আমার বড়মেয়েটা ছোটবেলা থেকে ভীষণ ইমোশনাল। অল্পতেই ভেউভেউ করে চোখের পানি নাকের পানি ঝরিয়ে সবার মাথা নষ্ট করে দেয়। ক্লাস সিক্সে পড়া মেয়েটা ছোট থেকেই বড় হয়েছে এই দেখে তার বাবা মায়ের পরীক্ষা আর পড়ালেখা। ওর জন্য সময় বরাদ্দ খুবই কম। খুব যে বিরক্ত করেছে তা কিন্তু না। ও নিয়মিত সাপোর্ট দেয়াতেই পড়াশোনা করাটা আমার জন্য অনেক বেশী সহজ ছিল।
সে যাই হোক ও যখন স্কুল শুরু করে সেটা ছিল একটা পাবলিক স্কুল। ওর আরো তিনজন বন্ধু ডেকেয়ার থেকে একসাথে একই স্কুলে আসে বলে মেয়ের মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়নি। বলা চলে আমার মাথাই ঘামাতে হয়নি। তারপর যখন নিজেদের প্রয়োজনে বাসার উল্টোপাশের প্রাইভেট স্কুলে নিয়ে আসি তখনই শুরু হয় বিড়ম্বনা। মেয়ের ব্যবহারে দিনে দিনে আসে পরিবর্তন। ঘটনা অনুসন্ধানে দেখা গেলো মেয়ে বন্ধু বানাতে পারছেনা। যার কারণে স্কুলে সারাক্ষণ সে মনমরা থাকে আর বাসায় এসে তার বহিঃপ্রকাশ হয় কান্নাকাটির মাধ্যমে। আমার নিজেরও মন ভেঙে যেতো যখন সে বলতো আমার সাথে আজও কেউ খেলেনি। আমি একা একা লাঞ্চ খেয়েছি। কি ভীষণ মন খারাপের একটা ব্যাপার। ওকে শুধু বোঝাতাম, মামনি তুমি এমন কিছুতে ভালো করো যেমন পড়াশোনা নয়তো খেলাধূলা যেন বাকীরা তোমার সাথে নিজে থেকে বন্ধু হতে চায়। আর বন্ধু তো নিজের যোগ্যতায় বানাতে হয় আমি কি বললে যে তোমার উপকার হবে তাই যে জানিনা। পড়াশোনায় ভালো করেও কাজ হয়নি তাতে। স্কুলে যখন টিচার কে জানালাম, কয়দিন খেয়াল রাখলো। অন্য বাচ্চাদের বললো ওর সাথে খেলতে। কিন্তু দেখা গেলো কয়েকদিন পর আবার যে কি সেই।
গতবছর অবশেষে সে একজন বান্ধবী পেলো। আমি খুশী যাক বাবা অন্তত বন্ধু সমস্যার সমাধান। কিন্তু কয়দিন পরেই আমি টের পেলাম তার বান্ধবীটি ভীষণ ডমিনেটিং। ও অন্য আর কারো সাথে ওকে মিশতে দিতোনা। এমনকি অন্য কেউ আমার মেয়ের সাথে খেলতে বা গল্প করতে এলে সে আমার মেয়েকে হাসির পাত্র করে কোন একটা কথা বলতো যে অন্যরা হেসে সরে যেতো। আমার মেয়েটা পুরো বছর ঐ বুলি করা বাচ্চাটার সাথে কোনরকমে মানিয়ে চলেছে। আমি বহুবার বলেছি আমি স্কুলে জানাই। ওর জবাব ছিল, মা তুমিতো রোজদিন স্কুলে যাবেনা। বেলাশেষে ওদের সাথেই তো আমার যেয়ে মিশতে হবে। আমি চেষ্টা করি।
এতো বড় ভূমিকা যে কারণে লেখা, আজ ওদের স্কুলে স্কুল রিপ্রেজেন্টিটিভ হওয়ার নির্বাচনী ফলাফল দিয়েছে। দু সপ্তাহ আগে ওরা যে যার নির্বাচনী স্পিচ দেয়। ক্লাসের ছাত্র ও শিক্ষকদের ভোটে জয় পরাজয় নির্ধারণ হয়। আমার মেয়েটা সেই ক্লাস ফোর থেকে এই পজিশনের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। কোনবারই জিততে পারেনি। আজও না। তবে যেটা ভালো লাগার ব্যাপার সেটা হচ্ছে সে শুধু এক পয়েন্টের জন্য দ্বিতীয় হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সাতজন। কাজ থেকে ফেরার পর ও যখন মন খারাপ করে আমাকে বলছিল ওর রেজাল্ট, তখন বলছিল, জানো মা আমার বন্ধুরা খুব মন খারাপ করেছে। ওদের সবার ধারনা ছিল আমি এবার জিতবোই।
মেয়েকে জড়িয়ে ধরি বলি, মা তুমি এস আর সি হওনি তাতে কি? যে বন্ধুগুলো তোমার অপ্রাপ্তিতে দুঃখ পেয়েছে, ভেবে দেখো গত কয়েকটা বছর তুমিই ওদের বন্ধু হওয়ার জন্য কতটা আক্ষেপ করেছো। গত তিন বছর হাল ছেড়ে না দিয়ে তুমি যে নিজের লক্ষ্য থেকে সরে যাওনি সেটাই তো আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় উপহার। তুমি জিততে পারোনি কারণ সেটা তোমার ভাগ্যে ছিলনা। তবে মানুষের ভালবাসা পাওয়ার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এই পৃথিবীতে আর কিছুই নেই মামনি। সেদিক থেকে যে আজকে তুমি জিতে গেলে।
আমার কথা শুনে মেয়ের মন খারাপ ভাব কাটার উপহার হিসেবে বিকেলের চা আজ ও বানিয়ে খাওয়ালো।
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস