#আমিরাহ্
৩,
আমিরাহ্দের বাড়িতে আজ আনন্দের বাজার বসেছে যেন। আজ সন্ধ্যায় সালমা একটি সুস্থ-সবল কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে। আরব দেশে একটা সময়ে কন্যাশিশু জন্ম নিলে তাকে মাটি চাপা দেওয়া হতো। কিন্তু এখনকার দৃশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন পুত্র-কন্যা উভয় শিশুর জন্মেই সবাই সমান খুশি হয়। কারণ এখনকার কন্যারা পিতামাতার জন্য বোঝা নয়, বরং সৌভাগ্য বয়ে আনে।
আমিরাহ্ ও ভীষণ খুশি। এতদিন তার কোনো বোন ছিল না বলে একটু আফসোস ছিল। আজ সেই দুঃখ দূর হওয়ার খুশিতে সে ঝলমল করছে। আরও খুশির কারণ হচ্ছে সালমাকে তার ছোটো বাচ্চাসহ বাড়ির বড়ো রুমেই থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই রুমে বাড়ির সব বাচ্চারা আর নারীরা একসাথে ঘুমায়–শুধু যে বেগম যেদিন বাবার ঘরে থাকেন সে বাদে। সালমা এখন থেকে বেশ কিছুদিন এই ঘরে থাকবে জেনে আমিরাহ্ খুবই খুশি।
আমিরাহ্ একটু সময় পরপর সালমার পাশে শোয়ানো গোলাপি শিশুটিকে দেখছে। বাচ্চাটা কী সুন্দর চোখ পিটপিট করে তাকায়, হাই তোলে। দেখামাত্রই আমিরাহ্ তাকে ভালোবেসে ফেলেছে।
–সালমা, খাবারটুকু এখনও খাওনি? প্লেটের খাবারটা জলদি শেষ করে ফেল। এগুলো তোমার জন্য খুব পুষ্টিকর। খেয়ে ফেল। শক্তি পাবে।
– মেজ উখতি( বোন), আমি এগুলো খাব না। মুখে দিলেই বমি চলে আসছে। না আছে লবন, না কিছু।
সালমার কথায় আমিরাহ্ সালমার সামনে রাখা প্লেটের থলথলে খাবারটার দিকে দেখল। আজ বাসায় অনেক মেহমান এসেছে। আগে থেকেই এলাকার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি আব্বাস আল আবাদি এবং তার পরিবারকে আমিরাহ্ এর বাবা দাওয়াত করেছিল। মূল উদ্দেশ্য ধনী ব্যক্তির সান্নিধ্যে থেকে ব্যাবসায়িক উন্নতি। এরমাঝেই হঠাৎ সালমাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। এখন মহিলা এবং পুরুষরা আলাদা আলাদা বৈঠকখানায় বসে আড্ডা দিচ্ছে, পুদিনা চা- গাওয়া খাচ্ছে। পুরুষদের বৈঠকখানা থেকে অবশ্য হুক্কার গুড়গুড় শব্দও ভেসে আসছে।
বড়ো রান্না বাবুর্চিরাই সামলাচ্ছে। তবুও বড়ো আর মেজ উম্মী নাস্তা পরিবেশনে ব্যস্ত, সেজ উম্মী মেহমানদের সময় দিচ্ছেন। এর মাঝেই আমিরাহ্ এর মা বারবার এসে সালমাকে এটা সেটা খেতে বলছেন, খাবার দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সালমা কিছুই খাচ্ছে না। আমিরাহ্ এর মা সালমাকে জলদি খাওয়ার নির্দেশ দিয়ে কাজে চলে গেছেন।
– তুমি খাচ্ছ না কেন ছোটো উম্মী?
– তুমি একটু মুখে দিয়ে দেখ। এগুলো খাওয়া যায়? এগুলো না কি আবার পুষ্টিকর খাবার।
সালমার কথায় আমিরাহ্ প্লেট থেকে এক চামচ থকথকে খাবার মুখে দিয়ে মুখ বাকিয়ে ফেলল। গমের গুঁড়োকে পানি দিয়ে জ্বাল দিয়ে আধা ঘন করে প্লেটে ঢালা হয়েছে। এর উপরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে খাঁটি ঘি এবং পুদিনার গুঁড়া। জিনিসটা দেখতে খুব সুন্দর হলেও খেতে বাজে। এতে কোনো লবন বা চিনি কিছুই মেশানো হয় নাই।
– আচ্ছা বাদ দাও। আমি তোমার জন্য দেখি অন্য কোনো খাবার নিয়ে আসছি।
মেহমান উপলক্ষ্যে বাড়ির পেছনের আঙিনায় মাটিতে বড়ো গর্ত করে অগ্নীকুন্ড জ্বালানো হয়েছে। তাতে আস্ত খাসী ঝলসানো হচ্ছে। খাসীর নিচেই আগুনের গর্তের ঠিক উপরে বড়ো ডেকচিতে মশলা, টমেটো পিউরি মেশানো পানি বসানো হয়েছে – শোরবা ( স্যুপের মতো সুস্বাদু স্টক) রান্না করার জন্য। উপর থেকে খাসীর গা বেয়ে চর্বি ঝোলের উপরে পড়বে। শোরবা তৈরি হলে কিছুটা আলাদা করে তুলে রাখা হবে খাবারের সাথে খাওয়ার জন্য। বাকী শোরবাতে পরিমাণমতো বাসমতি চাল দেওয়া হবে আর তাতেই রান্না হবে সুগন্ধী ও সুস্বাদু মেনদিল ভাত। খাওয়ার সময় বড়ো থালায় ভাত দিয়ে তার উপর ঝলসানো খাসীর বিশাল টুকরো দিয়ে পরিবেশন করা হবে।
অগ্নিকুন্ডের চারপাশে বাড়ির অল্পবয়সী ছেলেরা গল্প করে, হাতে তালি বাজিয়ে গান গায়। আমিরাহ্ খাসী ঝলসানোর ঘ্রাণ খুব পছন্দ করে। আগে সেও ভাইদের সাথে আগুনের পাশে বসে উপভোগ করত। কিন্তু এখন তার ওখানে যাওয়া নিষেধ। আমিরাহ্ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল পিছনে মেহমানদের গাড়ি পার্ক করা আছে। গাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে কোনো এক ভাইকে ডেকে বলবে সালমার জন্য এক বাটি শোরবা দিতে। সেই সুযোগে পিছনটা দেখেও আসা যাবে।
বাইরে রাত নেমে গেলেও আগুনের সোনালি লাল আলোতে সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তার উপরে আজ আকাশে পূর্ণ চাঁদ বসে বসে রুপালি আলোতে মরুর বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে। যেন সোনালি আর রুপালি আলো প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এমন আলোর মিশেলে আমিরাহ্ এর জীবনে ঘটে গেল এক রঙিন ঘটনা। গাড়ির আড়াল থেকে বের হতে যেতেই জোর ধাক্কা লেগে আমিরাহ্ মাটিতে পড়ে গেল। উপরে তাকিয়ে সে দেখল এক সদ্য কৈশোর পেরোনো সুদর্শন তরুন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমিরাহ্ র মনে হলো এত সুন্দর পুরুষ সে আর দেখেনি, যেন কল্পনার জগত থেকে উঠে এসেছে কোনো রাজকুমার।
ছেলেটাও তাকে মুগ্ধচোখে দেখছে। হঠাৎই আমিরাহ্ র মনে পড়ল সে বিনা হিজাব, নিকাবেই এখানে চলে এসেছে। ভেবেছিল লুকিয়ে থাকলে বাইরের কারো চোখে পড়বে না। কিন্তু এখন আচমকা ধাক্কা লেগে মাথার ওরনাটাও পড়ে গেছে। সোনালি চুলগুলো মরু হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে উড়ছে। তড়িঘড়ি করে উঠতে গিয়ে সে আবার পড়ে গেল। পায়ে চোট পেয়েছে সম্ভবত। ছেলেটা ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আমিরাহ্ হাত না ধরেই এবার পাশে থাকা গাড়িটা ধরেই দাঁড়াল। ছেলেটা এবার কথা বলতে শুরু করল, তার কন্ঠস্বর যেন আরও মোহনীয়।
– আমি আহমাদ বিন আব্বাস আল আবাদি। আব্বাস আল আবাদি এর ছোটো ছেলে আমি। সম্ভবত আজ আপনাদের বাড়িতেই আমি মেহমান হয়ে এসেছি। আমার কারণে আপনি ব্যথা পেয়েছেন। আপনি কী হেঁটে বাড়ির ভিতরে যেতে পারবেন না কী আমি সাহায্য করব?
– আমি কেন আপনার সাহায্য নিতে যাব? পর পুরুষের সাহায্য আমি নেই না। আমি একাই যেতে পারব।
আমিরাহ্ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে যাচ্ছিল। আহমাদ পিছন থেকে তাকে ডাকল,
– শুনুন। আমি তো আমার নাম বলেছি। আপনি যে আপনার নামটা না বলেই চলে যাচ্ছেন। বাড়িতে আসা মেহমানের সাথে এটুকু সৌজন্য তো দেখাতে হয় না কী।
আমিরাহ্ এবার একটু লজ্জা পেল,
– আমার নাম আমিরাহ্।
– আমিরাহ্! মানে ধনী নারী।
– আপনাদের চাইতে বেশি ধনী নই।
বলেই আমিরাহ্ আর দাঁড়াল না। পিছনে দাঁড়িয়ে আহমাদ মনে মনে ভাবছিল, ” রুপে তুমি অবশ্যই এক ধনী নারী। এত রুপ আর কোনো মেয়ের আমি দেখিনি।”
চলবে…