#আমিরাহ্
২২,
অস্তগামী সূর্যটা তার সোনালি রঙে দুনিয়া ডুবিয়ে সাগরের বুকে ডুব দিল। আমিরাহ্ তার মধুরঙা চোখে স্বপ্ন মেখে সূর্যের বিদায় দেখছে। সাদমান পিছন থেকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। আজ তাদের বিয়ের পাঁচ বছর পূর্ণ হলো। এই বিশেষ ক্ষণ উদযাপন করতে তাই গতকাল তারা এই অত্যাধুনিক রিসোর্টে এসে উঠেছে।
এই পাঁচ বছরে বদলে গেছে অনেক কিছুই। আমিরাহ্ বেগম আব্বাস আল আবাদি থেকে মিসেস আমিরাহ্ সাদমান হয়েছে। পাঁচ বছর আগে যেদিন আব্বাস আমিরাহ্কে তার চেম্বারে ডেকেছিলেন সেই দিনটাতেই আমিরাহ্ র জীবন বদলের সূচনা হয়েছিল। সেদিন আব্বাস সরাসরি তার মনের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে তিনি সৌদীতে পাকাপাকিভাবে ফিরে যেতে চান। তারপর আমিরাহ্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে সে কী চায়?
আমিরাহ্ হঠাৎ প্রশ্নে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে বসে ছিল। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল যে আব্বাস ফিরলে তাকেও তো ফিরতেই হবে। আব্বাস তখন বলেছিলেন যে সে চাইলে আমেরিকায় থেকে যেতে পারে। কিন্তু সে আসলে কী চায়? ফিরতে চায় নাকী থাকতে চায়? আমিরাহ্ বলেছিল তার ফিরে যেতে মন চাইছে না তবুও একাকী এখানে থাকাও তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তখন আব্বাস তার আসল প্রশ্নটি করেছিলেন,
– কেউ যদি তোমার সাথে থাকতে চায় তাহলে কী তুমি তাকে সেই সুযোগ দেবে?
আমিরাহ্ বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল,
– কে সে?
– সাদমান।
আমিরাহ্ বেশ বড়ো একটা ধাক্কা খেয়েছিল যেন,
– এসব আপনি কী বলছেন? সাদমান আমার বন্ধু ঠিক আছে। কিন্তু সে আমার সাথে থাকবে মানে কী? আমি আপনার বেগম।
– সাদমানকে কী তুমি ভালোবাসো না?
– এসব কী কথা! হ্যা, ও কে আমি বেশ পছন্দ করি। কিন্তু ওকে নিয়ে অন্য কোনো ভাবনা আমি কখনোই আমার মনে স্থান দেইনি।
– আমি জানি। আমি তোমাকে খুব ভালোভাবেই চিনি। কিন্তু দেখ আমিরাহ্, তোমার আমার সম্পর্কটা যেভাবে চলছে এভাবে জীবন চলে না। আর এ সম্পর্কের কোনো উন্নতি হবে সে সম্ভাবনাও নেই। আমাদের নিকাহ্ এর পরদিন সকালে পারিবারিক বসারঘরে তোমার আর আহমাদের কথোপকথন আমি শুনেছিলাম। এরপর তুমিই বলো আমার পক্ষে কী এই সম্পর্কে স্বাভাবিক হওয়া সম্ভব ছিল? না কখনও সম্ভব হবে?
আমিরাহ্ কেঁপে উঠল, কতকটা ভয়ে, কতকটা লজ্জায়। লোকটা এতদিন এসব নিজের মধ্যেই চেপে রেখে ওর সাথে এত স্বাভাবিক আচরণ কিভাবে করেছেন তা ভেবে অবাকও হলো। কিন্তু আব্বাস তার কথা বলতেই থাকলেন। আজ যেন তার মুখের বাঁধন ছিঁড়ে গেছে।
– এভাবে কোনো সম্পর্ক হয় তুমিই বলো? আমার কথা নাহয় ছেড়ে দাও। আমার আরও দুইজন বেগম আছে, অনেকগুলো সন্তান আছে। দাম্পত্য সুখ বলো আর সন্তানের সুখ বলো কোনোটাই আমার অজানা নয়। কিন্তু তোমার কথা একবার ভাব। তোমার কী এসবের প্রয়োজন নেই? তুমি কী চাও না তোমার মৃত্যুর পরেও তোমার কোনো অংশ এই পৃথিবীতে হেঁটে বেড়াক?
আমিরাহ্ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। কেঁদে ফেলল। আব্বাস সেদিকে যেন লক্ষ্যই করলেন না। আজ যেন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন যে করেই হোক আমিরাহ্কে বোঝাতেই হবে।
– তুমি চাইলে আমাকে তালাক দিয়ে সাদমানকে নিকাহ্ করে সুখী হতে পার। সাদমানের সাথে আমি কাল রাতে কথা বলেছি। সে তোমাকে ভীষণ পছন্দ করে। শুধু তুমি আমার বেগম বলে সে নিজেকে এতদিন সংযত রেখেছে। তুমি চাইলেই সে খুশি খুশি তোমাকে নিকাহ্ করতে সদা প্রস্তুত। আর তোমার কথা যদি বলি, তুমি নিজে হয়তো বুঝেও বুঝতে চাইছ না, তুমিও কী সাদমানকে বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু ভাবছ না?
দেখ, আমার বেশ বয়স হয়েছে। সামনে খুব বেশিদিন হয়তো নেই। কিন্তু তোমার পুরো জীবনটা পড়ে আছে। আমি একদিন তোমার দায়িত্ব নিয়েছি। সেই দায়িত্ব নেওয়া বলতে শুধু অন্ন-বস্ত্রের দায়িত্ব না, তোমার সুখ-শান্তি, তোমার নিরাপত্তার দায়িত্ব ও। আমার মতে প্রতিটি পুরুষের উচিৎ তার কাছের নারীদের এসব দায়িত্বও নেওয়া। কী বাবা, কী ভাই, কী স্বামী অথবা সন্তান সবারই এই দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত। আমি সবকিছুর পরেও এখনও তোমার সুখ নিশ্চিত করতে পারিনি। আমার যদি খুব শীঘ্রই কিছু হয়ে যায় তাহলে তোমার নিরাপত্তার কী হবে তাও অনিশ্চিত।
তোমাকে মাঝে মাঝেই আমি বিষণ্নতায় ডুবে যেতে দেখি। আমি তোমাকে এভাবে দেখতে চাই না। আমি বেঁচে থাকতে তোমার সুখ নিশ্চিত করতে চাই। নয়তো নিজের কাছেই নিজেকে অপরাধী মনে হবে আমিরাহ্। সাদমানের মতো ছেলে যদি তোমার পাশে থাকে তাহলে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারব কারণ আমার বিশ্বাস সে তোমাকে সুখি করবেই। এবং এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
আব্বাসের কথা শেষ হতেই সাদমান চেম্বারে প্রবেশ করেছিল। এভাবেই তাকে বলা হয়েছিল। সে যেন আমিরাহ্ আসার বেশ কিছুক্ষণ পরে আসে। আমিরাহ্ তখন আকুল হয়ে কাঁদছিল। এত বছরের জমানো কান্না একবারে বের হয়ে আসছিল যেন।
এরপর ধর্মীয় এবং রাস্ট্রীয় দুইভাবেই আমিরাহ্ র তালাক এবং বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। বিয়েতে সাদমানের মা-বাবা উপস্থিত ছিলেন। তারাও তাদের ছেলের মতোই অমায়িক মানুষ। বিয়ে সম্পন্ন হতেই আব্বাস নবদম্পতির হাতে বিয়ের উপহার হিসেবে একটা খাম তুলে দেন। সেখানে আমেরিকার যাবতীয় সম্পদের মালিক করা হয়েছিল আমিরাহ্ এবং সাদমানকে। তাদের প্রবল আপত্তি তিনি কানে তোলেননি। পরদিনই তিনি সৌদী আরবের পথে যাত্রা করেন।
এরপরের পাঁচ বছর আমিরাহ্ র কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়। সাদমানের মা-বাবা কিছুদিন পরেই দেশে ফিরে গিয়েছেন। আর ওরাও হানিমুন বাদ দিয়ে ব্যাবসায় ডুবে গিয়েছিল। আব্বাস আল আবাদির আমানত যে কোনো মূল্যে রক্ষা করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। ওদের দুজনের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ব্যাবসা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। ওরা আব্বাসের নামের একটা ট্রাস্ট গঠন করেছে। সেখানে ব্যাবসার লাভের একাংশ প্রতিমাসে জমা করে দেয়। এই ট্রাস্টের বর্তমানে তিনটা শাখা– আমেরিকায়, সৌদীতে আর বাংলাদেশে।
এরমাঝে একবার ওরা বাংলাদেশে এবং একবার সৌদীতে ঘুরে এসেছে। মক্কা-মদিনা ঘুরে আসলেও নিজের বাবার বাড়িতে আমিরাহ্ যায়নি। আমিরাহ্ র মায়ের মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে ওর ভাই সরাসরি ওকে ঐ বাড়ি যেতে নিষেধ করেছিল। তারপর আর সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই তো ওঠে না। তবে আমিরাহ্ র খুব হাসি পায়, ওর পরিবার ওর পরিচয় দিতে না চাইলেও প্রতি মাসে ওর পাঠানো সাহায্য ঠিকই গ্রহণ করে। আমিরাহ্ সালমাকে জোর কন্ঠে জানিয়েছে সাফার পড়াশোনার দিকে যেন কঠোর খেয়াল রাখা হয়। আমিরাহ্ র ইচ্ছা সাফা বড়ো হলে ওকেও এখানে নিয়ে আসবে।
আর কারও সাথে সুসম্পর্ক না থাকলেও আব্বাসের সাথে ওরা দুজনেই নিয়ম করে যোগাযোগ রাখে। এই মানুষটা যেন এক স্বপ্ন পূরণের জাদুকর হয়ে এসেছিল তাদের জীবনে। তাকে ভুলে যাওয়ার কথা ওরা ভাবতেও পারে না। আব্বাসের কাছেই আমিরাহ্ জেনেছে যে বড়ো বেগম, আয়শা আমিরাহ্ র কথা খুব মনে করে। মনে করেন মেজ বেগমও, যিনি আবার তার সাবেক ছোটো বেগম পদবিতে ফিরে গেছেন। আব্বাস নিজের মতো করে সবাইকে বুঝিয়েছেন। তাই আমিরাহ্কে কেউ ভুল বোঝেনি। আমিরাহ্ আর সাদমান যখন সৌদী গিয়েছিল তখন সবাই খুব করে বলেছিল যেন আবাদিদের পরিবারে কয়েকদিন বেড়িয়ে আসে। কিন্তু আমিরাহ্ ই সংকোচের কারণে যায়নি।
আমিরাহ্ আরও জেনেছে আহমাদ ভালো আছে। সে দুই সন্তানের বাবা হয়েছে। সেও তার নিজের বাবা আব্বাসের মতো তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী। আব্বাস তার সন্তানদের সব বিষয়-সম্পত্তি বুঝিয়ে দিয়েছেন। সবাই তাদের বাবার ব্যাবসা ধরে রাখলেও আহমাদ তার নিজ গুণে সেই সম্পদকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
সাদমানকে আমিরাহ্ সবই বলেছে। আহমাদের প্রতি তার ভালোলাগার কথাও জানিয়েছে। বিনিময়ে সাদমানও বলেছে তারও এক ভালোবাসার মানুষ আছে যাকে সে এখনও স্বপ্নে দেখে। আমিরাহ্ যখন মন খারাপ করেছে তখন হাসতে হাসতে জানিয়েছে যে সেই মানবী আর কেউ না সে এক বলিউডের নায়িকা, নাম ক্যাটরিনা কাইফ। তারপর দুজনে একসাথে বসে একে একে ক্যাটরিনার সব মুভি দেখেছে।
এভাবেই সুখে-দুঃখে পাঁচ বছর কেঁটে গেছে। এখন ব্যাবসার অবস্থা বেশ গোছানো হয়েছে বলে এবারই প্রথমবার ওরা সত্যিকারের হানিমুনে এসেছে। সাদমান আমিরাহ্ র সামনে হাঁটু ভেঙে বসে ওর ডান হাতে বেশ দামি একটা ব্রেসলেট পরিয়ে দিল। এবার সটান সামনে দাঁড়িয়ে নিজের উপহার দাবি করল। আমিরাহ্ শুধু মুচকি হেসে ওর হাতটা নিজের পেটের উপর রেখে বলল,
– সে আসছে।
এরপরের ঘটনা সব গল্প-উপন্যাসের মতোই। প্রথমে সাদমান আনন্দে আত্মহারা হলো। তারপর বলল ,
— অবশেষে আমার সামিরাহ্ আসছে।
আমিরাহ্ ভ্রূকুটি করল,
– সামিরাহ্ কেন? সালমান কেন নয়?
এরপর দুজনের কিছুক্ষণ মিষ্টি ঝগড়া চলল। আর এভাবেই এগিয়ে চলল আমিরাহ্ র সুখের গল্প।
( সমাপ্ত )
বি:দ্র: আমিরাহ্ এর যাত্রা এখানেই শেষ হলো। সবাইকে সাথে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।