#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_২২
#সুমাইয়া মনি।
দু তিনদিন ধরে নিভ্রর কাছে সব কিছুই কেমন বিরক্ত ও বোরিং ফিল হচ্ছে। থানায় মন বসছে না। বাহিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। খাওয়াতেও অনিহা। বিতৃষ্ণা অনুভব করছে সে। কেন? কি কারণে? সেটা তার অজানা! কাল রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেছে। সারাদিন ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিল। যার দরুণ কারো কলই পীক করা হয়নি, এবং-কি ফ্যামিলিরও না। রাত বারোটার দিকে নিভ্র ওর বাবার ফোনে কল দেয়। কেননা সে সারাদিনে বহুবার কল দিয়েছে। তাই তাকেই আগে কল করে। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারে না। এরি মাঝেই সে গাম্ভীর্য মুডে রেগে কিছু বাক্য বলেই ভোর পাঁচটার দিকে কুমিল্লার উদ্দেশ্য রওয়ানা হতে বলে তাকে। এভাবে তাকে কখনোই বাড়িতে আসতে বলেনি। হঠাৎ ভোর পাঁচার দিকে রওয়ানা দেওয়ার কথা শুনে সে অনেকটা অবাক হয়। বাবার কথা অমান্য করার ছেলে সে নয়। কথা অনুযায়ী গাড়ি নিয়ে রাতেই রওয়ানা হয় কুমিল্লার উদ্দেশ্যে। যেতে যখন হবে, তখন আগে ভাগে গেলে ক্ষতি কি এই ভেবে, ছুটি নিয়ে নেয় চার-পাঁচ দিনের।
বাড়ির গলি পথে আসতে আসতে এসব ভেবে চলেছে সে। সারারাত ড্রাইভ করেছে। ঘড়িতে নয়টা ছুঁই ছুঁই।
প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে সে। আর মাত্র পাঁচ মিনিটের রাস্তা বলা চলে। তার মাথায় শুধু একটাই প্রশ্ন? হঠাৎ করে বাড়িতে আসার জরুরীতলব করার কারণ কী?
ব্লু রঙের আলিশান বাড়ির সরু রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে তার গাড়িটি। পাশেই বড়ো করে নাম লিখা আকন ভিলা। আকন নিভ্রর দাদার নাম। পুরো নাম আকন উদ্দীন। তিনি মারা যাওয়ার পূর্বে বাড়িটি বানানো হয়, এবং তার নাম-ই দেওয়া হয়। গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। বুক ভরে একবার নিঃশ্বাস নেয় সে। সারারাত ড্রাইভ করেও তার শরীর কেন জানি ক্লান্ত লাগছে না। বাড়ির দিকে তাকাতেই মনটা ফুরফুরা হয়ে গেল। ব্যাগ বের করে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে এগিয়ে যায় সদর দরজার দিকে। ভেতরে প্রবেশ করে কিছু পথ এগোতেই হল রুমের ডাইনিং টেবিলে বাবা,চাচ্চুকে বসা দেখতে পায়। বাড়ির সবাই জানত নিভ্র আসবে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আসবে সেটা তাদের জানা ছিল না। নিভ্র আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে নিজের বাবা ও চাচাকে সালাম দিলেন। তারা উত্তর নেয়। নিভ্রর চাচ্চু কিছু বলতে যাবে তখনই নিভ্রর কাকি মা এগিয়ে আসে। তার সঙ্গে একটি মেয়েও ছিল। আকাশী রঙের শাড়ী পড়া। মাথায় ঘোনটা। চেহারা ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না।
-“কেমন আসিস নিভ্র? কত শুকিয়ে গেছিস তুই। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করিস না বোধ হয়।”
-“কোথায়? ঠিকিই তো আছি কাকি মা। বেশি মোটা হলে সবাই আমাকে দেখে মটু পুলিশ বলে ডাকবে যে। তোমার ছেলেকে মটু বলে ডাকবে। এটা নিশ্চয় ভালো লাগবে না তোমার।” মৃদু হেসে বলে নিভ্র।
-“হুম, তাই তো। আগে ভেবে দেখিনি।” কিছুটা ভাবার ভঙ্গিতে বললেন তিনি।
নিভ্রর ঠোঁটের হাসি কিছুটা চওড়া হয়। হঠাৎ নজর পড়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়েটির উপর। নিভ্র নজর সরিয়ে নিয়ে কাকি মা’র উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখে,
-“ওনি নিশ্চয় নতুন ভাবী আপনের ওয়াইফ?”
সে ঘুরে তাকায় পিছনে। জবাব না দিয়ে হেঁটে সঙ্গে করে নিয়ে এসে নিভ্রর সামনে দাঁড় করিয়ে মাথার ঘোনটা একটু পেছনে টেনে বলেন,
-“আপন নয়, তোর ছোট ভাই আদির বউ নবনীতা নূর।”
নিভ্রর কান যেন তবধা হয়ে গেছে। প্রতিধ্বনি হচ্ছে নামটি বার বার। চোখ মাজারি আকার ধারণ করেছে নবনীকে দেখে। সে বাক্শূন্য অবাক, বিস্মিত। কয়েক মিনিটের জন্য যেন চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে নিভ্র। নবনীর দৃষ্টি আগের দিন গুলোর মতো নত। সামনে যে নিভ্র দাঁড়িয়ে আছে এতে তার ভাবান্তর এবং কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। মনের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না নিভ্রর। স্বাভাবিক দেখাচ্ছে নবনীকে। রানী খাতুন নবনীর উদ্দেশ্য করে নিভ্রকে দেখিয়ে বলে,
-“নবনী ও হচ্ছে তোমার বড়ো ভাসুর নিভ্র আহমেদ। সালাম দেও।”
নবনী স্বভাবসুলভতা বজায় রেখে চোখ তুলে তাকায় নিভ্রর চোখের দিকে। ধীর ও শান্ত কন্ঠে বলে,
-“আসসালামু আলাইকুম! ভাইয়া।”
সালামের জবাব দেওয়ার ইচ্ছে পোষণ করছে না নিভ্র। তার যে কিছুতেই ঘোর কাটছে না। অবাক চাহনি তার বার বার বলছে যা সচক্ষে দেখছে সেগুলো আদৌও সত্যি কি-না। আদি বলেছিল আপনের বিয়ে হবে। মেয়ের নামও বলেছিল। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে নবনীকে দেখে এক জাঁক প্রশ্ন এসে মাথায় হানা দিচ্ছে। উত্তর পাওয়া যে বড্ড জরুরী।
তখন পাশের ঘর থেকে আদি বেরিয়ে আসে। নিভ্রকে দেখে মিষ্টি করে হেসে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
-“ভাইয়া কখন এলে তুমি?”
নিভ্রর ঘোর কেঁটে যায় কিছুটা। ঘুরে তাকিয়ে কৃত্রিম হেসে উত্তর দেয়,
-“মাত্রই।”
-“এসো বোসো খেতে। এক সঙ্গে নাস্তা করি।”
-“তার আগে আব্বু, চাচ্চুর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।”
-“সব কথা বলা হবে তোমায়। এই জন্যই তোমাকে কুমিল্লা আসতে বলা হয়েছে। ফোনে সব কথা বলা যায় না।” আজীম উদ্দীন গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে।
আজমল উদ্দীন রানী খাতুনের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,
-“নবনীকে রুমে নিয়ে যাও। নাস্তা রুমে দেওয়ার ব্যবস্থা করো ওর।”
রানী খাতুন তার কথা অনুয়ায়ী নবনীকে আদির রুমে নিয়ে যায়। সেখানেই নবনীকে খাবার দিয়ে আসে সে। বেরিয়ে আসে হল রুমে। এতক্ষণে নবনীর বুকের মাঝে বয়ে যাওয়া ঝড় গুলো উপচে পড়ে। দরজা বন্ধ করে পাথরের মতো ধুম করে ফ্লোরে বসে পড়ে। চোখের অশ্রুগুলো মুক্তোর মতো গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে ফ্লোরে। পুরোনো স্মৃতি, ক্ষত তাজা হয়েছে আজ। যে অতীত থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে, সেই অতীত তার জীবনের সঙ্গে নতুন ভাবে জুড়ে গিয়েছে। হল রুমে বের হবার পর নিভ্রর নাম শুনেই তার বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠে। আর যখন কন্ঠের স্বর শুনে, তখন সে আরো শিওর হয় এটাই সেই নিভ্র। যাকে এক সময় গভীর ভাবে ভালোবেসে ছিল। দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছিল বুকের ভেতরটা। বার বার কেন নিয়তি তার সঙ্গে এভাবে খেলছে? ভেবেই ঘনঘন অশ্রুবর্ষণ হয় চোখ থেকে। তখন পরিস্থিতি সামলে নিতে নিজেকে যে কিভাবে শক্তপোক্ত ভাবে উপস্থাপন করেছে সবার সামনে, একমাত্র সে-ই ভালো জানে। কিন্তু সে কিছুতেই দূর্বল হবে না। তাকে বুঝাতে হবে সে খুব ভালো আছে। অতীত ভুলে গিয়েছে বহুকাল আগেই। চোখ মুছে ফেলে সে। নিজেকে নিজেই আশ্বাস দেয়।
.
-“পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে মানসম্মান হারাতে বলেছিলাম। শুধু মাত্র আদির জন্য পারিপার্শ্বিক অবস্থা স্বাভাবিক হয়েছে। সম্মানহানি থেকে মুক্ত হয়েছি আমরা।” আজীম উদ্দীন কথা গুলো বলে নিভ্রর পানে তাকায়। এতক্ষণে বিয়ে বাড়ির পুরো ঘটনা পুনরায় নিভ্রকে তিনি খুলে বলেন। নিভ্র চুপ করে শুনেছে। আপন বাদে আদি, রানী খাতুন ও রুবিন বানু ছিলেন। নবনীর বাড়ির সবাই কেথায় বেড়াতে গিয়েছে এটা নিভ্র জানে। কিন্তু তারা যে কুমিল্লা তার মামাত বোনের বিয়েতে এসেছে, সেটা তার জানা ছিল না।
নিভ্র এসব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থির নবনীতে। সে তার আপন ছোট ভাইয়ের ওয়াইফ ভাবতেই রাগে চোখমুখ খিঁচে আসে। কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ওঁকে। আজমল উদ্দীন বলেন,
-“তোমাকে আরো একটি কারণের জন্য কুমিল্লা আনা হয়েছে…..”
-“কারণটি নিশ্চয় বিয়ে?” ক্ষোভিত কন্ঠে চটজলদি বলে উঠে নিভ্র।
-“হ্যাঁ! বড়ো ভাইয়ের আগে ছোট ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বিষয়টি সমাজের চোখে বেমানান।”
-“তোমরা এখনো সেই সমাজ নিয়েই পড়ে আছো। কবে বের হবে সেখান থেকে? আর কত ভাববে সমাজের কথা?” নিভ্র কিছুটা রাগী কন্ঠে বলে।
-“সমাজেই যখন আমাদের বসবাস, ওঠাবসা, তখন তার কথা মাথায় রাখতেই হবে। তোমাকে বিয়ে করতে হবে। এবার কোনো অজুহাত আমি শুনবো না।” ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলে আজীম উদ্দীন।
নিভ্র রাগে নাকের পাঠা ফুলিয়ে রাখে। মুখে কিছু বলে না। ব্যাগ নিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের রুমে আসে। একে তো সে নবনীকে দেখে ক্ষেপে আছে। তার ওপর বিয়ের প্রসঙ্গ তোলার কারণে আরো ক্ষেপে যায়। নিভ্রর রাগের ধারণা তাদের আছে। তাই কিছুক্ষণের জন্য তাকে একা ছেড়ে দেয় তারা।
রুমে আসতেই কাঁধের ব্যাগ সজোরে বিছানার ওপর ছুঁড়ে মারে নিভ্র। রীতিমতো রাগে তার শরীর কাপছে। একে তো নবনী, দ্বিতীয় বিয়ের জন্য ফোস করার কারণে ভীষণ রাগ লাগছে তার। বিয়ের ব্যাপারটি বাদ দিলেও নবনীর বিষয়টি কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারছে না সে। হোক এক্সিডেন্টলি বিয়ে হয়ে গেছে, তবুও মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। ছোট ভাইয়ের বউ হিসাবে নবনীকে কিছুতেই দেখতে চায় না ।
সে কথা বলবে নবনীর সঙ্গে। চলে যেতে বলতে তার ভাইয়ের জীবন থেকে।
.
নাস্তা খেয়ে নবনী রুম থেকে বের হয় না। বেলকনিতে এসে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়। একটু আগেই তার পরিবারের সকলের সঙ্গে কথা বলেছে সে। দুপুরের দিকে আদি ও তাকে নিতে আসবে তারা। মন কিছুটা হলেও শান্ত হয়েছে। কিন্তু নিভ্রর কথা মনে পড়তেই মনে আঁধার নেমে আসে। কেমন যেন সব কিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। আচ্ছা, দুঃস্বপ্ন হয়ে যেতে পারে না? নয়তো মিরাক্লেল হয়ে যাক!
তার ভাবনার ছেদ ঘটে আদির আগমনে। গলা খাঁকনি দিয়ে নবনীর এক হাত দুরত্ব রেখে দাঁড়ায়। নবনী দৃষ্টি কিছুটা নত করে রাখে। আদি নিজ থেকে বলে উঠে,
-“বিছানার উপর শাড়ী রাখা আছে। দেখবেন পছন্দ হয়েছে কি-না।”
নবনী ছোট করে বলে,
-“জি, দেখবো।”
আদি সেখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়। দু’জনার মধ্যে নীরবতা এসে জড়ো হয়। আদি পুনোরায় নিরবচ্ছিন্নতা ঘটিয়ে বলে,
-“দুঃখবিলাস বলে একটা টার্ম আছে, বুঝেন?”
নবনী আদির পানে তাকায়। তার চাহনি দেখে আদি নিজেও তাকায়। নবনী চোখ সরিয়ে নেয়। মৃদুস্বরে বলে,
-“নাহ!”
-“যাদের জীবনে সুখের অভাব, দুঃখ পেতে পেতে একসময় তারা দুঃখটাকেই উপভোগ করতে থাকে। দুঃখটাকে তারা নিজের সঙ্গী বানিয়ে নেয়। এটাই দুঃখবিলাস।”
হঠাৎ আদির দুঃখবিলাস নিয়ে বর্ণনা দেওয়ার কারণ নবনী বুঝতে পারছে না। তবে সে সুন্দর করে ব্যাখ্যা দিয়েছে। আদি পুনরুক্তি নমর স্বরে বলে,
-“কেন দুঃখবিলাস নিয়ে বর্ণনা দিলাম জানেন? কারণ এই দুনিয়ার বুকে অনেক মানুষই আছে দুঃখবিলাসে বেঁচে আছে। আবার অনেকের বেঁচে থাকার আশাটাই মরে গেছে। আপনি, আমি যদি নিজের দিক থেকে দেখি, তাহলে আমাদের কষ্ট সেই মানুষদের কাছে অতি তুচ্ছ বলে মনে হবে!”
নবনী চোখ জোড়া হালকা ভাবে বন্ধ করে নিয়ে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আদি জানে না তার মধ্যেও এক চিতলে দুঃখের রেশ লুকিয়ে রয়েছে। আর সেই দুঃক্ষের পুরো রশি এই সংসারের মধ্যে আবদ্ধ। প্রতিনিয়তে তার মুখোমুখি হতে হবে।
-“দুঃখিত! আসলে কাল রাতে আমাদের পরিবারের সদস্য যে আরেকজন আছে তার কথা বলতে ভুলে গিয়েছে। নিভ্র ভাইয়া।”
ফের নিভ্রর নামটি শুনে নবনী চোখ জোড়া চট করে বন্ধ করে নেয়। মেনে নিতে হবে তাকে। এখানে থাকলে নিভ্রর নাম সহ তারও মুখোমুখি হতে হবে। ভেবেই তার বুক ভার হয়ে আসে। আদির কথা বের শুনতে পায় নবনী। চোখ মেলে তাকায় সে।
-“আচ্ছা আপানার নিভ্র ভাইয়াকে কেমন লেগেছে? প্রথম দেখেছেন তাই হয়তো গম্ভীর, রাগী বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু ভাইয়া যথেষ্ট শান্ত স্বভাবের। অতিরিক্ত রাগকেও সে নিয়ন্ত্রণ আনার ক্ষমতা রাখে।”
যে মানুষটিকে কাছ থেকে দেখেছে, চিনেছে, এক সঙ্গে পাশাপাশি থাকাও হয়েছে। তার সম্পর্কে যে কিছুই অজানা নয়। না নতুন করে জানার আছে। উল্টো সে নিভ্রর স্বভাব, চরিত্রের বিবরণ দিতে পারবে। নবনী আদির চোখের দিকে তাকায়। ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে,
-“আপনার ভাইয়াকে আমি অতি নিকট থেকে চিনি। তার সম্পর্কে সব ধারণা আছে আমার। তাকে নিয়ে কিছু না বললেও চলবে।”
আদির ভ্রুকুটি কিঞ্চিৎ কুঁচকে আসে। কৌতূহল জেগে যায় মনে। সপ্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকায় নবনীর দিকে। নিভ্রকে আগে থেকে চেনার কারণ সে বুঝতে পারছে না।
.
.
.
#চলবে?
#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_২৩
#সুমাইয়া মনি।
দিনের বেলায়ও দরজা, জানালা বন্ধ করে অন্ধকার কক্ষে বসে আছে তনুজা। পরনে এখনো বিয়ের লেহেঙ্গা, সাজসজ্জা চেহারাতে লেপ্টে রয়েছে। এলোমেলো চুল। হাতের মেহেদী চকচক করছে। ডান হাতের তালুর এক পাশে এ অক্ষরটি লিখা। নজর যতবার পড়ছে তার, আপনাআপনি অশ্রু ঝরেছে। খাওয়া তো দূর, পানিও মুখে তুলেনি এখন পর্যন্ত। তনুজার এমন অবস্থা দেখে চিন্তিত বাড়ির সবাই। কিভাবে ওঁকে স্বাভাবিক করবে, কেউ বুঝতে পারছে না।
নবনী ও আদি কিছুক্ষণ আগেই এ বাড়িতে হয়েছে। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে তনুজার রুমে আসে নবনী। ভেতরে প্রবেশ করে প্রথমে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। আলো রুমে প্রবেশ করতেই তনুজা কপাল কুঁচকে ফেলে। নবনীর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। এসে পাশে বসে নবনী। দু গালে হাত রেখে তার দিকে ফিরিয়ে করুণ চোখে তাকায় সে। কনে সাজ এখনো আছে তার চেহারাতে। শুধু নেই উজ্জ্বল ভাবটা। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখখানা। নবনী কোমল কাতর স্বরে বলে,
-“আপু আমার দিকে তাকাও। দেখো আমি কত হ্যাপি থাকার চেষ্টা করছি। তুমি কেন পারবে না? আমাদের ভাগ্য যে আল্লাহ নিজের হাতে লিখেছেন। সাধ্য নেই বদলানোর। ওনি যা করেন, ভালোর জন্যই করে।”
তনুজা কেঁদে ফেলে। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
-“আপন ভাইয়ারও তোমার মতো একই অবস্থা আপু। চাইলে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারো তুমি। আর নিজেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসো আপু।”
-“কী করব আমি?” কান্নারত কণ্ঠে বলে।
-“আপাতত আগে নিজেকে গুছিয়ে নেও। যতটা অগোছালো হয়েছো, তার চেয়ে বেশি।”
চুপ থেকে নবনীকে জড়িয়ে ধরে আরো কয়েক ফোঁটা চোখের পানি বিসর্জন দেয়। নবনী পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু কাঁদতে বারন করে না। কাঁদলে যে মন হালকা হয়, সেটা সে জানে।
আদিকে গেস্ট রুমে একা একা বসে আছে। এক গাদা নাস্তা তার সামনে রাখা। একা খেতে মন চাইছে না। মনে মনে নবনীর কথা ভাবে। তার ভাবনা বিফলে যায় না। হঠাৎ-ই নবনীর আগমন হয়। কিছুটা হলেও আদি খুশি হয়। নবনী তার দিকে এগিয়ে আসতেই আদি প্রথমে জিজ্ঞেস করে তনুজার কথা,
-“তনুজা আপু কোথায়?”
-“তার রুমে আছে।”
-“স্বাভাবিক হয়েছি কি?”
-“এত তাড়াতাড়ি হবে বলে মনে হচ্ছে না।”
আদি চোখ নামিয়ে চুপ করে রয়। বুঝতে পারে আপন, তনুজার অবস্থা একই। আপন হারিয়েছে তার প্রেয়সীকে, তনুজা হারিয়েছে যাকে বিয়ে করার আশা নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছিল তাকে। দু’জনার কূলকিনারা এক। আদি চুপ হয়ে যাওয়াতে নবনী বলে,
-“খাচ্ছেন না যে?”
আদি চোখ তুলে তাকায়। বলে,
-“আচ্ছা আমাকে কী আপনাদের রাক্ষস বলে মনে হয়?”
নবনী বুঝতে পারে কেন রাক্ষসের প্রসঙ্গ সে তুলেছে। উত্তরে বলে,
-“আপনি এ বাড়ির এক মাত্র ভাগ্নি জামাই। এতটুকু আপ্যায়ন তো সামান্য। শ্বশুর বাড়ির কথা তো বাদই দিলাম।”
-“এতটুকু বলছেন? এগুলো আমি একা খাব?”
-“না পারলে আপনার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে করে কেন নিয়ে আসলেন না?”
-“বন্ধু তো আপাতত কাছে নেই, তবে নিভ্র ভাইয়াকে জোর করে নিয়ে আসলে ভালো হতো।”
মুখ চুপসে যায় তার। যতোই ভুলে থাকতে চায়। আদি কথার মাঝে একবার হলেও মনে করিয়ে দেয়।
-“ওহ! ভাইয়ার কথা বলাতে কাল আপনার কথা মনে পড়লো। আপনি তো বলেন নি ভাইয়াকে আপনি অতি নিকট থেকে কিভাবে চিনেন। কিন্তু ভাইয়া বলেছে। তাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। ভাইয়া বলেছে আপনি নাকি তার প্রতিবেশী ছিলেন। রাইট?”
-“জি।”
-“বরাবর বাড়ি আপনাদের।”
-“জি।”
-“তাহলে তো আপনি ভাইয়াকে খুব ভালো করেই চিনেন?”
-“জি, সেটা বলতে পারেন।” কথাটি বলে নবনী ভাবে নিভ্র হয়তো তার বিষয়টি চাপিয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে নিশ্চয় কোনো গভীর কারণ লুকিয়ে আছে।
-“আমি সেদিন দেখলাম না কেন আপনাকে? ওহ! দেখেছি কলেজে।”
-“কোনদিন?”
-“ভুলে গেলেন। আমাদের ফাস্ট মিট হয়েছিল কিন্তু লাইব্রেরিতে।”
-“আপনি কি আমাদের কলেজে পড়েছিলেন?”
-“আরে না। আপনের বিয়ের কার্ড নিয়ে সেদিন সকালে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসি। ভাইয়া নাকি তার কিছু কলিগদের বিয়ের দাওয়াত দিবে তাই। তারপর সকালে ভাইয়ার সঙ্গে বের হই থানার উদ্দেশ্যে। তার আগে আপনাদের কলেজে আসি। প্রিন্সিপালের সঙ্গে কিছু জুরুরী কথা বলবে ভাইয়া এই জন্য। ভাইয়া কথা নিচে বলছিল। এই ফাঁকে আমি লাইব্রেরিতে যাই। আর তখন কাকতালীয় ভাবে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়। ভাইয়ার জরুরী মিটিং ছিল। তাই গায়ে হলুদ,চলনে উপস্থিত থাকতে পারেনি। বৌ ভাতের অনুষ্ঠান এক দিন পিছিয়ে দেওয়া হয় ভাইয়ার জন্য। কিন্তু…? ডাউট ক্লিয়ার?”
-“জি।”
-“রাতের বাসে চড়ে পরেরদিন সকালে কুমিল্লা ফিরে আসি। এই জন্য বোধহয় আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয় নি।”
-“দেখা হলে হয়তো আমি আপনাকে বিয়ে করতাম না।” মনে মনে বলে নবনী।
-“শুনুন নবীনতা।”
বুক কেঁপে উঠে নবনীর। পুরো নাম ধরে নিভ্র ব্যতীত আর কেউ ডাকতো না। আদির মুখে পুরো নাম শুনে অস্বস্তি লাগছে তার। দ্রুত বলে উঠে,
-“আমাকে শুধু নবনী বলে ডাকলে খুশি হবো, নবনীতা না বলে।”
-“আপনি যদি খুশি হন তাহলে নবনী বলেই ডাকবো।”
-“আচ্ছা।”
-“এখন শুনুন। এই খাবার গুলো আমি একা খেতে পারব না। আপনাকে আমার সঙ্গে খেতে হবে।”
-“আপনি শুরু করুন, আমি আসছি।”
-“না, প্লিজ যাবেন না। একা খুব বোরিং লাগছে। খেতে হবে না, আপনি শুধু পাশে বসে থাকুন।” কিছুটা মিনতি স্বরে বলে।
নবনী মৃদু হাসি প্রধান করে বলে,
-“আচ্ছা যাব না, আপনি খেতে আরম্ভ করুন।”
-“ধন্যবাদ।” স্মিত হেসে বলে।
আদি খাচ্ছে আর নানান বিষয় নিয়ে আলাপ করছে। নবনী কথায় সায় দিচ্ছে। দরজার অপর পাশে দাঁড়িয়ে নিলুফা বেগম ওদের কথপোকথন শুনে ভেতরে প্রবেশ করে না।
বাহিরে দাঁড়িয়ে রয়। ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে,
-“নবনীর জীবন কেন যে এতটা কঠিন ভাবে বিধাতা বানিয়েছে জানি না। নিভ্রর কাছ থেকে কষ্ট পাওয়ার পর হুট করে বিয়ে হয়ে গেল। ভেবেছিলাম শ্বশুর বাড়িতে হয়তো ভালো থাকবে। কিন্তু নিয়তি আবার ওর জীবনের মোড় উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিলো। অতীত ফিরে এসেছে। জানি না মেয়েটার জীবনের শেষ পরিনতি কী লিখা আছে!” কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে চলে যায়। এ বাড়িতে আসার পর নিভ্রর কথা জানতে পারে আদির কাছ থেকে। প্রথমে তার ঘটকা লাগে। নবনীকে জিজ্ঞেস করতেই নিভ্রর তার বড় ভাসুর সেটা জানতে পারে। মেয়ের জন্য খুব দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে তার।
___________________
রাতে….
জরুরী তলব দেওয়ার ফলে তাকে কুমিল্লা আসতে হয়। এতে সে জিনানকে বলে আসতে পারে না। জিনান নিভ্রর বাড়িতে এসে দেখে তালা ঝুলানো। নিভ্রকে কল দিয়ে জানতে পারে সে কুমিল্লা। হঠাৎ করে যাওয়ার মূল কারণ জানতে চাইলে সংক্ষেপে সব খুলে বলে। জিনান নিজেও অবাক নবনীর কথা শুনে। নিভ্রর বিয়ের কথা শুনে জিনান কিছু বলে না। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর নিভ্র নিজেই ফোন কেঁটে দেয়। জিনান ভাবতে থাকে নিভ্র, নবনীর কথা। যখন আদি জানতে পারবে নিভ্রকে এক সময় নবনী ভালোবাসতো তখন কেমন রিয়েক্ট করবে ভাবে সে।
না খেয়ে শুয়ে পড়ে নিভ্র। আজীম উদ্দীন কয়েক বার নিভ্রকে আদির সঙ্গে যেতে বলেছিল ঐবাড়িতে। কিন্তু নিভ্র যায় নি। যাবে না কঁড়া গলায় নিষেধ করে। খুব জেদ হচ্ছে তার। কেন? কী কারণে? প্রশ্ন হয়ে লটকে আছে। এটি একটি গভীর প্রশ্ন? উত্তর কোথায় লুকিয়ে আছে জানা নেই তার।
__________
-“আপনি বিছানায় ঘুমান। আমি নিচে চাদর বিছিয়ে ঘুমাবো।” নবনী কথাটি আদির উদ্দেশ্যে বলে চাদর বিছাতে আরম্ভ করে।
আদি খাটের ওপর বসেই বলে উঠে,
-“সেকি! নাহ সেটা হবে না৷ আপনি বরং ওপরে ঘুমান। আমি নিচে শুই।”
-“দরকার নেই। শুয়ে পড়ুন।”
-“উঁহু! হবে না।” বলেই আদি নিচে নেমে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। নবনী একটু সরে দাঁড়িয়ে আদির পানে তাকায়। চোখাচোখি হয় তাদের। নজর আগে সরিয়ে নেয় নবনী। আদি নবনীর দিকে নজর তাক করে রাখে। এই দু’দিন নবনীকে দেখে তার মনে হয় স্বভাব-চরিত্র ভালো প্রকৃতির। চুপচাপ থাকে, মাথা নিচু করে কথা বলে। বেশ শান্তশিষ্ট সে। সৌন্দর্যের দিক থেকে দেখলে রূপবতী নারী বলা চলে। যেকোনো পরিস্থিতিতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে জানে, ঠিক তার মতো।
-“শুনছেন?” নবনীর আওয়াজ শুনে আদির ভাবনা কেটে যায়। এতক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। দ্রুত নজর ফিরিয়ে নেয়। নবনী বিছানা বিছিয়ে নিয়েছে। এখন শুধু শোবার পালা।
-“শুনে পড়ুন যান।” ফের নবনী বলে উঠে।
আদি বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে। জড়তা-সংকোচ ফেলে বলে,
-“আচ্ছা চলুন আজ রাতে আমরা গল্প করে সময় কাঁটিয়ে দেই।”
নবনী কাঁথা কেবল হাতে নিয়েছে গায়ে দিবে বলে। আদির কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় তার দিকে। ঠোঁটে স্মিত হাসি তার স্পষ্ট। নবনী যত চাইছে আদির কাছ থেকে এড়িয়ে চলতে, ততই আদি আগ বাড়িতে তার নিকট এগিয়ে আসছে। এক রাশ স্নিগ্ধ বিমুগ্ধতা ছেঁয়ে আছে তার চোখে, ঠোঁটে, আদলে। তার এমন বন্ধুসুলভ আচরণ, মনোমুগ্ধকর হাসি দেখে যে কোনো মেয়ে মোহগ্রস্ত হবে। দুই ভাই দুই প্রকৃতির। এক ভাই কঠিন, তো আরেক ভাই নরম, শান্ত!
নবনী চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। মনের মধ্যে তার জড়তা সৃষ্টি হয়। বলে,
-“আমি ঘুমাব।”
-“আচ্ছা ফোস করব না। গুড নাইট!” বলেই সে চিৎ হয়ে শুয়ে বালিশে মাথা রাখে। নবনী লাইট অফ করে দেয়। অন্ধকার হয়ে যায় পুরো রুম। বন্ধ রুমে দু’জন মানুষ দুই স্থানে শুয়ে রয়েছে। অথচ, কিছু দিন আগেও তারা দু প্রান্তের বাসিন্দা ছিল। আজ এক প্রান্তের বাসিন্দা হয়েও তাদের মধ্যকার দূরত্ব বেশখানিকটা জুড়ে রয়েছে।
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।