#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_২৬
#সুমাইয়া মনি।
সকাল সকাল আপন পার্কে জগিং করতে বেরিয়েছিল। আজ চার-পাঁচদিন পর সকালে হাঁটতে বেরিয়েছে। আগে রোজই হাঁটা হতো। আগেকার অভ্যেস গুলো পুনরায় চালু করছে। ভুলতে চাইছে তনুশ্রীর মৃত্যুর ঘটনা। কেননা সে সব সময় একা একাই তাকে নিজের পাশে অনুভব করে বিড়বিড় করে কথা বলে। সে মনে করতেই চায় না তনুশ্রী আর নেই! কখনো আসবে না তার কাছে। বকা দিয়ে বলবে না ‘তুমি খুব বাঁদর আপন’। দৌড়ানোর ফলে কিছুটা হাঁপিয়ে উঠে। একটি বেঞ্চে এসে বসে আপন। চারদিকের পরিবেশটা খুব সুন্দর। অনেকেই জগিং করতে পার্কে এসেছে। তাদের দেখার ভ্রূক্ষেপ নেই তার। প্রকৃতির রূপ উপভোগ করছে সে। আকাশের স্নিগ্ধ সূর্যকিরণে রাস্তা-ঘাট ঝলমল করছে। দোয়েল-কোয়েল আর বিভিন্ন পাখির কলকাকলিতে মুখরিত চারদিক। মাঝেমধ্যে ঝিরিঝিরি বাতাস এসে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। অন্যপাশ ফিরে কিছু একটা দেখছে সে। হঠাৎ পাশ থেকে অতি চেনা কারো কণ্ঠের স্বর ভেসে আসে। সে স্বর আগেও শুনেছে আপন।
-“পানি খাবেন?”
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। কিছুটা অবাক হয়। কারণ তনুজা ঠিক তার পাশে বসে রয়েছে। দৃষ্টি তার সামনের দিকে। সেদিকে চেয়েই আপনকে পানির কথা জিজ্ঞেস করেছে। এক নজরে তনুজাকে বেশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করো নেয় সে। মেয়েটি আগের চেয়ে অনেকটা শুঁকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। লাস্ট তাকে দেখেছিল তাদের হলুদের দিন। হলুদরঙের শাড়ীতে। আর আজ দেখছে। নজর সরিয়ে নেয় আপন। এভাবে তনুজাকে উপস্থিত হতে দেখে সে বিব্রতবোধ করছে। কষ্টও হচ্ছে তার।
তনুজা নিজেও সকালে এই পার্কে এসেছিল হাঁটতে। মন রিফ্রেশ করার জন্য। সামনের পথে এগিয়ে যেতেই আপনকে দেখতে পায়। স্থির হয়ে থেমে যায় সে। থমকে দাঁড়ায়। পরক্ষণে হেঁটে পাশে এসে বসে তার।
তনুজা আপনের উত্তেরর অপেক্ষা না করে পানির পটটি এগিয়ে দেয়। বোতলের দিকে তাকায় আপন। অর্ধেক খালি, হয়তো সে নিজে খেয়েছে বাকি পানিটুকু, নয়তো এতটুকুই এনেছে বাসদ থেকে। ধারণা করে সে। আপন হাত বাড়িয়ে এগিয়ে নেয় বোনলটি। এক চুমুক খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ফেরত দিয়ে দেয় তাকে। তনুজা হাতে নিয়ে সেভাবেই বসে রয়।
দু’জনার মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা ছেঁয়ে যায়।
হঠাৎ নীরবতাকে ছুঁড়ে ফেলে তনুজা মৃদুস্বরে প্রশ্ন করে,
-“কেমন আছেন?”
আপন ফের শান্ত নজর তাক করে তনুজার ওপর। সে নজর যেন বলে দিচ্ছে প্রশ্নের উত্তর। তবুও সে নজর সরিয়ে নেয়। বলে,
-“কেমন আছি, সেটা নিশ্চয় অজানা নয়।”
-“হুম। তবুও জানতে ইচ্ছে হলো। উত্তর পাবো?” গাঢ় গলায় বলে।
আপন সরু নিশ্বাস ফেলে বলে,
-“আলহামদুলিল্লাহ! আপনি?”
-“সব কিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ!”
আবারও নিরবতা এসে ভর করে তাদের মাঝে। দু’জনই চুপচাপ থেকে আরো কিছু সময় কাটিয়ে দেয়। এবার আপন নিজ থেকে বলে,
-“স্যরি!”
-“নিশ্চয় বিয়ে না করার জন্য?”
আপন উত্তর দেয় না। হ্যাঁ! সে তনুজাকে বিয়ে করতে পারেনি সে-ই জন্যই স্যরি বলেছে। তনুজা তাচ্ছিল্য হাসে। বলে,
-“ভালোই হয়েছে আপনি আমাকে সেদিন বিয়ে না করে চলে গিয়েছিলেন। এখন হয়তো সেই জন্য কষ্ট পাচ্ছি। বিয়ের পর তো আপনার ইগনোর, বিরহে আরো ভীষণ কষ্ট পেতাম।”
-“বেশিই ভালোবেসে ফেলেছিলেন নাহ!” অপরাধী বোধ নিয়ে বলে আপন।
-” নিজেকে সংযত করে রাখা যায় ঠিকিই, কিন্তু মনকে কিছুতেই সংযত করে বেঁধে রাখা যায় না।”
-“ভালোবাসা এমন কেন বলতে পারেন?”
-“নিজেকে প্রশ্ন করুন। উত্তর পেয়ে যাবেন।”
আপন নীরব হয়ে রয়। তনুজা উঠে দাঁড়িয়ে আপনের দিকে না তাকিয়ে বলে,
-“গেলাম, ভালো থাকবেন।”
হাঁটতে আরম্ভ করে তনুজা। যাওয়ার পানে চেয়ে রয় আপন, যতক্ষণ না তনুজা আড়াল হচ্ছে। আগের তনুজা আর এখনকার তনুজার মধ্যে তুমুল পার্থক্য রয়েছে। মেয়েটা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। উদাস মনে আকাশের দিকে তাকায় আপন।
___________________
আদি বাইক নিয়ে একা বাহিরে ঘুরতে বের হয়েছিল। আসার সময় দু’টি গোলাপ ফুল সঙ্গে নিয়ে এসেছে। অবশ্য সে ইচ্ছে করেই কিনেছে। জ্যামে আটকা পড়ার দরুন একটি ছোট্ট মেয়ে গোলাপ ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে একটি,দুটি ফুল বিক্রি করছিল। ফুলের দিকে তাকাতেই নবনীর কথা মনে পড়ে আদির। আগে তার জীবনে কেউ ছিল না। কিন্তু এখন ফুল দেওয়ার মতো প্রিয় মানুষ তার জীবনে এসেছে। যাকে সে ফুল দিয়ে এক রাশ ভালোবাসার শুভেচ্ছা জানাবে। চট করে কিনে নেয় দু’টি গোপাল ফুল।
এক বার কলিং বেল বাজানোর পর দরজা খুলে দেয় নিয়ান। আদি নিয়ানের হাতে চকলেট ধরিয়ে দিয়ে ফুল নিয়ে সোজা নবনীর রুমে আসে। মাত্রই নবনী গোসল সেরে বের হয়েছে। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছিল। বিন্দু বিন্দু পানির জল নবনীর ফর্সা পিঠে হিরের মতো চকচক করছে।
দেখতে বেশ সুন্দর স্নিগ্ধ লাগছে। আদির উপস্থিতি নবনী এখনো টের পায়নি, এতটাই মগ্ন সে চুল মুছতে। আদি ফুল হাতে নিয়েই ধীরে পায়ে এগিয়ে যায়। দু হাত পিছনের দিকে নিয়ে একটু ঝু্ঁকে নবনীর পিঠে জমে থাকা পানির জলকণার ওপর ফু দেয়। গড়িয়ে পড়ে পিঠ বেয়ে মাটিতে। নবনী কেঁপে উঠে দ্রুত ঘুরে তাকায়। এতে তার ভেজা চুলগুলো আদির আদলে ছুঁয়ে যায়। মিষ্টি ঘ্রাণ অনুভব করে সে। যেন মন চায় বার বার মুখ চুলের মধ্যে ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিতে। চাইলেও এটা সম্ভব নয়। তাই নিজেকে স্বাভাবিক রেখে পিছনে লুকিয়ে রাখা গোলাপ ফুলগুলো নবনীর সামনে ধরে সুইট স্মাইল দিয়ে বলে,
-“আপনার জন্য।”
ভ্রু কিঞ্চিৎ ভাঁজ করে আদির দিকে তাকায় সে। প্রথমে তো সে তাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। তারপর আবার গোলাপ ফুল দিয়ে আরো অবাক করে দিয়েছে তাকে। বিস্ময় চোখে তাকায় নবনী। আদি ঠোঁটে হাসি রেখে বলে,
-“নিন! ভয় নেই, ভালোবাসি বলতে হবে না।”
নবনী যেন কিছুটা বিরক্ত হলো আদির কথায়। তবুও সে ফুল নেয়। নাগের কাছে নিয়ে একবার ঘ্রাণ নিয়ে মৃদু হেসে বলে,
-“ধন্যবাদ। ”
-“শুধুই?” এক ভ্রু উঁচু করে বলে।
-“তো?”
-“একটু আগে আমি কি বলেছি, বলেন তো।”
-“শুধুই বলেছেন।”
-“উঁহু! তার আগে?”
-“ভয় নেই ভালোবাসি….”
-“থামুন।” বাকিটা বলার আগেই আদি হাত জাগিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে থামিয়ে দেয়। নবনীর ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে যায়। আদির কথা-কাজ কিছুই বুঝতে সক্ষম নয় সে। আদি ফিক করে হেসে দেয়। বলে,
-“আমি এতোগুলো ভালোবাসি…”
-“মানে….ইডিয়েট।” রেগে বলেই ফুল গুলো আদির হাতে তুলে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আদি ফুল গুলো নিয়ে খাটের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। ভালো লেগেছে নবনীকে রাগাতে। বেশ আনন্দিত সে। হেসে ফুল গুলোকে সামনে ধরে তাকিয়ে রয়।
.
.
নিভ্র কলেজ মাঠ থেকে থেকে ফিরে আসার সময় পাশ থেকে একটি মেয়ের চেঁচামেচি শুনতে পায়। থেমে গিয়ে ঘুরে তাকায়। মেয়েটি রাগী কন্ঠে একটি ছেলেকে আঙ্গুল তুলে বকাবকি করছে। ছেলেটি মাথা নত রেখে মেয়েটির কঁড়া কথা গুলো শুনছে। কিচ্ছু বলছে না। নিভ্র মেয়েটির বলা কিছু বাক্য শুনে বুঝতে পারে ছেলেটির যোগ্যতা নিয়ে কথা বলছে। এগিয়ে যায় তাদের দিকে। নিভ্রকে দেখে মেয়েটি চুপ হয়ে যায়৷ নিভ্র চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-“কি হয়েছে?”
মেয়েটি কোনো কথা বলে না। ভীতু হয়ে দৃষ্টি নত রাখে। নিভ্র ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে,
-“তুমি বলো কি হয়েছে?”
ছেলেটি যেন লজ্জা পেল নিভ্রর কথাতে। তার দৃষ্টি সেভাবেই নত। নিভ্র কপাল কুঁচকে মেয়ে ও ছেলেটির দিকে তাকিয়ে জোরে ধরকিয়ে বলে,
-“বলছো না কেন কি হয়েছে?”
মেয়েটি ঈষৎ কেঁপে উঠে। আমতা আমতা করে বলে,
-“ও আমকে ভালোবাসে। রোজ আমার বাড়ির সামনে লুকিয়ে ফুল রেখো আসে। ছোট বাচ্চাদের দিয়ে ফুল, চকলেট পাঠায়। লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দেখে। আমি বার বার ওঁকে নিষেধ করেছি এমনটা না করতে। কারণ ওর প্রতি আমার কোনো অনুভূতি নেই। না হবে। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। এটা জেনেও এসব পাগলামির কোনো মানে হয় না স্যার। আর এমনতেও ও আমার জন্য পারফেক্ট নয়। না ওর কোনো যোগ্যতা আছে আমার মতো মেয়েকে ভালোবাসার।”
প্রথম বলা কথা গুলো ঠিকঠাক থাকলেও পরের কথা গুলো নিভ্রর কাছে নিজের মতো বলে মনে হয়। যেই কথা গুলো সে নবনীকে বলেছিল। ছেলেটি গরীব। কিন্তু মেয়েটির পোশাকআশাকে গরীব বলে মনে হয় না। তাইতো সে তার ভালোবাসাকে প্রত্যক্ষান করছে। নিভ্রকে মৌন হয়ে রয়। ছেলেটি এবার মাথা তুলে। নরম স্বরে বলে,
-“আমাকে অপমান করো , কিছু মনে করব না। কিন্তু আমার ভালোবাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার অধিকার আমি দেবো না তোমায়। তুমি বললে না, অন্য একজনকে ভালোবাসো। আগে ভালোবাসাকে সম্মান করতে শিখো। তারপর না হয় ভালোবাসবে। দেহে যতদিন প্রাণ থাকবে, আমার মুখ তোমাকে দেখাব না। ভালো থেকো টুম্পা।” বলেই ছেলেটি গুড়িগুড়ি পায়ে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। চোখে তার অশ্রু। এতে মেয়েটির কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সেও ভাব নিয়ে উল্টোদিকে ছুঁটে চলে। রয়ে গেল শুধু নিভ্র। ছেলেটির সত্যিকারের ভালোবাসার ইতি ঘটল। আর সেটি খুব কাছ থেকে নিভ্র দেখেছে। মৌন হয়ে ঠাঁই সেভাবেই দাঁড়িয়ে রয়। ছেলেটির মধ্যে নবনীকে অনুভব করছে সে, আর মেয়েটির মধ্যে নিজেকে। সত্যি! সেদিনের জন্য নিজেকে আজ দোষী মনে হচ্ছে। বড্ড অপরাধ করে ফেলেছে।
প্রত্যক্ষান করেছে এত টুকু পর্যন্ত ঠিকঠাক থাকলেও, ওর ভালোবাসাকে অসম্মান করা ঠিক হয়নি। অনুভব করে নবনী তাকে কতোটা ভালোবেসে ছিল। কতোটা পাগলামি করেছিল।
.
.
.
#চলবে?
#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_২৭
#সুমাইয়া মনি।
আদির ইন্টারভিউ থাকার দরুন পরের দিন কুমিল্লা ফিরে আসে। রাত হয়ে যায় কুমিল্লা পৌঁছাতে। ফিরে এসে পড়ে যায় মহা মুসকিলে। সুখ নেই তার মনে। কিছুতেই মনকে স্থির রাখতে পারছে না। বার বার নবনীর কথা মনে পড়ছে তার। নবনীর শূন্যতা আদিকে আঁকড়ে ধরেছে। চোখ বন্ধ করলেই নবনীর মায়াবী মুনখানা ভেসে উঠছে। মন চাইছে তার এক দৌঁড়ে পুনরায় ঢাকাতে ফিরে যেতে। কিন্তু সেটি সম্ভব নয়। এ কোন রোগে ধরেছে তাকে। এটা কি তাহলে প্রেমের রোগ। যে রোগে আসক্ত আদি। সবে খাটের উপর চিৎ হয়ে নবনীর কথা ভাবছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে টুং করে মেসেজ আসে। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এসেছে। হাতড়িয়ে ফোন হাতে নেয়। নবনীর মেসেজ দেখে অবাক হয় এবং খুশিও লাগে। এতক্ষণে তাতেই বিভোর ছিল। এখন তার মেসেজ দেখে মহা খুশি। নবনী লিখেছে, ‘কুমিল্লা পৌঁছে গেছেন?’। প্রতিত্তোরে আদি ‘হ্যাঁ’ লিখে দেয়।
নবনী ফের লিখে পাঠায়,’কিছু খেয়েছেন কী?’
