#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব- ১
লিখা- Sidratul Muntaz
গভীর রাত। বারে মানুষ জন কমতে শুরু করেছে। মেয়েটির সেই খেয়াল নেই। সে আপনমনে মদ্যপান করে চলেছে। একের পর এক বোতল খালি হয়ে যাচ্ছে।কিছুক্ষণ পর অচেতন শরীরটা নিয়ে টেবিলেই মাথা এলিয়ে দিল মেয়েটি। বারের পরিচালক এসে ইংরেজিতে জানালেন,” ম্যাম,আমরা দোকান বন্ধ করে দিবো। আপনি আর কতক্ষণ বসবেন?”
উষসী মাথা তুলে তাকাল। ভেসে উঠল ভীষণ কোমল, মায়াবী একটি মুখ। গায়ে সুন্দর ফুলতোলা প্রিন্টের শাড়ি। ঢেউ খেলানো লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পেছনে ছড়িয়ে আছে। পোশাকে অশ্লীলতার কোনো ছোয়া নেই। দেখে মনে হচ্ছে ভদ্র ঘরের সুশীল মেয়ে। এখানে এই প্রথম এমন কাস্টমার এসেছে। লোকটি অবাক হয়ে উষসীর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।
উষসী রূঢ় স্বরে বলল,” কেন? আমি কি টাকা দিচ্ছি না আপনাদের? আমার কোনো দাম নেই? জানেন, আমার হাজব্যান্ড চাইলে আপনাদের এই পুরো বার কিনে নিতে পারে। আর আপনি আমাকে উঠতে বলছেন? এতো সাহস আপনার?”
কথাগুলো বলেই উষসী মিইয়ে গেল। হতাশ কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” না, স্যরি। ভুল বলে ফেললাম। আমার তো হাজব্যান্ডই নেই। তাকে তো আমি ডিভোর্স দিয়েছি। ”
উষসী হেসে উঠল। কিন্তু তার চোখ দু’টো অশ্রুপূর্ণ। তীব্র বেদনায় জর্জরিত মুখ। সে আক্ষেপে ক্লিষ্ট কণ্ঠে বলল,” আমি এখন রাস্তার ফকির। আমার কোনো দাম নেই। আসলেই কোনো দাম নেই….” সে কথা শেষ না করেই ঝিমিয়ে পড়ল।
লোকটি আলতো স্বরে বলল,” স্যরি ম্যাম। আর কিছুক্ষণ পরেই ভোর হয়ে যাবে। কোনো মানুষও এখানে নেই। আপনার জন্য একা বসে থাকা রিস্কি। আপনি মেয়ে মানুষ দেখেই বলছি। ম্যাম?”
উষসী কোনো জবাব দিল না। পাশের টেবিলের একজন দীর্ঘকায় লোক অনেকক্ষণ ধরে উষসীর দিকে নজর রাখছে৷ তার দৃষ্টিতে লিপ্সা। হঠাৎ সে উঠে এসে উষসীর পাশে বসে গেল। পরিচালক লোকটি বলল,” স্যার, কি করছেন?”
দীর্ঘকায় লোকটি হাতের ইশারা করে বলল,” এখান থেকে যান। আমি উনাকে চিনি।” সে উষসীর পিঠের উপর হাত রাখতেই কেঁপে উঠল উষসী। অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,” কে আপনি?”
” মনে হচ্ছে আপনার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আমার সাথে চলুন। আমি আপনাকে ডলার দিবো। যত আপনি চান।”
” না, আমার গা থেকে হাত সরান। আমাকে টাচ করবেন না।”
উষসী তার দূর্বল বাহু দিয়ে লোকটিকে ধাক্কা দিল। দীর্ঘকায় লোকটি শক্ত করে চেপে ধরল উষসীকে। একপ্রকার জোর করেই তাকে নিজের সাথে উঠিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। অন্যান্য স্টাফরা ভয়ে কিছু বলছে না। লোকটিকে মাফিয়া ধরণের কেউ মনে হচ্ছে। তার কাছে ছু*রি-চা*কু থাকতেও পারে। কিন্তু পরিচালক বলল,” স্যার, এভাবে কনসেন্ট ছাড়া আপনি কাউকে ফোর্সফুলি নিয়ে যেতে পারেন না। আমরা কিন্তু পুলিশ কল করব।”
দীর্ঘকায় সেই লোক রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল। পরিচালক ভয়ে চুপসে গেল। অনম দূর থেকে সম্পূর্ণ ঘটনা দেখছে। সে ইয়ামিনকে একটা ফোন করল। ইয়ামিন উষসীর স্বামী। আর অনম তার এসিস্ট্যান্ট। অনমের প্রধান দায়িত্ব হলো উষসীর প্রতিটি পদক্ষেপ ইয়ামিনকে মেসেজ অথবা কলের মাধ্যমে জানানো। দিনের চব্বিশ ঘণ্টা সে উষসীর আশেপাশেই থাকে। আজ উষসী তার চোখে ধুলো দিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছে। তাকে খুঁজে পেতে সারারাত লেগে গেল।
” স্যার, ম্যাডামকে খুঁজে পাওয়া গেছে। একটা ফালতু লোক ম্যাডামের সাথে অসভ্যতা করার চেষ্টা করছে। আপনি দ্রুত এখানে আসুন স্যার। আমি আপনাকে এড্রেস টেক্সট করছি।”
ইয়ামিন আশেপাশেই ছিল। হন্যি হয়ে উষসীকে খুঁজছিল সে। বারে আসতে তার বেশি সময় লাগল না।
উষসী দীর্ঘকায় লোকটির উদ্দেশ্যে বলল,” ছাড়ুন, কোথায় নিচ্ছেন আমাকে? আমি আপনার সাথে যাবো না।”
” এতো নাটক করার কি আছে? মাঝরাতে কোনো ভালো মেয়ে এখানে আসে না। অযথা সতী সাজার চেষ্টা করো না।”
ইয়ামিন এই অবস্থা দেখে এগিয়ে গেল। লোকটির হাত উষসীর কোমরের উপর৷ এই দৃশ্য দেখে ইয়ামিন তার মেজাজ ঠিক রাখতে পারল না। টগবগ করে উঠল তার শরীরের র-ক্ত। তীব্র ক্রোধ নিয়ে সে লোকটিকে থাপ্পড় মা*রল কঠিন হাতে। মুহূর্তেই দীর্ঘকায় লোকটি তার বিশাল দেহ নিয়ে কয়েকটি চেয়ারসহ উল্টে পড়ল। একটা সরগরম পরিবেশের সৃষ্টি হয়ে গেল। স্টাফরা ভয়ে থম মেরে গেল। অনম লোকটির কলার চেপে ধরে বলল,” সাহস কিভাবে হলো তোর? আমাদের ম্যাডামের গায়ে হাত দেওয়ার? শা’লা!”
সে লোকটিকে লাথি মা-রতে শুরু করল। উষসী আবছা দৃষ্টিতে ইয়ামিনের চেহারা স্পষ্ট দেখতে পেল না। কেবল লম্বা অবয়ব লক্ষ্য করল। অভিমান মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,” এখানে আপনি কেন এসেছেন? আমি তো আপনাকে ডিভোর্স দিয়েছিলাম। আপনি আমার কেউ না। চলে যান এখান থেকে। যান।”
ইয়ামিন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,” বাড়ি চলো উষসী। যথেষ্ট পাগলামি হয়েছে।”
” না, আমি যাবো না ওই বাড়িতে। আমাদের তো ডিভোর্স হয়ে গেছে। তাহলে আপনার বাড়িতে আমি কেন যাবো?”
” তোমার মুখের কথায় আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে না। চুপচাপ বাড়ি চলো। নাহলে কিন্তু ওই লোকটার হাতে তুলে দেবো তোমাকে।”
উষসী ভয় পেয়ে বলল,” না।”
ইয়ামিন হাসল। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল উষসী। তারপর হঠাৎ ঢলে পড়ল। ইয়ামিন কাছে এসে দুইহাতে জাপটে ধরল তার কোমল শরীর। পাজকোলে তুলে নিল।
অনম গাড়ি ড্রাইভ করছে। ইয়ামিন উষসীকে নিয়ে পেছনের সিটে বসেছে। গাড়ি চলছে ব্যস্ত রাস্তায়। উষসী পিটপিট করে তাকাচ্ছে আশেপাশে। তার বমি পাচ্ছে। মদ খাওয়ার বদভ্যাসটা কোনোদিন ছিল না। ইদানীং শুরু হয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে উষসী প্রচুর ড্রিংক করছে।
ইয়ামিন বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,” আর কখনও যাতে বাড়ির বাহিরে বের হতে না পারো সেজন্য তোমার পায়ে শে’কল পরাবো আমি।”
উষসী সহাস্যে জবাব দিল,” শি’কল দিয়ে কয়দিন আট’কে রাখবেন? যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে শি’কল দিয়ে বুঝি সম্পর্ক বেঁধে রাখা যায়?”
” কে বলেছে ভালোবাসা নেই?”
” আমি জানি।”
” ঠিকাছে মানলাম। আমার পক্ষ থেকে ভালোবাসা না থাকুক তোমার পক্ষ থেকে তো আছে। তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। এটা নিশ্চয়ই মিথ্যে নয়?”
উষসীর ঠোঁটে ফুটে উঠল তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি। প্রত্যেকবার এই কথার দ্বারাই ইয়ামিন তাকে ত’র্কে হারিয়ে দেয়। আর হারাবেই তো। উষসীর সবচেয়ে বড় দূর্বলতাটুকুই যে সে জেনে গেছে! নিজের বিশ বছরের জীবনে উষসী একটা ব্যাপার খুব ভালো ভাবে উপলব্ধি করেছে। কখনও কাউকে দূর্বলতার মাত্রা বুঝিয়ে দিতে নেই। কেউ যদি একবার বুঝে ফেলে কারো দূর্বলতা, তাহলে সেই দূর্বল জায়গায় বার-বার আঘা’ত করে মানুষটিকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। যেমনটা ইয়ামিন করছে। উষসী গাড়ির সিটে মাথা ঠেঁকালো। বুক চিরে বেরিয়ে আসছে ক্লান্তিময় দীর্ঘশ্বাস। চোখের কার্ণিশ ভরে আসছে দুঃখের জলে।
বাড়ি ফিরে উষসী সত্যি সত্যি একগাদা বমি করে ভাসালো। নোংরা জামা-কাপড় ছাড়তে গোসল করল। তারপর ভেজা চুল নিয়েই শুয়ে পড়ল বিছানায়। ইয়ামিন হেয়ার ড্রায়ার নিয়ে কাছে এলো। বিরক্ত কণ্ঠে বলল,” দিন দিন খুব কেয়ারলেস হয়ে যাচ্ছো তুমি। তোমার কি হয়েছে?”
” কি হয়েছে আপনি জানেন না বুঝি?”
উষসীর বিরস কণ্ঠ। ইয়ামিন লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলল,” হ্যাঁ জানি। আর আমার মনে হয় তুমিও জানতে। আরও আগেই জানতে।”
” কি জানতাম আমি?”
ইয়ামিন নিষ্ঠুর কণ্ঠে বলল,” আমি তোমাকে কোনোদিন ভালোবাসিনি, এটা জানতে না আগে? কখনও কি নিজ মুখে বলেছি তোমাকে ভালোবাসার কথা? ”
উষসীর চোখ ছলছল করছে। গলার কাছে আট’কে এলো তীক্ষ্ণ ব্যথা। কেঁ’দে ফেলতে নিয়েও কাঁ’দল না। ইয়ামিনকে সে এতো বেশি ভালোবাসে সে তার এতটুকু প্র’ত্যাখ্যানও স’হ্য হয় না। সব সত্যি জানার পরেও এমন নিগূঢ় বাক্য ইয়ামিনের মুখে শুনলে কা’ন্না পেয়ে যায়। এখনও পাচ্ছে।
ইয়ামিন কঠোর ভঙ্গিতে বলল,”আমার এই মনে সবসময় শুধু উষ্ণতা ছিল। কখনোই তুমি ছিলে না। উষ্ণতার ব্যাপারটা তুমি জেনেছো মাত্র কিছুদিন আগে। আর আমি যে তোমাকে ভালোবাসি না, এটা তুমি জানো বিয়ের আগে থেকেই। তাহলে কি আমি ধরে নিবো উষ্ণতার জায়গায় অন্যকাউকে ভালোবাসলে তোমার অসুবিধা হতো না? আমার ভালোবাসার মেয়েটি উষ্ণতা হলো বলেই এতো সমস্যা তোমার?”
ইয়ামিন হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে উষসীর চুল শুকিয়ে দিচ্ছিল এতোক্ষণ। উষসী কথাটা শোনার পর তাকে থামানোর উদ্দেশ্যে হাত চেপে ধরল।
” পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে আপন মানুষ ছিল উষ্ণতা আপু। দ্বিতীয় আপন মানুষ ছিলেন আপনি। দু’জন একসঙ্গে প্র’তারণা করেছেন।”
” সেটাও তো তোমার ভালোর জন্যই।”
” এখানে আমার কিসের ভালো বলতে পারেন? কেন করেছেন আপনারা এমন? আমি তো কখনও বলিনি দয়া দেখিয়ে আমাকে বিয়ে করুন। কখনও বলেছিলাম আপনাকে? তাহলে কেন করলেন আমাকে বিয়ে?”
উষসী চেঁচিয়ে উঠল। ইয়ামিন কোমল স্বরে বলল,
” উষসী, প্লিজ শান্ত হও। রোজ রোজ একই বিষয় নিয়ে সিন ক্রিয়েট করছো তুমি। না নিজে শান্তি পাচ্ছো আর না আমাকে দিচ্ছো। কি লাভ এসব করে? আমি তো বলেছি, আমাকে একটু সময় দাও৷ সব ঠিক হয়ে যাবে।”
” কিভাবে ঠিক হবে সব? জো’র করে আমাকে ভালোবাসার চেষ্টা করবেন? করেছেন তো দুইবছর যাবৎ। কোনো লাভ হয়েছে? ভুলতে পেরেছেন উষ্ণতা আপুকে?”
ইয়ামিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্দেশ্যে আঙুল ঠেঁকালো উষসীর কোমল ঠোঁটে,” শশশ, এই বিষয়ে এখন আর একটাও কথা না। ঘুমাও।”
তারপর সে পরম স্নেহে চুমু এঁকে দিতে চাইল উষসীর কপালে। তখনি উষসী বাঁধ সেধে বলল,” না। আসবেন না।”
বিস্মিত হলো ইয়ামিন। আগে যে মেয়ে তার একটু স্পর্শের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো এখন সেই নিষেধ করছে তাকে স্পর্শ করতে। ইয়ামিন কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করল,” কেন?”
” যে জিনিস আমার নয় সেই জিনিস আমি পেতেও চাই না।” উষসীর স্পষ্ট জবাব। ইয়ামিন স্বীকারোক্তি প্রদান করল,” আমি এখন তোমার উষসী।”
উষসী মানল না, ” উহুম। আপনি আমার না। শুধু শরীর দিয়েই কি ভালোবাসা প্রমাণ করা যায়? ভালোবাসতে মন দিতে হয়৷ যা আপনি আমাকে কোনোদিন দিতে পারবেন না।”
” তুমি কি চাও উষসী? কেন এমন করছো?”
” যা চাই তাই কি দিতে পারবেন আমাকে?”
ইয়ামিন ঢোক গিলে বলল,” আগে শুনি কি চাও?”
উষসীর কণ্ঠ ক্রমশ শীতল হয়ে এলো,” ডিভোর্স চাই। পারবেন দিতে? ”
ইয়ামিনের চোখে অবিশ্বাস খেলা করছে। কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,” ওকে। তবে তাই হোক!”
উষসীকে নিজের বাহুডোর থেকে মুক্ত করে উঠে দাঁড়ালো ইয়ামিন।তারপর হনহন করে চলে গেল ঘরের বাইরে। হতাশ দৃষ্টিতে তার যাওয়ার পথে উষসী চেয়ে রইল নিষ্পলক। একদম স্থিরচিত্রের মতো বসে রইল অনেকটা সময়। তারপর হঠাৎ করেই কান্না পেল ভীষণ। মানুষটি কখনোই তাকে ভালোবাসবে না, আজ যেন তা আবার প্রমাণ হয়ে গেল। উষসী ঠিক করল সে সত্যিই ডিভোর্স নেবে। ইয়ামিনকে মুক্তি দেবে চিরকালের জন্য।
চলবে
🍁