#আমার_হয়েও_আর_হইলোনা
#পর্বঃ৯(সত্যের উন্মোচন)
#লেখিকাঃদিশা_মনি
তৃণা বিষাদ মনে বসে আছে। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের সব জল শুকিয়ে গেছে। নিজের জীবনের হঠাৎ বদলে যাওয়া সমীকরণের হিসাব মিলাতে সে সম্পূর্ণ ব্যর্থ!
তৃণার এসব ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ রুমের দরজা খুলে আরেফিনের আগমন ঘটে। আরেফিনকে দেখার মতোই তৃণার ক্ষোভ বেড়ে যায়। ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতো সে ছুটে যায় আরেফিনের দিকে। আরেফিনের শার্টের কলার খামচে ধরে বলে ওঠে,
“তুমি কেন আমায় এই রুমে বন্দি করে রেখেছ? আমাকে এখান থেকে যেতে দাও বলছি।”
“এই জন্য বলে লোকের ভালো করতে নেই। আমি তো তোমার ভালোর জন্যই তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি। তোমার পরিবারের লোকজনই তো তোমায় দূরে ঠেলে দিয়েছে।”
“এমনটা নয়..আমি ওদের বোঝালে ওরা ঠিকই সবটা বুঝবে।”
কথা বলতে গিয়ে বারবার তৃণার বুকটা কেপে ওঠে। আরেফিন তা দেখে ক্রুর হেসে বলে,
“এটুকু কথা বলতেই তোমার কন্ঠ এত কাপছে। আর সবার সামনে কিভাবে কি বলবে?”
“তুমি আর তোমার ফুপি মিলে আমায় ফাসিয়েছ তাই না?”
“একদম ঠিক ধরেছ তুমি। তবে আফসোস বুঝতে একটু দেরি হয়ে গেল।”
“কেন করলে তোমরা এমন? সম্পত্তির জন্য?”
“সেটা একটা কারণ অবশ্যই। তবে আমার কাছে আরো বড় একটা উদ্দ্যেশ্য আছে আর সেটা হলো তোর অহংকার চূর্ণ করা। কত বার তোকে আমি নিজের প্রেম নিবেদন করেছি মনে আছে তোর? কিন্তু তুই দেমাগ দেখিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিস৷ তার ফল তো তোকে পেতেই হতো। এখন দেখ তোর সব দেমাগ কিভাবে বের করে দিলাম।”
তৃণার বুক চিড়ে কান্না বের হয়৷ কিন্তু সে নিজেকে সামলায়। এখন কিছুতেই ভেঙে পড়লে চলবে না। তাকে সমস্ত সত্যিটা জানতেই হবে। সত্য জানার উদ্দ্যেশ্যে তৃণা শুধায়,
“বলো তুমি কি করেছ আমার সাথে? আমার গর্ভে তোমার বাচ্চা কিভাবে আসতে পারে?”
আরেফিন বিকট হাসি দেয়। অতঃপর নিজের সব কুকর্মের কথা বলতে থাকে।
“যেদিন তোমাদের বাড়ির সবাই দাওয়াত খেতে গেছিল সেদিন শুধু তুমি,ফুফু আর ঐ ঈশান বাড়িতে ছিল। আমি ফুফুর মাধ্যমেই কথাটা জানতে পারি। ব্যস আমার মাথায় একটা প্ল্যান চলে আসে। আমি সেদিন তোমাদের বাড়িতে চলে যাই। সেদিন রাতে তোমাদের বাড়িতে গিয়েই আমি শুনতে পাই তুমি ঐ ঈশানের রুমে গিয়ে ওকে নিজের মনের কথা জানাচ্ছ যে তুমি ওকে ভালোবাসো। আমার সেই সময় কি রাগ হচ্ছিল সেটা বলে বোঝাতে পারব না। তারপর ঈশান যখন তোমায় প্রত্যাখ্যান করে আর তুমি কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বের হয়ে আসো আমি তখন পৈশাচিক আনন্দ পাই। যাইহোক এরপর আমি ফ্রিজ থেকে জুস বের করে সেই জুসে অ্যালকোহল মিশিয়ে দেই। তুমি যখন ফ্রিজ খুলে সেই জুসটা খাও তখন আমি পাশ থেকেই সব দেখছিলাম। ঈশান তখন বাইরে বেরিয়েছিল কোন কাজে। এই সুযোগটাকেই আমি কাজে লাগাই। তোমার নেশার সুযোগ নিয়ে তোমাকে একটা রুমে নিয়ে যাই আর তারপর…”
তৃণা চিৎকার করে ওঠে এবং আরেফিনের বুকে জোরে জোরে আঘা’ত করতে করতে বলে,
“শ*য়তান, তুই এমন করতে পারলি কিভাবে?”
“আমি তো কিছুই করিনি বেবি। যা হয়েছে আমাদের দুজনের মতেই হয়েছে। নেশায় থাকার কারণে তুমি আমাকে ঈশান ভাবছিলে। বারবার বলছিলে ঈশান আমাকে ছেড়ে যেওনা,আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। আর আমিও ঠিক এই সুযোগকেই কাজে লাগাই।”
তৃণার ভীষণ কান্না পায়। নিজের সাথে হয়ে যাওয়া অন্যায়গুলোর কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে সে মেঝেতে বসে পড়ে। এদিকে আরেফিন বলতে থাকে,
“জানো এরপর কি হয়? তোমাকে ভো*গ করা শেষ করে আমি ফুফুর কাছে যাই। ফুফুকে সবটা জানাই। ফুফু প্রথমে তো খুব রাগারাগি করে তবে পরে সে এই সুযোগকেই কাজে লাগাতে চায়। কারণ তার অনেক দিনের উদ্দ্যেশ্য তোমার বাবার সব সম্পত্তি একা দখল করা। কিন্তু তোমার বাবা তো সব তোমাদের দুবোনের নামে করতে চায়। তাই তোমাকে তোমার বাবার চোখে খারাপ প্রমাণ করার জন্য আমি আর ফুফু মিলে আরো গভীর পরিকল্পনা করি। ঈশান ফিরে এলে ফুফু তাকে খাবার খেতে দেয়। সেই খাবারে ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল। যা খেয়ে ও রুমে যেতেই গভীর ঘুমে আছন্ন হয়। তারপর আমরা দুজন মিলে তোমাকে ঈশানের রুমে অর্ধনগ্ন অবস্থায় রেখে আসি। উদ্দ্যেশ্য ছিল সকালে সবাই এসে তোমাদের এই উদ্দ্যেশ্যে দেখবে এবং যার ফলে সবার চোখে তুমি খারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। কারণ তোমার বাবা আর বোন দেরি করে বাড়িতে ফেরে। প্রথমে তোমার চাচা চাচি ফেরে, তারা তোমাদের দুজনকে এভাবে দেখে তোমাকে সবটা লোকাতে বলে। আর তুমিও সবটা লুকিয়ে রাখো। সেইসময় আমাদের মনে হয় আমাদের সব প্ল্যান জলে গেল। তবে এরপর আবার আমরা নতুন সুযোগ পাই। তুমি হঠাৎ করে বমি করতে শুরু করো এছাড়া প্রেগ্ন্যাসির আরো অনেক সিম্পটম তোমার মধ্যে প্রকাশ পেতে থাকে। আমার চতুর ফুফু সহজেই বিষয়টা ধরতে পারেন এবং তিনি একসময় নিশ্চিত হয়ে যান যে তুমি প্রেগন্যান্ট। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফুফু তোমার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়। তুমি প্রথমে ফুফুকে পাত্তা না দিলেও বেশিক্ষণ তার কথা না শুনে পারো না। কারণ তুমি এই অবস্থায় কাউকে পাশে চাইছিলে। ফুফু এটারই সুযোগ নিয়ে তোমার মগজধোলাই করে। তোমাকে এমন এমন কথা বলে প্ররোচিত করে যে তুমি যেই ফুফুকে এক সময় দেখতে পারতে না একসময় তার নেওটা হয়ে যাও। তুমি তো প্রথমে চাইছিলে বাচ্চাটা নষ্ট করতে। কিন্তু ফুফু তোমাকে বোঝায় এটা করা ঠিক হবে না বরং এই বাচ্চাকে মাধ্যম করেই তুমি ঈশানকে পেতে পারো। তবুও তুমি রাজি হচ্ছিলে না। এরপর ঈশান আর তৃষ্ণার বিয়ের দিন ফুফু খুব গভীর চাল চালে। সেদিন কিছু না করলে তুমি ঈশানকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে, তোমার জীবনও নষ্ট হবে এসব নানা কিছু বোঝায়। তুমিও তো ঈশানকে ভালোবাসতে তাই তুমিও ফুফুর কথায় প্ররোচিত হয়ে সেদিন সবার সামনে আমাদের সাজানো মিথ্যা নাটকটা উপস্থাপন করলে। আর তারপর বাকি সবটা তো তুমি জানোই।”
তৃণা হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে আছে আরেফিনের দিকে। যেন সে কথা বলতেও ভুলে গেছে। নিজের সাথে ঘটে যাওয়া সকল অন্যায়ের হিসাব মিলাচ্ছে সে। আরেফিন আর প্রেরণা বেগম মিলে কিভাবে তার সাজানো জীবনটা নষ্ট করেছে, সবার চোখে তাকে খা’রাপ করেছে,তার সব আপনজনদের থেকে তাকে আলাদা করেছে এসব ভেবে তৃণার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। নিজের ভাগ্যের প্রতি পরিহাস করতে ইচ্ছা করছে।
এরইমধ্যে আরেফিন তৃণার দিকে একটা ফাইল ছু’ড়ে মে’রে বলে,
“এটা ঈশান পাঠিয়েছে। ডিভোর্স লেটার। সাইন করে দিও।”
বলেই আরেফিন রুম থেকে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে রুমের দরজা বন্ধ করতে ভুলে না।
তৃণা ড্যাবড্যাব করে ডিভোর্স পেপারের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে আসছে। নিভু নিভু গলায় তৃণা বলে ওঠে,
“যা সব কিছু হয়েছে তাতে তো ঈশান ভাইয়ের কোন দোষ নেই। কিন্তু আমি না জেনে না বুঝে বারবার তাকে দোষ দিয়ে এসেছি। ঐ প্রেরণা বেগমের কথায় ভুলে আমি এমন করেছিলাম। কিন্তু আমারই বা দো’ষ কোথায়? সেদিন সকালে জ্ঞান ফেরার পর তো আমার মনে হয়েছিল যে ঈশান ভাইয়ের সাথে আমার…দোষ আমার নয় আবার আমারই। আমি চোখকান একটু খোলা রেখে যদি ঠান্ডা মাথায় সবকিছু ভাবতাম তাহলে সবটা অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। যাইহোক আমি আমার নিজের ভুলের জন্যই হয়তো শাস্তি পাচ্ছি। কিন্তু ঈশান ভাই আর তৃষ্ণা আপু তো কোন দোষ করেনি। ওরা সুখে থাক। আমি এই ডিভোর্স পেপারে সই করব।”
কথাটা বলেই তৃণা সই করতে উদ্যত হয়। তার হাত বারংবার কাপছিল। যতই সে মস্তিষ্ক দিয়ে বিবেচনা করুক তার মন যে মানছে না। কারণ সে যে সত্যি ভালোবাসে ঈশানকে। অনেক কষ্টে নিজের বুকে পাথর চেপে অবশেষে তৃণা ডিভোর্স পেপারে সই করেই দেয়। সাথে সাথে কান্নায় ভেঙে পড়ে মেয়েটা।
তৃণা মনে করে ভালোবাসা বুঝতে পারার পর থেকেই সে তো তার ঈশান ভাইকেই ভালোবাসত। অপরুপ সুন্দরী হওয়ার কারণে কতই না প্রেম প্রস্তাব পেত কিন্তু ঈশানের জন্য সবাইকে ফিরিয়ে দিত। সৃষ্টিকর্তার কাছেও প্রতি মুহুর্তে লোকটিকে চাইত। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ঈশানকে পেয়েও হারাতে হচ্ছে। তৃণা ভাবে আসলেই কি সে ঈশানকে পেয়েছিল? ঈশান কি সত্যিই তার হয়েছিল? হয়তো না। তাই এই ৬ মাসে ঈশান কখনো তার দিকে ফিরে তাকায় নি। সবটা ভেবে তৃণার মুখ থেকে একটা গানই বের হয়ে আসে,
“তারে আমার আমার মনে করি
❝আমার হয়েও আর হইলোনা❞
দেখেছি রুপ সাগরে মনের মানুষ
কাচা সোনা।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