আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-০৬

0
560

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব_৬
লিখা: Sidratul Muntaz

ড্রয়িংরুমের উত্তর পাশের প্রত্যেকটি সোফা দখল করে বসে আছে পাত্রপক্ষরা। দক্ষিণ পাশে তৃষাণের মা ডোনা, তৃষাণ আর উষ্ণতা বসেছে। উষসীকে বসানো হয়েছে একদম পাত্রের বরাবর। উষসী মাথা উঁচু করলেই পাত্রকে দেখতে পাচ্ছে। লম্বা-চওড়া, শ্যামবর্ণের বেশ সুন্দর একটা মুখ। অনুপমা উষসীর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল।

উষশী ফিসফিস করে বলল, ” এই অনু আপু, তুমি না বলেছিলে ছেলে পুলিশ অফিসার?”

অনুপমা উষসীর মুখের কাছে কান এনে বলল,” হ্যাঁ। পুলিশ অফিসারই তো। ”

” কই? আমার কাছে তো চোরের মতো লাগছে।”

অনুপমার বিষম খাওয়ার উপক্রম হলো। সাথে সাথেই পাত্রের মুখের দিকে তাকালো সে। বেচারা সরল দৃষ্টি নিয়ে তাদেরকেই দেখছে। আহারে, শুনে ফেললে কি ভাববে? অনুপমা বলল,” ধূর, কে বলেছে? কত মিষ্টি দেখতে একটা ছেলে। তোমার জায়গায় আমি হলে এখনই তিন কবুল বলে বিয়ে সেরে ফেলতাম।”

” আচ্ছা তাই নাকি? আহমেদ আঙ্কেল আসুক আজকে বাসায়। সব বলবো আমি।”

” বলো না! কে বারণ করেছে? ওকে কি আমি ভয় পাই?”

আহমেদ অনুপমার হাসব্যান্ড। তৃষাণের বহুবছরের সঙ্গী। তাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বের নয়। বরং তার চেয়েও বেশিকিছু। সম্পর্কে আহমেদ উষসীর ভাইয়ের মতো হলেও উষসী তাকে মজা করে আঙ্কেল ডাকে। তাদের ছোট্ট একটা মেয়েও আছে। নাম আইলা হলেও সে খুব শান্ত, নীরব। কেউ বুঝতেই পারে না যে এই বাড়িতে একটা ছোট্ট বাচ্চার অস্তিত্ব আছে। আর তৃষ্ণা হয়েছে একটা টর্নেডো। যেখানেই যাবে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হবে৷ এইতো কিছুক্ষণ আগেও হুড়োহুড়ি করে একটা কাঁচের প্লেট ভেঙে ফেলল। তৃষাণের ধমক খেয়ে এখন ভেতরের রুমে গিয়ে বসে আছে। সর্বোচ্চ পাঁচমিনিট শান্ত হয়ে বসবে। এরপর আবার যে কে সেই!

উষসীর এভাবে পুতুল সেজে বসে থাকতে খুবই অস্বস্তি লাগছে।তার উপর পাত্রের লাগামহীন চাহনি। উষসী যতবার ছেলেটার দিকে তাকায় ততবারই দেখে ছেলেটা তার দিকে চেয়ে আছে। যেন চোখ দিয়ে গিলে ফেলবে। কি হ্যাংলা! তবে একটা বিষয় উষসীর ভালো লেগেছে৷ এখন পর্যন্ত পাত্রপক্ষের কেউ উষসীকে কাজ সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন করেনি। শুধু পাত্রের বাবা জানতে চেয়েছেন উষসী কেমন আছে। মা জিজ্ঞেস করলেন উষসীর পুরো নাম কি। আর পাত্র জিজ্ঞেস করলেন উষসী কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ব্যস, এটুকুই!

তারা চলে যাওয়ার পর উষ্ণতা উষসীর বেডরুমে এলো। তার মতামত জানতে চাইল

” ছেলেকে কেমন লেগেছে তোর?”

