#আমিরাহ্
২১,
একমনে ডেক্সটপে কাজ করছে আমিরাহ্। গত এক বছরে সে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে পরিমাণ দক্ষতা অর্জন করেছে তা একদিকে আব্বাস এবং সাদমানকে যেমন মুগ্ধ করেছে, তেমনি তাদের ওয়ার্কিং ফার্মের অন্যান্য কর্মীদের করেছে ঈর্ষান্বিত।
আমেরিকার প্রথম সকালটা এখনও আমিরাহ্ র কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়। সেদিন ঘুম ভেঙে প্রথমে কিছুক্ষণ সে বুঝতেই পারছিল না যে কোথায় আছে। আধুনিক ও দামি সজ্জায় সজ্জিত কটেজের নরম বিছানায় সে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে পড়ে ছিল। আগের রাতে অনেকটা ঘুমের ঘোরেই এই রুমে এসে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। পরনের পোশাক পাল্টানো বা রাতের খাবার খাওয়া কোনোটাই করতে পারেনি।
সকালে ঘুম ভাঙতেই প্রথমেই পেটে মোচড় দিল। ঘড়ি দেখেও সময় হিসেব করে বের করতে পারল না যে ঠিক কতক্ষণ সে ঘুমিয়েছে। জানালার পর্দা সরিয়ে রীতিমত চমকে গিয়েছিল। বাইরেটা তখন ধবধবে সাদা তুষারে মোড়ানো ছিল। এসব কী, কেন এমন সাদা সেসব ভাবতে না ভাবতেই আবার তুষারপাত শুরু হয়েছিল। সৌদীতে মাঝে মাঝে এক আধ পশলা বৃষ্টি হয়। তাই বৃষ্টি তার চেনা। কিন্তু তুষারের এই রুপ প্রথমবার দেখে সে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়েই রইল।
দরজায় টুকটুক নক করার শব্দে অবশেষে তার ধ্যান ভাঙল। দরজা খুলতেও ভয় ভয় করছিল, নতুন জায়গা বলে কথা। একটুখানি খুলে আব্বাসের হাসিমুখ দেখে যেন বুক থেকে পাথর নেমে গিয়েছিল। এরপরে কটেজের অন্তর্ভুক্ত সুইমিং পুলের পাশে সকালের নাস্তা খেতে খেতেই সাদমান হাজির হয়েছিল। টুকটাক সৌজন্যমূলক কথাবার্তা শেষে আব্বাস আমিরাহ্ এবং সাদমানকে তাদের করণীয় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সাদমানকে বলেছিলেন আমিরাহ্কে যেন যথাসম্ভব ট্রেনিঙ দিয়ে ব্যাবসা সংক্রান্ত কাজের উপযুক্ত করে গড়ে তোলে, যতটা সম্ভব।
সেদিনের পর থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল আমিরাহ্ র নতুন জীবন। প্রথমেই ইংরেজী ভাষা শিক্ষার কোর্সে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। এরপর একে একে কম্পিউটার কোর্স, ড্রাইভিঙসহ আরও কিছু বিষয়ের শর্টকোর্স করে নিয়েছে। সেই সাথে চলছিল বাসায় সাদমান এবং আব্বাসের সহায়তায় ব্যাবসা সংক্রান্ত বেসিক ট্রেনিং। সবাইকে অবাক করে আমিরাহ্ খুব দ্রুতই সব শিখে নিচ্ছিল। ইদানিং ব্যাবসায়িক মিটিঙেও সে উপস্থিত থাকে। সবকিছু না বুঝলেও কিছু কিছু বিষয়ে আমিরাহ্ র সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ায় ওদের ব্যাবসা বেশ লাভের মুখ দেখেছে।
আব্বাস খুশি হয়ে আমিরাহ্ র নামে একটি বিশাল এপার্টমেন্ট কিনে দিয়েছেন। গাড়ি তো আগেই ছিল। এভাবেই প্রচন্ড ব্যস্ততায় একটা বছর যে কোথা থেকে চলে গেছে সে টেরই পায়নি। ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকেই সেন্ট্রাল পার্ক, স্ট্যাচু অব লিবার্টি, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, টাইমস স্কয়ারসহ মোটামুটি দর্শণীয় সব স্থান দেখেছে। অবশ্য সাদমান আছে বলেই ঘোরাফেরাটা সম্ভব হয়েছে। আব্বাস ভীষণ ব্যস্ত থাকেন। আর অবসরে ক্লান্তির অযুহাতে নিজ কক্ষেই বেশিরভাগ সময় কাটান। এই এক বছরে তিনি দেশে যাননি ঠিকই তবে এখানে বসেই ওখানকার সব কাজ তদারকি করে চলেছেন। তিনিই সাদমানকে বলেছেন যেন সময় করে আমিরাহ্কে বেড়াতে নিয়ে যায়।
আমিরাহ্ আর আব্বাস এখনও আলাদা রুমেই থাকছে। আমিরাহ্ মাঝে মাঝে তার বৈবাহিক জীবন সম্পর্কে ভাবে। সকল কাজের পরে রাতটুকু আমিরাহ্ ভীষণ অস্বস্তিতে কাটায়। ইদানিং তার স্বামীর ভালোবাসা, সন্তানের আদরের জন্য খুব লোভ হয়। আবার আব্বাসকে স্বামীর আসনে বসাতেও ঠিক স্বস্তি পায় না। তারচেয়ে তাকে পরম পূজনীয় কেউ ভাবতেই ভালো লাগে। তারপরেও আব্বাস যদি নিজের চারপাশে দেয়াল তুলে না রাখতেন তাহলে আমিরাহ্ হয়তো সংকোচ কাটিয়ে নিতে পারত।
– হেই আমিরাহ্, চলো কফি খেয়ে আসি।
সাদমানের ডাকে আমিরাহ্ বাস্তবে ফিরে আসল। কাজ থামিয়ে কখন যে সে জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে এসব ঊনিশ-বিশ ভাবছিল তা নিজেও খেয়াল করেনি। সাদমান যে কখন এসেছে তাও দেখেনি।
– উমম, এখন না। একটা জরুরি কাজ করছি।
– হুম দেখেছি তোমার কাজ করার নমুনা। রুমে আসা অব্দি দেখছি জানালা দিয়ে তাকিয়ে কী সব আকাশ-পাতাল ভাবছ। চলো ক্যান্টিনে গিয়ে তোমার প্রিয় পিঙ্ক ডোনাট আর কফি খাবে। জানো তো কাজের ফাঁকে ফাঁকে ব্রেক নেওয়া দরকার। চল চল।
অতঃপর সাদমানের পিছনে পিছনে আমিরাহ্ ক্যান্টিনের দিকে এগোল। সাদমান কেমন যেন নাছোড়বান্দা স্বভাবের। তাকে আমিরাহ্ কখনও ফেরাতে পারে না। এই কয়দিনে ওদের দুজনের সম্পর্ক মালকিন-কর্মচারি ছাড়িয়ে বন্ধুত্বে গড়িয়েছে।
এটা অবশ্য সাদমান আর আমিরাহ্ র ধারণা। কিন্তু আব্বাস-আল-আবাদির বিচক্ষণ চোখ ঠিকই ধরে ফেলেছে ওদের মনের কথা। তিনি তার কেবিনের কাচের ভিতর থেকে দুজনকে গল্প করতে করতে এগিয়ে যেতে দেখলেন। শুরু থেকেই সাদমান যে আমিরাহ্ কে পছন্দ করে ফেলেছে তা তিনি বুঝেছিলেন। তিনি আমিরাহ্কে আমেরিকায় নিয়ে এসেছিলেন যেন আমিরাহ্ স্বাবলম্বী হতে পারে। তিনি চেয়েছিলেন আস্তে আস্তে আমিরাহ্কে প্রস্তুত করে এখানকার ব্যাবসা তাকে বুঝিয়ে দেবেন। কিন্তু আমিরাহ্ র প্রতি সাদমানের অনুরাগ দেখে অন্য আরেকটি সম্ভাবনা তার মাথায় আসে। আমিরাহ্ আর সাদমান যদি এক হয়ে যায় তাহলে দেশের সবাই অখুশি হলেও তিনি নিজে খুব খুশি হবেন।
একজন প্রাপ্তাবয়ষ্কা নারী হিসেবে আমিরাহ্ অবশ্যই শুধুমাত্র শিক্ষা, স্বাধীনতা, সম্পত্তিতে সন্তুষ্ট থাকবে না। সে নিশ্চয়ই এক সময় না এক সময় সেই সবকিছু আকাঙ্ক্ষা করবে যা প্রতিটি মেয়েই তার জীবনে চায়। কিন্তু আহমাদের সাথে আমিরাহ্ র মন দেওয়া-নেওয়ার খবর শুনে তিনি আর এই সম্পর্কটাতে সহজ হতে পারেননি, হয়তো কখনও পারবেন ও না। তারচেয়ে আমিরাহ্ যদি অন্য কোথাও সুখী হয় তাহলে তার নিজের অন্ততঃ স্বস্তি হবে।
তাই তিনি সবসময়ই চেয়েছেন ওদের মধ্যে নিজ থেকেই আগ্রহ জন্মাক। আমিরাহ্ না চাইলে তিনি কখনোই তাকে এ ব্যপারে জোর করতে চাননি। বিয়ের মতো জরুরি একটা বিষয়ের সিদ্ধান্তে অবশ্যই পাত্র-পাত্রী দু’জনের সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে। শুরু থেকেই সাদমানের ব্যাকুলতা তিনি লক্ষ্য করেছেন। তবে আমিরাহ্ ভীষণ ব্যক্তিত্ববান মেয়ে। সে সবসময়ই একটা সীমা রেখেই চলেছে। তবুও আজকাল সাদমানকে দেখলেই আমিরাহ্ র চোখে-মুখে যে একটা খুশির আভাস দেখা যায় তা আব্বাসের দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি আশা করছেন খুব শীঘ্রই হয়তো আমিরাহ্ বুঝবে যে সেও সাদমানকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। আব্বাস ঠিক সেই সময়ের অপেক্ষা ই করছেন।
চলবে …