আমার ভীনদেশী এক তারা পর্ব-১২

0
714

#আমার_ভীনদেশী_এক_তারা
#পর্ব১২
#Raiha_Zubair_Ripte

ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে আমান, আরাভ, হেফজিবা,ফারাহ্, রত্না বেগম,আর আরাভের বাবা আরমান সাহেব। আরমান সাহেব কপালে এক হাত ঠেকিয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি বেশ বিরক্ত ছেলের এমন সিদ্ধান্তে। আমান বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বসে আছে। তার মতে এসব ব্যাপার কোনো ফ্যাক্টই না। ভালোবাসে যেহেতু তাহলে বিয়ে করলে অসুবিধা কোথায়? আরমান সাহেব একটু নড়েচড়ে উঠল। সামনে মাথা নিচু করে বসে থাকা হেফজিবার দিকে তাকিয়ে নম্র স্বরে বলল,,

” তুমি মুসলিম হতে পারবা?

হেফজিবা মাথা উঁচু করে আরমান সাহেবের দিকে তাকায়। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে বলে,,

” না আঙ্কেল আমি মুসলিম হতে পারবো না।

ব্যাস এই একটা কথাই ছিলো আরাভের মনে ঝড় তুফান সুনামি তুলে দেওয়ার জন্য। আরাভ বার বার ছলছল নয়নে হেফজিবার দিকে তাকাচ্ছে। হেফজিবা আরাভের চাহনি কে উপেক্ষা করে। আরমান সাহেব আরাভের দিকে তাকিয়ে বলে,,

” তাহলে আর কি ভুলে যাও আরাভ হেফজিবা কে।

কথাটা কর্ণকুহর হতেই আরাভ বসা থেকে উঠে সোজা হেফজিবার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,,

” হেফজিবা প্লিজ মুসলিম হয়ে যাও না।

হেফজিবা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

” আমিও তো বলতে পারি আপনি মুসলিম থেকে খ্রিস্টান হয়ে যান। কিন্তু আমি কি তা বলেছি আপনায় আরাভ?

আরাভ হেফজিবার হাত ধরে বলে,,

” আমাদের ধর্মে এমন টা হয় না মুসলিম ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে যাওয়া যায় না। লক্ষীটি প্লিজ এমন করে না ভালোবাসি তোমায়।

হেফজিবা আরাভের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বলে,,

” আপনি ভালোবাসলেই তো হবে না। আমার তো আপনায় ভালোবাসতে হবে। আমি তো বাসি না ভালো আপনায়।

কথাটা কর্ণকুহর হতেই দু পা পিছিয়ে গেলো আরাভ। হেফজিবাকে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলে,,

” ভালোবাসো না তুমি আমায়?

হেফজিবা চোখ ফ্লোরে নিবন্ধন করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,,

” ন না ভালোবাসি না।

” আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো।

হেফজিবা এবার আরাভের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে বলে,,

” না ভালোবাসি না আপনায়। আমায় দেখে কখনো মনে হয়েছে আমি আপনায় ভালোবাসি? সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত দিচ্ছি— একজন মানুষ আরেক জন মানুষকে ভালোবাসবে, এটাই স্বাভাবিক। ভালোবাসা তো আর এতো হিসাবনিকাশ করে হয় না, এটা জাস্ট হয়ে যায়। তখন খেয়াল থাকে না যে, ব্যক্তিটি কোন ধর্মের। আমাদের সমাজের আমজনতা দুটি ভিন্ন ধর্মের ব্যক্তির ভালোবাসাকে সমর্থন করেনা, তাদের ভালোবাসাকে সমর্থন করলেও তাদের বিয়ে হ‌ওয়াকে ঠিক সমর্থন করতে পারে না। আর যদি তাঁদের বিয়েকে সমর্থন করেও, তখন দুজন ভিন্ন ধর্মের নিরীহ বিবাহিত যুগল স্বতন্ত্র ভাবে নিজ নিজ ধর্ম‌ও পালন করতে পারে না। দুজনের মধ্যে একজনকে নিজের ধর্মের সাথে আপোষ করে অন্য ধর্মকে গ্রহণ করতে হয়। এটা আবার আমার বোধগম্যের বাইরে অর্থাৎ, ভালোবাসার জন্য নিজ ধর্ম ত্যাগের ব্যাপারটি আমি ঠিক ভাল ভাবে গ্রহণ করতে পারিনা।

” বেশ তাই হোক তোমায় ফোর্স করবে না আমি। শুধু বলবো ভালো থেকো। জোর করে সব পাওয়া গেলেও ভালোবাসা পাওয়া যায় না। আমার লাক টাই খারাপ জানো তো জীবন দ্বিতীয় বার সুযোগ এনে দিলেও সেটাকে আঁকড়ে ধরে নিজের করতে পারলাম না।

কথাটা বলে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেলো আরাভ। আরমান সাহেব হেফজিবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,,

” তোমার মতামত কে আমি সমর্থন করি মা। কারো পক্ষেই ধর্ম ত্যাগ করা সম্ভব নয়। ভালো থেকো।

কথাটা বলে আরমান ও চলে গেলো নিজের রুমে।

এনা হেফজিবার সামনে এসে জড়িয়ে ধরে বলে,,

” আমি সবসময় তোর পাশে আছি দোস্ত। চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে। চল রুমে।

আরাভ রুমে এসে মাথা চেপে বসে আছে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। পারছে না এভাবে। বাহির থেকে এনা দরজায় করাঘাত করে বলে,,

” আরাভ ভাই আসবো?

আরাভ নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,,

” হ্যাঁ আসে ভেতরে।

এনা ভেতরে এসে আরাভের পাশে বসে বলে,,

” আরাভ ভাই যে চায় না নিজের সাথে তোমায় বাঁধতে তাকে নিয়ে না ভাবাই শ্রেয়। তোমার উচিত মুভ অন করা। হেফজিবা কখনোই তার ধর্ম ছাড়তে পারবে না।

আরাভ অন্য দিকে তাকিয়ে চোখের জল আড়াল করার চেষ্টা করে বলে,,

” হুমম চেষ্টা করবো। আমাকে একটু একা থাকতে দাও। পরে কথা বলবো তোমার সাথে।

এনা মাথা নাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

চার্চিল স্কয়ারে বসে আছে এনা আর পিটার। পাশেই খেলছে অ্যাঞ্জেলেকা কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সাথে। এনা এবার পিটারের দিকে তাকিয়ে বলে,,

” ডাকলেন কেনো?

” এমনি।

” এমনি মানে?

” এমনি মানে এমনি।

” ঐ বাচ্চা মেয়েটা কে যাকে সাথে করে নিয়ে এসেছেন।

” আমার মেয়ে।

এনা এবার কপাট রাগ দেখিয়ে বলে,,

” ফাজলামি করছেন আপনি আমার সাথে? আপনি তো বিয়েই করেন নি তাহলে মেয়ে আসলো কোথায় থেকে।

পিটার এনার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,,

” বিয়ে না করলে কি মেয়ে হয় না নাকি।

” অব্যশই না। কারন একমাত্র ওসব করলেই তো বাচ্চা হয়।

পিটার চোখ পিটি পিটি করে বলে,,

” ওসব কোন সব?

” ওসব কোন সব জানেন না? ধাক্কা মে’রে একদম পানিতে ফে”লে দিবো। মেয়েটা কে হয় সেদিন মলের সামনে দেখেছিলাম মেয়েটাকে এক মহিলার সাথে।

পিটার তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে,,

” হ্যাভেনের মেয়ে।

কথাটা কর্ণকুহর হতে এনা ভ্রু কুঁচকে বলে,,

” ফাইজলামি করছেন আবার হ্যাভেন কবে বিয়ে করলো। আর করলেও এতো বড় বেবি আসলো কই থেকে।

” হ্যাভেন লুকিয়ে বিয়ে করেছিলো আমাদের না জানিয়ে। তুমি দেশ ছেড়ে চলে যাবার পর দু বছরের বাচ্চা নিয়ে হ্যাভেন একদিন সকালে হাজির হয় বাসায়। হ্যাভেনের স্ত্রী হেলেন গরীব ঘরের মেয়ে ছিলো। আর আমার মা তো স্ট্যাটাস আভিজাত্য ছাড়া মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে মানবে না তাই লুকিয়ে সব করে বাচ্চা সহকারে সামনে আসে। কারন তখন তো না মেনে উপায় নেই।

” ও তাই বলুন। হ্যাভেন কে দেখলাম না একবার। হ্যাভেন কোথায়?

” হ্যাভেন কোমায়।

” কিহ!

” হ্যাঁ আজ চার বছর ধরে কোমায় আছে।

” কিভাবে কি হলো?

” চার বছর আগে একদিন হঠাৎ হসপিটাল থেকে ফোন আসে হ্যাভেন হসপিটালে ভর্তি। গাড়ি এক্সি”ডেন্ট করেছিলো।

” এখন হ্যাভেনের অবস্থা কেমন। আগের থেকে একটু ভালো।

” ওহ।

” আচ্ছা এনা একটা কথা বলি?

” বলুন।

” আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তুমি কি রাজি?

কথাটা এনার কর্ণকুহর হতেই এনা ভীষণ রকমের একটা ঝটকা খায়। এ কথা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না এনা। আজ সকালে হেফজিবা আর আরাভের ঘটনা গুলে দেখে এনার মন বিষিয়ে গেছে। এমনিতেই নিজেকে অনেক টা শক্ত করে তুলছে এই কয়েক বছরে।

” যা ছয় বছর আগে হতে পারে নি তা আজ আর কিভাবে হবে।

” তুমি চাইলেই হবে।

” ছয় বছর আগে তো আমি চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি চান নি। সেই আপনি ভাবছেন আমি চাইবো?
আর তাছাড়া আপনার মা কি মানবে?

” সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও। যতোদিন আছি তোমার সাথে তোমার পাশে থেকে কাটাতে চাই।

” যতোদিন আছেন মানে?

” ও কিছু না। একটা উঠে দাঁড়াও তো।

” কেনো?

” আহা উঠোই না।

এনা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালে পিটার দৌড়ে গাড়ি থেকে গোলাপের তোড়া টা নিয়ে এসে এনার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বলে,,

” তোমার কি মনে পড়ে? ব্যান্ফ পার্কে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎের কথা! সারিবদ্ধ ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আমাদের হেঁটে চলার কথা!একসঙ্গে বসে থাকা প্রকৃতির সান্নিধ্যে। কবিতার মতো প্রেম। কখনো কৃত্রিম আবহে উড়তে থাকে তোমার চুল। তোমার হাত ছুঁয়ে বন্দী হয় সময়। স্পর্শে থাকে না যৌনতা! না থাকে মুগ্ধতা। সে স্পর্শে থাকে নির্ভরশীলতা। তোমার কাজল চোখ। আমার নির্লিপ্ত কাব্যিক দৃষ্টি। হারানোর ভয়। সে ভয়ে চোখ ভিজে যায়। শক্ত করে ধরে থাকি তোমার হাত।

” না মনে নেই।

এনার এমন বেহুদা কথা শুনে পিটারের ইচ্ছে করছিলে চ”ড়িয়ে গাল লাল করে দিতে। নিজের রাগ কে সংবরণ করে বলে,,

” আমাকে শেষ করতে দাও কাল সারা রাত ধরে এসব কাব্যিক শিখেছি। কথা বলো না চুপচাপ কথাগুলেকে তোমার হৃদকে স্পর্শ করতে দাও।

” আচ্ছা বলেন।

” প্রথম থেকে বলি?

” না না যেখান থেকে থেমে গেছেন সেখান থেকে বলেন।

পিটার বসা থেকে উঠে এনার হাত ধরে হাঁটা ধরলো।

” আরে কই নিয়ে যাচ্ছন।

” নির্জন প্রহরে।

” সেটা কোথায়।

পিটার হাঁটা থামিয়ে এনার দিকে ভ্রু কুঁচকে বলে,,

” নির্জন প্রহর মানে বুঝো না?

” বুঝি তো।

” তাহলে জিজ্ঞেস কেনে করছে চলো আমার সাথে।

কথাটা বলে ফের এনার হাত ধরে হাঁটা ধরলো পিটার। প্রায় মিনিট সাতেকের মধ্যে একটা নির্জন জায়গায় এনে এনার হাত ছেড়ে দিলো পিটার। এনা হাত ছাড়া পেয়ে আশেপাশে তাকাতেই দেখলো চারপাশে লম্বা লম্বা গাছপালায় ঢাকা জায়গা টা। বেশ সুন্দর। এনা ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখে পিটার একটা কাগজ এনার দিকে ধরে রেখেছে। এনা ভ্রু কুঁচকে বলে,,

” কিসের কাগজ এটা?

” দেখে তুমি।

এনা কাগজ টা নিয়ে দেখলো সেখানে স্পষ্ট লেখা ফয়সাল আহমেদ শান লেখা। অপরিচিত নামের সনদ পত্র দেখে এনা বিরক্ত হয়ে বললো,,

” কার সনদ পত্র আমায় দেখাচ্ছেন আপনি?

পিটার স্বাভাবিক হয়েই বলে,,

” আমার।

” আপনার মানে?

” আমার মানে আমার। আমি মুসলিম হয়েছি।

কথাটা কর্ণকুহর হতেই সারা শরীর বরফের মতো জমে গেলো এনার। মাথাটাও ঝিমঝিম করতে লাগলো। হাত পা কাঁপছে। হৃদপিণ্ড টার স্পন্দন মনে হয় থেমে গেছে। হাত থেকে কাগজ টা পড়ে গেলো। চোখ দুটো ঝাপসা হতে লাগলো।

#চলবে?

( ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিবেন। হ্যাপি রিডিং)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে