#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_৩৩
#সুমাইয়া_মনি।
রাতে নবনীর সঙ্গে কথা বলার পরপরই আদি একটি প্রজেক্টের কাজ শুরু করে। সাতটার দিকে কাজ সম্পূর্ণ হয়। একজন কলিংয়ের কাজে ডেলিভারি করে দেয় এবং রওয়ানা হয় ঢাকার উদ্দেশ্য। নতুন জব দেখে ছুটি নিতে অসুবিধা হলেও পরে আদির বাবার বন্ধু ইলিয়াস রহমানকে মানিয়ে নেয় সে। প্রজেক্ট রেডি করে তবেই ঢাকা যাবে চাচ্চুকে জানায়। তিনি আর অমত করে না। তিনদিনের ছুটি মনজুর করে আদিকে। আদি খুশি মুডে নিজের গাড়ি করে রওয়ানা হয় ঢাকার উদ্দেশ্যে। আসার আগে বাড়ির সবাইকে বলে আসে তার ঢাকায় যাওয়ার বিষয়টি যেন নবনীর কাছে গোপন রাখে।এবংকি নিভ্রর কাছ থেকেও। এইজন্য তারা কেউ কল ধরেনি। আদি চেয়েছিল নবনীকে সারপ্রাইজ দিতে । অথচ সে নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে গেছে। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। নয়তো এই সত্য চিরদিনের মতো চাপা পড়ে যেতো। বাড়ির ডুবলিকেট চাবি আদির কাছে আগে থেকেই ছিল। তাই নিভ্রকে না বলে রেডি হয়ে সরাসরি সেন্টারে চলে আসে। সরু রাস্তা দিয়ে হেঁটে সেন্টারের ভেতরে যাওয়ার সময় বাগানের দিকে নজর পড়ে। সেখানে উপস্থিত দু’জনকে দেখে আদি হেসে এগিয়ে আসে। উল্টো দিকে ফিরে ছিল নবনী। নিভ্র ডান দিকে মুখ করে দাঁড়ানোর ফলে আদিকে হেঁটে আসতে দেখেনি। নিভ্রর বলা প্রথম শাস্তির কথাটি শুনে আদি থেমে যায়। ফুল গাছের আড়াল হয়ে দাঁড়ায়। আগ্রহ নিয়ে শুনে তাদের কথপোকথন।
নবনী মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। নিভ্র তো বলেছিল আদি মিটিং থেকে মাত্র ফিরেছে। কল দেবার কথাও বলেছে। তাহলে আদি এখানে কিভাবে এলো। নিভ্র কি তবে মিথ্যে কথা বলেছে? এক প্রশ্ন নিভ্রর মনে। রুবিনা বানু কি তাকে মিথ্যে কথা বলেছে? আদির কাছ থেকে নজর সরিয়ে নিয়েছে নিভ্র। এই মুহূর্তে নিজেকে বড্ড অপরাধী বলে মনে হচ্ছে । আদি এগিয়ে আসে তাদের দিকে। একবার ভাইয়ের দিকে, আরেকবার নিজের অর্ধাঙ্গিনীর পানে তাকায়৷ মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে নিজের ভাইয়ের প্রেয়সী আজ তার বউ! যাকে সে এখন ভয়ংকর ভাবে ভালোবাসে। মৌন হয়ে রয় আদি। কোথা থেকে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। মুহূর্তেই আদি লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
-“আমি অতীত সম্পর্কে কিছুই জানতে চাই না, না ভবিষ্যতে চাইবো। যে টুকু আড়াল থেকে শুনেছি যথেষ্ট ছিল। আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলে, ভাগ্যক্রমে….।”
নিভ্র আদির কাছে এক কদম এগিয়ে এসে কিছু বলতে নিলে আদি দৃষ্টি সরিয়ে থামিয়ে দেয়। বলল,
-“কিচ্ছু বলার দরকার নেই ভাইয়া। না তোমাকে ভুল বুঝবো, না নবনীকে। তোমরা দু’জনই আমার কাছে প্রিয়। তিল পরিমাণ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ক্ষয় হয়নি। তবে..” এতটুকু বলে নবনীর দিকে তাকায়। তারপর নজর সরিয়ে নিয়ে নিভ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে দ্বিধাবোধ ফেলে অকপটে বলে ফেলে,
-“আমি নবনীতে আসক্ত! প্রিয়তম আসক্তি নামক অসুখ ও,
