আমার হয়েও আর হইলোনা পর্ব-০৩

0
850

#আমার_হয়েও_আর_হইলোনা
#পর্বঃ৩
#লেখিকাঃদিশা_মনি

তৃণা তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে তার পূর্বেই তৃষ্ণা রেগে টেস্ট রিপোর্টটা ঈশানের দিকে ছু’ড়ে মা’রে। ঈশান হতবাক হয়ে তাকায়। তৃষ্ণা রাগে ফুসে উঠে বলে,
“নিজের চোখে রিপোর্টটা দেখে নাও। রিপোর্ট পজেটিভই এসেছে। এর মানে তৃণা সত্যি বলছে। তুমি কি এরপরও কিছু বলবে?”

“বিশ্বাস কর তৃষ্ণা এইসব মিথ্যা।”

“কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা সেটা তো এখন দিনের আলোর মতো পরিস্কার হয়ে গেছে ঈশান ভাই। এখন তুমি আর এখানে কোন সিনক্রিয়েট করো না। তোমাএ ওয়াইফকে নিয়ে চলে যাও এখান থেকে। খুব শীঘ্রই তোমাদের সন্তান ভূমিষ্ট হতে চলেছে। তোমাদের সংসারটা সুন্দর করে সাজাও আর আমাকে প্লিজ একটু শান্তি দাও।”

বলেই তৃষ্ণা চলে যায় সেই স্থান থেকে। তৃষ্ণা চলে যাবার পর ঈশান তৃণার দিকে রাগী চোখে তাকায়। তৃণার হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,
“বল তুই কি করেছিস? নিশ্চয়ই এই রিপোর্টটা ভুয়া তাই তো?”

“আমি ভুয়া রিপোর্ট কিভাবে তৈরি করব ঈশান ভাই? তাছাড়া তুমিও খুব ভালো করে জানো এই রিপোর্টটা মিথ্যা নয়। কারণ এই বাচ্চাটা…”

তৃণা তার কথা সম্পূর্ণ করতে পারে না। তার পূর্বেই ঈশান থা’প্পর বসিয়ে দেয় তার গালে। তৃণা গালে হাত দিয়ে বলে,
“তুমি আমায় মা*রলে ঈশান ভাই!”

“হ্যাঁ, বেশ করেছি। প্রয়োজন পড়লে আরো মা*রব।”

বলেই ঈশান দ্রুত পায়ে হেটে বেরিয়ে যায়। তৃণাও অশ্রুসিক্ত নয়নে তার পিছনে যেতে থাকে। ঈশান বাইরে এসে গাড়িতে উঠে তৃণাকে না নিয়েই চলে যায়। রা’গে তার মাথা ভনভন করছে।

ঈশানের মাথায় তো এটাই ঢুকছে না যে রিপোর্ট পজেটিভ এলো কিভাবে। মুখে যাই বলুক ঈশান নিজেও এটা খুব ভালো করে জানে যে এত স্বনামধন্য একটা হসপিটালে ভুল রিপোর্ট কখনো দিবে না। একই সাথে গতকাল রাতে তৃণার বমি করার কথাও ঈশানের মাথায় এলো। সেটা তো মিথ্যা ছিল না। এর মানে কি তৃণা সত্যিই প্রেগন্যান্ট? কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? তাহলে কি তৃণা সত্যিই বলছে? সে কি তাহলে প্রেগন্যান্ট। কিন্তু ঈশান তো খুব ভালো করেই জানে যে এই বাচ্চাটা তার হয়। তাহলে বাচ্চাটা আসলে কার?

ঈশান কিছুক্ষণ ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে ব্যাপারটা নিয়ে। অতঃপর তার মাথায় কিছুটা ঢোকে ব্যাপার টা। ঈশান আন্দাজ করতে পারে এই বাচ্চাটা তার না হলে এটা হয়তো অন্য কারো বাচ্চা। এর মানে তৃণা অন্য কারো বোঝা তার ঘাড়ে চাপাতে চাইছে। কথাটা ভাবতেই রাগে ঈশানের পুরো শরীর কাপতে থাকে। তবে সে এত সহজে তৃণার উদ্দ্যেশ্য সফল হতে দিবে না। ঈশান স্বগতোক্তি করে বলে,
“এবার আমি সব সত্য সামনে বের করেই ছাড়বো৷ এইজন্য আমাকে সবার আগে তৃণার সন্তানের আসল বাবাকে খুঁজে বের করতে হবে। তারপর বাকি সবকিছু।”

★★★
তৃণা একা একাই বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছে। প্রেরণা বেগম ও তৌফিক খান নিচেই বসে ছিলেন। তৃণাকে দেখামাত্র তৌফিক খানের মাথায় রাগ চেপে বসে। এই মেয়েটা জন্মের এক বছর পরেই তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে তিনি হারিয়েছিলেন। সেই সময় অনেকে মেয়েটাকে অপয়া বললেও সেসব কথা কানে তুলেল নি তিনি। মা মরা মেয়েটাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেন নি। তৃষ্ণার থেকেও বেশি আদর দিয়েছেন। অথচ এই মেয়েটাই তার সব সম্মান ধূলিসাৎ করে দিলো৷ এখন তৌফিক খানেরও মনে হচ্ছে এই মেয়ে সত্যি অপয়া। তিনি কোন বাক্যব্যয় না করেই বসার ঘর নিজের রুমে চলে যান।

তিনি যাওয়ার পরেই প্রেরণা বেগম এসে তৃণার পাশে দাঁড়ান। তৃণার কাধে হাত রেখে বলেন,
“সব কিছু ঠিক তো?”

“হ্যাঁ রিপোর্ট পজেটিভই এসেছে।”

“তা তো আসবেই। কারণ তুমি তো সত্যিকার অর্থেই প্রেগন্যান্ট।”

“সেটা জানি আমি। কিন্তু আমার এখন কেমন জানি লাগছে। আচ্ছা আমি কি কোন ভুল করছি?”

“তুমি কোন ভুল করছ না। যা করছ নিজের সন্তানের জন্যই তো করছ। তার তো একটা পিতৃ পরিচয়ের দরকার আছে নাকি? নিজের জন্য না ভাবো নিজের অনাগত সন্তানের কথা ভেবে যা হচ্ছে সেটাকে সঠিক মেনে নাও৷ আর নিজেকে শক্ত করো।”

তৃণা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। জীবন তাকে এমন এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে যে এক সময় যেসব কাজকে সব থেকে বেশি ঘৃ*ণা করত আজকাল সেইসব কাজই করতে হচ্ছে। যেমন প্রেরণা বেগমের সাথে এই ঘনিষ্ঠতা। তৃণার আজো মনে পড়ে সে যখন দশম শ্রেণিতে পড়ছিল তখন তার বাবা এই মহিলাকে বিয়ে করে আনেন। যা তৃণাকে প্রচুর মর্মাহত করে। তৃণার যখন মাত্র ১ বছর বয়স আর তৃষ্ণার পাঁচ তখন তাদের মায়ের মৃত্যু হলে তৌফিক খান এতগুলো বছর একাই নিজের দুই মেয়েকে মানুষ করেন৷ কখনো দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবেন নি। কেউ দ্বিতীয় বিয়ের কথা বললেও রেগে যেতেন তিনি।

কিন্তু হঠাৎ করে শেষ বয়সে গিয়ে কেন এভাবে প্রেরণা বেগমকে তিনি বিয়ে করলেন সেটাই সবথেকে বড় প্রশ্ন ছিল সবার জন্য। তৃণার জানামতে প্রেরণা বেগম তৌফিক খানের বন্ধু আব্দুল করিমের স্ত্রী ছিলেন। আব্দুল করিমের মৃত্যুর কিছু মাসের মধ্যেই তিনি প্রেরণা বেগমকে বিয়ে করেন। তৃষ্ণা বরাবরই শান্তশিষ্ট আর বুঝদার মেয়ে। তাই সে এটা নিয়ে কোন কথা বলে নি। সবটা স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু তৃণা মোটেই সবটা এত সহজে মানে নি। সে তার বাবার এই কাজের প্রতিবাদ করেছিল। প্রেরণা বেগমকে বিয়ে করায় একদিন না খেয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে ছিল। পরে অনেক কষ্টে তাকে খাওয়ানো হয়। প্রেরণা বেগমের সাথে কখনো ভালো ব্যবহার করে নি তৃণা। নিজের মায়ের জায়গায় বসাতে পারেনি। কিছুদিন আগে অব্দি ভালো করে কথাই বলতো না কিন্তু এই ক’দিনে সমীকরণ পুরো বদলে গেছে।

★★★
তৃষ্ণার মন মেজাজ আজ খুব একটা ভালো নেই। এমনিতেই বিয়ের দিন যা হলো তাতেই তার ভীষণ রাগ জমেছে মনে। কিন্তু তারপরেও যা সবকিছু হলো সেটা তার মন পুরো খারাপ করে দিয়েছে।

ছোটবেলা থেকেই চাপা স্বভাবের তৃষ্ণা। অবশ্য মায়ের মৃত্যুর আগে সে এমন ছিল না। বাবা-চাচার মুখে শুনেছিল মা বেঁচে থাকতে নাকি অনেক চঞ্চল ছিল। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথে চঞ্চলতাও তার মধ্য থেকে হারিয়ে গেছিল।

ছোট্ট মেয়েটি মায়ের অভাব বুঝে ওঠার আগেই ছোট বোনের দায়িত্ব কাধে এসে নামে। বাবাও ছোট বোনকে বেশি সময় দেয়৷ যার ফলে তৃষ্ণা ধীরে ধীরে গম্ভীর হতে থাকে। নিজের চাওয়া পাওয়া সব ভুলে যায়। নিজের মনের কষ্টও গোপন করতে শিখে যায়। কখনো নিজের মনের কথা শেয়ার করার মতো কাউকে পায়নি। এভাবে থাকতে থাকতে যেন তৃষ্ণা মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এখন যে সে পারছে না। নিজের মনের এই কষ্টকর অনুভূতি লুকানো আর সম্ভব না। তৃষ্ণা খুব করে চাইছে কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। নিজের মনের বোঝ হালকা করতে কিন্তু সেটা যে সম্ভবপর নয়।

এরমধ্যে তার চেম্বারে একজন নার্স প্রবেশ করে বলল,
“আপনার একজন পেশেন্টের অবস্থা খুব সিরিয়াস। আইসিইউতে আপনাকে প্রয়োজন।”

তৃষ্ণা আর বিন্দুমাত্র সময় ব্যয় করে না। নিজের মনের অবস্থা যেমনই হোক নিজের দায়িত্বে অবহেলা সে কোনমতে করবে না। ডাক্তারি পেশায় আসার সময় যে শপথ করেছিল তা যে তাকে পূর্ণ করতেই হবে।

তৃষ্ণা আইসিইউতে গিয়ে রোগীটির কাছে যায়। তার পেশেন্ট ৮০ বছরের এক প্রবীণ ব্যক্তি। অবস্থা ভীষণ ক্রিটিকাল। তৃষ্ণার আর বেশি কিছু করার ছিল না। কারণ তার অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকটি মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। তৃষ্ণার আজ ভীষণ কষ্ট হয়। যদিও একজন ডাক্তার হিসেবে এটা তার কাছে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আজ কেন জানি তার মনে হচ্ছে তার মানসিক অবস্থার কারণেই তার দ্বারা এই গাফিলতি হয়ে গেছে। যদিও তার এই ভাবনা বেঠিক তবে এই মুহুর্তে তার এমনটাই মনে হচ্ছিল।

তৃষ্ণার চোখে জল চলে আসে। সে কাঁদতে কাঁদতে আইসিইউ থেকে বেরিয়ে আসে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে