#আমার_শহরে_রংধনু_উঠেনা
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–2
বেলা ঠিক বারোটা ছুঁইছুঁই। সূর্যের সুমিষ্ট রোদ এখন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রখর হতে শুরু করেছে। সূর্যের উত্তপ্ত রোদের কিরণ গায়ে এসে লাগতেই গরম ভাব অনুভব করে ফারাজ। ঘুমের মধ্যেই সে বিরক্তি প্রকাশ করে এপাশ থেকে ওপাশে মুখ ঘুরিয়ে শোয়। কিন্তু সূর্যের তীক্ষ্ম কিরণমালা থেকে নিজের শরীরকে রক্ষা করতে পারলো না সে। এদিকেও রোদ এসে গায়ে হানা দিচ্ছে। অগত্যা চোখ মেলে সে। চোখ মেলতেই সমস্ত শরীরে টান টান ব্যথা অনুভব হলো তার৷ মাথাটা ভীষণ ভারী লাগছে। এই অনুভূতি নতুন নয়। অনেকদিন পরপর ড্রিংকস করলে তার গা ব্যথা করে।কালকে বন্ধুদের সঙ্গে অনেকরাত অব্দি মদ গিলেছে। এর ফল হিসেবে সমস্ত গা ব্যথা করছে।
সে উঠে দাঁড়ালো এবং বাথরুমের দিকে ছুটলো। জরুরি কাজে যেতে হবে। এরপর ফুপির সঙ্গে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কথা বলতে হবে৷ হাতে বেশি সময় নেই। আব্বা সাতদিনের মধ্যে ফিরে আসবে। এই সাতদিনের মধ্যে তাকে যা করার করতে হবে।
গায়ের সাদা ধবধবে শার্টটা চেঞ্জ না করেই সে তিনতলা থেকে হুড়মুড় করে নেমে গাড়ির কাছে যেতেই কালকে সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে গেল। মেয়েটাকে সে সন্ধ্যার দিকে রুমে আটকে দিয়েছিল। এরপর শুরু হলো মদের আসর। এতো বেশি ড্রিংকস করেছিল কালকে যে দিন-রাতের হিসাব ছিল না। সে নিচ থেকে উপরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। পর্দা দিয়ে জানাল ঢাকা বিধায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। তুমুল ব্যস্ততা নিয়ে ফারাজ ফের তিনতলা উঠে বাসায় ঢুকে। তাকে ফিরে আসতে দেখে দারোয়ান অবাক হলেও মুখে কিছু প্রকাশ করলো না।
বর্ষাকে যেই রুমে আটকে রেখেছিল সেই রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থেমে যায় সে।পকেট থেকে চাবি বের করেও লক খুলতে গিয়ে থেমে যায়। কি করবে বুঝে পাচ্ছে না। এই মূহুর্তে বর্ষার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা নেই তার৷ কিন্তু এইভাবে একটা জলজ্যান্ত মানুষকে আটকে রাখাও তো অন্যায়। অবশ্য পৃথিবীতে বাঁচতে হলে এক-দুইটা অন্যায় কাজ করতে হয়। তাছাড়া সে তো আর মহাপুরুষ না! মনের সঙ্গে এক প্রকার যুদ্ধ করে সে দরজার নব ঘুরালো। দরজা খুললেই সূর্যের রশ্মি চোখে এসে লাগলো। জানালায় পর্দা টানা থাকলেও পর্দা ভেদ করে সূর্যের আলো রুমে প্রবেশ করছে। রুমের প্রতিটা জিনিস ঝলমলিয়ে উঠছে। আগে কোনদিন এতো চমৎকার লাগত না সকালটা!
ফারাজ দু’কদম এগুতেই দেখলো, বর্ষা বিছানার পায়ার সঙ্গে লেগে বসে বসে ঘুমাচ্ছে। ক্ষনেই তার ভ্রু কুচকে গেল। বিছানা থাকতে ফ্লোরে ঘুমানোর দরকার কি? আজব!
সে হাঁটু গেড়ে বসে বেশ জোর গলায় ডেকে উঠে, এই মাইয়া? উঠো।
কিন্তু বর্ষা উঠলো না৷ এমন কি তার ডাকে সাড়াও দিল। এই তিনদিনে এমন একবারো সে করে নি। ডাকামাত্র ভয়ের চটে সাড়া দিত।
ফারাজের চিন্তায় কপালে ভাজ ফুটে উঠলো। মেয়েটার আবার কিছু হলো না তো? কোন জানি থ্রিলার মুভিতে দেখেছিল এমন আটকা পড়া অবস্থায় হার্ট এটাক করে মারা যায়।
সিনটার কথা মনে পড়তেই ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে যেতে লাগলো। দ্রুত বর্ষার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য ওর মুখের দিকে ঝুঁকে নাকের সামনে হাত ধরতেই বর্ষা চোখ খুলে ফেলে। দুজনের মধ্যে তখন দূরত্ব ছিল কেবল এক ইঞ্জির। বর্ষা যেন ভূত দেখার মতো চমকে গেল।ফারাজকে নিজের এতো কাছে দেখে বুক ধক করে উঠলো তার। এতো কাছে আসার মানে কি?
সে ফারাজের হাত এক ঝটকায় সরিয়ে ফেলে কন্ঠস্বরে কঠিনতা এনে বলে, আপনি কি একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের পর্যায়ে পড়েন?সেই সন্ধ্যা থেকে আমাকে রুমে বন্দী করে রেখেছেন। রুমে এক ফোঁটা পানি নেই। বারো-তেরো ঘন্টা থেকে আমি পানি খাইনি। আমাকে কি আপনার জড়বস্তু মনে হয়?
ফারাজ চোখ ঘুরিয়ে পুরা রুমে চোখ বুলালো। আসলেই রুমে পানির কোন বোতলের অস্তিত্ব নেই। সে হাঁক পেড়ে বাকি সার্ভেন্টদের মধ্যে একজনের নাম ধরে ডেকে এক গ্লাস পানি আনতে বললো।
সার্ভেন্ট দ্রুত গ্লাস পানি এনে দিলো। তার মধ্যে বিপুল পরিমাণে আগ্রহ। কম বয়সী মেয়েটার জন্য তার দুঃখ লাগছে। তিনদিন আগে এই মেয়েটাকে ফারাজ স্যার বিয়ে করে ঘরে তুলেছে। অথচ তিনদিনের মধ্যে মেয়েটা শুকিয়ে শরীরের হাড় অব্দি দেখা যাচ্ছে। এই তিনদিনে মেয়েটাকে সে খেতে দেখেনি। বড়লোকদের নিষ্ঠুরতা সবসময় বৃহৎ হয়! বাড়ির বৌয়ের সঙ্গেও কি রুড আচরণ!
ফারাজ বুনুর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, কি হলো যান। এখানে দাঁড়িয়ে কি দেখছেন? যান। গিয়ে নাস্তা রেডি করেন।
বুনুর মা দ্রুত প্রস্থান করে। ছোট স্যারের মেজাজের ঠিক-ঠিকানা নেই। এই ভালো এই খারাপ।
সে একবার বর্ষার পানে তাকালো। সত্যি বলতে সে কিঞ্চিৎ মুহূর্তের জন্যও বর্ষার সঙ্গে এমন করতে চায়নি। এটা দুর্ভাগ্যজনক ভাবে একটা দুর্ঘটনা মাত্র।
তার মুখের সামনে পানির গ্লাস ধরে বললো, হ্যাভ সাম ওয়াটার।
বর্ষা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, গরু মেরে জুতো দানের দরকার নেই। আপনি যান।
হুট করে কি যেন হলো। ফারাজ শব্দ করে হেসে বলে উঠে, আমি আবার কখন গরু মারলাম?
— এমন মুহূর্তেও আপনার হাসি পায়?