উষসী জানে। সে নিষেধ করলেও কাজ হবে না। তৃষাণ ঠিকই উষ্ণতাকে ভংচং বুঝিয়ে তাকে রাজি করিয়ে ফেলবে। তাছাড়া বিয়েতে অমত করলে যদি তৃষাণ সত্যি কলকাতা যাওয়া বন্ধ করে দেয়? সেই ভয়ে উষসী বলল,” ভালো, খুব ভালো। ”

উষ্ণতা বিস্মিত হলো,” সত্যি? তুই কি বিয়েতে রাজি?”

” হুম। বলতে পারো নিমরাজি। ”

উষ্ণতা বোনের উত্তর শুনে কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হলো। সে ভাবেনি উষসী যে এতো সহজে রাজি হবে। এতো দ্রুত সে নিজেই উষসীর বিয়ে দিতে চায় না। কিন্তু যেখানে উষসী রাজি হয়ে গেছে সেখানে আর কি করার? তবে উষসী একটা শর্ত রাখল,” আমাকে একবার পাত্রের সাথে আলাদা দেখা করানোর ব্যবস্থা করো দিতে হবে আপু। কিন্তু তৃষাণ ভাইয়া যাতে না জানে। পারবে?”

” তৃষাণ জানলে কি সমস্যা?”

” সমস্যা আছে। তুমি পারবে কি-না বলো।”

” হ্যাঁ পারব।”

উষসী অনেক খুশি হলো। একদিন শুক্রবারে একটা রেস্টুরেন্টে উষসী আর তার হবু বরের এপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা হলো। উষসী একঘণ্টা আগেই পৌঁছে গেছিল৷ সাথে ছিল তার ঘনিষ্ট বন্ধু প্রীতম।

উষসী আক্ষেপ করে বলল,” দ্যাখ দোস্ত, ভাইয়া আমার জন্য কি বুড়া পাত্র ঠিক করেছে!”

প্রীতম ভর্ৎসনার সুরে বলল” ইয়ামিন কি কম বুড়া ছিল?”

” মানে? তুই ইয়ামিনের সাথে একে মেলাচ্ছিস কেন? কোথায় ইয়ামিন আর কোথায় এই বুইড়া।”

প্রীতম পাত্রের বায়োডাটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলল,” ছেলের বয়স দেখি ২৯। ইয়ামিনের যেন কত?”

” দুইমাস পর ২৬ হবে।”

” তোর বয়স কত?”

” আটমাস পর উনিশ হবে।”

” আটমাস পর কত হবে সেটা জানতে চাইনি। এখন কত?”

” আঠারো।”

” তাহলে তোর প্রসপেক্টে কি ইয়ামিন বুড়া না?”

” একদম না। মাত্র আটবছরের ডিফারেন্স। এইটা তো নরমাল।”

” ছেলের নাম রবীউল হাসান ইমন। উচ্চতা ছ’ফুট এক। মাশাল্লাহ!আর এক ইঞ্চি হলেই ইয়ামিনের সমান হয়ে যেতো। প্রক্সি হিসেবে ঠিকাছে। ”

” দ্যাখ ফালতু কথা বলবি না।”

” গাঁয়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। কিন্তু ইয়ামিন তো হলদে ফরসা। ইমনের চোখের রঙ বাদামী। ইয়ামিনের চোখের রঙ গাঢ় কালো। ”

উষসী এইবার রেগে বলল,” এই তোর প্রবলেম কি? ইমনের সাথে তুই ইয়ামিনের তুলনা করছিস কেন? আমি কি ইমনকে বিয়ে করবো? কক্ষনও না। তাই ইয়ামিনের সাথে তুলনা করে লাভ নেই। তোকে যা করতে বলেছি তাই করবি চুপচাপ।”

” দ্যাখ দোস্ত, আমার মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হবে না। তুই বড়সড় একটা কট খাবি।”

” আমার ব্যাপার আমি বুঝে নিব। তোকে যতটুকু করতে বলেছি ততটুকুই করে দে বাপ!”

” ওকে।”

একটু পর ইমনকে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দেখা গেল। উষসী ফিসফিস করে বলল,” ওইতো আসছে। জলদি যা এখান থেকে। ”

প্রীতম দূরের একটা টেবিলে গিয়ে বসল। ইমন খুব ফিটফাট সেজে এসেছে। কড়া পারফিউম দিয়েছে।উষসী জানে যাদের গায়ে ঘামের গন্ধ বেশি তারাই এমন কড়া পারফিউম ইউজ করে। ছি, ভাবতেই কেমন গা গুলিয়ে উঠল তার। ইমন উষসীকে সালাম দিল। সেই সালামের উত্তর নিয়ে উষসী বিনীত কণ্ঠে বলল,” বসুন প্লিজ।”

ইমন বসল। হাসিমুখে জানতে চাইল,” কেমন আছেন?”

” ভালো। ”

তাদের মধ্যে টুকটাক আলাপ শুরু হলো। উষসী খুঁজে পাচ্ছে না কি বলবে! ইমনই নানান প্রশ্ন করছে তাকে। উষসী ধৈর্য্যের সাথে উত্তর দিচ্ছে। এভাবে কিছু সময় কাটল। অবশেষে প্রীতম নিজেকে প্রস্তুত করে তাদের সামনে। বেশ রাগী রাগী ভাব নিয়ে বলল,” আরে উষসী, তুমি এখানে কি করছো?”

তারপর ইমনের দিকে চেয়ে আৎকে ওঠার মতো বলল,” কে এই লোক? তুমি এর সাথে কি করছো?”

উষসী ভয় পাওয়ার ভং ধরে বলল,” আরে ভাইয়া…. তুমি?”

” ও। এখন আমি ভাইয়া হয়ে গেলাম? লজ্জা করে না নতুন বয়ফ্রেন্ড পেয়ে ছাইয়াকে ভাইয়া বানাতে? তোর চরিত্র এতো খারাপ?”

উষসী কঠিন গলায় বলল,” মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ। উনি আমার বয়ফ্রেন্ড না। ফিয়্যান্সে। আমাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

” ও। এটাই তাহলে তোর সেই হবু বর? ভাই শুনেন, এই মেয়েকে খবরদার বিয়ে করবেন না। গতরাতেও আমাকে ন্যুড পাঠিয়েছে। খুবই বাজে মেয়ে চরিত্রহীন।”

প্রীতম আর উষসীকে হতভম্ব করে দিয়ে ইমন বলল,” কোথায় সেই ন্যুড? দেখি!”

উষসী বিপাকে পড়ে গেল। বেটা তো দেখা যায় খুবই ফাজিল। প্রীতম ইতস্তত হয়ে বলল,” ডিলিট করে দেওয়াটাই ভুল হয়েছে৷ এসব জিনিস তো আর ফোনে রাখা যায় না। আগে যদি জানতাম যে আপনার সাথে দেখা হবে তাহলে প্রুভ হিসেবে ফোনেই রেখে দিতাম। এই ক্যারেক্টারলেস মেয়ের আসল চেহারা দেখিয়ে দিতাম।”

উষসী মনে মনে বলল,”ফাটিয়ে দিয়েছিস দোস্ত। চালিয়ে যা।”

কিন্তু মুখে বলল,” প্লিজ থামো। আমার নামে এমন মিথ্যা অপবাদ দিও না।”

” কেন? হবু বরের সামনে লজ্জা পাচ্ছো?সে কি জানে আমাদের মধ্যে মোট কয়বার হয়েছে? গতবছরও তো আমরা সিলেট গিয়ে রিসোর্টে দশরাত থেকেছি। এতো স্মৃতি আমি কিভাবে ভুলবো? হায় আল্লাহ!”