এতোদিন যে ভালোবাসা মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলাম, ওটাকে দপ করে নিভিয়ে দিও না ভাইয়া। ওঁকে ছাড়তে, ছেড়ে থাকতে পারব না আমি। প্লিজ! ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।” কথাটা বলতে বলতে আদির গলা ধরে আসে। চট করে মাথা নিচের দিকে নামিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।
নবনী থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁট কাঁমড়ে হাতের মুঠোয় ওড়না খামচে ধরে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। দোটানায় পড়ে ক্লান্ত সে। নিভ্র আদির দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকায়।
ছোট ভাইয়ের ভালোবাসা আর নিজের ভালোবাসা এক সঙ্গে জড়ানো। কাকে ফেলে, কাকে স্বকীয় করবে বুঝতে পারছে না। ছোট থেকে আদির কোনো আবদান অসম্পূর্ণ রাখেনি। তবে আজ আদি কঠিন আবদারটি করেছে। এবারও সে মুখ ফিরিয়ে নিবে না। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানিটুকু হাতের উল্টোপিঠে মুছে নেয়। নিজেকে স্বাভাবিক করে হাসার চেষ্টা করে বলে,
-“নিরদ্বিধায় বলতে পারব নবনীতা তোকে ভালোবাসে। সূচনা আমাকে দিয়ে হলেও, উপসংহার তোকে দিয়েই ঘটবে। নবনী তোর আছে, তোরই থাকবে।” লাস্টেরটুকু বলে নিভ্র আদির কাঁধে হাত রাখে। আদি খুশির আবেগে নিভ্রকে জড়িয়ে ধরে। নিভ্র শেষ বারের মতো নবনীকে দেখে। তার দৃষ্টি নিচের দিকে নিবদ্ধ। পরপরই নজর সরিয়ে নেয়। আদিকে ছেড়ে নিভ্র সেন্টারের দিকে এগিয়ে যায়। আরো একজন আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। চোখে তারও পানি বিদ্যমান। তিশা! সেদিন রাতে জিনান, নিভ্রর কথা বাহিরে দাঁড়িয়ে শুনেছিল। কিন্তু মুখ ফুটে জিনানকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। আজ নিভ্রকে সেন্টার প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যেতে দেখে তিশাও বের হয় এবং বাগানে এসে থেমে যায়। সেখানে আগে থেকেই নবনী উপস্থিত ছিল। আড়ালে লুকিয়ে তাদের কথা শুনে। কিছুক্ষণ পর আদিও সেখানে উপস্থিত হয়। আদিকে ও লক্ষ্য করেনি।
অজান্তেই কেঁদে ফেলে তিশা। তবে সে খুশি হয় নিভ্রর মহৎকর্ম দেখে। সেও চলে যায় সেখান থেকে।
আদি নবনীর সামনাসামনি এসে দাঁড়ায়। নবনীর দু গালে হাত রেখে উঁচু করে। নবনীর দৃষ্টি অন্যদিকে। আদি শান্ত কন্ঠে বলে,
-“তাকাও আমার দিকে।”
নবনী তাকায় না। আদি ফেন একই কথা বলে। নবনীর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে কিছুটা ধমকের গলায় বলে,
-“তাকাও বলছি।”
নবনী ভয়ার্ত চোখে আদির দিকে তাকায়। আদি কৃত্রিম হেসে বলে,
-“ভয় পাচ্ছো কেন, আমি তোমাকে কিছু বলব না। ”
নবনী আলতো হাতে আদির হাত সরিয়ে দেয় গাল থেকে। দৃষ্টি সরিয়ে বলে,
-“মাফ করবেন…”
-“হুশশ! এই টপিকে কোনো কথা শুনব না।” নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলে আদি।
নবনী চুপ থেকে যায়। আদি নবনীর আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে বলে,
-“ব্লু রঙের লেহেঙ্গাটি পড়ো নি কেন?”
নবনী যেন আকাশ থেকে পড়লো আদির প্রশ্ন শুনে। ভ্রুকুটি কিঞ্চিত বাঁকিয়ে বলে,
-“মানে আপনি লেহেঙ্গাটি দিয়েছিলেন?”
-“ইয়েস! পাগলিনী।” মুচকি হেসে দু হাত পিছিয়ে নিয়ে নবনীর দিকে একটু ঝুঁকে বলে আদি। নবনী একটু সরে দাঁড়িয়ে বলে,
-“কিভাবে?”
-“সেদিন মলে আমার বন্ধু রোহানও গিয়েছিল। তোমাকে দেখে পিছন থেকে ছবি তুলে নেয় যখন তুমি লেহেঙ্গাটি ছুঁযে দেখতে ব্যস্ত ছিলে। কথা বলতে যাবে তখন তুমি চলে যাও ভেতরে। সেখানে দাঁড়িয়ে রোহান হোয়াটসঅ্যাপে ছবি সেন্ড করে। ছবি গুলো দেখে জিজ্ঞেস করতেই তোমার কথা বলে। তখন নজরে আসে লেহেঙ্গাটির কথা। কেন জানি মনে হচ্ছিল তুমি লেহেঙ্গাটি পছন্দ করেছো। ব্যস! রোহানের মাধ্যমে কিনে আগন্তুক হয়ে তোমাকে পাঠিয়ে দেই।”
অবশেষে মাথা থেকে লেহেঙ্গার টেনশন নেমে গেল। সে আদির দিকে কৃতজ্ঞতা দৃষ্টিতে তাকায়। আসলেই তার লেহেঙ্গাটি অনেক পছন্দ হয়েছিল। আর সেটি ও বুঝতে পেরেছে।
-“কিন্তু তুমি অনেক চাপা স্বভাবের। ভাবলাম হয়তো এই ঘটনাটি নিজ থেকেই বলবে আর আমি শুনে মজা নিবো। সেটা আর হলো না। প্লানে পানি ঢেলে দিলে। আদির অবুঝ পাগলিনী যত্তসব!” লাস্টের টুকু বিড়বিড় করে বলে আদি।
তবে নবনী ঠিক শুনেছে। মুখে হাত রেখে হেসে ফেলে। বলে,
-“ভালোই হয়েছে বলিনি।”
ভেংচি দেয় আদি নবনীকে টেনে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়।এখন অনেক শান্তি অনুভব হচ্ছে। এক সুমিষ্টঘ্রাণ নবনীকে শিহরণ করছে। ঘ্রানটা আদির শরীর থেকে পাচ্ছে নবনী। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে নবনী। আদি চোখজোড়া বন্ধ করে নিয়ে কাতর কন্ঠে বলে,
-“এভাবে আঁকড়ে ধরতে চাই সারাজীবন। হারাতে দিবো না, হারিয়ে যেতে দিবো না। প্রিয়তম অসুখ, আসক্তি তুমি। ভালোবেসে ভালোবাসায় বেঁধে রাখবো তোমায়। আমি তুমিতেই আসক্ত নবনী, ভয়ংকর নেশার মতো আসক্ত। সেই আসক্ততা কেটে যাওয়ার কোনো উপায় নেই! ”
নবনীর মনের ভেতরে আদির কথাগুলো অনেকখানি জায়গা নিয়ে বিশাল এক অনুভূতির তৈরি করেছে। ভালোলাগা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে ঠিক আদির মতো। একদিকে যেমন ভালোলাগা শুরু হয়েছে অন্যদিকে লজ্জায় লালনীল আকার ধারণ করেছে মুখমন্ডল। আদি আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নেয়। মুগ্ধতার মোহজালে তাকিয়ে আলতোভাবে নবনীর কপাল ছুঁয়ে দেয়। লজ্জায় লাল হয়ে যায় নবনীর গাল। মসৃণ ঠোঁট জোড়া কেঁপে ওঠে। শুধু মাথা নুইয়ে রাখে সে। সেটি দেখে মুচকি মুচকি হাসে আদি।
__________
জিনান অনেকক্ষণ যাবত নিভ্রকে খোঁজ করছে। শুধু নিভ্র নয় তিশা ও নবনীকেও খুঁজছে। কল দিয়েছিল নিভ্রকে। নিভ্র ফোন সাইলেন্ট করে রাখে জিনানে কল দেখে।
নিভ্র সেন্টারের একটি ফাঁকা কামরায় এসে সোফায় বসেছে।বুকের ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। অগ্নির শিখার মতো দাউদাউ করে জ্বলছে, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। না আছে দেখার মতো, না আছে কেউ বোঝার মতো। নীরবে চোখের পানি ফেলছে।
কিছুক্ষণ পর তিশাও সেই কামরায় আসে। নিভ্র তিশাকে দেখে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে। তিশা নিভ্রর পাশে এসে বসে। নিভ্র ফোন বের করে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলে,
-“এখানে কেন?”
-“আপনি কেন?” পাল্টা প্রশ্ন করে তিশা।
নিভ্র তিশার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,
-“আরে আমি তো হাবিলদারের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলাম।”
তিশা সরল চোখে তাকায় নিভ্রর চোখের দিকে। এই চোখে কিছু একটা আছে। কোমল স্বরে বলে,
-“কত সুন্দর করে মিথ্যে হাসি দিয়ে, মিথ্যে কথা বলতে পারেন। অনেক বড়ো অভিনেতা আপনি!”
দৃষ্টি সরিয়ে নেয় নিভ্র। তিশার চোখ এড়াতে পারেনি সে, ধরা পড়ে গিয়েছে। তিশা কণ্ঠ খাদে ফেলে বলে,
-“জানি আমি। সব শুনেছি, দেখেছি আড়াল থেকে। তার জন্য দুঃখিত!”
নিভ্র বুড়ো আঙুল দিয়ে চোখের পানি মুছে নেয়। নাক টেনে বলে,
-“একটা উপকার করবে তিশা?”
-“কি করতে হবে বলুন।”
-“কাল আমায় বিয়ে করবে?”
তিশা অবাক হয়না। দৃষ্টি নত রেখে ফের তাকায় নিভ্রর দিকে। মুচকি হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলে,
-“বিয়েটা নিশ্চয় নিজের ভাইয়ের জন্য করছেন?”
নিরুত্তর রয়ে যায় নিভ্র। পরক্ষণেই বলে,
-“আমি তোমাকে সত্যিই বিয়ে করতে চাই। থাকনা হাজারটা কারণ।”
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।