আদি এবার উত্তরে, ‘না’ লিখে দেয়। এসে সবার সঙ্গে দেখা করার পর সোজা রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। খাওয়া হয় নি। অবশ্য রানী খাতুন ফ্রেশ হয়ে খেতে আসতে বলেছিল আদিকে। আদি লিখে পাঠায়,’আপনি খেয়েছেন?’
নবনী উত্তরে,’হুম’ লিখে।
‘কী করছেন?’
‘ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
‘ওহ।’
‘আপনি খেয়ে শুয়ে পড়ুন। আমিও ঘুমাব।’ লিখেই নবনী ফোন পাশে রেখে দেয়। আদি রিপ্লাইতে ‘ওকে’ লিখে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুম আসে। আপাতত সে টায়ার্ড। তাই বেশি কথাবার্তা বলার আগ্রহ পোষণ করছে না।
আজিম উদ্দীন, আজমল উদ্দীন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার। বছরখানের আগেই তারা রিটায়ার করেন। বাবা,চাচ্চুর মতো নিভ্র পুলিশের চাকরীতে জয়েন্ট করে। আর আপন সি,আই,ডি এর কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োজিত ছিল।
আদির পুলিশের চাকরির প্রতি আগ্রহ নেই। মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর বেশ ক’দিন অবসরে দিন কাটিয়েছে। হুটহাট বিয়ে হয়ে যাওয়ার ফলে চাকরির জন্য এপ্লাই করে। এবং কাল তার ইন্টারভিউ। আদি স্বভাবে যতোটা শান্তশিষ্ট আসলে তা নয়। তবে সে শান্তিপ্রিয় লোক। সহজে রাগে না। তবে একবার রেগে গেলে খবর আছে। সবসময় নিজেও হাসিখুশি থাকে, অন্যকেউ হাসাতে, বিরক্ত করতে পছন্দ করে। ছোট থেকে আদি ভ্রমণপিয়াসু ও বই প্রেমী। এ যাবত বহু জায়গায় ঘুরেছে সে।
.
সকালে ইন্টারভিউ দিয়ে বাড়ি ফিরে। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসে মুখ মুছতে মুছতে নবনীকে কল দেয়। এর আগে আর তাদের মাঝে কথা হয়নি। নবনী তখন ক্লাস রুমে ছিল। ফোন সাইলেন্টে থাকায় রিংটোন শুনতে পায় নি। আদি দু’বার ফোন দেওয়ার পর বুঝতে পারে নবনী এখন ক্লাস করছে। তাই আর ফোন দেয় না। টেক্সট পাঠিয়ে দেয় ক্লাস শেষে যেন কল দেওয়া হয়। পুরো ক্লাস শেষ করার পর ক্যান্টিনে এসে বসে তিন বান্ধবী। নবনী ব্যাগের ভেতর থেকে ফোন বের করে দেখে আদি দু’বার কল ও মেসেজ। মানুষের আনাগোনায় সে উঠে একটু দূরে গিয়ে কল ব্যাক করে। অদ্ভুত বিষয়! নবনীর বুক ধুকধুক করছে। কেন সেটা তার অজানা। বুকে হাত রাখতেই আদির সালাম শুনতে পায়। নবনী হাত সরিয়ে ফেলে সালামের জবাব দেয়। অজানা প্রশান্তিতে বুকের ভেতরটা শীতল হয়ে যায় আদির। হয়তো নবনীর কণ্ঠে স্বর শুনে!
-“কী করছেন?”
-“ক্যান্টিনে ছিলাম।”
-“এখন কোথায়?”
-“একটু দূরে আছি।”
-“ওয়াও এত ভালোবাসা! আড়ালে এসেছেন আমার সঙ্গে কথা বলতে।”
-“বেশি বুঝেন।”
-“কম বুঝতে পারি না যে।”
-“তো কি করব?”
-“বলব?”
-“বলুন?”
-“মিস ইউ!” মিষ্টি কণ্ঠে বলে আদি।
নবনী চোখের পাতা বন্ধ করে নেয়। বুকটা কেমন কেঁপে উঠে তার। তবে কষ্টে নয়। অজানা অনুভূতিতে। যে অনুভূতি সে আগে কখনো ফিল করেনি। কিছুক্ষণ দু’জন নীরব থাকে। নীরবতা কাটিয়ে আদি নবনীকে ডাকে,
-“শুনুন?”
-“জি,বলুন।”
-“দূরত্ব ভাঙতে হলে একটু একটু করে আগে বাড়তে হয়। আজ থেকে তুমি করে বলব।”
নীরব থেকে নবনী আদির অগোচরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নবনীকে চুপ থাকতে দেখে আদি আবার বলে,
-“খুব বেশি চেয়ে ফেললাম কী?”
-“উঁহু! অধিকার আছে আপনার।”
-“হ্যাঁ, আছে তো।” হেসে বলে আদি।
-“রাখছি! বাসায় গিয়ে কথা বলব।”
-“আচ্ছা।” নবনী ফোন রেখে দেয়। ক্যান্টিনে ফিরে আসে। তিন বান্ধবী মিলে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে যে যার বাড়িতে ব্যাক করে।
_____________
নিভ্র দুপুরে বাড়িতে ফিরে প্রিয় ফুল গাছের দিকে তাকাতেই মুখ মলিন হয়ে আসে তার। কিছু গাছ রৌদে শুঁকিয়ে গেছে। আর কিছু গাছ গেছে মরে। আগের মতো যত্ন পরিচর্যা কিছুই করা হয়। নজর সরিয়ে ভেতরে আসে। ফ্যান ছেড়ে সোফায় পিঠ ঠেস দিয়ে বসে। সারা রাজ্যের ঘুম এসে ভর করে তার চোখে। রাতে ঠিক মতো ঘুম হয়নি। নিদ্রাহীন কেটেছে পুরো রাত। যার মূল উৎস নবনী। ইদানীং নবনীকে ঘিরেই তার ভাবনার নদী থৈথৈ করে ঢেউ খেলছে। মানুষ দেরিরে হলেও বুঝে। কিন্তু সে বুঝতে বড্ড বেশিই সময় নিয়ে ফেলেছে। এখন লাভ, উপায় কোনোটাই তার হাতে নেই। সব তার ধরা ছোঁয়ার বাহিরে।
-“নিভ্র!” জিনানের ডাকে ঘাড় কাত করে তাকায়। দরজার কাছ থেকে এগিয়ে আসতে আসতে নিভ্রকে ডাকে সে। জিনানকে দেখে সোজা হয়ে বসে। হাসার চেষ্টা করে বলে,
-“কেমন আছিস? অনেক দিন পর আসলি।”
-“ভালো,আজ সন্ধ্যার দিকে মায়াদের বাড়িতে যাবে আব্বু,আম্মু আংটি পড়াতে ওঁকে। বিয়ের তারিখও ঠিক করে আসবে। সেটা বলতে আসলাম।” সোফায় বসতে বসতে বলল জিনান।
-“কংগ্রাচুলেশনস।” মৃদুহেসে বলে নিভ্র।
-“ধন্যবাদ।”
-“চা, কফি?”
-“কিছুই খাব না।”
-“এখনো রেগে আছিস আমার উপর?”
-“নাহ!”
নিভ্র জিনানের নাহ বাক্যটিতে অনেকটা অভিমান অভিযোগ খুঁজে পায়। মুখে না বললেও সে জানে সেদিনের ব্যাপারটি নিয়ে জিনান এখনো রেগে আছে। নিভ্র স্মিত হেসে বলে,
-“জিনান,মানুষ কিছু ভুল থেকে শিক্ষা অর্জন করে, বুঝতে শিখে। ব্যতিক্রম নই আমি। ভুল থেকে শিখেছি, বুঝেছি। কিন্তু ভুলের মাশুল দিতে পারি নি।”
-“আমি বুঝতে পেরেছি তুই কি বলতে চাইছিস। বাট ইউ লেট নিভ্র।”
তাচ্ছিল্য হাসে নিভ্র। জিনানের চোখে চোখ রেখে বলে,
-“যদি কেঁড়ে নেই?”
জিনানের কপাল কুঁচকে যায়। নিভ্রর মুখ থেকে এমন কথা সে আশা করছে না। কেন জানি নিভ্রকে ওর নিজের কাছেই অচেনা মনে হচ্ছে। এই কি সেই নিভ্র? যার মধ্যে ডিসেন্ট, ম্যানার বলতে কিছু ভদ্রতা যুক্ত ছিল। জিনান গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
-“এক ভুলের মাশুল গুনে, আরেকটি ভুল করতে যাস না। পরিনতি ভালো হবে না। এখন তো দু’টি জীবন নষ্ট হয়েছে, পরবর্তীতে আরেকটি যোগ হবে।”
নিভ্রর ঠোঁটের হাসি চওড়া হয়। চওড়া হাসি ঠোঁটে রেখে বলে,
-“তোর কি মনে হয় আমি এটি করব? আমি তো শুধু তোকে পরিক্ষা করতে চেয়েছিলাম বলে।”
সরু চোখে জিনান নিভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“দিনে দিনে আগন্তুক হয়ে যাচ্ছিস তুই।”
-“ইউ নো, ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টর আমার ভালো লাগে।”
নীরব রয়ে যায় জিনান। আরো বেশ কিছুক্ষণ কথপোকথন হয় তাঁদের মাঝে।
.
নবনী কাপড়চোপড় ভাঁজ করে আলমারিতে রাখার সময় আদির একটি ব্লু রঙের শার্ট দেখতে পায়। হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সে। ভুলে আদি শার্টটি রেখে গেছে। আদির কথা মনে আসতেই টেবিলের পাশে রাখা ফুলের টপের দিকে তাকায়। সেখানে আদির দেওয়া সেই গোলাপ ফুল দু’টি ছিল। তাজা লাল টকটকে গোলাপ ফুল দু’টি এখন কিছুটা শুঁকিয়ে কালো বর্ন ধারণ করেছে। আদি নিজে থেকেই ফুল দু’টি টপের ভেতরে রেখেছিল। আদি চলে যাওয়ার পর নবনী নিজেও কিছুটা একা ফিল করছে। তার দুষ্টুমি গুলো মনে করে মৃদু হাসে। পরক্ষণে ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে সে।
হঠাৎ ফোনের রিংটোন শুনে খাটের ওপর তাকায়। শার্টটি পাশে রেখে ফোন রিসিভ করে। মায়া কল দিয়েছে।
-“বল মায়া।”
-“দোস্ত, আজকে আমাকে আংটি পড়াতে আসবে।”
-“এত তাড়াতাড়ি?”
-“জিনানের বাবা, মা নাকি দেরি করতে চাইছে না। মেবি এক সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যেতে পারে।”
-“ভালো খবর। কিন্তু সামনের মাসে তো পরিক্ষা।”
-“জানি রে। আমার কেমন ভয় ভয় করছে। তুই একটু আয় না আমাদের বাসায়।”
-“এখন?”
-“হ্যাঁ! তারা সন্ধ্যের পর আসবে। খুশিকে বলেছিলাম। ও আসতে পারবে না। এখন তুই ছাড়া আমার আর কোনো গতি নেই। চলে আয় প্লিজ।”
-“আচ্ছা আমি আসবো।”
-“আসব না। আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছি। তাড়াতাড়ি আয়।”
-“আচ্ছা রাখ।”
মায়া ফোন রেখে দেয়। নবনী মায়াদের বাসায় যাবে। কিন্তু যাওয়ার আগে আদিকে একবার বলতে চায়। তার পারমিশন নেওয়াটা জরুরী বলে মনে করে। নিশ্চয় আদি তাকে যেতে নিষেধ করবে না।
.
.
.
#চবলে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।