতমের সঙ্গে দেখা করব।”
,” না, তুমি দেখা করবে না।” ইয়ামিনের কণ্ঠ আরও কঠিন হলো।
” আমি অবশ্যই দেখা করব।” উষসী আরও জেদ দেখালো।
” তুমি দেখা করবে না উষসী!”
” একশোবার করব, হাজারবার করব।”
ইয়ামিন সটান করে উষসীর গালে চড় মারল। সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়ানো অবস্থায় অনম এবং আয়শা স্পষ্ট শুনতে পেল সেই চড়ের শব্দ। দু’জনেই মুখ চেপে ধরল। আতঙ্কে চুপসে গেল তাদের চেহারা। আর উষসীর মনে হলো সে বুঝি দুঃস্বপ্ন দেখছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে চিন্তা করতেও ভুলে গেল। একদৃষ্টিতে মেঝের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ মাথা তুলে তাকাল সে। তার গালের একপাশ অসাড় হয়ে এসেছে। টনটন করছে তীব্র ব্যথায়। ইয়ামিনের চোখ দু’টো ক্রোধের অনলে দপদপ করে জ্বলছে। যেন এখনি কোটর থেকে বেরিয়ে এসে উষসীকে ভস্ম করে দিবে।
উষসী একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে চেয়ে আছে। সে ভাবতেই পারছে না যে ইয়ামিন তার গায়ে হাত তুলেছে। হঠাৎ ইয়ামিনের সম্বিৎ ফিরে এলো। রাগের মাথায় যে কত ভয়ংকর ভুল সে করে ফেলেছে সেই চেতনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই অপরাধবোধে দগ্ধ হলো মন। সে ফ্যাকাশে কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” আই এম স্যরি।”
উষসী এক পা পিছিয়ে গেল। ইয়ামিন এগিয়ে এসে তাকে ধরতে নিলেই দুইহাতে বাঁধা প্রদান করল সে। তীব্র ঘৃণা ভরা একটা বিতৃষ্ণাময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে গেল নিজের ঘরে। ধড়াস করে আটকে দিল দরজা। সেই শব্দে কেঁপে উঠল পুরো ভবন।
ইয়ামিন একহাত মাথায় ঠেঁকালো। আফসোসের ভঙ্গিতে বলল,” শিট!”
উষসী ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। গালের একপাশ কি বিশ্রীভাবে লাল হয়ে গেছে। চার আঙুলের দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এতোদিন ইয়ামিন শুধু তার মনেই আঘাত করেছে। আর আজ শরীরেও আঘাত করল! উষসী বিছানার বালিশ ছুঁড়ে মারতে লাগল। চাদর উলোটপালোট করে ফেলল। ড্রেসিংটেবিলের সমস্ত কসমেটিক্স ভেঙে ফেলল। তাতেও রাগ এতোটুকু কমল না। এক পর্যায় সে মেঝেতে বসে কাঁদতে কাঁদতে নিজেকেই প্রশ্ন করল,” আমি কি এমন অন্যায় করেছিলাম? কি অন্যায় করেছিলাম আমি?”
________________
(অতীত)
একদিন সকালে ব্রেকফাস্টে বসে উষসী খুব কায়দা করছিল কিভাবে তৃষাণকে কলকাতা যাওয়ার ব্যাপারটা বলা যায়। আগেও একবার বলেছিল। কিন্তু উষসীর ধারণা তৃষাণ ভুলে গেছে। তাকে আবার মনে করাতে হবে। আগে-ভাগেই সবার অনুমতি নিয়ে রাখা প্রয়োজন। নাহলে দেখা যাবে ঠিক যাওয়ার আগ মুহুর্তে কেউ একজন বেঁকে বসল। এমন সুযোগ দেওয়া যাবে না। সে কোনো প্রকার রিস্ক নিতে চায় না।
একটু পর ড্রয়িংরুমে অনুপমা আইলাকে খাওয়াতে নিয়ে গেল। আইলার অভ্যাস টিভি দেখে খাওয়া। আহমেদ ব্রেকফাস্ট শেষ করে গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করতে গেছে। উষ্ণতা তৃষ্ণাকে রেডি করাতে বেডরুমে নিয়ে গেছে। আর উষ্ণতার শাশুড়ী ডোনাও খাওয়া-দাওয়া করে উঠে গেছেন। তৃষাণ একাই টেবিলে বসে খেতে খেতে মোবাইল দেখছে।
উষসীও এই সুযোগটাই খুঁজছিল। কখনও তৃষাণকে একা পাওয়া যায় না। উষসী টেবিল থেকে উঠল না। তৃষাণের পাশে বসে অনেক পায়তারা করে বলল,” ভাইয়া, একটা কথা ছিল।”
তৃষাণ মোবাইলের দিকে চেয়ে ঠান্ডা কণ্ঠে জবাব দিল,” বলো।”
” আমি যে বন্ধুদের সাথে কলকাতা যাওয়ার ব্যাপারে বলেছিলাম সেটা মনে আছে তোমার?”
তৃষাণ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,” ও হ্যাঁ, ভালো কথা মনে করিয়েছো। এই ব্যাপারে তোমার সাথে আমিও কথা বলবো ভাবছিলাম।”
উষসীর ভেতরটা খুশিতে ঝলমল করে উঠল। তৃষাণ নিশ্চয়ই প্লেনের টিকিটের ব্যাপারে বলবে। কিন্তু তৃষাণ বলল উল্টো কথা,” আমরা নেক্সট মান্থ কাশমীর যাচ্ছি৷ তুমি চাইলে তোমার ফ্রেন্ডদেরও বলতে পারো।কলকাতার চেয়ে কাশমীর অনেক সুন্দর জায়গা। সবাই খুশি হবে। ”
উষসীর চেহারার সব আনন্দ উধাও হয়ে গেল। চুপসানো কণ্ঠে বলল,” কিন্তু ভাইয়া, আমরা তো কলকাতা যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম। আর তুমিই না বললে আমাদের প্লেনের টিকিট কেটে দিবে?”
” হ্যাঁ! আমি তো সেটাই করছি। কাশমীর তো আমরা প্লেনে করেই যাবো। শুধু ডেস্টিনেশনটা চেঞ্জ হয়েছে। তাছাড়া ট্যুরের জন্য কাশমীরের কথা বললে কেউ নিশ্চয়ই মনখারাপ করবে না। বরং সবার ভালো লাগবে।”
উষসীর চোখ ছলছল করে উঠলো। তৃষাণ এক চুমুকে কফিটা শেষ করে উঠে গেল টেবিল থেকে। উষসী বসে রইল স্ট্যাচুর মতো। তার এতোদিনের সমস্ত প্ল্যান এইভাবে চপট হয়ে যাবে এইটা সে কল্পনাও করেনি। তার প্রায় কান্না পেয়ে গেল। এতোদিনের সব পরিশ্রম কি তাহলে বৃথা? ইয়ামিনের সাথে কি দেখা করা হবে না তাহলে!
ইয়ামিন যা ভেবেছিল তাই হয়েছে। কীর্তি ওই ঘটনার পর ইয়ামিনের সাথে আর কোনো রেকর্ডিং করতে চাইছে না। তাদের মিউজিক ডিরেক্টরকেও এই কথা জানিয়ে দিয়েছে। মিউজিক ডিরেক্টর আরমান জোহার কিছুক্ষণ আগেই ইয়ামিনকে ফোন করে ব্যাপারটা জানিয়েছেন। এমনকি তাদের যে নতুন মিউজিক ভিডিওটার শ্যুট বাকি ছিল সেটাও কন্টিনিউ করতে নাকচ করেছে কীর্তি।
ইয়ামিন সব শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ব্যক্তিগত বিষয় কীর্তি প্রফেশনাল লাইফেও টেনে আনছে কেন বুঝতে পারছে না সে। এইটা কীর্তির থেকে আশা করেনি ইয়ামিন। তবে সে জানে কীর্তি কি চাইছে। তার মতো গ্ল্যামারাস, ট্যালেন্টেড একজন মডেলের প্রেম ইয়ামিন এতো সহজে প্রত্যাখ্যান করেছে এটা তার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন! সে হয়তো চাইছে ইয়ামিন নিজে থেকে তাকে কল দিক। স্যরি বলে সবকিছু সমাধান করুক। অথবা হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করুক। কারণ চলমান মিউজিক ভিডিওটা নিয়ে ইয়ামিনের অনেক স্বপ্ন ছিল।
ইয়ামিন তার ক্যারিয়ারে একটা মাইলফলক তৈরী করতে যাচ্ছে এই গানের মাধ্যমে। নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে সে গানটা তৈরী করেছে। রাতের পর রাত জেগে গানের প্রত্যেকটি লিরিক্স লিখেছে। কীর্তি সবকিছু এইভাবে ভেস্তে দিয়ে ইয়ামিনের দূর্বলতা আদায় করতে চাইছে। কিন্তু সে হয়তো জানে না, ইয়ামিন মরে গেলেও কখনও তার কাছে মাথা নোওয়াবে না। একটা কীর্তি গেলে হাজারটা কীর্তি আসবে। তার জন্য ইয়ামিন ইব্রাহীমের কণ্ঠ থেমে থাকবে না। ইয়ামিন কীর্তিকে অবশ্যই দেখিয়ে দিবে তার থাকা না থাকায় ইয়ামিনের কিছুই যায় আসে না৷ ইয়ামিন একাই পরিপূর্ণ।
সে আরমান জোহারকে নির্দেশ দিল নতুন কোনো মডেল খুঁজে বের করতে। পরদিন সকালেই আরমান জোহার ইয়ামিনকে গুড নিউজ জানালেন। কাশ্মীরের একজন নামকরা মডেল কামলা সিং ইয়ামিনের সাথে কাজ করতে রাজি হয়েছে। তার ইয়ামিনের গানও খুব পছন্দ হয়েছে। খুব দ্রুতই ইয়ামিনকে সাক্ষাতের জন্য নিজের গেস্ট হাউজে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সে৷ কাশ্মীরের নাম শুনে ইয়ামিনের মাথায় নতুন আরেকটা গানের প্লট চলে আসল৷ সে আনন্দের সহিত আমন্ত্রণ গ্রহণ করল এবং দ্রুতই কাশ্মীর যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করল।
চলবে