আমিরাহ্
১,
সময়টা ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ। বিকেলের সোনালি রোদে সৌদী আরবের তপ্ত বালুরাশি জ্বলজ্বল করছে। দেখে বলে হচ্ছে যেন সেখানে বালু নয়, সোনার গুঁড়ো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সারাদিনের প্রচন্ড দাপদাহের পরে এই শেষ বিকেলের উত্তাপ খানিকটা সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে। তাই এসময়েই বেশিরভাগ আরবীয় নারী-পুরুষ আড্ডায় মেতে ওঠে। আরবরা এমনিতেও আড্ডাপ্রিয় জাতী। এরা বালিতে ফরাশ ( পাতলা তোশক) বিছিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেয়। সোনালি রঙের রাজকীয় দর্শণ ফ্লাস্ক থেকে ক্ষুদে কাপে সোনারঙা গাওয়া ( ” র” কফি) ঢেলে নেয়। সাথে অবশ্য গোলাপি রঙা টক স্বাদের চা এবং পুদিনা পাতা দেওয়া রঙ চায়েরও আলাদা আলাদা ফ্লাস্ক থাকে। সেসবের জন্য আবার আলাদা ছোটো ছোটো কাপ থাকে। তাতেও থাকে সোনালি কারুকার্য। সোনা এবং সোনালি রঙের প্রতি আরবদের টান যেন একটু বেশিই। এত এত সোনার মাঝে থেকেই তাদের গায়ের রঙও যেন হয়ে ওঠে সোনারঙ।
এমনই এক সোনারঙা কিশোরী আমিরাহ্ বিনতে কুতুব। মাত্রই দশ শেষ করে এগারো বছর বয়সে পা দিল। শৈশবের খোলস ছেড়ে কৈশোরের যাত্রাও তার শুরু হয়েছে মাত্রই। দুরন্ত মেয়ে আমিরাহ্ এতদিন ছোটো-বড়ো পিঠেপিঠি ভাইদের সাথে মরুভূমিতে যেত দুম্বার পাল নিয়ে। মাঝে মাঝে বাবার হাত ধরে দূর-বহুদূরে উটদের চড়ানোর জন্য যে তাবু ফেলা হয় সেখানেও যেত। বাবার একমাত্র কন্যা হওয়াতে আমিরাহ্ এর এসব আবদার ওর বাবা কখনও ফেলতে পারেনি।
কিন্তু হঠাত করেই আজকাল তার চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এখন থেকে না কী সে আর পুরো শরীর বোরকা আর নেকাবে মুখ না ঢেকে বাড়ির বাইরে যেতে পারবে না, ভাই- বাবা ছাড়া আর কোনো পুরুষের সামনে বিনা পর্দায় যেতে পারবে না। তবে আমিরাহ্ এর জন্য সবচেয়ে কষ্টের কথা সে দুম্বার পাল চড়াতে ভাইদের সাথে মরুভূমিতে যেতে পারবে না। ওর বেলায় এত কেন নিষেধ? ওর ভাইদের বেলায় তো সেসব কিছু নেই।
আমিরাহ্দের পরিবারে পড়াশোনার বালাই নেই। ওর মা বাবা এমনকি বাবার বাকী তিনজন স্ত্রীদের কেউই লিখতে পড়তে জানে না। এমনকি কুরআন তিলাওয়াত পর্যন্ত করতে পারে না। আমিরাহ্ এর বড়ো দুই ভাই প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত গিয়েছিল। এখন বাবার সাথে পারিবারিক ব্যাবসা আর উট-দুম্বার পালের হিসেব নিয়েই ব্যস্ত থাকে। আমিরাহ্ এর খুব ইচ্ছা করত ভাইদের সাথে স্কুলে যেতে, কিন্তু পারেনি। তবে বাসায় বসেই ভাইদের কাছে পড়তে, লিখতে শিখেছে। ওর আগ্রহে একজন আলিমা রেখে তার কাছে কুরআন শিক্ষাও দেওয়া হয়েছে। তবুও এই জীবন আমিরাহ্ এর ভালো লাগে না।
সোনালি রোদ গায়ে মেখে সে জানালা দিয়ে অবারিত বিস্তৃত মরুভূমির দিকে তাকিয়ে আছে। রোদের আঁচে তার মধুরঙা চুল আর চোখগুলোর সোনালি মনে হচ্ছে, গালে গোলাপি আভা। এসময়ে আমিরাহ্কে যেই দেখবে সেই ভাববে যেন জান্নাতের হূর ভুল করে পৃথিবীতে নেমে এসেছে। কিন্তু তার সুন্দর চোখে-মুখে কী এক বিষণ্নতার ছোঁয়া।
বাড়ির উঠোনে ফরাশ পেতে বাবার চার বেগম গাওয়া আর পুদিনা চায়ের পাত্র নিয়ে আড্ডায় মেতেছে। সাথে খোপকরা ডালা ভরে বিভিন্ন বাদাম, সূর্যমুখীর বিচি, মিষ্টি কুমড়ার বিচি নিয়েছে। এক চুমুক চা খাচ্ছে, একটা বিচি দাঁতের ফাঁকে নিয়ে চিবুচ্ছে আর কলকল করে কথা বলে চলেছে। এদের দেখলে কে বলবে যে এরা সতীন? আগের রাতেই এরা তুমুল ঝগড়া করে সবাই সমানভাবে বাবার মাথার বেড়ির ( আরবরা মাথার রুমাল আটকানোর জন্য কালো রিঙের মাথার উপরে দিয়ে রাখে, যা খুললে অনেকটা আগের দিনের চাবুকের মতো দেখায়) মার খেয়েছে?
চলবে…
#আমিরাহ্
২,
সালমা একমুঠো সূর্যমুখীর বিচি হাতে নিয়ে আমিরাহ্ এর পাশে এসে বসল।
– তোমাকে সবাই বাইরে চা খেতে ডাকল, গেলে না যে?
আমিরাহ্ সালমার দিকে তাকাল। মেয়েটা তার বাবার চতুর্থ স্ত্রী। বছরখানেক হলো বিয়ে করে নিয়ে এসেছেন। বয়স বেশি না। এই পনেরো- ষোলো। ছোটোবেলা থেকেই আমিরাহ্ সালমাকে দেখেছে। ওর বড়ো ভাই হাসানের বয়সী। ওরা সবসময় একসাথে খেলত, মাঝে মাঝে ছোট্ট আমিরাহ্ ওদের সাথে যোগ দিত। পরে হাসান স্কুলে যেতে শুরু করলে আমিরাহ্ আর সালমা ই খেলত। অথচ গতবছর হুট করেই যখন আমিরাহ্ এর বাবা সালমাকে বিয়ে করে নিয়ে আসল, আমিরাহ্ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেনি। ওর খেলার সাথীকে কিনা এখন ওর উম্মী ( মা) বলে ডাকতে হবে!
প্রথমে বেশ কিছুদিন এই নিয়ে বাড়িতে বেশ অশান্তি হয়েছিল। আমিরাহ্ এর বাকী তিন উম্মী কম কান্নাকাটি করেনি। সবচেয়ে কম কেঁদেছে বড়ো উম্মী। তার হয়তো এসব গায়ে সয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি কেঁদেছে সেজো উম্মী। সে হয়তো ভেবেছিল তার মতো সুন্দরীকে পেয়ে বাবা আর বিয়ের চিন্তা করবে না। তবে আমিরাহ্ অবাক হয়ে দেখেছিল ওর নিজের মা, ওর বাবার দ্বিতীয় বেগম, সেজো উম্মীর দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছিল। হয়তো ভাবছিল, ” এখন বোঝ কেমন লাগে? তুমি যখন এসেছিলে তখন আমারও এমনই লেগেছিল”।
প্রথমদিকে আমিরাহ্ ও সালমাকে এড়িয়ে চলত। কেমন রাগ লাগত। তবে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে গেছে। আমিরাহ্ আর সালমার সম্পর্কটা বদলে গেলেও বন্ধুত্বটা এখনও টিকে আছে। তাছাড়া সালমা ভীষণ হাসিখুশি মেয়ে। ওর সাথে না মিশে থাকা যায় না। এই যে তার এতবড়ো পেটটা নিয়ে চলতে-ফিরতে কষ্ট হয়, তবুও সে ঠিকই আমিরাহ্কে খুঁজতে চলে এসেছে। এখন হাসি হাসি মুখ করে একমনে বাদাম চিবুচ্ছে।
– ছোটো উম্মী, তোমার কী রাগ-অভিমান বলতে কিছু নেই? কিভাবে কালরাতে বাবার বেড়ির বাড়ি খেয়েও এত হাসিখুশি থাকো?
আমিরাহ্ র প্রশ্ন শুনে সালমা একটু যেন থমকে গেল। তারপর মুচকি হেসে বলল,
– আমার রাগ-অভিমানে কী কারও কিছু যাবে আসবে? যে রাগে দেখিয়ে কোনো লাভ নেই, সেই রাগ ধরে রাখব কেন? আর তাছাড়া কাল তোমার বাবা তো আমাকে ইচ্ছা করে মারেনি। বড়ো আর সেজো এত ঝগড়া করছিল যে না মারলে কী তারা থামত। মাঝখান থেকে তোমার উম্মী আর আমি শুধু শুধু মার খেয়েছি। এরকম তো তোমার বাবা সবসময়ই করে। শাসন করলে সবাইকে সমানভাবে করে, সোহাগটাও তো সমানভাবেই করে। দেখ না, কাল শুধু শুধু আমাকে মেরেছে বলে রাতে এই চুড়ি জোড়া এনে নিজে আমাকে পরিয়ে দিয়েছে।
সালমাকে খুব সুখি লাগছে। যেন গয়নাতেই সব সুখ। সালমার সব কথা আমিরাহ্ বোঝে না। তার বাবা সমান সোহাগ করল কোথায়? সালমাকে বিয়ের পরে বাবা তাকেই তো বেশি সময় দেয়, এটা সেটা কিনে দেয়। এই যে এখন সালমার দুইহাতে নতুন সোনার চুড়ি চকচক করছে। কোথায় ওর নিজের মাও কাল শুধু শুধু মার খেল, তার গায়ে তো কোনো নতুন গয়না শোভা পাচ্ছে না। আজকাল আমিরাহ্ মাঝে মাঝে ভাবে, ওর স্বামীরও কী এরকম অনেকগুলো বেগম থাকবে? মূহুর্তেই তার মন খারাপ হয়। আমিরাহ্ চায় ওর জীবনে এমন একজন আসুক যার জীবনে শুধু সেই একমাত্র রানী হয়ে থাকবে। ওর স্বামী শুধু ওকেই ভালোবাসবে। কিন্তু পরক্ষণেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, বাস্তবে এরকম হয়তো হবে না।
চলবে …