#আমার_শহরে_রংধনু_উঠেনা
Part–5
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
শেষরাতের দিকে বর্ষার শীত-শীত লাগতে লাগলো। তার ঘুম ভেঙে গেল। সে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। তখনো আযান দেয়নি। কিছুক্ষণ পরই সম্ভবত আযান দিবে। পাশে ঘড়ি নেই জন্য বুঝতে পারলো না এখন ক’টা বাজে। সে আশেপাশে তাকিয়ে কাঁথা খুঁজতে লাগলো।শীত করছে খুব।
নতুন বাসায় কোথায় কি থাকে কিছুই জানে না সে৷ কেবল রান্নাঘরের টুকটাক জিনিস-পত্র দেখেছে। ফারাজ তখন গভীরে ঘুমে বুদ। গভীর শ্বাস ফেলছে সে। অন্ধকারের মাঝেই তার অস্তিত্ব বড্ড অস্বস্তি দিচ্ছে বর্ষাকে। সে বেশ অসহায়বোধ করছে। রাতে অনেক জ্বর ছিল। এরপর রুমে ফারাজ এসে তার পাশে শুয়ে পড়লো। বিষয়টি তার কাছে বিব্রতকর। কাল অব্দি এই ছেলে তাকে দু’চোখে দেখতে পারত না আর আজকের ব্যবহারে আকাশ-পাতাল ফারাক!
সে উঁচু হয়ে হাত বাড়ালো ফ্যানের সুইচের দিকে। শীতের রাতে ফারাজ ফ্যান অন করে রেখেছে। সুইচ বোর্ড ফারাজ যেই পাশে শুয়ে ঘুমাচ্ছে ঠিক সেই বরাবর উপরে। বর্ষা সামান্য উঁচু হয়েও হাতে নাগাল পাচ্ছে না। এদিকে ঠাণ্ডায় তার জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। নিজেকে নরওয়েবাসিন্দা মনে হচ্ছে। সে আরেকটু আগাতেই ফারাজের সঙ্গে তার বাহুর ঘর্ষণ সৃষ্টি হলো। এর ফলে ফারাজ সামান্য নড়েচড়ে উঠে৷ বর্ষা ফারাজের কাছ থেকে সরে এসে ফ্যানের সুইচ অফ করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো কিছুক্ষণের জন্য। ফ্যান অফ করার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের মধ্যেই ফারাজ বিরক্তি প্রকাশ করে নড়াচড়া শুরু করলো। যা বুঝতে পেরে বর্ষা সামান্য হাসলো। এরপর সে বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ে। এখনো তার ঠাণ্ডায় গা কম্পন দিচ্ছে। অথচ জনাবের গরম লাগে।
সে শোয়ামাত্র ফারাজ তার গায়ে একটা পা তুলে দিল। সে হচকচিয়ে তার দিকে তাকালো। ততোক্ষণে সূর্যের আলো কেবল ফুটতে শুরু করেছে। বাহির থেকে পাখির কিচিরমিচির শব্দে রুমটা স্নিগ্ধময় হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনের তুলনায় আহক্ব্র দিনটা ভিন্নরকম লাগলো তার কাছে!
তার দৃষ্টি ফারাজের মুখের দিকে। ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় সব মানুষকেই শান্ত- নিষ্পাপ লাগে। ঠিক তখনই ফারাজ তার হাত ছড়িয়ে দিয়ে মুখ দিয়ে কি যেন শব্দ করে কান চুলকাতে লাগে। ঘুমন্ত ফারাজের কর্ম-কারখানাগুলো দেখতে বর্ষার ভারী মজা লাগছিল। বাচ্চাদের মতো কান চুলকাচ্ছে সে। ছোট বাচ্চারা ঘুমের মধ্যে ডিস্টার্ব ফিল করলে কান চুলকায় ঠিক তেমনি করে ফারাজও কান চুলকাচ্ছে !
আচমকা ফারাজ তার দিকে মুখ করে ঘুরে শুয়ে তাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে ফেলে। বর্ষা স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মুখ হা হয়ে যায় তার অবাকে। ছেলেটা কি জেগে আছে? নাকি ঘুমন্ত অবস্থায়? বর্ষার মধ্যে লজ্জা বিরাজ করতে লাগলো। সে আবেশে চোখ বুজে ফেলে। ফারাজ তার অতি নিকটে অবস্থান করছে। ওর নিশ্বাসের তাপ বর্ষার গলায় এসে পড়ছে। তার বুকের মধ্যে অজানা জলোচ্ছ্বাস, সুনামি শৈত্যপ্রবাহ শুরু হলো। বুক হুহু করে উঠলো তার। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে আরো বিকাপে পড়ে গেল। ফারাজ তাকে কোলবালিশ বানিয়ে ফেলল মুহূর্তের মধ্যে। বর্ষা বিরক্তিতে চ উচ্চারণ করে। চোখ ঘুরিয়ে সাদা দেয়ালটার দিকে তাকালো। সেখানেও রেহাই নেই। দেয়ালে বিশাল এক ফটোফ্রেমে ফারাজের হাসি মুখ করে ছবি তোলা। সেদিনে নজর পড়তেই বর্ষা কেমন অদ্ভুত লাগলো। সে আবারো ঘুমন্ত মানুষটার দিকে তাকায়।
ওই সময় তাদের দুইজনের মধ্যে দূরত্ব ছিল না বললেই চলে। ফারাজ তার গায়ের সঙ্গে মিশে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল আরাম করে।এদিকে ফারাজের উষ্ণ ছোয়ায় বর্ষার চোখ বন্ধ করে থাকতেও লজ্জা লাগছিল। মনে হচ্ছিল যদি মাটি মাঝ বরাবর ফাঁকা হয়ে যায়, সে মাটির নিচে নেমে যাবে।
ফারাজ তার কোমড় চেপে রেখেই আস্তে করে চোখ খুলতেই মুখের সামনে বর্ষার মুখমণ্ডল দেখে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে, আমার মুখের সামনে কি করছো তুমি?
বর্ষার তখন তন্দ্রাভাব এসে যাচ্ছিল। ফারাজর স্পর্শটা সহ্যসীমার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল ততোক্ষণে। তার কথায় বর্ষা চোখ খুলে ফেলে।
ফারাজ প্রশ্ন করে, সমস্যা কি মেয়ে? গায়ের সঙ্গে মিশে আছো কেন? গরমে বাঁচতেছি না। ফ্যান কেন অফ করা?
বর্ষা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, আমি আপনার গা ঘেঁষে মোটেও শুয়ে নেই। বরং আপনি আমাকে কোলবালিশ বানিয়ে রেখেছেন৷ ছাড়ুন।
ফারাজ একটা হাই তুলে আবারো বর্ষার দিকে ঘুরে জাগ্রত অবস্থায় তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, শুভ সকাল। হ্যাভ এ নাইস ডে– বলে পুনরায় ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল।
বর্ষা বলে উঠে, হাত সরান আমার গা থেকে৷
–পারব না।
তার জবাব শুনে বর্ষা তাজ্জব বনে গেলো।ক্রমশ সময় গড়িয়ে ঘড়ির কাটায় সাতটা বাজলো। ওই সময় ফারাজ ঘুমে মগ্ন থাকলেও বর্ষার এক ফোটা ঘুম হলো না৷ সে ফারাজের মুখে পানে চেয়ে ছিল সারাটা সময়!
বেল বাজার আওয়াজে বর্ষা উঠে পড়ে। ঠেলে-ঠুলে ফারাজের হাত সরায় সে। চুলে হাতখোপা করে দরজা খুলতেই বুনুর মা ঘরে প্রবেশ করে বলে, ভাবীমনি সকালের নাস্তায় কি বানামু?
বর্ষা একদন্ড চিন্তা করে বলে, ও কি খায় সকালে?
— ছোট স্যার তো পরোটা খায় ডিম দিয়ে৷
— তাহলে সেটাই করেন৷
বুনুর মা হাল্কা করে হেসে রান্নাঘরে চলে গেল। সকালে নাস্তার টেবিলে বসতেই বুনুর মা এসে ফারাজকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো, ছোট স্যার আমি আজকে দেশের বাড়ি যাচ্ছি। ভাগ্নির বিয়ে। সাত দিন আসব না৷
ফারাজ খেতে খেতে ছোট করে জবাব দেয়, আচ্ছা৷
— ফ্রিজে বাজার করা আছে৷ আপনাদের কোন সমস্যা হবে না৷
বর্ষা বুনুর মায়ের যাওয়াতে কিছুটা কষ্ট পেল। বাসায় সে বুনুর মায়ের সঙ্গে গল্প করত৷ একা একা থাকতে ভালো লাগে না। কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে খুব৷ তখন বুনুর মায়ের সাথে কথা বলে কাটায়।
সে রুমে ফিরে এসে দেখে ফারাজ রেডি হচ্ছে কোথাও যাওয়ার জন্য।
সে তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, আপনার ফোনটা দিন৷ আম্মুর সঙ্গে কথা বলব।
ফারাজ তার দিকে এক পলক চেয়ে ফোন এগিয়ে দিল। বর্ষা ফোন হাতে নিয়ে বের হতে ধরলে ফারাজ তার হাত খপ করে ধরে বলে, যা বলার আমার সামনেই বলবা। গেট ইট?
বর্ষা মুখ কুচকে নাম্বার ডায়াল করে৷ ফোন রিসিভ হতেই সে হড়বড় করে বলে উঠে, আম্মু কেমন আছো? বাবা কেমন আছে?
ওপাশ থেকে পজিটিভ কিছু বলা হলো যার দরুন বর্ষার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে তার মায়ের সঙ্গে বর্ষা কথা বলায় এতোটাই ব্যস্ত ছিল যে সে খেয়াল করতে ভুলে যায় কেউ একজন তাকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে কাছ থেকে অনুভব করছে।
ফারাজ আলগা করে তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষা বিরতিহীন ভাবে কথা বলেই যাচ্ছে। হুট করে ফারাজ তার কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। বর্ষা কানে ফোন নিয়ে তার দিকে চোখ গরম করে তাকালে, তার চোখের পাতায় জোরে করে ফু দেয় ফারাজ। বর্ষা ভ্রু কুচকে চোখ বন্ধ করে ফেলে। এবং সঙ্গে সঙ্গে ফারাজ তার কান থেকে ছোঁ মেরে ফোনটা কেড়ে নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে বলে, আমার জন্য দুপুরে রান্না করে রাখবে। আমি এসে খাব৷
বর্ষা বিড়বিড় করে বলে, ইশ শখ কতো। মুখে বলে উঠে, আমি রান্না করতে পারব না৷
ফারাজ বাঁকা হেসে উত্তর দেয়, রান্না না করলে খাওয়ার জন্য অন্য ব্যবস্থা করা হবে৷
সে বেরুতেই বর্ষা চিন্তায় পড়ে গেল। কি এমন ব্যবস্থা নিবে সে!
বর্ষা রান্না করবে না, করবে না ভেবেও বেশ আয়োজন করে দুপুরের রান্না বসালো। শিলা আপু কথায় কথায় বলেছিল ফারাজের কষানো মুরগির মাংস পছন্দ সঙ্গে ডাল। সে বেশ যত্ন নিয়েই মুরগির মাংস রাঁধলো। সঙ্গে ডাল আর বেগুন ভাজি করলো। গরম ভাত রেঁধে গোসল সেরে নিল। কিন্তু দুপুর তিনটার দিকেও ফারাজ ফিরলো না। বর্ষা তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। সে নিজেও খায়নি। ফারাজের অপেক্ষায় আসরের আযান হয়ে গেল তবুও তার দুপুরে খাওয়া হলো না আর না ফিরে এলো সে। মনের মধ্যে অভিমান, রাগ তুচ্ছতা এসে ভীড় জমালো। যদি আসার ইচ্ছাই নেই তার তবে কেন যাওয়ার আগে আশা দেখালো?
কেন এই ব্যক্তির জন্য তার কষ্ট হচ্ছে। কেন তার চোখের জলের কারণ হয় সে? বর্ষা তাকে একবিন্দুও ভালোবাসে না। এসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে তার কান্না পেয়ে গেলো৷
চলবে।