— খাওয়া-দাওয়া করো, তোমারও হাসি পাবে৷
ফারাজের খামখেয়ালি কথা-বার্তা শুনে বর্ষার রাগ উঠে গেল। সে নিজেকে সামলাতে না পেরে ফারাজের হাতে থাকা গ্লাসটা উল্টিয়ে ফেলে যার দরুন গ্লাসের সব পানি ফারাজের বুকে আছড়ে পড়ে।
ফারাজ ঘটনার আকষ্মিকতা সামলিয়ে ভীষণ চেঁচিয়ে উঠে বলে, হুয়াট দ্যা হেল! হাউ ডেয়ার ইউ বিটচ! আমার গায়ে পানি ঢালো কোন সাহসে তুমি?
— যেই সাহসে আপনি আমাকে রুমে আটকে রেখে দিয়েছিলেন। চাচা আসলে আমি ওনাকে সব বলে দিব৷ আপনি আমার উপর অত্যাচার করছেন এইসব কিছু বলে দিব সবাইকে।
ফারাজ তীক্ষ্ম চোখে তার দিকে তাকালো। বর্ষার রাগান্বিত চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে আগে থেকে।
চোখে চোখ রেখে সে শান্ত গলায় বললো, বাবা কিন্তু অসুস্থ। তোমার এইসব বাচ্চামির জন্য আমার বাবার কিছু হলে তোমাকে আমি গুম করে ফেললো৷
বর্ষার চোখে-মুখে আতংকের ছায়া এসে ভিরলো। ফারাজ দাঁড়িয়ে গেল এবং তার বাহু চেপে ধরে উঠে দাঁড় করায়। বর্ষা উঠে দাঁড়ানোর সময় আর্তনাদের সঙ্গে আহ করে শব্দ করে। ফারাজের দৃষ্টি গেল ফ্লোরের দিকে। সাদা ফ্লোরে রক্তের ছিঁটে দেখে সে ঘাবড়ে গেল। পরমুহূর্তে বর্ষার দিকে তাকিয়ে দেখলো, মেয়েটা বেশ আড়ষ্টতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ-মুখে লজ্জার আভা ফুটে উঠেছে। সে কথা বাড়ালো না।
শান্ত গলায় বললো, নাস্তা না খেলে নিজেরই ক্ষতি। পাগল ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নিজের ক্ষতি চায় না। টেবিলে খাবার দেওয়া আছে। আর আজকের ঘটনার কথা বাবাকে বলবা না। ইট ওয়াস এ এক্সিডেন্ট।
— কালকে রাতে আবারো নেশা করেছিলেন তাই না?
— হ্যাঁ।
বর্ষা তার দিকে ঘৃনিত দৃষ্টিতে তাকালো। সে তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে রুমের বাইরে হাঁটা ধরে। ড্রয়িং রুমে এসে ফের বুনুর মাকে ডাকলো। বুনুর মা ড্রয়িংরুমে আসতেই হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে খুব স্বল্প শব্দে বলে, ওর যা যা লাগে শুনে নিয়ে কিনে আনুন।
স্বল্প শব্দে বলা প্রতিটা কথাই বুনুর মা বুঝে যায়। ফারাজ আবারো বলে, আমি বিকেলের আগে আসব না। কেউ আসলে গেইট খোলার দরকার নাই।
–আচ্ছা।
★★★
বনানীর ১১ নাম্বার রোড ক্রস করে বায়ে মোর ঘুরলো ফারাজ। আপাতত সে ফুপির বাসায় যাবে। ওখানে উকিলের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। ফুপির বাসায় পৌঁছাতেই আযান পড়ে গেলো।
সে ড্রয়িংরুমে বসে পড়ে। সে ঘরে আসতেই তার জন্য শরবত আনা হয়। শরবতে চুমুক দিতেই তার ভ্রু কুচকে উঠে। মনে মনে বলে উঠে, “এতো মিষ্টি কেন দেয়?”
কিছুক্ষন পর মিলি বেগম এসে ফারাজের মুখোমুখি বসে বলে, আছিস কেমন?
— ভালো না। দুশ্চিন্তায় আছি ফুপি।
— এই দুশ্চিন্তার মূল তোর বাপ।
— জানি। আব্বা কিভাবে যে এতো বড় বোকামি করলো।
— তোর বাপের মাথায় গন্ডগোল আছে। নাহলে কেউ নিজের কামানো টাকা, সম্পত্তি অন্য কারো মেয়ের নামে লিখে দেয়? তাও অর্ধেক শেয়ার! পাগলের কারবার আর কি বলব?
ফারাজ বিড়বিড় করে কিসব বললো। এরপর ফুফুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, ফুপি এখন উপায় কি? বর্ষার কাছ থেকে সসম্পত্তি আমার নামে ট্রান্সফার কীভাবে করব? কাগজ-পত্র রেডি হলো? লইয়ার কি বললো?
মিলি বেগম পান হাতে নিয়ে মুখে পুড়ে বললেন, উকিলের সঙ্গে কথা বললাম। কাগজের সই দিয়ে কিছু ই হবে না। ভেরিফিকেশনের জন্য লোক এসে বর্ষার জবানবন্দি নিবে। মৌখিক ভাবে মেয়ের কাছ থেকে ওরা শুনবে এরপর যাচাই করে তারপর কাজ সম্পন্ন হবে। মেয়ে আসলেই তোর নামে সম্পত্তি লিখে দিবে কিনা এইসব হ্যান-ত্যান ওই ফুড়িকে স্বজ্ঞানে বলতে হবে। ভয় দেখায় সই করায় নিয়েও লাভ নাই। তোর বাপে খুব শক্তপোক্ত উইল করছে।
— তাহলে তো ওকে বিয়ে করে কোন ফয়দাই হলো না। যেই লাউ সেই কদুই রয়ে গেল।
মিলি বেগম কিঞ্চিৎ হেসে উত্তর দিলো, বিয়েটা তোর জন্য যে কি বড় আশীর্বাদ তা এখন বুঝবি না রে গাধা। তুই আর তোর বাপ দুইটাই গাধা। তুই গাধা, তোর বাপ মহাগাধা।
ফারাজ বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে ফেলে। ফুপি সব ঘেটে দিল। আর এখন পল্টি মারছে। বিয়ের আগের দিন অব্দি তাকে আশা দেখালো বর্ষার সঙ্গে বিয়ে হলেই সম্পত্তি হারানোর চিন্তা না করলেও চলবে। আর এখন বলে বর্ষা সিগনেচার দিলেও নাকি তেমন কোন সুবিধা করতে পারবে না। তীরে এসে নৌকা ডোবা টাইপ অবস্থা তার। তার নিজের বাবার সম্পত্তি সে বর্ষাকে এক দানাও দিবে না।
ফারাজ এক প্রকার বিরক্তি নিয়ে বলে, তাহলে আমি কি করব? বাবা যে উইল বানাইছে ওইটাই ভ্যানিশ করে দিই?
— ওইটা ভ্যানিশ কীভাবে করব? ওই উইল কার্যকর হবে তোর বাবা মরার পর। বর্ষা মেয়েটা কিছু জানে না। ওর যদি অন্যকারো সঙ্গে বিয়ে হত এতোদিনে ব্যাংক থেকে ওরা সম্ভবত একটা কল পাইত। তোর সঙ্গে বিয়েটা হইছে জন্যই ম্যানেজার আর ব্যাংকে ইনফর্ম করেনি। আমি মানা করে দিসি বলতে।
— এখন আমার করনীয় কি?
— দেখ ফারাজ, ভয়-ভর দেখায় কাজ হবে না। মেয়েটাকে ভুলায়-ফাসলায় রাজী করাবি।
— ওকে কীভাবে ভুলাবো?
মিলি বেগম হাতের ডগায় চুন নিয়ে মুখে পুড়ে নিয়ে বলে, পিঁপড়াকে মধু দিয়ে ভুলানো যায় আর মেয়েমানুষকে ভালোবাসা দিয়ে৷
ফারাজ ফুপির কথা শুনে হতভম্ব হলো। টাকা-পয়সার মতো গুরুত্বপূর্ণ ডিসকাশনে ভালোবাসার মতো ফালতু টপিক উঠানোর মানে কি?
চলবে।