#আমার_ভাঙা_ক্যানভাসে
#পর্ব_২
#তানজিলা_খাতুন_তানু
জয় রুহির দাদুকে দেখতে যাওয়ার বাহানায় ওই বাড়ির দিকে পা বাড়াল। মনে একরাশ ভয়, সংশয় নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ভয় লাগছে যদি রুহি ওর সাথে খারাপ আচরন করে। জয় নিজেকে শান্ত করে বলল,
– ‘রুহি আমার সাথে খারাপ আচরন করলে করুক, আমি তবুও ওর সাথে দেখা করব।’
জয় ভীত হয়ে কলিং বেল বাজাল। দরজা খুলল রুহির কাজিন প্রিয়া। মেয়েটা ওদের থেকে বয়সে ছোট, বাবা মায়ের সাথে শহরে থাকে মাঝেমধ্যে আসে। আর জয়কে ছোট থেকেই পছন্দ করে কিন্তু লজ্জায় বলতে পারেনি। আজকে এতদিন পর জয়কে দেখে প্রিয়া একটু ঘাবড়ে যায়, একরাশ লজ্জা এসে ভর করেছে কতদিন পর প্রেমিক পুরুষটিকে দেখল।
প্রিয়াকে এইভাবে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে জয়ের প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে, সামনের মেয়েটা কে সেটাও ঠিক করে বুঝতে পারছে না। হয়তো রুহির কোনো কাজিন কিন্তু ঠিক কে সেটা আন্দাজ করতে পারছে না।
– ‘বলছি দাদু কোন রুমে আছেন?’
জয়ের কষ্ঠস্বর শুনে প্রিয়ার ধ্যান ফিরল। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
– ‘নিজের রুমেই আছেন।’
জয় অপেক্ষা না করেই দাদুর ঘরের দিকে পা বাড়াল। আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হয় মেয়েটা চোখ দিয়েই গিলে খেত। জয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে প্রিয়া বুকে হাত দিয়ে বলল,
– ‘ইশ কি কিউট হয়ে গেছে। হায় মে মা’র যাওয়া।’
প্রিয়া লাফালাফি করতে করতে হাঁটার সময়ে কারোর সাথে এক ধাক্কা তারপর…
– ‘আহ মা গো ম*রে গেলাম গো, আমার কোমড় গো। এই রুহি’পু একটু দেখে হাঁটতে পারো না।’
রুহি কোমড়ে হাত গুঁজে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
– ‘আমি দেখেই হাঁটছিলাম কিন্তু আপনি তো চোখ দুটো আসমানে রেখে হাঁটছিলেন তাই ধাক্কা লাগল আর আপনি ধপাস। তা এত লাফালাফি কিসের?’
প্রিয়া মাথা চুলকে বোকা হেসে দিলো। বিষয়টা রুহির ভালো ঠেকল না, এইরকম রিয়াকশন মানুষ প্রেমে পড়লেই দেয় তারমানে কি প্রিয়া!
রুহি অপেক্ষা না করে প্রিয়াকে নীচে বসা থেকে তুলে একপ্রকার টানতে টানতে নিজের ঘরে নিয়ে গেল।
– ‘আরে কি হলো এইভাবে গোরু টানা করে আনলে কেন?’
– ‘সত্যি করে বল কার সাথে প্রেম করছিস।’
প্রিয়ার হাওয়া ফুড়ুত করে উড়ে গেল। কাঁচুমাচু হয়ে বলল,
– ‘কই কারোর সাথেই তো নয়।’
– ‘সত্যি করে বলবি নাকি আমি কাকিমাকে গিয়ে বলব।’
– ‘এই রুহিপু এইরকম করছ কেন?’
– ‘তাহলে সত্যিটা বল।’
– ‘এখনো প্রেম-ট্রেম হয়নি কিন্তু তুমি হেল্প করলে হয়ে যাবে।’ (লজ্জা পেয়ে)
– ‘আমি হেল্প করলে হয়ে যাবে মানে?’ (ভ্রু কুঁচকে)
প্রিয়া লজ্জাবতী পাতার মতো লজ্জা পেয়ে গুড়িয়ে যাচ্ছে। এইসব ন্যাকামি দেখে রুহি ধমক দিয়ে বলল,
– ‘বড় বোন এখনো সিঙ্গেল আর ছোট বোন প্রেম করছে। এই ন্যাকামি না করে বল ছেলেটা কে?’ (প্রথম কথাটা কিছুটা দাঁতে দাঁত চেপে আর শেষের কথাটা ধমকে দিয়ে বলল)
রুহির ধমক খেয়ে প্রিয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বলল
– ‘রুহিপু তোমার ওই বন্ধু আছে না জয়। ওনাকে না আমার দারুন লাগে, প্লিজ তুমি ওনার সাথে আমার লাইনটা করিয়ে দাও না।’
রুহি রাগী লুক নিয়ে প্রিয়ার দিকে তাকায়। ওকে এইভাবে তাকাতে দেখে বলল
– ‘এইভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’
– ‘জয়ের থেকে দূরে থাকবি।’
– ‘কেন?’
– ‘ওর গার্লফ্রেন্ড আছে।’ (দাঁতে দাঁত চেপে)
– ‘কিন্তু আমি যতদূর জানি উনি সিঙ্গেল।’ (চোখ ছোট ছোট করে)
– ‘আমি জয়ের ফ্রেন্ড না তুই?’
– ‘তুমি।’
– ‘তাহলে প্রেমের বিষয়ে কে ভালো জানবে!’
– ‘তুমি।’
– ‘রাইট প্রিয়ু। জয়ের গার্লফ্রেন্ড আছে আর ওকে তাকে অনেক ভালোবাসে। আমি চাই না তুই কষ্ট পাক তাই ওর কাছ থেকে দূরত্ব মেনটেন করলে তোর জন্যই ভালো। বুঝলি?’
– ‘হুম।’ (মন খারাপ করে)
– ‘এখন রুমে যা। মন দিয়ে পড়াশুনা কর, দেখবি জীবনে ছেলের অভাব হবে না।’
প্রিয়া মনখারাপ করে চলে যায়। রুহি মনে মনে বলল,
– ‘আমি চাই না তুই কষ্ট পাস। আর এটাই সত্যি জয়ের গার্লফ্রেন্ড আছে, আর তাকে ও এতটাই ভালোবাসে যে আমার সাথে এত দিনের বন্ধুত্ব ভাঙতেও দুবার ভাবেনি।’
রুহির ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠেছে তাচ্ছিল্যের হাসি। কথাতে বলে না দশদিনের ভালোবাসা দশবছরের বন্ধুত্বকে ভাঙতে পারে, ঠিক তেমনটাই হয়েছে রুহি আর জয়ের জীবনে। তৃতীয় ব্যক্তির আগমন তারপর সব সম্পর্ক শেষ!
**
জয় রুহির দাদুর সাথে কথা বলছে। মানুষটি জয়কেও যথেষ্ট স্মেহ করেন, এতদিন পর ছেলেটাকে দেখে বললেন,
– ‘কি জয় এতদিন পর বুড়োটার কথা মনে পড়ল?’
– ‘আসলে দাদু অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকি।’
– ‘ওইসব তো বাহানা আসল কারন আমি বুঝি।’
– ‘কি কারন?’
– ‘ওই যে আমার রুহি দিদিভাই ছিল না তুমি আসতে না। আর যেই আমার দিদিভাই এসেছে ওমনি গন্ধে গন্ধে ঠিক চলে এসেছ বলো।’
উনি হেসে উঠলেন। বিষয়টিতে জয় একটু লজ্জা পেল, ইশ্ দাদু কিভাবে মজা নিলেন।
– ‘তা দিদিভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে।’
– ‘না। কিভাবে করব বুঝতে পারছি না, ম্যাডাম তো আমার উপরে বিশাল ক্ষেপে আছে।’
– ‘বন্ধু হয়েছ আর বন্ধুর রাগ ভাঙাতে পারবে না!’
জয় চুপ করে আছে কি বলবে? রুহির সাথে সম্পর্কটাই এখন আর নেই কিভাবে রুহির রাগ কমাবে?
**
রুহি রঙ তুলি নিয়ে ক্যানভাসে ছবি তোলার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ তাই হয়তো মানিয়ে নিতে পারছে না। রুহি এখান থেকে চলে যাবার পর আর্ট কলেজে এডমিশন দেয় এবং ভাগ্য ভালো চান্স হয়ে যায় তারপর আর কি নিজের সমস্ত রাগ, অভিমান সবটা ক্যানভাসে তুলে ধরে। রঙে রাঙিয়ে তোলে অথচ নিজের মনের ক্যানভাসটাই রংহীন এবং ভেঙে খানখান হয়ে গেছে। যেটাকে চাইলেও জুড়তে পারেনা পরিবর্তে আরো খন্ড বিখন্ড হয়ে যায়।
– ‘দূর কিছুতেই আঁকতে পারছি না, অসহ্য লাগছে সবকিছু।’
– ‘সবুজটার পাশে হালকা হলুদ রং দে।’
বহু চেনা কন্ঠস্বর। কয়েকবছর না শুনলেও চিরচেনা মানুষটির কন্ঠস্বর কি এত সহজে ভোলা যায়! রুহি পেছন ফিরে তাকাল হ্যাঁ ওর আন্দাজটাই ঠিক জয় এসেছে। রুহি খুশি হলো পরক্ষনেই সেই সম্পর্কের শেষদিনের কথা মনে পড়ে গেল, মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ক্যানভাসে নজর দিলো।
– ‘কিরে কথা বলবি না আমার সাথে।’
কন্ঠে গভীর আকুতি, রুহির হৃদয় যেকোনো সময়েই গলতে পারে। রুহি নিজেকে সামলে নিল, না কোনোভাবেই জয়ের সাথে নিজেকে দূর্বল দেখালে হবে না। তাই পেছন ফিরেই কিছুটা গম্ভীর কন্ঠে বলল,
– ‘কারোর পার্সোনাল রুমে আসতে গেলে যে পারমিশন নিতে হয় এতটুকু ম্যার্নাস নেই?’
জয় হাসল। রুহির কন্ঠে স্পস্ট অভিমান, এই অভিমান ভাঙাতে যে অনেক কাঠখ’ড় পো’ড়াতে হবে। জয় কি পারবে রুহির অভিমান ভা’ঙাতে নাকি ওই আ’গুনে নিজেও পু’ড়বে?
#চলবে…