#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ২
Sidratul Muntaz
ভোরের আকাশটা যতটুকু শ্বেত- শুভ্র আর শীতল, উষসীর মনের আবহাওয়া ঠিক ততটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন, বিষণ্ণতায় উত্তপ্ত। সারারাত ঘুম হয়নি। চোখের পানি শুকিয়ে গালের চামড়ায় দাগ পড়ে গেছে। সে এই মুহূর্তে বসে আছে ছাদে। অনম পেছনে এসে দাঁড়ালো। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতির জানান দিল।
উষসীর বিষণ্ণ চেহারায় ফুটল বিষণ্ণ হাসি। বিষাদমাখা কণ্ঠে বলল,” আমাকে পাহারা দিতে এসেছেন নাকি অনম ভাই?”
অনম অসহায় চোখে তাকালো। মলিন কণ্ঠে বলল,” ঘরে চলুন ম্যাডাম৷ এখানে সারারাত ধরে বসে আছেন। আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে।”
” আপনি কিভাবে জানলেন আমি যে সারারাত ধরে বসে আছি?”
” স্যার বলেছেন।”
উষসী আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজল। উপহাস করে বলল,” এখানেও সিসিটিবি লাগিয়েছে নাকি আপনার স্যার?”
অনমের মুখটা চুপসে গেল। নরম গলায় উত্তর দিল,” স্যারকে আপনি শুধু শুধুই ভুল বোঝেন ম্যাডাম। স্যার ভালোবাসেন বলেই আপনার কেয়ার করেন!”
ফিক করে হেসে ফেলল উষসী। তার হাসিতে দুঃখের পরশ মেশানো। অনমের খারাপ লাগছে। তার এতো ভালো স্যারকে কেউ কখনও বুঝতে পারে না কেন? স্যার কারো ভালোর জন্য কিছু করতে গেলে সবসময় খারাপ হয়ে যায়। অনম আল্লাহর কাছে শুধু প্রার্থনা করে যেন তার স্যারের কপালে সুখ আসে। স্যারকে সে কখনও প্রাণ খুলে হাসতে দেখেনি। উষসী এই বাড়িতে আসার পর সে ভেবেছিল এবার বুঝি স্যারের সুখের দিন শুরু হবে। কিন্তু হলো উল্টো। উষসীই যেন এখন স্যারের দুঃখের প্রধান কারণ। স্যারের সাথেই সবসময় এমন কেন হয়? উত্তরটা জানা নেই অনমের। আল্লাহ বুঝি ভালো মানুষদেরই বেশি পরীক্ষা নেন। ধৈর্য্যের পরীক্ষা, সহ্যের পরীক্ষা। উষসীর হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ায় সে উঠে দাঁড়ালো। অনম প্রশ্ন করল,
” কিছু লাগবে ম্যাডাম?”
উষসী জবাব না দিয়ে দ্রুত ছাদ থেকে নেমে গেল। বেডরুমে এসেই ব্যাগ গোছানো শুরু করল সে। অনম আর উষসীর বেডরুমের দিকে গেল না। আয়েশাকে রান্নাঘরে গিয়ে ডাকল। আয়েশা এই বাড়ির কাজের লোক। বয়স অল্প। মেয়েটার বুদ্ধিও কিছুটা কম। অনম এই মেয়ের কাজ-কর্মে প্রায়শই বিরক্ত হয়। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার তাকেই দিতে হয়।
উষসী খুব বেছে বেছে জিনিসপত্র তুলছে ব্যাগে। আয়েশা ঘরে প্রবেশ করতেই উষসী তাকে আদেশ দিল তার জিনিসগুলো গুছিয়ে দিতে। আয়েশা আদেশ মতো কাজ করতে লাগল। সে কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেল না। তবে তার জানার খুব কৌতুহল। ম্যাডাম এই সকালবেলা কোথায় যাচ্ছেন? তাও এতো আয়োজন করে ব্যাগ গুছিয়ে!
আলমারিতে এতো দামী জামা-কাপড়। কিন্তু উষসী ব্যাগে ভরল কয়েকটি পুরনো সেলোয়ার-কামিজ। এগুলো তার বিয়ের আগের কেনা। উষসী ইয়ামিনের দেওয়া একটা জিনিসও ব্যাগে নেয়নি। যাকে ছেড়ে চলে যাবে, তার দেওয়া জিনিস কেন নেবে? উষসী গুছানো শেষ করে সিঁড়ি ভে-ঙে নিচে নামল। তাদের এই বাড়িটা বিশাল বড়। অথচ সদস্য সংখ্যা মাত্র তিনজন। কাজের লোক হিসেবে আছে আয়েশা। তাকে সদস্য ধরেই হয় তিনজন।
এতো বিশাল বাড়ি থাকার পরেও উষসীর দম আ’টকে আসে। বিশাল বাগানের বিশুদ্ধ বাতাস তার নিঃশ্বাস স্বস্তিময় করতে পারে না। বাগান সংলগ্ন বিশাল সুইমিংপুলেও উষসী গা ভিজিয়ে শান্তি পায় না। টাকায় সুখ নেই। আসল সুখ মনের শান্তিতে। এই ধ্রুব সত্যি উষসী প্রতিদিন নতুনভাবে উপলব্ধি করে। তাইতো আজ এতোবড় সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে সে!
উষসীকে ব্যাগ নিয়ে নিচে যেতে দেখে অস্থির হয়ে উঠল অনম। আয়েশার কাছে এসে বিচলিত ভঙ্গিতে জানতে চাইল,” ম্যাডাম কোথায় যাচ্ছে?”
আয়েশা কাঁচুমাচু মুখে বলল,” আমি জানি না অনম ভাই।”
অনমের চোখের দৃষ্টি গরম হলো,” জানো না মানে? তোমাকে কেন পাঠিয়েছি? ম্যাডামকে একটু বুঝোনোর জন্য। তা না করে তুমি উল্টা তাকে সাহায্য করছো বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে?”
” আমি কি করবো স্যার? সামান্য কাজের লোক আমি। আমার কি স্পর্ধা আছে ম্যাডামকে থামানোর?”
” অন্তত বোঝাতে পারতে! মাথায় কি বুদ্ধিও নেই?”
” এতো বুদ্ধি আমার নেই।”
” ইডিয়েট!” অনম দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল। স্যার দেখে ফেলার আগেই ম্যাডামকে আটকাতে হবে। অনমের দেখাদেখি আয়েশাও এলো।
ইয়ামিন ডাইনিং টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করছে। তার একহাতে চামচ অন্যহাতে মোবাইল ফোন। উষসী দৃশ্যটা দেখেও সম্পূর্ণ অবহেলা করল। সে পা বাড়ালো সদর দরজার দিকে। ইয়ামিন মোবাইল থেকে চোখ না সরিয়েও উষসীর প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ্য করছে। উষসী দরজার কাছে যাওয়া মাত্রই ইয়ামিন সশব্দে প্রশ্ন করল,
” আমি কি জানতে পারি, কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”
উষসী এমনভাবে শ্বাস ছাড়ল যেন খুব বিরক্ত সে। তার জায়গায় প্রশ্নের উত্তর দিল আয়েশা,” ম্যাডাম চলে যাচ্ছেন, স্যার।”
অনম চোখ পাকিয়ে তাকালো আয়েশার দিকে। হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলল। ইয়ামিন মোবাইল রেখে সোজা হয়ে বসল। তাকালো উষসীর দিকে। কিন্তু কথা বলল আয়েশার সঙ্গে, ” সেটা তো আমি দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু তোমার ম্যাডাম যাচ্ছে কোথায়?”
উষসী আয়েশার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,” আমি এই বাড়ি ছেড়ে হোটেলে শিফট হতে যাচ্ছি, আয়েশা। তোমার স্যারকে জানিয়ে দাও। আমি তার সঙ্গে থাকতে রাজি না। সে যেন আমাদের ডিভোর্স লেটার হোটেলের এড্রেসে পাঠিয়ে দেয়।”
অনম বড় বড় দৃষ্টিতে চাইল। আর্তনাদের সুরে বলল,” এসব কি বলছেন ম্যাডাম? প্লিজ আমাদের স্যারকে ছেড়ে যাবেন না। স্যার খুব একা হয়ে যাবেন।”
উষসী বিষাদসিক্ত দৃষ্টিতে মাথা নেড়ে বলল,” চিন্তা করবেন না অনম ভাই। আমি চলে গেলে আপনাদের স্যার একা হবেন না। বরং তিনি মুক্তি পাবেন।”
” ছি, ছি, ম্যাডাম, এসব কি বলছেন। আপনি হলেন স্যারের..”
চোখের ইশারায় অনমকে থামার নির্দেশ দিল ইয়ামিন। অনম অবিলম্বে নিশ্চুপ হলো। ইয়ামিন মুখে হাত রেখে একটু হাসার চেষ্টা করল। উষসীর গা জ্বলে উঠল সেই হাসি দেখে। সে কি তামাশা করছে নাকি সকাল সকাল? রেগে না থাকলে অবশ্যই ইয়ামিনকে প্রশ্ন করতো উষসী। ইয়ামিন আয়েশার উদ্দেশ্যে বলল,
” এই বাড়িতে কি খুব অসুবিধা হচ্ছে আয়েশা? হোটেলে থাকার দরকার পড়ল কেন?”
উষসী চোয়াল শক্ত করে উত্তর দিল,” এই বাড়ির মানুষের আমাকে নিয়ে বিরক্ত হওয়া চেহারা দেখার চেয়ে হোটেলে থাকা অনেক ভালো। আমি কারো বোঝা হতে চাই না।”
আয়েশা আর অনম যেন এই ঝগড়ার নীরব দর্শক। দু’জনেই বিরস দৃষ্টিতে নিচে তাকিয়ে আছে। ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ট্রাউজারের পকেটে মোবাইল গুজে বলল,” অনেক হয়েছে উষসী। ঘরে যাও। আমি আসছি।”
উষসী সাথে সাথে আয়েশার দিকে চেয়ে ক্রোধমিশ্রিত কণ্ঠে বলল,” আয়েশা তোমার স্যারকে বলে দাও আমি এই বাড়িতে অবহেলার পাত্রী হয়ে থাকতে পারবো না। যা-ই হয়ে যাক! আমাকে আটকানোর চেষ্টা যেন না করে৷ কারণ এতে কোনো লাভ নেই। আমি যখন বলেছি চলে যাবো, এর মানে অবশ্যই চলে যাবো।”
” তোমাকে কেউ অবহেলা করছে না। নিজেই এমন ভাবছো। ” ইয়ামিনের কঠিন গলা। উষসী জেদ ধরে দাঁড়িয়ে রইল। ইয়ামিন কিছুটা তেজ নিয়ে বলল,” তুমি কোথাও যাবে না। সোজা উপরে চলো।”
” আমাকে অর্ডার দেওয়া বন্ধ করুন। আপনার বেতনভুক্ত কর্মচারী না আমি। আর স্ত্রীও না। কারণ আজ থেকে আমাদের সব সম্পর্ক শেষ।”
অনম আর আয়েশা অবাক হয়ে চোখাচোখি করল। এসব কি হচ্ছে? ইয়ামিন কিছুক্ষণ থম ধরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল উষসীর দিকে। উষসীর চোখ থেকে ক্রোধের আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। সে আজ নিজ সিদ্ধান্তে অবিচল।
ইয়ামিন হঠাৎ উষসীর কাছে এসে হাত চেপে ধরল। উষসী বিস্মিত হয়ে চাইল। ইয়ামিন গম্ভীর কণ্ঠে আবারও নির্দেশ দিল,” উপরে চলো।”
উষসী রাগান্বিত স্বরে আওড়ালো,” আমাকে ছেড়ে দিন। কোনোভাবেই আটকে রাখতে পারবেন না। আমি এই বাড়িতে থাকবো না মানে কোনোভাবেই থাকবো না।”
ইয়ামিন ঝট করে উষসীকে পাজকোলে তুলে নিল। হতভম্ব হয়ে উষসী তাকালো আয়েশা আর অনমের দিকে। তারা দ্রুত নিজেদের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। এমন ভাব, যেন তারা কিছু দেখেইনি।
উষসীর লজ্জার থেকেও রাগ বেশি হলো। সে তড়পাতে লাগল ডাঙায় তোলা মাছের মতো। ইয়ামিন তাকে নিয়ে সিঁড়ি ভে-ঙে উপরে চলে এলো। একদম বেডরুমের বিছানায় এনে বসালো। উষসী ছটফটিয়ে উঠে দাঁড়ালো,” আপনার প্রবলেম কি? এখন কি আমাকে বেঁধে রাখতে চান? এসব করে কোনো লাভ নেই। আমাকে বের হতে না দিলে আমি আত্ম/হত্যা করবো!”
ইয়ামিন সজোরে উষসীর মুখ চেপে ধরল। অন্যহাত দিয়ে চেপে ধরল তার দুইহাত। উষসীর ছটফটানি বন্ধ হলো। স্থির হয়ে দাঁড়ালো সে। ইয়ামিন অনুরোধ করে বলল,
” তোমাকে বেঁধে রাখতে চাই না। চলে যেতে চাইলে অবশ্যই চলে যেতে পারো। কিন্তু তার আগে আমাকে একটা সুযোগ অন্তত দাও। আমি তো বলছি, সব ঠিক হয়ে যাবে। শুধু একটু সময় প্রয়োজন আমার।”
উত্তরে উষসী কিছু বলতে পারল না। নির্ণিমেষ চেয়ে রইল ইয়ামিনের চোখের দিকে। ওই কঠিন দৃষ্টিতে টলমল অশ্রু। সে কি কাঁদছে? এক মুহূর্তের জন্য উষসী বিভ্রান্ত হলো। ইয়ামিন তাকে ছেড়ে চলে যেতেই বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল উষসী। একবার ভাবল, ইয়ামিনকে সে সুযোগ দিবে। কিন্তু পর মুহূর্তেই আবার মনে পড়ল সেই নিদারুণ দৃশ্য। উষ্ণতার পায়ের কাছে মাথা রেখে ইয়ামিন ঘুমিয়ে ছিল। উষসী আর ভাবতে পারছে না। তার মাথার শিরা দপদপ করতে লাগল। প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে মস্তিষ্কে। উষসী মাথা চেপে ধরল। এতো জঘন্য স্মৃতি সে কি করে ভুলবে?
(অতীত)
দুইবছর আগের কথা। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের প্রি-টেস্ট শেষ হয়েছে। উষসী কেবল সতেরো বছরের উচ্ছল কিশোরী। পড়ালেখাই তার ধ্যান-জ্ঞান। তবে মাঝে মাঝে শৈশবের সেই রাক্ষ’সমানবের কল্পনায় ডুবে যেতেও মন্দ লাগে না। কিশোরী উষসীর কল্পনা জুড়ে বিরাজ করে তার স্বপ্নের মানব। ইন্সট্রাগ্রাম, ফেসবুক সব জায়গায় ইয়ামিনকে ফলো করে সে। কতদিন আগে ইয়ামিনকে মেসেজ করেছিল। ইয়ামিন এখনও কোনো রিপ্লাই দেয়নি। অবশ্য দিবে কি করে? সেলিব্রিটি মানুষ। সে এখন গান গেয়ে মুম্বাই কাঁপায়। তার কনসার্টে দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ ছুটে আসে। বিখ্যাত সিংগার বলে কথা! মেয়েদের মুখে মুখে যার জয়ধ্বনি সে কি উষসীর মতো অতি সাধারণ বাংলাদেশী মেয়েটির ম্যাসেজের রিপ্লাই দেওয়ার জন্য বসে আছে? কত সুন্দরী মডেলদের সাথে কাজ করে সে। গত সপ্তাহেই তো একটা রাশিয়ান মডেলের সাথে মিউজিক ভিডিও শ্যুট করল। কি হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছিল ওই ভিডিওতে তাকে! উষসী এখনও ওই গানের ট্রেলার দেখতে বসলে দিন-দুনিয়া ভুলে যায়। মাত্র পঞ্চাশ সেকেন্ডের ট্রেলারটি উষসী মনে হয় পঞ্চাশ হাজারবার দেখে ফেলেছে। নেভি ব্লু শার্ট পরিহিত, বুকের কাছে কয়েকটা বোতাম খুলে রাখা, সানগ্লাস চোখের চমৎকার হাসি দেওয়া হ্যান্ডসাম ছেলেটি যে কি আশ্চর্য সুন্দর! উষসী প্রতি মুহুর্তে প্রেমে পড়ে। কিন্তু লাভ কি? নিশ্চয়ই এতোদিনে গার্লফ্রেন্ড হয়ে গিয়েছে ইয়ামিনের। মডেল কীর্তি শর্মার সাথে তো প্রায়ই ইয়ামিনের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন শোনা যায়৷ উষসী পরশুই এত্তোবড় একটা আর্টিকেল পড়লো ইয়ামিন আর কীর্তিকে নিয়ে। যদিও কীর্তি হিন্দু আর ইয়ামিন মুসলিম। তবুও সেলিব্রিটিদের কি আর ধর্ম নিয়ে এতো মাথাব্যথা আছে? এমনও হতে পারে যে ওই মেয়ে ইয়ামিনকে পাওয়ার জন্যই মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে ফেলল। কতই তো হচ্ছে এসব। উষসী আর ভাবতে পারে না। সেদিন ফেসবুকে ওই বড় আর্টিকেলটা পড়ার পর উষসী আর কলেজে যেতে পারেনি। সারারাত শুধু কেঁদেছে। তৃষ্ণা বার-বার এসে জিজ্ঞেস করছিল,” এন্টস, তোমার কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?”
উষসী চোখ মুছে মুচকি হেসে বলেছে,” কিছু না বাবা।”
তৃষ্ণা উষসীর ছোট্ট ভাগিনা৷ তার বড়বোন উষ্ণতার একমাত্র ছেলে। ক্লাস ওয়ানে পড়ে। সাত বছরের পাকনা একটা। এই বাড়ির সবচেয়ে আদুরে সদস্য। উষসীর কাছে তো সে কলিজার টুকরা। তৃষ্ণা আদর করে উষসীকে এন্টস বলে ডাকে। এর মানে পিঁপড়া নয়। খালামণির মতো এতোবড় নাম উচ্চারণ করতে তৃষ্ণার কষ্ট হয়৷ তাই ঠিক করেছিল ইংরেজিতে আন্টি ডাকবে। কিন্তু অপরিচিতদেরও তৃষ্ণা আন্টি বলে ডাকে। এটা উষসীর পছন্দ না। সবাইকে যা ডাকে তা উষসীকেও কেন ডাকবে? উষসীর জন্য থাকবে স্পেশাল নাম। তাই তৃষ্ণা ‘এন্টস’ নামটা খুঁজে বের করেছে। সবাই তার আন্টি হলেও উষসী শুধুই এন্টস!
____________________
কীর্তি আচমকা চড় মারল ইয়ামিনের গালে। ইয়ামিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বুঝতে পারল না তার অপরাধটা কোথায়! কীর্তি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” এতোদিন শুধু সবার থেকে শুনেছি। কিন্তু আজকে প্রমাণ পেলাম, তুমি আসলেই একটা সাইকো! আই হেইট ইউ ইয়ামিন!”
কীর্তি কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ইয়ামিন হতাশ হয়ে সিঙ্গেল সোফায় বসে রইল। একটু পর মাথায় হাত ঠেঁকিয়ে হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। ঘাপলাটা কোথায় হয়েছে সেটা বুঝতে বেশি সময় লাগল না। যদিও এইখানে ইয়ামিন নিজের দোষ খুঁজে পাচ্ছে না। কীর্তি নিজে থেকেই তাকে কিস করতে এসেছিল। ইয়ামিন চোখ বন্ধ করতেই উষ্ণতার চেহারাটা ভেসে উঠল। না চাইতেও মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো উষ্ণতার নাম। এজন্যই কীর্তি ক্ষেপে গিয়ে চড় মারে ইয়ামিনকে। কিন্তু ইয়ামিন তো কখনোই বলেনি যে সে কীর্তিকে ভালোবাসে। কারো সাথে মিষ্টি ব্যবহার করা মানেই যে তার প্রতি ইন্টারেস্ট আছে এমন তো নয়! কীর্তির মতো স্মার্ট মেয়ের এইটুকু বোঝা উচিৎ। আজকের পর থেকে মনে হয় না কীর্তি তার সাথে আর কোনো কাজ করতে চাইবে। নেক্সট মান্থে তাদের কলকাতায় যে কনসার্ট হওয়ার কথা ছিল সেটাও বোধহয় ক্যান্সেল হয়ে যাবে এই কারণে৷ হোক ক্যান্সেল! ইয়ামিনের কিছুই যায়-আসে না৷ ক্যারিয়ার নিয়ে সে কখনোই এতো চিন্তা করেনি। করুণাময় তাকে সব দিয়েছেন। শুধু একটা জিনিস ছাড়া। আর আশ্চর্যের বিষয়, সব থাকার পরেও শুধুমাত্র ওই একটা জিনিসের অভাব তার জীবনটা শূন্য বানিয়ে রেখেছে। নয় বছর ধরে সে উষ্ণতাকে সামনা-সামনি দেখেনি। শুনেছিল মানুষ চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল হয়। এই থিউরি কি তাহলে সম্পূর্ণ ভুল? উষ্ণতার স্মৃতি ভুলে থাকার জন্য মাতৃভূমি ছাড়ল সে, পরিবার ছেড়ে এই অচেনা শহরে একাকিত্বের জীবন বেছে নিল। তাও সবকিছু ছাপিয়ে আজ-কাল উষ্ণতাকে না পাওয়ার বিরহই তাকে সবচেয়ে বেশি পোড়ায়! কেন এমন হয়? যা কোনোদিন পাওয়া সম্ভব না তাই কেন বেহায়া মন বার-বার চেয়ে বসে! উত্তর পায় না ইয়ামিন। সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এলো। আকাশের অবস্থা ভালো না। বৃষ্টি নামবে হয়তো। নামুক বৃষ্টি। অনেকদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। ইয়ামিন ঠিক করেছে আজ খালি গাঁয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে৷ কিন্তু সমস্যাও আছে। তার জীবনটা এখন আর নিজের নিয়মে চলে না। কোনো কাজ করার আগে দশবার ভাবতে হয়। এই বুঝি কেউ আড়াল থেকে ভিডিও করল। ইয়ামিন এখন তরুণ শিল্পীদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় মুখ। সে সিগারেট হাতে নিলেও সেই ঘটনা ভাইরাল হয়ে যায়। দেখা গেল বৃষ্টিতে ভিজতে ছাদে যাবে আর সেখানে আড়াল থেকে কেউ ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপ্লোড করে দিবে। সেই পোস্ট রাতারাতি ভাইরাল উইদ অদ্ভুত ক্যাপশনস। ইয়ামিন নিজের মনেই হাসল। মোবাইলটা হাতে নিতেই কীর্তির ম্যাসেজ,” আই প্রমিস ইউ, উই উইল নেভার মীট এগেইন। আই এম ব্লকিং ইউ।”
কীর্তি সব জায়গা থেকে ব্লক করেছে ইয়ামিনকে। ইয়ামিনের তাতে কিচ্ছু যায়- আসে না। সে আরামে সিগারেটে টান দিতে লাগল একটার পর একটা। হঠাৎ ইন্সটা ফীডের একটা পোস্টে দৃষ্টি আটকে গেল,” তুমি যার কথা ভেবে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছো, সে এখন অন্যের বাচ্চা সামলানোয় ব্যস্ত।”
ইয়ামিন দুঃখে হেসে ফেলল। কিছু কিছু কথা জীবনের সাথে একদম মিলে যায়। ঠিক যেমন এই পোস্টটি। সিগারেটের সাথে দুঃখবিলাস করতে করতে ইয়ামিন নিজের টাইমলাইনে একটি পোস্ট লিখল,
” তোমার আমার শেষ দেখা হয়ে গেছে বহু আগে। মনের মধ্যে স্মৃতিগুলো রয়ে গেছে তবু জেগে। কিভাবে ভুলে যাই তোমায়?
আজ তুমি আছো শুধু নিকোটিনের ধোঁয়ায়। খুঁজে-ফিরি সেই অবয়ব।
যে ভালোবাসায় হারিয়েছিলাম নিজেকে স্বয়ং।
যদি আবার কখনও হয় দেখা,তোমাকে বিব্রত করবো না।
হয়তো মন বায়না করবে কাছে পাওয়ার, তোমার উষ্ণতায় ডুবে যাওয়ার।
ছলছল চোখ মানবে না বারণ।
তবুও বিব্রত করবো না। কথা দিচ্ছি, তুমি হয়ে থাকবে শুধুই আমার মনখারাপের কারণ।
সেদিন হয়তো আকাশে আলো থাকবে না, চাঁদ হাসবে না, বাতাসে উড়বে না তোমার চুল, আমার গলায় থাকবে না প্রেমের সুর।
তবু আমি দেখবো তোমায়, আমার চোখ বেহায়া হবে, বেপরোয়া মন তোমাকে চাইবে, তুমি কি থাকবে?
প্রিয়তমা, ভালোবাসার এই দহন বড্ড পোড়ায়। তুমি মানো আর না মানো, বেহায়া মন আজও তোমাকেই চায়।”
উষসী ইয়ামিনের পোস্টটা দেখে লাফিয়ে উঠলো। হাজার হাজার স্যাড রিয়েক্টের মাঝে তার দেওয়া কেয়ার রিয়েক্ট কারো চোখেই পড়বে না হয়তো। সে যদি একটা কমেন্ট করে, সেই কমেন্ট অনাদরেই পড়ে থাকবে মাসের পর মাস। কিছু খুচরা পাবলিক হয়তো মজা নেওয়ার জন্য রিপ্লাই দিবে। কিন্তু কাঙ্খিত সেই মানুষটির উত্তর আসবে না কখনোই। উষসী এজন্যই ইয়ামিনের পোস্টে কখনও কমেন্ট করে না। তবে তার জানার ভীষণ ইচ্ছা। কে সেই ভাগ্যবতী? কীর্তি শর্মা নয়তো?
ইয়ামিনকে মেসেজ দিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারলে হতো।কিন্তু কখনও সাহস হয়নি। উষসীর একটাই ভয়, ইয়ামিন কি তাকে চিনতে পারবে? তাদের শেষ দেখা হয়েছিল নয় বছর আগে। এতো বছর ধরে নিশ্চয়ই উষসীকে মনে রেখে বসে নেই সে। অথচ উষসীকে দেখো, নিজের ধ্যান-জ্ঞান বানিয়ে বসে আছে মানুষটিকে। ইয়ামিন সে কথা হয়তো জানবেও না কোনোদিন।
চলবে