#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙
#সূচনা_পর্ব
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)
১)
—“বলি, এ ঘরের নবাব*জা*দীর চোখ থেকে সাধের ঘুম ফু*রা*নোর সময় কি এখনও হয় নি! বে*কার স্বামীর সোহাগে মোড়ানো চাদর থেকে বেড়িয়ে যে বাড়ির ক*র্মঠ বাকি দুই ছেলে ও পরিবারের সবার জন্য সকালের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে সেই খেয়াল কি আছে তাঁর?”
সৎ ছোট ছেলে রিজওয়ান ইয়াসির আর ছোট ছেলের স্ত্রী মেহরিনের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় জোড়ে জোড়ে ক*ড়া না*ড়তে না*ড়তে উপরোক্ত কথাগুলো বললেন রাহেলা বেগম। ফজরের নামাজ পড়ার পর বাড়ির সবার জন্য খাবার তৈরি করার উদ্দেশ্য নিয়ে যখন রুমের বাহিরে যেতে নিয়েছিলো মেহরিন সেইসময় মেহরিনের স্বামী রিজওয়ান ওর হাত ধরে টান দিয়ে নিজের বুকের উপর ফেলে আদুরে স্বরে বলেছিলো…..
—“আজ আর কিছুসময় আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকো প্লিজ মেহু, বুকের ভিতরটা আজ ভিষণ অ*শান্ত হয়ে আছে, এই অ*শান্ত বুকে তুমি মাথা রাখলে ভিষণ শান্তি অনুভব হয় আমার।”
স্বামীর এমন আদুরে স্বরে করা আবদার ফেলতে পারার সাধ্য মেহরিন করে উঠতে না পারায় রিজওয়ানের বুকের বাম পার্শে মাথা রেখে চোখ বুঝেছিলো সে। পরম তৃপ্তির মাঝে কখন যে পুরোপুরি ভাবে চোখ লেগে গিয়েছিলো মেহরিনের তা সে খেয়াল করে নি। দরজার বাহির থেকে শ্বাশুড়ির কঠিণ কন্ঠে তি*ক্ত কথাগুলো রিজওয়ান আর মেহরিনের কর্ণপাত হতেই তৎক্ষণাৎ শোয়াবস্থা থেকে উঠে বসে ওরা। মেহরিন দ্রুততার সাথে বিছানা থেকে নেমে পরণের এলোমেলো হয়ে থাকা শাড়ির ভাঁজ গুলো সমান করতে করতে দরজার দিকে অগ্রসর হয়। দরজা খুলতেই রাহেলার রাগী মুখশ্রী চোখে পড়ে মেহরিনের। রাহেলা রাগে হি*স*হি*সি*য়ে বললেন….
—“বাপের বাড়ি থেকে আসার সময় ১০-২০ জন কাজের লোক আনতে পারেন নি জ*মি*দা*র*নী! তাহলে আর আপনাকে সকালবেলা এতো ক*ষ্ট করে স্বামীর আলিঙ্গন ছেড়ে উঠতে হতো না।”
রাহেলার এরূপ কথায় মেহরিন ল*জ্জা*য় ঠোঁট কাঁ*ম*ড়ে মাথা নিচু করে ফেলে। রাহেলা আবারও রাগী স্বরে বললেন….
—“সং*য়ের মতো এভাবে মাথানত করে দাঁড়িয়ে থেকে আর কতো সময় ন*ষ্ট করবেন আপনি নবাব*জা*দী! ”
মেহরিন বিনাবাক্যে স্থান ত্যগ করে। রিজওয়ান নিরবে বিছানায় বসে নিজের বউকে তার সৎমায়ের মুখ ঝা*ম*টা সহ্য করতে দেখে শুধু। বে*কার হওয়ায় চেয়েও মুখ ফুটে একটা টু শব্দ সে বের করতে পারে না সে। রাহেলা ভেং*চি কে*টে স্থান ত্যগ করলেন। মেহরিন রান্নাঘরে এসে কোণায় থাকা টিউবওয়েল চেড়ে চোখে-মুখে পানি দেয়। অতঃপর শাড়ির আঁচল দিয়েই পানিটুকু মুছে নিয়ে সানসাইটের উপর উপুর করে রাখা ভাতের বড় সিসার পাতিলটা নামিয়ে মাটির চুলার একপার্শে রাখে। সানসাইটের উপর উপুর করা লাল রংয়ের প্লাস্টিকের পানির বালতিটা নিয়ে টিউবওয়েল থেকে একবালতি পানি নিয়ে চুলার অন্যপার্শে রেখে চুলার মুখ বরাবর বসে চুলায় আগুন ধরায়। পরক্ষণেই বসাবস্থা থেকে উঠে চুলার উপর পাতিলটা বসিয়ে বালতির পানিটুকু ঢেলে দেয়। পাশ থেকে বড় গামলাটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাহিরটা একপলক দেখে। এখনও বাড়ির অন্যসদস্যরা ঘুম থেকে উঠে নি। শ্বাশুড়ি মাকেও আশেপাশে দেখতে না পেয়ে মেহরিন কিছুটা সংকোচবোধ নিয়েই রান্নাঘরের অন্যপার্শের কর্ণারে রাখা চালের ড্রামের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বাড়ির ১০জন সদস্য হিসাব করে গুণে গুণে ১০ পট চাল গামলায় ঢেলে নিয়ে ড্রামের মুখ বন্ধ করে টিউবওয়েলের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। সেইসময় রাহেলা হৈ হৈ করে রান্নাঘরে প্রবেশ করে বললেন…..
—“যেই না একটু চোখের আড়াল হয়েছি ওমনি ঘরের অন্ন ধ্বং*স করতে নিজে নিজেই ড্রাম থেকে বেশি পরিমাণে চাল নিয়ে রান্না বসাতে যাচ্ছিলেন দেখছি নবাব*জা*দী! বলি এতো সা*হস পান কোথায় থেকে আপনি!”
শ্বাশুড়ি মায়ের এরূপ কথায় মেহরিন ঐস্থানেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পরে ধীরকন্ঠে বললো…..
—“বেশি নেই নি আম্মা! আসলে রান্না বসাতে দেড়ি হয়ে গিয়েছিলো আপনাকেও দেখছিলাম না আশেপাশে তাই ভাবলাম আর দেড়ি না করে নিজেই উঠিয়ে দেই একবেলা। আর আপনি প্রতিদিন সকালে ১০ পট চাল রান্নার জন্য দেন আজও তাই আমি ১০ পট ই নিয়েছিলাম।”
রাহেলা ধ*ম*কের স্বরে বললেন…..
—“ছোট*লো*কের ঘরের ছোট*লোক কোথাকার আজকাল আমার মুখে মুখে প*ট*র প*ট*র করে কথা বলা শিখে গিয়েছে খুব। আজ যে জ*মি*দা*র*ণীর মতো ঘুম থেকে উঠতে বেলা গড়িয়ে ফেলেছো তার জন্য তোমার নসিবে শা*স্তি জু*ট*বে না নাকি! এমনি এমনিই ছেড়ে দিবো ভেবেছিলে!”
মেহরিন এখনও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শা*স্তি*র বিষয়টা তার কাছে নতুন কোনো বিষয় না। কারণ এ বাড়িতে আসার পর থেকে এমন একটা দিন কাটে নি যে দিনে মেহরিনের হিসাবে না ধরলেও চলে এমন সামান্য ভু*ল গুলোকে অনেক বড় করে দেখে রাহেলা তাকে ক*ঠি*ন থেকে ক*ঠি*ন তম শা*স্তি দিয়েছেন। রাহেলা দ্রুত কদমে মেহরিনের কাছে এসে ওর হাত থেকে চালের গামলাটা কে*ড়ে নিয়ে ড্রামের কাছে গিয়ে সবগুলো চাল ঢেলে পুনরায় মেপে মেপে ৮পট চাল নিয়ে আবারও মেহরিনের কাছে এসে গামলাটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন…..
—“আজ সকালবেলা তোমার আর তোমার সোহাগের স্বামীর খাওয়া ব*ন্ধ। এখানে ৮পট চাল আছে আজ এতোটুকুই রান্না হবে। এর বেশি একটা চালও আজ হাঁড়িতে ফুটবে না।”
মেহরিন ছলছল দৃষ্টি নিয়ে হাতে ধরা গামলায় রাখা চালগুলোর দিকে একপলক দেখে রাহেলার দিকে তাকালেন। রাহেলা মেহরিনের নোনাজলে ভরপুর দৃষ্টিকে অ*গ্রা*হ্য করে সানসাইটের নিচে বিছিয়ে রাখা সবজিগুলো থেকে বেছে বেছে কিছু সবজি ডালায় নিতে নিতে বললেন…..
—“আজকে তোমাদের সকালে খাওয়া ব*ন্ধ মানে ব*ন্ধ কথাটা ভালো ভাবে মাথায় ঢুকিয়ে নাও। যদি সকলের খাবার খাওয়ার পরও ভাত-তরকারী বেছে যায় তাহলে সেগুলো আমি নিজ দায়িত্বে আঙিনায় বসা কু*কু*র-বিড়ালগুলোকে দিয়ে দিবো।”
রাহেলার এরূপ কথায় মেহরিনের দু’চোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে শুরু করে। মেহরিন ঠোঁট চে*পে কান্না নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে টিউবওয়েলের কাছে গিয়ে আধবসা হয়ে চালগুলো ধুঁয়ে পরিষ্কার করে চুলোর সামনে এসে ডাবু দিয়ে পাতিল থেকে পানির পরিমাণ কমিয়ে গামলায় থাকা চালগুলো ঢেলে দিতে শুরু করে। পানি ট*গ-ব*গ করে ফু*টছে। তাই চালগুলো পাতিলে দিতে গিয়ে মেহরিনের হাতে পানি গুলো ছি*ট*কে ছি*ট*কে এসে লাগছে। বুকের ভিতরে চা*পা য*ন্ত্র*ণা*র সামনে শরীরের এই সামান্য য*ন্ত্র*ণা মেহরিনের কাছে তু*চ্ছ মনে হয়। মেহরিন দীর্ঘ*শ্বাস ফেলে মনে মনে বললো…..
—“ওনাদের কাছে রাস্তার কু*কু*র-বেড়ালদের সম্মানও আমার আর আমার স্বামীর সম্মানের থেকে বেশি।”
রাহেলা মেহরিনের একপার্শে সবজির ডালাটি রেখে বললেন….
—“দ্রুত হাত চালিয়ে রান্নার কাজ শেষ করুন জ*মি*দা*র*নী। আপনার ঢি*লা*মীর জন্য সময় দুই সেকেন্ড মিলিয়ে একসেকেন্ড কা*টবে না!”
এই বলে রাহেলা রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন। মেহরিন পাতিলের উপর ঢাকনা দিয়ে সবজি কাটার কাজে মনোনিবেশ করলো।
.
.
.
রান্নার পর্ব শেষ করে ডায়নিং টেবিলে সব খাবারগুলো সাজিয়ে রেখে মেহরিন ওর সামনে থাকা দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো সময় তখন সকাল ৭টা বেজে ৩০ মিনিট। যেদিন থেকে রান্নার দায়ভার মেহরিনের উপর এসে পড়েছে সেদিন রাহেলা বেগম বলেছিলেন সকালের রান্না ৮টার পূর্বেই শেষ করতে হবে ওকে। অবশ্য গত দিনগুলোতে দুই ভাসুর-জায়ের রুম ব্যতিত পুরো বাড়ি পরিষ্কার করে ৭টা ২০ এর মধ্যেই রান্নার কাজ শেষ হয়েছে মেহরিনের। যদিও পুরো বাড়ি পরিষ্কার করা বাকি এখনও কিন্তু আজও সে ৮টার অনেক পূর্বেই রান্না শেষ করেছে। তবুও আজ সকালে তার আর তার স্বামীর খাবার খাওয়া ব*ন্ধ থাকবে। নিজের জন্য চিন্তা মেহরিন করে না। কিন্তু ওর স্বামীরও দিনের শুরুটা না খেয়ে করতে হবে ভেবেই ওর ভিষণ খা*রা*প লাগছে। নিজ হাতে বাহারি রকমের খাবার সে রান্না করলো তবুও এই খাবার গুলো থেকে এক টুকরো আলু উঠিয়ে নেওয়ার ক্ষ*ম*তা মেহরিনের নেই। মেহরিনের ভাবনায় ছে*দ ঘটে ওর মেজো জা ঊর্মিলার কথায়….
—“খাবারের দিকে ওভাবে হা করে চেয়ে আছো কি জন্য হ্যা! শুনলাম শ্বাশুড়ি মা আজ সকালে তোমাদের খেতে বা*রণ করেছেন! তাই মনে মনে ব*দ*দোয়া করছো নাকি! যেনো এই খাবারগুলো খেয়ে আমাদের সবার শরীর খা*রা*প হয়!”
ঊর্মিলার এরূপ কথা শুনে মেহরিন শান্ত দৃষ্টি নিয়ে ঊর্মিলাকে একপলক দেখে শুধু। ঊর্মিলার বলা কথাগুলোর কোনো প্রতিত্তুর করার মতো শব্দ মেহরিন খুঁজে পায় না। পরক্ষণেই মেহরিন ঊর্মিলার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রান্নাঘরের ভিতরে চলে যায়। সকাল থেকে কম তি*ক্ত পরিস্থিতির ও কথার সম্মুখীন হতে হয় নি তাকে। ওদের আশেপাশে থাকা মানে নিজ হাতে ওদের সামনে রাস্তা খুলে দেওয়া যেনো ওরা স্বযত্নে কথা দিয়ে ওর বুকের ভিতরটা ক্ষ*ত-বি*ক্ষ*ত করে দিতে পারে।
#চলবে ইনশাআল্লাহ……