উষসী মুখ টিপে হাসি আটকালো।প্রীতমের মতো ভদ্র ছেলে এ ধরণের কথা বলতে পারে সে তো ভাবতেই পারছে না। খুব তো ভদ্র সেজেছিল। আর এখন বোম ব্লাস্ট করে উড়িয়ে ফেলছে। ফাজিল একটা! উষসী বহু কষ্টে হাসি সামলে বলল,” কি হচ্ছে এটা? আপনার সামনে একটা অপরিচিত ছেলে আমাকে যা নয় তাই বলছে আর আপনি কিছু বলছেন না কেন?”

প্রীতম ফুঁসে উঠল,” উনি আর কি বলবে? বলবো শুধু আজকে আমি৷ ভাই, এই মেয়েকে খবরদার বিয়ে করবেন না। ও একটা বিষধরী নাগিন। আমার জীবন তো নষ্ট করেছে। আপনারটাও করবে।”

উষসী রেগে বলল,” এখান থেকে যা৷ নাহলে আমি পুলিশ ডাকব। মিথ্যুক, বদ!”

উষসী প্রীতমকে ইশারা করল যাওয়ার জন্য৷ কারণ কাজ যতটুকু দরকার ছিল তা হয়ে গেছে। ইমনের মুখ গম্ভীর দেখাচ্ছে। প্রীতম বলল,” আমি যাচ্ছি, কিন্তু যাচ্ছি না। আবার আমি আসব। তুই আমার সাথে যা যা করেছিস সবকিছুর প্রমাণ নিয়ে তোর বিয়ে ভাঙতে আমি আসবই।”

প্রীতম চলে যেতে লাগল। উষসী চেঁচিয়ে বলল,” হ্যাঁ যা,যা। আমিও দেখবো তুই কি কি করতে পারিস। যত্তসব।”

উষসী শান্ত হয়ে চেয়ারে বসল। ইমন মুখে হাত রেখে খুব সহজ ভঙ্গিতে বলল,” কে ছেলেটা? আপনার বয়ফ্রেন্ড?”

উষসী মাথা নিচু করে বলল,” হুম। বয়ফ্রেন্ড ছিল। কিন্তু বিয়ে ঠিক হওয়ার পরই ব্রেকাপ করে দিয়েছি। সেজন্য প্রতিশোধ নিতে এসেছে। আপনি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না, প্লিজ।”

ইমন হাসল। উষসী তার হাসি দেখে থম মেরে গেল। ইমন দীর্ঘ দম নিয়ে খুব স্পষ্ট গলায় বলল,” মিস উষসী,আমি একজন পুলিশ অফিসার। আপনার বয়ফ্রেন্ডের মতো গরুদের পিটিয়ে আমরাই মানুষ করি। ব্যাপারটা হয়তো আপনি জানেন না৷ এসব ছোট-খাটো কেইস বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না।”

উষসী খানিক ভ্যাবাচেকা খেল। ঢোক গিলে বলল,” মানে?”

ইমন মুচকি হেসে বলল,” মানে কিছু না৷ আপনার সাথে দেখা করে আমার খুব ভালো লেগেছে। আপনি দেখতে ভীষণ মিষ্টি। ছবির থেকেও মিষ্টি।”

উষসী হতভম্ব! ছেলেটা সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খাবার অর্ডার করল। যেন কিছুই হয়নি। কি আশ্চর্য! সে কি তাহলে প্রীতমের অভিনয় বুঝে ফেলল?

উষসী তীব্র হতাশা আর মনখারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরল। ইমনই তাকে পৌঁছে দিয়েছে। সে বাড়ি ফিরে দেখল সবাই খুব খুশি। পুরো বাড়িতে একটা উৎসব উৎসব ভাব চলে এসেছে। তৃষাণ মিষ্টি কিনে এনেছে। অনুপমা জানাল, ছেলের বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল। তারা বিয়েতে রাজি। সামনের শুক্রবার পাকা কথা আর এংগেজমেন্টের জন্য আবার আসবে। সর্বনাশ! উষসী মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে রইল। তার পুরো দুনিয়া দুলছে। এমন সময় প্রীতমের ফোন। উষসী অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিসিভ করে নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে বলল,” হ্যালো।”

” তারপর বল, কেমন দিলাম? ওই পুলিশ অফিসার লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে তাই না?”প্রীতমের কণ্ঠে আত্মগৌরব।

উষসীর এতো রাগ উঠলো! খট করে ফোনের লাইনটা কেটে দিল সে। ঠিক এমন সময় তৃষাণ ঘরে প্রবেশ করল। হাতে মিষ্টির প্যাকেট। উষসী তৃষাণকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। ভয়ে আত্মা কাঁপছে দুরু দুরু। ইমন নিশ্চয়ই এতোক্ষণে তৃষানকে সব বলে দিয়েছে! তৃষাণ কাছে এসে বলল,” মিষ্টিমুখ করবে না উষুমনি?”

উষসী ভীত দৃষ্টিতে তাকালো। তৃষাণ তার স্বভাব সুলভ চমৎকার হাসি দিল। আগে এই হাসি ছিল উষসীর কাছে ভরসার নাম। কিন্তু এখন এই হাসিটাই আতঙ্ক লাগে। তৃষাণ উষসীকে জোর করেই মিষ্টি খাওয়ালো। উষসী মিষ্টি মুখে নিল ঠিকই, কিন্তু তার গলা দিয়ে এই বিষ কিছুতেই নামবে না। চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে এলো।

তৃষাণ গম্ভীর স্বরে বলল,” এখন থেকে তোমার উচিৎ ভেবে-চিন্তে কাজ করা উষু। অনেক তো বড় হয়েছো, ভার্সিটিতে উঠে গেছো, এখনও বাচ্চাদের মতো আচরণ তোমাকে মানায় না। আরেকটা কথা, নিজেকে সবচেয়ে বুদ্ধিমান যারা মনে করে তারাই জগতের আসল বোকা।”

উষসীর শরীর তিরতির করে কাঁপছে। মা অথবা আপু এইখানে উপস্থিত থাকলে সে নিশ্চিত শব্দ করে কেঁদে ফেলতো। কিন্তু তৃষাণ ভাইয়ের সামনে কাঁদার জন্যেও সাহস দরকার। সেই সাহস আপাতত উষসীর নেই৷ সে চোখ মুছে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে রইল। তৃষাণ ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই উষসী কাঁচের গ্লাস হাতে নিল ছুঁড়ে মারবে বলে। তৃষাণ আচমকা পেছন ফিরে তাকাল। উষসী দ্রুত কাঁচের গ্লাস নামিয়ে রাখল। বিছানায় বসল মাথা নিচু করে৷

(বর্তমান)
উষসীর এখন খুব আফসোস হয়৷ কেন সেদিন পুলিশ অফিসারের সাথে বিয়েটা হলো না তার? সেই বিয়ে হলেই বুঝি ভালো ছিল। অন্তত প্রতারিত হওয়ার দুঃখ থাকতো না জীবনে। উষ্ণতাও তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। যে বোনকে হৃদয়ের সবচেয়ে উপরে স্থান দিয়েছিল সেও যে দিনশেষে উষসীর মন ভাঙার কারণ হবে তা কে জানতো?

এখন উষসী বুঝতে পারে, তৃষাণই ঠিক ছিল। সব ব্যাপারে, সবসময় সে উষসীর ভালো চেয়েছে। তার কথা না শুনেই বিরাট ভুল হয়ে গেছে৷ সেই ভুলের মাশুল এখন তিলে তিলে দিতে ইচ্ছে।

ইয়ামিন সারারাত বাড়ি ফিরেনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে উষসী তৈরী হয়ে গেল। দেনমোহরে সে যে টাকা পেয়েছিল সেগুলো এখনও তার কাছেই আছে। একটু একটু করে সে টাকাগুলো খরচ করছে। মনখারাপ হলেই শপিং-এ চলে যায়। আজও যাবে৷ তবে আজ বিশেষ একটা জায়গাতেও যেতে হবে তাকে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি৷ অর্ধেক রাত তো দুশ্চিন্তা করতে করতেই কেটেছে। মাথার ব্যথা উপশমের জন্য উষসী একটা টাফনিল খেয়ে নিল।

আয়শা সকালের নাস্তা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। উষসীকে সাজ-গোজ করতে দেখে একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল,” কোথাও যাচ্ছেন নাকি ম্যাডাম?”

” হ্যাঁ বের হচ্ছি। আর তুমিও আমার সঙ্গে যাবে।”

আয়েশা খুশি হয়ে বলল,” ঠিকাছে ম্যাডাম। কিন্তু কোথায় যাবো?”

” প্রথমে যাবো হসপিটালে। আমার কিছু রিপোর্ট আনতে হবে। তারপর শপিং- এ…”

রিপোর্টের কথা শুনে আয়শা উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,” কোনো গুড নিউজ আছে নাকি?”

উষসী কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। আয়শার মুখ চুপসে গেল। মাথা নিচু করে বলল,” স্যরি ম্যাডাম। স্যরি।”

উষসী শান্ত হয়ে প্রশ্ন করল,” তোমার স্যার কি রাতে ফিরেছে?”

” স্যার তো বেরই হয়নি৷ রাতে লাউঞ্জ রুমে ঘুমিয়েছিলেন।”

উষসীর হাসি পেল। রাগ দেখিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার মতো ছেলেমানুষী যে ইয়ামিন করবে না এটা তার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল। অযথাই সারারাত দুশ্চিন্তা করেছে সে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” অনম ভাইকে বলো গাড়ি বের করতে। কিন্তু সে আমাদের সাথে যাবে না। শুধু তুমি আর আমি যাবো।”

” ওকে ম্যাডাম।”

উষসী আয়শাকে নিয়ে বের হওয়ায় ইয়ামিন কিছু বলল না। অনমও তাদের সঙ্গে আসতে চাইল না। প্রথমে উষসী হসপিটালে গেল। তার রিপোর্ট চলে এসেছে। সেই রিপোর্ট হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইল সে৷ যে ভয়টা পাচ্ছিল তাই হয়েছে। প্রেগন্যান্সির রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে। সে প্রেগন্যান্ট! আয়শা আনন্দিত কণ্ঠে বলল,” স্যার জানতে পারলে যে কি খুশি হবে ম্যাডাম! আমারই তো খুশিতে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।”

উষসী উত্তপ্ত কণ্ঠে বলল,” খবরদার, এই কথা যাতে তোমার স্যার কোনোভাবেই জানতে না পারে।”

আয়শা হতভম্ব হয়ে বলল,” কেন ম্যাডাম? আপনি কি স্যারকে খুশি দেখতে চান না?”

উষসী তাচ্ছিল্য হাসল। বাচ্চার খবর শুনলে সে খুশি তো হবেই না উল্টা বিরক্ত হবে। এতোদিন শুধু উষসী ছিল তার বোঝা, এখন নতুন করে আরেকজন আসছে। এই খবর শুনে ইয়ামিনের খুশি হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাদের ডিভোর্সটা এখন আরও জটিল হয়ে গেল।

ঘড়িতে রাত সাড়ে আটটা। পাগলের মতো পায়চারী করছে ইয়ামিন। উষসী এখনও বাড়ি ফিরেনি। বিকাল পাঁচটায় কাঁদতে কাঁদতে আয়শা ফিরে এসেছে একা। তারা শপিংমলে ঘুরছিল। হঠাৎ করে লিফটে উঠল। উষসী বলল তার নিচে একটা কাজ আছে। আয়শাকে উপরে পাঠিয়ে সে নিচে নামল। ব্যস, তারপর আয়শা আর কোথাও উষসীকে খুঁজে পেল না। উষসী তার চোখে ধুঁলো দিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু কোথায় গেছে? নিজের অপরাধবোধের কারণে আয়শার কান্না পেল। এখনও সে কাঁদছে৷ তার কান্না ইয়ামিনের মেজাজ আরও বাড়িয়ে দিল। সে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,

” একদম সাইলেন্ট। তোমার ইরেসপন্সিবিলিটির জন্য এসব হয়েছে। এখন আমার সামনে থেকে যাও। গেট লস্ট।”

আয়শা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,” ম্যাডাম অসুস্থ, তার জন্য আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। কোথায় গেল সে?”

ইয়ামিন ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করল,” অসুস্থ ছিল মানে? ওর কি হয়েছিল?”

আয়শা কিছুক্ষণ থেমে থেকে বলল,” ম্যাডাম প্রেগন্যান্ট।”

ইয়ামিন স্তব্ধীভূত হয়ে তাকিয়ে রইল। পাশের রুম থেকে ফোনের তীক্ষ্ণ শব্দ শোনা যাচ্ছে৷ তাতেও ইয়ামিনের কোনো ভাবান্তর হলো না। সে দাঁড়িয়ে আছে স্থাণুর মতো। তাকিয়ে আছে শূন্যে। হয়তো ফোনের রিংটোনও তার কানে যাচ্ছে না। এ জগৎ থেকে সে কয়েক মুহূর্তের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে পুরোপুরি। অনম ফোন রিসিভ করল। ওই পাশ থেকে উষসীর মা যুথি কথা বললেন,” হ্যালো বাবা ইয়ামিন, উষসীকে সকাল থেকে ফোনে পাচ্ছি না। অনলাইনে তো একবারও আসেনি। কি হয়েছে তুমি জানো? আবার কি ঝগড়া হয়েছে তোমাদের?”

অনম বলল,” আমি স্যারের এসিসট্যান্ট বলছি আন্টি।ইয়ামিন স্যার এখানে নেই। উনি ম্যাডামকে খুঁজতে বের হয়েছেন। ”

যুথি অস্থিরচিত্তে বললেন,” খুঁজতে বের হয়েছে মানে? উষসী কোথায়?”

” এখনও ম্যাডামের খোঁজ পাওয়া যায়নি। খোঁজ চলছে। চিন্তা করবেন না, ম্যাডামকে দ্রুত পাওয়া যাবে।”

” হায় আল্লাহ, কি সর্বনাশের কথা! কখন থেকে নিখোঁজ মেয়েটা?”

অনম কিছু বলার আগেই ইয়ামিন ঘরে প্রবেশ করল। অসম্ভব শান্ত গলায় জানতে চাইল,” কার ফোন?”

অনম একটু হকচকিয়ে গেল। বিকাল থেকে ইয়ামিন বাইরে ছিল। উষসীকে তন্ন-তন্ন করে খুঁজে বেরিয়েছে। সে কখন ফিরে এসেছে সেটা অনম জানে না। সে বলল,” ম্যাডামের বাড়ি থেকে ফোন এসেছে স্যার।”

ইয়ামিন এসে ফোনটা ধরল। ওই পাশ থেকে শোনা গেল তৃষাণের ধারালো কণ্ঠ,” উষসী কোথায়?”

ইয়ামিন ঠান্ডা স্বরে বলল,” আমি জানি না।”

তৃষাণের চোয়াল শক্ত হলো। রাগে গজগজ করে বলল,” তুমি জানো না মানে? এই কথা বলার সাহস তোমার কিভাবে হলো?”

ইয়ামিন বলল,” আমি তাকে খোঁজার চেষ্টা করছি।”

তৃষাণ তীক্ষ্ণ হুমকি দিল,”আমাদের উষুর যদি কিছু হয় তাহলে তোমার কপালে দুঃখ আছে ইয়ামিন ইব্রাহীম। মাইন্ড ইট।”

ইয়ামিন চোয়াল শক্ত করে ফোনের লাইন কাটল। অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে তার। নিয়তির নিষ্ঠুরতা সহ্য করে সে অভ্যস্ত। তবুও আজ যেন বড্ড ক্লান্তবোধ হচ্ছে। উষসী কোথায়?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে