#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_৩
#সুমাইয়া_মনি।
থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি করেছে খুশি একাই। অপর পাশের চেয়ারে নবনী ও মায়া স্থিরচিত্ত নজর তাক করে চুপ করে বসে আছে। খুশির পাশে নোমান চোরের মতো মাথা নত করে বসে রয়েছে। তার ফর্সা গালের এক পাশে লালচে দাগ। দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন তাকে জোরে ঘুষি মেরেছে।
আজ ওদের দু’জনার বিয়ে হয়েছে। আর ওদের বিয়ে দিয়েছে নিভ্র। কালকে নোমানের পিছনে খোচর লাগিয়ে সব খবরাখবর জানতে পারে নিভ্র। এক নাম্বারের প্লে বয় নোমান। অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। এবার খুশির জীবন নষ্ট করার পর্যায় গিয়েও হতে হতে বেঁচে যায়। আজ সকালে নোমান ও খুশিকে কোটে নিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য এতে নোমান আপত্তি করেছিল যার ফলে নিভ্রর হাতে পাঞ্চ খেতে হয়। বিয়ে শেষে কঁড়া গলায় এটাও বলে দেয়,খুশির ওপর যেন কোনো রকমের টর্চার না করা হয়।
বিয়ে হবার খুশিতে সকাল সকাল খুশি নবনীকে আগে ফোন দেয়। যার দরুণ কথা বলার কোনো ভাষা খুঁজে না পেয়ে আগেই জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ ধাতস্থ থেকে ফোন উঠিয়ে কানে দিয়ে খুশির কন্ঠের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারে এটা ওরই বান্ধবী খুশি। আর তারপর খুশির কথা অনুযায়ী নবনীকে কলেজ মাঠে আসতে বলে। মায়াকেও আগে থেকে বলেছিল। তাই দু’জনে এক সঙ্গে কলেজ মাঠে এসে উপস্থিত হয়। খুশি সেই তখন থেকে নিজের বকবকানুষ্ঠান চালু করে রেখেছে। যা শুনতে হয় মুখ বুঁজে নবনী ও মায়াকে। নবনী তো নিভ্রর কথা ভেবে চলেছে। কাল যতোটা খারাপ, অসভ্য ভেবেছিল তাকে। আসলে সে ততটা খারাপ নয় সেটা এখন বুঝতে পারে। এক পর্যায় নবনী খুশিকে থামিয়ে দেয়। বলে,
-“সব বুঝেছি আমরা। হ্যাপি মেরিড লাইফ! এবার তোরা মেরিড লাইফ এনজয় কর। আমরা গেলাম। চল মায়া।” বলেই মায়াকে সঙ্গে নিয়ে ওঠে দাঁড়ায়।
-“শোন না নবনী।”
-“ট্রিট দিতে চাইলে পরে দিস। আগে তোর ভাঙা গাড়ি মেরামত কর। দেখে মনে হচ্ছে পাঞ্চটা বেশ জোরেশোরে লেগেছে নতুন দুলাই ভাইয়ের গালে।” বলেই হাঁটা ধরল।
খুশি মুখ টিপে হাসে। নোমান মাথা তুলে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই খুশির হাসি বন্ধ হয়ে যায়। মায়া হেসে হেসে নবনীকে বলে,
-“যাক,এক দিক থেকে ভালো হয়েছে খুশির বিয়ে হয়ে, কি বলিস।”
-“ঢের ভালো হয়েছে। সঙ্গে নিভ্র স্যারের পাঞ্চটাও।” বলেই হেসে ফেলে।
মায়াও হাসে। দু’জনে ক্লাসরুমে গিয়ে বসে। তিন চারটে ক্লাস করে দু’জনে এক সঙ্গে বের হয়। কলেজের গেটের বাহিরে এসে ফুটপাতে বসা ফুচকার দোকান থেকে ফুচকা খেতে আরম্ভ করে। এই একটি খাবার, যেটি অনেক মেয়েদেরই প্রিয়। নবনীও তাঁদের মধ্যে একজন। অর্ধেক ফুচকা খাওয়ার সময়, হঠাৎ নবনীর চোখ পড়ে দূরের রাস্তার পানে। সেখান থেকে একটি লোক উত্তেজিত হয়ে দৌড়ে এদিকে আসছিল আর তার পিছনে দু’টি কনস্টেবলও জোর বেগে তাকে ধরার জন্য পিছু ছুঁটছিল। কারো বুঝতে বাকি থাকে না এটা চোর-পুলিশের মামলা, আর নয়তো এর চেয়ে বড়ো কিছু। নবনীও বুঝতে পারে। তাই দ্রুত ফুচকার প্লেট চেয়ারের উপর রেখে ওঠে দাঁড়ায়। মায়া কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই নবনী তার ব্যাগ থেকে কত গুলো মার্বেল বের করে হেঁটে তাঁদের বরাবর রাস্তার মাঝখানে ফেলে দিয়ে সরে দাঁড়ায়। সেকেন্ড কয়েক পরেই লোকটি সেখানে দৌড়ে দিতে নিলে মার্বেলের ওপর পা রাখার ফলে দ্রিম করে চিৎ হয়ে পড়ে। সেটা দেখে কিছু লোক হেসে দেয়, সঙ্গে নবনী, মায়াও। খপ করে কনস্টেবল দুটি লোকটির কলার ধরে টেনে উঠিয়ে চড় দিতে দিতে নিয়ে যেতে লাগলো।
নবনী আগের জায়গায় এসে ফুচকার প্লেট হাতে নিয়ে চেয়ারে বসে পড়ে। মায়া প্রশ্নবোধক চাহনিতে জিজ্ঞেস করে,
-“তুই কি মার্বেল ব্যাগে নিয়ে ঘুরিস নাকি?”
-“আরে না।”
-“তাহলে?”
-“এগুলো নিয়ানের। কাল ওর কাছ থেকে মার্বেল গুলো নিয়েছিলাম। নিয়ানের প্রচণ্ড নেশা মার্বেলের। পড়াশোনা না করে সারাদিন মার্বেল নিয়ে পড়ে থাকে।”
-“এই জন্য নিয়ে নিলি। যাক,এই সুবাদে নিয়ানের মার্বেল গুলো এক কাজে তো লেগে গেল।”
-“ইয়েস।”
এতক্ষণে মধ্যবয়স্ক ফুচকাওয়ালা লোকটি মুখ খুলে। সে এতক্ষণ নবনীর সব করা কর্মকাণ্ড দেখেছিল এবং ওদের কথপোকথনও শুনতে পায়। সে বলে,
-“তয় আপামনি তোমার এইডা করা উচিত হয় নাই। এরা ভালা লোক না। পরর্বতীতে যদি জানবার পারে তুমি তারে ধরাইয়া দিতে সাহায্য করছো। পরে তোমার ক্ষতি করতে পারে। ”
-“আরে কাকাবাবু এত ভয় পেও না। এই নেও তোমার টাকা। আর বরাবরের মতোই আজও তোমার ফুচকা অনেক ভালো লেগেছে। তাই দশ টাকা বেশি দিলাম।”
-“ধন্যবাদ আপামনি।” হেসে বলেন।
তার কথার বিনিময় নবনী মুচকি হাসি উপহার দেয়। দু’জনে কথা বলতে বলতে হেঁটে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।
__________________
মেয়ে দেখতে যাওয়ার জন্য সবাই রেডি হয়ে গাড়িতে বসে আছে। শুধু একজনের অনুপস্থিতের কারণে তার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। সবাই প্রায় বিরক্ত। শেষে আজমল উদ্দীন বিরক্ত নিয়ে গাড়ির সামনে বসা আপনকে বলে,
-“আপন যা গিয়ে আদিকে ডেকে নিয়ে আয়। আর কত দেরি করবে? মেয়ে কি ওর জন্য দেখতে যাওয়া হচ্ছে নাকি। যে এত তোড়জোড় করে রেডি হতে হবে।” রাগ জেড়ে বললেন তিনি।
-“দেখলে সমস্যা কি? দু চাচাতো ভাইয়ের এক সঙ্গে না হয় বিয়ে দিয়ে দিলে।” ফর্সা করে কালো রঙের শার্ট-প্যান্ট পরিধান একজন সুদর্শন যুবক কথা গুলো আওড়াতে আওড়াতে ড্রাইভিং সিটে বসে আপনের দিকে তাকিয়ে হেসে চোখ টিপ দেয়।
পিছনে বসা রানী খাতুন ড্রাইভিং সিটে বসা আদির বাহুতে চিনটি কেঁটে মুখ বাকিয়ে বললেন,
-“এত শখ কেন বিয়ে করার হু? সবে তো পড়াশোনা শেষ হলো। চাকরি-বাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে তবেই বিয়ে।”
-“উফফ! চাচি মা,এসব চাকরি-বাকরি আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমি শুধু ঘুরবো আর খাবো।” দু বাহু উঁচু করে বলে আদি।
-“সেটা পড়ে দেখা যাবে। আগে গাড়ি স্টার্ট দে। এমেনেই দেরি হয়ে গেছে আমাদের।” আজমল উদ্দীন বলেন।
-“ওকে চাচু।”
গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার হয়। বাড়ি থেকে গাড়ি বের হয়ে তাদের গন্তব্যের দিকে ছুঁটতে লাগল। কিছুক্ষণ বাদে তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছে যায়। মেয়ে দেখার পর্ব শেষ হয়। মেয়ে তাঁদের পছন্দ হয়েছে। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে তারা চলে আসে।
তাঁদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আদি ও আপন চলে আসে ক্যাম্পাসে। এখানে আদি সহ তার আরো কিছু বন্ধুরা মিলে রোজ আড্ডা দেয়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। নিজের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠে আদি।
______________
চারটার দিকে নবনী পড়তে বসে। সন্ধ্যার দিকে পড়তে বসলে প্রচুর ঘুম পায় দেখে এখন পড়তে বসা। মনোযোগ সহকারে ম্যাথ করতে ব্যস্ত সে। আচমকাই নবনীর রুমের জানালার কাঁচ ভাঙার শব্দে লাফিয়ে ওঠে। হকচকিয়ে ওঠে বুকে ফু দিয়ে জানালার দিকে তাকাতেই ফ্লোরে একটি লাল বল দেখতে পায়। নবনীর বুঝতে বেগ পেতে হয় না। এটা এই কলোনির দুষ্ট বাচ্চাদেরই কাজ। জোরে ছক্কা মারতে গিয়ে জানালার কাঁচ উড়িয়ে দিয়েছে। দু বার তাদের ওয়ার্নিং দিয়েছে নবনী । আজ আর রক্ষে নেই তাদের সেটা বুঝাই যাচ্ছে। রেগেমেগে বাসার গেট থেকে বের হয়ে বাচ্চাদের কাছে যায়। নবনীর এক হাতে বল, আরেক হাতে টিনের স্কেল। সাত-আট বছরের পাঁচজন ছেলে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নবনীর রাগের আন্দাজ তাদের জানা। ক্রোধ নিয়ে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আজ তোদের সেই দুই দিন, আর আমার তিনদিন।” বলেই একটি ছেলের হাত ধরে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে মারতে যাবে তখনই পিছন থেকে নবনীর হাত ধরে ফেলে নিভ্র। নবনী হাত আগে আনতে পারছে না দেখে রাগী ফেইস নিয়ে ঘুরে তাকাতেই নিভ্রকে দেখে থমকে যায়। বাচ্চাটির হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে নিভ্রর হাত থেকে। যেটা নিভ্র বুঝতে পেরে হাত ছেড়ে দেয় নবনীর। গম্ভীর কণ্ঠে নিভ্র শুধালো,
-“কেন মারছো ওঁকে?”
নবনী কোমল স্বরে বলে,
-“ক্রিকেট খেলে বল মেরে আমার রুমের জানালার কাঁচ ভেঙে দিয়েছে ওরা।”
নিভ্র একবার বাচ্চাদের দিকে তাকায়, নজর সরিয়ে নিয়ে নবনীর দিকে তাকিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
-“ওরা ছোট বাচ্চা। না বুঝে মেরেছে। ওদের বদলে আমাকে মারতে পারো।” বলেই নিভ্র তার এক হাত নবনীর দিকে তাক করে।
এক মিনিটের জন্য নবনী ঘোরের মধ্যে চলে যায়। সে নির্বাক হয়ে চেয়ে রয় নিভ্রর পানে। এই লোকটি এমন কেন? না না, এত ভালো কেন? এখন পর্যন্ত যতবার দেখা হয়েছে আশ্চর্যজনক ব্যাপার ঘটে গেছে।
এখনও সেটাই হচ্ছে । বাচ্চাদের হয়ে নিজে মা’র খাওয়ার জন্য প্রস্তুত!
-“নবনীতা!” মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে নিভ্র ডাক দেয়।
ঘোর কাটিয়ে উঠে তার। চোখ পিটপিট করে চেয়ে বলটি নিভ্রর হাতে দিয়ে ছুঁটে পালিয়ে বাড়িতে চলে আসে। নিভ্র নবনীর যাওয়ার পানে চেয়ে থেকে নজর সরিয়ে বাচ্চাটির মাথার হাত বুলিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বল দিয়ে দেয়। বাচ্চারা খুশি হয়ে চলে যায়।
এদিকে নবনী তার রুমে এসে চেয়ারে বসে টেবিলের উপর এক হাত রেখে মুচকি মুচকি হাসছে। হঠাৎ করে কেন জানি নিভ্রকে তার কাছে প্রচণ্ডভাবে ভালো লাগতে শুরু করেছে। নিভ্রর তখনকার বলা কথাটি মনে পড়তেই সে লজ্জাপীড়িত। আর তার মুখে নিজের পুরো নামটি শুনে অন্যরকম অনুভূতি সৃষ্টি হয় মনে। সেই অনুভূতি যেন নতুন কিছুর জানান দিচ্ছে। নতুন কিছু প্রকাশ করছে।
.
.
.
#চলবে?…
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।