আমার প্রেয়সী পর্ব-১৬+১৭

0
115

#আমার_প্রেয়সী
#পর্ব_১৬
#জান্নাত_সুলতানা

-“আর্শিয়ান পাগল হয়েছো?
নিজের দিকে তাকাও।”

আর্শিয়ান আকরাম তালুকদার এর কথায় তাকালো পর্যন্ত না ওনার দিকে।শিউলি বেগম এর দিকে তাকিয়ে আছে আর্শিয়ান। তিনি দৃষ্টি নত করে দাঁড়িয়ে।ভোর পাঁচ টা বাজে।বাড়িতে কেউ একফোঁটা ঘুমায় নি।আর্শিয়ান বাড়িতে থেকে বেরিয়ে যাওয়ার খবর টা খুব দ্রুত বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছিলো।আর সেই থেকে অপেক্ষা করে বসে ছিলো সবাই। আর্শিয়ান এই মিনিট পাঁচ এক সময় হবে ফিরেছে। গায়ের কালো রঙের শার্ট টা বৃষ্টিতে ভিজে আবার শুকিয়ে গিয়েছে। চুল গুলো এলোমেলো। চোখ জোড়া সারা রাত নিদ্রাহীন ছিলো সেটা দেখলে যে কেউ বলে দিতে পারবে।
শর্মিলা বেগম কেঁদেকেটে নাজেহাল অবস্থা করেছে নিজের।আর্শিয়ান মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
নিজের হাত টা এগিয়ে আর্শিয়ান মায়ের একটা হাত মুঠোয় পুরে নিলো।
শান্ত কণ্ঠে বললো,

-“আমার একদিনের ছন্নছাড়া এই অবস্থা তোমার সহ্য হচ্ছে না।আর বাকি দিন গুলো কি করে সহ্য করবে মা?”

শর্মিলা বেগম কথা বলতে পারলো না। ছেলে তার ভিষণ শখের।পালিয়ে বিয়ে করে সব হারিয়ে স্বামী কে আপন করে নিয়েছিলো।আর বছর ঘুরতে যখন আর্শিয়ান এলো তখন সব দুঃখ কষ্ট ভুলে গেলো।আজো ছেলের জন্য তিনি সব বিসর্জন দিতে পারবে।
কিন্তু ছেলের কষ্ট কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না।
আর্শিয়ান মায়ের ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে আবার বলে উঠলো,

-“আমি ওকে ভালবাসি মা।
জানি না কখন হয়েছে এই ঘৃণিত কাজ টা আমার দ্বারা। কিন্তু ভালবসায় তো কোনো অন্য নয়।ওকে ছাড়া আমার এই আঠারো ঘন্টায় আমার জীবন দূর্বিষহ লাগছে।আমি ওকে ছাড়া বাঁচবো নয় এমন টা নয়।বাঁচব কিন্তু শুধু আমার ভালো করে বাঁচা আর টা হবে না।”

শর্মিলা বেগম হু হু করে কান্না করতে লাগলো। ছেলের দুর্বলতা ওনার একদম সহ্য হচ্ছে না। ছেলে তার ভিষণ শক্ত ধাঁচের মানুষ।ছেলের দুর্বল কণ্ঠ শুনতে নারাজ তিনি।
কান্না থামালো একপর্যায়ে। ছেলের গালে হাত রেখে বললো,

-“আমার সব সহ্য হবে আব্বা।
তোমার কষ্ট নয়।”

আর্শিয়ান যা বোঝার বুঝে গেলো।তৎক্ষনাৎ মায়ের কপালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিয়ে আগের পোশাকে হনহনিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।

—-

গ্রামের পরিবেশ। আষাঢ় আগে আর কখনো থাকে নি গ্রামে। এসছে ঘুরতে। নানা নানি না থাকার ফলে সারা দিন থেকে সন্ধ্যায় ফিরে যেতো সবাই। এক তলা এই বাড়ি টা আষাঢ়’র কাছে দারুণ সুন্দর লাগে। কিন্তু রাতে বা কখনো এভাবে এসে এই বাড়িতে থাকার কথা সে চিন্তাও করে নি।ওর খালা ঘুমিয়ে আছে একই ঘরে একই বিছানায় রয়েছে ওরা তিনজন।কিন্তু আষাঢ়’র চোখে ঘুম নেই।বিছানা থেকে নেমে ফ্লোরে বসে আছে হাঁটুতে মুগ গুঁজে। সে আসতে চায় নি এখানে। কিন্তু মায়ের জোড়াজুড়িতে এসছে। সে চায় না তার জন্য পরিবার আলাদা হয়।কোনো ঝামেলা হয়।সে নিজেই তো আর্শিয়ান ভাই উসকেছে।আর্শিয়ান ভাইয়ের পেছনে ঘুরেছে। আর্শিয়ান ভাই তো আজো মুখে বলে নি ভালোবাসে।আষাঢ় নিজে কে নিজে এমনও হাজার কথা বলে শান্তনা দিচ্ছে। কিন্তু মন মানছেই না।বারবার মনে হচ্ছে আর্শিয়ান ভাই আসবে। আবার এটাও মনে গেঁথে আছে আর্শিয়ান ভাই তাকে একবার ছুঁয়েছে।সেই স্পর্শে ভালোবাসা অনুভব করেছে আষাঢ়। যদিও স্পর্শ টা একটু হিংস্র ছিলো।তবে ভালোবাসা ছিলো বেশি।যেন বহুদিনের তৃষ্ণা মিটেয়ে ছিলো মানুষ টা।ভালোবাসা না থাকলে এমন টা সম্ভব হতো না।
একটু আগে আজান পড়েছে। হয়তো খালামনি এখন উঠবে। আষাঢ় গুটিগুটি পায়ে তাই বিছানায় ওঠে শুয়ে পড়লো।
কিন্তু ঘুম কিছুতেই আসছে না।ভাবলো নামাজ টা পড়ে ঘুমবে।তাই ওজু করতে গেলো।ফ্রেশ হয়ে ওজু করে এসে দেখলো ওর খালা বসে আছে বিছানায়। আষাঢ় অতিরিক্ত কান্না করেছে।যার ফলস্বরূপ চোখ মুখ অসম্ভব ভার দেখা যাচ্ছে। আষাঢ়’র খালার মায়া হলো।আষাঢ় নিজে কে যথেষ্ট আড়াল করতে চাইলো।তবে পারলো না। ওর খালা এগিয়ে এসে আষাঢ়’র কে আলগোছে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত রাখলো।
মোলায়েম কণ্ঠে বলল,

-“ভরসা রাখ।আল্লাহ তার বান্দাকে কখনো নিরাশ করে নাহ।”

আষাঢ় কিছু বললো না। নামাজ পড়ে শুয়ে পড়লো।ওর খালা তখন নামাজে দাঁড়িয়ে হয়তো শেষ রাকাআত আদায় করছে।মোনাজাত নিয়ে ভদ্রমহিলা জায়নামাজ গুছিয়ে রাখতেই গেইটে শব্দ হলো।কেঁচি গেইট বাড়িতে।তাতে আবার তালা মারা।তালা ধরে শব্দ করছে কেউ।টাশ টাশ শব্দে পুরো বাড়ির জেগে উঠলো।আষাঢ় শোয়া থেকে ওঠে বসে গেলো।ওর সাথে ছোট খালা তো বোন মিলিও ওঠে চোখ ডলে।ঘুমঘুম কণ্ঠে আষাঢ় কে জিগ্যেস করলো,

-“সকাল হয়েছে আপাই?”

-“হুঁ।”

আষাঢ় ছোট করে জবাব দিলো। কণ্ঠ টা বড্ড ভারি শোনালো।মিলি চিন্তিত হলো।বয়স মোটামুটি হয়েছে। ভালো খারাপ বোঝার মতো কিছু টা জ্ঞান হয়েছে।গ্রামের বাড়ি খারাপ কেউ এলো না তো আবার।মা ও কেমন থম মে’রে দাঁড়িয়ে আছে।মনে হচ্ছে ভয়, চিন্তায় বর্তমান অবস্থা ভুলে বসেছে। মিলি মায়ের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ফের আষাঢ়’র দিকে তাকালো।
বললো,

-“অন্ধকার মনে হচ্ছে বাহিরে।
এতো সকালে কে এলো?”

-“জানি না।”

আষাঢ় সোজাসাপটা জবাব।তবে ভেতর টা কেমন করছে। বারবার মনে হচ্ছে আর্শিয়ান ভাই এসছে।কিন্তু কিভাবে সম্ভব হবে এটা?তারা কোথায় আছে এটা তো কেউ জানে না।সিলেট যাওয়ার কথা থাকলে ওর মা আর খালা মিলে এখানে আসার জন্য বললো।তবে কে এলো এতো সকালে?
গেইট খোলারও সাহস পাচ্ছে না। আষাঢ়’র খালা যথেষ্ট রাগী মানুষ। আষাঢ় ওনাকে ডিঙ্গিয়ে গেইট খোলার মতো দুঃসাহসিকতা দেখাতে পারবে না।
তাই থম মেরে বসে রইলো।এভাবে কেটে গেলো কয়েক মিনিট।গেইটে কড়া নাড়ার শব্দ তীব্র হচ্ছে।
আষাঢ়’র খালা ধীরে পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। পেছন পেছন আষাঢ় মিলি এলো।দরজা খুলে বারান্দায় পেরিয়ে গেইটে আর্শিয়ান কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সবাই থমকালো।আষাঢ়’র চোখ দিয়ে আপনা-আপনি জল গড়িয়ে পড়ছে।
ওর খালা গেইট খুলতেই আর্শিয়ান কোনো দিকে তাকালো না।সোজা এসে আষাঢ় কে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।বাইরে তিন টা ছেলেও আছে। বয়স অল্প দেখে বোঝা যাচ্ছে।এরা প্রায় আর্শিয়ান এর সাথে থাকে।আষাঢ় জানে।তবে এখন কোনো দিকে ধ্যান নেই ওর।শুধু অনুভব করছে জড়িয়ে রাখা মানুষ টার হৃৎস্পন্দন।কত দ্রুত ছুটছে সেটা।আষাঢ়’র মনে হলে এই বুঝি এটা বেরিয়ে আসবে।
আর্শিয়ান টপাটপ ক’টা চুমু খেলো আষাঢ়’র মাথায়। এখানে ক্ষান্ত হলো না।মুখে চোখে অজস্র চুমু খেলো।আষাঢ় লজ্জা পাচ্ছে। খালা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাহিরে ছেলে গুলো দৃষ্টি নত।আর্শিয়ান থামলো।এক হাত শক্ত করে ধরে খালার সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,

-“আপনি সব গুছিয়ে নিয়ে গাড়িতে আসুন।আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।”

-“আর্শিয়ান,,,

-“আমি জানি আপনার দোষ নেই।চাপ নিবেন না।আমি আপনাকে দোষ দেবো না।”

আর্শিয়ান আষাঢ় কে নিয়ে বেরিয়ে এলো।
ছেলে গুলো কে উদ্দেশ্য করে আদেশ করলো,

-“খালামনি কে নিয়ে আসবি।”

ছেলে গুলো মাথা নাড়ালো।আর্শিয়ান আষাঢ়’র হাতে হাত রেখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।বাড়ির সামনে পিচ ঢালা রাস্তা। একপাশে দু’টো গাড়ি।একটা আর্শিয়ান এর।আরেক টা কার আসার চিনে না।হয়তো আর্শিয়ান ভাই ভাড়া এনেছে।
গাড়িতে বসে আর্শিয়ান একবার তাকালো না আষাঢ় এর দিকে।
চুপচাপ নীরবতা চললো অনেক সময়। আষাঢ় হঠাৎ বলে উঠলো,

-“আপনি কি করে জানলেন আমরা এখানে?
আম্মা মারবে আমায়।”

-“নাহ।
আমি থাকবো সাথে।”

-“যদি না মানে?”

-“থাকতে পারবি না আমার মায়ের সাথে? ”

-“বড়ো মা মানবে না।”

-“মেনেছে।”

আষাঢ় থমকালো।বিস্ময় কথা বলতে ভুলে গেলো।গম্ভীর আর্শিয়ান আর কিছু বললো না।

——-

আর্শিয়ান আষাঢ় দাঁড়িয়ে আছে লিভিং রুমে।
কেউ কিছু বলছে না।সবাই চুপচাপ। অবশ্য এতোক্ষণ চুপচাপ ছিলো না।মাত্রই আর্শিয়ান এর গম্ভীর কথায় সবাই নীরবতা পালন করছে।নিশ্চয়ই মনে মনে ভাবছে সবাই এই গম্ভীর থেকে আর্শিয়ান হঠাৎ পাগল কি করে হয়ে গেলো।তবে তাতে আর্শিয়ান এর কিচ্ছু আসে যায় না।সে যা বলেছে সেটাই হবে।
আর কিচ্ছু শুনতে নারাজ সে।অনেক বুঝিয়েও কোনো লাভ হলো না।বরং আকরাম তালুকদার এর কথায় সবাই বিস্ময় নিয়ে চুপসে আছে।
আর্শিয়ান তাসফিয়া কে ইশারা করে আষাঢ় কে নিতে বললো।আয়াত সহ তাসফিয়া ওকে নিয়ে দোতলায় চলে গেলো।শর্মিলা বেগম এগিয়ে এলো ছেলের নিকট।
বিচলিত কণ্ঠে বলে উঠলো,

-“আব্বা বিয়েতে পড়বে টা কি আষাঢ়?”

-“তোমার শাড়ী আছে না একটা বিয়ের?ওটা পড়িয়ে দাও।”

আর্শিয়ান সোজাসাপটা বলে দিলো।শর্মিলা বেগম চিন্তিত হলেন।একবার ওটা আয়াত আষাঢ় তাসফিয়া কে দেখিয়ে ছিলো।তখন সব গুলো কেমন করে যেন তাকিয়ে ছিলো।শর্মিলা বেগম লজ্জা পেয়েছিল।ভেবেছে হয়তো মডেল পুরোনো তাই ওরা হয়তো কিছু বলে নি।
ওনি মলিন স্বরে বললো,

-“কিন্তু অনেক পুরোনো ওটা।আগের ডিজাইন। আষাঢ়’র পছন্দ হবে না।”

-“ওর স্বপ্ন।
তোমার ওই শাড়ি নিয়ে।”

আর্শিয়ান দাঁড়ালো না নিজের বক্তব্য শেষ করে।উপ-রে রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। তবে যাওয়ার আগে তাগাদা দিতে ভুলে না।কাজি চলে আসবে যা করার দ্রুত করতে।
কিন্তু শর্মিলা বেগম তখন ঘোরে আছে। কি বলে গেলো আর্শিয়ান বুঝতে সময় লাগলো।বুঝতে পেরে মুচকি হেঁসে বলে উঠলো,

-“আমি তোকে আমার মন মতো করে গড়ে নেবো।আমার সব কল্পনা তোকে দিয়ে পূর্ণ করবো।”

——

লাল টকটকে একটা বেশ পুরোনো ডিজাইন এর জামদানী শাড়ি। মাথায় ফিনফিনে পাতলা একটা দোপাট্টা। সেটাও লাল।ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। চোখে কাজল নাকে জ্বলজ্বল করছে ছোট একটা নাক ফুল।মাঝে সিঁথি করে একটা টিকলি।ছোট গোলগাল মুখ খানা কি দারুণ লাগছে।এই অল্প সাজে আর্শিয়ান এর চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আর্শিয়ান এর ঘোর লেগে গেলো।দৃষ্টি সংবরণ করলো সে।
বিয়ে পড়ানো শুরু হয়েছে। আষাঢ় কাঁপছে মৃদু। কাল দুপুর থেকে সে পানি ব্যতিত আর কিছু খায় নি।পেটও জ্বলছে। অতিরিক্ত চিন্তায় অস্থিরতায় মাথা ঘুরছে।কবুল টা সে কোনো রকম কাঁপা কাঁপা অধর নেড়ে বললো।তবে বলার পর আর বসে থাকতে পারলো না। সোফায় আর্শিয়ান এর পাশে বসে আছে আষাঢ়। আষাঢ় এর দেহটা হেলে পড়তেই আর্শিয়ান দ্রুত হাতে আগলে ধরলো নিজের সাথে।
সবাই বিস্ময় কিছু বলতে ভুলে গেলো।একঘর মানুষের মাঝে এমন দৃশ্য বড়োই নজরে এলো সবার।তবে আর্শিয়ান সে-সব তোয়াক্কা করে না।সবাই কে আরো একধাপ চমকে দিয়ে ঝটপট কোলে তুলে বউ কে।কোনো দিকে না তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো।সবাই অবাক সেই সাথে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। আকরাম তালুকদার অবশ্য চশমা ঠেলে চোখ দিলো।বিড়বিড় করে স্ত্রী কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

-“ছেলে টা এতো নির্লজ্জ কবে থেকে হলো বলো তো মিলা?”

#চলবে…..

#আমার_প্রেয়সী
#পর্ব_১৭
#জান্নাত_সুলতানা

-“আর্শিয়ান ভাই?”

আষাঢ় নিচু স্বরে ডাকলো।আর্শিয়ান ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে সোফায়। গায়ে একটা নীল রঙের টি-শার্ট আর ট্রাউজার। খুব সিরিয়াস মুডে ছিলো সে। কিন্তু আষাঢ় এর কণ্ঠ ভাই ডাক শোনে ভ্রু কুঁচকে এলো।
বিয়ে করেছে সে। এটা কি সত্যি? মনে হচ্ছে না। বউ কেনো তাকে ভাই ডাকবে? বউ হচ্ছে আদরের জিনিস। ভালোবাসার জিনিস। বউ তো স্বামী কে আদরে করবে। কত কিছু বলে আদরে করে ডাকবে।তা না করে বউ কেনো তাকে ভাই ডাকবে?হোয়াই? আর্শিয়ান ভ্রু জোড়া কুঁচকে রেখেই ল্যাপটপ এর দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে গম্ভীর স্বরে জবাব দিলো,

-“হুঁ।”

আষাঢ় বিছানা ছাড়ে। গতকাল দুপুরেও হয়তো ভাবে নি গতকালের সময় সময়ে আজ আর্শিয়ান ভাই এর বউ হবে সে। ভালবাসার মানুষ টাকে নিজের করে পাওয়ার মতো সুন্দর অনুভূতি আর কি হতে পারে? পা জোড়া টেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো।দাঁড়ালো আর্শিয়ান এর ঠিক বরাবর। আর্শিয়ান বউয়ের উপস্থিতি টের পেয়ে একপলক তাকালো বউয়ের মুখের দিকে। গায়ে এখনো বিয়ের সেই শাড়ী। চুল গুলো হাত খোঁপা করা। ওষ্ঠে এখনো সেই লাল টকটকে লিপস্টিক। কিছু চুল এলোমেলো। চোয়াল বেয়ে সামনে গলা পর্যন্ত এসেছে।
আষাঢ় আর্শিয়ান এর দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে ছিলো।তবে আর্শিয়ান কে এভাবে তাকাতে দেখে লজ্জা পেলো সামন্য। কিন্তু দৃষ্টি ঘোরালো না। নিজেও তাকিয়ে রইলো তামাটে বর্ণে পুরুষ আর্শিয়ান ভাই এর দিকে।আহ,আষাঢ়’র মনে হচ্ছে সব কল্পনা। সব স্বপ্ন। ভালোবাসা কি বোঝার পর থেকে স্বপ্ন দেখে আসছে সে আর্শিয়ান ভাই এর বউ হবে। যে ঘরে আর্শিয়ান ভাই তাকে ঢুকতে নিষেধ করেছে সেই মানুষ টার ঘর সহ মানুষ টার উপর খবরদারি করবে। অধিকার ফলাবে।
আষাঢ় অস্থির হলো হঠাৎ। মনে হলো এই অস্থিরতা সে যা ভেবেছে তা না করতে পারলে ঠিক হওয়ার নয়।তাই কালবিলম্ব করে না।
মাথা নিচু মিনমিন করে আবদার করলো,

-“একটু জড়িয়ে ধরবো আর্শিয়ান ভাই!”

কি বলে এই মেয়ে? কিছু সময় আগেও কোলে উঠেছে। আর এখন কি-না ভয় পাচ্ছে! অনুমতি চাচ্ছে? আর্শিয়ান গম্ভীর।
মতিগতি বোঝার উপায় নেই। আষাঢ় ভাবলো আর্শিয়ান ভাই তাহলে সত্যি তাকে ভালোবাসে না!ভালোবাসলে বুঝি এভাবে বসে থাকতে পারতো?আষাঢ়’র মনঃক্ষুণ্ন হলো।মানুষ টা বড্ড আনরোমান্টিক।এমন হলে ভবিষ্যত প্রজন্ম কি করে ডাউনলোড হবে?
আষাঢ়’র আঙ্গুলে শাড়ির কোণ পেঁচাতে পেঁচাতে কথা গুলো ভাবছিল। ঠিক তক্ষুণি হাতে শক্ত পোক্ত একটা হাতের আভাস পেলো। কিছু বোঝে উঠার আগেই আর্শিয়ান হেঁচকা টানে আষাঢ় কে নিজের একটা উরুর উপর বসিয়ে নিলো।আষাঢ় চমকাল।শরীর জুড়ে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো। নিজে কে সামলে আর্শিয়ান এর গলায় জড়িয়ে ধরলো।অধর কোণে লাজুক হাসি ফুটলো।ভয় লজ্জা সংকোচ সব ঠেলে আর্শিয়ান কে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে দিলো।
আর্শিয়ান শক্ত হাতে বউয়ের পেট চেপে ধরে। নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।
একদম তুলার বস্তা একটা। নরম তুলতুলে দেহটা এই শক্ত পোক্ত, বলিষ্ঠ তাগড়া পুরুষ টাকে কি করে সামলাতে পারবে?
আষাঢ় আর্শিয়ান এর মাঝে বয়সের গ্যাপ টা গুণে গুণে এগারো বছরের। আর্শিয়ান এর তুলনায় আষাঢ় বাচ্চা একটা মেয়ে। আর এই বাচ্চা মেয়ে টা কি করে এতো বড়ো একটা মানুষের মন টা ছিনিয়ে নিলো! আর্শিয়ান টের ও পেলো না। আর্শিয়ান লম্বা নিঃশ্বাস টানে।মাতাল করা এক ঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে পৌঁছালো গিয়ে।
আর্শিয়ান মানুষ টা গম্ভীর। আর এই গম্ভীর পুরুষ টার প্রেমে আষাঢ় পড়লো। অবশ্য আষাঢ় বাদেও তো অনেকে আর্শিয়ান ভাই এর প্রেমে পড়েছে।কিন্তু পুরুষ টার গম্ভীর স্বভাবের আর রাগের জন্য কেউ সেটা সামনে দাঁড়িয়ে প্রকাশ করার সাহস পায় নি।

এখন বিকেল।বিয়ের পরপরই আষাঢ় জ্ঞান হারানোর পর আর্শিয়ান ওকে নিজের রুমেই এনেছে। এরপর আর কেউ বের হয় নি রুম থেকে। আষাঢ় এর জ্ঞান ফিরেছিলো আধঘন্টা হতেই। শর্মিলা বেগম খবর পাওয়া মাত্র ছেলে আর ছেলের বউয়ের খাবার রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে।
যদিও এরপর এসে দু’বার আষাঢ় কে দেখে গিয়েছে। সবাই দেখে গিয়েছে। শুধু শিউলি বেগম আসে নি। আষাঢ়’র মন এতে অনেক টা খারাপ হয়েছে। মা কেনো একটু এলো না?

-“ছাড়।”

হঠাৎ আর্শিয়ান এর কণ্ঠ কানে পৌঁছাতেই আষাঢ় ভাবনা ছেদ ঘটে।অবস্থান কোথায় বুঝতে কিঞ্চিৎ সময় লাগলো।তবে বুঝতে পেরে আর অপেক্ষা করে না।দ্রুত আর্শিয়ান কে ছেড়ে উঠতে গেলেই আর্শিয়ান বাঁধা দিলো।দুই হাত কোমরে রেখে চাপ প্রয়োগ করে। আষাঢ় কেঁপে উঠে।
আর্শিয়ান বললো,

-“এখন রুমে যাবি।
আমি বাহিরে যাচ্ছি। ফিরে এসে নিয়ে আসবো।”

আষাঢ় টুঁশব্দ করলো না। আর্শিয়ান ভাই মানে তার কোনো প্রশ্ন নেই। কোনো চিন্তা নেই। তাই বিনাবাক্যে রুম ত্যাগ করে।

—–

রাতের খাবার খেতে যাওয়ার জন্য তাসফিয়া এসে আষাঢ় কে নিয়ে গেলো।আষাঢ় ডাইনিং টেবিলে এসে আর্শিয়ান এর দেখা পেলো।বসে আছে খাবার নিয়ে।আষাঢ় বুঝতে পারছে না এখন এক সাথে বসা কি ঠিক হবে? কি মনে করবে সবাই? নতুন বউ সে।তারউপর বাড়ির বড়ো বউ।
আষাঢ় দাঁড়িয়ে ছিলো এক পাশে শিউলি বেগম সাঈদ কে তখন খাবার দিচ্ছে। শর্মিলা বেগম আষাঢ় কে দাঁড়িয়ে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। পরক্ষণেই বুঝতে পারলো মেয়ে টা দ্বিধায় ভুগছে।তিনি নিজে থেকে এগিয়ে এলো।আষাঢ় কে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?
বোস।”

-“আমি পর,,,

-“নাহ এক্ষুণি বোস।”

জোর করে বসালো আষাঢ় কে।আষাঢ় আর বাড়াবাড়ি করে না।
বসে পড়ে আর্শিয়ান এর পাশের চেয়ার টায়।
আর্শিয়ান আঁড়চোখে তাকালো একবার।
আপন মানুষ। পরিচিত মুখ। জন্মের পর থেকে তাদের সাথে বাস। বুঝ হওয়ার পর থেকে সব সময় এক সাথে খাবার খাওয়া। খেলাধুলা, হাঁটাচলা। সব কিছু এই সামনে পেছনে আশেপাশে থাকা মানুষ গুলো কে ঘিরে। অথচ আজ তাদের সাথে একই টেবিলে খাবার খেতে বসে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। আষাঢ় মাথা নিচু করে খাবার মুখে নিচ্ছে। বাম হাত টা কোলের উপর রাখা।
তবে হঠাৎ অনুভব করলো সেটা একটা দানবীয় হাত মুঠোয় পুরে নিয়েছে।
আষাঢ় চমকালো।অবাক হলো।পাশে আর্শিয়ান এর দিকে তাকাতেই দেখলো আর্শিয়ান খাবার খাচ্ছে। দৃষ্টি তার প্লেটের দিকে।আর সেভাবে থেকেই আদেশের স্বরে বললো,

-“ফিনিশ।
একটা ভাত প্লেটে থাকলে সারা রাত বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখবো।”

চাপা স্বরে হুমকি আষাঢ়’র অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। মানুষ টা বড্ড খারাপ। একটু দয়ামায়া নেই মনে। এভাবে কেনো বলছে? লোক টা কি বুঝতে পারছে না আষাঢ় খেতে পারছে না। আষাঢ় মুখ ভোঁতা করে খাবার খেতে লাগলো বাধ্য হয়ে।

——

খাবার শেষ লিভিং রুমে বসেছে সবাই। আষাঢ় নেই।আয়াত তাসফিয়া ওকে নিয়ে অনেক আগেই উপরে চলে গিয়েছে।
এখন বড়রা বসে আছে। আকরাম তালুকদার ছেলের মতিগতি অবলোকন করেছে। ছেলের পাগলামো না মেয়ে টার জীবনে এখানে থমকে থাকে।হঠাৎ তিনি আর্শিয়ান কে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“দেখো আর্শিয়ান কথা টা বলা আমার কত টা ঠিক হবে আমি জানি না।তবে এটা বলা জরুরি। আষাঢ় বাচ্চা মেয়ে। আঠারো বছর হয় নি এখনো। ওর রুমে থাক,,,

-“ওহ বাবা প্লিজ।
আমার বউ?আমার তো তবে আমাকে বুঝতে দাও। আষাঢ় আমার রুমে থাকবে।”

আকরাম তালুকদার নিজেই লজ্জা চোখ নিচু করে নিলো। কি বলবে? শুধু শুধু এতো মানুষের ভীড়ে সম্মান হারানোর মানে হয় না।আর্শিয়ান বসে না আর সেখানে। ফোন পকেটে পুরে লম্বা লম্বা কদম ফেলে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে চলে এলো। বউ নিশ্চয়ই তারজন্য অপেক্ষা করছে।

আষাঢ় এখনো বিয়ের শাড়ী পড়া। মাথায় দোপাট্টা টা আবার দিয়েছে। সাজিয়েছে ওকে তাসফিয়া আয়াত।
বুকে টিপটিপ করছে। কাঙ্খিত মানুষ টা কখন আসবে সেই অপেক্ষার প্রহর গুনছে। আষাঢ় এর বিয়ে নিয়ে কত কল্পনা জল্পনা ছিলো। কিন্তু সে-সব কিচ্ছু হলো না। মন টা খারাপ হতে গিয়েও হয় না। যাকে স্বামী রূপে চেয়ে এসছে তাকেই পেয়েছে এই আনন্দের নিকট সব খারাপ লাগা তুচ্ছ।
দরজা খোলার কোনো শব্দ হলো না। আর্শিয়ান দক্ষ হাতে দরজা খুলে কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে। দরজা বন্ধ করে গম্ভীর মানুষ টা গম্ভীর ভাব নিয়ে এগিয়ে গেলো বিছানার সামনে। গিয়ে দাঁড়াতেই আষাঢ়’র টনক নড়ে। দ্রুত পায়ে বিছানা ছেড়ে সংকোচ নিয়ে সালাম দিলো আর্শিয়ান কে।তাসফিয়া বলেছে আর্শিয়ান রুমে এলেই যেন সালাম দেয়।জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করবে।সেটা সম্পূর্ণ ভালোবাসা দিয়ে যেনো শুরু করে।
আর্শিয়ান সালাম এর উত্তর করলো।
আষাঢ় দাঁড়িয়ে রইলো। আর্শিয়ান টেনে নিলো আষাঢ় কে।নিজের সাথে একদম মিশিয়ে নিলো এক ইঞ্চি ফারাক রাখলো না।আষাঢ় সমস্ত শরীর কেঁপে উঠে। সাপের ন্যায় মোচড়ামুচড়ি করলো। ভালোবাসার মানুষ টার গভীর স্পর্শ। এতো টা কাছ থেকে আষাঢ় ভেতর থেকে এলোমেলো হলো।
আর্শিয়ান দেখলো।সবটাই সে পর্যবেক্ষণ করলো।
নেশাময় দৃষ্টি পুরুষ টার।আষাঢ় আস্তে করে ঢুক গিলে। আর্শিয়ান বউয়ের অধরের উপর বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলো।আষাঢ় আবারও নড়েচড়ে উঠতেই আর্শিয়ান অধর বাঁকিয়ে হাসলো।বললো,

-“ব্যাস! এটুকু এতেই সহ্য হচ্ছে না।
পুরো আমি টা কে কি করে সহ্য করবি?”

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে