আমিরাহ্ পর্ব-১৯+২০

0
787

#আমিরাহ্

১৯,

বিমানটা আকাশে ডানা মেলতেই আমিরাহ্ র চোখ আর বাঁধা মানল না। সে হু হু করে কেঁদে উঠল। প্লেনের জানালা দিয়ে নিচে আলো ঝলমলে জন্মভূমিকে ধীরে ধীরে দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতে দেখল। জন্মভূমির প্রতি যে আলাদা এক টান থাকে, এক অন্যরকম ভালোবাসা থাকে আমিরাহ্ তা এখন বুঝতে পারছে।

গত দুইমাস তার দিনকাল বেশ ব্যস্ততায় কেটেছে। প্রথমে আয়শার নিকাহ্, তারপর আহমাদের। এর ফাঁকেই পাসপোর্টসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করতে হয়েছে। এরপর তো গোছগাছ, সবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়া এসব করতে করতেই কেটে গেছে। আমিরাহ্ ভাবল একদিকে ভালোই হয়েছে। এতটা ব্যস্ততা না থাকলে হয়তো আহমাদের নিকাহ্ এর সময় আরও বেশি কষ্ট হতো।

বিদায় বেলায় পরিবারের সবাই উপস্থিত ছিল। এমনকি মেজ বেগমও গলা জড়িয়ে বেশ কান্নাকাটি করেছিলেন। আহমাদ আর তার বেগমও উপস্থিত ছিল। আমিরাহ্ র চোখ এক নজর নতুন বেগমের আঙুলে জ্বলজ্বল করতে থাকা আঙটিটায় ঘুরে এসেছিল। আহমাদের বেগমের মুখ দেখে আমিরাহ্ সেই হীরাচূর্ণ খচিত পান্নার আঙটিটা তার আঙুলে পরিয়ে দিয়ে বলেছিল,

– এই আঙটিটার জন্মই হয়েছিল তোমার আঙুলের শোভা বাড়ানোর জন্য। কেন যেন প্রথমদিন আঙটিটা দেখেই আমার মনে হয়েছিল এই আঙটির মালকিন হবে আহমাদের বেগম। মাঝখান থেকে শুধু শুধুই কয়েকটা হাত ঘুরেছে।

আহমাদ বিষাদমাখা নয়নে আমিরাহ্কে দেখছিল শুধু। আমিরাহ্ মুচকি হেসে সেখান থেকে চলে এসেছিল। এতদিনে যেন তার দায় মুক্তি ঘটল।

আমিরাহ্ গতকাল তার নিজের পরিবারের কাছে বিদায় নিতে ওদের বাড়িতে গিয়েছিল। বাবা তার হাত ধরে অনেকে কেঁদেছিলেন। আমিরাহ্ তাকে আশ্বস্ত করেছে যে তার এখন আর কোনো অভিযোগ নেই। তবে অনুরোধ করেছে তার সাথে যা ঘটেছে এমনটা যেন সাফার সাথে ভুলেও না ঘটে।

যে সাফা একসময় আমিরাহ্কে ছাড়া কিছুই বুঝতে চাইত না, সে আমিরাহ্ র কাছ থেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। তার না কী লজ্জা লাগছিল। আমিরাহ্ কিছু বলেনি, শুধু দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে। তার জীবনে আপন বলতে আসলেই কেউ নেই। তাই সে মন শক্ত করে রইল। মা, বাবা, সালমা কারো কান্নাতেই তার চোখে একফোঁটা পানি আসেনি।

আল আবাদী বাসভবন থেকে বের হওয়ার সময় আমিরাহ্ র বেশ খারাপ লাগছিল। তার জন্য নির্মিত ভবনটির কাজ প্রায় শেষ। কিন্তু তাতে আমিরাহ্ এর পদধূলি আর পড়ল না। আমিরাহ্ খুব করে চাইত তার একটা নিজের বাড়ি হবে, সাজানো সংসার হবে। তাই হয়তো তার ভাগ্যে কোনো বাড়িই জুটল না। কম্পাউন্ড ছেড়ে গাড়িটা যখন বের হয়ে যাচ্ছিল তখন আমিরাহ্ র বেশ বুক ভার লাগছিল। তবুও কান্না আসেনি।

সেইসব পাথর হয়ে যাওয়া কান্নাগুলোই যেন এখন বাঁধভাঙা প্লাবন হয়ে বয়ে চলেছে। নিজের দেশ, পরিবার, পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে সে এগিয়ে চলেছে কোন এক অজানা দেশের পথে। আর কী কখনও ফেরা হবে এই ধূলোমাখা পথে? বিদায়ী সূর্যের রঙে রঞ্জিত মরুর আকাশ কী কখনও দেখা হবে? আমিরাহ্ র খুব মনে পড়ছে শৈশবে বাবার কাঁধে চড়ে ছাগল চড়াতে মরুভূমিতে যেত। সারা শরীরে ধূলো মেখে ভূত সেজে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরত। বুকভরা ছিল আনন্দ। ছিল না কোনো কষ্ট, অভিমান, না পাওয়ার হাহাকার। আর ফিরে আসবে না সেইসব আনন্দময় দিন, আর হয়তো কখনোই ধুলো দিয়ে শরীর মেখে যাবে না।

বেশ কিছুক্ষণ পরে খানিকটা ধাতস্থ হয়ে আমিরাহ্ রাতের আকাশ দেখতে লাগল। যা পিছনে ফেলে এসেছে তা তো ফিরে পাওয়ার কোনো উপায় নেই। সামনে যা আসতে যাচ্ছে তাকে গ্রহণ করতে নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করে নিল। জীবনে যাই ঘটুক চলতে তো হয় ই, চলতে হবেই। থেমে যাওয়া মানেই হেরে যাওয়া। আমিরাহ্ হেরে যেতে চায় না। আমিরাহ্ কখনও হার মানবে না।

চলবে…

#আমিরাহ্

২০,

পুরো ১৫ ঘন্টা শেষে আমিরাহ্ যখন নিউ ইয়র্ক এয়ারপোর্টে পা রাখল তখন সে খুশি হওয়ার সুযোগ পেল না। ক্লান্তিতে তার শরীর ভেঙে আসতে লাগল। এর আগে এত লম্বা জার্ণি তার কখনও করা হয়নি। এমনিতে সাড়ে তেরো ঘন্টার ফ্লাইট থাকলেও ফ্লাইট ডিলে হওয়ার কারণে আরও ঘন্টাখানেক লেগে গেল। সব ফর্মালিটি ও লাগেজ ক্লেইম শেষে বের হতে আরও ঘন্টাখানেক পার হয়ে গেল।

এক্সিট পেরোতেই আমিরাহ্ দেখল স্যুটেড-বুটেড এক সুদর্শন এশিয়ান যুবক। সবার আগে তাকেই চোখে পড়ল কারণ সে ওয়েটিঙ লাউঞ্জের একদম সামনের সারিতেই দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে একগুচ্ছ গোলাপি টিউলিপ । আমিরাহ্ আর আব্বাসকে দেখেই তার মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত হলো। কাছে যেতেই আব্বাসের সাথে করমর্দন এবং কোলাকুলি করল। আমিরাহ্ বুঝতে পারল এই যুবক আব্বাসের খুব কাছের মানুষ। এবার যুবক আমিরাহ্ দিকে ফুলের তোড়াটা এগিয়ে দিল।

– ওয়েলকাম টু নিউ ইয়র্ক, ম্যাম।

আমিরাহ্ ইংরেজি ভালো বলতে না পারলেও টুকটাক বুঝতে পারে। সে আব্বাসের দিকে তাকাল।

– এ হচ্ছে সাদমান। আমার এখানকার সবকিছু ওর হাতেই টিকে আছে। সবদিকে তার নজর থাকে। দেখছ না তোমাকে অভ্যর্থনা জানাতে ফুল নিয়ে আসতেও ভোলেনি।

আমিরাহ্ বুঝল আব্বাস চাইছেন সে যেন ফুলটা গ্রহণ করে। তাই সে মুচকি হেসে হাত বাড়াল।

– ত্যাঙ্কু।
উচ্চারণগত জটিলতার কারণে আমিরাহ্ র ইংরেজি হাস্যকর শোনালেও যুবকের চোখে-মুখে কোনো উপহাস দেখতে না পেয়ে সে স্বস্তি বোধ করল।

গাড়িতে যেতে যেতে জানতে আমিরাহ্ জানতে পারল সাদমানের মা-বাবা দু’জনেই বাংলাদেশ থেকে অনেক বছর আগে আমিরিকায় পড়াশোনা করতে এসেছিলেন। আমিরাহ্ এর আগে সৌদীতেও বেশ কিছু বাঙালি দেখেছে। তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে তার অল্প বিস্তর ধারণা আছে। তবে সাদমান জন্মসূত্রে আমেরিকান। তার মা-বাবা পড়াশোনা শেষে এখানেই কাজে যোগদান করেছিলেন। এখন অবশ্য দুজনেই বাংলাদেশে ফিরে গেছেন। মাঝেমাঝে ছেলের কাছে বেড়াতে আসেন।

সাদমান এখানে একাই থাকে। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে টপ রেজাল্ট করার পরে প্রাথমিক টাইম পাস করার উদ্দেশ্যে আব্বাসের ফার্মে সিভি জমা দিয়েছিল। এখানে কাজ করে তার এত ভালো লেগে যায় যে আর অন্য চাকরির চেষ্টা করেনি। আমিরাহ্ বুঝল আব্বাসও তাকে নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করেন।

এসবকিছু শুনতে শুনতে আমিরাহ্ ঘুমে ঢুলছিল। সাদমান সেটা খেয়াল করল।

– ম্যাম সম্ভবত খুব ক্লান্ত। স্যার আপনার কথামতো আমাদের রিসোর্টের সেরা দুটো কটেজ রেডি করে রেখেছি। ম্যামের জন্য গোল্ডেন পেটাল আর আপনার জন্য সিলভার পেটাল কটেজ দুটো রেডি আছে। আপনাদের খাবার কী কটেজেই পাঠিয়ে দেব?

– আমিরাহ্ র টা ওর কটেজে পাঠিয়ে দিও। আমি আর তুমি একসাথেই আমার কটেজে খাব কেমন?

– জ্বি স্যার।

ড্রাইভারের পাশের সিটে বসা সাদমানের চোখ রিয়ারভিউ মিররে আটকে গেল। সেখানে অনিন্দ্য সুন্দর আমিরাহ্ র ঘুমন্ত মুখটা দেখা যাচ্ছে। প্লেনেই আব্বাস বলেছিলেন আমিরাহ্ র এখানে নেকাব না করলেও চলবে। হিজাব করাটাও ওর সিদ্ধান্তেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমিরাহ্ শুরুতে নেকাব করে থাকলেও এত দীর্ঘ যাত্রায় ক্লান্ত হয়েই তা খুলে রাখতে বাধ্য হয়েছিল। নিউ ইয়র্কে নেমে আর তেমন সংকোচ বোধ করেনি যেমনটা সৌদীতে নেকাব ছাড়া থাকলে অনুভব করত। আসলে যেখানকার যেমন পরিবেশ। তবে আমিরাহ্ এতবছরের অভ্যাস আর ধর্মীয় অনুভূতির কারণে হিজাব খুলল না। নিকাব খুলতে পেরেই তার বেশ স্বস্তি লাগছিল। দীর্ঘ যাত্রার ধকলে তার কেমন যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল।

এই মূহুর্তে রিয়ারভিউ মিররে আমিরাহ্ র সদা ঢেকে রাখা মুখটা যেন সদ্য ফোটা কোনো ফুলের মতো স্নিগ্ধতা নিয়ে ফুটে রয়েছে। সাদমান বসের বউয়ের মুখের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে বলে নিজেকে ধিক্কার দিলেও চোখ সরিয়ে নিতে পারছে না। এ যেন রুপকথার সেই স্লিপিং বিউটি, কল্পলোক থেকে কোন্ এক জাদুবলে বাস্তবে চলে এসেছে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে